১৩. নতুন হুজুগ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

এ নতুন হুজুগটা যে কী তা বুঝতেই বেশ একটু সময় লাগল এদের। কারণ ‘আইন মানব না’ একথা পাগল ছাড়া যে আর কেউ বলতে পারে, তা কখনও ভাবে নি এরা। বাইরে যে বাতাস পাল্‌টেছে–বাতাস যে দ্রুত পালটাচ্ছে সে খবর এখানে পৌঁছয় না। ইংরেজের আইন মানবে না, আইন ভেঙ্গে জেলে যাবে–এই নাকি ঢেউ উঠেছে শহর-বাজারে, সে ঢেউ নাকি ওদের গাঁয়েও এসে পৌঁচেছে। সে তরঙ্গে আন্দোলিত হয়েছে ইতিমধ্যে অনেকগুলো জায়গাই ওদের আশেপাশে; সে ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়েছে ওদিকে সাঁতরাগাছি রামরাজাতলা এদিকে ডোমজুড় মাকড়দা–সর্বত্র। সে ঢেউ নাকি ওদের গাঁয়ে এসে আছড়ে পড়েছে। তার তরঙ্গে নাচছে দুলছে এই গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনও।

কিন্তু আইন মানবে না! আইন ভেঙ্গে জেলে যাবে! এ আবার কি কথা! এ যে অবিশ্বাস্য। এতবড় বুকের পাটা কার? জেল মানে কি, সেখানে পাথরভাঙ্গায়, ঘানি টানায় রাস্তা পেটায়–সেখানে এতটুকু বদমাইশি করলে বুকের ওপর বাঁশ দিয়ে ডলে।

হ্যাঁ তাই করছে। আরও করছে। ঠেকো রদ্দুরে সূর্যের দিকে মুখ করে ফেলে রাখছে, নখের মুড়িতে মুড়িতে পিন ফোঁটাচ্ছে, পায়ের নিচে দিচ্ছে বিছের কামড়–আরও কত কী। তবু জেলে যাচ্ছে দলে দলে সবাই, বড়লোকের ছেলেরা, বাবুদের ছেলেরা। বুড়োরাও নাকি যাচ্ছে। উকিল ব্যারিস্টার মাস্টার জমিদার–সব এক সঙ্গে। মার খেয়ে কত লোক পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে জন্মের মতো–তবু যাচ্ছে।

তাদের ওপর অত্যাচার দেখে বাঙালি পুলিশ নাকি ক্ষেপে গেছে–সরকার তাই, গুর্খা পুলিশ আমদানি করেছেন। তবু তাঁরা পেরে উঠছে না। মার খাবার এত লোক যে তারা মেরে শেষ করতে পারছে না।….

চোখ বড় বড় করে খবরটা দেয় মহাশ্বেতা তার মাকে। খবরটা দিতেই ছুটে এসেছে সে। সেও বেশিদিন খবরটা পায় নি। তার জগৎ তার ঐ সংসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ শুধু নয়–একরকম সম্পূর্ণও। সংসারকেন্দ্রিক মনের শক্ত উঁচু পাঁচিল দিয়ে তা ঘেরা, তার মধ্যে বাইরের বাতাস ঢোকে কদাচিৎ। বাইরের খবর নিয়ে পুরুষরা মধ্যে মধ্যে আলোচনা করে বটে–কিন্তু সে যেন সুদূর কোন দেশের খবর, কারা যেন, কাদের যেন কথা–তার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক ক্ষণিক কৌতূহলের শুধু। বিলেতে কি মার্কিন মুলুকে কি হচ্ছে তাও যেমন– পাঞ্জাব বা কাশ্মীরের ঘটনাও তেমনি ওদের কাছে। সে কোন্ দেশ কতদূরে, স্পষ্ট কোন ধারণা নেই–ধারণা করার কোন চেষ্টা বা আগ্রহও নেই। কী প্রয়োজন ওদের?

এ খবরেও প্রথমটা ওরা কান দেয় নি। দেবার সুযোগও হয় নি।

এসব খবর মেজকর্তা আর ছোটকর্তাতেই আলোচনা করে বেশির ভাগ। ছোটকর্তাই এ বাড়ির গেজেট চিরকাল–কারণ সেই যা পাঁচজনের সঙ্গে মেশে, পাঁচ জায়গায় যায়। মেজকর্তা তাই মধ্যে মধ্যে ছোটভাইকে ধরেই মোটামুটি খবর সংগ্রহ করে। বড় কোন দিনই কারুর সঙ্গে বসে গল্প করে না, বাড়িতে যতক্ষণ থাকে কোন না কোন কাজ নিয়ে থাকে। তাকে কেউ গিয়ে কোন কথা ‘ওপরপড়া’ হয়ে না শোনালে সে শোনে না। দরকারি কথা ছাড়া অত গরজ করে তাকে শোনাবেই বা কে? তা এবার নাকি তাও শোনাচ্ছে ছোটকর্তা। বাগানে গিয়ে তাকে শুনিয়ে আসে এসব খবর–কোথায় কী ঘটছে।

‘তা তাদের ভেয়েভেয়ে কত কী কথা হয় বাপু বুঝিনে তো! কী কথা তো কী কথা। ওসব কথায় কান দিতে গেলে এ সংসার ঠেলবে কে বলো! এই নারদের গুষ্টির ডানহাতের ব্যাপার দুবেলা চালানো তো চাট্টিখানি কথা নয়।… কাল আমাদের ছোটকত্তা শোনালে ধরে তাই শুনলুম। ছোঁড়াগুলোও অবিশ্যি বলছিল কদিন ধরে–বলছিল আর হাসাহাসি করছিল–তা আমি বলি দূর হ, যে কথা নয় সেই কথা! তোরা সব যা পণ্ডিত, কী শুনতে কি–ধান শুনতে কান শুনেছিস। মুখুর ডিম, তোরা বুঝিসও তো খুব, তোদের কারা বোকা বানিয়েছে। ইংরেজের রাজত্বে বাস করে তাদের আইন মানব না, পুলিশকে কেয়ার করব না, যা খুশি তাই করব, মনময় রাজত্বি–এ আবার নাকি হয়। বলি পুলিশের রুলের গুঁতো খেয়ে আর জেলে গিয়ে যদি ইংরেজ তাড়ানো যেত তো চোর-ডাকাতরা কবে ইংরেজকে তাড়িয়ে এদেশের রাজা হয়ে বসত।… তা ছোঁড়ারা বলে বিশ্বাস না হয় ছোটকাকে জিজ্ঞেস করো।… ওমা, কাল ছোটকত্তা নিজেই এসে বললে, ব্যাপার গতিক ভাল নয়, এমনি ধারাই সব হচ্ছে, সত্যিই নাকি। পুলিশও নাকি গেছে ক্ষেপে, যাকে পাচ্ছে তাকে ধরছে আর তেমনি নাকি বেধড়ক ঠেঙ্গাচ্ছেও। ছোটকর্তা আরও বললে অল্পবয়িসী ছেলে একজায়গায় দু’তিনজন দেখলেই পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে–ও আর কিছু বাচছে না।… বিশেষ যদি হিঁদুর ছেলে হ’ল তো নাকি, কথাই নেই। বলে–তোমাদের বাড়ির এ যা দঙ্গল এর খবর পেলে আর রক্ষে থাকবে না, সামলে সুমলে রাখো কদিন।…. তা কোথায় সামলাই বলো দিকি। এ কি আর এতটুকুটি আছে যে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখব?’

ভুরু কুঁচকে–যেন একটু উৎসুকভাবে মায়ের মুখের দিকে চায় মহাশ্বেতা, বুদ্ধিটা নিতেই চায় হয়ত, সেইজন্যেই ছুটে এসেচে। কিন্তু তারও বলা শেষ হয় নি। মাকে উত্তর দেবার মতো অবসর না দিয়েই তাই আবার শুরু করে সে, ‘মুখপোড়ারা কি কারও কথা শোনে! বলতে গেলে উল্টে আমায় দাবড়ায়, বলে থামো থামো তুমি আর বকো নি, আমাদের যারা ধরবে তারা এখনও মায়ের গর্ভে!… শোন কথা। বড় বড় দামড়া হয়েছে সব, ওদের কি কুলুপ দিয়ে রাখব গা? তাও বললুম আমার পাঁটাগুলোকে, দিনকতক নয় তোদের দিদ্‌মার কাছে গিয়ে থাক্‌গে যা না! তা বলে কি, হ্যাঁ, যাচ্ছি ঐ কিপটে বুড়ির কাছে, আমাদের না খাইয়ে মেরে ফেলবে! যদ্দিন মামী ছিল তদ্দিন তবু যা হোক–এখন তো বুড়ির মজা।… এদের আমি কী করে সামলাই বল দিকিন! ভেবে ভেবে তো পেটের ভাত চাল হয়ে গেল!

আবারও একটু থামে। একটু উদ্বিগ্নভাবে মায়ের মুখের দিকে চায় কিন্তু এবারও তাঁর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে না। উদ্বেগের বদলে একটু গর্বের সুরই বরং ফোটে এবার। বলে, ‘তবে তাও বলি, মুখ্‌খুই হোক আর যাই হোক, এদিকে ছোঁড়াগুনো চালাক আছে খুব। ওরা ক’ভাই দাঁড়িয়ে যদি মুখ ছোটায় তাহলে পুলিশ তো পুলিশ– জজ ম্যাজিস্টারও ভেসে যাবে সে কথার তোড়ে।… আরও গুণ আছে বাপু, হক্ কথা যা বলব–ওরা বাইরে বিশেষ যায় না, নিজেদের মধ্যেই যা কিছু আড্ডা। পাড়া-ঘরে ঘুরে বেড়ানো কি বাজারে গিয়ে মুণ্ডুলি করা–সে সবে ওরা থাকে না। কোন খারাপ নজরও নেই, আর নেশাভাঙেও তেমন রত নয় ওরা। তাই ভাবি মরুক গে, নিজেদের জমিতে বসে থাকবে না বাড়ির ছেলেরা তো কি যে যার ঘরে খিল এঁটে থাকবে? এটুকু কি আর বুদ্ধি নেই পুলিশের, কে বজ্জাত আর কে ভাল–তারা খবর নেবে না? তবে তারা এতবড় রাজত্বিটা চালাচ্ছে কি করে? আবার ভয়ও হয়–কে জানে বাপু কী হবে, বুঝিও না তো কিছু!’

এবার অসহিষ্ণু হয়ে থামিয়ে দেন তাকে শ্যামা।

‘তুই একটু চুপ কর দিকি। তোর ঐ একঘেয়ে থগ্গানি আর আমার ভাগ লাগে না! ওসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাস কেন? অনেক দেখলুম এ পর্যন্ত! এ বয়সে হুজুগ কি আর কম দেখলুম! হুজুগ না তুললে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না তারাই মধ্যে মধ্যে এই সব হুজুগ তোলে।… ও তুই রেখে বোস, রেখে বোস! অনেক দেখলুম এই বয়েসে। হুজুগ কি আর একটা–না একরকম! সেই এক রেলা দেখলুম দিনকতক–কী সমাচার, না বিলিতী কাপড় পরব না, বিলিতী চিনি খাব না। বিলিতী কাপড় পুড়েই নষ্ট হল দেদার–তারপর তো আবার যে-কে সেই! আবার এক ঢেউ উঠল কি না, চরকা কাটো, খদ্দর পরো– তাহলেই দেশ স্বাধীন হবে! আর সব ইস্কুল কলেজ ছেড়ে দাও, ইংরেজদের ইস্কুলে পড়ব না! আ মর –তাতে লাভ হল কার? মাঝখান থেকে কতকগুলো ছেলের ইহকাল পরকাল মাটি। সে সব চরকা তো কোথায় কি গেল–উনুনে পুড়ে ভাত রান্না হয়ে নিশ্চিন্তি।…. ঐ যে তোদের গুষ্টি বলত না–ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সদ্দার! তা এও তাই!… আর বাপু তোদের কি ক্ষ্যামতা তোরা লড়বি ইংরেজদের সঙ্গে, কী আছে তোদের কামানবন্দুক আছে? তাও তো অতবড় জার্মানিরা পারলে না! হু! যে মহারানীর রাজত্বে সূয্যি অস্ত যেতে সাহস করে না সেই মাহারানীর ফৌজের সঙ্গে লড়বি তোরা?

দীর্ঘ বক্তৃতা দেন শ্যামাও। কিন্তু তাতেই যেন মনে মনে একটু বল পায় মহাশ্বেতা তবু খানিকটা চুপ করে থেকে বলে, ‘কিন্তু তা যাই বল বাবু, সেবার তো ভাঙ্গা বাংলা জোড়া লাগিয়ে ছিল ঐসব করে।’

‘হ্যাঁ–তা আর নয়! ওদের সুবিধের জন্যে দুখানা করেছিল, সুবিধে হল না–আবার জুড়ে দিলে। তোদের এইসব তালপাতার সেপাইদের ভয়ে তো তারা শ্যালের গত্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকে একেবারে!’

মহাশ্বেতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কী ভাবে, বুঝি মার কথাগুলো বোঝবার চেষ্টা করে। তারপরই আসল কথা মনে পড়ে যায়। বলে, ‘মরুক গে, সে তো পরের কথা! এখন এ পাঁটাগুলোকে সামলাই কী করে তাই একটা যুক্তি দাও দিকিনি। দুষ্টু গোরুর সঙ্গে যদি কপ্‌লে গাইও বাঁধা পড়ে? বাবা অমনি করে চোরের মার মারবে নাকি গো!’

বিরক্ত হয়ে ওঠেন শ্যামা, ‘তোর যেমন কথা! শুধু শুধু সুখ-সোমন্দা ওদের ধরবে কিসের জন্যে রে? ওরা যদি ওসব হ্যাঁঙ্গামে না যায় তো ধরবে কেন? জেলে পুরলে তো খেতে দিতে হবে–বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে কেন শুধু শুধু? ….আর খাওয়ালে তো ভালই–তবু জামাইয়ের দুটো পয়সা বাঁচে, ওদের নাম হয়। বেকার বসে বসে অন্ন ধ্বংসাচ্ছে বৈ তো নয়! তবে সে ভয় নেই, তোর ও পাঁটাদের যমেও ছোঁবে না, তুই নিশ্চিন্ত থাক্!’

‘ষাট্ ষাট্!’ রাগ করে উঠে দাঁড়ায় মহাশ্বেতা, ‘যমের কথা আবার কী গা এর মধ্যে! ওরা তোমার কী করলে যে ওদের যমের অরুচি বলছ! ওরা কি তোমার খাচ্ছে, না তোমার

পয়সা খসাচ্ছে?…. তোমাকে কিপ্‌টে বলেছে বলে তুমি অত বড় গালটা দিলে? …..দুর্গা দুর্গা, এখানে আসাই আমার ঝকমারি হয়েছে!’

সে আর দাঁড়ায় না। দালানের জানলায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বিধবা বোন, আসার আগে ভেবেছিল তার সঙ্গে বসে দুটো গল্প করে যাবে–এবেলার মতো ছুটি নিয়েই এসেছে জায়েদের কাছে, বলে এসেছে, ‘এখন তো একটিনি দিয়ে রেখেছি আমার বৌকে, আমি যদি দুদণ্ড না-ই থাকি, সংসারটা চলবে না? আমি কি চিরজন্ম খাটব?’–এই ভেবেই ছুটি নিয়ে এসেছিল। এখন মার এই কথার পর ‘মার সে প্রবৃত্তি রইল না। সে যখন আসে তখন কান্তি দেখতে পায় নি, পেছন ফিরে বাগানে কাজ করছিল, শব্দ তো পায়ই না– এখন ওকে দেখতে পেয়ে হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল কথা কইবার জন্য–কিন্তু মহাশ্বেতা কোন দিকে তাকাল না, চোখ মুছতে মুছতে হন্হন্ করে বেরিয়ে গেল সোজা একেবারে রাস্তায়।

এ দৃশ্য নতুন নয়, বুঝলে যে মা কিছু বলেছেন, মর্মান্তিক কিছু। তার কান নেই, শুনতে পায় না, তবে বুঝতে পারে। মার মুখের কথা যে কী সাংঘাতিক, ইচ্ছে করলে যে তিনি সত্যি সত্যি বাক্যবাণই প্রয়োগ করতে পারেন তা সে জানে। ইদানীং আরও বেড়েছে, বৌদি–অমন ভালমানুষ শান্ত মেয়েও অস্থির হয়ে পড়েছিল দুবেলা কথা শুনতে শুনতে। চলে গিয়ে বেঁচেছে। কিসের যেন একটা সাংঘাতিক জ্বালায় জ্বলছেন দিবারাত্র, সেই দাহই–চারিদিকে যারা থাকে–তাদের দগ্ধ করে। খুব দুঃখের দিনেও এত জ্বালা ছিল না, এখন যেন ঢের বেড়েছে। হয়ত কান্তিই এর প্রধান কারণ। ছোড়দিও। মেজদি–মেজদির মেয়ে। সব জড়িয়েই যে এ জ্বালা তা কান্তি বোঝে। তবু মনে হয়, এতদিন এতই সহ্য করলেন, মিছিমিছি এই শেষ বয়সে এমন করে সকলকে দুঃখ দিয়ে কী সান্ত্বনা পান উনি ওঁর জ্বালা কি এদের চোখের জলে কমে?

দিদির মুখখানা মনে করে কান্তির চোখ ছল ছল করতে থাকে।

মনে পড়ে যায় ওর–বৌদিরা যেদিন জামালপুর চলে যাবে তার আগের দিনের কথাটা। ছোটখাটো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস নিয়ে সেদিন সকাল থেকেই তার পিছনে লেগেছিলেন মা। ঘরমোছার সময় বুঝি পাপোশটা ঝাড়া হয় নি ঠিকমতো–যদিও কান্তি নিজের চোখে দেখেছিল বৌদিকে পাপোশ ঠুকেঠুকে ঝাড়তে, বাটনা বাটাও নাকি দায়- ঠেলা-গোছের হয়েছে (মায়ের ভায়ায় কি তা জানে কান্তি, মা বলেন দুই সতীনে চিবিয়ে রাখা!) –এমনি নিতান্ত ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট উপলক্ষ।… সবচেয়ে শেষকালে কী কাণ্ডটাই না করলেন! দুপুরবেলা ওঁর কাজ করতে দেরি হবে বলে বৌদিকে খেয়ে নিতে বলেছিলেন, বৌদি খায় নি-বোধহয় শেষ দিনটা বলেই; মা আরও যেন কতকটা ইচ্ছে করেই সেদিন চরম দেরি করলেন, একেবারে বেলা সাড়ে তিনটেয় খেতে এলেন। এটাও যেন বৌদির অপরাধ, খেতে বসে এই নিয়েই কী না শোনালেন এক ঝুড়ি কথা। কান্তি শুনতে পায় না তবে ঠোঁট-নাড়া দেখে আজকাল অনেক কথাই বুঝতে পারে, বিশেষ করে পরিচিত লোকদের কথা, যাদের ঠোঁটের ভঙ্গিতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মনে হল, মা এটাকে লোকদেখানো আদিখ্যেতা, কাষ্ঠনৌকতা ইত্যাদি বলে বিদ্রূপ করছেন। কিন্তু শুধু বিদ্রূপেই শেষ হল না, সেটা শুধু শুরু। ক্রমশ কথাগুলো তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, তা ওঁর ওষ্ঠের ভঙ্গিতেই শুধু নয়–দৃষ্টির পরুষ কঠোরতা থেকেও বুঝতে পারা গেল। বৌদি ওঁর ছেলেকে নাতিকে ওঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, সন্তানকে পর করে দিচ্ছে তার ষড়যন্ত্রেই ওঁর অমন বাধ্য মাতৃভক্ত ছেলে ওঁকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে বিদেশ চলে যাচ্ছে; ইচ্ছে করে তদ্বির করিয়েই নাকি এই বদলির ব্যবস্থা করিয়েছে বৌদি–শাশুড়ীকে জব্দ করবে বলে–এইসব অভিযোগ করতে লাগলেন। অন্তত কান্তির তাই অনুমান। সে স্পষ্ট দেখেছে–ঝরঝর করে বৌদির চোখের জল ঝরে পড়েছে ভাতের ওপর; একে তো সেই কোন ভোরের চাল-হয়ে-যাওয়া ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত–তবু সেই চোখের জলমাখা কদন্নগুলোই গিলতে হয়েছে বৌদিকে, মার ভয়েই ফেলে উঠতে পারে নি। অথচ কী লাভই বা হয় এতে!

মানুষ তো আরও দূরে সরে যায় মনের মধ্যে।

মা এত বোঝেন, এটা কেন বোঝেন না।

ওর অমন বৌদি, দুটো মিষ্টি কথা বললেই চিরকাল তাকে বেঁধে রাখা যেত।

॥২॥

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়েও অমনি দ্রুত হন হন করে হাঁটছিল মহাশ্বেতা। পথের মাঝে মাঝে জটলা বা তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা কোনটাই লক্ষ করে নি। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরীতলা ছাড়িয়ে বাজারের মোড়ে এসে ওদের বাড়ির রাস্তা ধরতে গিয়েই চমকে উঠল। থামতেও হল ওকে।

‘বাবা, এত ভিড় কিসের গা? এ যে লোকে লোকারণ্যি একেবারে!’

কতকটা যেন মনে মনেই প্রশ্ন করে সে।

সত্যিই এ রাস্তায় এমন ভিড় কোনদিন দেখে নি মহাশ্বেতা, মেলার সময়ও না। তখন লোক এ পথে বিস্তর হাঁটে বটে কিন্তু সে এমন দাঁড়িয়ে থাকে না এক জায়গায় –স্রোতের মতো দু’দিকে দুমুখো এগিয়ে চলে ক্রমাগত। আর এ তো কোন মেলার দিনও নয়–অন্তত কৈ মনে তো পড়ছে না তেমন কোন মেলার কথা! তার যদি-বা ভুল হয়, মেলাটেলা কিছু হলে এতক্ষণ দু’দিকের সার সার তেলেভাজা খাবারের দোকান বসে যেত, বেগুনি ফুলুরি পাঁপরের পাহাড় জমে যেত এক-একটা বারকোশের ওপর–আর সবচেয়ে ঐ অনামুখো মাগীগুলো, এই দিন দুপুরেও তাহলে মুখে খড়ি মেখে ঠোঁটে-গালে আলতা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত গড়াগড়!

না, মেলা-ফেলা কিছু নয়। এ অন্য কোন ব্যাপার!……

মহাশ্বেতার স্বভাবে কৌতূহলটাই প্রবল।

প্রায় শিশুর মতোই সব বিষয়ে কৌতূহল তার।

‘ব্যাওরা’টা কি জানবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল সে। এত পুরুষের ভিড়ের মধ্যে তার এগোবার কথা নয়, সাধারণত বাইরের অপরিচিত পুরুষকে যতদূর সম্ভব দূরেই রাখে সে সেই শিক্ষা পেয়ে এসেছে জ্ঞান হওয়া অবধি–কিন্তু আজ তার স্বভাব-কৌতূহল সে সংস্কারও ভুলিয়ে দিল। এ ভিড় এড়ানো চলত অনায়াসেই। ওদিক দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলে রাজবাড়িকে বাঁয়ে রেখে পোলের কোল দিয়ে শ্মশানের ধার দিয়ে যেতে পারত– এমন কিছু ঘুর-পাক নয় সেটা, সেদিকে এখন ভিড়ও কম–কিন্তু এদিকে ব্যাপারটা কি ঘটছে সেটা না জেনে চলে যেতে পারল না কিছুতেই।

পুরুষের ভিড় ঠেলে এগোনো মুশকিল, তবু ঘোমটাটা আর একটু সামনের দিকে টেনে দিয়ে চাদরটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে একেবারে দোকানগুলোর কোল ঘেঁষে এগোবার চেষ্টা করল। এতক্ষণে তার লক্ষ হল এদিকের দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, সবাই ঝাঁপ ফেলে বা দোর বন্ধ করে বসে আছে ভেতরে, শুধু চোখ বার করে একটু দেখবার মতো ফাঁক রেখেছে একটু একটু। তবে কি লুটতরাজ কিছু হচ্ছে? ডাকাত পড়ে নি তো কাছে-পিঠে কোথাও? কিন্তু এত লোকের সামনে ডাকাতি বা লুটতরাজই বা হবে কী করে? না কি হরতাল? আজকাল তো আবার ঐ এক হুজুগ বেরিয়েছ। ছেলেরা বলে এস্ট্রাইক। কিন্তু সে রকম কিছু হলে তো সব বাজারই বন্ধ থাকত। আর হরতাল তো সকাল থেকেই শুরু হয়–বরং সন্ধ্যের দিকে তাতে কেউ কেউ দোকান খোলে। আজ তো এই একটু আগেও আসার পথে দেখে এসেছে দিব্যি সব খোলা। এখনও তো ওদিকের সব দোকান খোলা রয়েছে দেখে এল। এখান থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, ভোঁদা গয়লার দোকানের ওপাশ থেকে ওধারের দোকানগুলো তো এখনও খোলা।

তবে? এটা হচ্ছে কী এখানে?

পথের ওপর কেউ বেদের ভেল্কি-টেকি দেখাচ্ছে না তো? তাই বোধহয় হবে। অনেকদিন আগে আর একবার দুটো ভেল্কীওলা এসেছিল–মনে আছে ওর। ওঃ, সে কী কাণ্ড! একটা ঝুড়ির মধ্যে একটা মেয়েকে পুরে তার বর কী কোপানোটাই না কোপালো তলোয়ার দিয়ে–’রক্তে রক্তাকির্নি’ একেবারে–আর মেয়েটার সে কী চিত্কার প্রথম প্ৰথম, তার পরে সব চুপ। ওমা, ভয়ে মরে সবাই, এ কী খুনো-খুনি ব্যাপার রে বাবা, খেলা দেখতে গিয়ে থানা-পুলিশ ছুটোছুটি করতে হবে নাকি? তা সে মিসে তো খোঁচাখুঁচি করে বৌটাকে মারলে, তারপর তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল বৌয়ের শোকে কাঁদে আর কী সব হিন্দী-মিন্দীতে বলে–এই কাণ্ড চলছে, ওরা সবাই ভয়ে ভাবনায় কাঠ, তারই মধ্যে কিনা পেছন থেকে ভিড় সরিয়ে সে মেয়েটা দাঁত বার করে হাসতে হাসতে হাজির। দিব্যি জ্যান্ত। ওদিকে তখনও তলোয়ারটা পড়ে রয়েছে, তাতে রক্ত মাখামাখি! তা খেলা বাপু মন্দ নয়, সে কথা মহাশ্বেতাও মানতে বাধ্য–তবে সে যতই ভাল হোক, পাড়াঘরে এসে দেখায় সে আলাদা কিন্তু সরকারি সদর রাস্তা জোড়া করে বসে খেলা দেখানো–এ আবার কী অনাছিষ্টি কাণ্ড।

মহাশ্বেতার কেমন সত্যি-সত্যিই ধারণা হয়ে গেল যে, বেদের ভেল্কীই দেখানো হচ্ছে। আর যে কিছু হতে পারে, অন্য কোন কারণ থাকতে পারে এ ভিড়ের–তা একবারও মনে হল না ওর। তাই, আরও যেন কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েই আর একটু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। অবশ্য চেষ্টা করাও খুব সহজ নয়–কারণ রৈরাবণের ব্যাপার যেন চারিদিকে, বাপরে বাপ্, মনিষ্যি যেন কারও বাড়ির মধ্যে নেই আর, সব্বাই বেইরে পড়েছে। আর সবাই তো দেখছি মদ্দ মিনসে–যেতে দেবে কি এগিয়ে–?’ মনে মনে বলে মহাশ্বেতা।

তবু ওরই মধ্যে একটা ফাঁক দিয়ে দেখবার চেষ্টা করতেই কে একজন রুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এ সব খুন-খারাবি থানা-পুলিশের কাণ্ড, চারদিকে র-র করছে গুর্খা পুলিশ, এর মধ্যে মেয়েছেলে সেঁধুচ্ছ কেন বাছা! বলি তেমার কি একটু ভয়ডর হুঁশপব্ব নেই? কেমন ধারা মেয়েছেলে তুমি?… যাও যাও, পালাও শিগগির।

ওমা কী হবে! এ যে আরশোলা মল্লিকের গলা। চিনে ফেলে নি তো?

ঘোমটাটা আগেই যথেষ্ট দেওয়া হয়েছিল, এখন টানাটানি করে আরও খানিকটা বাড়াতে গিয়ে পিঠের দিকটাই অনাবৃত হয়ে পড়বার উপক্রম হল। সে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে আসবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল, কিন্তু পেছনো আর হল না। তার আগেই আর একটা হৈ- হৈ–লোকগুলো যারা সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারাও যেন পিছু হটে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। সে চাপ ওর ওপরেও এসে পড়ল এবার। সে যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল সেখানে দেওয়াল নেই ফলে একটা দোকানের ঝুলনো –বাইরে বেরিয়ে আসা কাঠের পাটাতনের ধারে লেগে পা দুটো ভেঙ্গে যাবার যোগাড় হল।

যন্ত্রণায় একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল ও, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হল।

যে দোকানে এই কাণ্ড–তার মালিক ও কর্মচারীরা সবগুলো কাঠ বন্ধ করে নি–একটা কাঠ ফাঁক করে রেখে তার মধ্যে দিয়ে সব দেখছিল। তারা এখন এই ব্যাপার দেখে একজন চট্ করে কাঠটা সরিয়ে এক হ্যাঁচকায় ওকে টেনে নিল পাটাতনের ওপর–তারপর ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সে কাঠটা যথাস্থানে পরিয়ে দিল আবার।

‘ওমা, এ আবার কী?…. কে গা তোমরা?… ওমা এ কী কাণ্ড! রাহাজানি নাকি? এমন করে ভদ্দরলোকের মেয়েছেলের হাত ধরে টানো–তোমাদের সাহস তো কম নয়! এতো ভারী আস্পদ্দা দেখতে পাচ্ছি।’

মহাশ্বেতা চেঁচামেচি করে ওঠে, পায়ে তখনও যন্ত্রণা হচ্ছে কিন্তু তার চেয়েও ভয়টা বেশি।

‘ভদ্দরলোকের মেয়েছেলে তো মরতে এসেছিলে কেন? পাটা যে ভেঙ্গে এতক্ষণে নড়নড় করত! সেইটে বুঝি ভাল হত? তার ওপর চারদিকে গুর্খা পুলিশ, তাদের হাতে পড়লে ভদ্দরতা থাকত কোথায়; মান-ইজ্জৎ নিয়ে ফিরতে পারতে?’

দোকানদার চাপা গলায় খিঁচিয়ে উঠল।

মহাশ্বেতা থতমত খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘আমি তো এত কাণ্ড জানি না। যাবার সময় তো অত দেখি নি কিছু। তাহলে কি আর এ পথে আসতুম!… তা হ্যাঁগা বাছা, পুলিশ-টুলিশ এসেছে কেন–কী হয়েছে কি এখানে? ….কী সব গুখা-মুখ্‌খা বলছ–তা তাদের আনতে হল কেন? আমাদের খোট্টা পুলিশ সব কোথায় গেল? এখানে কী হচ্ছে কী? ডাকাত পড়েছে নাকি কোথাও? না কি খুন জখম হয়েছে?’

বিপদের মধ্যেও কৌতূহলটাই প্রবল হয়ে ওঠে আবার।

‘খুন জখম হবে কেন! পিকেটিং হচ্ছে কদিন থেকে শুঁড়িখানায়–জান না? বলি কোন্ দেশে থাক গা মেয়ে?’

‘কি–হচ্ছে? কি টিং বললে?… শুঁড়িখানায় কি হয়েছে কি?’

‘পিকেটিং, পিকেটিং!….. স্বদেশী ছেলেরা মদের দোকানে পিকেটিং করছে, কাউকে মদ খেতে দেবে না!’

‘তা সে তো ভাল কথাই, তার আবার অত থানা-পুলিশ কিসের?

‘ভাল কথা তো তোমার আমার কাছে। যারা এক গাদা টাকা দিয়ে সরকারি লাইসিং নিয়েছে মদ বেচবে বলে– তাদের কাছে কি ভাল? তারাই পুলিশ ডেকেছে, তাদের যে ভাতে হাত পড়ে নইলে! আর কোম্পানিও তো মুকিয়ে আছে, স্বদেশী ছেলেদের জব্দ করতে পেলে তো আর কিছু চায় না… তাছাড়া তাদেরও তো ক্ষেতি, লোকে মদ না খেলে তাদের রোজগারও তো বন্ধ। কোম্পানির ঘরে মোটা টাকা যে যোগান দেয় এরা!’

আর কোন কথার অবকাশ হল না। বাইরের হৈ-চৈটা যেন আরও বেড়ে গেছে। এর পর আর নিশ্চেষ্ট বা উদাসীন থাকা সম্ভব নয়। মহাশ্বেতা দোকানের কারিগরদের এক রকম ঠেলে সরিয়েই কাঠের ফাঁকে চোখ লাগাল।

এবার ঠেলাঠেলির কারণটা বোঝা গেল। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসছে –বোধ হয় ভিড় সরাতে। ফলে লোকগুলো সব পৌঁ পোঁ করে পালাচ্ছে।

‘আ মরণ, কী সব বীরপুরুষ রে! তাই আবার আরশোলা মল্লিক আমাকে বকছিল, মেয়েমানুষ এর ভেতরে কেন!…. তোরাও তো পোঁ পোঁ দৌড়াচ্ছিস। অবিশ্যি বলেছে একটা কথা ঠিক, আমি কি আর ওদের মতো পালাতে পারতুম। এমনিই তো পা-টা যেতে বসেছিল।’

কিন্তু সে যা হোক, এ আবার কি হচ্ছে! মহাশ্বেতার চোখ সেই আছা অন্ধকারেই বিস্ফারিত হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসবার যোগাড় হল। তিনটে ছেলেকে টানাটানি করছে পুলিশ, তারা আসবে না, শুয়ে পড়েছে। তাদের পা ধরে রাস্তার ওপর দিয়েই টেনে নিয়ে চলল হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে। আহা রে, এবড়ো-খেবড়ো খোয়া বারকরা রাস্তা–পিঠের জামা ছিঁড়ে এতক্ষণে বোধ হয় ক্ষতবিক্ষত রক্তারক্তি হয়ে গেল। ছাল-চামড়া কি আর রইল কিছু! তাও তো মোটা জামা–কোট ফোট কারুর গায়ে নেই। অভয়পদ যে মোটা জিনের কোট পরে বারো মাস্–যেটা এতদিন পর্যন্ত চক্ষুশূল ছিল ওর কাছে–তার উপকারিতা এবার বেশ বুঝতে পারল মহাশ্বেতা। সব তো বেশ ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে তবে এ দুর্মতি কেন বাপু!… খা-দা বাড়িতে বসে থাক, নিজের ধান্দা দ্যাখ, তা নয়–এই সব হুজুগ করতে আসা। চাকরি-বাকরি করে বাপ-মায়ের দুঃখ ঘোচাবি তবে তো ছেলের জন্ম –কে মদ খেলে না খেলে তা নিয়ে তোদের অত মাথাব্যথা কেন? বিশেষ যখন কোম্পানি চায় না!…. তোরা না খেলেই তো হল!

দূরে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। ছেলেগুলোকে টেনে নিয়ে চলল সেই দিকেই। ঐ তো, রাস্তাতেই রক্তের দাগ পড়েছে, মাটি লাল হয়ে গেছে ওদের রক্তে।

‘মরে যাই, মরে যাই–কাদের বাছা রে!’

আপন মনেই সহানুভূতিসূচক আওয়াজ করে মহাশ্বেতা।

তবু, তখনও ওদের লাঞ্ছনার শেষ হয় নি। গাড়ির দরজা অবধি টেনে নিয়ে গিয়ে ওদের পা ছেড়ে দিলে সিপাইরা, তারপর বোধ হয় গাড়িতে উঠতে বললে। ছেলে তিনটে কিন্তু শুয়েই রইল চুপচাপ, যেন শুনতেই পায় নি। দুবার-তিনবার বললে–ওরা তেমনি নির্বিকার, নিস্পৃহ। একজন ওপরওলা ছিল ওদের সঙ্গে, সে এবার কী যেন বললে, সিপাহিগুলো দমাদম বুটসুদ্ধ লাথি মারতে লাগল ওদের।….. একজনের নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আর একজনের বুঝি দাঁতই ভেঙ্গে গেল দু-তিনটে। নিশ্চয়ই পেটে লাথি পড়েছে–ও ছেলেটা নইলে অমন ধনুকের মতো বেঁকে উঠবে কেন! এ কী প্রহারী গো। ওমা, ওদের কি দয়ামায়া নেই একরত্তি! কিন্তু তবু কৈ তো কেউ টু শব্দ করছে না একটা। ঐ ভারী ভারী বুটের লাথি সইছে কী করে? ওদের কি পাথরের জান!

আহা রে, ঐ ছেলেটার পেটেই লেগেছে সত্যি, সত্যি কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছে যন্ত্রণায়—

এততেও কিন্তু ওঠানো গেল না ওদের। আবারও সেই ওপরও’লা কি বললেন, গাড়ির দোর খুলে ধরল একজন, চারজনে চারদিক থেকে ধরে গাড়ির মেঝেতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল, চালের বস্তার মতো। তারপর তারাও গাড়িতে উঠে দোর বন্ধ করে দিল। কতক উঠতে পারল না, তারা হেঁটে যেতে লাগল। গাড়ি চলে গেল।

এতক্ষণ চারিদিকের ভিড় যেন পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল, ভয়ে ও কৌতূহলে। নিঃশ্বাস রোধ করে দাঁড়িয়েছিল তারা। চোর-ডাকাতকে মারে সে আলাদা কথা। ভদ্রলোকের ছেলেদের এমন প্রকাশ্য নির্যাতন, এমন অমানুষিক লাঞ্ছনা তারা কখনও দেখে নি, শোনেও নি বোধ হয়। পুলিশের রুদ্রমূর্তি তাদের মনে ও মুখে এক সুগভীর আতঙ্কের ছাপ ফেলেছে গত কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে। তারা পালাতে পারলে বাঁচে, এতক্ষণ সে চেষ্টা করে নি পাছে সামান্যমাত্রও নড়াচড়ায় সিপাইদের দৃষ্টি তাদের ওপর এসে পড়ে–এই ভয়।

এইবার–পুলিশের গাড়ি সরস্বতীর পুলের বাঁকে অদৃশ্য হতেই একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল সবাই। ভিড়ও পাতলা হয়ে গেল দেখতে দেখতে। তবু, লোক একেবারে গেল না, পুলিশের বড় দল গাড়ির সঙ্গে চলে যেতে তাদের মনে বোধহয় আশ্বাসের ভাব ফিরে এসেছে খানিকটা। তারা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে জটলা করতে লাগল।

তবে রাস্তা এবার অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। এবার যাওয়া চলবে। দোকানদার ওদিকের দরজাটা দেখিয়ে বলল, ‘নাও, এবার ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাও গো বাছা ভাল- মানুষের মেয়ে। ….এখন হ্যাঙ্গামা-হুর্জ্জুতের সময় অমন হুট করতে বেরিও না। দিনকাল ভাল নয়, এসব সময়ে যে যার ঘরে বসে থাকতে হবে।…. যাও, বেরিয়ে পড়ো এই বেলা। এখন ভালয় ভালয় মানে মানে ঘরে ফিরতে পারো তো গুরুবল।’

মহাশ্বেতা কোন মতে দেওয়াল ধরে ধরে দোকানের মালপত্র বাঁচিয়ে ভেতর দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারে পড়ল। পা-দুটো ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে তার, ভয়ে আর কী এক রকমের উত্তেজনায়, এখনও সেই কাঠের কোণের সঙ্গে চেপে যাওয়ার ব্যথাটা টনটন করছে–কিন্তু অপেক্ষা করার সাহসও আর নেই। সত্যিই এখন মানে মানে বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। যদি কিছু কেলেঙ্কারি হয়–কর্তারা কী বলবে। পাড়া-ঘরে কি আর মুখ দেখানো যাবে?

বাজারের ওপাশের ফটক দিয়ে বেরিয়ে, যতটা দূর দিয়ে হয় এগিয়ে এসে চেয়ে দেখল–মদের দোকানটার সামনে তখনও চার-পাঁচজন সিপাই দাঁড়িয়ে আছে। ফলে রাস্তা খাঁ-খাঁ করছে সেখানটায়। ওদের সামনে দিয়ে পথ চলবারও সাহস হচ্ছে না কারও। মদের দোকান খুলে রেখেছে বটে দোকানি মিন্‌সে–কিন্তু যমদূতের দল অমন করে সামনে পাহারা দিলে কার একটা ঘাড়ে তিনটে মাথা আছে যে ওখানে মদ গিলতে যাবে? মরণদশা বুদ্ধির!

অদম্য কৌতূহলে কখন বুঝি একটু সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে মহাশ্বেতা, তা খেয়ালও নেই। হঠাৎ একটা সিপাই মুখ তুলে সোজা ওর দিকে চাইতেই চমকে উঠল। বুকের মধ্যে গুর-গুর করে উঠল ভয়ে–মাগো, চাইছে দ্যাখো না চোখ পাকিয়ে–সাক্ষাৎ যমের দূত একেবারে!–ছুটে এসে ধরবে না তো? তাকেও যদি অমনি মারধোর করে, হাজতে নিয়ে যায়? বাপ রে, তাহলে শুধু ভয়েই মরে যাবে সে।

কেন তাকে ধরবে আর কেনই বা মারবে–তা একবারও মনে হল না ওর। কিছুক্ষণ আগেকার দেখা দৃশ্যটাই বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল শুধু, ফলে যখন সবচেয়ে ক্ষিপ্রপদের প্রয়োজন তখনই যেন পাদুটো সবচেয়ে অবশ হয়ে পড়ল।

কী করবে, চিৎকার করবে কিনা–চিৎকার করে আশপাশের লোককে ডেকে বলবে কিনা ‘আমাকে বাঁচাও আমি অমুকদের বাড়ির বৌ’ কিংবা মাটিতে বসে পড়ে সামলে নেবে কিছুই বুঝতে না পেরে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। কিন্তু পা দুটাতেও সত্যিই আর কিছুমাত্র জোর নেই, দাঁড়িয়ে থাকাও বেশিক্ষণ যাবে না– তা বেশ বুঝতে পারল। মাথাটার মধ্যেও যেন কেমন করছে, ফাঁকা লাগছে সব।

ঠিক সেই মুহূর্তে–অন্তত মহাশ্বেতার মনে হল–যে সিপাহীটা তার দিকে চেয়ে দেখেছিল, সে যেন তার দিকে এগিয়ে এল দু পা, মনে হল আরও এগোচ্ছে–

অধিকতর আতঙ্কের এই বৈদ্যুতিক আঘাতেরই প্রয়োজন ছিল বুঝি তার। ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে এইবার ছুটল সে। পা-দুটো যে অবশ লাগছিল, তা তার মনে রইল না, সে রকম কিছু আর বোধও করল না সে। বাজার ছাড়িয়ে, রাজবাড়ি ছাড়িয়ে খালধার দিয়ে একেবারে শ্মশানের সামনে পড়ে একবার থামল শুধু–কেউ পেছনে আসছে কিনা, সেই সেপাইটাও দৌড়চ্ছে কিনা তার পিছু পিছু তাই দেখবার জন্যে–তাহলে বোধ হয় সে সোজা শ্মশানেই ঢুকে সেখানে দিয়ে খালে নেমে পড়ত। ওদের হাতে পড়ার চেয়ে ডুবে মরাও শ্রেয়। কিন্তু দেখল যে, কেউই আসছে না তেড়ে, এ দিকের দোকানদারগুলোই শুধু মজা-দেখবার মতো করে হাসিহাসি মুখে চেয়ে আছে দু’-চারজন, বোধ হয় পাগলী ভেবেছে তাকে। তা ভাবুক, মহাশ্বেতা আর থামল না; আবার তেমনি করে–অত জোরে না হোক দৌড়তে শুরু করল।

বাড়িতে পৌঁছে অবশ্য আর দালানে কি রকেও উঠতে পারল না, যেন প্রাণপণ চেষ্টায় এই শক্তিটুকুই জিইয়ে রেখেছিল, কোনমতে বাড়িতে পৌঁছবার কথাই ভেবেছে সারাক্ষণ, রাস্তায় না মুখ থুবড়ে পড়ে মরতে হয় সেইটুকুর জন্যেই একাগ্র প্রার্থনা জানিয়েছে মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে–সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার পর তাই আর বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট রইল না। খিড়কির দরজা পেরিয়ে ভেতরের উঠোনে ঢুকেই সেই মাটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং পড়েই রইল। ঠিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে নি হয়ত কিন্তু জ্ঞানও পুরোপুরি ছিল না, সত্যিই যেন মাথার মধ্যে চিন্তা-শক্তি ধারণা-শক্তি কেমন ঝাপসা একাকার হয়ে গেছে, কথা কইবার অবস্থা তো ছিলই না। কী হয়েছে, কোথাও কোন চোট লেগেছে কিনা–কিংবা পথে আসতে আসতে কোন অসুখ বিসুখ করেছে–উগ্র ধরনের পেট ব্যথা কি শূলব্যথা বা ঐ রকম কিছু–নাকি শুধু মাথা ঘুরেই পড়ে গেল–তাও কিছু জানা গেল না।–একটি কথাও কইতে পারল না মহাশ্বেতা, চোখ বুজে মূর্ছিতের মতোই পড়ে রইল।

কারণ যা-ই হোক, ভয় পাবার মতোই অবস্থা–ভয়ই পেল সকলে। যে যেখানে ছিল ছুটে এল, ছোটবৌ এক ঘটি জল এনে মুখে মাথায় থাবড়ে থাবড়ে দিতে লাগল, বুড়োর বৌকে বললে একটা পাখা এনে জোরে জোরে বাতাস করতে–এমন কি স্বয়ং মেজবৌ এসে মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে ঝিনুকে করে করে খানিকটা গরম দুধ খাইয়ে দিলে।

কিন্তু তারপর একটু সুস্থ হয়ে উঠে বসে যখন ঘটনাটা খুলে বলল সব তখন লাঞ্ছনার আর কিছু অবশিষ্ট রইল না। কর্তারা তো যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলই, ছেলের দলও মহাশ্বেতার নিজের ভাষায় তারা পাঁঠারাও–যা মুখে এল তাই বলল। এক কথায় তিরস্কার ও ধিক্কারের একটা ঝড় বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে।

মহাশ্বেতা ঘাড় হেঁট ক’রে সব তিরস্কারই মেনে নিল। একথা একবারও সে বলতে পারল না যে, এতে তার কোন দোষ নেই, এমন তো হামেশাই যায় সে বাপের বাড়ি, পথে যে এমন কাণ্ড হবে তা সে জানবে কেমন করে? আজকাল যে এই সব কাণ্ড ঘটছে তা তাকে কেউ বলে নি, তার জানবার কথা নয়। সে কিছু বলল না এই জন্যে যে, এই প্ৰথম সে সম্মিলিত তিরস্কারে একটা মাধুর্যও অনুভব করছে। আজ যেন তার পুনর্জন্ম লাভ হয়েছে এবং এই কটুমিষ্ট তিরস্কারগুলো সেই নবজন্মেরই অভিবাদন! যদি কোন বিপদ-আপদ ঘটত তার, যদি পুলিশের হাতে পড়ে তাকে লাঞ্ছনা সইতে হত, যদি এমন করে ছুটে আসতে গিয়ে দম আটকে মরেই যেত–কী সর্বনাশ হত, তিরস্কারের শব্দে যাই তফাত থাক, মূল বক্তব্য একই। তার অভাবে এদের সর্বনাশ বোধ হত, তার জন্য এদের মনে এত উদ্বেগ এত দুশ্চিন্তা–এইটুকু জেনেই তার মন ভরে গেছে–এই আন্তরিকতাতেই সে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার আর কোন ক্ষোভ নেই কোথাও, কিছুর জন্যেই। শুধু মনে হচ্ছে যে সত্যি সত্যিই দম আটকে মারা গেলে এইটেই চরম ক্ষতি হত–এই তিরস্কারটাই শুনতে পেত না সে, তার জন্য এদের মনে এমন আন্তরিক উদ্বেগ আছে সেইটেই জানতে পারত না। বিশেষত এসে যখন অমন করে পড়েছে–তখন সেই অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থাতেও তরলার আর বুড়োর বৌয়ের চোখের জলটুকু সে লক্ষ করেছে–সেইটুকুই জীবনের পরম সম্পদ বলে বোধ হচ্ছে তার। সেই সম্পদই কোথায় যেন বাইরে একটা বর্ম পরিয়ে দিয়েছে, আর কোন আঘাতই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

এরই মধ্যে খবরটা দিল ছোটকর্তা। আজই অফিস থেকে শুনে এসেছে সে। অরুণের খবর। অরুণ নাকি অনেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত কলকাতাতে কাদের বাড়ি ছেলে পড়াবার কাজ নিয়েছিল। ছোট ছোট চার-পাঁচটা ছেলেমেয়েকে পড়াবে–তার বদলে খাওয়া-থাকা আর মাসে দু’টাকা হাত খরচা পাবে–এই বন্দোবস্ত হয়েছিল। যাদের বাড়ি–সেই গাঙ্গুলীবাবুদের এক ভগ্নীপতি বোতা চাটুয্যে ওদের অফিসে কাজ করেন, তিনিই খবরটা দিয়েছেন। অরুণের দেশের অনেকে দুর্গাপদদের অফিসে কাজ করে–সেই সূত্রে অরুণকে চিনতে খুব অসুবিধা হয় নি তাঁর। গাঙ্গুলীবাবুরা ওর ব্যবহারে নাকি খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরা ক-ভাইই ভাল চাকরে, টিকে থাকলে তাঁরাই একটা কোথাও চাকরি-বাকরিতে বসিয়ে দিতে পারতেন, সে কথাও নাকি তাঁদের আলোচনা হয়েছিল–কিন্তু ছেলেটার জন্মলগ্নে বোধহয় একসঙ্গে শনি আর রাহুর দৃষ্টি আছে–কোথায় কোন বাসা বাঁধা বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ওর ভাগ্যে নেই, তাই সেখানেও টিকতে পারল না। এই স্বদেশী হুজুগে মেতে নাকি কাদের সঙ্গে মহিষবাথান চলে গিয়েছিল নুন তৈরি করতে–পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। মারধোর তো যথেষ্ট খেয়েছেই, জেলেও পুরেছে তারা। মারধোরের চোটেই কোথায় কী করত সব বার করে নিয়েছে, তারপর এদের নিয়ে টানাটানি, পঞ্চাশ রকম জেরা, ওকে কোথায় পেলে, ওর কে আছে, কী জানো ওর কথা–এই সব ঠিকুজী-কুলুজী — থানায় যাওয়া এজাহার দেওয়া–একেবারে নাজেহাল করে ছেড়েছে গাঙ্গুলী বাবুদের। তাতে ওঁরা খুব চটে গেছেন, আর কখনও কোন অজানা অচেনা লোককে বাড়িতে আশ্রয় দেবেন না তাঁরা–প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জেল থেকে বেরিয়ে আর ও-মুখো হতে হচ্ছে না বাবুকে–এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।

খবরটা ফলাও করেই বিবৃত করল দুর্গাপদ। তারপর বেশ যেন পরিতৃপ্তির হাসির সঙ্গেই বক্তব্য শেষ করল তার, ‘যাদের বাড়া ভাত তেতো লাগে, সুখশয্যেয় শয্যেকণ্টকী হয়– তাদের তো এমনি দুগ্‌গতি হবেই গো, হতে বাধ্য। ওদের সেই যাকে বলে না–রাহুর দশা, তাই। কোথাও স্থির থাকতে দেবে না, সুখে আছে দেখলেই পেছনে চাবুক মেরে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তবে আর বলে কেন সুখে থাকতে ভূতে কিলানো। সত্যিই ভূতে কিলোয় ওদের। নইলে এ বাড়ি ছেড়ে অমন ভূতে তাড়ানোর মতো পালাবে কেন বলো তোমরা। আমরা কি ওর পাকা ধানে মই দিচ্ছিলুম, না বুকে বাঁশ দিয়ে ডলছিলুম দুবেলা। তা নয়, বরাত। ওর বরাতে আছে পাঁচ দোর ঝাঁট দিয়ে বেড়ানো, ভিক্ষে করে খাওয়া–তুমি আমি চেষ্টা করলে কি আর তা বন্ধ হয়? বরাত এমন না হলে বাপ-মায়েরই বা অমন হাল হবে কেন? ও-সব লোককে যারা বাড়িতে ঠাঁই দেবে তাদেরও মন্দ হবে। হয় না হয়–গাঙ্গুলীবাবুদেরই ব্যাপারটা দ্যাখো না। আমাদের যে কোন বড় ক্ষেতি হয় নি সেই গুরুবল!’

ছোটকর্তা আরও কত কি বকে যায় কিন্তু মহাশ্বেতার কানে ঢোকে না সে সব কথা মহাশ্বেতার যেন দু’চোখ জ্বালা করে জল ভরে আসে ছেলেটার কথা ভেবে। আহা অমন ভাল ছেলেটা কী থানছাড়া মানছাড়া হয়েই না ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী দরকার ছিল বাপু, বেশ তো ছিলি এখানে, খাচ্ছিলি দাচ্ছিলি থাকছিলি–কেউ তো কিছু বলেও নি। চেপে থাকলে এতদিনে পড়াশুনো কতদূর এগিয়ে যেত, আর একটা পাস দিতে পারত। চাকরি-বাকরি যা হোক একটা জুটিয়ে নিয়ে বিয়ে-থা করে ঘরবাসী হতে পারত চাই কি! তা নয়–এ ওর কী দুর্মতি হল বাপু!

ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল বুঁচির কথা। বুঁচি শুনলে দুঃখ পাবে, হয়ত কান্নাকাটি করবে। ওর ওপর টানটা খুবই ছিল। নিজের ভায়েদের চেয়েও বেশি দেখত ওকে। সে থাকলে ও ছোঁড়াও বোধহয় অমন করে পালাতে পারত না।

অনেকদিন বুচিরও কোন খবর পাওয়া যায় নি। কে জানে সব কে কেমন আছে এইসব হ্যাঁঙ্গামা হুজ্জত ওদিকেও হচ্ছে কিনা কে জানে। ওর দেওরেরই তো পাল একেবারে–খুড়তুতো-জাঠতুতো মিলিয়ে সোমখ দেওর একগাদা। তারা যদি এইসব হুজুগে মেতে থাকে? মাগো, শেষে জামাইয়ের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে না তো?….

কালই পাঠাবে বড়কর্তাকে খবরটা নিয়ে আসবার জন্যে।

বরং অমনি বলে আসবে যদি দিনকতকের জন্যে পাঠায় এখানে।….. তা কি আর পাঠাবে!

‘মুয়ে আগুন! ঐ হয়েছে এক কুটুম। এক মিনিটের জন্যেও বৌকে কোথাও পাঠাবে না। পাঠাবার কথা তুললেই সাত কাহন ওজর ফেঁদে বসবে। মা-বেটা সব সমান। বৌ না হলে ওদের যেন ত্রিভুবন অন্ধকার, সংসার বন্ধ একদম। আ-মরণ বৌ যখন হয় নি–তখন চলত কী করে? তোরা কি সব ওপস করে থাকতিস নাকি?….. এবার আমি আনবই, তাতে ঝগড়া হয় সেও ভাল!’

॥৩॥

বুড়োর ইচ্ছে, বাবুদের বাড়ির আসন্ন উৎসবে তার শালাশালীদের নিয়ে আসে ছাঁদার জন্যে। এবার যদিও লুচি ও সন্দেশের সংখ্যা নাকি কমিয়ে দেওয়া হবে, মাথাপিছু বারোখানা লুচি এবং আটটা সন্দেশ মাত্র বরাদ্দ হয়েছে–আর সে জন্যে ঘোঁটও চলছে খুব, একদল বলছে আমরা যাব ঠিক নিয়ম মতো তবে কম ছাঁদা দিতে এলে নেব না, চলে আসব; আর একদল বলছে–না নেবে তো ওদের বড় বয়ে গেল, যারা নেবে না সামনের বারে তাদের নাম কাটা যাবে, তাতে ক্ষতিটা কার হবে? এ তো আর জোর কিছু নেই, কবুলতি দলিলদস্তাবেজও কিছু করে দেয় নি ওরা–ইচ্ছেসুখের দেওয়া, একেবারে এ পাট তুলে দিলেই বা ঠেকাচ্ছে কে? ওরা বোকা তাই এ বাজারে দিয়ে যাচ্ছে এখনও, বন্ধ করাই তো উচিত ছিল! এই সব নিয়ে নানান কথা তক্কাতক্কি, আলোচনা চলছে পাড়ায় পাড়ায় — কিন্তু কম দিলেও, এবারে নাকি একটু বিশেষ ব্যাপারও আছে। এবার শুধুই লুচি আর মোণ্ডা নয়, সেই সঙ্গে নাকি নগদ পয়সাও কিছু করে দেওয়া হবে। আর তার অঙ্কও খুব সামান্য নয়–কেউ বলছে একটা করে সিকি বন্দোবস্ত হয়েছে, কেউ বলছে আধুলি। যাই দিক, কলকাতার টাকশালে লোক পাঠানো হয়েছে, নতুন সিকি বা আধুলি তারা গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যাবে। তবে সিকিই হোক আর আধুলিই হোক, এটা ঠিক যে মাথাপিছু প্রত্যেকেরই দেওয়া হবে, এক মাসের শিশু হলেও পাবে। বাবুদের কার নাকি একটা বড় মকদ্দমায় জিত হয়েছে, তারই মানসিক ছিল, সেই হিসেবেই এবার এই দমকা খরচের ব্যবস্থা। তা ছাড়াও শোনা যাচ্ছে, এবারের সামাজিক অন্যবারের মতো পেতলের সরা দিয়ে সারা হবে না, একখানা করে ভরুঙে থালা দেওয়া হবে প্রত্যেক বাড়িতে। অবশ্য সবাই তা বিশ্বাস করছে না এখনও, কেউ কেউ বলছে থালা না হাতি, দেখো শেষ পর্যন্ত একটা করে জলখাবারের মতো রেকাবি বেরোবে।

সে যাই হোক, পাওনা এবার কিছু বেশি হবেই–এত যখন শোনা যাচ্ছে, কিছু কি তার ফলবে না?

‘যা রটে তার কিছুটাও তো বটে।’ বুড়ো বলে, ‘আর বারোখানা নুচি আটটা সন্দেশই বা কম কি। নুচির সাইজ তো আর পাল্টাবে না, অন্তত তেমন তো কই শোনা যাচ্ছে না এখনও। একোখানা বারকোশের মতো নুচি–আটখানা খেলেই পেট ভরে যায়। আনলে –ওরা যদি কজন আসে তো বেশ বড় এক পুঁটলি ছাঁদা নিয়ে যেতে পারে–’

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় বুড়ো। বক্তব্যটা এইখানেই শেষ ধরে নেওয়া যেতে পারত যদি না বলবার ভঙ্গিতে অসমাপ্ত সুর একটা প্রকাশ পেত। আরও কিছু বলবার আছে ওর–সেটা কোথায় বাধা পেয়ে আটকে যাচ্ছে। ওর মনের এই এত বড় বাসনাটা চরিতার্থ হবার পথে একটা অন্তরায় ঘটেছে–সেটা কারুর কাছেই আর অস্পষ্ট নেই, শুধু সেই অন্তরায়ের কথাটা খুলে বলতে কেন ইতস্তত করছে সে, সেইটেই কারও ঠাওর হচ্ছে না।

ওর খুড়তুতো ভাই হাবলা বলে, ‘তা আনিয়েই নাও না। এখনও তো সময় আছে। একটা খবর পাঠালে ওরা তো নিজেরাই চলে আসতে পারে!

‘দূর! বাড়ির মত না নিয়ে আমি অমনি খপ করে খবর পাঠাতে পারি!’

‘তা বাড়ির মতটা নিয়ে নাও না, কী হয়েছে!’

‘সে বড় লজ্জা করে। শ্বশুরবাড়ির কথা কি আর বলা যায়।’

কয়েক মিনিট সবাই চুপ করে থাকে। কী বলবে চট করে ভেবে পায় না বোধহয়। ওদের আসর বসেছে চিরাচরিতভাবে ওদের ভেতরের বাগানে। গোল হয়ে বসেছে সবাই, মাঝখানের খানিকটা জায়গা ফাঁক রেখে। হাবলারা তিন ভাই ইস্কুলে যায়, অন্য দিন তাই এ সময় আসর বসতে পারে না। আজ কী একটা ছুটির দিন বলে মজলিসের সভ্যসংখ্যা পুরো হয়েছে। বুদ্ধি বা যুক্তি নেবার পক্ষে এটাই সবচেয়ে অনুকূল অবসর।

আইন অমান্য আন্দোলনের প্রবল তরঙ্গ বাইরের জীবনমূলে যতই নাড়া দিক, এ বাড়ির এই কটি দেওয়াল ভেদ করে সে তরঙ্গের স্পন্দন পৌঁছয় না। এদের জীবন পুরনো নিয়মেই চলে, প্রতিদিন কাটে চিরদিনের মতো। কর্তারা চাকরি করে, সাবধানে চাকরি বাঁচিয়ে চলে। চাকুরেরা অবশ্য সর্বত্রই হুঁশিয়ার–প্রথম সেই অসহযোগ আন্দোলনে কয়েকজন যা চাকরি ছেড়েছিল–কিন্তু তাইতেই, তাদের দুর্দশা দেখেই বোধহয় সকলের চোখ খুলেছে, এ আন্দোলনে বিশেষ কেউ চাকরি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি। যাঁরা আগের আন্দোলনের মার্কামারা–তাঁরাই এবার নেতৃস্থানীয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরাই যা আছেন বড়দের মধ্যে। বাকি সবাই তরুণের দল। ছাত্ররা এবং যারা ইস্কুল কলেজ ছেড়ে বেকার বসে আছে, চাকরিতে বা অন্য কোন কাজকর্মে লেগে পড়ার অবসর পায় নি–তারা। এরাই মার খাচ্ছে জেলে যাচ্ছে দলে দলে, এমন কি প্রাণের মায়াও করছে না, জান দিতে ও নিতে প্রস্তুত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে–স্বাধীনতা-যুদ্ধের এ আহ্বানে।

কিন্তু এসব কোন নিয়মই এ বাড়িতে খাটে না। এদের কথা স্বতন্ত্র সব ব্যাপারেই। এ বাড়ির এত বড় ছেলের দল–যার অধিকাংশই বেকার–এরা ত্রিকালজ্ঞ বৃদ্ধদের মতোই সন্তর্পণে দূরে সরে আছে। এদের মধ্যে এ হুজুগ বা ওদের অভিভাবকদের মতে পাগলামী ঢোকে নি। ওরা সব এসব খবর শোনে, আলোচনা করে, মজা দেখে। শোনেও লোকপরম্পরায় কারণ এ বাড়িতে খবরের কাগজ আসে না। পাড়ার মধ্যে কোন কোন বাড়িতে আসে–ইচ্ছে করলে চেয়ে পড়তে পারে কিন্তু এদের সে ঔৎসুক্য নেই। পড়ার ক্ষমতা কম–ইচ্ছা আরও কম। তাই ওদের জীবনে রাজনৈতিক ঘটনা-সংঘর্ষের সংবাদের চেয়ে বাবুদের বাড়ির চার আনা দক্ষিণার খবর বেশি চিত্তাকর্ষক। ওদের জীবন যে অতি পুরাতন বৃত্তে আবর্তিত হয় সেখানে বাবুদের বাড়ির ছাঁদার পরিমাণে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলে বিপুল তরঙ্গ ওঠে। এ ঘটনা–এই পাওনার দিনগুলো বছরে আসে মাত্র তিন-চারবার, তাই এর আগমনের বহু পূর্ব থেকে এদের থিতিয়ে আসা জীবনে আলোড়ন জাগে–আলোচনা ও তর্কবিতর্কের অবসান থাকে না।

আজও সেই প্রসঙ্গ উঠেছে। কদিনই উঠছে। কিন্তু বুড়োর এই গোপন ইচ্ছাটার কথা জানা যায় নি। অথচ এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। এই ছাঁদার সময় হলে এবাড়িতে বহু আত্মীয়সমাগম হয়, কুটুম্বদেরও আনানো হয় অনেককে। যাদের অভাবের সংসার–আর অভাব এখনকার দিনে নেই কার–তাদেরই আনানো হয়। বুড়োর বড়পিসিদের সচ্ছল অবস্থা, তবু সেবাড়ির ছেলেরাও আসে। পিসতুতো ভাইয়ের খুড়তুতো ভাইদেরও আসতে বাধা নেই। তাতে করে সেই একটা দিন এবাড়িতে যে পরিমাণ ভাত-ডাল-তরকারির খরচা হয় সেটাও খুব অকিঞ্চিৎকর নয়–তবু বাবুদের বাড়ি থেকে যে আদায় হয় সেটাই বড় কথা, সেটাই বাঞ্ছনীয় এদের কাছে।

সুতরাং বুড়ো বলতে পারত অনায়াসেই। তবু বলে নি। বলতে পারে নি–সঙ্কোচে বেধেছিল বোধ হয়। আজ খুলে বলতে পেরে বাঁচল। যে সমস্যাটা ওর মনে দেখা দিয়েছে তার সমাধান ওর বুদ্ধির সাধ্য নয়। এদেরই পরামর্শ নিতে হবে তাও সে জানে–সুতরাং যত তাড়াতাড়ি এদের জানানো যায় ততই ভাল। সেই জানানো হয়ে যেতে তাই সে প্রাণপণে ভুরু ও কপালে কুঁচকে কেমন এক রকমের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ভাইদের মুখের দিকে।

প্রথম মুখ খুললে ওদের মধ্যে কেষ্টপদ অর্থাৎ ন্যাড়া।

তুমিও যেমন! মার কাছে আগে ছোটমাসীর ছেলেটার কথা পাড়ো না। বল যে কেউ গিয়ে ছাঁদার দিন কোলে করে নিয়ে আসবে–আবার পৌঁছে দেবে। ওদের তবু তো একটা ছাঁদা আদায় হবে। ছোটমাসী না থাক বুড়ি তো দশ দিন ধরে তাংড়ে তাংড়ে খেয়ে বাঁচবে!’

‘তা তো বললুম। তারপর? ছোটমামাও তো থাকবে–সে কী আর কোলে করে নিয়ে আসবে না?’

‘তা আনুক না। আসবে যে তার কোন ঠিকও তো নেই। কথাটা তুমি পাড়োই না। তারপর সেই কথার সুত্তুর ধরে তোমার শ্বশুরবাড়ির কথাটা তুলব অখন!

বুড়ো খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে একেবারে। এইটেই সে চাইছিল। আর একজনকে দিয়ে বলাতে পারলে সঙ্কোচের কোন কারণ থাকে না। তার পর কথার পৃষ্ঠে কথা–নিজেও বেশ গুছিয়ে বলা যায়, তাতে কেউ তত দোষ ধরতে পারবে না।

তখনই সে হয়ত উঠে যেত কিন্তু ভোম্বলের একটা কথাতে আবার যেন কেমন চুপসে গেল। ভোম্বল বললে, ‘আবার দল ভারী করছ মেজদা, মনে আছে গত বছর রাসের সময় অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলেছিল। বড়পিসির বাড়ি থেকে গেল বার এক গাদা ছেলে এসেছিল, তাইতেই বলেছিল–এদের বাড়ি কি ছারপোকার বেয়ান নাকি রে বাবা, নাকি খোদা ছপ্পর ফুঁড়ে দেয় এই সময়টা হলে? কোথাও থেকে ভাড়া ক’রে আনে নাকি আদ্দেক ভাগ দেবার বন্দোবস্তয়!’

কেষ্ট বললে, ‘হ্যাঁ–বলেছিল যেমন তেমনি তার জবাবও তো পেয়েছে! জবাব কি দিয়েছিলুম মনে নেই?…. ওদের মাথায় ডাঙ্গশ মেরে রেখেছি, আর কোনদিন মুখ খুলতে সাহস করবে না!’

জবাবটার কথা মনে আছে বৈকি। সকলেরই মনে আছে। কেষ্টই দিয়েছিল জবাবটা, সঙ্গে সঙ্গেই দিয়েছিল, যেন সাক্ষাৎ দুষ্ট সরস্বতী এসে ওর জিভে ভর করেছিলেন। কেষ্ট বলেছিল, ‘এত বড় গুষ্টিটার ভাগ্না-ভাগ্নী দৌউত্তুর মিলিয়ে কি কম হয়–না কম হবার কথা? বাড়বাড়ন্ত সংসার হলে এমনিই হয়। এ তো আর আঁটকুড়োর ঘর নয়–ছেলেমরার বংশও নয়। আমাদের সব জেঁওজ পোয়াতীর ঘর!’

যিনি শোনাতে এসেছিলেন কথাটা–বাবুদের হেড সরকার সুরেন পাল–তাঁর মুখ অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠেছিল কথাটা শুনে, কিন্তু কোন জবাব দিতে পারেন নি। তাঁর ছেলেপুলে হয় নি। এক ভাইঝির ছেলেকে পোষ্য নিয়েছিলেন সেওঁ মরে গেছে। আর তাঁর মনিবদের মধ্যে যিনি মেজবাবু তাঁর পাঁচটি ছেলের মধ্যে এখন একটিতে ঠেকেছে, শিবরাত্রির সলতে যাকে বলে। সেই জন্যেই জবাব কিছু দিতে পারেন নি সুরেন পাল। হঠাৎ কোন কথা মুখে যোগায় নি। কিল খেয়ে কিল চুরি করতে হয়েছে।

কথাটা বলার জন্যে অবশ্য বাপের কাছে ধমক খেয়েছে কেষ্ট পরে। অভয়পদ সাধারণত সাংসারিক ব্যাপারে, বিশেষ করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও, এ কথাটায় চুপ করে থাকতে পারে নি, বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিল, ‘অমন করে লোকের আঁতে ঘা দিয়ে কথা কইতে নেই, ছিঃ!…. এ তো আর মানুষের হাত কিছু নয়–ভগবানের মর্জি। কার কখন কী হয় কেউ বলতে পারে? আমাদের বাড়ি এত ছেলে কিন্তু ভগবানের ইচ্ছে হলে এই বাড়ি ফাঁকা হয়ে যেতেও দেরি লাগবে না। মুনির শাপ আর মনস্তাপ দুইই সমান–ও কুড়োতে নেই অমন করে। এবার থেকে সাবধান হয়ে কথা কয়ো।’

তা অভয়পদ যাই বলুক, ভায়েদের কাছে বাহবার অভাব হয় নি। তারা একবাক্যে প্রশংসা করেছে ওর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের।

কিন্তু আজ ভোম্বল অন্য সুরে কথা বলল। খানিকটা চুপ থেকে বলল, ‘তা হোক, আর হয়ত কিছু বলবে না–কিন্তু কী দরকারই বা এত কাণ্ড করবার তাও তো বুঝি না। বড়দার শালারা আসবে কত দূর থেকে–তার মজুরি পোষাবে? বুঝলুম না হয় গাড়ি পালকি করবে না, হেঁটেই মেরে দেবে–তবু এতটা পথ হেঁটে লাভ কি হবে?… এই তো কাল থেকেই ভিয়েন বসবে শুনছি, তেবাটে চতুব্বাটে লুচি খানকত, তার জন্যে এ দুক্‌চেটেপনার দরকার কি?’

ভোম্বলের কথার জবাব অবশ্য কেষ্টপদকে আর দিতে হয় না। তার নিজের ভাই চাঁদাই টাকরা আর জিভে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলে ওঠে, ‘ইলো–দেখিস! বড্ড বড়লোক হয়েছিস যে দেখতে পাই। ঐ চতুব্বাটে নুচিই তো পড়তে পায় না। কৈ সামনে ধরে দিলে পড়ে থাকতে তো দেখি না কোন দিন। পরম পদাখ করে উঠে যায় যে।…. আর ঘিয়ে ভাজা নুচি কি বাসি হয় নাকি? ও যেদিন পাবে সেদিনই টাটকা।’ .

ভোম্বল আর চাঁদা পিঠোপিঠি–এক বছরের ছোট-বড়। পিঠোপিঠি বলেই বোধ হয়, দিন-রাত টা-টরি ওদের লেগেই থাকে।

পিঠোপিঠি ভাই-বোনে বা ভায়ে ভায়ে এমন অবশ্য হয়েই থাকে কিন্তু ভোম্বলের এই অকারণ খোঁচা তোলায় বা ‘ফুট কাটা’য় সব ভাই-ই তার ওপর একটু অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল। ওরা কেউই বৌদিকে খুশি করবার এই হঠাৎ-পাওয়া সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। এই ছাঁদার জন্যে এতদূর আসা তাদের পোষাবে কিনা সে তাদের বিবেচ্য, কিন্তু ভাই-বোনদের অপ্রত্যাশিতভাবে কাছে পেলে বৌদি যে খুশি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ সুযোগ দেবার জন্য তারা মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল বুড়োর কাছে।

এতকাল পর্যন্ত এবাড়ির ছেলেরা এবাড়ির মেয়েদের সম্পর্ক নির্বিশেষে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে প্রাণপণে। মেয়েদের কাছাকাছি থাকা মানেই সংসারের খাটুনি ঘাড়ে চাপা–এবং অনেক অপ্রীতিকর কথা শোনা। কোন-না-কোন উপলক্ষ ধরে খ্যাচখ্যাচ’ করা তাদের স্বভাব। হয় পড়ার জন্যে–লেখাপড়া হ’ল না বলে, নয় চাকরির জন্যে –চাকরি জুটিয়ে নেবার জন্যে তাদের যথেষ্ট উদ্যম দেখা যাচ্ছে না বলে, নয়ত সংসারের কাজের জন্যে–অবিরত খ্যাচ-খ্যাচ তারা করবেই। কিন্তু বুড়োর বৌ এবাড়িতে পা দেবার পর থেকেই সব ধারণা যেন গোলমাল হয়ে গেছে। হঠাৎ ওরা আবিষ্কার করেছে যে, এমন মেয়েও আছে যার সাহচর্য রুচিকর, যার ফরমাশ ভার মনে হয় না বরং সে ফরমাশ খেটে সুখ পাওয়া যায়, খ্যাচখ্যাচানিও এমন কি মিষ্টি লাগে। সুতরাং তার প্রিয় হবার জন্যে সকলেই উৎসুক, ব্যগ্র। এদের মধ্যে একমাত্র বোধ হয় ভোম্বলই দলছাড়া, তারই বৌদির প্রিয়সাধনে উৎসাহ কম তাই সে এদের এই আকস্মিক উষ্মার কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে একটু অবাক হয়েই চেয়ে রইল।

অবশ্য উষ্মা প্রকাশের বা ঝাল ঝাড়ার খুব অবসরও মিলল না। কারণ–কথা যে পাড়ে পাড়ুক, সে তো পাড়বে বুড়ো আর ন্যাড়া, সে যখন হয় হবে, আর সে হবেই জানা কথা– এখন সবচেয়ে যেটা বেশি দরকারি সেটা হচ্ছে বৌদিকে শুভ সংবাদটা দেওয়া। তিন- চারজন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হৈ-হৈ করে উঠে পড়ল। কেউই মুখে যদিচ খুলে বলছে না, কিন্তু সকলকারই ইচ্ছে বাকি সকলের আগে গিয়ে খবরটা দেবে বৌদিকে।

তবে সে সৌভাগ্য সেদিন বিধাতা ওদের কারও অদৃষ্টেই লেখেন নি। বাগান পেরিয়ে উঠোন পার হয়ে দালানে ঢোকবার মুখেই দেখা গেল ছোটকাকাকে। সে যেন ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল, ওদের দেখেই বলে উঠল, ‘এই যে! এতক্ষণে গুণধরদের টিকি দেখা গেল।…. এই শোন্ তোরা কেউ গিয়ে বৌমার বাপের বাড়িতে খবর দিয়ে আসবি, কালই বরং ভোরে গিয়ে একেবারে ওর ভাই-বোনদের সঙ্গে করে নিয়ে আসবি!’

বোধহয় পাথর হতে বাকি আছে ওদের, এমনি আড়ষ্ট কাঠ হয়ে গেছে। এত জল্পনা- কল্পনা, বুড়োর এত দুশ্চিন্তা ও তার নিরসন, ওদের এত আশা উৎসাহ–সব কি তাহলে মাটি হয়ে গেল! সকলেই যেন বিমূঢ় জড়বৎ দাঁড়িয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

‘কী হল কি তোদের? অমন কাঠ হয়ে গেলি কেন? কেউ কি কোন দিন ওখানে হেঁটে যাস নি?’

‘না–তা নয়। ইয়ে–’, হাবলা বলে ফেলে, ‘বৌদিকে বলা হয়েছে? বৌদি জানে?’

বৌদির জানাজানির কী হয়েছে এতে?’ তেড়ে ওঠে দুর্গাপদ, ‘তার অনুমতি চাইতে হবে নাকি?… তোদের যা বলছি শোন, অত কত্তাত্তি করতে ডাকে নি কেউ তোদের! আ গেল যা! আমাকে জেরা করতে এসেছ!…. সে আমি সক্কাল বেলা উঠেই বলে দিয়েছি, তোমার ভাই-বোনদের সব আনিয়ে নিচ্ছি–দুদিন রেখে ছাঁদা দিয়ে ফেরত পাঠাবে, তার আগে নয়… এ তো তার আনন্দের কথা!’

‘না তাই বলছি!’ অনুচ্চ ক্ষীণকণ্ঠে বলে হাবলা। কিন্তু তারপর–কে যাবে, কখন যাবে সে কথা আর কেউ কিছু বলে না। হঠাৎ সব উৎসাহ যেন তাদের মিইয়ে গেছে। আরও কিছুক্ষণ নিজেদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে একে একে সরে পড়ে তারা।

একেবারে আবার সেই বাগানে নিজেদের ‘কোটে’ ফিরে গিয়ে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করে–অথবা বলা যায় সে মনোভাব যেন ফেটে বেরিয়ে আসে তাদের মুখ দিয়ে।

ছোট্‌কার সব তাইতে আগ বাড়িয়ে মুণ্ডুলি করতে যাওয়া! কত্তামো করা যেন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এ আমাদের ছোটদের ব্যাপার–আমরা যা হয় করতুম! তোমার এত নাক- গলানোর কী আছে! এটুকু কি আর আমরা পারতুম না! সেই তো যেতে হবে সাত কোশ পথ ভেঙ্গে তাদের ঘাড়ে করে নিয়ে আসতে আমাদেরই। … কেন, অত যদি শখ তো নিজেই যাও না!’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে সে কথাগুলো বাঁশ বাগানের ছায়াচ্ছন্ন নির্জনতাতেই আটকে থাকে, চারিদিকের কাঁঠাল জাম কলাগাছের প্রাচীর ভেদ করে ছোট্‌কার কানে পৌঁছয় না তাই রক্ষা

পৌঁছবে না তা বক্তারাও জানে।

ক্ষোভ শুধু ওদের মনেই নয়, বিচিত্র জটিল পথে এসে অন্যত্রও কিছু জমা হয়েছিল। সে ক্ষোভের কারণ এমন কিছু স্পষ্ট নয়, ঠিক অভিযোগ করার মতো তো কিছু নয়ই–তবু কোথায় একটা মেঘ জমে উঠল এই তুচ্ছ ঘটনা উপলক্ষ করেই।

দালানের মুখে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। কে জানে, হয়ত ইচ্ছে করেই দুর্গাপদ গলা একটু চড়িয়ে দিয়েছিল স্বাভাবিক পর্দার চেয়ে। সোজাসুজি শোনানোর দায়িত্ব স্বীকার না করেও যাতে কাজটা সারা যায়–বোধহয় সেই উদ্দেশ্যই ছিল। সুতরাং রান্নাঘরে যারা ছিল তাদের শুনতে কোন অসুবিধা হয় নি। মহাশ্বেতা তখন ছিল না, সেদিন তার ঠাকুরঘরে ‘ডিউটি’ (এ কথাটা সে সম্প্রতি শিখেছে)। সে সময়ে ছিল মেজ আর ছোট। কথার সূচনাতেই ছোট বৌয়ের হাতের কাজ থেমে গিয়েছিল, সে বেশ মন দিয়েই শুনেছিল কথাগুলো। শুনেছিল মেজবৌও, তাই তরলার হাত থেমে যাওয়ায় তত বিস্মিত হয় নি, সত্যি সত্যিই বিস্মিত হল–যখন ওদিকের কথা শেষ হতেও এদিকে এক জোড়া হাত থেমে রইল। এবার ভাল করে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল প্রমীলা, ছোটবৌ যেন কেমন কাঠ হয়ে উঠেছে, তার দৃষ্টি নত কিন্তু হাতের কাজে আবদ্ধ নয়–কিছু দূরের খালি মেঝেতেই তা স্থির।

মেজবৌ কুটনো কুটছিল, সে বঁটিখানা কাত করে উঠে দালানে এল। দুর্গাপদও কী এক দুর্বোধ্য কারণে তখনও দালান ছেড়ে যেতে পারে নি, সেইখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রমীলা কোন ভুমিকা করল না। দুজনেই দুজনের মনের চেহারা জানে–দীর্ঘকাল ধরে, ভূমিকার কোন প্রয়োজন হয় না আর। সে একেবারে সোজাসুজি প্রশ্ন করল, ‘তুমি একথা আমাদের কাউকে না জানিয়ে একেবারে বৌমাকে গিয়ে বলতে গেলে কেন?’

ঠিক এই ধরনের স্পষ্ট প্রশ্নের জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিল না দুর্গাপদ। সে একটু চমকে উঠল। উত্তর দিতেও খানিকটা সময় লাগল তার। উত্তর যখন দিল, তখনও খুব ভালভাবে দিতে পারল না, জড়িয়ে জড়িয়ে আমতা-আমতা করেই বলল, কেন–মানে–তা তাতে দোষ কি হয়েছে?’

‘দোষ হয়েছে বৈকি! আর কী দোষ হয়েছে তা কি তুমিই বুঝতে পারছ না? কুটুমবাড়ির ব্যাপার, তার ভায়েদের আনব কি না আনব সে আমরা বুঝব। তার শ্বশুর আছে, শাশুড়ী আছে–তাদের মত নেওয়া দরকার ছিল, আর বলবার হলে তারাই বলতে পারত–এ ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে যাবার কি দরকার পড়ল তোমার শুনতে পাই?’

বলতে বলতে ক্রমশ প্রমীলার কণ্ঠস্বর যেন বেশ রূঢ় হয়ে আসে।

এবার কিন্তু দুর্গাপদও ছেড়ে কথা কইল না। এতক্ষণে সে সামলে নিয়েছে নিজেকে। সেও বেশ একটু চড়া সুরেই বলল, ‘বেশ তো, তারা বলে নি, না হয় আমিই বলেছি। এর আর ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবার কি আছে! আমি কি এ বাড়ির কেউ নই?…. আমিও তো তার শ্বশুর একজন!… আর বেশ তো কথাটা তোমাদের অপছন্দ হয়, মান-ময্যেদায় আঘাত লাগবে মনে করো তো–বারণ করে দাও না। এখনও তো কাজটা হাতের বাইরে চলে গিয়ে চুকে-বুকে যায় নি! আমিই না হয় বারণ করে দিচ্ছি!’

‘সে যদি বারণ করতে হয় তো আমরাই করতে পারব, তা নিয়ে আর তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।…. আর তুমি শ্বশুর বলেই তো বলছি, তুমি একশোবার বোয়ের সঙ্গে ছুতোয়-নাতায় কথা কইতে যাও কেন? যদি এতই দরকার মনে করেছিলে–আমাদের কাউকে দিয়েও তো বলাতে পারতে, ছোটবৌও তো ছিল!’

‘তাও কি দোষের নাকি?’

একটা ব্যঙ্গের সুরই ফোঁটাতে চেষ্টা করে দুর্গাপদ, যেন ওদের সঙ্কীর্ণতাকে ধিক্কার দিতে চায়–কিন্তু সে সুর সে ধিক্কার যেন গলায় ঠিক ফোটে না। কেমন বিকৃত শোনায় গলাটা নিজের কানেই।

‘হ্যাঁ–দোষের। খুবই দোষের। এ-বাড়িতে এ অঞ্চলে এসব রেওয়াজ এখনও যে হয় নি তা তুমিও জান। তুমি তো কচি খোকা নও, এবাড়িতে কিছু নতুনও আসো নি।… তার নিজের শ্বশুর তার সঙ্গে কটা কথা কয়?’

‘ঐ লাও! তোমাদের মনের মধ্যে এত প্যাঁচ তা জানতুম না বলেই–। এত ছিষ্টির কথা উঠবে এই তুচ্ছ কথা থেকে, এমন তিল থেকে তাল হবে জানলে কি আর–!

কথাটা শেষ করে না দুর্গাপদ, যেন উত্যক্ত বিরক্তভাবেই মেজবৌকে পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে যেতে চায়।

কিন্তু অত সহজে তাকে অব্যাহতি দেয় না প্রমীলা। তেমনি শানিত শীতল কণ্ঠেই বলে, ‘প্যাঁচটা কারণে কি অকারণে জন্মেছে তা নিজের মনেই বুঝে দ্যাখো না।… বলি তোমাকে তো আর নতুন দেখছি না, তোমার হাবভাবও আমার কিছু অজানা নেই।… সে যাক গে মরুক গে, কথা বাড়ালেই বাড়বে, বয়স হচ্ছে–এখন একটু বুঝে সমঝে চলো, ব্যাগত্তা করি!’

এই বলে, আর বাদানুবাদের অবসর না দিয়েই প্রমীলা আবার যখন রান্নাঘরে ফিরে আসে তখনও তরলা তেমনি স্থির হয়ে বসে আছে।

‘ও কি লো! এখনও অমনি করে বসে আছিস! চচ্চড়ি যে ধরে উঠল, নাড়, নাড়। এতগুলো লোকের কুঁড়ে-পাতর উঠবে কি দিয়ে! সত্যি-সত্যিই আঙুলঠেলায় ভাত নামাৰি নাকি? কী এত ধ্যান করছিলি এতক্ষণ ধরে?’

অপ্রতিভ তরলা তাড়াতাড়ি চচ্চড়ির কড়ায় চাপা দেওয়া বড় কাঁসিখানা খুন্তির ডগা দিয়ে উলটে দেয়।

সত্যিই নিচের দিকটা তখন ধরে উঠেছে। গন্ধটা ঢাকতে তাড়াতাড়ি খানিকটা কাঁচা তেল ঢেলে দেয় সে।

।।৪।।

আঘাতটা এল একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই। কেউ প্রস্তুত ছিল না। সেদিন শনিবার–সকাল করেই ফেরার কথা সকলের, মেজ-ছোট ফিরলও যথাসময়ে, ফিরল না খালি অভয়পদ–বড়কর্তা। যে লোকটা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক তিনটেতে বাড়ি এসে হাজির হয় অন্য শনিবারে–সে আসছে না, কোন খবরও দেয় নি, ভাবনার কথা বৈকি। তবু প্রথমটা এক মহাশ্বেতা ছাড়া কেউ তত ভাবে নি। কিন্তু যখন সন্ধ্যাও উত্তীর্ণ হয়ে গেল, পাড়াঘরে শাঁখ বাজল আলো জ্বলল, ওদের ঠাকুরঘরেও আলো দিয়ে গেল ওদের খুড়তুতো জা–তখন সকলেই চিন্তিত হয়ে উঠল।

মেজকর্তা আর স্থির থাকতে না পেরে তার চিরাভ্যস্ত হিসাবের খাতা ফেলে (অফিস থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়েই এই খাতা নিয়ে বসা তার অভ্যাস) বাইরের রকে এসে দাঁড়াল–অন্ধকারে যতটা দৃষ্টি যায় প্রাণপণে বিস্ফারিত চক্ষু মেলে চেয়ে রইল ওদের বাড়ির মোড়ে ছোট্ট পুকুরটার দিকে। এলে ঐ পথ দিয়েই আসবে।…. ছোটকর্তা দুর্গাপদ এর আগে থেকেই ঘন ঘন নস্যি নিচ্ছে আর পায়চারি করছে। সকলের মুখেই উদ্বেগের ছায়া। মহাশ্বেতা বিকেল থেকেই ঘরবার করছিল, এখন–এদেরও এই দুশ্চিন্তা লক্ষ করেই সম্ভবত–উপরি উপরি বাগানে যেতে লাগল। মেজবৌ বেগতিক দেখে রান্নাঘরের ভার তরলা আর তড়িতের ওপর ছেড়ে দিয়ে বড় জায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। তারও মুখ শুকিয়ে উঠেছে এতক্ষণে কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা–মহাশ্বেতার সঙ্গে সঙ্গে কারও থাকা দরকার, কোথায় পড়ে মরবে, কি হবে!

শেষে যখন কুণ্ডু বাবুদের কাছারির ঘড়িতে নটা বেজে গেল তখন আর মহাশ্বেতা স্থির থাকতে পারল না। ছেলেরা ভেতরের দালানের যেখানটায় বসে জটলা করছিল সেইখানে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদ্‌মা বলতেন না যে, যে আঁটকুড়ো হয় তার পৌত্তুরটি আগে মরে– তা তাই হয়েছে আমার! সর্বনাশ হবে বলে ছেলেগুলোকেও ভগবান পাঠিয়েছেন এক একটি পাঁঠা করে!…. মুয়ে আগুন তোমাদের! বাপ এখনও আসছে না, তা একটা ভাবনা- চিন্তেও কি থাকতে নেই তোদের?… –হ্যাঁ হ্যাঁ করে বত্তিশপাটি দাঁত মেলে হাসছেন আর ইয়ার্কিবোটকেরা করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ওরে এটা জেনে রাখিস–গেলে আর কারুরই কিছু হবে না, তোদেরই মুখে ভাত ওঠা বন্ধ হবে। খেতে পাবি না, রাস্তার ধারে গামছা পেতে বসে ভিক্ষে করতে হবে –এই বলে রাখলুম, তাও জুটবে না!

কতকটা কেষ্টকে উদ্দেশ্য করেই বলা, সে-ই সামনে ছিল, অকস্মাৎ এই তাড়া খেয়ে সে একটু দিশাহারাই হয়ে উঠল। বলল, ‘বা রে! তা আমাকে খিঁচোচ্ছ কেন, আমি কি করব?’

‘কি করবি তার আমি কি জানি!…. দ্যাখ্ খোঁজ নিয়ে মানুষটা কোথায় গেল। তার আপিসেই নয়ত যা একবার! ইস্টিশনে দেখগে যা, থানায় খবর নে। আমি মেয়েছেলে, আমি বলে দেব কি করবি তোরা?….. তোদেরই তো গরজ! আর কার মাথাব্যথা আছে যে ছুটোছুটি করবে? …..গেলে তোদেরই যাবে–আর কারুর নয়, এটা মাথায় ঢুকছে না গছেরাবের দল! মুখে আগুন তোমাদের। জ্যান্তে নুড়ে-জ্বেলে দিত হয় তোমাদের মুখে! যত রেলে গলা দেওয়া মড়া, খালে ডোবা ভাগাড়ের মড়া কি আমার পেটে এসে জুটেছে গা!’

এবার মেজকর্তা ওকেই ধমক দিয়ে ওঠে।

‘বলি আপিসে গিয়ে কি করবে শুনি? সে তো বন্ধ হয়ে গেছে সেই বেলা একটায়। এতক্ষণে দারোয়ানরা সুদ্ধ ফটক বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। সেখানে যাবার হলে আমরাই যেতুম। আজ আটমাস ওপর-টাইম বন্ধ আর সে ওপর-টাইম থাকলেও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে যেত।…. দেখি আর একটু, তারপর বেরোতে হবে বৈকি। থানা হাসপাতালে সব জায়গাতেই খবর নিতে হবে।… সে আর ওরা কি নেবে? থানায় গিয়ে দারোগার সঙ্গে কথা কইতে পারবে কি হাসপাতালে গিয়ে খবর নেবে–তেমনভাবে কি মানুষ করেছ ছেলেদের?’

ধমক খেয়ে মহাশ্বেতা অনেকটা নরম হয়ে আসে। বলে, ‘বেশ তো, ওদিকে যেতে না পারুক, পিসির বাড়ি মামার বাড়িও তো খবর নিতে পারে! সেখানে কারও কোন বিপদের খবর পেয়েই সোজা চলে গেল কিনা তাই বা কে জানে। এমন যে এর আগে যায় নি মানুষটা–তাও তো নয়।…. যা হোক একটা খবর নিক্–চুপ করে খুঁটো জগন্নাথের মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে এমনি পর রাত?’

পাগল-ছাগল যা-ই হোক, মহাশ্বেতার এ কথায় যুক্তি আছে তা মেজকর্তাকেও মানতে হয়। সে তখন ন্যাড়া আর নিজের বড় ছেলেকে পাঠায় বড় বোনের বাড়ি। বুড়ো আর হাবলা যায় শ্যামা-ঠাকরুনের ওখানে। আরও যা দু-একটা সম্ভাব্য জায়গা আছে–নিকট- আত্মীয়দের বাড়ি–সেখানেও পাঠানো হয় দুজন দুজন করে। অনেক রাত হয়েছে, চাপা অন্ধকার রাস্তা–একা কারুর পক্ষেই যাওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু এদের পাঠিয়ে দিয়ে যেন যন্ত্রণা আরও বাড়ে। এতবড় বাড়িটা যেন খালি হয়ে গেছে একেবারে; নিজেদের উদ্বেগের জন্যেই হয়ত আরও–থম থম করছে। সেইটেই বেশি ভয়াবহ লাগছে। বাইরে এরা দুভাই নিঃশব্দে পায়চারি করছে, ভেতরে রান্নাঘরে তিনটি মেয়েছেলে যেন এক জায়গায় ডেলা পাকিয়ে কার্ড হয়ে বসে। ছোটর দল প্রায় সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কথা কইবার কি শব্দ করবার মতো কেউ আর নেই। শুধু আপস-তাপস করে বিলাপ করছে মহাশ্বেতা একা। কিন্তু এই শব্দহীন প্রকাণ্ড বাড়িটায় নিজের গলাই যেন বেখাপ্পা রকমের তীক্ষ্ণ আর তীব্র শোনাচ্ছে, কণ্ঠস্বরের উচ্চগ্রাম নিজের কাছেই কটু কর্কশ মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারও কথা বন্ধ হয়ে গেল এক সময়ে –বোবা ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চুপ করে বাইরের রকের একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল শুধু।…..

অবশেষে, দশটা বেজে যাবারও পরে, ওদিকের রাস্তায় একটা পায়ের শব্দ উঠল যেন। খুব আস্তে কে যেন একটা চটিজুতো টেনে টেনে আসছে। সেই ক্ষীণ শব্দ এবং ঘাসের ওপর শুকনো পাতা পিষ্ট হবার ক্ষীণতর শব্দে বোঝা গেল কোন মানুষই আসছে। অন্য সময় হলে এ আওয়াজ কানে লাগত না–বর্তমানে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার জন্যই শুনতে পেল এরা।

আশা করার মতো এমন কিছু অবলম্বন নয় এটা আরও অনেক লোক হতে পারে। যে- সব ছেলেরা বেরিয়েছে তাদেরও কেউ ফিরে আসা বিচিত্র নয়, তবু, এত মৃদু পদক্ষেপের শব্দই কে জানে কেন এদের মনে হয়–অভয়পদই আসছে।

আবার পরক্ষণেই মনে হয়–এত আস্তেই বা সে আসবে কেন?

মানুষটা শান্ত ধীর চলনবলনও সে রকমই –তাই বলে এমন নির্বীর্য ধরনেরও তো নয়। তার ভারী পায়ের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এরা সকলেই শুনে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে এ পা ফেলার তো কোনই মিল নেই। তবে–!…..

যেটুকু শব্দ উঠেছিল, সেটুকুও যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল ক্রমশ। যেন সেই অপরিমাণ শব্দহীনতার সমুদ্রে এক বিন্দু শব্দ–এক বিন্দু জলের মতোই মিলিয়ে গেল।

তবে কি ওরা ভুল শুনল?

ছোটকর্তা আর চুপ করে থাকতে পারল না, ঘরের মধ্যে থেকে হ্যারিকেনটা টেনে নিয়ে অধীরভাবেই নেমে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল।

হ্যাঁ অভয়পদই তো বটে।

কিন্তু এ কোন অভয়পদ? যে অভয়পদকে জন্মাবধি দেখে আসছে তারা–এ যে তার প্রচণ্ড ব্যতিক্রম! অভয়পদের শ্রান্তি বা অবসাদ বলে যে কিছু আছে তা তো তারা জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত কখনও দেখে নি। অথচ–

ওদের বাড়ি ঢুকতেই মজুমদারদের ছোট্ট পুকুরটা–তারই কোণাচে একফালি বাঁধা ঘাটের ওপরের পৈঠেটায় চুপ করে বসে আছে অভয়পদ। কিন্তু সে সাধারণ বসে থাকা নয়–কোন অপরিসীম শ্রান্তিতে যেন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে সে। ওর এ রকম অবসন্নভাবে বসে পড়া কিছুতেই স্বাভাবিক কোন কারণে সম্ভব নয়। তাছাড়া–লণ্ঠনের ম্লান আলোতে স্পষ্ট চোখে পড়ল–কে যেন ওর সারা মুখে এক বোতল কালি ছিটিয়ে দিয়েছে এমনই কালো হয়ে উঠেছে তা। এত দুঃখ-কষ্টেও, এমন দুঃসহ জীবনসংগ্রামেও যে মুখের সুশুভ্র বর্ণাভা সম্পূর্ণ ম্লান করতে পারে নি–সেই মুখ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এমন কালো হয়ে উঠল কি করে?

‘এ কি কাণ্ড! দাদা–কী হয়েছে কি তোমার? রাস্তায় পড়ে-টড়ে গিছেলে নাকি? কোন য়্যাকসিডেন্ট হয় নি তো?’

একটা চাপা আর্তনাদের মতো আওয়াজ করে ছুটে কাছে যায় দুর্গাপদ। আলোটা তুলে ভাল করে দেখবার চেষ্টা করে–কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নজরে পড়ে কি না।

সে আর্তনাদ এবং সেই দ্রুত উদ্বিগ্ন প্রশ্নের শব্দ ওদের কানেও পৌঁচেছিল। এরাও ছুটে কাছে এল। রান্নাঘর থেকে তরলা-তড়িৎ ওরাও বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। সকলেরই মনে এতক্ষণ ধরে যেটা বড় হয়ে ছিল সেটা এই দুর্ঘটনারই ভয়–প্রাণপণে মন থেকে তাড়াবার চেষ্টা করার ছলে সেই আশঙ্কাটাকেই লালন করছিল এরা–এবার সেইটে সর্ববাধামুক্ত হয়ে তার সম্পূর্ণ, বীভৎস চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে–সেই সম্ভাবনাটাই সমর্থিত হয়েছে দুর্গাপদর অস্ফুট আর্তনাদে–কী হয়েছে, কতটা হয়েছে, কী দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত, সেইটেই এখন বড় প্রশ্ন। কাছে এলেও তাই সামনে গিয়ে ভাল করে দেখবার সাহস নেই কারও, বুক কাঁপছে, পায়ের জোর গেছে ফুরিয়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই তরলার মাথা ঘুরে উঠেছিল। সে কোনমতে রকের ধারের লোহার সরু থামটা ধরে সামলে নিলে নিজেকে কিন্তু মহাশ্বেতা আর পারল না। সে একবার চকিতে অভয়পদ দিকে চেয়েই ‘বাবা গো’ বলে ঘাটে ওঠবার পথে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল।

ভয় দুর্গাপদরও কম হয় নি। কিন্তু তার ভেঙ্গে পড়লে চলে না বলেই সে সামনে এসে লণ্ঠনটা তুলে ভাল করে দেখল।

না, আঘাতের কোন চিহ্ন কোথাও নজরে পড়ে না। পায়ের দিকগুলোও ভাল করে দেখল দুর্গাপদ। সেখানেও কোন গোলমাল নেই। এ আর কিছু, আঘাত ছাড়া এমন চেহারা হবার কোন্ কারণ থাকতে পারে,–সেই কথাটা একসঙ্গেই যেন সকলের মনে পড়ে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকের মধ্যেটা।

তবে কি কোন খারাপ খবর আছে? কারও কোন অসুখ-বিসুখ করেছে?

নাকি ….. মারাই গেছে কেউ?

প্রশ্ন করতে যেন সাহসে কুলোয় না কারও। সকলেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। এরই মধ্যে ক্ষীরোদা কখন উঠে পড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন কেউ লক্ষ করে নি। তিনি সন্ধ্যা হলেই শুয়ে পড়েন প্রত্যহ–আজও পড়েছিলেন। ঘুম আসে না তাঁর অত সকালে কোনদিনই–কিন্তু জেগেও থাকতে পারেন না। ঝিমিয়ে থাকেন। তারই মধ্যে এদের সকলের খাওয়া হলে ছোট বৌ একটু দুধ খাইয়ে যায়, কিংবা ঘরে থাকলে তার সঙ্গে একআধটা মিষ্টি। সামান্যই খান–তবু সেটুকু না পেটে পড়া পর্যন্ত নাকি ওঁর পাকা ঘুম আসে না। সেটা অবশ্য অন্যদিন ঢের আগেই হয়ে যায় কিন্তু আজ তাঁকে দুধ খাওয়ানোর কথা এদের কারও মনে পড়ে নি। আরও মনে হয় নি কারণ এদেরও তো খাওয়া হয় নি তখনও পর্যন্ত।

ঘুম তো হয়ই নি–অন্যদিনের মতো ঝিমিয়েও থাকতে পারেন নি পুরোপুরি। কারণ সন্ধ্যা পর্যন্ত অভয়পদ ফেরেনি তা তিনি শুতে যাবার আগে শুনে গেছেন। নিথর হয়ে পড়ে থাকলেও মনটা সজাগ ও সক্রিয় ছিল। তাছাড়া বয়স যতই হোক –কান দুটো তাঁর এখনও খুব পরিষ্কার আছে। এধারের এই সামান্য আওয়াজ–দুর্গাপদর অস্ফুট উদ্বিগ্ন উক্তি এবং এদের খালি পায়ে দৌড়ে যাবার মৃদু শব্দও কানে গেছে তাঁর। তিনি আর শুয়ে থাকতে পারেন নি। উঠে বাইরে এসেছেন অন্ধকারেই। হাতড়াতে হাতড়াতে সেইভাবেই ঘর থেকে দালানে, দালান থেকে রকে পড়েছেন, তখনও কেউ দেখতে পায় নি। কিন্তু রক থেকে নিচে মাটিতে পড়বার সময়ই হুড়মুড় করে তালগোল পাকিয়ে পড়ে গেলেন।

এবার সকলে সচকিত হয়ে উঠল। মেজকর্তা দাদার কাছেও যেতে পারে নি–রকেও থাকতে পারে নিন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল –সে ছুটে এসে তাড়াতাড়ি মাকে টেনে তুলল, ‘এ কী কাণ্ড, তুমি আবার এমন করে আসতে গেলে কেন? আমরা কি আর খবর দিতুম না?…. ডাকলেও তো হ’ত কাউকে! দ্যাখো দিকিনি কী মুশকিল বাধালে। হাত-পা ভাঙ্গল কিনা–। এই বয়সে হাড় ভাঙ্গলে আর জোড়া লাগবে?’

অম্বিকাপদ তিরস্কার করতে থাকে।

ততক্ষণে তড়িৎ দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে লম্পটা নিয়ে এসেছে। দুর্গাপদও হ্যারিকেন নিয়ে এদিকে ফিরেছে।

যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলেও ছেলের হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারলেন ক্ষীরোদা। বললেন, ‘না, না, ও কিছু না। কিন্তু অভয়ের কী হল তাই বল্ না আগে। তার হল কি? সে কোথায়? বেঁচে আছে তো?

মায়ের এই আকুল প্রশ্ন কানে যেতেই বোধহয় অভয়ের সম্বিৎ ফিরল। সে পুকুর পাড় থেকে উঠে এসে তাড়াতাড়ি মাকে ধরল, হাত ধরে সাবধানে রকে বসিয়ে দিল।

ক্ষীরোদার হাত-পা বা হাড়-গোড় কিছু ভাঙ্গে নি কিন্তু লেগেছে খুব। বাঁপাটা বিশ্রীভাবে মচকে গেছে। যন্ত্রণায় চোখে জল এসে যাচ্ছে বার বার। তবু সেই ঝাপসা চোখেই, হ্যারিকেন ও লম্পর মিলিত আলোকে প্রাণপণে বড় ছেলের মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। তারপর, এদের যে কথাটা মাথায় যায় নি এতক্ষণ, অথবা যে প্রশ্নকে মনে মনে প্রশ্রয় দেবারও সাহস হয় নি, সেই প্রশ্নই খুব সহজভাবে করে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, আমার কাছে নুকুস নি–তোর কি চাকরি গেছে?’

প্রশ্নটা শুনেই এরা চমকে উঠল। তবু, তখনও বোধ করি উত্তরটা শোনবার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। অভয়পদকে এভাবে কথা কইতে কেউ কখনও শোনে নি। সে প্রাণপণে সহজ হবারই চেষ্টা করল, খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলতে গেল কিন্তু গলা কেমন যেন কেঁপে বিকৃত হয়ে উচ্চারণগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে গেল। সে মার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘না, চাকরি যায় নি, তবে বহু টাকা ডুবেছে। বাকি জীবনটা–যদি আরও বিশ-পঁচিশ বছরও বাঁচি–রোজগার করেও এর অর্ধেক হাতে পাব না। এতগুলো টাকা কখনও একসঙ্গে দেখব তা-ই কোন দিন মনে করি নি।… নিজের বুদ্ধির দোষে সেই সব টাকাই ক্ষুইয়ে এলুম।

সকলেই নির্বাক। কি টাকা, কিসের টাকা প্রশ্ন করার কোন প্রয়োজন নেই। টাকার অঙ্কটা না জানা থাকলেও সে যে কীভাবে টাকা খাটায় অফিসে তা এতদিনে এ বাড়ির সকলেই জেনেছে।

বুঝেছে সবাই–মহাশ্বেতা ছাড়া। অভয়পদর সঙ্গে সঙ্গে সেও উঠে এসেছে পুকুর ধার থেকে, ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সে, কথাগুলো শুনতে বোধ হয় কোন অসুবিধা হয় নি–শুধু তাদের শব্দগত অর্থটা যেন এখনও হৃদয়ঙ্গম হয় নি তার। অথবা সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সেও সকলের মতোই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তবে তার চোখের বিহ্বল দৃষ্টি দেখে মনে হতে লাগল যে যা শুনেছে তার একবর্ণও মাথায় ঢোকে নি।

অভয়পদ এবার মেজভাইয়ের দিকে চাইল। বলল, ‘তুমিই ঠিক বলেছিলে খোকা, অতি লোভ করতে গিয়েই সর্বস্ব গেল! সবটাই ডুবল একেবারে। শুধু তাই নয়–টাকাটা সব আমারও ছিল না তো–বেশির ভাগই পরের টাকা খাটছিল–এর, আমার শাশুড়ীর, আরও দুএকজন বন্ধুবান্ধবের। সে দেনাও আমাকে শোধ করতে হবে কিনা কে জানে– তারা তো আমাকে দেখেই দিয়েছিল! কিন্তু সে তো আমি আর এ জন্মে পেরে উঠব বলে মনে হচ্ছে না।… ওঃ!’

এবার আর সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না কোথাও।

‘কী সর্বনাশ। য়্যা!’ বলে একটা শব্দ করে অম্বিকাপদ সত্যি-সত্যিই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল রকে। টাকা তার নয়, সে ঘর থেকেও বার করে দেয় নি–তবু সে তো জানে তাদের ঘরে একটি টাকা সঞ্চয়ের জন্যও কী প্রাণপণ এবং মর্মান্তিক প্রয়াস করতে হয়। টাকা যারই হোক, বহু দুঃখের টাকা তাতে কোন সন্দেহ নেই। টাকা এমন কি শত্রুর লোকসান যাচ্ছে শুনলেও বুকে বাজে, এ তো নিকট-আত্মীয়ের টাকা। বিশেষত দাদাকে তারা চেনে–তার সারা জীবনটাই তো সুকঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের ইতিহাস। নিজেকে সর্বপ্রকারে বঞ্চিত করা পয়সা তার। এর একাংশও যদি নিজের ভোগসুখের জন্য ব্যয় করত তো এদের বোধহয় এতটা কষ্ট হত না। এই সংবাদটা তাই অম্বিকাপদর নিজের টাকা খোয়া যাবার মতোই বাজল।

এবার মহাশ্বেতাও বুঝেছিল নিঃসংশয়ে। সর্বনাশের পরিমাণটা এত তাড়াতাড়ি হিসাব করা সম্ভব নয়–তবু মোটামুটি আছা আবছা একটা ধারণা করতে পারল বৈকি! আর তাই তো যথেষ্ট। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল একেবারে, মড়াকান্নার মতো। এই গভীর নিস্তব্ধ রাত্রিতে এই কান্নার শব্দ উঠলে আর রক্ষা থাকবে না। এখনই পাড়াপড়শীরা জেগে উঠবে, কী হয়েছে সেই কৌতূহলে ছুটে বেরোবে সবাই এবং সংবাদটা শুনে মৌখিক সমবেদনা প্রকাশ করে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরবে। এ সবই জানা কথা। সকলেরই জানা। বাঁধা ছকের ব্যাপার। মহাশ্বেতারও অজানা নয়, মাথার ঠিক থাকলে সেও এ-কান্নার ফলাফল বুঝতে পারত। কিন্তু তার কাছে তখন এত বিবেচনা আশা করা যায় না। মেজবৌও তাকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল না, ‘চুপ! চুপ!’ করে তার মুখে নিজের আঁচলেরই খানিকটা গুঁজে দিয়ে একরকম টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।

তার এই সময়োচিত সতর্কতায় বাকি সকলেরও জ্ঞান হল।

‘চল চল, যা হবার তা তো হয়েছেই–এখন ভেতরে চল।’

দুর্গাপদ একরকম সকলকে তাড়িয়ে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এল। ক্ষীরোদাকে অভয়পদই ধরে ধরে এনে শুইয়ে দিলে আবার।

সে রাত্রে কারও খাওয়া হল না। শুধু তড়িৎকে জোর করে দুগাল খাইয়ে দিলে মেজ বৌ। মহাশ্বেতা প্রথম কান্নার বেগটা সামলাবার পর অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল, তারপর–সর্বনাশের পরিমাণটা সম্পূর্ণ জানা হয়ে গেলে, যখন আর সন্দেহ বা আঁকড়ে ধরবার মতো এতটুকু আশা কোথাও অবশিষ্ট রইল না তখন–টিক্ টিক্ করে মাথা খুড়ে বুক চাপড়ে রক্তগঙ্গা করে তুলল একেবারে।

বলল অভয়পদই। সে এবার অনেকটা স্থির হয়ে এসেছে, আগেকার অবিচলিত প্রশান্তি ফিরে না পেলেও কথাবার্তা সহজ হয়ে এসেছে বেশ। অম্বিকাপদর প্রশ্নের উত্তরে সবই খুলে বলল সে।

না, আশা বলতে আর কোথাও কিছু নেই। যে দুটি সাহেব ওর কাছ থেকে নিয়মিত ধার নিত তাদের দুজনেই দেওয়া নেওয়া করতে করতে অনেক টাকা বাকি ফেলে দিয়েছিল। শুধু অভয়পদর কাছেই না–আরও অনেকের কাছেই। এরা আগে কেউ কাউকে কিছু বলে নি। শেষে দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে দেওয়াটা যখন অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে রইল তখন সকলেই সজাগ হয়ে উঠল। তখন জানাজানি হয়ে সকলেই প্রমাদ গুনল, কারণ টাকার পরিমাণ ভয়াবহ। এখানে এই চাকরি করে সে ঋণ শোধ করা যায় না। যারা যারা ধার দিয়েছিল তারা বিপদ বুঝে ওপরওলা সাহেবদের কাছে গিয়ে পড়ল। সেটাই হল আরও ভুল। তাঁরা ওদের হাঁকিয়ে দিলেন, শাসালেন যে এরকম অমানুষিক সুদে যারা টাকা খাটায় তাদের প্রতি কোন সহানুভুতিই নেই তাঁদের–ওরা বারদিগর ঐ টাকার কথা মুখে আনলে পুলিশে খবর দেবেন তাঁরা। আর খাতকদের গোপনে বলে দিলেন যে, ‘তোমরা যে কাণ্ড করেছ, এর পর আর তোমাদের চাকরিতে বহাল রাখা সম্ভব নয়, এদেরও বেশিদিন সামলে রাখা যাবে না। তোমরা অপমানিত হলে আমাদের সকলেরই অপমান। তার চেয়ে এইবেলা মানে মানে সরে পড়ো–clear out! নইলে শেষ অবধি তোমাদের জবাব দিতে বাধ্য হবো।’

তাঁদের এ উপদেশের কথা অভয়পদরা কিছুই জানত না। হঠাৎ একদিন শুনল যে দুজনের একজন বোম্বাইতে চলে গেছে–বলে গেছে সেখানে কে দেশের লোক আছে আত্মীয়–তার কাছ থেকে টাকা এনে এখানকার দেনা শোধ করবে। আর একজন এখানেই ছিল, সে সময় নিয়েছিল গতকাল পর্যন্ত। গতকালই রাত্রে সে আত্মহত্যা করেছে। তার নাকি দেশেও এই অবস্থা–সেখানেও মুখ দেখাবার উপায় নেই। তাছাড়া সে নানা কৌশলে নাকি তার প্রভিডেন্ট ফান্ডেরও বেশির ভাগ টাকা বার করে নিয়েছে–অবলম্বন বলতে তার আর কোথাও কিছু ছিল না।

সকালে অফিসে গিয়ে এই খবর শুনেই ওরা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল, এইমাত্র সন্ধ্যাবেলায় আরও খবর এল–সে সাহেবটিও বোম্বে থেকেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পাওনা টাকাকড়ি সব চুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে বিলেতে রওনা হয়ে গেছে। তাকে আর ধরা-ছোঁওয়া যাবে না কোন রকমেই।

সব ইতিহাস শুনে আর একদফা নিথর হয়ে রইল সবাই। শেষে অতিকষ্টে সাহস সঞ্চয় করে অম্বিকাপদ প্রশ্ন করল, ‘তোমার–মানে তোমার হাত দিয়ে কত গেল দাদা, সবসুদ্ধ? হিসেব আছে কিছু?’

‘আছে বৈকি।’ বেশ সহজভাবেই উত্তর দিল অভয়পদ, ‘প্রায় সাত হাজার টাকা।’

‘সা-ত-হা-জা-র!’ দম বন্ধ হয়ে আসে যেন অম্বিকাপদর, অতিকষ্টে টেনে টেনে অক্ষর কটা উচ্চারণ করে সে।

দমবন্ধ হয়ে আসে উপস্থিত সকলেরই। অঙ্কটা তাদের ধারণার অতীত, অবিশ্বাস্য। খানিকটা চুপ করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অম্বিকাপদ কতকটা আপনমনেই বললে, ‘গেল সপ্তাহে আমার ভায়রাভায়ের এক মামা একখানা দোতলা কোঠাবাড়ি বিক্রি করলে- হাওড়া খুরুট রোডের ওপর–সাড়ে ছ হাজার টাকায়। বাড়িটায় ভাড়া ওঠে প্রায় চল্লিশ টাকার মতন!’

আরও একবার বুক চাপড়ে হাহাকার ক’রে ওঠে মহাশ্বেতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *