ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্য বললেই মনে হয়। একজন প্রতাপশালী সম্রাট এবং তাঁর শাসনভুক্ত একটা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের কথা। যেমন, সম্রাট অশোক–যার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিলো হিমালয় থেকে সিংহল পর্যন্ত। যেমন, আলেক্সান্ডার–যার সাম্রাজ্য ছিলো আরও বড়ো–পূর্ব ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা থেকে আরম্ভ করে ভারতবর্ষ পর্যন্ত। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটেন, স্পেন এবং ফ্রান্সও উপনিবেশ স্থাপন করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে ছিলো। ইংরেজ সাম্রাজ্য ছিলো এতোই বিস্তীর্ণ যে, সেখানে নাকি সূর্যস্ত হতো না কখনো। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের আদর্শ বা মতবাদকে বলে: সাম্রাজ্যবাদ। সাম্প্রতিক কালে দেশ জয় করে সাম্রাজ্য স্থাপন করা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে সাম্রাজ্যবাদ লোপ পায়নি। বরং তা দেখা দিয়েছে ভিন্ন পোশাকে।
এই নব্য-সাম্রাজ্যবাদের দু-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন স্থাপিত হয়। তারপর যে-বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়, তাকে বলা যেতে পারে একটি কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেই এই সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছিলো সমগ্র পূর্ব ইউরোপে। এমন কি, খানিকটা ভিন্ন চেহারায় চীনেও। অ্যামেরিকার কোনো কোনো অঞ্চলেও। কমিউনিস্ট দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গঠিত হয়। স্থাপিত হয় সামরিক জোেটও। কমিউনিষ্ট মতাদর্শের নামে অন্য অনেক দেশকেও নিজেদের কোলে টেনে নিতে চেষ্টা করে এই সাম্রাজ্য। তার জন্যে প্রয়োজনবোধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করেনি। এই সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্যেই তৈরি করেছিলো ছোটো-বড়ো হাজার হাজার পারমাণবিক বোমা।
উল্টো দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে এবং কখনো কখনো তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে তাদের নিজেদের দলে রাখে। ইউরোপীয় দেশগুলোর যেসব উপনিবেশ ছিলো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে সেসবকে স্বাধীনতা দিতে তারা বাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু তারপরও নানাভাবে তাদের ওপর নিজেদের প্রভাব বজায় রাখলো। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ। সামরিক যোগাযোগও। এই যোগাযোগকে জোরদার করার জন্যে তারা গড়ে তোলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। যেমন কমনওয়েলথ, যেমন নেটো। এই সাম্রাজ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রই লক্ষকোটি ডলার ব্যয়ে তৈরি করে পারমাণবিক মারণাস্ত্ৰ।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক শক্তি হিশেবে রাশিয়ার যে-পরিচয় ছিলো, তাও ঘুচে যায় পুরোপুরি। অবশিষ্ট থাকে কেবল কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমা। নতুন পরিপ্রেক্ষিতে পরাশক্তিদের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই টিকে থাকলো একমাত্র পরাশক্তি হিশেবে। এই অবস্থায় জর্জ বুশ (সিনিয়র) নতুন বিশ্ব বিন্যাসের ঘোষণা দেন। এই নতুন ওয়ার্ল্ড অডার আসলে খাটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
এভাবে এ শতাব্দীতে একটি কমিউনিস্ট এবং একটি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। কিন্তু তার বাইরে নতুন আর-একটি সাম্রাজ্যও জোরালো হয়ে ওঠে যার ভিত্তি অর্থনীতি নয়, এমন কি, আপাতদৃষ্টিতে ইহলৌকিকতাও নয়। এর ভিত্তি হলো ধর্ম। ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ কিছু নতুন নয়। অতীত কাল থেকেই প্রধান ধর্মগুলোকে কেন্দ্ৰ করে তা গড়ে ওঠে, যদিও রেনেসন্স-পরবর্তী কালে, বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের পর তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। যা লক্ষণীয় তা হলো: ইদানীং নতুন করে তার প্রবল প্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র। একে বলতে পারি নব্য ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে খৃস্টান এবং ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদী চেতনা পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই দানা বাঁধতে থাকে। তারপর কতোগুলো রাজনৈতিক ঘটনাকে ঘিরে শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে তা রীতিমতো সাম্রাজ্যবাদী চেহারা নেয়।
এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হলো মধ্যপ্ৰাচ্য সমস্যা। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পেট্রোলের দাম বাড়তে আরম্ভ করে। বিশেষ করে এর দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পায় বহু গুণ ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর যুদ্ধের পর। এর ফলে বিশেষ লাভবান হয় সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, কাতার ইত্যাদি কতোগুলো ইসলামী দেশ। তারা এই পেট্রোলের কাচ টাকা দিয়ে নিজেদের দেশে প্রভূত উন্নয়ন কাৰ্য করতে সমর্থ হয়। এসব দেশে দেখা দেয় দ্রুত নগরায়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। সেই সঙ্গে এরা গড়ে তুলতে চেষ্টা করলো আধুনিক ফৌজী বাহিনী। শিক্ষার দিক দিয়ে এরা ছিলো খুবই পিছিয়ে। সেদিকেও নজর দিলো তারা। সবচেয়ে বড়ো কথা, নতুন বিত্ত লাভের ফলে এই দেশগুলো মুরুবি সাজার চেষ্টা করলো। যেহেতু এই দেশগুলোর পরস্পর-বিরোধী স্বাৰ্থ থাকলেও একটা অভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় ছিলো সে জন্যে এরা যে-মুরুবিয়ানা শুরু করলো, তা শুরু করলো ইসলামের নামে। এভাবে তারা গড়ে তুললো একটা ইসলামী সাম্রাজ্য। এবং তারা এই সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার সক্রিয় প্রয়াস চালাতে আরম্ভ করলো। এক কথায় এটা হলো: ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ।
পশ্চিমা দেশগুলো প্ৰযুক্তি এবং বিজ্ঞানের দিক দিয়ে উন্নত হলেও, পেট্রোল ছাড়া তারা আচল। সুতরাং তারা মধ্যপ্রাচ্যের এই অনুন্নত দেশগুলোকে হাতে রাখার জন্যে নানা রকমের উপায় অবলম্বন করতে আরম্ভ করলো। তারা বাড়িয়ে দিলো আপাতদ্বন্ধুত্বের হাত। যেমন, সৌদী আরব হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মিত্র। তবে লিবিয়া, ইরাক অথবা ইরানের মতো কোনো দেশ অবাধ্য হলে তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাগে আনার জন্যেও ব্যবস্থা গ্ৰহণ করলো পশ্চিমা দেশগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এবং বিশেষ করে ব্রিটেনের সহযোগিতায় যে-ইরাক অভিযান চালানো হয়, তার পেছনে কেবল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্য ছিলো। না। ছিলো পেট্রোল নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিও।
কারো হাতে টাকা এলে সে যেমন ধীরে ধীরে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আর্থিক অবস্থা রাতারাতি উন্নত হওয়ায় তারাও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে প্রভাবশালী হতে চেষ্টা করলো–শিক্ষা-সহ বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও। তবে জাতিসঙ্ঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে পারলো না। অথবা পশ্চিমা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তারা পারলো না কোনো ছাপ ফেলতে। এই হতাশা থেকেই তখন তারা মুসলমান-প্রধান দেশগুলোর দিকে হাত বাড়ালো। এভাবে একাধিক সংস্থা গড়ে উঠলো ইসলামী দেশগুলোর। আর এসব সংস্থার নেতা হলো তেলের টাকা যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি ছিলো, সেই দেশগুলো। তেল ছাড়া, আরও একটা অস্ত্র তাদের হাতে ছিলো, সেটা ইসলাম ধর্মের নাম। তেলের জন্যে পুঁজি লাগে, তেল উত্তোলনের জন্যে লাগে প্ৰযুক্তি এবং পরিশ্রম। অপর পক্ষে, বিনা পুঁজিতে রবারবা ব্যবসা করা যায় ধর্মের নাম দিয়ে। কারণ, ধাৰ্মিক হলে যে-পুরস্কার পাওয়া যাবে, সেটা অবিলম্বে অথবা নগদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতের জন্যে ফেলে রাখা যায়। এবং স্বৰ্গ এবং স্বৰ্গীয় অন্সরা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি ঠিক মতো পালন করা হলো কিনা, তাও যাচাই করে দেখার কোনো উপায় থাকে না।
মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মের এই এন্তার পুঁজি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করার সুযোগ পেলো সৌদী আরব। কারণ ইসলাম ধর্মের সূত্রপাত সেখান থেকে এবং মুসলমানদের পবিত্র তীর্থ মক্কা-মদিনাও সেখানে। সৌদী আরবকেই গোটা বিশ্বে দেখা হয় ইসলাম ধর্মের রক্ষক হিশেবে। এভাবে নতুন এক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হলো: যাকে বলতে পারি ইসলামের ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ। এই বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতা সৌদী আরব হলেও, ইরান, ইরাক, কাতার, লিবিয়া ইত্যাদি দেশও দ্বিতীয় সারির নেতা হলো। এদের বিশাল পুঁজি থেকে ছিটে-ফোঁটা দিয়ে এরা দরিদ্র দেশগুলোতে তেল যতোটা পাঠালো, তার থেকে বেশি পাঠালো ধৰ্ম প্রচারক দল। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যে-ইসলাম দরিদ্র দেশগুলোতে মধ্যযুগে প্রচলিত হয়েছিলো, তা ধ্বংস করে এরা পুরোনো ইসলাম প্রচারের ব্যবস্থা করলো। এভাবে সামান্য মূলধন দিয়েই ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ ছড়িয়ে পড়লো ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত। এমন কি, তার বাইরে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিও এতে অনুকুল হাওয়া দিয়েছিলো। বিশেষ করে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনীদের সমস্যা এতে ইন্ধন জোগায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে ইসরাইল যে-দখলদারি এবং ভয়ঙ্কর রাষ্ট্ৰীয় সন্ত্রাস চালাতে থাকে তা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে। আফগানিস্তান এবং ইরাকের সমস্যাও তাতে সহায়তা দেয়। এই মুসলমানী জাতীয়তাবাদ দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ইসলামী ভ্ৰাতৃত্বের জন্ম দেয়। বস্তুত, এভাবে একটা প্রবল ইসলামী জাতীয়তাবোধ দানা নাবাধলে মৌলবাদী ইসলাম অথবা আল কাইদার জঙ্গীবাদ অতো দ্রুত অথবা অমন ব্যাপক সমর্থন লাভ করতো না।
ধর্মের নামে এই যে ভূখণ্ড জয় করা এবং সেখানে ধর্মের বাণী পৌঁছে দেওয়াএটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রাচীন কাল থেকেই ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠেছিলো। বেদের বাণী নিয়ে আর্যরা এসেছিলেন ভারতবর্ষে খৃষ্টর জন্মেরও অনেক আগে। অনার্যদের কেবল পরাজিত নয়, প্রায় বিনাশ করেছিলেন তারা। গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারের পর সে ধর্মও ভারতবর্ষের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছিলো নানা দিকে। বিশেষ করে সম্রাট অশোক রক্তস্রোত বইয়ে দিয়ে নিজের আসন পোক্ত করার পর বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্যে প্রচারক পাঠিয়েছিলেন উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে। ফলে ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পেঁৗছে গিয়েছিলো। আর পশ্চিমে আফগানিস্তান পর্যন্ত এ ধর্মের রীতিমতো শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছিলো। এমন কি, তারও পশ্চিমে।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও এ কথা বলা যায়। এই ধর্মের প্রবর্তক কেবল শান্তির ধর্ম প্রচার করেননি, সেই সঙ্গে তাঁর ধর্মের বাণী পার্শ্ববতী দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, অনেক সময় তরবারি দিয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর তিরিশ বছরের মধ্যে সিরিয়া, লেবানন, পারস্য, জর্দান, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকা ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। আরও পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন হয়ে ইউরোপে প্ৰবেশ করে। এর পর ইসলাম প্রচারিত হয় ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষেরও পুবে। এভাবে যে-ইসলামী বিশ্ব গঠিত হয়, বিস্তৃতির দিক দিয়ে একমাত্র খৃস্টান বিশ্বের সঙ্গেই তার তুলনা চলে।
ইসলাম ধর্মের সঙ্গে তুলনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, খৃস্টধর্ম প্রসার লাভ করে তুলনামূলকভাবে আধুনিক কালে। পীর-দরবেশরা নানা দেশে গিয়ে ধর্মপ্রচার করে পুণ্য লাভ করতে চেষ্টা করেছেন। সেসব দেশে ইসলামী রাজত্ব স্থাপনের জন্যে তারা অপেক্ষা করেননি। অপর পক্ষে, ইউরোপীয় খৃষ্টান মিশনারিরা নানা দেশে গেছেন। প্রধানত সেসব দেশে সামরিক বিজয়ের পর। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ইত্যাদি ইউরোপীয় দেশ উপনিবেশন স্থাপনের কাজ শুরু করার পর মিশনারিরা যান এসব দেশে ধর্ম প্রচার করতে। ভারতবর্ষে যেমন পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের পেছনে পেছনে আসেন জেসুইট মিশনারিরা। ইংরেজদের পেছনে আসেন অ্যাংলিকান, ব্যাপটিস্ট, রোম্যান ক্যাথলিক এবং স্কটিশ মিশনারিরা। মিশনারিদের অত্যুৎসাহী প্রচারের মাধ্যমে খৃস্টধর্ম আফ্রিকা, এশিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ অ্যামেরিকায় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বস্তুত, খৃস্টধর্মের আক্রমণে বহু জায়গায় সেখানকার আদি ধর্ম পুরোপুরি লোপ পায়। আধুনিক আফ্রিকায় যেমন প্রাচীন ধর্মগুলোর জায়গা দখল করেছে। খৃষ্ট আর ইসলাম ধর্ম।
পৃথিবীতে খৃষ্ট ধর্ম এখন সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। সে তুলনায় ইসলাম ধর্ম কেবল দ্বিতীয় নয়, অনেকটা পেছনে থেকে দ্বিতীয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যে-শক্তির যোগাযোগ কল্পনা করা হয়, খৃষ্ট ধর্মের তুলনায় ইসলামে তা অনেক বেশি। কারণ, খৃস্টানদের বিশ্বাস ধর্ম এবং রাষ্ট্র আলাদা। অপর পক্ষে, ইসলামের মতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত আছে ঈশ্বরে। আবুল মওদুদী পশ্চিমা গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের তুলনা করে বলেছেন যে, পশ্চিমা গণতন্ত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে মানুষের হাতে, কিন্তু ইসলামী বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আছে ঈশ্বরের হাতে। মানুষ হলো ঈশ্বরের প্রতিনিধি। পশ্চিমা গণতন্ত্রে আইন প্রণয়ন করে মানুষ, কিন্তু ইসলামে আইন হলো রসুলের মাধ্যমে পাওয়া আল্লাহর বিধান।
বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়ে সবাইকে আল্লাহর আইনের অধীনে আনার কাজকে মনে করা হয় পবিত্র দায়িত্ব হিশেবে এবং সে কারণে জেহাদ ইসলামের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ইসলামের লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত শান্তি স্থাপন করা–দরকার হলে তার জন্যে রক্তপাতও অবৈধ নয়। কমিউনিজমকে ইসলাম অত্যন্ত ঘূণা করে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কমিউনিজমের সঙ্গে ইসলামের এখানে একটা মিল রয়েছে। কমিউনিজম এবং ইসলাম উভয়ই বলে যে, পরিশেষে সর্বাঙ্গীণ শান্তি আসবে এবং তার জন্যে অশান্তির অর্থাৎ যুদ্ধের / বিপ্লবের আশ্রয় নিতে হতে পারে।
এই যে-ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের নীতি, মনে করার কারণ নেই যে, এখন তা কেবল মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বস্তুত, কমবেশি সব ধর্মের মধ্যেই তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন কি, হিন্দুদের মধ্যেও গত দু দশকে একটা জঙ্গীবাদী এবং প্রসারণবাদী মনোভাব দেখা দিয়েছে। ভারতে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অথবা শিবসেনার শ্ৰীবৃদ্ধি থেকে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়। তেমনি পুনরুত্থান লক্ষ্য করা যায় খৃস্টানদের মধ্যে। গত কয়েক দশক ধরে অত্যুৎসাহী মার্কিন খৃস্টানরা রাজনীতিতে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে আছেন এভ্যানজেলিকাল এবং নব্যরক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো। মার্কিন সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব এভ্যানজেলিকাল অ্যালায়েন্সও গঠিত হয়েছে। এই এভ্যানজেলিকাল খৃষ্টানরা ধর্ম প্রচারের ছদ্মবেশে সম্প্রসারণ ও আধিপত্যবাদ প্রচার করছেন। এ ছাড়া, এঁরা দেশপ্রেমকেও ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। তবে তাঁরা নতুন নতুন পরিভাষার ছদ্মবেশে নিজেদের আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখতে চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন তাদের মতবাদের একটা মননশীল এবং গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে।
খৃষ্টীয় এবং ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ বস্তুত বিশ্বব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এসেছে গোড়া থেকেই। সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্যে সম্রাটরা যেমন ন্যায়-অন্যায় সব রকমের পন্থা নেন, ধর্মীয় সাম্রাজ্য বিস্তারেও তেমনি সব রকমের পন্থা নেওয়া হয়। তার জন্যে দরকার হলে রক্তপাতেও আপত্তি নেই। কারণ ধর্মীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে পরিণামে মানুষের কল্যাণ হবে–এই যুক্তিতে ধর্মীয় নেতারা যেকোনো পন্থাকে ন্যায্য বলে বিবেচনা করেন।
এই ধর্মীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের পরস্পরবিরোধী স্বাৰ্থ থেকেই মধ্যযুগে খৃস্টান এবং মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ হয়েছে। এমন কি, ইদানীং কালে দেশের সীমানাকে অতিক্রম করে ধর্মকে আন্তর্জাতিক সীমানায় নিয়ে যাওয়ার বিশ্বাস এবং বাসনা–খৃষ্ট এবং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের ধর্মের দিকে টানার বাসনাও এদের মধ্যে প্রবল। প্যান ইসলামী চেতনার কথা অনেক আগে থেকেই চালু আছে, কিন্তু প্যান খৃষ্টীয় চেতনার কথা চালু না-থাকলেও আসলে প্রবল স্রোতে এ চেতনাও বহমান। বিশেষ করে সপ্তদশ / অষ্টাদশ শতাব্দীতে উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। যেখানে যেখানে ইংরেজ, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং জার্মান উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে, খৃস্টান মিশনারিরাও সেসব জায়গায় গেছেন এবং ধর্ম প্রচার করেছেন। এভাবে আফ্রিকায় যেসব ধর্ম প্রচলিত ছিলো ইসলাম এবং খৃষ্ট ধর্মের আগ্রাসনের ফলে সেসব ধর্ম প্রায় লোপ পেয়েছে।
ধর্ম প্রচারে খৃস্টান এবং মুসলমানরা সাম্প্রতিক কালে কিছু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন। খৃস্টানরা পরকালের লোভ দেখানো ছাড়াও, অর্থবল ব্যবহার করেছেন ব্যাপকভাবে। দরিদ্রদের খাদ্য, শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিশেষভাবে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় তাঁরা ধর্ম প্রচার করতে চেষ্টা করেছেন। অপর পক্ষে, অতি সাম্প্রতিক কালে মুসলমানরা প্রধানত পরকালের ভয় এবং লোভ দেখিয়েই ধর্ম প্রচার করেন। স্বর্গের সুখ এবং নরকের যন্ত্রণা ইসলাম ধর্মে যেমন অতি উজ্জ্বলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, খৃস্টধর্মে তেমনভাবে করা হয়নি।
ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের প্রতিপত্তি বিস্তারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার করছেন। এটা তারা করেন প্রধানত দুভাবে–প্রচারে এবং সন্ত্রাসে। প্রচারের ক্ষেত্রে খৃষ্টানরাই প্রযুক্তিগত জ্ঞানের কারণে এগিয়ে আছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এভ্যানজেলিক্যাল খৃস্টানরা প্রচারের কাজে অডিও-ভিজুয়াল প্রযুক্তির চূড়ান্ত ব্যবহার করেন। কিন্তু মুসলমানরাও খুব পিছিয়ে নেই। তাঁরা টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং পত্রপত্রিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকেন। প্রচার ছাড়া, নিজেদের মতবাদ বিস্তারের জন্যে উগ্ৰবাদী খৃস্টান এবং জঙ্গী মুসলমানরা ব্যবহার করেন মারণাস্ত্ৰ। উগ্ৰবাদী খৃস্টানরা কোথাও কোথাও হত্যা এবং সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন–যেমন, গর্ভপাতবিরোধী গোষ্ঠী। কিন্তু এ ব্যাপারে জঙ্গী জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা অনেক এগিয়ে আছেন। তাঁরা সন্ত্রাসের কাজে অত্যাধুনিক বিস্ফোরক এবং স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্ৰ–সবই ব্যবহার করছেন। উড়ো জাহাজ দিয়ে টুইন টাওয়ারের মতো বিশাল ভবন ধ্বংস করার দৃষ্টান্তও তাঁরা স্থাপন করেছেন। এমন কি, এই সন্ত্রাসীরা নিম্নশ্রেণীর পারমাণবিক বোমাও জোগাড় করার চেষ্টা করছেন বলে মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। তালিবানদের মতো তারা আফিমের টাকা দিয়েও এসব মারণাস্ত্ৰ সংগ্রহে দ্বিধা করেন না। কারণ, তারা মনে করেন যে, তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে তারা অন্যায় পন্থা বেছে নিলেও সেটা অন্যায় নয়।
বস্তুত, খারাপ লোকেদের হাতে পড়লে ধর্ম মারাত্মক অন্ত্রের মতো কাজ করতে পারে। কারণ অত্যুৎসাহী ধর্মকরা ধর্মকে ব্যবহার করে ঐশী শক্তির নামে। কিন্তু এর ফলে এ থেকে দেখা দিতে পারে সহিংসতা এবং ধর্মািন্ধতা। আজকের অ্যামেরিকায় তাই ঘটছে। বুশের সমর্থন নিয়ে অ্যামেরিকার মুক্ত এবং কল্যাণধৰ্মী চিন্তাধারা বিপন্ন হচ্ছে। ডানপন্থীরা চেষ্টা করছে ক্ষমতায় এসে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের। তার জন্যে হাজার-হাজার নিরীহ লোকের প্রাণহানিতেও তাদের অনীহা নেই। এই ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকারও খর্ব করার চেষ্টা হচ্ছে। যেমন, আয়কর কমিয়ে ধনীদের আরও ধনী করছে বুশ-প্ৰশাসন। কিন্তু তার ফলে ব্যয় কমাতে হচ্ছে কল্যাণমূলক কাজের। এভাবে দরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্কিন গণতন্ত্র এখন বস্তুত ধনীরা আত্মসাৎ করেছে। ন্যায়নীতি এবং সাম্যের বদলে পুঁজিবাদী চিন্তাধারাই পরিপুষ্টি লাভ করছে এবং এতে ধর্মের নাম পুরোপুরি ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইসলাম এবং নব্য-হিন্দুত্বের আক্রমণে দক্ষিণ এশিয়ায়ও যুক্তিবাদ, উদারতা এবং মুক্তচিন্তাকে দারুণ বিপন্ন হতে দেখি। বিশেষ করে হতাশ হতে হয় যখন দেখি পেট্রোডলারের ছড়াছড়ি হলেও দরিদ্রদের অবস্থা উন্নতিতে কোনো প্ৰয়াস নেই; আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের কোনো উদ্যোগ নেই; কিন্তু আছে এন্তার মাদরাসা স্থাপনের কার্যক্রম। এসব মাদরাসা আসলে বিনা পয়সায় প্রাচীনপন্থী শিক্ষা দিয়ে অগ্রযাত্রার পথ চিরতরে রুদ্ধ করার সংগঠিত এবং সুকল্পিত প্ৰয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা প্রজন্মকে উন্নতির পথ থেকে সরিয়ে রাখার এই প্ৰযত্নকে প্রশংসা করা যায় না। সেই সঙ্গে সমগ্ৰ দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় প্রতিপত্তির নামে মানুষে মানুষে ঘূণা এবং অবিশ্বাসকে যেভাবে পদ্ধতিগতভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তাতে যে-কোনো উদারপন্থী লোক বিচলিত হবেন। মোট কথা, সাম্রাজ্যবাদ–তা সে যে-নামেই প্রসার লাভ করুক না কেন–তাকে মানবতা এবং প্রগতির পরিপন্থী বলেই বিবেচনা করতে হয়।
(যুগান্তর, ২০০৬)