১৩. পঁচিশে মার্চ দুপুর থেকে

পঁচিশে মার্চ দুপুর থেকেই সবার ধারণা হলো কিছু একটা হয়েছে। হয়তে ইয়াহিয়া ঠিক করে ফেলেছে এ দেশের মানুষদের কোনো কথা শোনা হবে না। চারদিক থমথম করতে লাগল। খোকনের বড়চাচা দুপুর একটায় অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে ঘরে কিরলেন। ফিরেই বললেন, আজ যেন কেউ ঘর থেকে না বের না হয়। সবাই যেন ঘরে থাকে। কবীর কোথায়, কবীরকে ডাকো।

কবীরকে কোথাও পাওয়া গেল না। বড়চাচা থমথমে গলায় বললেন, ও কোথায় গিয়েছে?

কেউ জবাব দিতে পারল না।

খোকনকে ডাকো।

খোকন নিচে এমে এল। বড়চাচা বললেন, কবীর কোথায় জানো?

জি-না।

 তুমি আজ ঘর থেকে বেরুবে না।

কেন চাচা?

শহরের অবস্থা ভালো না। শহরে মিলিটারি নামবে এরকম একটা গুজব শোনা যাচ্ছে।

খোকন কিছু বুঝতে পারল না। মিলিটারি তো নেমেই আছে। নতুন করে নামবে কী! বড়চাচা বললেন, তোমার ওই বন্ধুটি, সাজ্জাদ যার নাম, ও কোথায় আছে?

ও আছে দাদুমণির বাসায়।

কার বাসায়।

একজন বুড়ো ভদ্রলোকের বাসায়। ওনাকে আমরা দাদুমণি ডাকি।

করেন কী উনি।

আমি জানি না চাচা।

তাঁর বাসায় আমাকে একদিন নিয়ে যাবে। আমি ওই ছেলেটির জন্যে কিছু করতে চাই।

জি আচ্ছ, আমি নিয়ে যাব।

এখন যাও দারোয়ানকে ডেকে নিয়ে এসো।

দারোয়ান আসামাত্র বড়চাচা বললেন, কবীর যখন ফিরবে তাকে ঢুকতে দেবে না। বলবে এ বাড়িতে তার জায়গা নেই। সে যেন তার নিজের পথ দেখে নেয়। বুঝলে?

আমিন চাচা সন্ধ্যাবেলা মুখ কালো করে ঘরে ফিরলেন। চা খেতে খেতে বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান যে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন সেটা বাতিল হয়ে গেছে। ব্যাপার কী কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

খোকনরা যখন ফার্স্টব্যাচে খেতে বসেছে তখন দারোয়ান এসে খবর দিল কবীর ভাই এসেছে, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বড়চাচা বললেন, তুমি এই খবরটি আমাকে দিতে এসেছ কেন? তোমাকে বলে দিয়েছি না ওকে ঢুকতে দেবে না। যাও, যা বলেছি।

তাই করো।

বড়চাচি বললেন, সে কোথায় থাকবে রাতে?

যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকবে। এ বাড়িতে না।

তুমি এটা ঠিক করছ না।

আমি যা করছি ঠিকই করছি।

না, ঠিক করছ না।

ওপর থেকে খোকনের বাবা নেমে এলেন। তিনি অত্যন্ত শান্তগলায় বললেন, ভাইয়া, ছেলেটাকে ঘরে আসতে দেন।

যে ছেলে আমার কথা শোনে না সে আমার বাড়িতে থাকবে না।

আমরা বড় মাঝে মাঝে ভুল কথা বলি। সেসব কথা সবসময় মানা যায় না।

আমি ভুল কথা বলি।

না, আপনি ভুল কথা কম বলেন। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে ভুল করছেন। সবাইকে মূল আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। এটা ঠিক না।

বড়চাচা তাকিয়ে রইলেন। খোকনের বাবা শান্তস্বরে বললেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় একসময় এসব বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদেরই বন্দুক হাতে তুলে নিতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার ছেলেমেয়েরা পরাধীন হয়ে থাক। চান? বলুন, আপনি চান?

না, চাই না।

তাহলে এমন করছেন কেন?

বড়চাচা ক্লান্তস্বরে বললেন, ওকে ভেতরে আসতে বলে। যাও, বলো ভেতরে আসতে।

দারোয়ান ছুটে গেল। কিন্তু গেটের বাইরে কাউকে পাওয়া গেল না। আমিন চাচা তক্ষুনি খুঁজেতে বের হলেন। বড়চাচি কাঁদতে শুরু করলেন।

খোকন অনেক রাতপর্যন্ত জেগে রইল। যদি কবীর ভাই ফিরে আসেন। আমিন চাচা ফিরলেন দশটায়। কবীর ভাইকে কোথাও পাননি। তার মুখের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তিনি ভীষণ চিন্তিত।

.

গভীর রাতে খোকনকে ডেকে তোলা হলো। বাবা এসে খুব নরম গলায় বললেন, খোকন, তোমার মার শরীর খুব খারাপ, এসো, মায়ের পাশে বসো।

মায়ের ঘরে সবাই আছেন। বড়চাচা মাথা নিচু করে বসে আছেন একটি ছোট চেয়ারে। বড়চাচী মার হাত ধরে কাঁদছেন। মায়ের মুখ নীল বর্ণ। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। বারবার কেঁপে উঠছেন। নার্সটি বলল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। এক্ষুনি হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কিন্তু সবাই এমন ভাব করছে যেন তার কথা কে ওনেতে পাচ্ছে না। খোকন অবাক হয়ে তাকাল বাবার মুখের দিকে। কেন, হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে না কেন? বাবা শান্তস্বরে বললেন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা আক্রমণ করেছে খোকন। রাস্তায় মিলিটারি ছাড়া আর কিছু নেই। আজ রাতে কাউকে  যাবে না। আজ রাতে কিছুই করার নেই।

খোকন নিজেও শুনতে পেল প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। ট্যাংক নেমে গেছে। বড়চাচা মদুস্বরে কী যেন বললেন। কেউ শুনতে পেল না। নার্স আবার বলল,  ডাক্তার দরকার। সবাই চুপ করে রইল।

বাবা বললেন, খোকন, মায়ের পাশে গিয়ে দাড়াও।

হলো একটি অন্ধকার দীর্ঘ রাত। মানুষের সঙ্গে পশুদের একটা বড় পার্থক্য আছে। তারা কখনো মানুষদের মতো হৃদয়হীন হতে পারে না। পঁচিশে মার্চের রাতে হৃদয়হীন একদল পাকিস্তানি মিলিটারি এ শহর দখল করে নিল।

তারা উড়িয়ে দিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের প্রতিটি ছাত্রকে গুলি করে মারল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে হত্যা করল শিক্ষকদের। বস্তিতে ঘুমিয়ে থাকা অসহায় মানুষদের গুলি করে মেরে ফেলল বিনা দ্বিধায়। বাঙালিদের বেঁচে থাকা না-থাকা কোনো ব্যাপার নয়। এরা কুকুরের মতো প্রাণী, এদের মৃত্যুতে কিছুই যায় আসে না। এদের সংখ্যায় যত কমিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এদের মেরে ফেলো। এদের শেষ করে দাও।

এক রাতে এ শহর মৃতের শহর হয়ে গেল। অসংখ্য বাবা তাদের ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে গেল না। অসংখ্য শিশু জানল না বড় হয়ে ওঠা কাকে বলে। বেঁচে থাকার মানে কী?

শহরের জনশূন্য পথে দৈত্যাকৃতি ট্রাক চলল। ধ্বংস ও মৃত্যু। স্বজনহারা মানুষদের কান্নার সঙ্গে ঠাঠা শব্দে গর্জাতে লাগল মেশিনগান। জেনারেল টিক্কা খান বাঙালির মরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। যেন এরা দ্বিতীয়বার আর পাকিস্তানিদের মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা না পায়।

পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তানের জনদরদী ভুট্টো চলে গেল পাকিস্তানে। সে হাউল্লসিত। প্লেনে ওঠার আগে হাসিমুখে বলে গেল, যাক শেষপর্যন্ত শক্রদের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেল।

ছাব্বিশে মার্চের সমস্ত দিন কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারল না। শহরে কার্ফু। ঘরে বসে শুধুই প্রতীক্ষা। এর মধ্যেই আবার অবাঙালিরা যোগ দিল মিলিটারিদের সঙ্গে। বলে দিতে লাগল–কাদের কাদের শেষ করে দিতে হবে। চারদিকে মৃত্যু আর মৃত্যু।

ছাব্বিশ তারিখ ভোর এগারোটায় ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রচারিত হলো।

… শেখ মুজিবকে বিনা বিচারে আমি ছেড়ে দেব না। আওয়ামী লীগ দেশের শত্রু। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমার দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে। এবারও তাদের পূর্বসুনাম অক্ষুণ্ণ থাকবে…

দেশের লোক হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কী হচ্ছে এসব? কী হচ্ছে ঢাকা শহরে? কিছুই জানার উপায় নেই। ঢাকা বেতার থেকে অনবরত হামদ ও নাতে রসূল প্রচারিত হচ্ছে।

পাশের দেশ ভারত। সেখানকার বেতারেও কোনো খবর নেই। এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেছে, তারা কি কিছুই জানে না। কলকাতা বেতার থেকে দুপুরবেলা হঠাৎ করে গীতালি অনুষ্ঠান বন্ধ করে বলা হলো–

পূর্ববাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্বপাকিস্তান রাইফেলস, পূর্ববাংলা রেজিমেন্ট, পূর্বপাকিস্তান পুলিশ, পূর্বপাকিস্তান আনসারস, পূর্বপাকিস্তান মুজাহিদ দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র বাজানো হলো সেই বিখ্যাত গান–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। এই দেশে শুরু হলো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবনযাত্রা।

ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে মৃতদেহ পড়ে রইল। সরাবার লোক নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *