জেন্টুদের দুর্গোৎসব
Doorga Pujah…is the grand general feast of the Gentoos, usauslly visited by all Europeans (by invitation) who are treated by the proprietor of the feast with the fruits and flowers in seasons, and are entertained every evening whilst the feast lasts, with bands of singers and dancers.
Holwell : Interesting Historical Events 1766
দুর্গাপূজা জেন্টুদের বা বাবুদের সবচেয়ে গ্র্যান্ড বা জমকালো উৎসব। সাধারণত সাহেবরাও এই উৎসবে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রিত হন এবং উৎসবের কর্তারা নানা রকমের ফলমূল দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করেন। উৎসবকালে প্রতি সন্ধ্যায় নাচ—গানের ব্যবস্থাও করা হয়।
আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে হলওয়েল সাহেব কলকাতার দুর্গোৎসব সম্বন্ধে এই কথা লিখে গেছেন। কোম্পানির আমলের কথা, হলওয়েল তখন ছিলেন কলকাতার জমিদার। প্রায় এই সময় দেখা যায়, মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর কোনো এক বন্ধুকে লিখছেন : ‘এবার পূজার সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটীতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন। তোমার আসা চাই,’ ইত্যাদি। হলওয়েল সাহেবের কথার সমর্থন মহারাজা নবকৃষ্ণের চিঠিতে পাওয়া যাচ্ছে। শোভাবাজারের রাজা মুনশি নবকৃষ্ণ তখন উত্তর কলকাতার তালুকদার। কলকাতার ব্রিটিশ জমিদার ও ব্রিটিশের তৈরি দেশি নয়া—তালুকদাররা অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে দুর্গোৎসবের রূপ বদলাচ্ছিলেন। বদলাবার প্রধান স্থান হল ব্রিটিশ আমলের নতুন রাজধানী কলকাতা শহর। অর্থাৎ দুর্গোৎসব শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ যুগের নয়া—কলকাতা কালচারের একটা প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠল। কলকাতা কালচারের সমস্ত বৈশিষ্ট্য এসে দুর্গোৎসবকে ‘grand general feast of the Gentoos’ করে তুলল। দুর্গোৎসবের এই ভেরিয়েশন বা প্রকারভেদ বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে নিশ্চয় একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
নব্যযুগের কালচারের এই বিশেষ তরঙ্গও কিন্তু ঐতিহাসিক পথ ধরেই মহানগরের দিকে এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘ভাষা’ গোয়াড়ি কৃষ্ণনগর, চুঁচড়ো চন্দননগর, উৎসবের তরঙ্গ এসে মিলিত হয়েছে কলকাতা শহরে। এই নবতরঙ্গের ভগীরথ হলেন কোম্পানির আমলের ইংরেজ বণিকরা এবং তাঁদের বাঙালি গোমস্তা আমলা উকিল মুনশিরা। আজ থেকে দু’শো বছর আগে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি থেকে এই নবতরঙ্গের যাত্রা শুরু বলা চলে। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই তরঙ্গেরই বিচিত্র ওঠানামা দেখেছি আমরা এবং আজও দেখছি সেই তরঙ্গেরই নতুন বাঁক ফেরার চেষ্টা। জাতীয় সংস্কৃতির একটা প্রায় লুপ্ত সুস্থ ধারাকে কলকাতার দুর্গোৎসবের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করবার চেষ্টা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম যুগের কলকাতা কালচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে যে দুর্গোৎসবের পত্তন হয়েছিল কলকাতা শহরে, লক্ষ করলে আজ তারই একটা স্বাভাবিক পরিণতি নজরে পড়ে। আসল যে দুর্গোৎসব, বাঙালির নিজস্ব যে ঐতিহাসিক দুর্গোৎসব, তার বনিয়াদ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে অনেকদিন। অর্থাৎ সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সেই আত্মনির্ভর গ্রাম্য সমাজ, সেই গোষ্ঠীজীবন, যৌথপরিবার, সেইসব ‘বেনাভলেন্ট ডেম্পট’ টাইপের বাংলার জমিদার আজ আর নেই। বাঙালির কৃষ্টিগঙ্গা যখন গৌড়, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতাভিমুখী হতে শুরু করেছে, তখন থেকে বাঙালির জাতীয় উৎসব ও লোকোৎসবের ভাঁটার সূচনা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের নতুন জমিদার, তালুকদার ও পত্তনিদাররা এবং হঠাৎ—গজিয়ে—ওঠা বিত্তবান ‘জেন্টুরা’ কলকাতা শহরে বা আশপাশে গ্রামাঞ্চলে নতুন যে জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা আসলে স্বাভাবিক জোয়ার নয়, অস্বাভাবিক একটা বন্যা, একটা তরঙ্গোচ্ছ্বাস—পাঁক ও আবর্জনাই ছিল তার মধ্যে বেশি। উচ্ছ্বাসের বুদবুদ মিলিয়ে যাবার পর সেই আবর্জনার তলানি জমতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ক্লাইভ হেস্টিংস হলওয়েল সাহেবের যুগে, শোভাবাজারের রাস্তা মুনশি নবকৃষ্ণ, আন্দুলের রাজা দেওয়ান রামচাঁদ রায়, ভূকৈলাসের রাজা দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ প্রভৃতির আমলেই দেখা যায় বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় উৎসব ‘গ্র্যান্ড ফিস্ট অফ দ্য জেন্টুস’—এ পরিণত হয়েছে।
১৭৯২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখের ‘ক্যালকাটা ক্রনিক্ল’ পত্রিকায় আসন্ন দুর্গোৎসবের বিবরণ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিখ্যাত গৃহের কথা উল্লেখ করা হয়। যাঁদের গৃহে মহাসমারোহে দুর্গোৎসব হবে, তাঁদের মধ্যে মহারাজা নবকৃষ্ণ, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচাঁদ মিত্র, নারায়ণ মিত্র, রামহরি ঠাকুর, বারাণসী ঘোষ ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের নাম করে বলা হয় যে, অন্যান্য বছরের মতন, এ বছরেও কলকাতার এইসব ধনীগৃহে সাহেবরা প্রমোদসভায় যোগ দেবেন। উৎসবে সাহেবদের এই মেলামেশা সম্পর্কে পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়—‘Call it diversion, and the pill goes down.’
দুর্গোৎসবের পর, ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখের পত্রিকায়, মহারাজা সুখময় রায়ের বাড়ির নাচসভার একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় যে, এ বছরের নূতনত্ব হল হিন্দুস্থানি গানের সঙ্গে ইংরেজি সুর মিশিয়ে পরিবেশন—‘The only novelty that rendered the entertainment different from those of last year was the introduction, or rather the attempt to introduce, some English tunes among the Hindoostance music…’
অনেকের ধারণা, নানা রকমের পাশ্চাত্য সুর মিশিয়ে নতুন সুর রচনা করা আধুনিক সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য। কথাটা বোধহয় সম্পূর্ণ সত্য নয়। ১৭৯২ সালে মহারাজা সুখময় রায়ের গৃহে, হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের সঙ্গে ইংরেজি সুর মিশিয়ে, আমন্ত্রিত সাহেব ও বাঙালিবাবুদের শোনানো হয়েছিল, দুর্গোৎসব উপলক্ষে। ইয়োরোপের অনুকরণে যে ‘আধুনিকতা’ তার জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং কলকাতা শহরের ধনিক বাঙালিদের দুর্গোৎসবে পর্যন্ত তা বিকটভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল।
শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস ১৮২৩ সালে কলকাতার এক ধনিক বাঙালির গৃহে দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। উৎসবের যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা বিশেষ উপভোগ্য। একদিকের সারি সারি ঘরে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। গান্টার অ্যান্ড হুপার কোম্পানি খাদ্য—সরবরাহের ভার নিয়েছিল। সাহেব অতিথিদের জন্য বরফ ও ফরাসি মদ্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর—একদিকের ঘরে বাইজিদের নাচ—গান চলছিল পূর্ণোদ্যমে। সাহেব ও বাঙালিবাবুরা আরামকেদারায় বসে, মৌজ করে, হিন্দুস্থানি বাইজিদের গান শুনছিলেন।
বাঙালির দুর্গোৎসব প্রাচীনতম উৎসব না হলেও, শ্রেষ্ঠ জাতীয় উৎসব। যত দূর জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল আমলেই বাংলাদেশে শারদীয় ও বাসন্তী দুর্গোৎসবের প্রচলন হয়। কেউ কেউ বলেন, রমেশ শাস্ত্রী মহাশয়ের পরামর্শে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন করেন। পরে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাদুড়িয়ার (রাজশাহি) রাজা জগৎনারায়ণ প্রায় দু’লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে অন্যান্য হিন্দু রাজা—ভুঁইয়ারা নিয়মিতভাবে এই দুই পূজা আরম্ভ করেন। তখনকার গ্রাম্য সমাজের বৈশিষ্ট্যের গুণে এই দুর্গোৎসব স্বভাবতই একটা সামাজিক লোকোৎসবে পরিণত হয়। সমাজের গোড়ায় যে পরিবার, সেই বাঙালি পরিবার তখন শাখাপ্রশাখাসহ মহীরুহের মতন বিশাল যৌথ পরিবার। যত মাসি—পিসি—খুড়ি—জেঠি যেখানে যে আছেন এবং তাঁদের পুত্রকন্যারা, সকলে একত্রে না বাস করলেও পুজোর সময় এসে ঠিক জড়ো হতেন। এইভাবে প্রথমে গৃহে হত পারিবারিক সমাবেশ। তারপর গ্রামের যে যেখানে আছে সকল শ্রেণির ও সকল জাতের লোকের মধ্যে একটা কাজের সাড়া পড়ে যেত। পুজো যার বাড়িতে হোক—না কেন (সাধারণত অবশ্য জমিদার বা গ্রামের বড়লোকদের বাড়িতেই হত), তাতে যোগ দেবার জন্য ডাক পড়ত সকলের। তা সে চণ্ডালই হোক, আর ব্রাহ্মণই হোক। পরিবারের পিসিমা—মাসিমা থেকে গ্রাম্য সমাজের চণ্ডাল, ডোম, বাগদি, ব্রাহ্মণ সকলের একটা বিশেষ কাজ, এটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকত। সেকালের মেলার মতন দুর্গোৎসবের মধ্যেও আর্থিক লেনদেন ও সহযোগিতার একটা সুযোগ ঘটত। সমস্ত পরিবারের আত্মীয়স্বজন, সমস্ত পরিবারের লোকজন ঠিক একটা ইউনিটের মতন কাজ করত। বাস্তব জীবনের সমস্ত বিরোধের মধ্যেও মনের দিক থেকে রাখিবন্ধনের কাজ করত এই উৎসব। অচল অটল কূপমণ্ডূক গ্রাম্য সমাজে প্রাণসঞ্চার করত মধ্যে মধ্যে এইসব উৎসবপালপার্বণ। কিন্তু এই গ্রাম্য সমাজে ভাঙন ধরল ক্রমে এবং যার স্রোত নেই, প্রবাহ নেই, গতি নেই, তার পচন ধরাও স্বাভাবিক। ধরলও তা—ই। বর্ণভেদ ও জাতিভেদের উৎকট চাপে, বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের উগ্র যথেচ্ছারিতায় এবং সবার উপরে আর্থিক ক্রমাবনতির ফলে, সেকালের গ্রাম্য সমাজের মধ্যে যেটুকু গতিশীলতা ছিল তা—ও নষ্ট হয়ে গেল। গ্রাম হয়ে উঠল জীবনের কারাগার এবং অর্থ, বর্ণ ও শ্রেণির গারদ ভেদ করে আলোর পথ, মুক্তির পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। মোগল আমলেও একশ্রেণির নতুন জমিদার আমাদের দেশে তৈরি হয়েছিলেন, মানসিংহ ও তাঁর পরবর্তী শাসকদের কৃপায়, যাঁরা ক্রমে চরম ভোগবিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে নদিয়ার রাজা অন্যতম। এই সময়ে ইংরেজদের আবির্ভাব এবং সেই সঙ্গে একটা নতুন বাণিজ্যিক যুগের সূচনা। ইংরেজরা এসে প্রথমে নিজেরাই জমিদার হলেন, তারপর নতুন একশ্রেণির জমিদার—তালুকদার সৃষ্টি করলেন এবং নিজেদের লুণ্ঠনের বকযন্ত্র চালু রাখার জন্য দালাল, গোমস্তা, মুচ্ছুদি, দেওয়ান নিয়ে একশ্রেণির এ দেশি ‘জেন্টু’ গড়ে তুললেন। জমিদার ও জেন্টু উভয় শ্রেণির হাতে যথেষ্ট পয়সা জমল অবশ্য, কিন্তু পয়সার কোনো সদগতি হল না। অর্থাৎ স্বাধীন দেশের মতন মজুত পয়সা শিল্প—বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবাধে নিয়োগ করা সম্ভব হল না। সুতরাং হক্কের ধন ফক্কে উড়তে লাগল—বাঁদরের বিয়েতে ও বাপের শ্রাদ্ধে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাইনাচে, টপ্পা খেউড়ে, বুলবুলির আর মেড়ার লড়াইয়ে, ইংরেজ প্রভুদের উপঢৌকন দিয়ে, উৎসব—পার্বণে বিদেশি প্রভুসেবা ও দেশি দরিদ্রনারায়ণের সেবা করে। এই সময় শুধু দুর্গোৎসবেই কলকাতার ধনী বাঙালিরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন, তাতে আজকাল তিনটে পঞ্চবার্ষিক শিল্প—পরিকল্পনার ব্যয়সঙ্কুলান করা যায়।
তা—ও যদি উৎসবের একটা সুস্থ ধারা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে টাকাটা ব্যয় করা হত, তাহলেও না—হয় সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তা হয়নি। দুর্গোৎসবের সময় শহরের ধনী হিন্দুদের বাড়ি বাইনাচের আসর বসত। রাজা সুখময় রায়ের বাড়ি ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান। ১৭৯২ সালে তাঁর বাড়িতে যে নাচ—গানের আসর হয় উৎসবের সময়, তাতে হিন্দুস্থানি গান বিলেতি ঢঙে গেয়ে এক অভিনবত্ব দেখানো হয়। মহারাজা নবকৃষ্ণের বাড়ির দুর্গোৎসব সম্বন্ধে কেরি সাহেব বলছেন—‘The majority of company crowded to Raja Nabkessen’s where several mimics attempted to imitate manners of different nations.’ অর্থাৎ নানা জাতের বিচিত্র ভাবভঙ্গি অনুকরণ করে রঙ্গরসিকতা করা হত, প্রধানত বিদেশি জমিদার ও দেশি জেন্টুদের খুশি করবার জন্য। এইভাবে বাঙালির যে দুর্গোৎসব ছিল সর্বপ্রধান ‘ন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল’, তাকে ইংরেজ আমলের দেশি—বিদেশি জেন্টু ও জমিদাররা ‘গ্র্যান্ড ফিস্ট’—এ পরিণত করেন। উৎসবটা জাতীয় জীবনের বিচিত্র প্রকাশ না হয়ে, ধনদৌলতের বিকৃত ফ্যাশন হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে অবশ্য ইংরেজের কমার্স, রেলপথ, জমিদারি প্রথা, বাংলার গ্রাম্য সমাজকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। নতুন আর্থিক ও মানসিক পরিবেশের মধ্যে যৌথ পরিবারেও দ্রুত ভাঙন ধরেছে। গ্রাম থেকে শহরের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছে আমাদের কালচারের ভারকেন্দ্র। সুতরাং দুর্গোসবের ঐতিহাসিক বনিয়াদ আর নতুন যুগের ধাক্কায় টিকছে না দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে শহরের ‘জেন্টুরা’ তাকে যে নতুন রূপ দেবার চেষ্টা করলেন তা অত্যন্ত কৃত্রিম ও প্রাণহীন। আমাদের জাতীয়তাবোধের উদ্বোধনও হল অবশ্য এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে, মনে হল যেন উৎসবের নবরূপান্তর শুরু হল। কিন্তু ঐতিহাসিক নিয়মেই তা হল না। আজও অবশ্য দুর্গোৎসবকে সত্যকার জাতীয় উৎসবে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে, বিশেষ করে যাঁদের সুস্থ রুচিবোধ, শিক্ষাদীক্ষা আছে, তাঁরা তো করছেনই। নানা রকমের মেলা ও প্রদর্শনীরমধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এ দেশি জেন্টুদের প্রবর্তিত ধারাও আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পূজামণ্ডপে ‘লারে লাপ্পা, লারে লাপ্পা’ গান শুনলে, মার্কিনি ঢঙে কোনো হিন্দুস্থানি অভিনেত্রীর রেকর্ডের ঘন ঘন আবর্তন কানে এলে মনে হয় যেন সুখময় রায়ের সেই বিলেতি ঢঙের হিন্দুস্থানি গান শুনছি। মনে হয়, ‘কলকাতা কালচার’—এর পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে বাঙালির দুর্গোৎসবেরও—একেবারে ‘যা দেবী সর্ব্বভূতেষু’ থেকে ‘লারে লাপ্পা’ পর্যন্ত, নিধুবাবুর টপ্পা থেকে ফুলকুমারীর হলিউডি গজল পর্যন্ত।