১৩
দরজায় খুব আলতো করে কে যেন হাত রাখল। মিসির আলি কেরোসিনের চুলোয় চা বসিয়েছেন। সেখান থেকেই বললেন, ‘কে?’ কোনো রকম জবাব পাওয়া গেল না। কেউ দরজার কড়াও নাড়ছে না। মিসির আলি উঠে এলেন। দরজার ওপাশে একজন—কেউ আছে। কড়া না-নাড়লেও তা বোঝা যাচ্ছে। মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব দুর্বল নয়, অনেক কিছুই সে ধরতে পারে।
হয়তো কোনো ভিখিরি। কড়া নাড়তে সঙ্কোচ বোধ করছে, কিংবা এমন কেউ, যে ঠিকানা গুলিয়ে ফেলেছে। মিসির আলি দরজা খুলে চমকে উঠলেন–নীলু দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই সে নানান জায়গায় ঘুরছে। তার শান্তমুখে শ্রান্তির ছায়া।
‘কেমন আছ নীলু?’
‘ভালো। ভেতরে আসব?’
‘কী আশ্চর্য! কেন আসবে না?’
‘আমি ভাবছিলাম, আপনি আমাকে ঘরেই ঢুকতে দেবেন না।’
‘এ-রকম মনে করার কোনো কারণ আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। আপনি আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঠিকানা বদল করেছেন। ইউনিভার্সিটিতেও যান না।’
‘ইউনিভার্সিটিতে যাই না, কারণ আমি এক বছরের ছুটি নিয়েছি। এস, ভেতরে এসে বস।’
নীলু ভেতরে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নিচু গলায় বলল, ‘আর কেউ নেই?’
‘আর কে থাকবে? তুমি কি ভেবেছিলে বিয়ে করে, সংসার পেতে বসেছি?’
‘না, তা ভাবি নি। আপনি গৃহী মানুষ নন।’
‘তাহলে আমি কি সন্ন্যাসী?’
‘না, তাও না।’
‘নীলু, তুমি আরাম করে বস–আমি চা বানাচ্ছিলাম। চা শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’
‘চা-টা আমি বানিয়ে দিই?’
‘দাও। সব হাতের কাছেই আছে–হাত বাড়ালেই পাবে।’
নীলু শীতল গলায় বলল, ‘হাতের কাছে থাকলেই হাত বাড়ালে সব কিছু পাওয়া যায় না।’
মিসির আলি এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় কথার পিঠে কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। কিছুতেই সহজ হতে পারেন না, অথচ তার সঙ্গেই সম্পর্কটা সবচে সহজ হওয়া উচিত ছিল।
নীলু চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘আপনি আমাকে কিছু না বলে বাড়িটা বদলালেন কেন?
‘নানান ঝামেলায় বলা হয়ে ওঠে নি।’
‘বাজে কথা বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করেই এটা করেছেন। এবং কেন করেছেন তাও জানি।’
‘কেন করেছি?’
‘লোকলজ্জার ভয়ে। আমার মতো একটা অল্পবয়সী মেয়ে আপনার মতো আধবুড়োর পেছনে দিন-রাত ঘুরঘুর করে, এটা আপনার ভালো লাগে নি। সারাক্ষণ ভেবেছেন, লোকে না-জানি কি বলছে।’
‘লোকে কি বলছে না-বলছে, তা নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না।’
‘তাও অবশ্যি ঠিক। আপনি মাথা ঘামান বড়-বড় বিষয় নিয়ে।’
মিসির আলি আলোচনার মোড় ঘোরাবার জন্যে বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছি, বুঝলে নীলু। একটা মানুষের অনেক ক’টা জীবন থাকার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’ নীলু বলল, ‘এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না।’
‘ভালো না লাগলেও শোন–এই যে তুমি এসেছ আমার কাছে, এটা ঘটছে এই জীবনে। অন্য এক জীবনে আমি হয়তো গিয়েছি তোমার কাছে। সেই জীবনে আমি হয়তো তোমার পেছনে-পেছনে ঘুরছি, আর তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ।’
‘আপনি কি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?’
‘আমি কথার কথা বলছি নীলু।’
নীলু থমথমে গলায় বলল, ‘আপনার ঠিকানা বের করার জন্যে আমি যে কী কষ্ট করেছি, তা যদি আপনি জানতেন · · · ·।’
‘জানলে কী হত?’
‘না–কী আর হত? কিছুই হত না।’
নীলুর চোখ ছলছল করছে। মিসির আলি ভয় করছেন, হয়তো কেঁদে ফেলবে। তবে এই মেয়েটি শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদবে না। নিজেকে সামলে নেবে।
হ্যাঁ, তাই হচ্ছে। নীলু নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সে সহজ গলায় বলল, ‘চায়ে চিনি হয়েছে তো?’
মিসির আলি হাসলেন। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে