১৩. ট্রেনিং ক্যাম্প

ট্রেনিং ক্যাম্প।

লরেনকো মারকুইস।

মোজাম্বিক, আফ্রিকা।

১৫ই ডিসেম্বর। মঙ্গলবার।

ভোর ৫-৩০।

বাহাত্তর জন সদস্য খোলা মাঠে অপেক্ষা করছে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা। হার্ডি ফকনার তাদের প্রথম কিছু বলবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনজাতীয় কিছু হয়তো। দলের সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, তারা নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছে। এদের দাঁড় করানো হয়েছে পাঁচটি ভাগে। বার জনের একটি রিজার্ভ দলও আছে।

তারা দাঁড়িয়ে আছে প্ৰকাণ্ড একটি ভোলা মাঠের মাঝামাঝি জায়গায়। মাঠটির চারপাশে ঘনবন। পূর্বদিক থেকে হাড়-কাঁপানো শীতল হাওয়া বইছে। সূর্য উঠে গেছে। বনের আড়ালে থাকায় তার আলো এসে এখনো পৌঁছচ্ছে না।

দলের সবাই নড়েচড়ে উঠল। তাঁবুর ভেতর থেকে হাতি ফকনার বের হয়ে। আসছে। তার মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাদা টুপি। রঙিন একটি হাওয়াই শার্ট। গলায় লাল রঙের স্কার্ফজাতীয় কিছু।

কি, কেমন আছ তোমরা?

কেউ কোনো জবাব দিল না।

শীতের প্রকোপটা মনে হয় একটু বেশি। আফ্রিকা একটি অদ্ভুত জায়গা। দিনের বেলা প্রচন্ড গরম, রাতে শীত, তাই না?

ঠিক বলেছেন স্যার।

আমি সবসময় ঠিকই বলি। এখন কাজের কথায় আসা যাক। তোমাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে যে-আছে, তার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তার নাম এড়ু জনাথন। জনাথন, একটু এদিকে এস। তোমার হাসিমুখ ওদের দেখিয়ে দাও।

জনাথন এগিয়ে এল। তার মুখ হাসিমুখ নয়।

এই ছোটখাটো মানুষটির নাম এন্ড্রু জনাথন। এর সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। তোমরা নিজেরা আজ দিনের মধ্যেই তার সম্পর্কে জানবে। হা-হা-হা। আমার নিজের ট্রেনিংও এই লোকের কাছে। সে ছিল ইউএস ম্যারিনের RSM. এখানে যারা পুরোনো লোক আছে, তারা তাকে চিনবে। আমরা তাকে ডাকতাম ইয়েললা জাগুয়ার।

দলটির মধ্যে চাপা ধরনের কথাবার্তা বাড়তেই থাকল। ফকনার সেদিকে কোন কান না-দিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগল, লাঞ্চের আগ পর্যন্ত হবে ড্ৰিল। লাঞ্চের পর অস্ত্রের ট্রেনিং। ঠিক আছে? এখন বাজছে—পাঁচটা চল্লিশ। এই ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ ভোর পাঁচটা চল্লিশে আমি তোমাদের তুলে দিচ্ছি জনাথনের হাতে। যথাসময়ে আমি আবার নিজের হাতে তোমাদের নেব। গুড লাক।

ফকনার এগিয়ে এসে প্রত্যেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল, দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্নও করল, যেমনকি, চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম ভালো হয় নি? বাহ্, তোমার হাত দেখি মেয়েমানুষদের মতো নরম। এত নরম হাতে কি রাইফেল মানায়? তোমার হাতে থাকা উচিত ফুল। কি, ঠিক বললাম না?

ফকনারের সঙ্গে-সঙ্গে বেন ওয়াটসন এবং রবিনসনও মাঠ ছেড়ে গেল। সূর্য উঠে। এসেছে। এন্ড্রু জনাথন শুধু দাঁড়িয়ে আছে। জনাথনের কোমরে একটি লুগার টুয়েন্টিওয়ান পিস্তল। গায়ে গলাকাটা গেঞ্জি। গলায় ফুটবল রেফারিদের বাঁশি। সে বাঁশিতে তীব্র ফুঁ দিয়ে আচমকা সবাইকে চমকে দিল।

অ্যাটেনশন। তোমাদের অনেকেই দেখি দাড়ি-গোঁফ এবং লম্বা-লম্বা চুল। আজ দিনের মধ্যেই এ-সব বাড়তি ঝামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত করবে। তোমাদের কারোকারো মুখে একটু বাঁকা হাসি দেখতে পাচ্ছি। কারণ, তোমরা নিজেদের খুব শক্ত মানুষ ভাবছ এবং চোখের সামনে এক জন ছোটখাটো মানুষকে দেখছ। তবে সুখের কথা, তোমরা অনেকেই আমাকে চেন। আগে পরিচয় হয়েছে। যারা চেন না তাদের বলছি, একজন মানুষকে একটি রাইফেলের চেয়েও বড় হবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা কেউ যদি আমার কথার অবাধ্যতা কর, আমি তৎক্ষণাৎ গুলি করে পথের কুকুরের মতো মারব। আমার কোমরে যে-বস্তুটি দেখছ, তার নাম লুগার টুয়েন্টিওয়ান। মানুষের মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করে না। তোমাদের চেয়েও অনেক অনেক ভালোমানুষকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখেছি। কাজেই আমি যখন বলব, লাফ দাও লাফ দেবে। তোমার সামনে খাদ আছে কি নেই সে-সব দেখবে না। পরিষ্কার হয়েছে?

কেউ কোনো জবাব দিল না।

গুলি করে মারার কথাটা আমার মনে হয় অনেকেই বিশ্বাস করছ না। তোমাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এখানে আইন-আদালত বলে কিছু নেই। আমি এড়ু জনাথন-আমিই আইন। আমার এই ছোট পিস্তলটি হচ্ছে আদালত।

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

কারোর কিছু বলার আছে?

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

এস, এখন আমি দেখব, তোমাদের শারীরিক ফিটনেস কোন পর্যায়ে আছে। আমি বাঁশি বাজাবার সঙ্গে-সঙ্গে দশ কদম হাঁটবে, তারপর পঞ্চাশ কদম দৌড়াবে, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে। সঙ্গে-সঙ্গে উঠেদাঁড়াবে। দৌড়াবে। আবার শোবে। যতক্ষণ-না আমি থামতে বলব, এটা চলতে থাকবে। শুরু করা যাক।

তীক্ষ্ণ শব্দে হুইসেল বাজল।

সাড়ে ছটার মধ্যে সব এলোমেললা হয়ে যেতে শুরু করল। শুয়ে পড়বার পর উঠতে সময় লাগতে লাগল। পঞ্চাশ কদম দৌড়ে যাবার কথা। অনেকেই অল্প কিছুদূর গিয়েই বসে পড়তে শুরু করল। সবাই ঘামছে। চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে। ঠোট গেছে শুকিয়ে।  জনাথন এগিয়ে গেল। কড়া গলায় বলল, এই যে নীলশার্ট, তুমি শুয়ে আছ কেন? উঠে দাঁড়াও

আমার ওঠার ক্ষমতা নেই স্যার।

উঠে দাঁড়াও, নয়তো লাথি বসিয়ে ওঠাব।

স্যার, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

দেখা যাক, সম্ভব কি সম্ভব নয়।

জনাথন অতিদ্রুত দুটি গুলি করল। শুয়ে থাকা নীল শার্ট পরা লোকটির মাথায় চুল ঘেষে গেল একটি, অন্যটি তার চেয়ে এক ইঞ্চি উপরে। সে লাফিয়ে উঠল।

গুড। দৌড়াও, শুয়ে পড়। আবার উঠে দাঁড়াও হাঁট দশ কদম। দৌড়াও।

সকাল আটটার দিকে অনেকেই বমি করতে শুরু করল। দৌড়ানোর ক্ষমতা রইল না অনেকেরই। জনাথন শীতল স্বরে বলল, স্কোয়াড হল্টা নাশতার জন্যে আধ ঘন্টার ব্রেক দেওয়া হল। আধ ঘন্টা পর শুরু হবে ফুট ড্রিল। ডিসমিস। আধ ঘন্টা পর সবাইকে এখানে চাই।

ফুট ড্রিলের ব্যাপারে জনাথনের বরাবরই দুর্বলতা আছে। সে মনে করে, দশ মিনিট ফুট ড্রিল দেখেই বলে দেওয়া যায় কে সত্যিকার সৈনিক, কে নয়। তা ছাড়া ফুট ড্রিল সৈনিকদের হুকুম তামিল করতে শেখায়। এবং একসময় তাদের রক্তে মিশে যায়, যা করতে বলা হবে তা করতে হবে। এর অন্য কোন বিকল্প নেই।

অ্যাটেনশন। স্ট্যান্ড এট ইজ। রাইট টান। স্কোয়াড় মার্চ। লেফট লেফট। লেফট লেফট। হল্ট। লেফট টার্ন স্কোয়াড মার্চ। লেফট লেফট। লেফট লেফট। হল্ট।  আধা ঘন্টা ফুট ড্রিলের পর ছটি দলকে তাদের নিজেদের এনসিওর হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। এরা তার নিজের, নিজের দলকে দুপুর বারটা পর্যন্ত ফুট ড্রিল করাবে। জনাথন ঘুরেঘুরে দেখতে লাগল। কাজ ভালোই এগুচ্ছে। মাঝে-মাঝেই অবশ্যি জনাথনের উচ্চকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, এই যে, তোমার নাম কি?

পিটার স্যার।

শোন পিটার, তোমার বাম হাত যদি ডান পার সঙ্গে সমান ভাবে ওঠানামা নাকরে, তাহলে বাম হাতটি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। অবাধ্য হাতের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছ?

পারছি স্যার।

এই যে তুমি, সাদাগেঞ্জি, ঠিকমতো পা ফেল। তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার পা টেনে ছিঁড়ে ফেলি? নাকি চাও?

জনাথন আকাশের দিকে তাকাল। রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে। ঘড়িতে বাজছে মাত্র সাড়ে দশটা। রোদ আরো বাড়বে। সে এনসিওদের ডেকে আনল।

এখন আমরা যাব বনে। গাছপালার ভেতর কীভাবে নিঃশব্দে দ্রুত হাঁটা যায়, সেটা শেখাব। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং। রোজ খানিকক্ষণ এই ট্রেনিং হবে। এখন সবাই দৌড়াও আমার সঙ্গে। স্কোয়াড কুইক মার্চ।

হাঁপাতে-হাঁপাতে দৌড়াতে শুরু করল সবাই। আকাশে গগনে সূর্য। দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্ত মানুষগুলো যে-কোনো সময় একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়বে।

দৌড়াও, দৌড়াও। বড়-বড় স্টেপ ফেল। এতে পরিশ্রম হবে কম। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে থাক। বাই দা লেফট। বাই দা লেফট।

বিকেল চারটায় সবাই এসে দাঁড়াল তাঁবুর সামনে। এন্ড্রু জনাথনের হাতে একটি রাইফেল। তার সামনে একটি টেবিলে একটি সাব-মেশিনগান। এন্ড্রু জনাথন রাইফেল হাতে এগিয়ে এল কয়েক পা। দলের সবাই খানিকটা পিছিয়ে গেল।

যে-রাইফেল তোমাদের দেওয়া হয়েছে, তার নাম কালাসনিকভ অ্যাসন্ট উইপন। সংক্ষেপে AK-7.62. সবাই একে আদর করে ডাকে কলা রাইফেল। তার কারণ, এর ম্যাগজিনগুলি হচ্ছে কলার মতো বাঁকানো। তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে যেভাবে চেন, এই রাইফেলটিকে তার চেয়েও ভালোভাবে চিনবে। এর রেঞ্জ কম। কিন্তু দু শ গজ পর্যন্ত এটি অত্যন্ত নিখুঁত। এ দিয়ে একটি-একটি গুলি করা যায় আবার প্রয়োজনে প্রতি মিনিটে দু শ রাউন্ড করেও গুলি করা যায়। এটা হচ্ছে একটা ডিফেনসিভ উইপন।

এখন সবাই মন দিয়ে আমার এই উপদেশ শোন। যারা পুরোনো সৈন্য, তাদের এ উপদেশ জানা আছে, যারা নতুন, তাদের জানা নেই। তবে এ-উপদেশ সবার জন্যেই। এখন থেকে রাইফেলটি থাকবে তোমাদের সঙ্গে-সঙ্গে। বাথরুমে যাও, গোসলখানায় যাও বা ঘুমাতে যাও, রাইফেল থাকবে তোমার সঙ্গে, যতক্ষণ-না এটা তোমাদের একটি বাড়তি হাতের মতো হয়।

তোমরা নিজেদের শরীরের যেমন যত্ন নাও, রাইফেলটিকেও তেমনি যত্ন করবে। এখন তোমাদের দেখাচ্ছি এটা কী করে খুলতে হয় এবং ফিট করতে হয়।

 

রাতের খাওয়া সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। সাড়ে সাতটায় মেসের হলঘরে জনাথন দেখাল লাইট RPD মেশিনগান।

তোমরা সবাই অস্ত্রটি ভালো করে চিনে রাখ, এর নাম RPD লাইট মেশিনগান। এটিও তৈরি হয়েছে শক্তিশালী একটি দেশে। তবে সেখানে এখন আর এর ব্যবহার নেই। পৃথিবীতে যে-কটি হালকা মেশিনগান আছে এটি হচ্ছে তার মধ্যে একটি। ওজন মাত্ৰ ১৯৩ পাউন্ড। ব্যানানা রাইফেলে যেগুলি ব্যবহার করা হয়, এতেও সেই গুলিই। ব্যবহার হয়। প্রতি মিনিটে এর সাহায্যে দু শ পঞ্চাশ রাউন্ড করে গুলি ছোঁড়া যায়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় একটি অস্ত্র, এবং চমৎকার একটি জিনিস। আমাদের যে-পাঁচটি দল আছে, তাদের সঙ্গে দুটি করে থাকবে। অর্থাৎ সর্বমোট দশটি অস্ত্র থাকবে। তবে সবাইকে এই অস্ত্র চালানো শিখতে হবে।

রাত আটটায় মেসঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। শেষ হল প্রথম দিনের ট্রেনিং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *