১৩. নারায়ণশিলা গ্রামটি বনেজঙ্গলে পূর্ণ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

নারায়ণশিলা গ্রামটি বনেজঙ্গলে পূর্ণ। মাত্র ত্রিশ মাইল দূরের কলিকাতা শহরে যে বিংশ শতাব্দী তাহার আধুনিক ভাবনাচিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার লইয়া মহাপ্রতাপে রাজত্ব করিতেছে, এ গ্রামের গভীর বাঁশবন, ছায়াচ্ছন্ন আম-কাঠালের বাগান আর অধিবাসীদের নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রা দেখিয়া তাহা আন্দাজ করিবার কোন উপায় নাই। নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন হইতেও গ্রামটি মাইল চারেক দূর। অপালা গরু বা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা রাখিতে চাহিয়াছিল, কাজল হাসিয়া বলিয়াছিল–আমি গ্রামেরই ছেলে, চার মাইল হাঁটার ভয়ে কাবু হই না। তাছাড়া ধরো যদি কোনও কারণে না যেতে পারি, তাহলে আমোক অতদূর এসে গাড়ি ফিরে যাবে। কিছু দরকার নেই–

ছোট সুটকেসটা হাতে লইয়া ধুলায় ভরা পথে হাঁটিতে হাঁটিতে কাজল ভাবিল-কীটস কী সত্যি কথাই লিখে গিয়েছেন। শহরের সেই ধোঁয়া আর ময়লা, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ-আই হ্যাভ ল বীন ইন এ সিটি পেন্ট! এমন সবুজ গাছপালা না দেখলে মানুষ বাঁচে?

পথটা এক জায়গায় আসিয়া দু-ভাগ হইয়া গিয়াছে। এখানে একবার জিজ্ঞাসা না করিয়া লইলে পথ ভুল হইবার খুবই সম্ভাবনা। কিন্তু জায়গাটা সেইমুহূর্তে একেবারেই জনমানবশূন্য। কাজল সুটকেসটা নামাইয়া সিগারেট ধরাইল, এখানে একটু বিশ্রাম করিয়া লওয়া যাইতে পারে। পৌঁছাইবার এমন কিছু তাড়া নাই। শহরে সকাল হইতেই কর্মব্যস্ততা শুরু হইয়া যায়। সব কাজেরই পৃথিবীতে প্রয়োজন আছে কিনা কে জানে, কিন্তু দুনিয়াসুদ্ধ লোক সারাদিন খাঁটিয়া খুন হয়। এমন কি ছুটির দিনেও প্রকৃত বিশ্রাম পাওয়া কঠিন। সবাই যত কাজ জমাইয়া রাখে আর ছুটির দিনে তাহার কাছে আসিয়া হাজির হয়। এইরকম বাহির হইয়া পড়িলে তবে ইচ্ছামতো কিছু করিবার সুযোগ মেলে।

রাস্তার ধারেই মাদারগাছের ডালে কিকি করিয়া শালিক ডাকিতেছে। ঝিরঝিরে বাতাসে মুক্তির স্বাদ। বর্ষার জলে সতেজ হইয়া গাছপালা গভীর সবুজ সাজ পরিয়াছে। পৃথিবীর অনেক স্থানে ব্যবসায়িক লাভের জন্য এমন সুন্দর অরণ্যশোভা কাটিয়া নষ্ট করিতেছে ভাবিলেও মনের মধ্যে কেমন করে! তেমন ঝাকালো একখানা গাছ বড় হইতে লাগে পঞ্চাশ-ষাট কী একশো বছর। আর কাটিতে বড়জোর একদিন। বিলাত-আমেরিকায় বৈদ্যুতিক করাত দিয়া আধঘণ্টায় পনেরো ফুট বেড়ের গাছ কাটিয়া ফেলিতেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় জেনারেল শেরম্যান নামে নাকি একটি বিশাল রেডউড গাছ আছে, তাহার বয়েস প্রায় চার-পাঁচ হাজার বছর। ভাবিলে অবাক লাগে, ওই গাছটি যখন একশো-দেড়শো বছরের তরুণ, তখন মানুষ সবে কিছুকাল গুহা হইতে বাহির হইয়া সভ্যতা গড়িতেছে—মেসোপটেমিয়ায় বর্ণলিপির অভ্যুদয় ঘটিতেছে, মিশরে ফারাও খুফুর পিরামিড তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। মানবসভ্যতার সেই অস্পষ্ট ঊষাকালের সাক্ষী পাঁচহাজার বৎসরেব ওই রেডউড গাছ। কিন্তু হইলে কী হইবে, কাঠের লোভে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য ব্যবসায়ীর দল উহা কাটিল বলিয়া। আধুনিক যুগ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তিই সত্য, সাধে কী আর লোকে তাহাকে ঋষি বলে! কমলাকান্ত আফিংয়ের ঘোরে যাহা বলিতেছে, তাহা বঙ্কিমেরই হৃদয়ের কথা। কমলাকান্তের জিজ্ঞাসা—এই যে মানুষ এত টাকা করিতেছে, রেলগাড়ি বানাইতেছে, টেলিগ্রাফের কল বানাইতেছে, মানুষে মানুষে প্রণয়ের একটা কল অবিষ্কার করা যায় না? নহিলে আর সব কলই যে বেকল হইয়া যাইবে।

আজও হয় নাই। কে জানে কোনোদিন হইবে কিনা।

কাজলের সিগারেট শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে দূরে পথে উপব একজন লোক দেখা দিল। লোকটা স্টেশনের দিক হইতেই আসিতেছে। কাছে আসিতে বোঝা গেল মানুষটি পুববাহিত শ্রেণির। তাহার পরনে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে নামাবলী, ছোট ছোট কবিযা চুল ছাঁটা। কপালে এবং নাকে চন্দনের ছাপ। খালি পা, হাতে একখানি পিতালের সাজি—তাহাতে পূজার কিছু উপকরণ। সে হনহন করিয়া হাঁটিায় আসিল এবং কাজলের সামনে দাঁড়াইয়া পড়িয়া অমায়িকভাবে একগাল হাসিল।

কাজল তাহাকে আদৌ চেনে না, কাজেই এ ঘনিষ্ঠ হাসির মর্মোদ্ধার করিতে না পারিয়া সে কী বলিবে ভাবিতেছে, এমন সময় লোকটিই তাহাকে প্রশ্ন করিল—বাবু কী কোথাও যাবেন? এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে?

কাজল তাহার গন্তব্যের কথা বলায় সে বলিল—খুব চিনি, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি। আপনার বুঝি সেখানে নেমন্তন্ন?

লোকটির বয়েস বেশি নয়, কাজলেরই সমান হইবে। বাকি পথটা সে আপনমনে গল্প করিতে করিতে চলিল। তাহার কথাবার্তা শুনিয়া মনে হয় সে পুরাপুরি পাগল না হইলেও কিছুটা ছিটগ্রস্ত বটেই।

কাজল বলিল—আপনি কী এই গ্রামেই থাকেন?

উত্তরে লোকটি জিজ্ঞাসা করিল—আপনি কী ব্রাহ্মণ?

কাজল বলিল—হাঁ। কেন বলুন তো?

–তাহলে আমাকে আপনি বলবেন না। বয়েসে আমি আপনার চেয়ে কিঞ্চিৎ ছোটই হব—

বলিয়া সে নিচু হইয়া খ করিয়া কাজলের পায়ের ধুলা নিতে গেল। কাজল ব্যস্ত হইয়া বলিল—আরে না না, থাক। আচ্ছা তুমিই বলবো এখন–

পথ চলিতে চলিতে লোকটি বলিল—আমার নাম নন্দলাল-নন্দলাল চক্রবর্তী। থাকি এখান থেকে চারক্রোশ দূরে নাটাবেড় গ্রামে। সকালবেলা উঠে পুজোআচ্চা সেরে এতটা পথ হেঁটে আসতে বেলা হয়ে গেল। আসবার সময় আবার মহেন্দ্র বিশ্বাসের আড়তে গণেশের নিত্যপুজাটা করে আসতে হল কিনা—ওরা মাসে তিন টাকা করে দেয়, আর এই পুজোর আগে একখানা কাপড়। এই দেখুন না, তাদের দেওয়া কাপড়ই তো পরে রয়েছি। কেমন, ভালো না?

কাজল বলিল—হাঁ, বেশ সুন্দর।

-হবে না কেন বলুন! বিরাট বড়োলোক তাঁরা, বাবার আমল থেকে আমাদের যজমান। বাবা বাতের ব্যথায় চলাফেরা করতে পারে না, তাই এখন আমিই পুজো সারি। তবে বড়োলোক হলেই হয় না, দেবার মনও থাকা চাই। লালু মুখুজ্জের বাড়ি গত তিনবছর ধরে প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো কবছি-তা ববাবর সেই একসিকি দক্ষিণা আর দেড়সের চাল! এবার কত বললাম আমার পুজো করার কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছে, একখানা কিনে দাও। শেষ অবধি কী দিলো, জানেন?

-কী?

-একখানা গামছা। তাও আবার কেমন, ষষ্ঠীর দিন সেইটে পরে চান করেছি—তারপর দেখি রঙ উঠে কোমরের নিচে থেকে হাঁটু অবধি একদম সবুজ। বুঝুন কাণ্ড!

কাজল বলিল—তোমারও বুঝি পুজোবাড়িতে নেমন্তন্ন?

নন্দলাল সহজভাবেই বলিল—না, আমায় কী আর আলাদা করে চেনে যে নেমন্তন্ন করবে? পুজোয় ভালো খাওয়ায় শুনে গতবছরও এসে খেয়ে গিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণের এতে কোন অপমান নেই, বলুন! আমাদের পেশাই হল ভিক্ষা। ওই যে, পুজোবাড়ি দেখা দিয়েছে

রাস্তা হইতে একটু ভিতরে ঘন সবুজ গাছপালার ছায়ায় বাড়িটা। জায়গায় জায়গায পলেস্তাবা খসিয়া সেকেলে পাতলা ইট দেখা যাইতেছে। ঢুকিবার দরজার দুই পাশে পূর্ণঘট এবং কলাগাছ বসানো। দরজা পার হইলেই বিশাল বাঁধানো উঠান, উঠানের প্রান্তে ঠাকুরদালান। সেখানে ডাকের সাজ দেওযা দেবীপ্রতিমার সামনে কয়েকটি বালক-বালিকা বসিয়া কলরব করিতেছে। লালপাড় গরদের শাড়ি পরা ফরসা একজন প্রৌঢ়া মহিলা হাতে একটি তামার পাত্র লইয়া কী কাজে ঠাকুরদালানে আসিতেছিলেন, কাজলকে দেখিয়া তিনি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেনতুমি কে বাবা? কাউকে খুঁজছো?

কাজল উত্তর দিবার আগেই কোথা হইতে অপালা আসিয়া হাজির হইল।

-ওমা! সত্যি এসেছেন তাহলে আসুন, বাড়ির ভেতরে আসুন-পথ চিনতে অসুবিধে হয়নি তো?

নন্দলালের বোধহয় আরও গল্প করিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কাজল বাড়ির ভিতর চলিয়া যাওয়ায় সে ঠাকুরদালানের একদিকে দুপুরবেলা খাওয়ার ডাক পড়িবার আশায় বিমর্ষমুখে একা বসিয়া রহিল।

অপালার দাদু-দিদিমা মানুষ ভালো, তাঁহারা কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজলকে একান্ত আপন করিয়া লইলেন এবং অপালার সহিত তাহার সম্পর্ক লইয়া নানাবিধ ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতা করিয়া আসর জমাইয়া তুলিলেন। অপালার বাবা স্বল্পবাক মানুষ কিন্তু তাহার সংযত ব্যক্তিত্বের মধ্য হইতে একটা সহৃদয়তার প্রভাব ফুটিয়া বাহির হয়। তিনি অপুর বইয়ের পরম ভক্ত, অপুর ছেলেকে দেখিয়া প্রকৃতই খুশি হইলেন।

দুপুর ঠাকুরদালানের ডানধারে লম্বা বারান্দায় চাটাইয়ের আসন পাতিয়া খাইবার জায়গা হইল। এক সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন লোক দুই সারিতে বসিয়া খাইতেছে। কাজলের মুখোমুখি নন্দলাল বসিয়াছে, চোখে চোখ পড়িতে সে খুশির হাসি হাসিল। খাইবার পদের বিশেষ বাহুল্য নাই। নিজেদের চাষের ঈষৎ মোটা চালের ভাত, কুমডোভাজা, ডাল, দুইরকম তরকারি, চাটনি ও পায়েস। কাজলের পাতে চাটনি পড়িবার সময় সে তাকাইয়া দেখিল নন্দলাল তৃতীয়বার ডাল চাহিয়া লইয়া ভাত মাখিতেছে।

খাইবার পর অপালা সমস্ত বাড়িটা ঘুরিয়া দেখাইল। বলিল—এটা কিন্তু নতুন বাড়ি, দাদুদের আদি বাড়ি ওইদিকে, আসুন দেখাই

আম-জাম-কাঁঠাল গাছের সারি পার হইয়া একটা বহু পুরাতন পাকাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আগাছার জঙ্গলের মধ্যে পড়িয়া আছে। ছাদ ভাঙিয়া পড়িয়াছে অনেকদিন, ইট বাহির হওয়া দেওয়ালগুলি কোনমতে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। খসিয়া পড়া কড়ি-বরগা এমনভাবে ছড়াইয়া আছে যে, তাহা পার হইয়া ভিতরে যাওয়া অসম্ভব।

অপালা বলিল—প্রায় একশো বছর ওই বাড়ি এমনি পড়ে রয়েছে, দাদুর ঠাকুরদার আমলের বাড়ি। তখন আমরা এই অঞ্চলের জমিদার ছিলাম, জানেন?

অপালা তাহার বংশের পূর্ববৃত্তান্ত বলিতেছিল। শুনিতে শুনিতে কাজল অন্যমনস্ক হইয়া গেল। বিশাল বাড়ির ভগ্নস্তূপটা তাহাকে কেমন যেন মুগ্ধ করিয়াছে। কেমন ছিল একশত বৎসর আগের সেই মানুষগুলি? যাহারা এই বাড়িতে বাস করিত, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করিত? তাহাদের কাছে একান্ত বাস্তব সেই বর্তমান আজ এক শতাব্দী পিছাইয়া পড়িয়াছে–যেমন সে নিজে একদিন অতীত ইতিহাসে পর্যবসিত হইবে।

সান্ধ্য-আরতি ও ভোগের আয়োজনে সাহায্য করিতে অপালা বাড়ির ভিতরে চলিয়া গেল। দুই-একজন ছাড়া কাজল এ বাড়ির অন্যদের এখনও ভালো করিয়া চেনে না, অচেনা মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকিবার ইচ্ছা না করায় সে আমবাগানের ওপাশে দীঘির বাঁধানো ঘাটের উপর আসিয়া বসিল। একেবারে উপরের ধাপে বসিবার জন্য দুই দিকে বেদি করা আছে, তাহারই একটিতে নন্দলাল চক্রবর্তী অঘোরে ঘুমাইতেছে। দীঘির জলে প্রাচীন গাছেদের শান্ত ছায়া। অপরাহু গাঢ় হইয়া আসিয়াছে, গাছের ডালে ডালে বাসায় ফিরিয়া আসা পাখিদের কলরব। এই শান্তির আবাস ছাড়িয়া লোভী মানুষ শহরে চলিয়া গিয়াছে। ভুল বুঝিয়া যখন ফিরিবে, এই পরিবেশ আর থাকিবে কি?

নন্দলাল ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া বসিল, আড়ামোড়া ভাঙিয়া চারদিকে তাকাইয়া বলিল—যাঃ, বেলা গিয়েছে দেখছি।

কাজল বলিল–ভালো ঘুম হল? তোমার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে–

-আজ আর ফিরবো না ভাবছি। শুনলাম ঠাকুরবাড়ি রাত্তিরে লুচি-ভোগ হবে। জনাই থেকে মণ্ডা এনেছে, তাও দেবে। আমরা গাঁয়ের মানুষ, এসব তো বড়ো একটা খেতে পাই না–আমাদের এদিকে পুজোর প্রসাদ বলতে দুটো আখের টিকলি, একমুঠো কুচোনো ফলমূল আর কয়েকটা পিপড়েধরা ফোপরা বাতাসা। থেকে যাই রাতটা–

কাজল জিজ্ঞাসা করিল—না ফিরলে বাড়ির লোক ভাববে না? বলে এসেছো?

—কে ভাববে বলুন! আমার মা নেই, ছোটবেলাতেই মরে গিয়েছে। বারা একজন সেবাদাসী রেখেছে—সে আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। ভাববে কে?

কাজল অবাক হইয়া বলিল—সেবাদাসী মানে?

নন্দলাল নির্বোধের মতো হাসিয়া বলিল—মানে যা, তাই। বিয়ে করা বউ নয়, তবু বারো বছর আমাদের সংসারে রয়েছে। নিজের বাবার কথা নিজে বলতে লজ্জা করে। এখন বাবার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে, সংসারের সবকিছু সেই সেবাদাসীর হাতের মুঠোয়। আমি ফিরলাম কী ফিরলাম না কেউ খোঁজও করবে না হয়তো—

পুকুরের জলের দিকে তাকাইয়া কিছুক্ষণ নন্দলাল কী ভাবিল, তারপর কাজলকে জিজ্ঞাসা করিল—আপনি কখনও জনাইয়ের মণ্ডা খেয়েছেন?

কাজল হাসিয়া বলিল—কী জানি, মনে পড়ছে না—

—তাহলে খাননি। ও জিনিস খেলে মনে থাকত। ওপরে পাতলা চিনির রসের পলেস্তারা থাকে, তার ভেতরে নরম সন্দেশ। নাম হচ্ছে-কী যেন বলে-মনোহরা। চৌধুরীদের ছোট মেয়ের বিয়েতে খাইয়েছিল। ওই একবারই খেয়েছি। তা আজ যখন শুনলাম—পুরুতমশাইও দালানের একদিকে থাকতে দিতে রাজি হয়েছেন—থেকেই যাই

মুখ-হাত ধুইবার জন্য নন্দলাল ঘাটের সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল। সেদিকে তাকাইয়া এই সুখাদ্যলোলুপ দরিদ্র ব্রাহ্মণসন্তানটির জন্য কাজলের মায়া হইল। একবার ইহাকে তাহাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলে হয় না?

সন্ধ্যাবেলা আরতির পর কাজল আবার দীঘির ঘাটে গিয়া বসিল। বাঁধানো ঘাটে নবমীর জ্যোৎস্না পড়িয়াছে। ওপারের নারকেল গাছের পাতায় চাঁদের আলো পড়িয়া চিকচিক করিতেছে। খানিকক্ষণ এমন জায়গায় বসিলেই মনের সব ঢেউ শান্ত হইয়া আসে। সুটকেস হইতে খাতা আর কলমটা লইয়া আসিলে চাদের আলোয় কবিতা লেখা যাইত।

হঠাৎ ছোট্ট হাসির শব্দে চমকাইয়া কাজল দেখিল কখন ঘাটের উপর অপালা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

—আমি ঠিক ভেবেছি আপনি এইখানে এসে বসে আছেন।

কাজল বলিল–শহরে থাকি তো, এমন জ্যোৎস্না, পুকুরঘাট, এমন নির্জনতা—এ সবই আমার কাছে নতুন। বেশ লাগছিল বসে থাকতে।

অপালা বলিল—আমার কাছেও। বাংলার গ্রাম তেমন করে দেখিই নি। লোকে পয়সা খরচ করে দূর দেশে বেড়াতে যায় কেন বলুন তো? যা আমি আগে কখনও দেখিনি, তাই তো আমার কাছে রহস্যময় নতুন দেশ, না?

কাজল অপালার সহিত একমত হইল।

বাড়ি হইতে দূরে পুকুরঘাটে রাত্রিবেলা অবিবাহিতা কোন মেয়ের অনাত্মীয় যুবকের সহিত এভাবে বসিয়া গল্প করাটা সমীচীন নয়, বাঙালি সমাজে মানুষ না হওয়ায় অপালা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। কিন্তু তাহার নিষ্পাপ সারল্যে আঘাত করিতে কাজলের বাধিল। সে বলিল—একটু একটু হিম পড়তে শুরু করেছে, না? চলো বরং বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসি—

অপালা প্রখর বুদ্ধিমতী, কিন্তু জীবনের ব্যবহারিক দিকগুলিতে তাহার কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। সে কাজলের ইঙ্গিত বুঝিতেই পারিল না, বলিল—আপনি ভারী শীতকাতুরে তো! কোথায় হিম? আমার মতো ছোটবেলা থেকে হিমালয়ের কাছাকাছি থাকলে বুঝতেন শীত কাকে বলে! বসুন না আর একটু, গল্প করি–

বাধ্য হইয়া কাজল বসিল। সামাজিকতার হানি ঘটে বলিয়া মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি থাকিলেও অপালার মতো মেয়ের সহিত জ্যোৎস্নায় একান্তে বসিয়া কথা বলিবার নেশা আছে। দুইজনে অনেক গল্প করিল। বেশির ভাগ গল্পেরই তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা নাই। কিন্তু প্রথম যৌবন, শরতের আশ্চর্য জ্যোৎস্না সামনে বিস্তৃত, পথের সবটা দেখা যায় না কে জানে তাহার অদৃষ্টে বাঁকে বাঁকে কত রোমাঞ্চ ও শিহরণ অপেক্ষা করিয়া আছে—প্রাসঙ্গিকতার খোঁজ কে করে, তারুণ্যই আসল, তারুণ্যের আনন্দই মানুষকে সঞ্জীবিত করিয়া রাখে।

চন্দ্রালোকিত এই রাত্রির কথা সে কোনোদিন ভোলে নাই।

পরের দিন বিদায় লইয়া চলিয়া আসিবার সময় নন্দলাল আবার সঙ্গী হইল। কিছুদূর হাঁটিবার পর নন্দলাল হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। কাজল বলিল–কী হল? থামলে যে?

নন্দলাল ঘাড় চুলকাইয়া লজ্জিতমুখে বলিল—আপনি একটু এগিয়ে ওই পথের মোড় একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি–

কাজল প্রথমে বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

—এইখানে পথের ধারে জল আছে, সুবিধে হবে। আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি আসব।

রাস্তার পাশে নয়ানজ্বলিতে জল জমিয়া আছে বটে। সেদিকে তাকাইয়া কাজল ব্যাপারটা বুঝিতে পারিল। গতরাত্রে অপরিমিত লুচি ও মণ্ডা খাইয়া নন্দ বেসামাল হইয়াছে। লোকটাকে ফেলিয়া আসা যায় না, তাহাকে কিছুক্ষণ বসিতেই হইল।

তাহার ট্রেন আসা পর্যন্ত নন্দলাল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া রহিল। কাজল তাহাকে ঠিকানা দিয়া বলিল–সুযোগ করে একদিন আমার বাড়ি যেয়ো, আমার মা খুব ভালো রান্না করেন, তোমাকে পেট ভরে খাওয়াব–

নন্দলাল কৃতজ্ঞতার হাসি হাসিল।

বিজয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা কাজল নদীর ধারে প্রতিমা বিসর্জন দেখিতে গেল। অন্যদিন এই সময়ে জায়গাটা নির্জন হইয়া আসে। আজ সেখানে বহু লোকের চেঁচামেচি। মানুষের কাঁধে করিয়া, লরি করিয়া ঠাকুর আসিতেছে। সব দলই সঙ্গে করিয়া পেট্রোম্যাক্স লণ্ঠন আনিয়াছে, কেহ কেহ আবার মশাল জ্বালাইয়া হাতে লইয়াছে। কোন ঠাকুর ঘাটের ধাপে দাঁড়াইয়াই বিসর্জন হইল, কোন দল নৌকায় চাপাইয়া মাঝনদীতে প্রতিমা লইয়া চলিল, সেখানে বিসর্জন দেওয়া হইবে। ঘাটের উপর কোলাহলরত জনতার দিকে তাকাইয়া কাজলের বছর চারেক আগের এমনই একটি বিজয়ার দিনেব কথা মনে পড়িল।

সে তখন সবে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হইয়াছে। আজকের মতোই একা ঘুরিতে ঘুরিতে নদীর ধারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। ঠিক সেই সমযটা নদীর ধার নির্জন, কোন প্রতিমা নাই। কাজলের হঠাৎ নদীর জলে একটু হাত ডুবাইতে ইচ্ছা করিল। কোন বিশেষ কারণে নয়, প্রবহমান জল দেখিলেই মানুষের স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করে, তাই। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া গিয়া সে ঠাণ্ডা জলে আঙুল দিয়া রেখা কাটিয়া খেলা করিতে লাগিল। ভেজা হাত লইয়া মুখে বুলাইয়া দিল। কিছুক্ষণ বসিবার পর হঠাৎ ঢাক-ঢোলের শব্দে উপরে তাকাইয়া দেখে প্রতিমা লইয়া একটি বিসর্জনের দল আসিয়া হাজির হইয়াছে। সে সন্ত্রস্ত হইয়া একপাশে সরিয়া গেল। যাহারা বিসর্জন দিবে তাহারা দাঁড়াইয়া রহিল। সম্ভবত কাহাদের বাড়ির পূজার ঠাকুর, বাড়ির মহিলারাও সঙ্গে আসিয়াছেন। উপরে উঠিতে গিয়া কাজল থামিয়া গেল।

দলের মধ্যে একটি মেয়ে দাঁড়াইয়া বিসর্জন দেখিতেছে। বছর সতেরো-আঠারো বয়েস। পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি। ঘনকুঞ্চিত লম্বা চুল কোমর ছাড়াইয়া নামিয়া আসিয়াছে। পাশেই কাহার হাতে মশাল জ্বলিতেছে, মেয়েটির মুখে সেই আলোর প্রভা। গোল মুখখানি, টানা-টানা দুই চোখ-মশালের আলো পড়িয়া যেন দুর্গাপ্রতিমার মুখে ঘামতেল চকচক করিতেছে।

দৃশ্যটা ভারি সুন্দর লাগিয়াছিল। কাহাদের মেয়ে কে জানে? হয়ো কবেই বিবাহ হইয়া গিয়াছে, কতদূরে চলিয়া গিয়াছে হয়তো বা। তবু চার বছর আগের ঘটনাটা সে ভুলিতে পারে নাই।

আজ আবার মনে আসিল।

বাড়ি ফিরিয়া মাকে বিজয়ার প্রণাম করিতেই হৈমন্তী বলিল—তুই এসে গিয়েছিল, ভালো হয়েছে। এত দেরি করলি কেন? একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আয় দেখি, মার কাছে যাব

কাজল বলিল—আজ রাত্তিরে আর কেন মা? কাল সকালে বরং

-না রে, এখুনি একবার যেতেই হবে। তুই বাড়ি ছিলি না, প্রতাপ এসে খবর দিয়ে গেল মায়ের খুব শরীর খারাপ। আমি আজই একবার যাব।

দিদিমার শরীর খারাপ শুনিয়া কাজলের চিন্তা হইল। দাদু মারা যাইবার পর হইতেই দিদিমা কেমন একরকম যেন হইয়া পড়িয়াছেন। আগেই হৃদযন্ত্রের গোলমাল ছিল, আজকাল বিছানা ছাড়িয়া ওঠা দূরের কথা, নিজে পাশও ফিরিতে পারেন না। সেবা ও পরিচর্যার জন্য সবসময়ে কাহাকেও কাছে থাকিতে হয়। কাজল সপ্তাহে অন্তত দুইদিন গিয়া দিদিমাকে দেখি আসে।

মামাবাড়ির বারান্দায় পুরাতন চাকর ভূষণ বসিয়া আছে। তাহারা রিক্শা হইতে নামিতেই সে মেজদি এসেছেন? বলিয়া হৈমন্তীকে প্রণাম করিল।

—ভালো আছো ভূষণ? মা কেমন আছে?

–খুব ভালো না। আজ একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। যান, ভেতরে যান–

ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখিল দিদিমা চোখ বুঁজিয়া শুইয়া আছেন। দুই অবিবাহিত মাসি সীতা ও প্রভা পাশে বসিয়া হাওয়া করিতেছে ও কপালে জলপটি দিতেছে। হৈমন্তীকে দেখিয়া প্রভা মায়ের কানের কাছে মুখ লইয়া বলিল—মা, ও মা-মেজদি এসেছে

বার-দুই বলিবার পর দিদিমা একবার তাকাইয়া দেখিলেন। উদাসীন নিস্পৃহ দৃষ্টি। তারপব আবার চোখ বন্ধ করিয়া পড়িয়া রহিলেন।

হৈমন্তী খাটের এককোণে বসিয়া বলিল—কবে থেকে এমন হয়েছে?

প্রভা বলিল—আজই সকাল থেকে। নইলে তো তোকে আগেই খবর দিতাম। তাও এতটা বাড়াবাড়ি হবে বুঝতে পারিনি। সকালে বলছিলেন মাথায় ব্যথা কবছে, মাথা ঘুরছে। দুপুবেব পর থেকে দেখি আর বিশেষ কথাবার্তা বলছেন না—

—প্রতাপ কোথায়?

সীতা বলিল—দাদা হেমন্তবাবুকে খবর দিতে গিয়েছে—

হেমন্তবাবু আজ বহুদিন মামাবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক। হঠাৎ কোন ছোটোখাটো প্রয়োজনে পাড়াব সুরেশ ডাক্তারকে ডাকা হইলেও বিপদ ঘোরালো হইলে হেমন্তবাবুই ভবসা। বেঁটেখাটো কিন্তু বিপুলায়তন মানুষটি। পোশাকে নিখুত পবিচ্ছন্নতা আছে। সমস্ত ব্যক্তিত্বে সহৃদয় বহুদর্শিতার ছন্দ। হেমন্তবাবু সেই বিবল চিকিৎসকের একজন, যাঁহারা ঘরে ঢুকিলেই বোগী আশ্বাস পাইয়া বালিশে ভর দিয়া উঠিয়া বসে।

এই সময়েই প্রতাপ হন্তদন্ত হইয়া ফিবিয়া আসিল। সঙ্গে ডাক্তারবাবু আসিয়াছেন। ধপধপে সাদা শার্ট সাদা প্যান্টের নিচে খুঁজিয়া পরা, লোমশ মোটা হাতে গোল বড়ো ডায়ালেব ঘড়ি, চলাফেরায় একটা অ-ত্বরিত বিচক্ষণতা। তিনি ঘরে ঢুকিতেই সবাই দাঁড়াইয়া উঠিয়াছিল। হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করিল–ভালো আছেন ডাক্তারবাবু?

হেমন্তবাবু হাসিয়া বলিলেন—ভাল আছি। আপনি ভালো তো?

হৈমন্তী ছাড়া এ বাড়ির সকলকে তিনি তুমি সম্বোধন করেন। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও হৈমন্তীকে আপনি বলা ছাড়িতে পাবেন নাই। হেমন্তবাবু অপুর বইয়ের ভক্ত পাঠক। সম্ভবত অপুর প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাহার স্ত্রীকে কন্যার বয়েসী হওয়া সত্ত্বেও সম্মান জানানো উচিত মনে করেন।

দিদিমাকে দেখিয়া ডাক্তারবাবু হাত ধুইবার জন্য বারান্দায় আসিলে কাজলও সঙ্গে আসিল। প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিল–কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?

সীতার কাছ হইতে তোয়ালে লইয়া হাত মুছিতে মুছিতে হেমন্তবাবু বলিলেন—বিশেষ ভালো নয়। এখুনি হয়তো কিছু হবে না, আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, আপাতত সামলে যাবেন এখন। কিন্তু হার্ট খুব উইক। তোমাদের মন প্রস্তুত করো

প্রতাপ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

–তাছাড়া কি হয়েছে জানো? তোমার বাবা মারা যাবার পর ওঁর বাঁচার ইচ্ছেটাই উনি হারিয়ে ফেলেছেন। সি উইল টু লিভ—এইটে খুব বড়ো কথা। শুধু ওষুধে রোগ সারে না, সঙ্গে ওটাও দরকার হয়। মাকে আর বেশিদিন রাখতে পারবে না

আজ দিদিমাকে দেখিয়া কাজলেরও সেই কথা মনে হইয়াছিল।

বাড়ি ফিরিবার সময় হৈমন্তী বলিল–মার যেমন অবস্থা দেখলাম—তুই একটু ঘন ঘন এসে খবর নিয়ে যাবি, কেমন?

কাজল সংক্ষেপে বলিল—যাবো।

জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা গিয়াছে। শৈশবে বাবা। এখন দিদিমা চলিয়া গেলে পুরাতন দিনগুলির সহিত একটা সত্যকারের বিচ্ছেদ ঘটিয়া যাইবে।

কিন্তু ইহাই নিয়ম। ইহার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ খাটে না।

স্কুলে পড়াইতে গিয়া কাজল একটা জিনিস লক্ষ করিল। বেশির ভাগ ছাত্রই ইংরেজিতে ভয়ানক কাঁচা। এ বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা করিতে গেলে প্রথমেই রুটিনে ইংরেজির ক্লাস কিছু বাড়ানো প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে একদিন সে হেডমাস্টারের সঙ্গেও কথা বলিল। উত্তরে হেডমাস্টার বলিলেন, প্রতিবারের মতো এই বৎসরও সিনিয়র টিচাররা অনেক মাথা খাটাইয়া রুটিন তৈরি করিয়াছেন, নতুন ক্লাস দিবার মতো কোন ফাঁক তাহাতে নাই।

কাজল বলিল—ওপরের ক্লাসগুলোয় হপ্তায় দু-তিনদিন এইটথ পিরিয ইনট্রোডিউস্ করে দেখলে হয় না স্যার?

হেডমাস্টার নিজের বিরলকেশ মস্তকে একবার হাত বুলাইয়া মৃদু হাসিলেন, তারপর বলিলেন—আমি অবশ্য এই স্কুলে কয়েকমাস হল এসেছি, শিক্ষক বা ছাত্রদের মানসিকতা সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু তবু আমার অভিজ্ঞতা বলে, ওটা সর্বত্রই এক। আপনার এই প্রস্তাব শিক্ষকমহলে সমর্থিত হবে বলে আমি মনে করি না। এমনিতেই তারা মনে করেন তারা ওভারবার্ডেনড়—নিজেদের রুটিনের ক্লাস ছাড়াও অনুপস্থিত শিক্ষকদের ক্লাস ভাগ করে নিতে হচ্ছে। এর ওপরে আর ক্লাস বাড়ালেন অমিতাভবাবু, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনার উদ্যোগ অ্যাপ্রিসিয়েট করছি, কিন্তু আপনার প্রস্তাব খুব প্রাকটিক্যাল নয়—

-স্যার, আমি যদি নাইন আর টেনের ছাত্রদের নিয়ে ছুটির পর স্পেশাল ক্লাস করি?

হেডমাস্টার আবার হাসিলেন। বলিলেন—ইনডমিটেবল ইয়ুথ, আঁ! তা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ছাত্রদের ভালোর জন্য কিছু করলে আমি তাতে বাধা দেব কেন? তবে আমার পরামর্শ এই—ও কাজ করতে যাবেন না। অফিসিয়াল রুটিনের ক্লাস না হলে অনেকেই স্পেশাল ক্লাসে থাকবে না, কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে যাবে। আপনিও তাদের শাস্তি দিতে পারবেন না। কিছুদিন পর স্পেশাল ক্লাস আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে আপনার এবং স্কুলের সুনামের হানি হবে।

কাজল বিমর্ষ হইয়া ফিরিয়া আসিল।

রুটিন বাড়ানো সম্ভব নয়। স্পেশাল ক্লাস নেওয়াও হেডমাস্টার সমীচীন মনে করেন না। কিন্তু কী করিলে ছাত্রদের উন্নতি হয় সে বিষয়ে তো আলোচনা হইল না? ছাত্রদের কৃা অবস্থা, কিছু বাড়তি পড়াশুনা না করিলে বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজির ফল বিভীষিকাময় হইবে। ইংরেজির অপর দুইজন শিক বহুদিন ধরিয়া কাজ করিতেছেন। নতুন কিছু করিবার উৎসাহ অনেককাল হইল ফুরাইয়াছে। তাঁহারা নির্দিষ্ট ক্লাসগুলি সারিয়া টিচার্স রুমে আসিয়া নস্য লন এবং ভাগাভাগি করিয়া খবরের কাগজ পড়েন। ছাত্ররা চরিয়া খায়।

ভাবিয়া ভাবিয়া কাজল একটা উপায় বাহির করিল। ক্লাস লইতে গিয়া নাইন ও টেনের ছাত্রদের সে বলিল—আমি তোমাদের কিছু কিছু করে হোম-টাস্ক দেব। এর জন্য তোমরা একটা  আলাদা খাতা করবে। কেবল ব্যাকরণ মুখস্থ করে ভালো ইংরেজি শেখা যায় না, বাড়িতে তোমরা সোজা ইংরেজিতে লেখা ছোট ছোট বই পড়বার চেষ্টা করবে। যারা উৎসাহী, তারা আমার বাড়িতে গেলে আমিও এ ধরনের বই দিতে পারব। ক্লাসেও আমি সহজ ইংরেজিতে মাঝে মাঝে গল্প বলব। তারপর তার থেকে প্রশ্ন লিখতে দেব। তোমরা বাড়িতে তার উত্তর লিখে ক্লাসে আমাকে এনে দেবে। আমি অবসর সময়ে কারেকট করে ফেরত দেব। দেখবে এতে তোমাদের উপকার হবে

কাজলের প্রস্তাবে ছাত্রদের মধ্যে খুব উৎসাহ দেখা গেল। সকলেই কিছু ফাঁকিবাজ ছাত্র নয়। অনেকেই সন্ধ্যাবেলা কাজলের বাড়ি গিয়া বই লইয়া আসিতে লাগিল। তাহার ক্লাসে টেবিলের উপর হোম-টাস্কের খাতার পাহাড় জমিয়া যায়। অফ পিরিয়ডে সে লাইব্রেরি ঘরে বসিয়া সেগুলি দেখে। পরের দিন টিফিনের সময় ছেলেরা ফেরত লইয়া যায়।

একদিন টিফিন পিরিয়ডে লাইব্রেরি ঘরে ছোকরা টিচারদের আড্ডা জমিয়া উঠিয়াছে। দপ্তরী কেশব ঘরের কোণে স্টোভ জ্বালিয়া চা বানাইয়া দুইটি বিস্কুটসহ সকলকে দিতেছে। মাঝে মাঝে দুএকজন ছাত্র আসিয়া কাজলের নিকট হইতে খাতা ফেরত লইয়া যাইতেছে। এমন সময় প্রেীঢ় ইতিহাসের শিক্ষক রামনাথবাবু দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ভিতরে উঁকি দিলেন। ছোকরারা একটু সন্ত্রস্ত হইয়া গুঞ্জন বন্ধ করিল, যাহারা ধুমপান করিতেছিল তাহারা সিগারেট লুকাইয়া ফেলিল। বিশ্বেশ্বর ভট্টচার্য বলিল—কিছু বলবেন নাকি রামনাথদা? আসুন ভেতরে আসুন

-না, তোমরা বসো। এ ঘরে টিফিনের সময় আজ কদিন ধরে ছাত্ররা খুব যাতায়াত করছে, তাই দেখতে এলাম কী ব্যাপার–

উত্তরে কেহ কিছু বলিল না। রামনাথবাবু আর একবার দৃষ্টিপাত করিয়া চলিয়া গেলেন।

পরদিন থার্ড পিরিয়ড অফ থাকায় কাজল বসিয়া ক্লাস নাইনে হোম-টাস্কের খাতা দেখিতেছে, রামনাথবাবু আবার আসিলেন।

-কী হে, অমিতাভ, কী করছো?

কাজল দাঁড়াইয়া বলিল—আসুন রামদা। এই একটু খাতা দেখছি আর কি–

-খাতা? কিসের খাতা? প্রাইভেট টিউশনির?

–আজ্ঞে না। উঁচু ক্লাসগুলোয় একটু স্পেশাল কোচিং দেবার চেষ্টা করি, যাতে রেজাল্টটা— এবার ইয়ারলি পরীক্ষার অবস্থা দেখেছেন তো?

রামনাথবাবু কোনো কথা না বলিয়া কিছুক্ষণ টেবিলের উপর স্তুপীকৃত খাতার দিকে তাকাইয়া থাকিলেন, তারপর বলিলেন–বাঃ, বেশ ভালো! নিজের সময় নষ্ট করে ছেলেদের উপকার এসব আজকাল আর দেখা যায় না—

—না দাদা, আসলে নিজের চর্চাটাও থাকে, ছাত্রদেরও কাজ এগোয়—

—ভালোই তো। চালিয়ে যাও। একটা মহৎ দৃষ্টান্ত–

রামনাথবাবু চলিয়া গেলেন বটে, কিন্তু কাজলের আর কাজে মন বসিল না। পরপর দুইদিন ভদ্রলোকের আসাটা কেমন যেন সন্দেহজনক। এমনিতে সিনিয়র টিচাররা লাইব্রেরি ঘরে বড়ো একটা আসেন না। ব্যাপার কী?

ব্যাপার কয়েকদিন বাদেই পরিষ্কার হইয়া গেল।

ফিফথ পিরিয়ডে কাজল আর রমাপদ দুইজনেরই একসঙ্গে অফ পড়িয়াছে। কাজল খুসিডিডিস-এর পেলোপনেশিয়ান ওয়ার পড়িতেছিল, রমাপদ একটা সিগারেট ধরাইয়া উমুখে ধোয়া হাড়িয়া বলিল–বই রাখুন, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে। নিন একটা সিগারেট ধরান আগে

সিগারেট ধরাইয়া কাজল বলিল—কী কথা?

–রামনাথদা কাল দুপুরে এসেছিলেন এ ঘরে?

-হ্যাঁ, কেন বলো তো?

—আপনি তখন কী করছিলেন?

ছাত্রদের হোম-টাঙ্কের খাতা দেখছিলাম। কেন, কী হয়েছে তাতে?

রমাপদ ধোয়ার রিং করিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতে করিতে বলিল—হয়েছে অনেক কিছু। রামনাথদা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন এটা প্রকৃতপক্ষে প্রাইভেট টিউশনি জোগাড় করার জন্য আপনার একটা কায়দা–

কাজল স্তম্ভিত হইয়া গেল। তাহার কোন সৎ প্রচেষ্টার যে এইরূপ ব্যাখ্যা হইতে পারে তাহা সে আদৌ ভাবে নাই। সে বলিল—কী বলছো তুমি? রামনাথদা এই কথা রটাচ্ছেন? প্রাইভেট টিউশনি আমি চেষ্টা করলে তো এখুনি দশটা নিতে পারি কত ছেলে আমার বাড়ি গিয়ে সাধাসাধি করে। কিন্তু আমার সময় কোথায় বলো তো? টিউশনি করতে গেলে আমার লেখাপড়ার সময় আর থাকে না। সেজন্যই তো স্কুলে বসে অফ পিরিয়ডে ছেলেদের খাতা দেখি–

রমাপদ বলিল—আমার কাছে আপনার সাফাই গাইতে হবে না, আমি তো জানি আপনি কী ধরনের লোক। ভুলটা আপনিই করেছেন অমিতাভদা–

—কী রকম?

—এসব ছাত্রকল্যাণমূলক কাজকর্ম শুরু করে ভালো কবেন নি। বাইরে থেকে শিক্ষকতা বেশ একটা মহৎ ব্রত বলে মনে হয়, এব ভেতরে যে কত ঈর্ষা আর গোলমাল রয়েছে তা আপনি জানেন না। স্কুলের প্রায় কেউই আপনার এই কাজ ভালো চোখে দেখছে না–

কাজল জিজ্ঞাসা করিল–কালিদাসবাবুও?

জিভ কাটিয়া রমাপদ বলিল—উনি বাদে। কালিদাসবাবু অন্যরকম লোক—

কাজল জিজ্ঞাসা করিল—এ নিয়ে রামনাথদার সঙ্গে একবার কথা বলব নাকি? উনি যদি ভুল বুঝে থাকেন, সেটা ভেঙে দেওয়াও তো উচিত।

-পাগল নাকি? আপনি নিজে কিছুই শোনেননি, রামদা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবেন একথা আপনাকে কে বলেছে? উনি যাদেব বলেছেন তারাও কেউ আপনার কাছে স্বীকার করবে না। মাঝ থেকে আপনি ফেঁসে যাবেন। তাছাড়া রামদা মোটেই ভুল বোঝেন নি, রাগে উনি অমন বলছেন—

—রাগ কিসের?

-বলা কঠিন। নিজের যে কাজ করা উচিত অথচ করতে পারছি না, অন্যে তা করছে—এটা থেকে অকারণ রাগ আসতে পারে। প্রফেশনাল জেলাসি হতে পারে

কাজল আশ্চর্য হইয়া বলিল—কী রকম?

—আপনি বিনাপয়সায় এরকম পরোপকার করে বেড়ালে ওঁদের টিউশনি কমে যাবে। অন্তত ওঁরা ছাত্রদের কাছে হেয় হবেন। যে কাজ ওঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে করে থাকেন, সেটা আপনি বিনাপয়সায় করে দিলে ছাত্রদের কাছে ওঁদের দর কমে যাবে

বাহিরের জগৎটা সম্পর্কে কাজলের ধারণা বাবার বই পড়িয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। পৃথিবীর মানুষ মোটর উপর সবাই ভালো, বিশ্বসৃষ্টির ভিতর দিয়া প্রবাহিত একটা শুভাক্তি সমাজ-সংসারকে চালিত করিতেছে—এই বিশ্বাস তাহাকে এতদিন নানা বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও আশাবদী রাখিয়াছিল। আজ প্রথম সেই বিশ্বাসটায় বোরকমের ধাক্কা খাইল।

কিন্তু অনেক রাতে নিজের ঘরে বিছানায় শুইয়া হথর্নের স্কারলেট লেটার পড়িতে পড়িতে তাহার হতাশার বোধটা কাটিয়া গেল। নতুন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়াই জীবনের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপিত হয়। মানিয়া লইতে যতই কষ্ট হউক, তবু বাস্তবকে স্বীকার করিতেই হইবে।

কত রাত এখন? বারোটা? একটা? গত পাঁচ-ছয়দিন সে কিছু লেখে নাই, উপন্যাসখানি কিছুদূর অগ্রসর হইয়া থামিয়া রহিয়াছে। আচ্ছা, আজ বাকি রাতটুকু সে যদি না ঘুমাইয়া শুধু লেখে?

আউট অফ কেও কেম দি কসমস! বিশৃঙ্খলা হইতে, আদর্শ ভাঙিয়া যাইবার বেদনা হইতেই প্রকৃত সাহিত্য উঠিয়া আসে। অপূর্ণতার যন্ত্রণাই সমস্ত শিল্পের মূল কথা। সংসারে সবকিছু ঠিকঠাক চলিলে কে আর ছবি আঁকিয়া বা গান গাহিয়া ফাঁকটুকু পূরণ করিবার চেষ্টা করিত?

সারারাত জাগিয়া কাজল লিখিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *