১৩ নম্বর ঘর

১৩ নম্বর ঘর

মূল গল্প  Room Number 13 (Montagues Rhodes James)

জুটল্যান্ড শহরের মধ্যে এই ভাইবর্গ জনপদটা সবথেকে বেশি বিখ্যাত, আর তার থেকেও বেশি বিখ্যাত শহরের বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন চার্চগুলো৷ শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা লেক বয়ে গেছে৷ সব মিলিয়ে বলা যায় ছুটির দিনে বেড়াতে আসার জন্য ভাইবর্গের থেকে ভালো শহর আর হয় না৷ তবে এতদূর শুনে ভাববেন না আমি কোনও ভ্রমণ কাহিনি লিখতে বসেছি৷

ভাইবর্গ শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো হোটেল আছে, প্রিসলার আর ফিনিক্সের নাম তো আকছার শোনা যায়, কিন্তু আমার যে মাসতুতো ভাইয়ের কাহিনি আমি আপনাদের কাছে বলতে বসেছি সে উঠেছিল গোল্ডেন লায়ন নামের একটা হোটেলে৷ এবং তারপর আর কোনওদিন সেই হোটেলে সে ফিরে যায়নি৷ বাকি গল্পটা আপনাদের বুঝবার সুবিধার্থে তার জবানবন্দিতেই বলছি আমি৷

১৭২৬ সালে আগুন লেগে এই গোটা শহরের অনেকগুলো বাড়ি পুড়ে যায়৷ যেক-টা হোটেল তারপরেও দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে গোল্ডেন লায়ন অন্যতম৷ বাড়িটা লাল রঙের ইটের তৈরি, সামনের দিকটায় লাল এবং পিছনের দিকের সৌধগুলো কালচে রঙের, গোটা বাড়িটাই কাঠ আর প্লাস্টার দিয়ে তৈরি৷

এই বাড়িটার সামনে আমি যখন এসে উপস্থিত হই তখন দিগন্তের কাছে সূর্য ঢলে পড়েছে৷ বাড়ির ছাদের কার্নিসে একটু-একটু করে মিলিয়ে আসছে রোদ৷ এই ধরনের পুরনো বাড়ির প্রতি জানি না কেন ছোট থেকেই একটা টান কাজ করে আমার৷ মনটা খুশি হয়ে গেল৷

বিগত কয়েক মাস ধরে আমি ডেনমার্কের প্রাচীন চার্চগুলো নিয়ে একটু গবেষণা শুরু করেছি৷ ইচ্ছা আছে ম্যাগাজিনে বড় করে একটা প্রবন্ধ লিখব৷ ভাইবর্গ শহরে প্রাচীন চার্চের ছড়াছড়ি৷ ফলে সেগুলো খতিয়ে দেখতে গেলে শহরে এসে থাকা ছাড়া উপায় নেই৷

স্থানীয় লোকজনের কাছে খোঁজখবর করে গোল্ডেন লায়ন হোটেলের সন্ধান পাই আমি৷ হোটেলের ম্যানেজারটি ভারী অমায়িক৷ আমি এসে একটা বড়সড় ঘরের খোঁজ করতে বেশ কয়েকটা ঘর তিনি আগে থাকতেই দেখিয়ে দিলেন৷

তার মধ্যে থেকে একেবারে উপরতলার ঘরগুলো আমি প্রথমেই বাদ দিলাম৷ সারাদিন কাজের পর হোটেলে ফিরে একগাদা সিঁড়ি ডিঙাতে মোটেই ভালো লাগবে না৷ তিনতলায় আমার পছন্দ মতো কোনও ঘর ছিল না৷ নীচে নেমে দোতলার দুটো ঘরের সামনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ সত্যিই এই রকম একটা ঘরই খুঁজছিলাম৷

‘আপনি এই ১৭ নম্বর ঘরটায় থাকতে পারেন, আপনার যেরকম রুচি তাতে এর থেকে ভালো ঘর আর হয় না…’

ঘরের ভিতরে তাকিয়ে এক ঝলক দেখে আমার কিন্তু পছন্দ হল না, বিশেষ করে ঘরের জানলাটা পাশের বাড়ির দেওয়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে৷ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম ‘উঁহু, সন্ধ্যার পর ঘরটায় বিশেষ আলো পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না, এ ঘর চলবে না…’

বাকি ঘরগুলো দেখে নিয়ে ঠিক করলাম ১২ বা ১৪ নম্বরের মধ্যে যে-কোনও একটা ঘর আমার থাকার জন্য আদর্শ৷ দুটো ঘর থেকেই রাস্তা দেখা যায়, সন্ধের আলো খোলা জানলা দিয়ে সহজেই ঘরের ভিতর ঢুকে আসে৷ ফলে আমার পড়াশোনাতেও কিছু সুবিধা হবে৷

ভেবেচিন্তে শেষপর্যন্ত বারো নম্বরটাই ঠিক হল৷ আশপাশের ঘরগুলোর মতো এটাতেও মোট তিনটে জানলা, এবং তিনটে একইদিকে৷ ঘরটা বেশ উঁচু, কোনও ফায়ারপ্লেস নেই তবে দশাসই একটা স্টোভ আছে৷ একদিকের দেওয়ালে একটা পৌরাণিক ছবি ঝুলছে৷ ছবিটা চিনতে পারলাম না৷

ডিনারের সময় হয়ে আসছিল৷ বেল বাজার আগেই আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম৷ খাবার সার্ভ হতে এখনও কিছু দেরি আছে৷ ভাবলাম এই সময়টুকু চারপাশের ঘরে কারা আছে সেই নিয়ে কিছু খোঁজখবর করা যেতে পারে৷

ডেনমার্কের এই হোটেলগুলোর নিয়ম হল প্রত্যেকটা ঘরে যেসব ভাড়াটে আছে তাদের নাম বাইরে একটা বড় ব্ল্যাকবোর্ডে লিস্ট করে লেখা থাকে৷ সেই লিস্টের উপর মন দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি৷ অস্বাভাবিক কিছুই নেই প্রায়৷ অতিথিদের মধ্যে একজন উকিল আছেন, নাম জ্যান্সেন৷ বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি৷ এছাড়া বাকিদের মধ্যে আছে একজন সার্জেন, একজন জার্মান আর একজন কোপেনহেগেন থেকে আসা সরকারি আমলা৷

লিস্টের মধ্যে একমাত্র আশ্চর্যের ব্যাপার হল—১২ আর ১৪ নম্বর ঘরের মাঝে কোনও ১৩ নম্বর ঘর নেই৷ অবশ্য ডেনমার্কের অনেক হোটেলেই এই ব্যাপারটা লক্ষ করেছি আমি৷ মন বলল তেরো সংখ্যাটা অশুভ হওয়ার জন্য অনেক ভাড়াটেই হয়তো ও ঘরে থাকতে চায় না৷ তাই খরচ বাঁচাতে তৈরিই করা হয়নি ঘরটা৷ ঠিক করলাম পরে বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে হবে ব্যাপারটা৷

সেদিন সমস্ত সন্ধ্যাটা আর বলার মতো তেমন কিছু ঘটেনি৷ জামাকাপড় বই আর কাগজপত্র গোছাতে-গোছাতেই সন্ধেটা চলে গেল৷ রাত এগারোটা নাগাদ আমি ঘুমানোর তোড়জোড় শুরু করলাম৷ দীর্ঘদিন হল গল্পের বই পড়তে-পড়তে ঘুমানো আমার অভ্যাস, আজ বইটা খুঁজতে গিয়ে সেটা কোথাও পেলাম না৷ ঠিক তখনই মনে পড়ল ট্রেনে আসতে-আসতে বইটা পড়ছিলাম৷ ট্রেন থেকে নেমে কোটের পকেটে রেখে দিয়েছিলাম বইটা৷ সেই কোটটা ঝুলছে ডাইনিং রুমের পাশের দেওয়ালের হুকে৷

তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেলাম ডাইনিং রুমের দিকে৷ কোটটা নিয়ে ফিরে এসে দরজার হাতল ঘোরাতেই কিন্তু থমকে গেলাম৷ দরজা বন্ধ৷ অথচ স্পষ্ট মনে আছে যাবার সময় দরজা আমি বন্ধ করে যাইনি৷ তাহলে কি নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে? তাজ্জব ব্যপার!

দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কী করা যায় ভাবছি, এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে একটা চাপা শব্দ ভেসে এল, যেন ঘরের আসবাব খুব ধীরে-ধীরে কেউ নাড়াচ্ছে৷

একটু চিন্তা করতেই মাথার ভিতরে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা৷ তাড়াহুড়োতে হয়তো ভুল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমি৷ আমার নিজের ঘরটা কি তবে ডানদিকে? না বাঁদিকে? মুখ তুলে ঘরের নম্বরটা দেখার চেষ্টা করলাম—১৩ নম্বর ঘর৷ মানে আমার ১২ নম্বর ঘরটা হবে বাঁদিকে৷

কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরে ফিরে এসে বইটা পড়তে শুরু করলাম৷ তিনটে-চারটে পাতা পড়ার পরেই দু-চোখ জুড়ে ঘুম নামল আমার৷ বইটা সরিয়ে রেখে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ধাঁ করে মনে পড়ে গেল ব্যাপারটা৷ ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা লিস্টে কোনও ১৩ নম্বর ঘর ছিল না৷ তাহলে কি ভুল দেখেছিলাম? তাই হবে হয়তো৷

ভাবলাম, যদি আগে জানতাম যে তেরো নম্বর ঘর আছে, তাহলে সেখানেই থাকতাম না হয়৷ আর কিছু না হোক আমি যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই সেটুকুনির প্রমাণ অন্তত বাড়িওয়ালাকে দেওয়া যেত৷ একবার মনে হল ঘরটা হয়তো সত্যি আছে৷ তবে চাকর-বাকরদের ঘর বা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার হয় বলে ব্ল্যাকবোর্ডে নাম নেই৷

ঘুমাতেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা অচেনা অস্বস্তি এসে চেপে ধরল আমাকে৷ খোলা জানলা দিয়ে বাইরে স্ট্রিট ল্যাম্পের হলদে আলো আসছে৷ সেই আধো-আলোতে ভরে আছে আমার ঘরটা৷ হলদে আলোর রেখাগুলো ঘরময় একটা ভৌতিক নকশা তৈরি করেছে৷ সাধারণত এই ধরনের আধো-আলোতে ছোট ঘরকে বড় মনে হয়, কিন্তু এখন আমার ঘরটাকে আগের থেকে বেশ ছোট মনে হচ্ছে৷ আরও কিছুক্ষণ এক মনে খেয়াল করতে বুঝলাম ঠিক তা নয়৷ ঘরটা প্রস্থে ছোট হয়েছে বটে, কিন্তু দৈর্ঘ্যে বেড়ে গেছে৷ নাহ, প্রথম যখন এ ঘরে এসেছিলাম তখন সিলিংটা তো এত উঁচুতে ছিল না৷ ঘরটা কি নিজের আয়তন বদলে ফেলছে? মাথা না ঘামিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷

পরদিন সকাল হতে খাতাপত্র নিয়ে রিগসার্কিভ চার্চে উপস্থিত হলাম৷ চার্চের লোকজন বেশ অমায়িক৷ সামান্য বোঝাতেই যাবতীয় ডকুমেন্ট আর রেলিক্স আমার হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করলেন না তাঁরা৷ সেই সব কাগজপত্রে চোখ বোলাতে-বোলাতে ভারি চমকপ্রদ কিছু তথ্য উঠে এল আমার হাতে৷ ডকুমেন্টের মধ্যে বিশপ জরগান ফ্রিজের সম্পর্কে বেশ কয়েক পাতা লেখা আছে৷ এই ক্যাথলিক অন্দরমহলে বেশ কিছু স্ক্যান্ডাল নাকি চালু ছিল৷ বিশপকে নিয়ে চার্চের শোনা যায় শহরের মধ্যে কোনও একটি বাড়ির মালিক ছিলেন তিনি৷ সে বাড়িতে তিনি নিজে থাকতেন না৷ একটি ভাড়াটে বসবাস করত৷ তো সেই ভাড়াটেটি বিশেষ সুবিধের ছিল না৷ নানানরকম তন্ত্রমন্ত্র আর ব্ল্যাকআর্টস নাকি প্যাকটিস করত সে৷ এমন এক দুর্বৃত্তের সঙ্গে বিশপের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তাকে সমন পাঠায় চার্চ৷ বলাবাহুল্য ফ্রিজ সমস্ত অপরাধ অস্বীকার করেন এবং এও বলেন যে তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় তাঁর ভাড়াটে কোনওরকম অলৌকিক সাধনার সঙ্গে যুক্ত তবে তার বিরুদ্ধে তিনি নিজেই ব্যবস্থা নেবেন৷

কাগজে আরও কিছু তথ্য ছিল বটে কিন্তু সেসব পড়ে দেখার ঢের আগেই আমার জন্য চার্চের নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়ে যায়৷ পরের চিঠিটা হাতে তুলেও নামিয়ে রাখি৷ মনের ভিতরে কৌতূহল কিন্তু দানা বাঁধতে শুরু করেছে ততক্ষণে৷

চার্চ থেকে বেরিয়ে শহরের এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে আমি আবার গোল্ডেন লায়নে ফিরে আসি৷ কিছুক্ষণ পেশেন্স খেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই মাথায় আসে যে হাবিজাবি কথার ফাঁকে তেরো নম্বর ঘরের ব্যাপারটা বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি৷

উপরে উঠে তেরো নম্বর ঘরটা আবার চোখে পড়ে৷ তার সামনে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াই আমি৷ ভিতর থেকে কাল রাতের সেই শব্দগুলো ভেসে আসছে৷ সেই সঙ্গে খুব মিহি, কিন্তু চাপা স্বরে যেন হিসহিস করছে কেউ৷

শব্দগুলো শুনতে-শুনতে কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হয়৷ সেগুলো মাথা থেকে সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই কাল রাতের সেই ভাবনাটা আবার আমার মাথায় ফিরে আসে৷ প্রথমবারের তুলনায় এখন বেশ কিছুটা ছোট হয়ে গেছে ঘরটা৷ তবে কি আমারই মনের ভুল? প্রথমবারই কি তবে ভুল দেখেছিলাম? ঘরটা বড় ছিল বলেই তো পছন্দ হয়েছিল৷ ভাবলাম ধুর, ঘরটা ছেড়ে বরঞ্চ অন্য কোনও ঘরে শিফট করে যাই৷

ঠিক এই সময়ে একটা রুমাল দরকার পড়ে আমার৷ রুমাল একটা ছিল বটে আমার সুটকেসের মধ্যে৷ সুটকেসটা রেখেছিলাম ঘরের একদিকের দেওয়ালের সামনে রাখা টুলের উপরে৷ সেদিকে তাকিয়ে আমি হতাশ হলাম৷ জায়গাটা খালি৷ টুল কিংবা সুটকেসের কোনও চিহ্ন নেই সেখানে৷ বুঝলাম চাকর-বাকরদের মধ্যে কেউ হয়তো সুটকেস খুলে তার জিনিসপত্র ওয়ারড্রবের মধ্যে তুলে রেখেছে৷ এগিয়ে গিয়ে ওয়ারড্রব খুলে অবাক হয়ে গেলাম—সেখানেও কিছু নেই৷

মাথাটা গরম হয়ে উঠল৷ কেউ চুরি করল সুটকেসটা? কিন্তু ডেনমার্কের লোকজন চুরি করে বলে তো শুনিনি! তাহলে? কোথাও একটা গন্ডগোল নিশ্চয়ই হয়েছে৷ তবে সেই মুহূর্তে আর এই নিয়ে বেশি হইচই করতে আমার ইচ্ছা করল না৷

দেওয়ালের দিক থেকে সরে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ বাইরে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা লম্বা বাড়ি দেখা যাচ্ছে৷ মৃত দেওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা৷ রাস্তায় কোনও লোক নেই—শুনশান, অন্ধকার রাত৷ বাইরে প্রায় কিছুই দেখা যায় না৷

ঘরে আমার ঠিক পিছনেই আলো জ্বলছিল৷ উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালে আমার নিজের ছায়া গিয়ে পড়েছে৷ তার ঠিক পাশেই এগারো নম্বর ঘরের লোকটার ছায়া দেখা যাচ্ছে৷ লোকটা ঘরের একদিক থেকে আরেকদিক বেশ কয়েকবার যাতায়াত করল৷ পাশে তাকাতেই চোখে পড়ল তেরো নম্বর থেকেও কারও ছায়া পড়েছে দেওয়ালে৷ জানি না কেন একটা আগ্রহ জন্মাল আমার৷ আমার মতোই জানলায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে লোকটা৷ দেখে মনে হল লোকটা লম্বা আর রোগা৷ তবে পুরুষ না মহিলা সেটা বুঝতে পারলাম না৷ ছায়া দেখে মনে হচ্ছে প্লাস্টিক টাইপের কিছু দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে মানুষটা৷ ঘরে যে আলো জ্বলছে সেটা লাল৷ মাথাটা জানলা থেকে বেশ কিছুটা বাইরে বের করে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তেরো নম্বর ঘরের জানলায় কাউকে চোখে পড়ে কি না কিন্তু দেওয়ালের গায়ে সাদা রঙের পর্দাজাতীয় কিছু থাকার জন্য কিছুই দেখা গেল না৷

ঠিক এই সময়ে রাস্তার উপর বেশ কিছুটা দূরে একটা পায়ের শব্দ শোনা গেল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার বাঁ পাশে দেওয়ালের উপরে লাল আলো ঝট করে নিভে গেল৷ সেই সঙ্গে ছায়াটাও যেন মুহূর্তে সরে পড়ল৷ এতক্ষণ যেখানে লাল আলোটা এসে পড়েছিল দেওয়ালের সেই জায়গাটা ঢেকে গেল অন্ধকারে৷ আরও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিগারেট খেয়ে আমি শুতে চলে গেলাম৷

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম একটা চাকর গরম জল দিতে এসেছে৷ কোনওরকমে ঘুম জড়ানো গলায় তাকে বললাম ‘আমার সুটকেসটা কে সরাতে বলেছে তোমাদের? দিয়ে যাও ওটা৷’

আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা একটু হাসল৷ তারপর গরম জল টেবিলে রেখে কোনও কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল৷ ভাবলাম ডেকে আচ্ছা করে ধ্যাতানি দিই৷ কিন্তু দেওয়ালের দিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ টুলের উপর রাখা আছে সুটকেসটা৷ ঠিক যেমন ভাবে রেখেছিলাম, সেইভাবে৷ কাল রাতে তবে জিনিসটা দেখতে পেলাম না কেন? আরও একটা ব্যাপার মনে হল আমার৷ কাল রাতে ঘরটাকে ছোট মনে হচ্ছিল বটে এখন কিন্তু আবার আগের মতোই লাগছে, আমারই মনের ভুল হচ্ছে বারবার? একটা সন্দেহ শুরু হল মনের ভিতরে৷

নীচ থেকে জলখাবারের ডাক আসতে আমি জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম৷ যাবার সময় খেয়াল করলাম ১৩ নম্বর ঘরের বাসিন্দা এখনও ঘরের ভিতরেই আছে৷ ঘরের ঠিক বাইরেই একজোড়া জুতো খোলা আছে৷ পুরুষ মানুষের বুট৷ অর্থাৎ ১৩ নম্বর ঘরের বাসিন্দা একজন পুরুষ৷ মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে হাঁটতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় খেয়াল করলাম, যে ঘরের সামনের জুতো খোলা আছে সেটা ১৩ নম্বর নয় ১৪ নম্বর ঘর৷ তাহলে কি ১৩ নম্বর ঘর পেরিয়ে এসেছি? পিছিয়ে এসে উপরে তাকালাম৷ ঘরের নম্বর ১২৷ ১৪ আর ১২ নম্বর ঘরের মধ্যে কোনও ১৩ নম্বর ঘর নেই৷

অবিশ্বাস্য! যতদূর মনে পড়ছে কাল রাতে একফোঁটা মদও খাইনি, তাও চোখ এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল! ব্যাপারটা মাথায় নিয়েই সেদিনের মতো কাজে বেরিয়ে পড়লাম৷

তবে কাজে তেমন সুবিধা করতে পারলাম না৷ বিশপ ফ্রিজ বা তার ভাড়াটে সম্পর্কে একটা মাত্র চিঠি আমার হাতে এল, এবং সে চিঠিতেও তেমন স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই৷ শুধু এটুকু বোঝা যায় যে ভাড়াটের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনওটাই প্রমাণিত হয়নি৷ উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ এরপর বিশপ ও তার ভাড়াটের কী হয় সে সম্পর্কে আর কোনও চিঠিপত্র নেই৷ বিশপের সেই বিতর্কিত বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল চার্চের লোকজনকে জিজ্ঞেস করায় তারা মাথা নেড়ে জানায় যে তার সঠিক লোকেশন এ শহরে প্রায় কেউই জানে না৷

সেদিন হোটেলে ফিরে আমি আর পেশেন্স খেলতে গেলাম না৷ চোখে পড়ল বাড়িওয়ালা একতলার ডাইনিং হলে বসে রাতের খাওয়া সেরে নিচ্ছেন৷ তার পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম৷ খানিক এলোমেলো গল্পগুজবের পর মূল প্রসঙ্গে এসে পড়লাম৷ ‘আচ্ছা আপনাদের এখানে বেশিরভাগ হোটেলে তেরো নম্বর ঘর নেই কেন বলুন তো? এমনকি এই হোটেলে ও দেখছি… কোনও কুসংস্কার থেকেই কি?’

মনে হল আমার প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হয়েছেন বাড়িওয়ালা৷ খেতে-খেতে বললেন, ‘আপনার মতো আমারও বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে ব্যাপারটা৷ সত্যি কথা বলতে কী, এই সব কুসংস্কার আমিও বিশ্বাস করি না৷ আমি এখানকারই স্কুলে পড়ে মানুষ হয়েছি, আমাদের যিনি হেডমাস্টার ছিলেন তিনি এসব ব্যাপার একদম সহ্য করতে পারতেন না৷ ভদ্রলোক মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল…’

বুঝলাম প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইছেন তিনি৷ বললাম, ‘তার মানে আপনি বলছেন তেরো নম্বর ঘর নিয়ে আপনার কোনও আপত্তি নেই?’

আমার প্রশ্নটার আর কোনও সরাসরি উত্তর দিলেন না ভদ্রলোক৷ একটু ফেনিয়ে-ফেনিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এই হোটেলটার দায়িত্ব আমি পেয়েছিলাম আমার বাবার থেকে৷ উনি এই ভাইবর্গেই জন্মেছিলেন৷ হোটেলটা কার থেকে কিনেছিলেন জানি না৷ ১৮৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই হোটেলের দায়িত্ব পাই আমি…’

‘তো সেই সময় এখানে একটা ১৩ নম্বর ছিল?’

‘আরে, না-না৷ সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম, বুঝতেই পারছেন এখানে বেশিরভাগ ভাড়াটেই দূর দেশ থেকে ঘুরতে এসেছেন৷ তাঁদের সবার ভাবনা-চিন্তাও একরকম নয়, পছন্দও নয়, তবে একটা ব্যাপার নিয়ে সকলেই একমত৷ ১৩ নম্বর ঘরে শোবার থেকে রাস্তায় শুয়ে রাত কাটানো ভালো৷ তাঁদের মতামত ১৩ নম্বর নাকি অপয়া৷ তর্ক করতে গেলে নানান রকম গল্প শোনাতেন তাঁরা৷ বিচিত্র সব গল্প৷ বলতেন, ১৩ নম্বর ঘরে রাত কাটালে মানুষ নাকি আর আগের মতো থাকে না…’

‘এখন তাহলে আপনাদের ১৩ নম্বর ঘরে কে থাকে?’

‘কী বলছেন মশাই! ১৩ নম্বর ঘর!’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান বাড়িওয়ালা, ‘এ বাড়িতে কোনও ১৩ নম্বর ঘর নেই৷ আমি তো ভাবলাম আপনি আগেই লক্ষ করেছেন৷ কারণ সেটা যদি থাকত তাহলে সেটা তো আপনার ঘরের পাশেই থাকত…’

‘তা ঠিক, তবে কাল রাতে আমি দেখলাম আমার ঘরের ঠিক পাশেই একটা ঘরের উপরে ১৩ লেখা আছে এবং এমনকি পরশুদিন রাতেও…’

বাড়িওয়ালা মাথা নেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন৷ আমিও এই নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না৷

মনটা কিন্তু সারাদিন খিঁচড়েই রইল৷ ব্যাপারটাকে শুধু ভুল দেখা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ পরপর দু-দিন একটা আস্ত ঘর চোখের ভুলে দেখলাম, এ হতে পারে না৷

সেদিন রাতে বাড়িওয়ালাকে আমার ঘরে নেমন্তন্ন করলাম৷ তিনি রাজিও হয়ে গেলেন৷ রাত ঠিক দশটার সময় তার আসার কথা৷ তার আগে কিছু চিঠিপত্র লেখার ছিল সেগুলো লিখতে-লিখতে, হাত কেঁপে গেল৷ বুঝলাম, ১৩ নম্বর ঘরের ব্যাপারটা আমার নার্ভগুলোকে অস্থির করে তুলছে বারবার৷ সন্ধে থেকে আবার স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট দেখাচ্ছে আমার ঘরটাকে৷

আমার প্রতিবেশীদের দিক থেকে তেমন আওয়াজ আসছে না৷ মাঝে- মাঝে বুট পরা পায়ের হেঁটে যাওয়ার শব্দ, মানুষের গুনগুন, রাস্তার উপর দিয়ে কখনও-কখনও একটা-দুটো ঘোড়ার গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ভেজা কবলস্টোনের উপর দিয়ে৷

চিঠি লেখা শেষ হতে খানিকটা হুইস্কি খেয়ে জানলার কাছে এসে বসে পড়লাম৷ চোখ রাখলাম উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালে৷ যতদূর মনে আছে ১৪ নম্বর ঘরের বাসিন্দা উকিল জ্যান্সন৷ বেশ সিরিয়াস গোছের মানুষ৷ খুব একটা কথাবার্তা বলেন না, সারাক্ষণ একগোছা কাগজপত্র নিয়ে কী যেন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেন৷ এইরকম একটা মানুষ হঠাৎ করে এরকম ছটফট করবেন কেন? কথাটা মনে হল কারণ এখন সেটাই দেখতে পাচ্ছি৷ বারবার জানলার সামনে থেকে তার ছায়া এক দিক থেকে আরেক দিকে যাওয়া-আসা করছে, হাতগুলো প্রসারিত হচ্ছে দু-পাশে, পা দিয়ে কোনও কিছুকে যেন লাথি মারার চেষ্টা করছেন, অথচ পাশের ঘর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না৷ ভদ্রলোক আচমকা খেপে গেলেন নাকি?

পিছন থেকে ভেসে আসা একটা শব্দে চমকে উঠলাম৷ দরজায় টোকা পড়ছে৷ বাড়িওয়ালার গলা ভেসে এসেছে সেই সঙ্গে৷ দরজা খুলেই তাঁর চোখ মুখের অবস্থা দেখে একটু খটকা লাগল আমার৷ কিছু একটা কারণে যেন আতঙ্কে ভুগছেন ভদ্রলোক৷

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না তাঁকে৷ আমার সামনের চেয়ারে বসে খোশগল্প শুরু করলেন তিনি৷ কথায়-কথায় ১৩ নম্বর ঘরের প্রসঙ্গ এসে পড়ল এবং সে প্রসঙ্গে কথা আরও এগোত যদি না পাশের ঘর থেকে গান গাওয়ার আওয়াজ ভেসে আসত৷ চোদ্দো নম্বর ঘরে কেউ শুধু যে গান গাইছেন তা নয়, মনে হচ্ছে যেন অত্যধিক মদ্যপানের ফলে মাতাল হয়ে উন্মাদের মতো নৃত্যও করছেন৷ অচেনা কোনও গানের সুর ভেসে আসছে৷ ঠিক যেন ঠান্ডা ঝড়ের হাওয়া বয়ে চলেছে সরু চিমনির মধ্যে দিয়ে৷ একবারের জন্য আমার মনে হল উকিল ভদ্রলোক হয়তো সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন৷

বাড়িওয়ালার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম তিনিও থমথমে মুখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘এ ব্যাপারটা আমি আগেও শুনেছি তবে বিড়ালের কান্না ভেবে তেমন গুরুত্ব দিইনি…’

‘ভদ্রলোক কি পাগল হয়ে গেলেন?’

‘তাই হবে৷ তবে ওনার মতো ধীর-স্থির জ্ঞানী মানুষ হঠাৎ করে রাতারাতি উন্মাদ হতে যাবে কেন মাথায় ঢুকছে না…’

ঠিক এই সময়ে দরজার দিক থেকে আবার ঢোকার শব্দ শোনা গেল৷ আমি তড়িঘড়ি উঠে দরজা খুলে দেখলাম উকিল জ্যান্সেন দাঁড়িয়ে আছেন৷ মুখ দেখে মনে হল কোনও কারণে যথেষ্ট রেগে আছেন তিনি, ‘আপনারা কী শুরু করেছেন বলুন তো? রাত্রিবেলা নিরিবিলিতে একটু কাজ করার…’ কথাটা বলতে গিয়েও তিনি থমকে গেলেন৷ হয়তো বুঝলেন যে, তাঁর কাজে বিঘ্ন হওয়ার জন্য এ ঘরের দুটো মানুষের মধ্যে কেউ দায়ী নয়৷ কিছুক্ষণ সেই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আগের চেয়ে কয়েক পর্দা গলা নামিয়ে তিনি বললেন, ‘এসবের অর্থ কী? কে… কে চিৎকার করছে এই ভাবে? নাকি আমার মাথাতেই কিছু…’

‘আওয়াজটা পাশের ঘর থেকে আসছে সন্দেহ নেই৷ আচ্ছা চিমনিতে বিড়াল জাতীয় কিছু আটকে যায়নি তো?’

‘অসম্ভব’ উকিল ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার ঘরে কোনও চিমনিই নেই, উল্টে আমার তো স্পষ্ট মনে হল আওয়াজটা এই ঘর থেকেই আসছে…’

‘আপনার আর আমাদের ঘরের মাঝে অন্য কোনও দরজা চোখে পড়েছে আপনার?’ শান্ত গলায় প্রশ্ন করলাম আমি৷

‘না, অন্তত আজ সকালে তো নয়…’

‘আর আজ রাতে?’

‘কী জানি! ঠিক মনে পড়ছে না…’ একটু ইতস্তত করে বললেন তিনি৷

ঠিক এই সময়ে পাশের ঘরের সেই ভূতুড়ে গানের শব্দ থেমে গেল৷ মনে হলো একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসছে যেন সেই অদৃশ্য গায়ক৷ আমাদের তিনজনের শরীরেই সেই হাসির শব্দ শুনে শিহরন খেলে গেল৷ পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধতা এসে গ্রাস করল গোটা ঘরটাকে৷

‘কী হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’ নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন বাড়িওয়ালা৷

‘আপনার তো আমাদের থেকে বেশি জানা উচিত?’ তাঁর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলাম আমি৷

‘আ… আমি! আমি আপনাদের থেকে বেশি কিছুই জানি না৷’

‘কিন্তু কিছু তো একটা করা দরকার,’ আমি বললাম৷ ‘আচ্ছা, আমরা তিনজন মিলে একটু খুঁজে যদি কিছু বের করতে পারি?’

‘আসুন আমার সঙ্গে…’ কথাটা বলে দরজা খুলে বাইরে বেরোনোর তোড়জোড় শুরু করলেন বাড়িওয়ালা৷ আমাদের হাতে অস্ত্র বলতে শুধু একটা লাঠি আর একটা ছাতা৷ সেইসব সম্বল করে আমরা প্যাসেজে বেরিয়ে এলাম৷ বাইরেটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে৷ পাশের ঘরের দরজার তলা দিয়ে মৃদু একটা আলো আসছে৷ আমি আর জ্যান্সেন সেটা লক্ষ করে এগিয়ে গেলাম৷ ঘরের হ্যান্ডেল ধরে একটু চাপ দিতে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল৷ দরজাটা আগের মতোই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

‘এইটাই ১৩ নম্বর ঘর…’ দরজার উপর হাত রেখে বললেন জ্যান্সন৷

‘হ্যাঁ ডান দিকে আপনার, বাঁ দিকেরটা আমার…’

বাড়িওয়ালার দিকে ফিরে বললাম, ‘আপনি তাড়াতাড়ি দরজা ভাঙতে পারে এমন কাউকে নিয়ে আসুন৷’

খুশি মনে তিনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন৷

আমরা দুজন মিলে এরপর আবার কয়েকবার ধাক্কা দিলাম দরজার উপরে৷ মিহি শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা৷ ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে ভিতরটা৷ মনে হল কোথা থেকে একটানা জল পড়ার শব্দ আসছে যেন৷

‘আপনি বাইরে দাঁড়ান, আমি ভিতরে ঢুকছি৷’ কথাটা বলে আমি এগিয়ে গেলাম সামনে৷ আর ঠিক সেই সময়ে—ঘন অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা কালো বরফের মতো ঠান্ডা হাত বেরিয়ে এসে চেপে ধরল আমার হাতটা, আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সেই গভীর অন্ধকারের ভিতরে৷ আমি চিৎকার করে উঠলাম আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার অন্য হাতটা ধরে একটা টানে আমাকে মাটির উপর এনে ফেলল জ্যান্সেন৷ আমি সেখানে এসে পড়তেই তেরো নম্বর ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷ ওপাশ থেকে একটা আমানুষিক হাসির শব্দ ভেসে এল৷ জোরে-জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম আমি৷

এর মধ্যে নীচ থেকে শক্তসমর্থ একটা লোককে নিয়ে উঠে এসেছেন বাড়িওয়ালা৷ লোকটার হাতে একটা কোদাল জাতীয় অস্ত্র৷ দৌড়ে এসে তেরো নম্বর ঘরের বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার উপরে সেই কোদাল চালাতে লাগল লোকটা৷

আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, ‘নাহ, দরজাটা খুলবেন না, ভিতরে যে আছে সে…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কোদালের কয়েকটা কোপ পড়েছে দরজার উপরে৷ আমরা চারজনেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম তেরো নম্বর ঘরের দরজাটা এতক্ষণ যেখানে ছিল, এখন সেখানে নিরেট কাঠের দেওয়াল৷ দেওয়ালের উপরে গিয়ে পড়েছে, কোদালের কোপ৷

‘দরজাটা আর নেই!’ হতবাক গলায় কথাটা বলে কোদালটা সরিয়ে নিলেন বাড়িওয়ালা৷

সেদিন রাতটা সতেরো নম্বর ঘরে কাটিয়ে দিই আমি আর জ্যান্সেন৷ বেশ বেলার দিকে চোখ খোলে আমাদের৷ ঘুম ভাঙে কাঠের পাটাতন সরানোর শব্দে৷ কোনওরকমে চোখ-মুখ ধুয়ে আমরা ছুটে যাই বারো নম্বর ঘরের সামনে৷

বাড়িওয়ালাকে চোখে পড়ে সেখানে৷ কালরাতের সেই লোকটার সঙ্গে আরও দুজন লোক মিলে বারো আর চোদ্দো নম্বর ঘরের মাঝে মেঝের উপর পাটাতন সরিয়ে ফেলেছে৷ মেঝের নীচের কিছুটা ফাঁকা অংশে আলো গিয়ে পড়েছে৷ আমরা দু-জনেই মুখ বাড়িয়ে জায়গাটা দেখার চেষ্টা করলাম৷

আপনারা হয়তো ভাবছেন মেঝের নীচের সেই ফাঁকা জায়গাটায় বিশপের সেই ভাড়াটের কঙ্কাল জাতীয় কিছু দেখতে পেয়েছিলাম আমরা৷ কিন্তু না, কোনও মানুষের কঙ্কাল ছিল না সেখানে৷ তেরো নম্বর ঘরের সামনে মেঝের তলায় রাখা ছিল একটা ছোট তামার বাক্স৷ সেই বাক্স খুলতে তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ভাঁজ করা—পুরনো হলদেটে পার্চমেন্ট কাগজ৷ মোট কুড়িটা লাইন লেখা ছিল সেই কাগজে৷ তবে, ভাষাটা চিনতে পারিনি আমরা৷

ভাষাতত্ত্ব নিয়ে জ্যান্সেনের কিছু পড়াশোনা ছিল৷ তাঁর মতে, প্রাচীন ড্যানিশ ভাষায় কিছু লেখা ছিল কাগজটায়৷ কিছু একটা নির্দেশ সম্ভবত, কিংবা একটা মন্ত্র৷ কিন্তু কয়েকশো বছর আগে সে ভাষা হারিয়ে গেছে বলে সেই পার্চমেন্ট কাগজের অর্থ আজও উদ্ধার করা যায়নি৷

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *