১৩. নার্সারি স্কুল

ত্রয়োদশ অধ্যায় নার্সারি স্কুল

 কিরূপ অভ্যাস গঠিত হইলে তাহা শিশুর পক্ষে সুখদায়ক এবং তাহার পরবর্তী জীবনে প্রয়োজনীয় হইতে পারে সে সম্বন্ধে আগের অধ্যায়গুলিতে আলোচনা করা হইয়াছে। কিন্তু এই সদভ্যাস গঠনের শিক্ষা পিতামাতা দিবেন কিংবা ইহার জন্য নির্ধারিত কোনো বিদ্যালয় থাকিবে সেই প্রশ্ন আলোচিত হয় নাই। আমার মনে হয় কেবলমাত্র দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং অতিরিক্ত কর্মভার প্রপীড়িত জনক-জননীর সন্তানদের জন্যই নয়, সকল শিশুদের জন্যই বিশেষ করিয়া শহরের শিশুদের জন্য নার্সারি স্কুল বা শিশুপালনাগার একান্ত আবশ্যক। আমি বিশ্বাস করি যে, যে কোনো অবস্থাপন্ন লোকের পুত্রকন্যা অপেক্ষা ডেপ্টফোর্ডে [Deptford] শ্রীমতী ম্যাকমিলান কর্তৃক পরিচালিত নার্সারি স্কুলের শিশুরা ভালো শিক্ষা পাইতেছে। এইরূপ সুশিক্ষার ব্যবস্থা ধনী-দরিদ্র সকল শিশুর জন্যই প্রসারিত হউক, ইহাই আমি কামনা করি। কোনো একটি বিশেষ নার্সারি স্কুলের বিষয় বর্ণনা করার পূর্বে কি কি কারণে এরূপ বিদ্যালয় বাঞ্ছনীয় তাহা আলোচনা করা যাক।

প্রথমেই বলা যায়–শিশুর দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানসিক গুণগুলি বিকাশের পক্ষে শৈশবকাল অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর দেহ ও মনের বিকাশ পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ উল্লখ করা যায় : ভয় শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের ত্রুটির কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং দোষপূর্ণ শ্বাস-প্রশ্বাসের অভ্যাস নানাপ্রকার রোগ সৃষ্টি করে। ভয় মানসিক ব্যাপার কিন্তু শিশুর দেহের উপরও ইহার প্রক্রিয়া রহিয়াছে। এইরূপ পরস্পরাবদ্ধ সম্বন্ধ এত বেশি যে, চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছুটা জ্ঞান ব্যতীত শিশুর চরিত্রগঠনে আশানুরূপ ফললাভ সম্ভবপর নয়। তেমনই শিশুর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান না থাকিলে কেহ শিশুকে স্বাস্থ্যবান করিয়া গড়িয়া তোলার আশাও করিতে পারেন না। শিশুর দেহ ও মন উভয়দিকের পুষ্টিসাধনের জন্য যেরূপ জ্ঞান প্রয়োজনীয় তাহার অধিকাংশই নূতন; প্রাচীন চিরাচরিত প্রথার সহিত ইহাদের মিল নাই। উদাহরণস্বরূপ শিশুকে শৃঙ্খলা মানিয়া চলিতে অভ্যাস করানোর প্রশ্নটি ধরুন, শিশুর সহিত কোনো দ্বন্দ্বে অর্থাৎ আপনি তাহাকে যেরূপভাবে চলিতে, যেরূপ আচরণ করিতে বলেন তাহা যদি সে না মানিয়া চলে এইরূপ অবস্থার প্রধান নীতি হইল : আপনি নত হইবেন না বা পরাজয় স্বীকার করিবেন না কিন্তু শিশুকে শাস্তি দিয়া বাধ্য করিতে বা জোরজবরদস্তি করিতে চেষ্টাও করিবেন না। সাধারণ পিতামাতা ইহার। বিপরীত পন্থাই গ্রহণ করেন; নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্ত জীবন কামনা করিয়া অনেক পিতামাতা পুত্রকন্যার সঙ্গে এরূপ কোনো দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হন না, আবার কখনও বা শিশুদের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হইয়া শাস্তি দিয়া তাকেন। এইরূপ ক্ষেত্রে কৃতকার্য হইতে হইলে পিতামাতার চরিত্রেও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। তাহা হইল ধৈর্য এবং নীরবে প্রভাব বিস্তার করার মতো চারিত্রিক শক্তি। এই তো গেল শিশুর ক্রমবিকাশ ব্যাপারে অভিভাবকের মনস্তত্ত্বসম্মত আচরণের কথা। এইবার ধরুন শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে মুক্ত বায়ুর প্রভাবের কথা। বুদ্ধি প্রয়োগ এবং সতর্কতা অবলম্বন করিলে দিবারাত্রি সর্বদাই মুক্ত বাতাস এবং কম পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত থাকা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী কিন্তু সতর্কতা এবং বুদ্ধির অভাবে হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগার ফলে শিশুর অপকার হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

পিতামাতার পক্ষে শিশুদিগকে মানুষ করার উপযুক্ত নূতন জ্ঞান ও কৌশল সম্বন্ধে জ্ঞান বা সেইগুলি প্রয়োগ করার অবসর নাও থাকিতে পারে। অশিক্ষিত পিতামাতার বেলায় এ প্রশ্ন উঠে না; প্রকৃত উপায় তাহারা জানেন না, বুঝাইয়া দিলেও বিশ্বাস করেন না। আমি সমুদ্রের ধারে একটি কৃষিপ্রধান জেলায় বাস করি; এইখানে টাটকা খাদ্যদ্রব্য সহজে মেলে, শীত বা গ্রীষ্মের আধিক্যও বেশি নয়। শিশুদের স্বাস্থ্যের পক্ষে চমৎকার বলিয়াই আমি এই স্থান পছন্দ করিয়াছিলাম। তথাপি এখানকার কৃষক এবং দোকানিদের প্রায় সব ছেলেমেয়েদের মুখ দেখি রোগা ফ্যাকাসে, কাজকর্মে তাহারা অলস, কেবল খেলাধুলায় পটু। সমুদ্রের তটে তাহারা কখনও যায় না কারণ তাহাদের ধারণা পা ভিজানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক খারাপ। গৃহের বাহির হইলেই তাহারা পশমের মোটা কোট পরিয়া থাকে, এমনকি গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের দিনেও ইহার ব্যতিক্রম নাই। খেলার সময় যদি হইচই করে তাহাদের আচরণ দ্র করার চেষ্টা করা হয়। অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহারা বাড়ির বাহিরে থাকিলে কোনো আপত্তি করা হয় না, খাদ্যের ব্যাপারে কোনো বাধা নিষেধ নাই; বয়স্ক ব্যক্তিদের উপযোগী ছোটদের পক্ষে অপকারী সব রকম খাদ্যই তাহারা গ্রহণ করে। তাহাদের পিতামাতারা বুঝিতে পারে না তাহাদের ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডায় এতদিন মরিয়া যায় নাই কেন। কিন্তু চোখের সম্মুখে উদাহরণ দেখিয়াও তাহারা বিশ্বাস করে না যে, তাহাদের সন্তান মানুষ-করার প্রণালীতে অনেক গলদ আছে। তাহারা দরিদ্র নয়, সন্তানের প্রতি স্নেহহীনও নয় কিন্তু কুশিক্ষার ফলে নিদারুণভাবে অজ্ঞ। শহরবাসী গরিব ও কর্মক্লান্ত পিতামাতার পক্ষে এইরূপ অশিক্ষার কুফল আরও বেশি। কিন্তু যে পিতামাতা উচ্চশিক্ষিত, সন্তানের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন এবং অতিরিক্ত কর্মব্যস্ত নন তাঁহারাও শিশুদের পক্ষে যে পরিমাণ যত্ন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার এবং যে পরিমাণ শিক্ষা তাহারা নার্সারি স্কুলে পায় সেইরূপ বাড়িতে দিতে পারে না। শিশুদের ক্রমবিকাশের অনুকূল যে সর্বপ্রধান ব্যবস্থা অর্থাৎ সমবয়সী শিশুদের সঙ্গ, তাহা বাড়িতে দুর্লভ। পরিবার যদি ছোট হয় আজকাল ইহা হইয়াছে রীতি–তবে শিশুরা বয়স্কদের দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে। প্রায় সর্বদা তাহাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। ইহার ফলে শিশুরা ভেঁপো ও হঁচড়েপাকা হইয়া ওঠে। ইহা ছাড়া অনেক শিশুর সংস্পর্শে আসার ফলে শিশু যে বাস্তক শিক্ষা পায় পিতামাতা তাহা দিতে পারেন না। ধনী ব্যক্তিরাই কেবল-শিশুদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ফাঁকা জায়গা এবং খেলার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করিতে পারেন। কিন্তু ইহারও কুফল আছে। যে শিশুদের এইরূপ বিশেষ বন্দোবস্ত থাকে তাহাদের মনে ইহার জন্য গর্ববোধ হয় এবং তাহারা নিজদিগকে অন্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে। করে। নৈতিক শিক্ষা হিসাবে ইহা বড়ই ক্ষতিকর। এইসব কারণে আমার মনে হয়, কাছাকাছি নার্সারি স্কুল থাকিলে অবস্থাপন্ন এবং উচ্চশিক্ষিত পিতামাতাও দুই বৎসর বয়সের সময় হইতেই শিশুকে সেইখানে পাঠাইলে উপকারই পাইবেন।

বর্তমানে পিতামাতার অবস্থানুযায়ী সন্তানদের শিক্ষার জন্য বিলাতে দুই রকম শিশু-বিদ্যালয় আছে : ফ্রয়বেল স্কুল এবং মন্তেসরি স্কুলে ধনী লোকদের ছেলেমেয়েদের জন্য; গরিব লোকদের সন্তান-সন্ততির জন্য আছে অল্প সংখ্যক নার্সারি স্কুল। নার্সারি স্কুলগুলির জন্য স্ত্রীমতী ম্যাকমিলানের বিবরণ সন্তানের মঙ্গলকামী প্রত্যেক ব্যক্তিরই পড়া উচিত। আমার মনে হয় ধনীব্যক্তির ছেলেমেয়েদের জন্য পরিচালিত কোনো-স্কুলই শ্ৰীমতী ম্যাকমিলানের স্কুলের মতো এত ভালো নয়, কারণ এইখানে ছাত্রসংখ্যা বেশি; তাহা ছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকগণ যেমন অল্পতেই হইচই করিয়া শিক্ষককে বিব্রত করিয়া তোলেন এইখানে সেইরূপ হয় না। শ্ৰীমতী ম্যাকমিলান সম্ভবপর হইলে শিশুকে এক বছর হইতে সাত বৎসর পর্যন্ত তাঁহার স্কুলে রাখেন যদিও শিক্ষাকর্তৃপক্ষ শিশুদিগকে পাঁচ বৎসর বয়সে সাধারণ প্রাথমিক স্কুলে পাঠাইবার পক্ষপাতী। শিশুরা সকাল আটটায় স্কুলে আসে এবং সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকে; তাহারা সকলেই স্কুলের খাবার খায়। যতক্ষণ সম্ভব তাহারা ঘরের বাহিরেই কাটায়। ঘরেও প্রচুর মুক্ত বাতাসের বন্দোবস্ত আছে। শিশুকে ভর্তি করার পূর্বে তাহাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়া দেখা এবং কোনো অসুখ থাকিলে চিকিৎসা করিয়া আরোগ্য করানো হয়। অতি অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হইলেও ভর্তির পর সাধারণত সুস্থ থাকে। স্কুলে একটি বড় মনোরম উদ্যান আছে; এইখানে অনেক সময় আনন্দে খেলাধুলায় অতিবাহিত হয়। মন্তেসরি প্রণালীতে শিক্ষাদান করা হইয়া থাকে। দুপুরে খাওয়ার পর সকল শিশু ঘুমাইয়া পড়ে। যদিও রাত্রিতে এবং রবিবারে শিশুদিগকে নিরানন্দ জীর্ণ বাসগৃহে অনেক সময় মাতাল পিতামাতার সঙ্গে একই কুঠুরিতে ঘুমাইতে হয় তবে দেহে এবং বুদ্ধিতে এই শিশুগণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের মতোই যোগ্যতা অর্জন করে। শ্রীমতী ম্যাকমিলান তাহার বিদ্যালয়ের সাত বৎসর বয়স্ক বালক-বালিকার কথা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন :

তাহারা প্রায় সকলেই দীর্ঘ ও ঋজু। সকলেই দীর্ঘ না হইলেও ঋজু সবাই; বেশির ভাগেরই দেহ সুগঠিত, পরিষ্কার ত্বক, উজ্জ্বল চোখ এবং রেশম কোমল চুল। উচ্চ মধ্যবিত্তশ্রেণির সাধারণ ছেলেমেয়ে অপেক্ষা ইহারা প্রায় সকলেই উন্নত ধরনের। এই গেল দৈহিক আকৃতি ও গঠনের কথা। মানসিক দিক দিয়াও ইহারা তীক্ষ্ণ অনুভূতি-সম্পন্ন, অপরের সঙ্গে মিলিতে ইচ্ছুক, নানা কাজের ভিতর দিয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে উৎসুক। ভালো লিখিতে পারে এবং অনায়াসে বলিতে পারে। এইরূপ যে-কোনো ছাত্র ভালো ইংরাজি এবং ফরাসি ভাষাও বলে। সে কেবল নিজের যত্ন নিজে লইতেই শেখে নাই, কয়েক বছর ধরিয়া অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়েকে সাহায্য করিয়াছে; সে গণিত পারে, ওজন করিতে পারে, নকশা আঁকিতে পারে; বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি তাহার হইয়াছে। তাহার প্রথম কয়েক বৎসর শান্ত ও প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে কৌতুক ও আমাদের ভিতর দিয়া অতিবাহিত হইয়াছে, শেষের দুই বৎসর হইয়াছে নানা গবেষণা এবং আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাপূর্ণ। বাগান সম্বন্ধে তার ধারণা হইয়াছে; সে নিজে চারগাছ পুঁতিয়াছে, জলসিঞ্চন করিয়াছে, গাছপালা এবং প্রাণীর যত্ন পরিচর্যা করিয়াছে। সাত বৎসর বয়সের বালক-বালিকা নাচিতে পারে, গান করিতে পারে এবং অনেক খেলা জানে। এই রকম হাজার হাজার ছেলেমেয়ে নিম্ন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির জন্য উপস্থিত হইবে। ইহাদিগকে লইয়া কি করা যায়? আমি প্রথমেই উল্লেখ করিতে চাই যে, সমাজের নিম্নস্তর হইতে এইরূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সবল সুস্থ বালক বালিকা স্কুলে ভিড় করিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ বহুলাংশে পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। হয় নার্সারি স্কুল ব্যর্থ হইয়া একটি বাজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে, আর না হয় ইহার প্রভাব শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও পড়িবে। ইহা নূতন ধরনের শিক্ষার্থীদল প্রস্তুত করিবে এবং দুই দিন পরেই হউক আর পরবর্তীকালেই হউক শুধু সব রকম স্কুলই নয় সামাজিক জীবন, শাসনব্যবস্থা, আইনকানুন এবং আমাদের সহিত অন্য জাতির সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করিবে।

নার্সারি স্কুলে সুফল স্বরূপ যাহা আশা করা হইয়াছে তাহার মধ্যে অতিরঞ্জন আছে বলিয়া আমি মনে করি না। নার্সারি স্কুল যদি সর্বজনীন করা যায় তবে ইহা এক প্রজন্মকালের মধ্যে [In one generation] অর্থাৎ পঁচিশ বৎসরের মধ্যে বর্তমান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ভিতর শিক্ষাগত যে গভীর পার্থক্য রহিয়াছে তাহা দূর করিতে সমর্থ হইবে। ইহা সকল নাগরিকের মানসিক ও দৈহিক উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হইবে, যাহা বর্তমানে কেবল অল্পসংখ্যক ভাগ্যবান এই সুবিধা ভোগ করিতেছেন। যে রোগ অপচিকীর্ষা এবং অজ্ঞতার গুরুভার মানুষের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে তাহা দূর করিতে পারিবে। ১৯১৮ সনের শিক্ষা আইন অনুসারে সরকারি অর্থে নার্সারি স্কুলের উন্নতি সাধনের কথা ছিল কিন্তু পরে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে সুবিধা লাভের আশায় যুদ্ধ জাহাজ এবং সিঙ্গাপুর জাহাজঘাট [Dock] নির্মাণ করাই অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত হয়। সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য গভর্নমেন্ট বর্তমানে কেবল এই খাতেই বার্ষিক সাড়ে ছয় লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করিতেছেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাদের সন্তানদিগকে রোগ-দুর্দশা এবং অশিক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করা হইয়াছে অথচ সামাজ্য রক্ষার্থে যুদ্ধের আয়োজনে প্রতি বৎসর যে পরিমাণ টাকা খরচ করা হয় তাহা নার্সারি স্কুলের বাবদ ব্যয় করিলে জনসাধারণকে এই দুর্ভোগের কবল হইতে রক্ষা করা সম্ভব। মহিলাগণ এখন ভোটের অধিকার পাইয়াছে। তাহারা কি নিজেদের পুত্রকন্যার মঙ্গলকামনায় একদিন ইহা প্রয়োগ করিতে শিখিবেন?

নার্সারি শিক্ষার বৃহত্তম দিকটি ছাড়াও অন্য একটি বিষয় বিবেচনা করিবার আছে। শিশুদের উপযুক্ত যত্ন ও তত্ত্বাবধান বাবদ কাজ রীতিমত শিক্ষাসাপেক্ষ; পিতামাতার নিকট হইতে ইহা আশা করা যায় না এবং পরবর্তিকালের বিদ্যালয় শিক্ষা হইতেও ইহা পৃথক। শ্রীমতী ম্যাকমিলানের কথা আবার উদ্ধৃত করি :

নার্সারিতে প্রতিপালিত শিশুর স্বাস্থ্য ভালো। তুলনায় সে কেবল বস্তির ছেলেমেয়ে হইতেই উৎকৃষ্ট নয়, ভালো জেলার মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুও তাহার সমকক্ষ নয়। ইহা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শিশুকে মানুষ করিতে অপত্যস্নেহ এবং পিতামাতার দায়িত্ববোধ হইতেও বেশি কিছু আবশ্যক। শাসন এবং জোরজবরদস্তি ব্যর্থ হইয়াছে, জ্ঞানবিহীন অপত্যস্নেহ ব্যর্থ হইয়াছে কিন্তু শিশুর স্বভাব পরিবর্তিত হয় নাই। শিশুকে গড়িয়া তোলার চিন্তা বিশেষ শিক্ষা এবং কৌশলসাপেক্ষ।

তিনি আরও বলিয়াছেন :

নার্সারি স্কুলের একটি বড় সুফল হইল এই যে শিশুরা বর্তমানে প্রচলিত পাঠ্যক্রম দ্রুত শেষ করিতে পারিবে। প্রাথমিক বিদালয়ে ছাত্র-জীবনের অর্ধেক কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ কাল শেষ হইতেই তাহারা উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্য হইয়া উঠিবে! … মোট কথা, পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত হওয়া শিশুকে কেবল তদারক করার আখড়া না হইয়া নার্সারি স্কুল যদি প্রকৃতই শিশুর দৈহিক ও মানসিক শিক্ষার নিকেতন হয় তবে অল্প দিনেই ইহা আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়ন করিবে। ইহা নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয় হইতে শুরু করিয়া সকল প্রকার শিক্ষায়তন ছাত্রদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির মান উন্নত করিবে। বর্তমানে যে রোগ ও দুঃখ-দুর্দশার প্রকোপের ফলে শিক্ষক অপেক্ষা চিকিৎসকের প্রয়োজন বেশি অনুভূত হয় তাহা দূর করা সম্ভবপর হইবে। বর্তমানের বিদ্যালয় ইহার বিরাট প্রাচীর, প্রকাণ্ড প্রবেশ পথ, শক্ত খেলার মাঠ, আলোহীন বড় বড় শ্রেণিকক্ষ তখন দানবীয় ভবন বলিয়া মনে হইবে। নার্সারি স্কুল শিক্ষকদের প্রতিভা বিকাশের এক নূতন সুযোগ আনিয়া দিবে।

বাল্যের চরিত্রগঠনের শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষাদানে এই দুই অবস্থার মধ্যবর্তীকালীন শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে নার্সারি স্কুল। নার্সারি স্কুল এই উভয় দায়িত্ব পালন করে। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদান কার্যে প্রাধান্য দেওয়া হয়; এইরূপ বিদ্যায়তনেই শ্রীমতী মন্তেসরি তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর সার্থক প্রয়োগ করিয়াছিলেন। রোমে একটি বিরাট বাড়ির একটি বড় কক্ষে তিনি তিন হইতে সাত বৎসর বয়সের শিশুদের এক শিশুনিকেতন পরিচালনা করেন। ডেপ্টফোর্ডে যেমন তেমনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আসিত : ডেপ্টফোর্ডের মত এখানেও দেখা গিয়েছিল যে বাল্যকাল হইতে যত্ন লইলে শিশুদিগকে গৃহের কুফল এবং অসুবিধা হইতে রক্ষা করিয়া তাহাদের যথোপযুক্ত দৈহিক ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভবপর।

ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, (সেগুই-এর পর হইতে), শিশুদের শিক্ষায় যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে তাহা সবই হইয়াছে বুদ্ধিহীন এবং দুর্বলচিত্ত লোকদের পরীক্ষার ফল হইতে। জড়প্রকৃতি, দুর্বল মানসিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকেও মানসিক শক্তির বিষয়ে শিশু বলা যাইতে পারে। ইহাদের ক্ষীণ মননশক্তি বা বৃদ্ধিহীনতা দূষণীয় মনে করা হইত না বা শাস্তি দিয়া ইহা দূর করা যাইবে এমন ধারণাও করা হইত না। এই জন্যেই ইহাদের বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিকারের উপায় চিন্তা করা হইয়াছিল। ডক্টর আর্নল্ড যেমন করিতেন যে, চাবুক মারাই কুঁড়েমি দূর করার একমাত্র ঔষধ; তাঁহার পরবর্তীকালের শিক্ষাবিদগণ সেইরূপ মনে করিতেন না। এইজন্য ক্রোধের বশবর্তী হইয়া নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লইয়াই তাঁহারা এইরূপ ছাত্রদের অবস্থা পর্যালোচনা করিতেন; কেহ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারিলে ক্রুব্ধ শিক্ষক তাহাদিগকে বলিতেন না যে, বুদ্ধিহীনতার জন্য তাহাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি শিশুদের প্রতি ধমক ও উপদেশ বর্ষণের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিতে পারিত তবে দুর্বল মননশক্তিসম্পন্ন লোকদিগকে পরীক্ষা না করিয়া তাহারা বুদ্ধিহীন শিশুদের শিক্ষার উপায় নির্ধারণ করিতে সক্ষম হইত। নৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে ধারণাই বহু অন্যায়ের জন্য দায়ী। দুইটি বালকের কথা কল্পনা করুন–একজন সৌভাগ্যক্রমে নার্সারি স্কুলে শিক্ষা পাইয়াছে। অন্যজন বস্তিজীবনের মধ্যে লালিতপালিত হইয়াছে। দ্বিতীয় বালকের যদি দৈহিক এবং মানসিক বিকাশ প্রথম বালকের তুলনায় হীনতর হয় তবে সে কি নিজেই ইহার জন্য নৈতিক দিক দিয়া দায়ী? সেই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার জন্য তাহার পিতামাতা তাহার যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারিল না। সেই তাহার পিতামাতা কি সেই কারণে নৈতিকভাবে দায়ী? পাবলিক স্কুলে পড়িবার সময় ধনীব্যক্তিদের মনে স্বার্থপরতা এবং কতকগুলি ভ্রান্ত ধারণা সঞ্চারিত করা হয়। আর ইহার ফলেই তাহারা নিজেদের একটি পৃথক সমাজ সৃষ্টি করিয়া সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে ভোগবিলাসে মগ্ন হয়। এইজন্য ধনীরাই কি নৈতিকভাবে দায়ী? সকলেই অবস্থার দাস; বাল্যে তাহাদের চরিত্রের বুনন শুরু হইয়াছে, স্কুলে তাহাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশ লাভ করে নাই। ইহার জন্যে নৈতিক দায়িত্ব তাহাদের ঘাড়ে চাপাইয়া কোনো লাভ নাই; তাহারা অন্যের মতো চরিত্রগঠনের পক্ষে অনুকূল বাল্যকাল এবং বুদ্ধি বিকাশের পক্ষে অনুকূল বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিতে না পারিলে তাহাদের দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়া অথবা তাহাদিগকে তিরস্কারে লাঞ্ছিত করিয়া কোনো উপকার হইবে না।

জাগতিক ব্যাপারে অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রেও তেমন উন্নতির একমাত্র পথই আছে; তাহা হইল প্রেম কর্তৃক বিধৃত বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ব্যতীত প্রীতি শক্তিহীন; প্রীতিহীন বিজ্ঞান ধ্বংসকারী। শিশুদের শিক্ষাদান প্রণালীর যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে তাহা সম্ভব হইয়াছে এইরূপ ব্যক্তি সকলের চেষ্টায় যাহারা শিশুদিগকে ভালোবাসিতেন; উন্নততর প্রণালী উদ্ভাসিত হইয়াছে এইরূপ ব্যক্তিসকলের দ্বারা যাহারা শিশুর ক্রমবিকাশ ও মনঃপ্রকৃতি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য অবগত ছিলেন। ইহা স্ত্রীলোকদিগের উচ্চ শিক্ষালাভের একটি সুফল। আগেকার দিনে শিশুপ্রীতি এবং বিজ্ঞানের একত্র মিলন ঘটে নাই। বর্তমান যুগে শিশুদের মন গড়িয়া তোলার মতো যে ক্ষমতা বিজ্ঞান আমাদের হাতে দিয়াছে তাহা বড়ই নিদারুণ; এই ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার সম্ভবপর। ভ্রান্ত লোকে ইহা প্রয়োগ। করিয়া পশুরাজ্য অপেক্ষাও নিষ্ঠুর নির্দয় মানব-সমাজ গড়িয়া তুলিতে পারে। শিশুদিগকে ধর্ম, স্বদেশপ্রীতি এবং সাহস কিংবা কমিউনিজম, শ্রমিকতন্ত্রবাদ এবং বিপ্লববাদ শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে সংকীর্ণমনা, যুদ্ধপ্রিয় এবং হৃদয়হীন পশুরূপে গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা তাহাদের শিক্ষাদানে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত; শিশুদের অন্তরে প্রতিবোধ জাগানো ইহার উদ্দেশ্য হওয়া আবশ্যক। তাহা না হইলে বিজ্ঞানের উন্নতি শিশুদের অপকার করার ক্ষমতাই ক্রমে বাড়াইয়া দিবে।

শিশুর প্রতি ভালোবাসা কার্যকরি শক্তি হিসাবে মানবসমাজে বিদ্যমান রহিয়াছে; শিশু-মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস এবং শিশুর শিক্ষা-প্রণালীর উন্নতিই ইহার প্রমাণ। এই শিশুপ্রীতি এখনও পর্যন্ত দুর্বল বলিয়াই আমাদের রাজনীতিকগণ অত্যাচার ও রক্তপাতের পথে নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অগণিত শিশুর জীবন বলি দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। তথাপি শিশুর প্রতি মানুষের প্রীতি আছে এবং ক্রমে বৃদ্ধি পাইতেছে। যে সকল ব্যক্তি শিশুদিগের প্রতি স্নেহশীল তাহারাই আবার এমন ভাব মনে পোষণ করেন যাহার ফলে শিশুরা পরবর্তীকালে যুদ্ধবিগ্রহে মৃত্যুবরণ করিতে অনুপ্রাণিত এবং বাধ্য হয়। যুদ্ধকে বলা যায় বহু লোকের সম্মিলিত পাগলামি। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ক্রমে বয়স্ক ব্যক্তির জীবন পর্যন্ত প্রসারিত হোক ইহা কি আশা করা চলে না? শিশুদিগকে যাহারা ভালোবাসেন তাহারা তাহাদের অপত্যস্নেহ ও অনুরাগ কি শিশুদের পরবর্তী বয়স্ক জীবনেও বিস্তৃত করিতে পারেন না? শিশুদিগকে সবল দেহ ও বলিষ্ঠ মনে ভূষিত করিয়া তুলিয়া আমরা কি তাহাদিগকে তাহাদের শক্তি ও উদ্যমকে নূতন উন্নততর জগৎ গড়িয়া তোলার কাজে নিয়োগ করিতে দিব, না তাহারা এইকাজে প্রবৃত্ত হইলে আমরা ভয়ে পিছাইয়া গিয়া তাহাদিগকে পুনরায় দাসত্ব ও গতানুগতিক অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করিব? শিশুদের মঙ্গল করা এবং অমঙ্গল করা দুই ব্যাপারেই বিজ্ঞান আমাদের প্রধান সহায়। কোন পথ আমরা অবলম্বন করিব তাহা নির্ভর করে আমরা শিশুদিগকে ভালোবাসি না ঘৃণা করি তাহার উপর। কিন্তু দেখা যায় নৈতিক আদর্শের ধ্বজাধারীগণ শিশুদের প্রতি ঘৃণাকেই নানা আপাতশোভন নামের আবরণে ডাকিয়া অনুরাগের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং কাম্য আদর্শ বলিয়া প্রচার করেন।

সাধারণ নীতি : আমরা এ পর্যন্ত শিশুর চরিত্রগঠনের শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। এই শিক্ষা প্রধানত বাল্যের শিক্ষা। ঠিকমতো পরিচালিত হইলে শিশুর ছয় বৎসর বয়সের মধ্যেই ইহা সম্পূর্ণ হইবে। আমি এইকথা বলি না যে, ছয় বৎসর বয়সের পর বালকের চারিত্রিক গঠন আর পরিবর্তিত হইতে পারে না; এমন কোনও বয়স নাই যখন প্রতিকূল ঘটনা বা পরিবেশ শিক্ষা পাইলে ছয় বৎসর বয়সের মধ্যে বালক বা বালিকার এমন বাসনা ও অভ্যাস গঠিত হয় যে, তাহা ঠিক পথেই চালিত হয়, কেবল পরিবেশের প্রতি অভিভাবকের কিছুটা দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ছয় বৎসর পর্যন্ত উপযুক্ত বাল্যশিক্ষাপ্রাপ্ত বালক-বালিকা যে বিদ্যালয়ে পড়ে তথাকার কর্তৃপক্ষ অবিবেচক না হইলে তবে সেইস্থানে নৈতিক উপদেশদানের বিশেষ কোনো প্রয়োজন হইবে না, কেননা ছাত্রদের নিকট হইতে আর যে সব গুণের বিকাশ আশা করা হইবে তাহা বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ফলস্বরূপ আপনা হইতে বিকশিত হইবে। ইহাই যে একমাত্র নীতি এবং ইহার কোনো ব্যতিক্রম নাই এইকথা আমি বলিতেছি না; নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নাই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে শুধু এই কথাটিই মনে রাখিতে হইবে। এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই যে, ছয় বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশু চরিত্রগঠনের শিক্ষা পাইলে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত কেবল বুদ্ধিমূলক শিক্ষার সুব্যবস্থা করা; কারণ ইহার মাধ্যমেই শিশুর চরিত্রের অন্য বাঞ্ছিত গুণগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করিবে।

অবাঞ্ছনীয় বিষয়ের প্রতি কৌতূহল : শিক্ষাদান যদি নৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে তাহা বুদ্ধির পক্ষে এবং শেষ পর্যন্ত চরিত্রের পক্ষে হানিকর হইয়া দাঁড়ায়। ইহা মনে করা উচিত নয় যে, কতক জ্ঞান ক্ষতিকর এবং কতক বিষয়ে অজ্ঞতা ভালো। শিক্ষার জন্যই শিক্ষাদান করা উচিত, কোনো নৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রমাণ করার জন্য নহে। ছাত্রের তরফ হইতে বিবেচনা করিলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত করা এবং এমন দক্ষতা আয়ত্ত করানো যাহার ফলে সে নিজেই কৌতূহল মিটাইতে সক্ষম হয়। শিক্ষকের তরফ হইতেও কতক ফলদায়ক কৌতূহল জাগ্রত করা উচিত। স্কুলের শিক্ষা বিষয়ের বহির্ভূত কোনো কিছুর প্রতি ছাত্রের কৌতূহল উদ্দীপ্ত হইলেও তাহাকে নিরুৎসাহ করা উচিত নহে। এই কৌতূহল পরিতৃপ্ত করার জন্য স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে কোনোরূপ ব্যতিক্রম বা বিঘ্ন সৃষ্টি করার প্রয়োজন নাই; তাহাকে বরং প্রশংসনীয় কৌতূহলের জন্য উৎসাহিত করিয়া স্কুলের সময়ের পরে, অন্য উপায়ে–যেমন পাঠাগার হইতে বই লইয়া, কিভাবে যে কৌতূহল নিবৃত্ত করিতে পারিবে সে সম্বন্ধে উপদেশ ও নির্দেশ দান করা উচিত। এই বিষয়ে যেরূপ তর্ক উঠিতে পারে আগেই তাহার আলোচনা করা যাক। ছাত্রের কৌতূহলকে উৎসাহিত করিতে হইবে বলা হইয়াছে কিন্তু এ কৌতূহল যদি বিকৃত হয় তবে কি করা হইবে? বালক যদি অশ্লীলতা অথবা নিষ্ঠুরতার প্রতি কৌতূহলী হয় তবে কি করা হইবে? অন্যে কি করে কেবল তাহা জানিতেই যদি তাহার কৌতূহল হয় তবে কি করা হইবে? এইরূপ কৌতূহলেও কি তাহাকে উৎসাহ দিতে হইবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদিগকে একটি পার্থক্যের কথা মনে রাখিতে হইবে। কখনই আমাদের এইরূপ আচরণ করা উচিত নহে যাহাতে বালকের কৌতূহল কেবল একই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অবাঞ্ছনীয় বিষয়ের প্রতি কৌতূহলের উদ্রেক হইয়াছে বলিয়াই বালককে অপরাধী মনে করার কিংবা তাহার নিকট হইতে ওই সব বিষয়ের জ্ঞান লুকাইয়া রাখিবার কোনো প্রয়োজন নাই। প্রায় সকল ক্ষেত্রে দেখা যায়, এইসব বিষয় বালকের নিকট হইতে গোপন রাখার ফলেই ইহাদের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়; কতক ক্ষেত্রে মানসিক রোগ এইজন্য দায়ী এবং এই রোগের চিকিৎসা করানো আবশ্যক। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই বাধা নিষেধ ও নৈতিক ভীতি প্রদর্শন ইহার নিরাময় করার উপযুক্ত উপায় নহে। অশ্লীলতার প্রতি কৌতূহলের উদাহরণটি লওয়া যাক; সাধারণভাবে এটি ব্যাপক আকারে দেখা যায়।

অশ্লীলতার প্রতি কৌতূহল : যে বালক বা বালিকার কাছে যৌন বিষয়ের জ্ঞান অন্যান্য বিষয়ের মতোই অতি সাধারণ, অর্থাৎ কোনোরূপ বাধা নিষেধ বা গোপনতার অবলম্বনের ফলে ইহার প্রতি যাহার কোনো আকর্ষণ সৃষ্টি হয় নাই তাহার নিকট ইহার কোনো মোহ বা কৌতূহল থাকিতে পারে না। যে বালক কোনো অশ্লীল ছবি সংগ্রহ করে সে ইহা সংগ্রহ করার কৌশলের জন্য এবং ছবির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাহার অন্য সঙ্গীদের তুলনায় বেশি কিছু জানে ইহা ভাবিয়া গর্ব বোধ করে। তাহাকে যদি যৌন বিষয় সম্বন্ধে খোলাখুলিভাবে আগেই বলা হইত তবে সে এইরূপ ছবিতে বিশেষ কোনো কৌতূহল বোধ করিত না। ইহা সত্ত্বেও যদি কোনো বালক এইরূপ ছবির প্রতি এবং যৌনজীবনের প্রতি কৌতূহল দেখাইতে থাকে তবে আমি বিশেষজ্ঞের দ্বারা তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিব। চিকিৎসার পদ্ধতি হইবে এইরূপ : প্রথমে বালককে তাহার মনের সব চিন্তা ও বাসনা তাহা যতই অশ্রাব্য বা অকথ্য হউক না কেন প্রকাশ করিয়া চলিতে উৎসাহ দিতে হইবে; এই সম্বন্ধে তাহাকে আরও অনেক বেশি বিষয় জানানো হইবে, এইভাবে তাহাকে যৌনজীবনের বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি জানাইলে ইহার প্রতি তাহার কৌতূহল নিভিয়া আসিবে। সে যখন বুঝিবে যে, এই সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু জানিবার নাই এবং যাহা জানা হইয়াছে তাহাও চমকপ্রদ নয় তখন সে এই মানসিক ব্যাধি হইতে আরোগ্য লাভ করিবে। এই বিষয়ে বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, যৌনজ্ঞান দোষের কিছু নয়, কেবল কোনো কিছু সম্বন্ধে সর্বদা চিন্তায় তন্ময় হইয়া থাকাই ক্ষতিকর। জোর করিয়া মনকে অন্য কোনো বিষয়ে নিবদ্ধ করিলে এইরূপ তন্ময়তার ঝোঁক নিবারণ করা যায় না, মানসিক ব্যাধিও নিরাময় হয় না, ইহার জন্য বরং দরকার সেই বিষয়েই তাহাকে আরও বেশি করিয়া ভাবিবার এবং জানিবার সুযোগ দেওয়া। এই উপায়ে তাহার অস্বাভাবিক এবং অসুস্থ মনের পরিচয়ক বাসনাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা চলে। ইহা করা হইলে তখন সে-কৌতূহল আর অপকারক হয় না বা মনকে কেবল একই দিকে সর্বক্ষণ নিবদ্ধ করিয়া রাখে না। আমার বিশ্বাস, ইহাই কোনো সংকীর্ণ এবং অস্বাভাবিক কৌতূহল দমন করিবার প্রকৃষ্ট উপায়। নিষেধ করিয়া বা নৈতিক শাস্তির ভয় দেখাইয়া ইহা নিবৃত্ত করিতে গেলে বিপরীত ফলের সম্ভাবনাই বেশি।

চরিত্রের উন্নতিসাধন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য নয়, তবু মানব-চরিত্রের কতকগুলি বাঞ্ছিত গুণ আছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য যেগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয়। ইহাদিগকে বুদ্ধিমূলক গুণ বলা যাইতে পারে। বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ফলস্বরূপ ইহাদের বিকাশ সাধিত হওয়া উচিত, গুণ হিসাবে পৃথকভাবে ইহাদিগকে আয়ত্ত করার প্রশ্ন ওঠে না, জ্ঞান অর্জনের সাধনায় স্বাভাবিকভাবেই এইগুলি আয়ত্ত হওয়া প্রয়োজন। এইরূপ গুণগুলির মধ্যে আমার কাছে প্রধান মনে হয় : কৌতূহল, মুক্ত মনোভাব, জ্ঞান অর্জন কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয় এই ধারণা, ধৈর্য, অধ্যবসায়, একাগ্রতা এবং যথার্থতা [Exactness]। ইহাদের মধ্যে কৌতূহলই মূল; যথায় কৌতূহল খুব প্রবল এবং ঠিক পথে পরিচালিত হয় তথায় অন্যগুলি আপনা হইতেই আসিবে। কিন্তু কৌতূহল হয়তো এত সক্রিয় নয় যে সমগ্র বুদ্ধিমূলক জীবনের ভিত্তিস্বরূপ হইতে পারে। কোনো কঠিন কিছু কাজ করিবার বাসনাও থাকা উচিত; যে জ্ঞান অর্জন করা হইবে তাহা শিক্ষার্থীর নিকট কৌশল বলিয়া বোধ হইবে, যেমন কৌশল আয়ত্ত হয় খেলার বা দৈহিক ক্রীড়া প্রদর্শনে। প্রথমদিকে স্কুলে, কৃত্রিম কাজ আয়ত্ত করার ভিতর দিয়াই কৌশল অর্জন করিতে হইবে, ইহার ব্যতিক্রম করা কঠিন; কিন্তু স্কুলের কাজের বাহিরের কোনো কাজে কৌশল আয়ত্ত করার বাসনা ছাত্রের মনে জাগাইতে পারিলে প্রকৃত উপকার করা হইবে। শিক্ষাকে জীবনের সহিত সম্পর্ক শূন্য করা শোচনীয় ব্যাপার; কিন্তু স্কুল জীবনে ইহা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা যায় না। যেখানে পরিহার করা একান্তই অসম্ভব সেখানে জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন যে জ্ঞান আয়ত্ত করার প্রশ্ন ওঠে, ব্যাপক অর্থে তাহার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা করা দরকার; ছাত্র যেন বুঝিতে পারে তাহার বর্তমান জীবনের সঙ্গে সেরূপ জ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সংযোগ না থাকিলেও তাহারও প্রয়োজনীয়তা আছে এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাহা কাজে লাগিতে পারে। ইহা ছাড়াও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ কৌতূহলের জন্য আমি অনেকটা স্থান-দিব; ইহা ব্যতীত অনেক মূল্যবান জ্ঞান কখনই মানুষের আয়ত্ত হইত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়–বিশুদ্ধ গণিতের কথা [Pure Mathematics]। এমন অনেক শিক্ষণীয় বিষয় যাহা অন্য কোনো প্রয়োজনে না লাগিলেও কেবল জ্ঞানের জন্যই আমার কাছে মূল্যবান মনে হয়। যে-কোনো রকম জ্ঞান অর্জন করিতে হইলেই ছাত্রগণ তাহা হইতে কিছু লাভের আশা করুক অথবা কোনো উদ্দেশ্য সম্মুখে রাখিয়া অগ্রসর হউক ইহা আমি চাই না। উদ্দেশ্য বা লাভ নিরপেক্ষ কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা যায় না তথায়ই কেবল দক্ষতা অর্জনের বাসনা জাগাইবার চেষ্টা করিব যে দক্ষতা কাজে প্রকাশ করা যায়। শিক্ষার্থীর জীবনে প্রত্যেকটি উদ্দেশ্যেরই প্রয়োজনীয়তা আছে–জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত বিষয়ের প্রতি কৌতূহলের যেমন আবশ্যকতা আছে, উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ কৌতূহলেরও তেমনই মূল্য আছে। ইহাদের একটির প্রতি বেশি জোর দিতে গিয়া অন্যটিকে উপেক্ষা করা উচিত হইবে না।

শিক্ষার্থীর জ্ঞান লাভের বাসনা যদি অকৃত্রিম হয় তবে তাহার মনও থাকে উন্মুক্ত। যাহা কিছু জ্ঞাতব্য তা সবই জানিয়াছি এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন আরও অন্য কামনা একত্রে তালগোল পাকাইয়া যায় তখনই আমাদের ভোলা মন আর থাকে না, কোনো নির্দিষ্ট অভিমত আমাদের মনে স্পষ্ট হইয়া ওঠে। এইজন্য বাল্যে এবং প্রথম যৌবনে আমাদের মন যতখানি উন্মুক্ত এবং অন্যের নিকট হইতে ভাব গ্রহণের জন্য বা বিচার করিয়া দেখিবার জন্য প্রস্তুত থাকে শেষ বয়সে ততখানি থাকে না। কোনো বিষয় সম্বন্ধে বয়স্ক ব্যক্তিরা যে অভিমত পোষণ করেন তাহার সহিত তাহাদের কার্যকলাপ ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ধর্মযাজক ধর্মের অনুশাসন সম্বন্ধে অথবা সৈনিক যুদ্ধ সম্পর্কে উদাসীন হইতে পারেন না। আইনজীবী বলিবেন অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত, তবে আসামিপক্ষে নিযুক্ত হইলে তিনি তাহার শাস্তি না দেওয়ার পক্ষেই যুক্তি প্রর্দশন করিবেন। স্কুল শিক্ষক যেরূপ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ট্রেনিং লইয়াছেন এবং যাহার ভিতর কাজ করিয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়াছেন তাহাই সমর্থন করিবেন। যে রাজনৈতিক দলে থাকিলে উচ্চপদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা রাজনীতিক সে-দলের মতবাদ না মানিয়া পারেন না। উপজীবিকা হিসাবে একজন যখন কোনো কাজ নির্বাচন করিয়া লয় তখন ইহা আশা করা যায় না যে, সে সর্বদা এই চিন্তা করিবে সে অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করিলেই ভাল হইত। অতএব দেখা যায়, পরবর্তী জীবনে ভোলা মনে কোনো বিষয়ে অভিমত প্রকাশ বা পোষণ করায় নানা প্রতিবন্ধক আছে কিন্তু শিশু ও কিশোরের জীবনে উইলিয়াম জেমসের কথায় জোর করিয়া চাপানো মত গ্রহণ করার অবস্থা বেশি ঘটে না। এইজন্যই সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করার প্রবণতাও কম থাকে। বয়স্ক ব্যক্তিরা কর্মজীবনে শিশুদের মতো ভোলা মন রাখিতে পারে না। ইহা স্বাভাবিক; কেননা চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা এবং অবস্থার চাপে তাহাদিগকে কোনো বিষয় সম্বন্ধে অভিমত গ্রহণ করিতে হয়। তাহাদিগকে অনেক সময় নিজেদের বিবেকের নির্দেশসম্মত না হইলেও স্বার্থের যাহা অনুকূল এমনভাবেই মতামত গড়িয়া তুলিতে হয়। তরুণদিগকে উৎসাহ দেওয়া উচিত যাহাতে তাহারা প্রত্যেকটি প্রশ্ন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করিয়া নিজেদের বিচার বুদ্ধিমতো অভিমত প্রদান করিতে পারে। এই চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ এই নহে যে, স্বেচ্ছামত যে-কোনোরূপ আচরণ করার অধিকারও তাহাদের থাকিবে। কোনো লোকের সমুদ্রে বীরত্ব প্রদর্শনের কাহিনী শুনিয়াই যে বালকগণ সমুদ্রে ঝাপাইতে যাইবে তাহাদিগকে এতখানি স্বেচ্ছাচারী হইতে দেওয়া ঠিক হইবে না। তবে তাহাদের ছাত্রাবস্থায় তাহারা যদি এইরূপ রোমাঞ্চকর অভিযানের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং মনে করে যে অধ্যাপক হওয়া অপেক্ষা জলদস্যু হওয়া বেশি বাঞ্ছনীয়। তবে তাহাকে এইরূপ চিন্তার স্বাধীনতা দিতে কোনোরূপ আপত্তি করা উচিত নয়।

একাগ্রতা : মনোবিকাশের ক্ষমতা বা একাগ্রতা একটি অতি মূল্যবান মানসিক গুণ কিন্তু শিক্ষা ব্যতীত ইহা অর্জন করা যায় না। ইহা অবশ্য সত্য যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে একাগ্রতা স্বভাবতই বাড়িতে থাকে; শিশুরা কোনো বিষয়েই কয়েক মিনিটের বেশি মনোনিবেশ করিতে পারে না কিন্তু বয়স যত বাড়িতে থাকে তাহাদের চঞ্চলমতিত্ব তত কমিতে থাকে। তথাপি বহুদিনব্যাপী বুদ্ধিগত শিক্ষা ব্যতীত তাহারা যথোপযুক্ত পরিমাণে মানসিক একাগ্রতা অর্জন করিতে পারে না। পূর্ণাঙ্গ একাগ্রতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে : ইহা হইবে তীব্র, দীর্ঘদিন স্থায়ী এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। একাগ্রতা কতখানি নিবিড় এবং গম্ভীর হইতে পারে আর্কিমিডিসের কাহিনীই তার প্রমাণ। একটি অঙ্কের সমস্যায় তিনি এমন তন্ময় হইয়াছিরেন যে, রোমান সৈন্যগণ কখন সায়রাকিউজ দখল করিয়া তাহাকে হত্যা করিতে তাহার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল তিনি তাহা কিছুই জানিতে পারেন নাই। কোনো কঠিন কাজ সম্পন্ন করিতে এবং এমন জটিল ও সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান বাহির করিতে একই কাজে গভীর একাগ্রতার প্রয়োজন। কোনো বিষয়ের প্রতি অনুরাগ থাকিলে স্বাভাবিকভাবেই এইরূপ তন্ময়তা আসে। অনেকেই কোনো যান্ত্রিক হেঁয়ালি বা ধাঁধার মধ্যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনোনিবেশ করিতে পারে কিন্তু ইহার বিশেষ মূল্য নাই। একাগ্রতা যখন ইচ্ছা দ্বারা চালিত হইবে তখনই বলা যায় যথার্থ মূল্যবান। ইহা বলার উদ্দেশ্য এই যে, কতক জ্ঞানের বিষয় স্বভাবতই নীরস, তবু ইচ্ছাশক্তির বলে লোকে তাহাতেও নিরবচ্ছিন্নভাবে মনোনিবেশ করিতে পারে। আমার মনে হয় উক্ত শিক্ষার ফলেই লোকে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করিয়া এইরূপ একাগ্রতা লাভ করিতে পারে। এই একটি ব্যাপারে প্রাচীন প্রণালীর শিক্ষা প্রশংসনীয়; স্বেচ্ছায় কোনও নীরস কাজে আগ্রহের সঙ্গে মনোনিবেশ করাইতে বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী প্রাচীনের মতো এতখানি সফলতা লাভ করে কি না সন্দেহ। যাহাই হউক বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে এই দোষ বিদ্যমান থাকিলেও তাহা অসংশোধনীয় নহে। প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালী শিক্ষার্থীর মনঃপ্রবৃত্তির উপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করিত না। কোনো শিক্ষণীয় বিষয় শিক্ষার্থীর নিকট সরস কি নীরস মনে হইবে তাহার বিচার না করিয়া তাহার উপর চাপাইয়া দেওয়া হইত। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ছাত্রকে তাহা শিক্ষা করিতেই হইত। ইহার ফলে অনেক নীরস বিষয়বস্তুর প্রতিও নিবিষ্টভাবে মনোনিবেশ করিতে হইত। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা হইবে।

ধৈর্য ও অধ্যবসায় সুশিক্ষার ফলস্বরূপ বিকশিত হয়। পূর্বে মনে করা হইত যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাহিরেই কর্তৃপক্ষের শাসনের ফলে যে সদভ্যাস গঠিত হয় কেবল তাহা দ্বারাই এই-গুণগুলি অর্জন করা সম্ভব। কঠোর শাসনের ভিতর দিয়া প্রথমে ঘোড়াকে বাগ মানাইতে হয়; ইহা দেখিয়া মনে হয় এইরূপ শাসনে সংযত করার ও সদভ্যাস গঠন করানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু ইহার জন্য জোরজবরদস্তি না করিয়া ছাত্রকে প্রথমে সহজ একটি কাজে সাফল্য লাভ করিতে দিয়া তাহাকে ক্রমে কঠিনতর বিষয়ে কৃতকার্যতা অর্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় উৎসাহিত করা যায়। ধৈর্য ও নিষ্ঠার ফলে সাফল্য অর্জিত হইলে তাহা ছাত্রকে পুরস্কার লাভের আনন্দময় অভিজ্ঞতা দান করে; পরে ক্রমে ধৈর্য ও চেষ্টার পরিমাণ বৃদ্ধি করা চলে। জ্ঞান অর্জন কঠিন হইলেও অসম্ভব নয়–এই বিশ্বাসও ঠিক অনুরূপভাবে শিক্ষার্থীদের মনে সঞ্চার করা যায়। এইজন্য তাহার দ্বারা প্রথমে সহজ হইতে শুরু করিয়া ক্রমে কঠিন সমস্যা সমাধান করাইয়া তাহার আত্মবিশ্বাস জন্মাইয়া লইতে হয়।

ইচ্ছামতো যে কোনো নীরস বিষয়েও মনোনিবেশের শক্তির মতোই নির্ভুলতার প্রতিও শিক্ষা-সংস্কারকগণ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন না। ডক্টর ব্যালার্ডের মতে বিলাতের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অনেক বিষয়ে পূর্বের অপেক্ষা যথেষ্ট উন্নত হইয়াছে কিন্তু ছাত্রদের লিখিত উত্তরের নির্ভুলতা আগের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পাইয়াছে। তিনি বলেন :

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই শতকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে বার্ষিক পরীক্ষায় যে প্রশ্ন দেওয়া হইত তাহার উত্তর বিবেচনা করিয়া বিদ্যালয়ের আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করা হইত। এইরূপ বহু প্রশ্ন এখনও রক্ষিত আছে। বর্তমানের ছাত্রছাত্রীদিগকে এই একই প্রশ্ন উত্তর করিতে দিলে ফল হয় পূর্বের অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট। ইহার কারণ যাহাই বলি না কেন, এই বিষয়ে যে অবনতি ঘটিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। সমগ্রভাবে ধরিলে আমাদের বিদ্যালয়ের কাজ অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ, পঁচিশ বৎসর পূর্বে যেমন ছিল এখন তাহা অপেক্ষা অনেক কম নির্ভুল হয়।

এই বিষয়ে ডক্টর ব্যালার্ডের আলোচনা এমন চমৎকার যে, ইহার উপর আমার আর বিশেষ কিছু বলিবার নাই। তাহার উপসংহারের কথা কয়েকটি উদ্ধৃত করি :

যত কিছুই বলা হউক না কেন, নির্ভুলতা বা কোনো কাজ যথার্থভাবে করার অভ্যাস এখনও একটি মহৎ এবং প্রেরণাদায়ক আদর্শ বলিয়া পরিগণিত। ইহাকে বুদ্ধির সততা বলা যায়। আমাদের চিন্তায়, বাক্যে এবং কর্মে আমরা কি পরিমাণ যথার্থ তাহা দ্বারাই আমাদের সত্যনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়।

আধুনিক শিক্ষাপ্রণালীর সমর্থকগণ মনে করেন শিক্ষা শিশুর নিকট আনন্দপ্রদ করিতে পারাই মস্ত বড় লাভ; কোনো বিষয় নিখুঁতভাবে শিক্ষা দিতে গেলে যে পরিশ্রম ও অধ্যবসায় স্বীকার করিতে হয় তাহার ফলে ছাত্রের মনে অবসাদ আসিতে পারে। এইজন্য আধুনিক প্রণালী সমর্থনকারীগণ জ্ঞানে পূর্ণাঙ্গতার উপর বেশি জোর দেন নাই। এইস্থানে ছাত্রের মানসিক অবসাদ কি ধরনের হইতে পারে তাহা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। শিক্ষক যদি জোর করিয়া কোনো কিছু ছাত্রের উপর আরোপ করেন এবং তাহার ফলে যদি সে অবসাদ বোধ করে তবে তাহা নিশ্চয়ই অপকারী। কিন্তু নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিবার জন্য ছাত্র স্বেচ্ছায় যে কঠোর পরিশ্রমের কাজে আত্মনিয়োগ করে তাহা মাত্রা অতিক্রম না করিলে সত্যই বিশেষ মূল্যবান। যে সকল বাসনা পূরণ করা রীতিমত কষ্টসাধ্য তাহা সাধন করিতে ছাত্রদিগকে উৎসাহিত করা শিক্ষার অঙ্গ হওয়া উচিত। যেমন, বীজগণিতের জটিল অঙ্ক কষা, হোমারের কাব্য পাঠ করা, ভালো বেহালা বাজানো এইরকম নানা ধরনের কাজ ছাত্রদিগকে দেওয়া চলে। ইহার প্রত্যেকটি কাজে উৎকর্ষ অর্জন করিতে নিখুঁতভাবে তাহা জানা প্রয়োজন। যোগ্য বালক বালিকা উৎসাহিত হইলে এইরূপ কাজে নিপুণতা অর্জনের জন্য অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাইতে পারে। কাজে দক্ষতা অর্জনের যোগ্য স্বাভাবিক ক্ষমতা না থাকিলেও কতক ছাত্র শিক্ষকের নিকট হইতে অনুপ্রেরণা লাভ করিয়া উৎসাহের সঙ্গে প্রবৃত্ত হইতে পারে। শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীর নিষ্ঠা, অনুরাগ এবং শেখার বাসনাই প্রধান শক্তি জোগায়, শিক্ষকের কর্তৃত্ব অনিচ্ছুক ছাত্রকে জোর করিয়া শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিতে পারে না; পিপাসা না থাকিলে যেমন ঘোড়াকে জল পান করানো যায় না তেমনই। কিন্তু তাই বলিয়া এইরূপ মনে করিবার কোনো কারণ নাই যে, প্রত্যেক স্তরেই শিক্ষা হইবে কোমল, সহজ এবং সুখদায়ক। কোনো বিষয়ে সঠিকতা অর্জনের প্রশ্নে একথা বলা চলে। নিখুঁতভাবে কিছু শিক্ষা করিতে গেলে যতেষ্ট পরিশ্রম ও ধৈর্য দরকার কিন্তু ইহা ছাড়া জ্ঞানে বা বিদ্যায় উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভবপর নয়। শিশুদিগকে ইহা বুঝাইয়া দেওয়া যায়। আধুনিক প্রণালী এই বিষয়ে অনেকটা অকৃতকার্য হইয়াছে। কারণ প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীর কঠোরতার বিরুদ্ধে যে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অতিরিক্ত শিথিলতা দেখা দিয়াছে, ইহার স্থানে নূতন শাসন বিধান গড়িয়া তুলিতে হইবে এবং এই শৃঙ্খলা বাহিরের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চাপানো শাসন হইবে না, মনোবিজ্ঞানকে ভিত্তি করিয়া শিক্ষার্থীর মনের দিক হইতে ইহা গড়িয়া তুলিতে হইবে। প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীতে বাহিরের কর্তৃপক্ষ শাসন ও শৃঙ্খলা আরোপ করিয়া শিক্ষার্থীকে সংযত রাখিতেন, কাজে নিযুক্ত থাকিতে বাধ্য করিতেন। তাহাতে শিক্ষার্থীর মনে স্বাভাবিক স্ফূর্তি থাকিত না, আধুনিক প্রণালীর শিক্ষার্থীর উপর এরূপ জবরদস্তি করার পক্ষপাতী নয় কিন্তু শৃঙ্খলা ব্যতীত শিক্ষা কখনই সম্ভব হইতে পারে না; এ শৃঙ্খলাবোধ শিশুর মনে জাগ্রত করিতে হইবে এবং আচরণে ইহার প্রকাশ দেখা যাইবে। কাজ নিখুঁততা অর্জন হইবে এইরূপ নূতন শৃঙ্খলার পরিচায়ক।

অনেক প্রকার নিখুঁততা আছে; ইহাদের প্রত্যেকটিই প্রয়োজনীয়। প্রধান কয়েকটি হইল–মাংসপেশি সঞ্চালনে নিপুণতা, সৌন্দর্য ও রসসৃষ্টিতে সূক্ষ্ম নিপুণতা, কোনো বিষয় সম্পর্কে যথার্থ, যুক্তিতর্কে নিখুঁততা। প্রত্যেক বালক বালিকাই চলা-ফেরা করিতে মাংসপেশির শোভনভাবে সঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিতে পারে; দেহের ভারসাম্য ও সুষ্ঠু গতিভঙ্গির জন্য ইহা আবশ্যক। স্বাস্থ্যবান শিশু দেহের এই স্বচ্ছন্দগতির জন্য নিজের অজ্ঞাতে প্রস্তুত হইতে থাকে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে দৌড়ানো, লাফানো, মই বাহিয়া উপরে ওঠা-নামা প্রভৃতির ভিতর দিয়া সে দেহ সঞ্চালনের কৌশল আয়ত্ত করে; এইভাবে সে পরবর্তীকালের খেলাধুলার জন্য প্রস্তুত হয়। খেলাধুলা সংক্রান্ত দৈহিক উৎসুক এবং মাংসপেশির সুষ্ঠু সঞ্চালন ছাড়াও স্কুল-জীবনে শিক্ষণীয় অন্য প্রকার নিপুণতা আছে, যেমন স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর হস্তাক্ষর, বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি শিশু প্রয়োজনীয় মনে করিবে কি না তাহা নির্ভর করিবে তাহার পরিবেশের উপর।

সৌন্দর্য বা রসসৃষ্টির নিখুঁততা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝানো মুশকিল; ইহার উদ্দেশ্য আনন্দের অনুভূতি সঞ্চার করা। সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতিতে খুঁত থাকিলে তাহা যে রসভঙ্গ করে এবং পরিপূর্ণ আনন্দ দান করে না তাহা ছাত্রদিগকে বুঝানো সহজ। শেকসপিয়রের অথবা রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা মুখস্থ করান; আবৃত্ত করিবার সময় কোথাও ভুল করিলে সে স্থান তাহাকে নিজেকে কথায় পূরণ করিতে বলুন এবং মূলের সঙ্গে পার্থক্য দেখাইয়া দিন। সে নিজেই বুঝিতে পারিবে মূল রচনার সহিত তুলনায় তাহার নিজের দেওয়া কথাগুলি কবিতার অঙ্গহানি করিয়াছে। এইভাবে সংগীত ও নৃত্যে কোথাও ভুল হইলে তাহা অশোভন হয় এবং তাহার ফলে মানুষেরা সূক্ষ্ম রসবোধ তৃপ্তি লাভ করে না। আবৃত্তি, সংগীত এবং নৃত্য ছাত্রদিগকে নিখুঁততা শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। অঙ্কনও শিশুদিগকে নিখুঁত কাজের উৎসাহ দেয় কিন্তু রসোপলব্ধির উপাদান হিসাবে ইহার মূল্য খুব বেশি নহে।

মডেল দেখিয়া অংকন, ছাত্রের নিখুঁততা শিক্ষার উপাদান হিসাবে কাজে লাগানো চলে কিন্তু ইহার মূল্য খুব বেশি নহে; কারণ সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য প্রভৃতি যেমন নিখুঁত হইলে আনন্দদান করে এবং ছাত্র ইহার মাধ্যমে নূতন সৃষ্টির আনন্দ বোধ করে, অঙ্কনের ক্ষেত্রে তেমন নয়; একটি নির্দিষ্ট বস্তু দেখিয়া ঠিক অনুরূপ করিয়া আঁকায় নূতন সৃষ্টির আনন্দ নাই। এই হিসাবে সংগীত, নৃত্য আবৃত্তি অঙ্কনের অপেক্ষা ছাত্রকে নিখুঁততা অর্জনে বেশি আনন্দ দেয়। ইহা সত্য যে, কোনো মডেল দেখিয়া আঁকিতে গেলে মামুলি এবং বাঁধাধরা উপায়ই গ্রহণ করিতে হয়, নূতন সৃষ্টির উন্মাদনা। মডেল ভালো বলিয়াই ইহার নকল আঁকা হয়, যে কোনো জিনিসের নকল করাই যে ভালো তাহা নহে।

ইতিহাসের সন তারিখ এবং ভূগোলে উল্লিখিত স্থানের নাম প্রভৃতি যথাযথ মনে রাখা অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার। ইংল্যাণ্ডের রাজাদের রাজত্বের তারিখ এবং প্রধান জেলাগুলির নাম মুখস্থ করা বিলাতের ছেলেমেয়েদের কাছে এক ভয়াবহ বিষয় ছিল। আমি অন্তরীপগুলির নাম মনে রাখিতে পারিতাম না কিন্তু আট বৎসর বয়সে আমি ভূগর্ভস্থ রেল লাইনের প্রায় সবগুলি স্টেশনের নাম বলিতে পারিতাম। পুত্র কন্যাদিগকে যদি সিনেমার ছবিতে দেশের উপকূল দিয়া জাহাজ চালানো ছবি দেখানো যায় তবে তাহারা শীঘ্রই অন্তরীপগুলি চিনিয়া ফেলিবে। এইগুলি শেখা যে একান্তই কর্তব্য তাহা আমি বলি না; আমি বলিতে চাই যে, ইহা শিখানোর প্রকৃষ্ট পন্থা হইল চলচ্চিত্রে ইহা দেখানো। সিনেমার মারফত সমগ্র ভূগোল শিক্ষা দেওয়া উচিত; ইতিহাসও প্রথমে এইভাবে শিকানো উচিত। ইহার জন্য প্রাথমিক খরচ পড়িবে খুব বেশি কিন্তু গভর্নমেন্টের পক্ষে ইহা খুব বেশি নয়। ইহার ফলে এ বিষয়গুলি শিখানো সহজ হইয়া আসিবে।

যুক্তিতর্কের নিখুঁততা এবং বিচারবুদ্ধি কিঞ্চিৎ বেশি বয়সে অধিগত হয়; শিশুদের নিকট হইতে ইহা আশা করা উচিত হইবে না। নামতার ছক মুখস্ত করিয়া গুণফল মুখে মুখে বলার নিখুঁততা আছে বটে কিন্তু প্রথমে শিশু ইহা না বুঝিয়াই মুখস্থ করে এবং পরে সে ইহার ভিতরকার যুক্তি বুঝিতে পারে। যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষের জন্য অঙ্কশাস্ত্রই স্বাভাবিক পন্থা কিন্তু ইহা যদি কতকগুলি নীরস এবং পূর্ব নির্দিষ্ট কানুন বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় অর্থাৎ ইহার মধ্যে যে যুক্তির প্রয়োগ রহিয়াছে তাহা লক্ষ্য করা না হয় তবে এই শিক্ষা ব্যর্থ। নিয়মকানুনগুলি অবশ্যই শিখিতে হইবে কিন্তু এক সময়ে শিশুর কাজে ইহার মূলে যে যুক্তি রহিয়াছে তাহা বুঝাইয়া দিতে হইবে, নতুবা অঙ্কের কোনো শিক্ষা-মূল্য নাই।

এখানে একটি প্রশ্ন আলোচনা করা যাক : শিক্ষাদান সকল অবস্থাতে আনন্দপ্রদ করা সম্ভব কি না কিংবা বাঞ্ছনীয় কি না। পূর্বে ধারণা ছিল ইহার বেশিরভাগই নীরস, কেবল কর্তৃপক্ষের কঠোর শাসনে শিশু ইহা গ্রহণ করিত। (বেশিরভাগ মেয়েই অজ্ঞ থাকিত) আধুনিক শিক্ষাবিদগণের অভিমত এই যে, শিক্ষা আগাগোড়া আনন্দদায়ক করা চলে। আধুনিকদের অভিমতের প্রতিই আমার সহানুভূতি বেশি, তথাপি আমার মনে হয়, শিক্ষা সকল স্তরেই বিশেষ করিয়া উচ্চশিক্ষায় ইহা সর্বদা সম্ভবপর হয় না।

শিশু মনোবিজ্ঞানের আধুনিক লেখকগণ সকলেই এই কথাটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন যে, খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য শিশুকে পীড়াপীড়ি করা অনুচিত; শিশু স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইহা করিবে; এইজন্য তোষামোদ বা জোর করার কোনো প্রয়োজন নাই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এই অভিমতের সত্যতা প্রমাণ করিয়াছে। প্রথমে আমরা শিশু-শিক্ষার এই নূতন প্রণালী জানিতাম না বলিয়া প্রাচীন পন্থা অনুসরণ করিয়াছিলাম। এই প্রণালী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছিল কিন্তু নূতন প্রণালীতে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করি। কেহ যেন ইহা মনে না করেন যে, আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী প্রয়োগ করিতে গিয়া আধুনিক পিতামাতা সন্তানের খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য কিছুই করেন না; পক্ষান্তরে শিশু সদভ্যাস গঠনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইয়া থাকে। নিয়মিত খাবার সময় আসে, শিশু ভোজন করুক বা না করুক খেলাধুলা বাদ দিয়া তখন তাহাকে অন্যের সঙ্গে একত্রে বসিতেই হইবে। নিয়মিত সময়ে তাহাকে ঘুমাইতে যাইতে হইবে। বিছানার মধ্যে সে কোনো খেলনা প্রাণী আদর করিবার জন্য কাছে রাখিতে পারে কিন্তু এমন কৈানো খেলনা রাখা চলিবে না যাহা টিপিলে শব্দ করে, স্প্রিং কষিয়া দিলে যাহা ছুটাছুটি করে কিংবা অন্য কোনো প্রকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে। শিশুকে বরং বলা যায়–পোষা প্রাণীটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাকে ঘুম পাড়াও। তারপর তাহাকে একা থাকিতে দিন, শীঘ্রই সে ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু শিশুকে কখনোই বুঝিতে দিবেন না যে, তাহার খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য আপনি উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িয়াছেন; ইহা বুঝিতে পারিলে সে মনে করিবে আপনি তাহার নিকট একটু অনুগ্রহ চাহিতেছেন; নিজের শক্তি সম্বন্ধে সে সচেতন হইয়া উঠিবে এবং ক্রমেই বেশি বেশি আদর-আপ্যায়ন বা শাস্তি দাবি করিতে থাকিবে। সে যেন বুঝিতে পারে যে আপনাকে খুশি করিবার জন্য নয়, তাহার নিজের তাগিদেই খাওয়া এবং ঘুমানো প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের এই নীতি শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা চলে। আপনি যদি শিশুকে জোর করিয়া শিখাইতে চান, সে মনে করিবে আপনাকে খুশি করিবার জন্য সে কিছু অপ্রীতিকর কাজ করিতে বাধ্য হইতেছে। এই মনোভাবের ফলে তাহার মনে একপ্রকার প্রতিরোধ দানা বাঁধিয়া উঠে। অন্যের তাগিদে কোনো কাজ করিতে গেলে তাহাতে তাহার স্বাভাবিক প্রাণের আবেগ থাকে না, মনের ভিতর বরং একটি বিরুদ্ধ ভাব জমিতে থাকে। শিশুর প্রথম জীবনে এইরূপ ভাব সঞ্চারিত হইলে, তাহা বরাবর থাকিবে; পরবর্তীকালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বাসনায় সে পড়াশুনায় মন দিবে বটে কিন্তু জ্ঞানলাভের বাসনায় নহে। পক্ষান্তরে আপনি যদি প্রথমে শিশুর জ্ঞানলাভের স্পৃহা জাগ্রত করিতে পারেন এবং তাহার প্রতি অনুগ্রহ হিসাবে যে-শিক্ষা লাভ করিতে সে উন্মুখ তাহা দান করেন, তবে অবস্থা ভিন্নরূপ ধারণ করিবে। বাহিরে শাসনের বিশেষ প্রয়োজন হইবে না এবং শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ হইবে। এই বিষয়ে কৃতকার্য হইতে হইলে কতকগুলি শর্ত আবশ্যক। শ্রীমতী মন্তেসরি ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই অবস্থা সাফল্যের সঙ্গে সৃষ্টি করিয়াছেন। শিশুর জন্য নির্দিষ্ট কাজগুলি সহজ এবং চিত্তাকর্ষক করিতে হইবে। প্রথম অবস্থায় অন্য শিশুদিগকে কাজ করিতে দেখিয়া সে উৎসাহিত হইবে। সে সময় যেন অন্যত্র শিশুর পক্ষে অধিকতর আকর্ষণের কোনো বস্তু না থাকে। শিশু কাজে লাগাইতে পারে এমন অনেকগুলি জিনিস থাকিবে; যেটি ইচ্ছা সেটি লইয়া সে কাজ করিতে পারিবে। এইরূপ অবস্থায় প্রায় সকল শিশুই আনন্দে থাকে এবং বাহিরের কোনো প্রকার চাপ না থাকাতেও পাঁচ বৎসর বয়সের পূর্বেই পড়িতে ও লিখিতে শেখে।

এই প্রণালী বয়স্ক শিশুদের উপর কতদূর প্রয়োগযোগ্য তাহা তর্কের বিষয়। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মনও অন্যান্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়; তখন শিক্ষার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষযই যে আনন্দপ্রদ করিতে হইবে এমন কোনো আবশ্যকতা নাই। কিন্তু শিক্ষালাভের জন্য শিশুরাই আগ্রহান্বিত হইবে এই মূলনীতি শিশুর যে-কোনো বয়স পর্যন্ত চালু রাখা যায়। এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থা সৃষ্টি করিতে হইবে যাহাতে শিশু নিজেই যেন শিক্ষার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশ করে। শিক্ষাগ্রহণ কাজে ব্যাপৃত না থাকিলে তাহাকে যেন নিঃসঙ্গ অবস্থায় অবসাদের মধ্যে সময় কাটাইতে হয়। শিক্ষা লাভ করিতে আনন্দ আছে, পরিশ্রমও আছে কিন্তু ইহার বিকল্প অবস্থায় শিশু যেন আনন্দ না পায়; তাহা হইলে সে নিঃসঙ্গভাবে অবসন্ন হইয়া সময় কাটানোর পরিবর্তে শিক্ষা গ্রহণের কাজই পছন্দ করিবে। কিন্তু কোনো শিশু যদি কখনও এই বিকল্প অবস্থাই পছন্দ করে তাহাকে নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকিতে দিতে হইবে, পরে নিজের ভুল সে নিজেই বুঝিবে। শিশুর ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার নীতি সম্প্রসারণ করা চলে যদিও প্রথম কয়েক বৎসর পর সমবেতভাবে কাজ করানো অত্যাবশ্যক। কোনো বালক বা বালিকাকে যদি শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করার প্রয়োজন হয় অর্থাৎ সে যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইহাতে উৎসুক না হয় তবে তাহার দেহ বা মনের স্বাস্থ্যগত কোনো কারণ না থাকিলে, বুঝিতে হইবে যে, শিক্ষকের দোষই ইহার জন্য দায়ী কিংবা শিশুর বাল্যশিক্ষা খারাপ হইয়াছে। পাঁচ বা ছয় বৎসর পর্যন্ত শিশুর শিক্ষানুরাগ উদ্দীপ্ত করিতে পারেন।

ইহা সম্ভব হইলে সুবিধার অন্ত নাই। শিক্ষক তখন ছাত্রের শত্রু নন। তিনি তাহার বন্ধু। শিক্ষক তাহার সহযোগিতা করেন বলিয়া সে দ্রুত শিখিতে থাকে; সে পরিশ্রান্ত হয় কম, কারণ অনিচ্ছুক মনকে জোর করিয়া কোনো অপ্রীতিকর কাজে আটকাইয়া রাখার কোনো প্রশ্ন এখানে নাই। ছাত্র স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া কাজ করার আনন্দ বোধ করে, শিক্ষকের পক্ষ হইতে তাহাকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করার প্রয়োজন হয় না। অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে যদি ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় তবে সেইরূপ ছাত্রদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করিতে হয়। তবে আমার মনে হয়, শিশুর বুদ্ধি অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষাপ্রণালী অনুসরণ করিলে এরূপ ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম হইবে।

শিক্ষায় বিশেষ নিপুণতা অর্জন করিতে হইলে শিক্ষার সকল স্তরই আনন্দদায়ক করা সম্ভব হয় না। কোনো বিষয় ভালো করিয়া শিখিতে গেলে ইহার কতক অংশ নীরস মনে হইবেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এইরূপ নীরস অংশও আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তা বুঝাইয়া দিলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে বালক-বালিকা আগ্রহের সঙ্গেই ইহাতে ব্রতী হইবে। নির্দিষ্ট কাজের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ দেখিয়া কাজের প্রশংসা করিয়া বা তাহার দোষ দেখাইয়া দিয়া ছাত্রকে উৎসাহিত করিতে হইবে। এই নীরস অংশের গুরুত্ব শিক্ষক ছাত্রের নিকট সুস্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দিবেন। এই প্রণালী ব্যর্থ হইলে ছাত্রকে কমবুদ্ধিসম্পন্ন বলিয়া বুঝিতে হইবে। তখন তাহাকে অন্যান্য সাধারণ ছাত্রের শ্রেণি হইতে পৃথক করিয়া পৃথকভাবে শিক্ষাদানের বন্দোবস্ত করিতে হইবে কিন্তু লক্ষ্য রাখিতে হইবে এ ব্যবস্থাকে সে যেন শাস্তি বলিয়া গ্রহণ না করে।

শিশুর চারি বৎসর বয়সের পর পিতা বা মাতার পক্ষে তাহার শিক্ষার ভার নিজ হাতে রাখা উচিত নহে (অবশ্য খুব কর্মক্ষেত্রে ইহার ব্যতিক্রম সমর্থন করা চলে!) শিক্ষাদানের কৌশল বিশেষ শিক্ষাসাপেক্ষ কিন্তু বেশিরভাগ পিতামাতাই শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া বা কৌশল সম্বন্ধে কিছু শিখিবার সুযোগ পান না। শিশুর বয়স যত কম থাকে, তাকে শিখাইবার কৌশলও তত বেশি দরকার। ইহা ছাড়া শিশু সর্বদা পিতামাতার সঙ্গ লাভ করে; কাজেই তাহাদের আচরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে তাহার মনে কতকগুলি ধারণা স্পষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু মামুলি শিক্ষার কাজ আরম্ভ হইলে শিক্ষার প্রতি সে যেইরূপ আচরণ করিত পিতামাতার প্রতি সেইরূপ করে না। অধিকন্তু পিতা হয়তো নিজের সন্তানের পাঠোন্নতির জন্য অতিরিক্ত আগ্রহশীল হন। শিশু বুদ্ধির পরিচয় দিলে তাঁহার আনন্দের অবধি থাকে না। আবার বোকামির পরিচয় দিলে ক্রোধে কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া পড়েন। চিকিৎসক যে কারণে নিজের পরিবারের লোকজনের চিকিৎসা করেন না, পিতামাতার পক্ষেও নিজ সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ না করার অনুরূপ যুক্তি আছে। কিন্তু আমি এ-কথা বলি না যে, তাঁহাদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে যাহা সম্ভব সন্তানকে সেইরূপ শিক্ষাও দেওয়া উচিত নয়; আমার বক্তব্য এই যে, অন্যের ছেলেমেয়ের পক্ষে ভালো শিক্ষক হইলেও পিতামাতা সাধারণত নিজেদের সন্তানের বিদ্যালয়ের পাঠ শিখানোর পক্ষে সর্বোত্তম নন।

শিক্ষার প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষাকাল ব্যাপিয়া ছাত্রের মনে এই ধারণা জাগাইয়া রাখিতে হইবে যে, সে যেন বুদ্ধিমূলক রোমাঞ্চকর অভিযানের প্রবৃত্ত হইয়াছে। ইহার উদ্দেশ্য, জানিবার ভিতর দিয়া অজানাকে জয় করা। এই বিশ্বজগতে বহু জটিল বিষয় আছে, যেইগুলি একনিষ্ঠ চেষ্টার দ্বারা বুঝিতে পারা যায়; জটিল এবং কঠিন বিষয় বুঝিতে পারায় মানসিক উল্লাস আছে। প্রত্যেক যোগ্য শিক্ষক ছাত্রকে ইহা উপলব্ধি করাইতে পারেন। মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিশুরা যখন প্রথম দেখে যে, তাহারা লিখিতে শিখিয়াছে তখন তাহাদের যে কিরূপ বিপুল উল্লাস হয় তাহা শ্রীমতী মন্তেসরি বর্ণনা করিয়াছেন : আমি যখন প্রথম মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত নিউটন-লিখিত কেপলারের দ্বিতীয় সূত্র [Keplers Second Law] পাঠ করি তখন আনন্দে আত্মহারা হইয়াছিলাম। এইরূপ বিশুদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় আনন্দ খুব কমই আছে। নিজের চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত উদ্যম ছাত্রকে নূতন আবিষ্কারের আনন্দ দান করে এবং এইভাবেই তাহার বুদ্ধিগত রোমাঞ্চকর অভিযান সার্থক এবং জয়যুক্ত হয়। সেখানে সব কিছুই কেবল ক্লাসে শিখানো হয়, ছাত্রকে স্বচেষ্টায় কোনো বিষয় অধিগত করিতে উৎসাহিত করা হয় না; সেইখানে এই মানসিক আনন্দ বোধের সুযোগও কম। যে স্থানেই সুযোগ পাওয়া যায় তথায়ই ছাত্রকে এই বুদ্ধি অভিযানে উৎসাহিত করুন; ইহাতে সে নিষ্ক্রিয় না থাকিয়া সক্রিয় হইয়া উঠিবে। ইহাই শিক্ষাকে শিশুর কাছে কষ্টদায়ক না করিয়া আনন্দময় করিবার অন্যতম উপায়।

চৌদ্দ বৎসরের পূর্বে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম : কি শিক্ষা দেওয়া হইবে? এবং কেমন করিয়া শিক্ষা দেওয়া হইবে? এই প্রশ্ন দুইটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যোগসূত্র বিদ্যমান রহিয়াছে, কারণ শিক্ষার জন্য উন্নত ধরনের প্রণালী অবলম্বন করিলে বেশি শিক্ষা করা সহজসাধ্য। শিক্ষণীয় বিষয় যদি ছাত্রের নিকট নীরস মনে না হয় এবং সে যদি স্বেচ্ছায় শিক্ষার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে তবে বেশি পরিমাণ শিখানো সম্ভবপর হয়। শিক্ষার প্রণালী সম্বন্ধে পূর্বে মোটামুটি বলা হইয়াছে, পরবর্তী অধ্যায়ে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইবে। এখন ধরিয়া লওয়া হইতেছে যে, উন্নত শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করা। হইয়াছে। কি শিক্ষা দেওয়া উচিত তাহাই এই অধ্যায়ে আলোচিত হইতেছে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে কি জানা উচিত তাহা বিবেচনা করিলে বোঝা যায় এমন কতক বিষয় আছে যাহা প্রত্যেকের জানা প্রয়োজন এবং কতক অল্পসংখ্যক লোকের ভালো করিয়া শেখা দরকার, সকলের জানা না থাকিলেও চলে। কতক লোককে ভালো করিয়া চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করিতে হইবে কিন্তু বেশিরভাগ লোকের পক্ষেই শারীরবিদ্যা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মোটামুটি বিষয় ও নিয়মগুলি জানা থাকিলেই যথেষ্ট। কতককে উচ্চ গণিত শিক্ষা করিতে হইবে কিন্তু যাহাদের নিকট ইহা মোটেই প্রীতিপদ নয় তাহারা গণিতের সাধারণ মৌলিক বিষয় জানিলেই চলে। কতককে ট্ৰমবোন (জয়ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র) বাজানো শিখিতে হইবে কিন্তু সকল ছাত্রেরই ইহা অভ্যাস করিবার আবশ্যকতা নাই। চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে প্রধানত এমন জিনিসই শিক্ষা দেওয়া উচিত যাহা সকলেরই শিক্ষা করা প্রয়োজন। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্রের কথা বাদ দিলে, কোনো বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা সাধারণত পরবর্তীকালে দিতে হইবে। তবে এই সময়েই অর্থাৎ চৌদ্দ বৎসরের পূর্বেই বালক বা বালিকার কোন বিষয় শিক্ষার দিকে বেশি প্রবণতা আছে তাহা লক্ষ্য করিতে হইবে যাহাতে পরবর্তীকালে তাহার বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয়। এইজন্য প্রথম অবস্থায় প্রত্যেকের পক্ষেই শিক্ষণীয় বিষয়গুলি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা উচিত, কোনো বিষয় কাহারও ভালো লাগিলে পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার স্তরে তাহার জের টানিবার প্রয়োজন নাই।

প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তির কে কোন বিষয় শিক্ষা করা উচিত তাহা নির্ধারিত হইলে প্রথমে ঠিক করিতে হইবে কোনটি আগে এবং কোনটি তাহার পর শিখাইতে হইবে। এইস্থানে নীতি হইবে, সহজটি আগে শিখাইতে হইবে এবং কঠিন বিষয়গুলি পরে ক্রমে ক্রমে আসিবে। ছাত্রদের বিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকে এই নীতিই শিক্ষাক্ষেত্রে অবলম্বিত হয়।

আমি ধরিয়া লইব যে, শিশুর পাঁচ বৎসর বয়স হইতে হইতেই সে পড়িতে এবং লিখিতে শিখিয়াছে। মন্তেসরি স্কুল কিংবা ইহার অপেক্ষা অন্য উন্নত ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইলে তথায় শিশুর এই প্রাথমিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হইবে। মন্তেসরি স্কুলে বিভিন্ন খেলনা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে করিতে শিশুর নানা জিনিসের আকৃতি, আয়তন, পরিমাণ, ওজন প্রভৃতি সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মে। অঙ্কন, সংগীত ও নৃত্যশিক্ষারও সূত্রপাত হয়। অপর শিশুর মধ্যে থাকিয়াও শিক্ষামূলক কোনো বিষয় মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাসও এই সময় গঠিত হয়। অবশ্য পাঁচ বৎসর বয়সে শিশুর এই গুণগুলি পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হইবে না; পরে আরও কিছুদিন তাহাকে এই সকল বিষয়ে শিক্ষা লাভ করিতে হইবে। আমার মনে হয় শিশুকে সাত বৎসর বয়সের পূর্বে কোনোরূপ গুরুতর মানসিক পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করা উচিত নহে। তবে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োগ করিলে শিশুর অসুবিধাগুলি অনেক পরিমাণে লাঘব করা যায়। ছেলেবেলায় গণিত একটি ভয়ের বিষয়; মনে পড়ে গুণনের নামতা মনে রাখিতে না পারিয়া বাল্যকালে আমি বহুদিন কাদিয়াছি। গুণনের ছক ধীরে ধীরে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় শিশুকে আয়ত্ত না করাইলে ইহা দুরূহ রহস্য বলিয়া বোধ হয় এবং তাহার মনে গভীর নৈরাশ্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু মন্তেসরি স্কুলে যেমন সরঞ্জামের সাহায্যে ক্রমে ক্রমে এবং যত্নের সঙ্গে ইহা শিক্ষা দেওয়া হয় তাহাতে এইরূপ ভীতি বা নৈরাশ্যের কোনো কারণ ঘটে না। তবে অঙ্ক কষা ভালো করিয়া শিখিতে হইলে শিশুকে নিয়ম মুখস্থ করার অপ্রীতিকর ও নীরস কাজটি করিতেই হইবে। শৈশবের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম যখন শিশুদের নিকট আনন্দদায়ক করার চেষ্টা হয় তখন এই বিষয়টি সেখানে স্থান দিলে কিছুটা বিসদৃশ হয় বটে কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরেই ইহা করিতে হয়। ইহা ছাড়া গণিত শিশুর মনকে স্বাভাবিকভাবেই যথার্থতার জন্য প্রস্তুত করে; কোনো অঙ্কের উত্তর শুধু ঠিক কিংবা ভুল হইতে পারে; ইহা বলা চলে না যে, উত্তরটি খুব আনন্দদায়ক কিংবা ভাবপূর্ণ হইয়াছে। গণিতের ব্যবহারিক উপযোগিতা তো আছেই, তাহা ছাড়া যথার্থতা শিক্ষার সহায়ক বলিয়া বাল্যশিক্ষায় ইহার গুরুত্ব অনেকখানি। প্রথম হইতেই অঙ্ক যাহাতে শিশুর কাছে ভীতিজনক বলিয়া মনে হইতে না পারে সেইজন্য কঠিনতা অনুসারে ইহার ক্রম নির্ধারণ করিয়া ধীরে ধীরে সহজ হইতে কঠিনের দিকে আগাইয়া যাইতে হয়; একসঙ্গে খুব বেশি সময় শিশুকে এ বিষয়ে নিয়োজিত রাখা উচিত নহে।

আমাদের বাল্যকালে ভূগোল ও ইতিহাস পড়ানো হইত সর্বাপেক্ষা খারাপ। ভূগোলের প্রতি আমার বিশেষ ভীতি ছিল; ইতিহাসের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ ছিল বলিয়া ইহার পাঠ কোনো রকম সহ্য করিয়াছি। এই দুটি বিষয়ই শিশুদের নিকট আনন্দদায়ক করা যায়। আমার পুত্রটি এখনও ভূগোলের পাঠ গ্রহণ করে নাই, তবু সে তাহার পরিচারিকার অপেক্ষা ভূগোলের বিবরণ বেশি জানে। অন্যান্য বালকের মতোই তাহার যে রেলগাড়ি ও স্টিমারের প্রতি আকর্ষণ আছে তাহারই ভিতর দিয়া সে জ্ঞান অর্জন করিয়াছে। তাহার কল্পনার জাহাজ কোন পথে চলিবে সে তাহা জানিতে চায় এবং আমি যখন চীনদেশে যাওয়ার পথের বর্ণনা দিই তখন সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাহা শোনে। তখন সে যদি দেখিতে চায় তবে আমি তাহাকে পথে বিভিন্ন দেশের ছবি দেখাই। সময় সময় সে বড় ভূচিত্রাবলিখানা টানিয়া লইয়া তাহাতে দেশ ভ্রমণের পথ দেখিতে চায়। আমরা প্রতি বৎসর দুইবার করিয়া লন্ডন যাই। লন্ডন ও কর্নওয়ালের মধ্যে ট্রেনে ভ্রমণে খোকা যারপর নাই আনন্দিত হয় এবং যেখানে যেখানে ট্রেন থামে অথবা যেখানে গাড়ি জুড়িয়া দেওয়া হয় সেই সব স্থানের নাম তাহার মুখস্থ। উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু তাহাকে মুগ্ধ করে কিন্তু সে ভাবিয়া পায় না পূর্ব মেরু ও পশ্চিম মেরু নাই কেন! কোন দিকে ফ্রান্স ও স্পেন দেশ এবং কোন্ দিকে আমেরিকা তাহা সে জানে; ওই সব দেশে কি কি দেখিতে পাওয়া যায় তাহাও মোটামুটিভাবে অনেক কিছু জানে। এইসব বিষয় তাহাকে শিক্ষা দিবার জন্য শিখানো হয় নাই, কৌতূহলের বসে প্রশ্ন করিয়া করিয়া সে এইসব শিখিয়াছে। ভ্রমণের সঙ্গে সংযুক্ত হইলে ভূগোল শেখার আগ্রহ প্রায় সকল শিশুরই হয়। শিশুকে ভূগোল শিখানোর উপায় স্বরূপ ছবি এবং ভ্রমণকারীদের গল্প বলা চলে কিন্তু প্রধান উপায় হইল বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকারী কি। দেখিতে পায় তাহা চলচ্চিত্রে ছাত্রদিগকে দেখানো। এমনই কতকগুলি ভৌগোলিক বিষয়ের জ্ঞান কাজে লাগিতে পারে কিন্তু ইহার বুদ্ধিমূলক কোনো মূল্য নাই। কিন্তু ছবির সাহায্যে ইহা যখন শিশুর মনে স্পষ্ট ও জীবন্ত হইয়া উঠে তখন ইহা শিশুকে কল্পনার খোরাক জোগায়। পৃথিবীতে যে গরম দেশ ও শীতল দেশ আছে, শ্বেতকায় লোকের ন্যায় কৃষ্ণকায় লোক, পীত লোক, বাদামি বর্ণের লোক এবং লোহিত বর্ণের লোকও যে আছে শিশুর পক্ষে তাহা জানা ভালো। ইহা জানা থাকায় পরিচিত ভৌগোলিক পরিবেশ শিশুর মন ও কল্পনার উপর চাপিয়া বসিয়া তাহার মনের সতেজটা নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে না এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশ সে সত্য সত্যই আছে–এই বোধ জন্মাইতে সাহায্য করে। নতুবা দেশভ্রমণ ব্যতীত অন্যান্য দেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে স্পষ্ট বিশ্বাস বা অনুভূতি লাভ করা বড় কঠিন। এই সব কারণে অতি অল্প বয়সেই শিশুদিগকে আমি ভূগোল শিখাইবার পক্ষপাতী; তাহারা ইহাতে আনন্দবোধ না করিলে আমি বিস্মিত হইব। কিছুদিন পরে আমি শিশুদিগকে ছবিযুক্ত বই, মানচিত্র দিব এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সম্বন্ধে মোটামুটি বিবরণ জানাইব। এই প্রসঙ্গে আমি তাহাদিগকে বিভিন্ন দেশের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ছোট ছোট প্রবন্ধ রচনা করিতে বলিব।

ভূগোলের সম্বন্ধে যাহা প্রযোজ্য ইতিহাস শিক্ষার বেলাতেও তাহাই বরং আরও বেশি ভাবে খাটে। তবে ইতিহাস শিক্ষা একটু বয়স বেশি হইলে শুরু করিতে হয় কারণ অতি অল্পবয়সে শিশুর সময়-জ্ঞান খুবই কম থাকে। প্রথমে বিখ্যাত লোকদের গল্প বহুচিত্রিত পুস্তকে বিশেষ আকর্ষণীয়ভাবে শিশুদের সম্মুখে ধরিতে হইবে। ওই রকম বয়সে আমার নিজের একখানা ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের ছবির বই ছিল। তাহাতে একটি ছবি ছিল রানী ম্যাটিল্ডা আবিংডনে বরফের উপর দিয়া টেমস্ নদী পার হইতেছেন। সেই ছবিখানি আমার মনে এমন গভীরভাবে রেখাপাত করিয়াছিল যে, আঠারো বৎসর বয়সে আমি যখন ঠিক ওইরূপভাবে বরফ পার হইয়া গিয়াছিলাম তখন আমার দেহ-মনে শিহরণ উঠিয়াছিল। মনে হইতেছিল রাজা স্টিফেন যেমন রানী ম্যাটিল্ডাকে সসৈন্যে অনুসরণ করিয়াছিলেন তেমনই আমার পিছনে যেন স্টিফেন ছুটিয়া আসিতেছিলেন। আমার ধারণা পাঁচ বৎসর বয়সের এমন কোনো বালক নাই যে আলেকজান্ডারের জীবনী শুনিয়া আনন্দিত না হইবে। কলম্বাসের জীবনকথায় ইতিহাস অপেক্ষা ভূগোলের অংশই বেশি। দুই বৎসর বয়স্ক শিশু অন্তত সমুদ্রের সঙ্গে পরিচয় আছে এমন শিমু যে কলম্বাসের জীবন-কথায় আনন্দ পায় এ প্রমাণ আমি নিজেই দিতে পারি। শিশু যখন ছয় বৎসর বয়সে পদার্পণ করে তখন মিঃ এইচ, জি ওয়েলসের ধরনের লেখা পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তাহাকে দেওয়া চলে, অবশ্য কোনো কোনো অংশ আরও সরলভাবে লেখা এবং অধিকতর ছবি সন্নিবেশ করার প্রয়োজন হইবে; অথবা সম্ভবপর হইলে চলচ্চিত্রের সাহায্য গ্রহণ করা চলে। লন্ডনে বাস করিলে শিশু প্রাকৃতিক ইতিহাসের জাদুঘরে [Natural History Museum] অদ্ভুত প্রাণী দেখিতে পারে কিন্তু দশ বৎসর কিংবা ওই রকম কাছাকাছি বয়স ছাড়া শিশুকে আমি ব্রিটিশ জাদুঘরে [British Museum-F] লইয়া যাইতে চাহি না। ইতিহাস শিখাইবার সময় বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে যাহাতে আমাদের বয়স্ক ব্যক্তিদের নিকট যাহা আনন্দদায়ক তাহা যেন জোর করিয়া শিশুর উপর চাপাইয়া দেওয়া না হয়। যে দুইটি বিষয় শিশুকে প্রথমে আকৃষ্ট করে তাহা হইল পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব, বন্য মানুষ হইতে ক্রমে সভ্য মানুষের পর্যায়ে তাহার। জয়যাত্রার কথা। দ্বিতীয়, যেখানে কোনো ব্যক্তির বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া বালক তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হয় তাহার জীবনের ঘটনাগুলির সরস নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণনা। এ স্থানে মনে রাখিতে হইবে মানুষের অগ্রগতি সরল এবং সহজ পথে হয় নাই। আদিম বর্বর মানুষের নিকট হইতে রক্তের ভিতর দিয়া আমরা যে বর্বরতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছি তাহাই মাঝে মাঝে সভ্যতার দিকে আগাইয়া যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছি কিন্তু জ্ঞানের বলে মানুষ এই প্রতিরোধ জয় করিয়াছে। কোনও বিশেষ এক দেশের অধিবাসীদের কথা নয়, সমগ্র মানব জাতির ক্রমবিবর্তন ও অগ্রগতির কাহিনী হইবে ইতিহাস শিক্ষার গোড়ার কথা। মানুষ তখন বাহিরের নানারূপ প্রতিকূল ও বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং ভিতরের অজ্ঞানতার সঙ্গে সংগ্রাম করিতে করিতে আগাইয়া চলিয়াছে, বিচারবুদ্ধির ক্ষুদ্রদীপ জ্ঞানের দীপ্তিতে ক্রমশ উজ্জ্বলতর হইয়া অজ্ঞানের অন্ধকার রজনীর অবসান ঘটাইতেছেন। বিভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি এবং ধর্মসম্পদায়ে বিভক্ত হওয়া মানবের পক্ষে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক; বিশৃঙ্খলা ও অজ্ঞান তমসারাত্রির আবাসনকল্পে মানবের যে সংগ্রাম অবিরাম চলিয়াছে তাহাতে এই ভেদবুদ্ধি মানুষকে দুর্বল এবং বিভ্রান্ত করিয়া ফেলে। পক্ষান্তরে, সুশৃঙ্খল ও জ্ঞানদীপ্ত মানবসমাজ গড়িয়া তোলাই মানবোচিত কাজ।

প্রথমে আমি ছবি ও গল্পের ভিতর দিয়া বিষয়বস্তুটির অবতারণা করিব। প্রথমে থাকিবে কেবল মানুষের আদিম যুগ হইতে ক্রমোন্নতির পথে জয়যাত্রার কথা। ইহার অন্তর্নিহিত ভাব এবং মানুষের আদর্শে কি হওয়া উচিত সে কথা প্রথমে না বলিয়া পরে শিশুর বিচারবুদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি পাইলে–অবতারণা করা চলে। আমি দেখাইব কেমন করিয়া আদিম মানব শীতে কষ্ট পাইয়াছে, কাঁচা ফল খাইয়া জীবন ধারণ করিয়াছে। কখন আগুন আবিস্কার করা হইল এবং ইহার ফলে আদি মানবের জীবনে কি পরিবর্তন আসিল তাহা দেখাইব। এই প্রসঙ্গে প্রমিথিয়ুস কর্তৃক আগুন আনার কাহিনী বর্ণনা করিলে তাহা সময়োপযোগী হইবে। তাহার পরে দেখাইব কেমন করিয়া মিশর দেশে নীল নদের উপত্যকায় কৃষিকার্যের পত্তন হয় এবং কুকুর, ভেড়া ও গরু পোষা শুরু হয়। গাছের গুঁড়ি খোদাই করিয়া যে নৌকা তৈয়ার করা হইত তাহা হইতে শুরু করিয়া কেমন করিয়া বর্তমান যুগের বিরাট জাহাজ নির্মাণ করা সম্ভব হইয়াছে তাহা দেখাইব। মানুষের বাসস্থান আদি মানবের পর্বত গুহা হইতে কিভাবে বর্তমানে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো বিরাট শহরের অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহার চিত্র দেখাইব। অক্ষর ও সংখ্যা লেখার ক্রমবিকাশ দেখাইব, গ্রিসের উন্নত সভ্যতার কথা, রোমের বিপুল ঐশ্বর্যের কথা, তাহার পরবর্তীকালের সভ্যতার অবনতি ও অজ্ঞানের অন্ধকারের কথা এবং সর্বশেষ বর্তমান যুগের বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির কথা গল্প ও চিত্রের সাহায্যে শিশুদিগকে বুঝাইতে হইবে। খুব কম বয়সের শিশুর নিকটও এই বিষয়গুলি চিত্তাকর্ষক করা যায়। মানবজাতির ইতিহাস বর্ণনায় যুদ্ধবিগ্রহ, অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে নীরব থাকিব না তবে রণজয়ী বীরদিগকে আমি খুব প্রশংসার পাত্র বলিয়া ছাত্রদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিব না। আমার ইতিহাস শিক্ষার প্রকৃত বিজয়ী বীর তাহাদিগকেই বলিব যাহারা মানুষের ভিতরের ও বাহিরের অজ্ঞান-তমসা দূর করিয়াছেন-যেমন বুদ্ধ এবং সক্রেটিস, আর্কিমিডিস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং আর সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তি যাহারা আমাদিগকে আত্মজয় করিতে কিংবা বহিঃপ্রকৃতি জয় করিতে সাহায্য করিয়াছেন। মানুষের মহান সম্ভাবনা এবং বিপুল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি ছাত্রদের ধারণা গড়িয়া তুলিতে চাই। তাহারা যেন বুঝিতে পারে যে যুদ্ধবিগ্রহ এবং আমাদের পূর্বপুরুষ আদি বর্বর মানবের মতো আচরণ দ্বারা আমরা অবনতির ভ্রান্ত পথেই চারিত হইব, মানুষের মধ্যে সদ্ভাব, মানবজাতির পক্ষে কল্যাণকর কাজ করাতেই মানুষের সভ্যতার আসল পরিচয়।

নৃত্য ও সংগীত : বিদ্যালয়ে প্রথম কয়েক বৎসরে নৃত্য অভ্যাস করার জন্য কিছু সময় নির্দিষ্ট করিয়া রাখিতে হইবে। নৃত্য শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে, তাহাদিগকে প্রচুর আনন্দ তো দেয়ই, তাহা ছাড়া সুরুচিবোধ জাগ্রত করে। নৃত্যের প্রথম পাঠ শিক্ষা করা হইলে শিশুদিগকে সমবেত নৃত্য শিখাইতে হইবে। এই ধরনের সহযোগিতামূলক আনন্দদায়ক কাজ শিশুরা ভালোবাসে। সংগীত সম্বন্ধে ঠিক এইরূপ ব্যবস্থা করা চলে, তবে নৃত্যের কিছু পরে ইহা আরম্ভ করিতে হইবে, কারণ নৃত্যে যেমন দেহের আন্দোলনজনিত আনন্দ আছে সংগীতে তেমন সুযোগ নাই। তাহা ছাড়া সংগীত নৃত্যের অপেক্ষা কঠিনও। সকলে না হইলেও অনেক শিশুই গান গাহিতে আনন্দ পাইবে এবং শিশুর ছড়া শেখার পর ভালো গান গাহিতে শিখিবে। প্রথমেই শিশুদের রুচি বিকৃত করিয়া পরে সংশোধনের কোনো লাভ নাই। ইহার ফলে তাহাদিগকে হঁচড়ে-পাকা করা হয় মাত্র। বয়স্ক ব্যক্তিদের ন্যায় সকল শিশুর গান গাহিবার সমান যোগ্যতা থাকে না। কাজেই কঠিন সুরের গানগুলি শিখিবার জন্য কতক ছেলেমেয়েকে বাছাই করিয়া লইতে হইবে। এইরূপ বালক-বালিকার পক্ষেও গান স্বেচ্ছাধীন বিষয় রাখিতে হইবে। গান গাহিতে পারে বলিয়াই তাহাদের উপর জোর করিয়া ইহা চাপাইবার প্রয়োজন নাই।

সাহিত্য শিক্ষার ব্যাপারে সহজেই ভুল হইতে পারে। কি শিশু, কি বৃদ্ধ কাহারও পক্ষেই সাহিত্য সম্বন্ধে কেবল কতকগুলি বিষয়, যেমন কবিদের সময়কাল, তাহাদের রচনাবলির নাম বা এই ধরনের বিষয় জানিয়া কোনো লাভ নাই। এইরূপ নোটবুকে টুকিয়া রাখার যোগ্য যে জ্ঞান তাহা শুধু পল্লবগ্রহিতারই পরিচায়ক; ইহার প্রকৃত মূল্য কিছু নাই। সৎ সাহিত্য যদি পাঠকের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে তবেই ইহার পাঠে সার্থকতা। সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের প্রভাব পাঠকের কেবল রচনাশৈলির [Style] উপর নয়, চিন্তার প্রকৃতির উপরও পড়া চাই। কয়েক শতাব্দী আগে বাইবেল ইংরাজ শিশুদের উপর এইরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ইংরাজি গদ্যরচনায় ইহার সুফল দেখা গিয়াছে কিন্তু আধুনিককালের খুব কম বালক-বালিকারই বাইবেলের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় আছে। আমার মনে হয় মুখস্থ না করিলে সাহিত্য হইতে সম্পূর্ণ সুফল পাওয়া যায় না। স্মৃতিশক্তি বেশি করার উপায়স্বরূপ পূর্বে মুখস্থ করানোর রীতি ছিল কিন্তু মনোবিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহা এক রকম নিষ্ফল। আধুনিক শিক্ষাবিদগণ ইহাকে শিক্ষাক্ষেত্রে খুব কম স্থান দিতেছেন কিন্তু আমার মনে হয় ইহাতে ভুল করা হইতেছে। মুখস্থ করার ফলে যে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহা নয়, কথায় এবং লেখার সুন্দর ভাষা প্রয়োগ করার সে সুফল পাওয়া যায় তাহার জন্য মুখস্থ করা দরকার। কষ্ট করিয়া ভাষার মাধুর্য অর্জন করিতে হইবে না; চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বাহন হিসাবে যদি সাবলীল ভাষা স্বাভাবিকভাবে আসে তবেই ইহার সার্থকতা প্রমাণিত হইবে। বর্তমান সমাজে প্রাচীন যুগের তুলনায় সৌন্দর্য ও রুচিবোধের আবেগ কমিয়া গিয়াছে। সৎ সাহিত্যের সঙ্গে ভালরকম পরিচয়ের ফলেই চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও ভাষার সৌষ্ঠব আয়ত্ত করা সম্ভবপর। এইজন্যই মুখস্থ করা আমার কাছে এত প্রয়োজনীয় মনে হয়।

কিন্তু এইজন্য কতকগুলি বাঁধাধরা গদ্য ও পদ্যের অংশ মুখস্থ করাইলে তাহা শিশুদের নিকট বিরক্তিকর ও অকৃত্রিম বলিয়া মনে হয়; কাজেই ইহাতে সুফল পাওয়া যায় না। অভিনয় করানোর সুযোগে মুখস্থ করাইলে বরং উপকার হয়, কেননা অভিনয় করিতে শিশুরা খুবই ভালবাসে। তিন বৎসর বয়স হইতেই শিশুরা ইহাতে আনন্দ পায়। নিজেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এইরূপ করে, ইহার জন্য যখন নানারূপ সাজসজ্জা করা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য আয়োজন হয় তখন তাহাদের উল্লাস ধরে না। বাল্যকালে জুলিয়াস সিজার নাটক অভিনয় করিতে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসের মধ্যে বিষাদের দৃশ্য অভিনয়ে আমি কিরূপ তীব্র আনন্দ অনুভব করিয়াছিলাম তাহা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

যে সকল শিশু অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে তাহারা যে কেবল নিজেদের অংশই মুখস্থ করে তাহা নহে, অপর অংশগুলিরও প্রায় সবটাই মুখস্থ করিয়া ফেলে। নাটকটি বহুদিন তাহাদের চিন্তায় স্পষ্ট হইয়া থাকে এবং আনন্দ দান করে। ভালো সাহিত্যের উদ্দেশ্যই হইল আনন্দদান করা; শিশুরা যদি সাহিত্য হইতে আনন্দ আহরণ করিতে না পারে তবে ইহা হইতে কোনো উপকারও পাইবে না। এই কারণের জন্য আমি বাল্যকালে কেবল অভিনয়োপযোগী অংশগুলি মুখস্থ করানোর পক্ষপাতী। ইহা ছাড়া শিশুরা ইচ্ছামতো স্কুলের লাইব্রেরি হইতে সুলিখিত গল্পের বই লইয়া পড়িতে পাইবে।

আজকাল অনেক লেখক শিশুদের জন্য বাজে এবং তরল ভাবোদ্দীপক বই লেখেন; ইহাতে শিশুদের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। এইগুলি শিশুদের ছেলেমিকে বাড়াইয়া তুলিয়া তাহাদিগকে অপমান করে। ইহার বিপরীত অবস্থা লক্ষ করুন রবিনসন ক্রুসো পুস্তকে। শিশুদের জন্য লিখিত হইলেও তাহাতে কোথাও ছেলেমি বা ন্যাকামির স্থান নাই। কি শিশুর সঙ্গে আচরণে কি অন্যত্র তার ভাবপ্রবণতার আকর্ষণ কখনই বেশি নয়। কোনো শিশুই ছেলেমির প্রতি আকৃষ্ট হয় না, সে চায় যতশীঘ্র সম্ভব বয়স্ক ব্যক্তির মতো আচরণ অভ্যাস করিতে। কাজেই শিশুদের জন্য বই লিখিতে তাহাদের ছেলেমি অবলম্বন করিয়া কাহিনী গড়িয়া তোলার কোনো আবশ্যকতা নাই। শিশুদের জন্য রচিত আধুনিক বইতে এইরূপ কৃত্রিম ন্যাকামি বড়ই বিরক্তিকর। শিশুরা ইহা পড়িয়া আনন্দ পায় না, তাহাদের মানসিক বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল স্বাভাবিক ভাবাবেশও ইহা দ্বারা ব্যাহত হয়। শিশুদের মন বিকাশোনুখ এবং সম্প্রসারণের জন্য অধীর। শিশুরা চিরকাল শিশু হইয়া থাকিতে চায় না, তাহারা চায় শক্তিমান কর্মক্ষম বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইতে। গল্পের বইতেও তাহারা এই বিকাশের পরিচয় দেখিতে পাইলে আনন্দিত হয়; কাজেই বইতে ইহার বিপরীত অবস্থা দেখিলে শিশুর ছেলেমিতে তাহাদের মন সায় দেয় না। এইজন্যই যে সব ভালো বই বয়স্কদের জন্য লিখিত অথচ তাহাদের পক্ষেও উপযোগী সেইগুলিই শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ। ইংরাজি সাহিত্যে ইহার ব্যতিক্রম কয়েকখানি মাত্র বই আছে; যেমন লিয়ার [Lear] ও লুই ক্যারোল কর্তৃক [Lawis Carol] শিশুদের জন্য লিখিত বই; এগুলি পড়িয়া বয়স্ক ব্যক্তিরাও প্রচুর আনন্দ পায়।

বিদেশি ভাষা শিক্ষা : আধুনিক ভাষা শিক্ষার প্রশ্নটি একেবারে সহজ নয়। শৈশবে কোনো আধুনিক ভাষায় কথা বলা যেমন সুন্দরভাবে শেখা যায় অন্য কোনো বয়সে তত সম্পূর্ণভাবে শেখা যায় না। শৈশবে ভাষা শিক্ষা দিলে দেওয়ার স্বপক্ষে ইহাও একটি সুযুক্তি। অনেকে আশঙ্কা করেন যে, শৈশবে বিদেশি ভাষা শিক্ষা শিশুর মাতৃভাষা শিক্ষায় ব্যাঘাত জন্মে। আমি ইহা বিশ্বাস করি না। টলস্টয় এবং টুর্গেনিভ যদিও শৈশবে ইংরাজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শিখিয়াছিলেন তবু রাশিয়ান ভাষায় তাঁহাদের দখল ছিল অসাধারণ। গিবন ইংরাজি ভাষার মতো সহজ সাবলীল ভঙ্গিতেই ফরাসিও লিখিতে পারিতেন, কিন্তু এইজন্য তাঁহার ইংরাজি রচনাশৈলি [Style] মোটেই ব্যাহত হয় নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক ইংরেজ অভিজাত ব্যক্তি কৈশোরেই ফরাসি এবং অনেকে ইতালি ভাষাও শিক্ষা করিতেন তথাপি তাহাদের ইংরাজি ভাষা তাঁহাদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের অপেক্ষা অনেক ভালো ছিল। কেহ হয়তো মনে করিতে পারেন শিশু বহুভাষা শিক্ষা করিলে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবে। সে যদি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলিবার সুযোগ পায় তবে তাহার নাটকীয় প্রবৃত্তিই তাহাকে এইরূপ খিচুড়ি পাকাইতে দেয় না। আমি ইংরাজি শিক্ষার সময় হইতেই জার্মান ভাষা শিক্ষা করা শুরু করিয়াছিলাম এবং দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত পরিচারিকা ও গৃহশিক্ষয়িত্রী এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলিতে ওই ভাষা ব্যবহার করিতাম। ইংরাজির সহিত মিশিয়া যাইত না কারণ ইহার প্রত্যেকটি সঙ্গে পৃথক ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ [Association] জড়িত ছিল।

বিদেশি ভাষা শিক্ষার সহজ উপায় : আমার মনে হয় যদি বর্তমান ভাষা শিক্ষা করিতে হয় তবে উহা যাহার মাতৃভাষা এমন লোকের নিকটই শেখা উচিত কারণ তিনি যে কেবল ভালোভাবে শিখাইতে পারিবেন তাহাই নয়, শিক্ষার্থী শিশুর মাতৃভাষায় যিনি কথা বলেন তাহার সঙ্গে বিদেশি ভাষায় কথা বলিতে যেইরূপ কৃত্রিমতা থাকে বিদেশির সঙ্গে বিদেশি ভাষায় বাক্যালাপ করিতে সেইরূপ কৃত্রিমতা-বোধ আসে না। কাজেই আমার মনে হয় প্রত্যেক স্কুলেই একজন করিয়া ফরাসি শিক্ষয়িত্রী থাকা উচিত। ভাষা শিক্ষাদানের প্রথম অবস্থায় কেবল ইহারা যথারীতি পাঠ দিবেন। তারপর খেলাধুলা এবং শিশুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার ভিতর দিয়া ভাষা শিক্ষা চলিবে; এমন হওয়া চাই যেন বিদেশি ভাষা বুঝিয়া তাহাতে উত্তর করিতে পারার ভিতর দিয়াই খেলা পূর্ণাঙ্গ ও সফল হয়। শিক্ষয়িত্রী প্রথমে সহজ খেলা হইতে শুরু করিয়া ক্রমে জটিলের দিকে অগ্রসর হইতে পারেন। এইভাবে কোনোরূপ। মানসিক পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দদায়ক কাজের মাধ্যমে বিদেশি ভাষা শিখানো চলে। বাল্যকালে যেমন সহজে এবং যত কম সময় অপচয় করিয়া ইহা আয়ত্ত করা যায় অন্য কোনো বয়সে সেইরূপ করা সম্ভবপর নয়।

অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা : আমরা যে বয়সের পাঠ্যক্রম আলোচনা করিতেছি ইহার শেষ দিকে অর্থাৎ বারো বৎসর বয়সে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হইবে। অবশ্য আমি ধরিয়া লইতেছি যে ইতোমধ্যে পাটীগণিত শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে এবং জ্যোতিষ ও ভূবিদ্যা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, বিখ্যাত আবিষ্কারক এবং অনুরূপ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় সম্বন্ধে মোটামুটি আলোচনা করা হইয়াছে। আমি এখন জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যা শিখানোর কথা চিন্তা করিতেছি। খুব কমসংখ্যক বালক-বালিকা জ্যামিতি ও বীজগণিত পছন্দ করে, বেশিরভাগই পছন্দ করে না। কেবল ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাদান প্রণালীই ইহার কারণ কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। গান গাহিবার ক্ষমতার মতোই গাণিতিক বোধ দেবদত্ত শক্তি; মাঝারি রকম মাত্রায়ও ইহা একান্ত বিরল। তথাপি প্রত্যেক বালক-বালিকারই গণিতের প্রতি অনুরাগ থাকা উচিত; কাহারাও গাণিতিক প্রতিভা আছে কি না তাহা ইহার অনুশীলনের ভিতর দিয়াই আবিষ্কার করা যায়। যাহারা বিশেষ কিছু শিখিতে পারে না, তাহারা ইহা জানিয়া উপকৃত হয় যে, ওই ধরনের একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। উপযুক্ত প্রণালীতে শিক্ষা দিলে প্রায় সকলেই জ্যামিতির বিষয়বস্তু বুঝিতে পারে। বীজগণিত সম্বন্ধে ঠিক একথা বলা চলে না; জ্যামিতির চেয়ে ইহা অধিকতর বস্তুনিরপেক্ষ [abstract] এবং স্থূল বস্তু হইতে যাহারা মনকে সরাইয়া লইতে পারে নাতাহাদের পক্ষে ইহা দুর্বোধ্য। উপযুক্তভাবে শিক্ষা দিলে পদার্থবিদ্যা ও রাসায়নবিদ্যার প্রতি অনুরাগী ছাত্রের পরিমাণ গণিতানুরাগীর অপেক্ষা কিছু বেশি হইতে পারে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় ইহার প্রতি অনুরাগ খুব কম সংখ্যক যুবকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোনো বালক বা বালিকার গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি কোনোরূপ প্রবণতা আছে কি না তাহা জানিবার জন্য বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত ইহা শিখানো উচিত। অনেক সময় ইহা প্রথমেই ধরা পড়ে না। আমি প্রথমে বীজগণিত মোটেই পছন্দ করিতাম না যদিও পরে ইহার কায়দা শিখিয়া লওয়ার বিষয়টি সহজ মনে হইয়াছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রের কোনো প্রতিভা আছে কি না চৌদ্দ বৎসর বয়সে তাহা যথার্থভাবে জানা নাও যাইতে পারে। এইরূপ ছাত্র বা ছাত্রীকে পরীক্ষামূলকভাবে আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা চলে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চৌদ্দ বৎসর বয়সেই বাছাই করা যায়। কতক এই বিষয়গুলি পছন্দ করিবে এবং ইহাতে ভালো করিবে, কতক ইহা মোটেই পছন্দ করিবে না কিংবা বোকা ছাত্র ইহা পছন্দ করিবে। এইরূপ ব্যাপার অতি কদাচিৎ ঘটিতে পারে।

প্রাচীন সাহিত্য : গণিত ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কেও তাহাই প্রযোজ্য। বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর বয়সের মধ্যে প্রাচীন ভাষা (যেমন ল্যাটিন) ততটুকুই শিক্ষা দিতে হইবে যাহা হইতে বোঝা যায় কোনো বালকের বা কোনো বালিকার ইহার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ এবং দক্ষতা আছে। আমি মনে করি যে, চৌদ্দ বৎসর বয়স হইতেই ছাত্রের রুচিপ্রবণতা ও ক্ষমতা অনুসারে বিশেষ এবং উন্নত মানের শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত। শিশুকে পরবর্তিকালে কী শিক্ষা দিলে ভালো হইবে তাহা ছাত্রের চৌদ্দ বৎসর বয়ঃপ্রাপ্তির কিছু পূর্ব হইতেই বিশেষভাবে নিরূপিত হওয়া আবশ্যক।

বহিঃপ্রকৃতির সহিত পরিচয় : সারা স্কুল জীবন ধরিয়াই বাহিরের সহিত পরিচয় চলিতে থাকিবে। অবস্থাপন্ন লোকের সন্তানদের বেলায় ইহার ভার ছাত্রের পিতামাতার উপর দেওয়া চলে কিন্তু অপর ছাত্রদের বেলায় এইরূপ পরিচয় সাধনের দায়িত্ব বিদ্যালয়কেই আংশিকভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। আমি যখন বাহিরের বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার কথা বলিতেছি তখন আমি খেলাধুলার কথা ভাবিতেছি না। ইহার অবশ্য উপকারিতা আছে এবং তাহা রীতিমতভাবে স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু অন্য ধরনের বহির্বিষয়ের শিক্ষার কথা বলিতেছি–যেমন চাষ-আবাদের প্রণালী, গাছপালা ও জীবজন্তু চেনা, বাগানের কাজের সঙ্গে পরিচয়, পলি-পর্যবেক্ষণ এবং অনুরূপ বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি যে, এমন শহুরে লোক আছে যাহারা কম্পাস বা দিগদর্শন-যন্ত্রের চিহ্ন বোঝে না। সূর্য কোন্ দিকে যায় জানে না, গৃহের কোন্ দিকটি বায়ুপ্রবাহের আড়ালের দিকে পড়ে জানে। প্রত্যেক গরু কিংবা ভেড়ার যে জ্ঞান সেইরূপ জ্ঞান হইতেও বঞ্চিত। ইহা নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল শহরে বাস করার কুফল। যদি বলি শ্রমিকদল যে পল্লি অঞ্চলে ভোটে জয়ী হইতে পারে না ইহা তাহার অন্যতম কারণ, তবে হয়তো অনেকেই আমাকে কল্পনা-বিলাসী বা খামখেয়ালি বলিবেন। কিন্তু শহরে লালিতপালিত ব্যক্তিদের পল্লির সঙ্গে কোনোরূপ সংস্রব না থাকার ফলেই বহু প্রাচীন এবং মৌলিক জিনিসের সঙ্গেও তাহাদের পরিচয় নাই।

বিভিন্ন ঋতু ও আবাহওয়া, ফসল বোনা ও কাটা, নানা গৃহপালিত প্রাণী প্রভৃতির মানব-জীবনের সহিত সংযোগ আছে। কাজেই জীবধাত্রী বসুন্ধরার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিতে না চাহিলে ইহাদের সহিত প্রত্যেকের পরিচিত হওয়া উচিত। বিদ্যালয়ের বাহিরে নানা কাজের ভিতর দিয়া শিশুগণ এইসবের সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিতে পারে। বিদ্যালয়ের বাহিরে কাজকর্ম এবং রৌদ্রে ও মুক্ত বায়ুতে অবস্থান ছাত্রদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অশেষভাবে উপকারী; শুধু এই জন্য পল্লি অঞ্চলে ভ্রমণ বাঞ্ছনীয়। শহরের শিশুরা পল্লিতে গেলে যেইরূপ আনন্দিত হয় তাহা হইতে বোঝা যায় যে, তাহাদের একটি বড় অভাব যেন পূরণ করা হইতেছে। যতদিন এই অভাব পূরণ না হয় ততদিন শিক্ষাপ্রণালী অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *