১৩. নিশানাথবাবু দোতলায় উঠে এসে

রাত দশটা।

নিশানাথবাবু দোতলায় উঠে এসে অপালার দরজায় ধাক্কা দিলেন।

মা, একটু দরজা খুলবে?

অপালা দরজা খুলল। তার চোখ লাল। দৃষ্টি এলোমেলো। নিশানাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন, কী হয়েছে?

কই, কিছু হয়নি তো। কী হবে?

আজ তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

ম্যানেজার কাকু, আজ আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। আপনি এখন যান। আপনার পায়ে পড়ি।

নিশানাথবাবু আবার নিচে নেমে গেলেন। সেই রাতে তিনি আর বাড়ি ফিরলেন না। একতলার গোস্টরুমে রাত কাটালেন।

ফখরুদিন সাহেব গভীর রাতে টেলিফোন করলেন। গভীর রাতের টেলিফোন গলা অন্যরকম শোনা যায়। চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়। অপালা বলল, আপনি কে?

ফখরুদিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কী আমাকে চিনতে পারছি না, মা?

ও, বাবা তুমি?

হ্যাঁ, আমি! তোমার কী হয়েছে?

কই, কিছু হয়নি তো!

মা, সত্যি করে বল তো।

সত্যি বলছি, আমার কিছু হয়নি, শুধু…

শুধু কী?

আমার খুব একা-এক লাগছে বাবা।

ফখরুদিন সাহেব টেলিফোনেই কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তাঁর অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল।

মা, তুমি কী কাঁদছ?

হ্যাঁ, কাঁদছি। আর কোদব না।

কিছু একটা তোমার হয়েছে। সেটা কী?

অপালা চুপ করে রইল। ফখরুদিন সাহেব বললেন, আমাকে বলতে কী তোমার কোনো বাধা আছে?

বলার মত কিছু হয়নি বাবা।

কোনো ছেলের সঙ্গে কী তোমার ভাব হয়েছে? নিশানাথ বলছিল আর্টিস্ট একটা ছেলে নাকি আসে প্রাযই। তুমি কী আজ তার কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, গিযেছিলাম।

সে কী এমন কিছু বলেছে, যাতে তোমার মন খারাপ হয়েছে?

না।

এই ছেলেটিকে তোমার কী পছন্দ হয়? যদি হয় আমাকে বল। তুমি যা চাইবে তাই হবে। যা হওয়ার নয়, তাও আমি হওয়াব। আমার প্রচুর ক্ষমতা।

ফখরুদিন সাহেবের মনে হল, অপালা আবার কাঁদতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, ঐ ছেলে যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকে, আমি টেনে তার জিভ ছিঁড়ে ফেলব।

ঐ সব কিছু না বাবা, এমনিতেই আমার মন খারাপ। তুমি তো জান, মাঝে মাঝে আমার মনখারাপ হয়।

এটা তো ভাল কথা না। এটা একটা অসুখ, এর নাম মেলাংকলি। আমি ঢাকায় এসেই বড় বড় ডাক্তার দেখাব।

কবে আসবে ঢাকায়?

তোমার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেই আমি ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করব। এখানে আমার অনেক ঝামেলা, তবুও আমি ফাস্ট এ্যাভেইলেবল ফ্লাইটে চলে আসব। তোমার মাকেও নিয়ে আসব।

আচ্ছা।

তুমি কী আর কিছু বলবে?

না।

তুমি কী জেগে ছিলে নাকি মা?

না।

এত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে কী করছিলে?

ছবি দেখছিলাম।

কী ছবি দেখছিলে?

আমার ছবি। কত ছবি যে তোমরা আমার তুলেছ!

দ্যাটস রাইট। ফটোগ্রাফির হবিটা একসময় বেশ জোরােলই ছিল। এখন নেই। ভাবছি, আবার শুরু করব। একটা ডার্ক রুম বানিয়ে নিজেই ছবি ডেভেলপ করব। কেমন হবে?

ভালই হবে। বাবা।

বল মা।

আমার এত ছবি, কিন্তু খুব ছোটবেলার ছবি নেই কেন?

তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

জন্মের পর পর তোলা ছবি। এক বছর-দুবছর বয়সের ছবি।

ফখরুদ্দিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। অপালা যখন দ্বিতীয় বার প্রশ্নটি করতে যাবে তখন তিনি বললেন, তোমার ছোটবেলার ছবিও আছে। না-থাকার তো কোনো কাবণ নেই। আমি এসে তোমাকে খুঁজে দেব।

আচ্ছা।

তোমার ছোটবেলায় আমি একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। ব্যবসা-সংক্রান্ত ঝামেলা। মনমেজাজ ভাল ছিল না। প্রচুর ছোটাছুটি করতে হত, ছবি তোলার তেমন মুড় ছিল না। ছবি তোলা, কবিতা এবং গল্প লেখার মতই একটা মুডের ব্যাপার।

তা ঠিক।

একেবারেই যে তুলিনি তা নয়। কিছু কিছু নিশ্চয়ই তোলা হয়েছে। তবে আরো বেশি তোলাব প্রয়োজন ছিল। আমি ফিরে আসি, তারপর দেখবে প্রতিদিন এক রোল করে স্ন্যাপ নেব।

বাবা।

বল মা।

আগামীকাল আমার একটা পরীক্ষা আছে।

ও, আই অ্যাম সরি। এতক্ষণ তোমাকে ডিস্টার্ব করা খুবই অনুচিত হয়েছে।

অপালা ক্ষীণ স্বরে বলল, কাল যদি পরীক্ষাটা না দিই, তাহলে কী তুমি বাগ করবে?

মা, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

কাল আমার পরীক্ষা দিতে ইচ্ছা করছে না। যদি পরীক্ষার হলে যাই, তাতেও লাভ হবে না। একটা লাইনও লিখতে পারব না।

কেন?

আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।

শরীর খারাপ লাগলে তো পরীক্ষা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মা, তুমি শুয়ে থাক। আমি আসছি, এসেই সব ঠিক করে দেব।

অপালা টেলিফোন রেখে খাবার ঘরে গেল। এত রাত হয়েছে, তবু কেউ ঘুমাযনি। সবাই জেগে আছে। সে আজ সারা দিন কিছু খায়নি, রাতেও খায়নি এই জন্যেই জেগে আছে হয়ত।

রমিলা।

জি আফা।।

আমি এক কাপ কফি খাব। খুব কড়া করে এক কাপ কফি দাও।

সাথে আর কিছু দিব আফা?

এক টুকরো পনির কেটে দিও। আমার ঘরে নিয়ে এসো। আর শোন, তোমরা সবাই জেগে আছ কেন? শুয়ে পড়া।

অনেক দিন পর অপালা তার খাতা নিয়ে বসেছে। ঘুম ঘুম একটা ভাব ছিল, কফি খাওয়ায় সেই ভাব কেটে গেছে। খুব ক্লান্তি লাগছে, আবার ইচ্ছেও করছে কিছু একটা লিখতে। অপালা লিখতে শুরু করল।

 

আমার বাবা

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বাংলার স্যার একটা রচনা লিখতে দিলেন তোমার প্রিয় মানুষ। কেউ লিখল রবীন্দ্রনাথ, কেউ শরৎচন্দ্র। কিছু-কিছু স্মার্ট মেয়েরা বিদেশের নামকরা লোকদের প্রিয় মানুষ বানিয়ে রচনা লিখল, লেনিন, আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা। আমি লিখলাম, আমার প্রিয় মানুষ আমার বাবা। কেন তিনি আমার প্ৰিয় মানুষ তাও লিখলাম। ছোট ছোট কিছু ঘটনার কথা লিখলাম।–যেমন, আমার এক বার টনসিল অপারেশন হল। সলিড কিছু খেতে পারি না। বাবার তা দেখে খুব কষ্ট হল। তিনি বললেন, আমার মা যত দিন সুস্থ না হয়েছে, তত দিন আমিও সলিড কিছু খাব না। সত্যি সত্যি তিন দিন তাই করলেন। দুধ, মুরগির সুপ। এইসব খেয়ে কাটালেন। আরেক বার আমার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। মাটীর হাড়ে কী যেন হয়েছে। কত ওষুধ কত ডাক্তার, ব্যথা কমে না। আমার কষ্ট দেখে বাবা যেন কী-রকম হয়ে গেলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট বাচ্চাদের মত শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! বাবার কান্না শুনে আমার ব্যথা কমে গেল। আমি বললাম, বাবা তুমি কাঁদবে না, আমার ব্যথা কমে গেছে। বাবা মনে করলেন আমি তাকে সান্তুনা দেবার জন্যে বলছি। তিনি আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। এই মানুষটি যদি আমার প্রিয় না হয়, তাহলে কে হবে? রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা–এঁরা মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ, পৃথিবীর সবার প্রিয়। কিন্তু আমি সামান্য মানুষ, আমার প্রিয় মানুষটিও সামান্য।

 

এই রচনা নিয়ে কত কাণ্ড! আমাদের বাংলার স্যার কবিরউদ্দিন খুব খুশি। ক্লাসে সবাইকে পড়ে শোনালেন। শুধু তাই না, লেখাটা কপি করে তিনি দৈনিক বাংলার শিশুদের পাতায় ছাপতে দিলেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, লেখাটা সেখানে ছাপাও হল। এটাই আমার প্রথম ছাপা লেখা এবং এটাই শেষ।

বাবা এই লেখা পড়লেন না। কারণ তিনি জানেনই না যে তার মেয়ের একটা লেখা ছাপা হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল বাবাকে লেখাটা পড়াই, আবার লজ্জাও লাগছিল। নিজের গোপন ভালবাসার কথা জানাতে লজা করে…।

আমার মনে হয় লজ্জা একটু বেশি। মা এত অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, আমার এত খারাপ লাগে, কিন্তু নিজের খারাপ লাগার কথা মাকে কখনো জানাই না। জানাতে ইচ্ছা করে না। সব সময় মনে হয় নিজের মনের কথা থাকুক না মনে! কী হবে সবাইকে জানিয়ে?

 

ভোরবেলা খুব সহজভাবে অপালা নিচে নেমে এল। নাশতার টেবিলে বসল। নিশানাথবাবুর স্ত্রী প্রায় ছুটে এলেন। চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে অপালা বলল, একটা হাসির গল্প বলুন তো কাকিমা।

তিনি খুবই অবাক হলেন। এত অবাক হলেন যে হাসির গল্প মনে এল না। তিনি হাসির গল্পের জন্যে আকাশপাতাল হাতড়াতে লাগলেন। অপালা নাশতা শেষ করে অরুণা-বিরুণার খোঁজে গেল। অরুণা তাকে বিশেষ পছন্দ করে না, তবে বরুণা তার জন্যে পাগল। আজ দু’জনই ছুটে এল। লাফালাফি করতে লাগল। বরুণার স্বভাব হচ্ছে আদর দেখানোর জন্যে পা কামড়ে ধরার ভঙ্গি করা। অপালা যখন বলে–এই, এ সব কী! তখন তার ফুর্তির সীমা থাকে না। অনেকটা দূরে ছুটে যায়, আবার দৌড়ে এসে কামড়ের ভঙ্গি করে। আজ দু’জনই এক খেলা খেলছে। দুজনের মনেই আনন্দ।

গোমেজ এসে বলল, আপা, আপনার টেলিফোন।

গোমেজের হাতে এক কাপ কফি।

আপা, কফিটা নিন। অন্য রকম করে বানিয়েছি।

অন্য রকম মানে? লবণ দিয়েছ নাকি গোমেজ ভাই?

খেয়ে দেখেন আপা।

অপালা কফির কাপ হাতে টেলিফোন ধরতে গেল। টেলিফোন করেছেন মা। তার গলাটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। যেন খুব সূক্ষ্মভাবে কাঁপছে।

মা, তুই কেমন আছিস?

আমি ভাল আছি। আমি খারাপ থাকিব কেন? আমার তো আর হাটের অসুখ হয়নি।

আজ তোর পরীক্ষা না?

হ্যাঁ, বিকেলে।

তোর বাবা বলছিল, তুই নাকি পরীক্ষা দিবি না?

পরীক্ষা দেব না কেন? এত পড়াশোনা শুধু শুধু করলাম? তবে পরীক্ষাটা খুব খারাপ হবে।

তুই কাল তোর বাবাকে কী বলেছিলি? সে সারা রাত ঘুমুতে পারেনি।

ও-মা, সে কী কথা! আমি তো কিছু বলিনি। কই, বাবাকে দাও তো, তোমার কাছে আছেন না?

না। টিকিটের জন্যে ছোটাছুটি করছে। টিকিট পাচ্ছে না। এখন গেছে আরোফ্লটের অফিসে মস্কো হয়ে ঢাকায় যাবে।

তোমাদের এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমার কিছু হয়নি। আমি খুব ভাল আছি।

সত্যি ভাল আছিস?

হ্যাঁ, সত্যি ভাল। মিথ্যা ভালো আবার কেউ থাকে নাকি?

অপালা হেসে ফেলল।

 

প্রশ্ন হাতে নিয়ে অপালার জ্বর এসে গেল। সব অচেনা। মনে হচ্ছে অন্য কোনো সাবজেক্টের প্রশ্ন ভুল করে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, লিখতে গিয়ে দেখল। সে লিখতে পারছে। উত্তরগুলো বেশ ভালই হল। রিগ্রেশন মডেলের একটা জটিল অঙ্কও শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে ফেলল। কে জানে, হয়ত এই শেষ পরীক্ষাটাই তার সবচেয়ে ভাল হয়েছে।

অনার্সের কঠিন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। বেশ লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে। গাড়িতে করে নয়, হেঁটে হেঁটে। ফিরোজ নামের ঐ ছেলেটিকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? তাকে গিয়ে সে যদি বলে, আপনি আপনার বান্ধবীর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন, ঐ মেয়েটিকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

 

হাজি সাহেব অবাক হয়ে একটি দৃশ্য দেখলেন। বিশাল একটা নীল রঙের গাড়ি তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। লম্বা, ফর্সা একটা মেয়ে নামছে গাড়ি থেকে। বেশ সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দোতলায় উঠে যাচ্ছে। যেন অনেক বার সে এসেছে। সব কিছু তার খুব ভাল চেনা। দোতলায় এই মেয়েটি কার কাছে যাচ্ছে? মেয়েটির বয়স এমন যে চট করে তুমি বলা যায় না। আবার তার মত একজন বয়স্ক লোকের পক্ষে আপনি করে বলাও মুশকিল তাঁর বড় মেয়ের বয়স নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি। হাজি সাহেব ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

অপালা সিঁড়ির মাঝামাঝি থেমে গেল। দুপা নেমে এসে বলল, ফিরোজ বলে একজন ভদ্রলোক থাকেন, তার কাছে।

উনি তো হাসপাতালে।

সে কী, কেন?

আকাশপাতাল জ্বর। আমিই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি।

কোন হাসপাতাল, কত নম্বর বেড়, এইসব বলতে পারবেন?

মুখস্থ বলতে পারব না। আমার কিছু মনে থাকে না। তবে লেখা আছে। আমার সঙ্গে এস,

অপালা নেমে এল। হাজি সাহেব বললেন, ফিরোজ তোমার কে হয়?

কিছু হয় না। আমার খুব পরিচিত।

হাজি সাহেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। বেফাঁস কিছু বলে ফেলছিলেন, বহু কষ্টে নিজেকে সামলালেন। মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে হাসপাতালের নাম-ঠিকানা দেবার কোনো আগ্রহ এখন আর অনুভব করছেন না। তবু মুখের ওপর বলা যায় না … তুমি চলে যাও, তোমাকে কিছু দেব না।

অপালা হাজি সাহেবের পেছনে-পেছনে বসার ঘরে গিয়ে ঢুকল। সেখানে তার জন্যে বড় রকমের একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হাজি সাহেবের ছোট মেয়ে বিছানার ওপর বসে আছে। তার ছবিই সে ফিরোজের কাছে দেখেছে। মেয়েটি ছবির চেয়েও অনেক সুন্দর। তবে সে বোধহয় নিজের পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নয়। খুব হকচিকিয়ে গেছে। একটি কথাও না-বলে চলে যাচ্ছে ভেতরের দিকে। কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটছে। এমনভাবে হাঁটছে কেন?

অপালা বলল, এই মেয়েটির সঙ্গেই কী ফিরোজ সাহেবের বিয়ের কথা হচ্ছে?

হাজি সাহেব এবং তাঁর মেয়ে দু’জনই চমকে উঠল। মেয়েটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাজি সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার হাতে একটা নোটবই। নোটবইটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। তিনি অত্যন্ত গভীর গলায় বললেন, বিয়ের কথা তুমি কী বললে?

আমি বোধহয় কোনো ভুল করেছি। কিছু মনে করবেন না।

ভুল না, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি গোড়া থেকে সে রকমই সন্দেহ করছিলাম। ওর মাকে বলেছিও কয়েক বার।

দরজা ধরে দাঁড়ানো মেয়েটি চট করে সরে গেল। হাজি সাহেব বললেন, মুখ ফুটে নিজের কথা বললেই হয়, কিংবা আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে বলতে পারে, তা না!

বিস্মিত অপালা বলল, বিয়ের ব্যাপারে তাহলে উনি আপনাদের কিছু বলেননি?

আরে না! একেক সময় একেক কথা বলে। এক বার বলল, বিয়ের সব দায়িত্ব আমার। তখনই সন্দেহ হল। চালাক ছেলে। তুমি বস, দাঁড়িয়ে আছ কেন? দাঁড়াও, চায়ের কথা বলে আসি। আর এই হল ঠিকানা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ওয়ার্ড নাম্বার পাঁচ। বেড নাম্বার তেতাল্লিশ। ওয়ার্ডে ঢুকেই প্রথম বিছানাটা।

অপালাকে ঘণ্টাখানেক বসতে হল। হাজি সাহেবের স্ত্রী এই এক ঘণ্টা ক্রমাগত কথা বললেন। মোটাসোটা ধরনের মহিলা, কথা বলার সময় খুব হাত নাড়ান। শুরুই করলেন মা ডাক দিয়ে।

মা, তোমার নাম কী?

অপালা।

ও-মা, কী অদ্ভুত নাম! তুমি আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?

জি না।

তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি। একটা ঝামেলা মিটে গেল। ছেলের মনে কী ছিল তা তো আর আমরা জানি না। জানলে এত দিনে শুভ কাজ সমাধা হয়ে যেত ইনশাআল্লাহ।

হাজি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এসেই কী বকবক শুরু করলে? চুপ কর তো। চুপ করব কেন? আমরা মেয়েতো-মেয়েতে কথা বলছি, তুমি এর মধ্যে থাকবে না। বারান্দায় গিয়ে বস।

মেয়েটি চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। একটা প্লেটে পাপর ভাজা, অন্য একটা প্লেটে সুজির হালুয়া। সে খুব সাবধানে ট্রে নামিয়ে রাখল। এক বারও চোখ তুলে তাকাল না। ভয়ে-সঙ্কোচে সে এতটুকু হয়ে গেছে। এখন ভাল লাগছে মেয়েটিকে দেখতে।

 

হাজি সাহেবের বাড়ি থেকে বেরুতে-বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা কারো বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। সন্ধ্যাবেলা শুধু পশু এবং পাখিরাই ঘরে ফিরবার জন্যে ব্যাকুল হয়। মানুষ হয় না। উষা এবং গোধূলি হচ্ছে গৃহত্যাগের লগ্ন।

ড্রাইভার বলল, বাসায় যাব। আপা?

না, এমনি একটু রাস্তায় চালান।

মীরপুর রোড ধরে যাব?

যান।

শ্যামলীতে বড় খালার বাড়ি। তার সঙ্গে এক বার দেখা করে এলে কেমন হয়? কত দিন ওবাড়িতে যাওয়া হয় না। খালাও আসেন না। মা মাঝে মাঝে এ-বাড়িতে আসেন, কিন্তু অপালাকে সঙ্গে আনেন না। কেন আনেন না। এ নিয়ে সে কখনো মাথা ঘামায়নি। আজ তার মাথায় কাম-কাম করে বাজতে লাগল–মা আমাকে এ বাড়িতে আনেন না, মা আমাকে এ বাড়িতে আনেন না। যেন রেকর্ডে পিন আটকে গেছে, তুলে না দেয়া পর্যন্ত বাজতেই থাকবে।

ড্রাইভার সাহেব।

জি আপা।

শ্যামলী চলুন। বড় খালার বাসায়। বড় খালার বাসা চেনেন না?

জি, চিনি। চিনিব না কেন?

 

বড় খালা অপ্রসন্ন মুখে বললেন, তারপর রাজকন্যা, কেমন আছ?

অপালা হেসে ফেলল। আমি ভাল আছি বড় খালা।

সন্ধ্যাবেলা কী মনে করে? আমাদের বাড়িঘর তো তোমার জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা। ফরবিডেন জোন।

ফরবিডেন জোন হবে কেন?

আমি তো জানি না, আছে নিশ্চয়ই কোনো কারণ। রাজকন্যার কী সব জায়গায় যেতে পারে, না যেতে পারা উচিত? বাস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বসব না খালা। আমি এখন যাব।

এখন যাবে মানে! তাহলে এসেছে কেন?

অপালা বসল। বড় খালা গম্ভীর মুখে বললেন, এমনিতে তো তোমাদের খবর পাওয়ার উপায় নেই। পত্রিকায় অবশ্যি ইদানীং পাচ্ছি।

অপালা বিস্মিত হয়ে বলল, পত্রিকায় খবর মানে! পত্রিকায় আবার কী খবর?

সে কী! তুমি পত্রিকা পড় না?

জি না।

দেশী পত্রিকা তোমার বাবা পড়তে দেন না বোধহয়।

তা নয়। খালা, ইচ্ছা করে না। কী খবর বেরিয়েছে?

দু’টা খুন হয়েছে তোমাদের টঙ্গির কারখানায়। খুনি ধরা পড়েছে। তার ছবিটবি দিয়ে নিউজ হয়েছে। সে বলছে, তোমার বাবার নির্দেশেই এই কাণ্ড সে করেছে। সব পত্রিকাতেই তো আছে, তুমি কিছুই জানো না?

জি না।

না জানাই ভাল।

খুব চিন্তা লাগছে খালা।

চিন্তা লাগার কী আছে? টাকাওয়ালা মানুষদের এইসব সামান্য জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তোমার বাবা আসুক। দেখবে, সব ঠিক হয়ে গেছে। ঐ খুনিই তখন উল্টো কথা বলবে। বস তুমি, আমি দেখি, চা-টার ব্যবস্থা করি। তোমার ঠিকমত যত্ন হয়নি এই খবর তোমার বাবার কানে উঠলে উনি রেগে যাবেন। জগৎ শেঠদের রাগাতে নেই।

অপালা একা একা বসে রইল। এক বার বড় খালার মেয়ে বিনু এসে বলল, ছবি দেখবে আপা? বালিকা বধু আছে। খুব ভাল প্রিন্ট।

তুমি দেখ। আমার ইচ্ছা করছে না।

আমি চার বার দেখেছি আপা। তুমি দেখলে তোমার সঙ্গে আবার দেখব।

আমার আজ একটুও ইচ্ছা করছে না। ভীষণ মাথা ধরছে।

মাথা ধরার ব্যাপারটা মিথ্যা নয়। আসলেই প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যেতে। তা সম্ভব নয়। বড় খালা তার সামনে প্রচুর খাবারদাবার সাজিয়ে রাখছেন। তার মুখে কী অদ্ভুত এক ধরনের কাঠিন্য!

বড় খালা।

বল।

আমার জন্ম কী হাসপাতালে হয়েছিল?

তা দিয়ে তোমার কী দরকার?

এমনি জিজ্ঞেস করছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, জানেন না?

জানিব না কেন? নাও, চা খাও। তুমি কী এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে এসেছিল?

জি না। হঠাৎ মনে হল।

তোমার বাবা-মা ফিরবেন কবে?

টিকিট নিয়ে কী সব ঝামেলা হচ্ছে, ঝামেলা মিটলেই ফিরবেন।

খুব একা থাক আমাদের খোঁজখবর নেয়া উচিত, কিন্তু নিতে পারি না। কেন জানো?

জি না!

তোমাদের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা মানেই আগ বাড়িয়ে গালে চড় খাওয়া। পত্রিকায় খবর দেখার পর তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম। কী বলল, জানো?

জী বলল?

বলল, তুমি পড়াশোনা করছ, তোমাকে ডাকা যাবে না।

ওদের দোষ নেই খালা আমিই বলে দিয়েছিলাম।

ভাল, খুব ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *