ডাক্তারের পরামর্শ দিলে দার্জিলিঙে নিয়ে যেতে।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গোকুলকে বিদায় দেবার সেই ম্লানগম্ভীর সন্ধ্যাটি মনের মধ্যে এখনো লেগে আছে। তার পুনরাগমনের দিকে আমরা ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকব এই প্রত্যাশাটি তাকে হাতে-হাতে পৌঁছে দেবার জন্যে অনেকেই সেদিন এসেছিলাম ইষ্টিশানে। কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে সে কাঞ্চনকান্তি নিয়ে ফিরে আসবে। বিশ্বভুবনের যিনি তমোহর তিনিই তার বোগহরণ করবেন।
সঙ্গে গেলেন দাদা কালিদাস নাগ। কিন্তু তিনি তো বেশি দিন থাকতে পারবেন না একটানা। তবে কে গোকুলকে পরিচর্যা করবে? কে থাকবে তার রোগশয্যায় পার্শ্বচর হয়ে? কে এমন আছে আমাদের মধ্যে?
আর কে! আছে সে ঐ একজন, অশরণের বন্ধু, অগতির গতি–পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।
যখন ভাবি, তখন পবিত্রর প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে ওঠে। শিবপুরে থাকতে রোজ সে রুগীর কাছে ঠিক সময়ে হাজিরা দিত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত তার পাশটিতে, তাকে শান্ত রাখত, প্রফুল্ল রাখত, নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে মনের দরজায় বসে কড়া পাহারা দিত একমনে। কলকাতা থেকে হাওড়ার পোল পেরিয়ে রোজ শিবপুরে আসা, আর দিনের পর দিন এই আত্মহীন কঠিন শুশ্রূষা-এর তুলনা কোথায়! তারপর এ নিঃসহায় রুগীকে নিয়ে দার্জিলিঙে যাওয়া—অন্তত তিন মাসের কড়ারে—নিজের বাড়ি ঘর কাজকর্মের দিকে না তাকিয়ে, সুখসুবিধের কথা না ভেবে ভাবতে বিস্ময় লাগে! একটা প্রতিজ্ঞা যেন পেয়ে বসেছিল পবিত্রকে। অক্লান্ত সেবা দিয়ে গোকুলকে বাঁচিয়ে তোলবার প্রতিজ্ঞা।
যে স্যানিটোরিয়ামে গোকুল ছিল তার টি-বি ওয়ার্ড প্রায় পাতাল প্রদেশে নেমে চলেছে তো চলেইছে। নির্জন জঙ্গলে ঘেরা। চারদিকে ভয়গহন পরিবেশ। সব চেয়ে দুঃসহ, ওয়ার্ডে আর দ্বিতীয় রুগী নেই। সামান্য আলাপ করবার জন্যে সঙ্গী নেই ত্রিসীমায়। এক ঘরে রুগী আরেক ঘরে পবিত্র। রুগীরও কথা কওয়া বারণ, অতএব পবিত্র ও সে কি শব্দ-শ্রুতিহীন কঠিন সহিষ্ণুতা। এক ঘরে আশা, অন্য ঘরে চেষ্টা—দুজন দুজনকে বাঁচিয়ে রাখছে। উৎসাহ জোগাচ্ছে। আশা তবু কাঁপে, কিন্তু চেষ্টা টলে না।
এক-এক দিন বিকেলে গোকুল আর তাগিদ না দিয়ে পারত না। কি আশ্চর্য, চব্বিশ ঘণ্টা রুগীর কাছে বসে থেকে তুইও শেষ পর্যন্ত রুগী বনে যাবি নাকি? যা না, ঘন্টা দুই বেড়িয়ে আয়।
পবিত্র হাসত। হয়তো বা খইনি টিপত। কিন্তু বাইরে বেরুতে চাইত না।
দার্জিলিঙে এসে কেউ কি ঘরের মধ্যে বসে থাকে কখনো?
একজন থাকে। একজনের জন্যে একজন থাকে। আবার হাসত পবিত্র : সেই দুই একজন যখন দুইজন হবে তখন বেরুব একসঙ্গে।
গোকুল যেখানে ছিল, শুনেছি, সেখানে নাকি সুস্থ মানুষেরই দেহ রাখতে দেরি হয় না। সেইখানেও পবিত্রর আপ্রাণ যোগসাধন!
না, তুই যা। তুই ঘুরে এলে আমি ভাব কিছুটা মুক্ত হাওয়া আর মুক্ত মানুষের সঙ্গস্পর্শ নিয়ে এলি।
পবিত্র তাই একটু বেরুত বিকেলের দিকে, শুধু গোকুলকে শান্তি দেবার জন্যে। কিন্তু নিজের মনে শান্তি নেই।
গোকুলের চিঠি। তিরিশে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩২ সালে লেখা। দার্জিলিঙের স্যানিটোরিয়াম থেকে :
অচিন্ত্য, তোমার চিঠি (নন্দনকানন থেকে লেখা!) আমি পেয়েছি। উত্তর দিতে পারিনি, তার কারণ নন্দনকাননের শোভায় তোমার কবিমন এমন মশগুল হয়ে ছিল যে ঠিকানা দিয়েছিলে কলকাতার। কিন্তু কলকাতায় যে কবে আসবে তা তোমার জানা ছিল না। যাই হোক, তুমি ফিরেছ জেনে সুখী হলাম।
পৃথিবীতে অমন শত-সহস্র নন্দন-অমরাবতী-অলকা আছে, কিন্তু সেটা তোমার-আমার জন্যে নয়—এ কথা কি তোমার আগে মনে হয়নি? তোমার কাজ আলাদ। : তুমি কবি, তুমি শিল্পী। ঐ অমরাবতী অলকার স্নিগ্ধমায়া তোমার প্রাণে দুর্জয় কামনার আগুন জেলে দেবে। কিন্তু তুমি দস্যু নও, লুট করে তা ভোগের পেয়ালায় ঢালবে না। কবি ভিখারী, কবি বিবাগী, কবি বাউল—চোখের জলে বুকের রক্ত দিয়ে ঐ নন্দন-অলকার গান গাইবে, ছবি আঁকবে। অলকার সৃষ্টি দেবতা যেদিন করেন সেদিন ঐ কবি-বিবাগকে ও তার মনে পড়েছিল। ঐ অলকার মতই কবি বিধাতার অপূৰ্ক সৃষ্টি। তার তৃপ্তি কিছুতে নাই, তাই সে ছন্নছাড়া বিবাগী পথিক, তাই সে বাউল।
এ যদি না হত, অলকা-অমরাবতীকে মানুষ জানত না, বিধাতার অভিপ্রায় বৃথা হত। তিনি স্বর্গের সৌন্দর্য সুখশান্তি দিয়ে পূর্ণ করে কবির হাতে ছেড়ে দিলেন। কবি সেখানে দুঃখের বীজ বুনল, বিরহের বেদনা দিল উজার করে ঢেলে–
মাটির মানুষ ভুখা। তৃষ্ণায় তার বুক শুকিয়ে উঠেছে, ব্যথা-বেদনা সে আর বুঝতে পারে না, চোখে তার জল আসে না, জ্বালা করে। কদবার শক্তি তার নেই, তাই সে মাঝে-মাঝে কবির সৃষ্টি ঐ নন্দনঅলকা-অমরাবতীর দিকে তাকিয়ে বুক হালকা করে নেয়। বিধাতা বিপুল আনন্দে বিভোর হয়ে কবিকে আশীর্বাদ করেন-যে কবি, তোমার শূন্যতা তোমার ক্ষুধা মরুভূমির চেয়ে নিদারুণ হোক।
যাক, অনেক বাজে বকা গেল। তোমার শরীর আছে কেমন? পড়াশোনা ভালই চলছে আশা করি। নতুন আর কি লিখলে? ভালই আছি। আজ আসি।
কদিন পরেই চৌঠা আষাঢ় আবার সে আমাকে একটা চিঠি লেখে। এ চিঠিতে আমার একটা কবিতা সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ আছে, সেটা দ্রষ্টব্য। নয়। দ্রষ্টব্য হচ্ছে তার নিজের কবিত্ব। তার বসবোধের প্রসন্নতা।
অচিন্ত্য, এ ভারি চমৎকার হল। সেদিন তোমাকে আমি যে চিঠি লিখেছি তার উত্তর পেলাম তোমার বিরহ কবিতায়। অপূৰ্ব! বিস্ময়, কামনা, বুভুক্ষা, অতৃপ্তি, প্রেম আর শ্রদ্ধা যেন ফুলের মত ফুটে উঠেছে।
বিস্ময় বলছে :
মরি মরি
অপরূপ আকাশেরে কি বিস্ময়ে রাখিয়াছ ধরি।
নয়নের অন্তরমণিতে। নীলের নিতল পারাবার!
বাঁধিয়াছ কি অপূর্ব লীলাছন্দ জ্যোতি-মূর্চ্ছনার
সুকোমল স্নেহে!
কামনা বলছে :
যৌবনের প্রচণ্ড শিখায়
দেহের প্রদীপখানি আনন্দেতে প্রজ্বালিয়া
সৌরভে সৌরভে,
এলে প্রিয়া
লীলামত্ত নির্ঝরেব ভঙ্গিমাগৌরবে–
বুভুক্ষা বলেছে :
আজ যদি প্রচণ্ড উৎসুকে
সৃষ্টির উন্মত্ত সুখে
তোমার ঐ বক্ষপানি দ্রাক্ষাসম নিষ্পেষিয়া লই মম বুকে
কানে-কানে মিলনের কথা কই—
অতৃপ্তি বলছে :
এই মোর জীবনের সর্বোত্তম সর্বনাশী ক্ষুধা
মিটাইতে পারে হেন নাহি কোনো সুধা
দেহে প্রাণে ওষ্ঠে প্রিয়া তব–
প্রেম বলছে :
জ্যোৎস্নার চন্দনে স্নিগ্ধ যে আঁকিল টিকা
আকাশের ভালে।
ফাল্গুনের স্পর্শ-লাগা মুঞ্জরিত নব ডালে-ডালে
সদ্যফুল্প কিশলয় হয়ে
যে হাসে শিশুর হাসি…
যে তটিনী কলকণ্ঠে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
বক্ষে নিয়া দুরন্ত-পিপাসা
সে আজি বেঁধেছে বাসা
হে প্রিয়া তোমার মাঝে!…
মরি মরি
তোমারে হয় না পাওয়া তাই শেষ করি।
চেয়ে দেখি অনিমিখ
তুমি মোর অসীমের সসীম প্রতীক।
শ্রদ্ধা বলছে :
হে প্রিয়া তোমারে তাই
বারে বারে চাই
খুঁজিতে সে ভগবানে,
তাই প্রাণে-প্রাণে
বিরহের দগ্ধ কান্না ফুকারিয়া ওঠে অবিরাম
তাই মোর সব প্রেম হইল প্রণাম।
তোমার কথা তোমায় শোনালাম। এ সমালোচনা নয়। আমি দু-একজনের কবিতা ছাড়া বাংলার প্রায় সব কবির লেখাই বুঝতে পারি না। যাদের লেখা আমি বুঝতে পারি, পড়ে মনে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই, উপভোগ করি, তোমাকে আজ তাদের পাশে এনে বসালাম। আমার মনে যাদের আসন পাতা হয়েছে তারা কেউ আমায় নিরাশ করেনি। তোমাকে এই কঠিন জায়গায় এনে ভয় আর আনন্দ সমান ভাবে আমায় উতলা করে তুলছে। কিন্তু খুব আশা হচ্ছে কবিত। লেখা তোমার সার্থক হবে। তোমার আগেকার লেখার ভিতর এমন সহজ ভাবে প্রকাশ করবার ক্ষমতাকে দেখতে পাই নি। সূৰ্য্য কবিতা কতকটা সফল হয়েছিলে কিন্তু বিরহে তুমি পূর্ণতা লাভ করেছ।
গতবারের চিঠিতে যে আশীৰ্বাদ পাঠিয়েছিলাম সেটাই আবার তোমায় বলছি। তোমার শূন্যতা তোমার অন্তরের ক্ষুধা মরুভূমির চেয়ে নিদারুণ হোক। শরীরের যত্ন নিও। কাজটা খুব শক্ত নয়। ইতি–
আমাকে লেখা গোকুলের শেষ চিঠি। এগারোই আষাঢ়, ১৩৩২ সাল।
অচিন্ত্য, তোমার চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আমার দুটো চিঠির উত্তর একটাতে সারলে ফল বিশেষ ভাল হবে না। আর একটা বিষয়ে একটু তোমাদের সাবধান করে দিই—আমাকে magnifying glass চোখে দিয়ে দেখোনা কোন দিন। এটা আমার ভাল লাগে না। আমি কোন বিষয়েই তোমাদের বড় নই। আমি তোমাদের বন্ধুভাবে নিয়েছি বলে তোমরা সকলে হাতে চাঁদ আর কপালে সুয্যি পেয়েছ এ কথা কেন মনে আসে? এতে তোমরা নিজের শক্তিকে পঙ্গু করে ফেলবে। আমাকে ভালবাস শ্রদ্ধা কর সে আলাদা কথা, কিন্তু একটা হবু-গবু কিছু প্রমাণ কোরো না।
আমি আজও পথিকের চেহারা দেখতে পেলাম না। জন্মদাতার chance কি সবার শেষে? মনটা একটু অস্থির আছে। আসি।
গোকুলের পথিক ছাপা হচ্ছিল কাশীতে, ইণ্ডিয়ান প্রেসে। ডাকে প্রুফ আসত, আর সে-প্রুফ আগাগোড়া দেখে দিত পবিত্র। পড়ে যেত গোকুলের সামনে, আর অদল-বদল যদি দরকার হত, গোক বলে দিত মুখে-মুখে। গোকুলের ইচ্ছে ছিল পথিকের মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথের পথিক কথিকাটি কবির হাতের লেখায় ব্লক করে ছাপবে, কিন্তু তার সে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি।
তেরোশ বত্রিশের বৈশাখে কল্লোলে রবীন্দ্রনাথের মুক্তি কবিতাটি ছাপা হয়। কল্লোলের সামান্য পুঁজি থেকে তার জন্যে দক্ষিণা দেওয়া হয় বিশ্বভারতীকে।
যেদিন বিশ্বের তৃণ মোর অঙ্গে হবে রোমাঞ্চিত
আমার পরান হবে কিংশুকের রক্তিম-লাঞ্ছিত
সেদিন আমার মুক্তি, যেই দিন হে চির-বাঞ্ছিত
তোমার লীলায় মোর লীলা
যেদিন তোমার সঙ্গে গীতরঙ্গে তালে-তালে মিলা।
দাজিলিং থেকে দুজন নতুন বন্ধুসংগ্রহ হল কল্লোলের–এক অচ্যুত চট্টোপাধ্যায়, আর সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, এক কথায় আমাদের দা-গোঁসাই। প্রথমোক্তর সম্পর্কটা কিছুটা ভাসা-ভাসা ছিল, কিন্তু দা-গোঁসাই কল্লোলের একটা কায়েমী ও দৃঢ়কায় খুঁটি হয়ে দাঁড়াল। পলিমাটির পাশে সে যেন পাথুরে মাটি। সেই শক্তি আর দৃঢ় শুধু তার ব্যায়ামবলিষ্ঠ শরীরে নয়, তার কলমে, মোহলেশহীন নির্মম কলমে উপচে পড়ত। বত্রিশের প্রাবণে দা-গোঁসাই নামে সে একটা আশ্চর্যরকম ভাল গল্প লেখে, আর সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় দা-গোঁসাই। গল্পটার সব চেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল যে সেটা প্রেম নিয়ে লেখা নয়, আর লেখার মধ্যে কোথাও এতটুকু সঙ্গলকোমল মেঘোদয় নেই, সর্বত্রই একটা খটখটে রোদ্দরের কঠিন পরিচ্ছন্নতা। এ যে অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গটুকুর জন্যে সমস্ত সৃষ্টি অর্থান্বিত, সেই মধুর ব্যঙ্গটুকু অপরিহার্যরূপে উপস্থিত। লোকটিও তেমনি। একেবারে সাদাসিধা, কাঠখোট্টা, স্পষ্টবক্তা। কথাবার্তাও কাট-কাট, হাড়-কাপানো। ঠাট্টাগুলোও গাট্টা-মারা। ভিজে হাওয়ার দেশে এক ঝাপটা তপ্ত লু। তপ্ত কিন্তু চারদিকে স্বাস্থ্য আর শক্তির আবেগ নিয়ে আসত। ঢাকের যেমন কাঠি, তেমনি তার সঙ্গে সাইকেল। পো ছাড়া যেমন সানাই নেই, তেমনি সাইকেল ছাড়া দা-গোঁসাই নেই। এই দোচাকা চড়ে সে অষ্ট দিক (উর্ধ্ব-অধঃ ছাড়া) প্রদক্ষিণ করছে অষ্টপ্রহর। সন্দেহ হয়েছে সে সাইকেলেই বোধ হয় ঘুমোয়, সাইকেলেই খায়-দায়। বেমাইকেল মধুসূদন দেখেছি কিন্তু বেসাইকেল সুরেশ মুখুজ্জে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
পবিত্রর চেষ্টা ফলবতী না হলেও ফুল ধরল। গোকুল উঠে বসল বিছানায়। একটু একটু করে ছাড়া পেল ঘরের মধ্যে। ক্রমশ ঘর থেকে বাইরের বারান্দায়। আর এই বারান্দায় এসে একদিন সে কান দেখলে। মুখে-চোখে আনন্দ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, দেহ-মন থেকে সরে গেল বোগচ্ছায়া। পবিত্রকে বললে, জানিস, কারু মরতে চাওয়া উচিত নয় পৃথিবীতে, তবু আজ যদি আমি মরি আমার কোনো ক্ষোভ থাকবে না।
সংসারের আনন্দ সব ক্ষীণশ্বাস, অল্পজীবী। কিন্তু এমন কতগুলি হয়তো আনন্দ আছে যা পরিণতি খুঁজতে চায় মৃত্যুতে, যাতে করে সেই আনন্দকে নিরবচ্ছিন্ন করে রাখা হবে, নিয়ে যাওয়া হবে কালাতীত নিত্যকায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে গোকুল দেখতে পেল ধ্রুব আর দৃঢ় স্থির অর স্থায়ী কোন এক আনন্দতীর্থের মুক্তদ্বার। পথিকের মন উন্মুখ হয়ে উঠল।
ভাদ্রের শেষের দিকে ডাক্তার কালিদাসবাবুকে লিখলেন, গোকুলের অসুখ বেড়েছে। চিঠি পেয়েই দীনেশদা দার্জিলিঙে ছুটলেন। তখন ঘোর দুরন্ত বর্ষা, রেলপথ বন্ধ, পাহাড় ভেঙে পথ ধ্বসে পড়েছে। কাশিয়াং পর্যন্ত এসে বসে থাকতে হল দুদিন। কদিনে রাস্তা খোলে তার ঠিক কি, অথচ যার ডাকে এল তার কাছে যাবার উপায় নেই। সে প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে চলেছে অথচ দীনেশদা গতিশূন্য। এই বাধা কে আনে, কেন আনে, কিসের পরীক্ষায়? দীনেশদা কোমর বাঁধলেন। ঠিক করলেন পায়ে হেঁটেই চলে যাবেন দার্জিলিং! সেই ঝড়-জলের মধ্যে গহন-দুর্গম পথে রওনা হলেন দীনেশন। সেটাই কল্লোলের পথ, সেটাই কল্লোলের ডাক। বারো ঘণ্টা একটানা পায়ে হেঁটে দীনেশদা দার্জিলিং পৌঁছুলেন—জলকাদারক্ত-মাখা সে এক দুর্দম যোদ্ধার মূর্তিতে। চলতে-চলতে পড়ে গিয়েছেন কোথাও, তারই ক্ষতচিহ্ন সর্বদেহে ধারণ করে চলেছেন। আঘাতকে অস্বীকার করতে হবে, লঙ্ঘন করতে হবে বিপত্তি বিপর্যয়।
গোকুলের সঙ্গে দেখা হল। দেখা হতেই দীনেশদার হাত ধরল গোকুল। বললে, জীবনের এক দুর্দিনে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভাবছিলাম, আজ আবার এই দুর্দিনে যদি তোমার সঙ্গে দেখা না হয়।
বন্ধুকে পেয়ে কথায় পেয়ে বসল গোকুলকে। দীনেশদা বাধা দিতে চেষ্টা করেন কিন্তু গোকুল শোনে না। বলে, বলতে দাও, আর যদি বলতে না পারি।
কথা শেষ করে দীনেশদার হাত তার কপালের উপর এনে রাখন; বললে, Peace, Peace। আমার এখন খুব শান্তি। বড্ড চাইছিলাম তুমি আস, বেশি করে লিখতে পারিনি, কিন্তু বড় ইচ্ছে করছিল তুমি আস। সব বন্ধু-বান্ধবের কথা খুঁটিনাটি করে জেনে নিলে। বললে, আমাকে রাখতে পারবে না, কিন্তু কল্লোলকে রেখো।
সে রাত্রে খুব ভালো ঘুমোল গোকুল। সকালে ঘুম ভাঙলে বললে, বড় তৃপ্তি হল ঘুমিয়ে।
কিন্তু দুপুর থেকেই ছটফট করতে শুরু করলে। দাদা এখন এলেন না?
আজ সন্ধেবেলা পৌঁছুবেন।
গভীর সমর্পণে চোখ বুজল গোকুল।
সন্ধেবেলা কালিদাসবাবু পৌঁছুলেন। দুই ভাইয়ে, সুখ-দুঃখের দুই সঙ্গীতে, শেষ দৃষ্টিবিনিময় হল। আবেগরুদ্ধকণ্ঠে গোকুল একবার ডাকলে, দাদা!
সব শেষ হয়ে গেল আস্তে আস্তে। কিন্তু কিছুই কি শেষ আছে?
গোকুলের তিরোধানে নজরুলের কবিতা গোকুল নাগ প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণের কল্লোলে, সেই বছরেই। এই কটা লাইনে কল্লোল সম্বন্ধে তার ইঙ্গিত উজ্জ্বল-স্পষ্ট হয়ে আছে :
সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
সব আছে—নাই শুধু নিতি-নিতি
নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে
আদি নাই অন্ত নাই ক্লান্তি তৃপ্তি নাই–
যত পাই তত চাই—আরো আরো চাই,–
সেই নেশা সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান
সেই কল্পলোকে নব-নব অভিযান–
সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল
সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত উতরোল।
* আজ সেই প্রাণঠাসা একমুঠো ঘরে
* শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে।….
সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
দারিদ্রের দর্পতেজ নিয়ে এল যারা,
যারা চির-সর্ব্বহারা করি আত্মদান
যাহারা সৃজন করে করে না নির্ম্মাণ,
সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
এ সহজ আয়োজন এ স্মরণ দিন
স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
করেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার।
নহে এরা অভিনেতা দেশনেতা নহে
এদের সৃজনকুঞ্জ অভাবে বিরহে,
ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
নাই বড় আয়োজন নাই কোলাহল;
আছে অশ্রু আছে প্রীতি, আছে বক্ষক্ষত,
তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!
গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদনিৰ্ম্মাণ
শিরোপা তাদের তরে তাদের সম্মান।
দুদিনে ওদের গড়া পড়ে ভেঙে যায়,
কিন্তু স্রষ্টাসম যারা গোপনে কোথায়
সৃজন করিছে জাতি সৃজিছে মানুষ
রহিল অচেনা তারা।
অপ্রত্যাশিতভাবে আরেক জায়গা থেকে তপ্ত অভিনন্দন এল। অভিনন্দন পাঠালেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন, বাগবাজার বিশ্বকোষ লেন থেকে।
…গোকুলের পথিক পড়া শেষ করেছি। বইখানিতে সব চাইতে আমার দৃষ্টি পড়েছে একটা কথার উপর। লেখক বাঙ্গালার ভাবী সমাজটার যে পরিকল্পনা করেছেন তা দেখে বুড়োদের চোখের তারা হয়ত কপালে উঠতে পারে, হয়ত অনেকে সামাজিক শুভচিন্তাটাকে বড় করে দেখে মনে করতে পারেন, এরূপ লেখায় প্রাচীন সমাজের ভিত ধসে পড়বে। আট বছরের গৌরীর দল এ সকল পুস্তক না পড়ে তজ্জন্য অভিভাবকেরা হয়ত খাড়া পাহারার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা যে দরজা শাশি ও জানালা একেবারে বন্ধ করে রেখেছি এ ত আর বেশী দিন পারব না–এতে করে যে কতকগুলি রোগা ছেলে নিয়ে আমরা শুধু প্রাচীন শ্লোক আওড়ে তাদের আধমরা করে রেখে দিয়েছি। বাঙালী জাতি একেবারে জগৎ থেকে চলে যাওয়া বরং ভাল কিন্তু সংস্কারের যাঁতায় ফেলে তাদের অসার করে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন কি?
এবার সব দিককার দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে, আলো ও হাওয়া আসুক। হয়ত চিরনিরুদ্ধ গৃহে বাস করায় অভ্যস্ত দুই একটা নোগা ছেলে এই আলো ও হাওয়া বরদাস্ত করতে পারবে না। কিন্তু স্বভাবটাকে গলা টিপে মারবার চেষ্টায় নিজেরা যে মরে যাব। না হয় মড়ার মতন হয়ে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকব। এরূপ বাঁচার চেয়ে মরা ভাল।
যে সকল বীর আমাদের ঘর-দোর জোর করে খুলে দেওয়ার জন্যে লেখনী নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, তন্মধ্যে কল্লোলের লেখকেরা সর্বাপেক্ষা তরুণ ও শক্তিশালী। প্রাচীন সমাজের সহিত একটা সন্ধি স্থাপন করবার দৈন্য ইহাদের নাই। নিজেদের প্রগাঢ় অনুভূতি সত্যের প্রতি অনুরাগ প্রভৃতি গুণে একান্ত নির্ভীক, ইহারা মামুলী পথটাকে একেবারে পথ বলে স্বীকার করেন না, ইহারা যাহা সুন্দর যাহা স্বাভাবিক, যেখানে প্রকৃত মনুষ্যত্ব, তাহা প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই আত্মার প্রকাশিত সত্যটাকে ইহারা বেদ কোরাণের চাইতে বড় মনে করেছেন। এই সকল বলদর্পিত মৰ্ম্মবান লেখকদের পদভরে প্রাচীন জরাজীর্ণ সমাজের অস্থিপঞ্জর কেঁপে উঠবে। কিন্তু আমি এদের লেখা পড়ে যে কত সুখী হয়েছি তা বলতে পারি না। আমাদের মনে হয় ডোবা ছেড়ে পদ্মার স্রোতে এসে পড়েছি—যেন কাগজ ও সোলার ফুল-লতার কৃত্রিম বাগান ছেড়ে নন্দনকাননে এসেছি।
গোকুল সম্বন্ধে আরো একটি কবিতা আসে: নাম, যৌবন-পথিক:
তুমি নব বসন্তের সুরভিত দক্ষিণ বাতাস
ক্ষণতরে বিকম্পিত করি গেলে বাণীর কানন—
লেখাটি এল মফঃস্বল থেকে, ঢাকা থেকে। লেখক অপরিচিত, কে-এক বুদ্ধদেব বসু। তখন কে জানত এই লেখকই একদিন কল্লোলে—তথা বাংলা সাহিত্যে গৌরবময় নতুন অধ্যায় যোজনা করবে।
————
[* এ দুটো লাইন মালের কাব্যগ্রন্থে নেই।]