১৩. চিলড্রেন্স রাইমস পার্ট টু বইটা পাওয়া গেছে

চিলড্রেন্স রাইমস পার্ট টু বইটা পাওয়া গেছে। ফরহাদ বই নিয়ে ছাত্রীর বাসায় গিয়েছে।

ছাত্রীর মা বই হাতে নিয়ে বললেন, থ্যাংকস। বই পাচ্ছিলাম না, পাচ্ছিলাম না এখন দু কপি হয়ে গেছে। আমি আমার এক বান্ধবীকেও এই বইটা জোগাড় করতে বলেছিলাম। সেও এনেছে। অসুবিধা নেই। ফরহাদ সাহেব আপনি যাবার সময় বই এর দাম নিয়ে যাবেন।

ফরহাদ বলল, দাম দিতে হবে না। আমি বই ফেরত দিয়ে দেব।

ফেরত নেবে?

অবশ্যই ফেরত নেবে।

আপনার ছাত্রী বলেছে সে আজ পড়বে না। তার না-কি মাথা ধরেছে। সব বানানো কথা। আপনি চেষ্টা করে দেখুন। যদি পড়তে না চায় আজ ছুটি দিয়ে দেবেন।

জ্বি আচ্ছা।

ফরহাদের ছাত্রীর বয়স ছয়। মেয়েটা এতই সুন্দর যে দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। সুন্দরী মেয়েরা গম্ভীর প্রকৃতির হয়। এও সে রকম। যখন তখন ভুরু কুঁচকে বড়দের মত তাকায়। মেয়েটির নাম লীলাবতী। অতি আধুনিক যুগের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া মেয়ের জন্যে নামটা খুবই পুরানো। নিশ্চয়ই এই নাম। রাখার পেছনে কোন গল্প আছে। গল্পটা একদিন জেনে নিতে হবে। ফরহাদ বলল, তোমার মাথা ধরা কি খুব বেশি?

লীলাবতী চুল ঝাঁকিয়ে বলল, বেশি না অল্প।

আজ পড়তে ইচ্ছা করছে না?

না।

তাহলে থাক পড়তে হবে না। আমারো পড়াতে ইচ্ছা করছে না।

আজ আমাদের দুজনেরই ছুটি তাই না স্যার?

হ্যাঁ দুজনেরই ছুটি।

স্যার আপনারও কি শরীর খারাপ?

শরীর খারাপ না। মন খারাপ।

কেন?

আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ ছিল। তার প্রচণ্ড শরীর খারাপ। সে চিকিৎসার জন্যে আজ দেশের বাইরে চলে গেছে। এই জন্যেই মনটা খারাপ। যাবার সময় তার সঙ্গে আমার দেখাও হয় নি। তোমার খুব প্রিয়জন কেউ যদি বাইরে চয়ে যায় তোমার মন খারাপ হবে না?

হবে।

লীলাবতী আজ উঠি?

লীলাবতী ঘাড় কাত করে সায় দিল। কিন্তু ফরহাদের উঠে যেতে ইচ্ছা করছে। বাচ্চা এই মেয়েটার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। তাকে বলা যেতে পারে—লীলাবতী আমি যে সার্টটা পরে আছি এটা সুন্দর না। কি সুন্দর লাল রঙ আজ রোববারতো কাজেই আজকের জন্যে এই সার্ট। অসুস্থ যে মানুষটার কথা আমি বললাম, সে সপ্তাহের সাতদিনের জন্যে সাতটা সার্ট কিনে দিয়েছে। তার নাম হল আসমানী। দেখিতো তোমার কেমন বুদ্ধি। আসমানীর ইংরেজি কি বল।…

ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। এখন কোথায় যাবে সে বুঝতে পারছে না। আসমানী বিহীন শহরটা কেমন দেখার জন্যে সারাদিন ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়ানো যেতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে কোন আইসক্রীমওয়ালার সঙ্গে দেখা হলে আইসক্রীম কিনতে হবে। আগে সে যখন আসমানীর সঙ্গে হাঁটতো, আসমানী আইসক্রীম খেতো। সে খেতো না। আসমানী খুব রাগ করতোলীলাবতী মেয়েটার মত ভুরু কুঁচকে বলত—তুমি এমন কেন বলত? কি হয় আমার সঙ্গে একটা আইসক্রীম খেলে। দুজন বয়স্ক মানুষ বাচ্চাদের মত আইসক্রীম খেতে খেতে যাচ্ছে মজার দৃশ্য না? না, আজ আইসক্রীম খেতে হবে।

শুধু আইসক্রীম খেলে হবে না আজ নাপিতের দোকানে গিয়ে চুলও কাটতে হবে।

আসমানীর খুব শখের দৃশ্য না-কি ছেলেদের চুল কাটার দৃশ্য। সে বলত—আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমাদের বাসার সঙ্গেই ছিল একটা নাপিতের দোকান। নাপিত কচ কচ করে চুল কাটতো দেখতে আমার এত মজা লাগত। এখনো মজা লাগে। আমরা মেয়েরা মাথার লম্বা চুল কাটতে পারি না বলে ছেলেদের লম্বা চুল কাটা হচ্ছে দেখে মজা পাই। আমি কি ঠিক করেছি জান? চুল কাটা শিখে নেব। তোমার চুল যতবার লম্বা হবে ততবার কেটে দেব। চুল কাটা শেষ হবার পর নাপিতদের মত মাথা বানিয়ে দেব।

ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে সে সারাজীবন খুব পরিশ্রম করেছে। নিঃশ্বাস ফেলার মত সময়ও তার ছিল না। আজ ছুটি পাওয়া গেছে। প্রচণ্ড কর্ম ব্যস্ত এ শহরে আজ তার কাজ নেই। আজ সারাদিন রাস্তায় হাঁটা। পার্কে বসে থাকা। নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল কাটানো, মাথা মালিশ করানো। পুরানো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করা যেতে পারে। অফিসে চলে যাওয়া যায়। ক্যাশিয়ার সিদ্দিক সাহেবের সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে। বিদেশে তার মেয়েটা কেমন পড়াশোনা করছে সে সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে। দেশের পলিটিকস নিয়েও কথা বলা যায়। কথা বলার বিষয় বস্তুর কোন অভাব নেই।

গভীর রাতে ফার্মগেট পেট্রোল পাম্পের কাছে গেলে কেমন হয়। ঐ মেয়েটিকে হয়ত সেখানে পাওয়া যাবে। নিশিকন্যারাও এক অর্থে ভিক্ষুকদের মত। ভিক্ষুকরা যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় ভিক্ষা করে, এরাও তাই করে, নিদৃষ্ট জায়গায় সেজেগুজে št তাকে বললেই হবে অনেক দিন আগে তোমাকে দেখে হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কার মত খেয়েছিলাম। কারণ তোমার চেহারা দেখতে আমার অতি প্রিয় একজনের মত। তখন আমার হাতে এক হাড়ি বগুড়ার দৈ ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল দৈ এর হাড়িটা তোমাকে দিতে। কেন জানি দেয়া হয় নি। আজ নিয়ে এসেছি। আমি খুবই খুশি হব যদি তুমি দৈটা নাও। তুমি ভাল থেকো কেমন? আমার অতি প্রিয়জনের নামটা জানতে চাও? ওর নাম আসমানী। ওর কোন ছবি আমার কাছে নেই। ছবি থাকলে দেখতে ওর সঙ্গে তোমার চেহারার কি অদ্ভুত মিল।

জাহানারাদের বাড়িতে একবার যাওয়া যায়। বাবার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। ঐ বাড়িতে সে অনেকবার গিয়েছে। তাকে পাওয়া যায় নি। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। কোন রকম কাজ কর্ম নেই মানুষ সবচে ব্যস্ত থাকে। কাজের মানুষদের বাড়ি ঘরে পাওয়া যায়। অকাজের মানুষদের কখনোই পাওয়া যায় না।

 

জাহানারাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় জোবেদ আলি কি গাছের যেন চারা পুঁতছেন। ছেলেকে দেখে বিস্মিত গলায় বললেন, আরে তুই।

ফরহাদ বলল, কেমন আছ বাবা? আমি প্রায়ই আসি। তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। যাক আজকে দেখা হয়ে গেল। কি করছ?

জমি ঠিক করছি। এ জায়গার মাটি ভাল। গাছ ঠাই ঠাই করে বড় হবে। তোর কি শরীর খারাপ না-কি। তোকে কেমন অদ্ভুত লাগছে।

চুল কাটিয়েছি মনে হয় এই জন্যে।

শরীরের যত্ন নিবি বুঝলি। একসারসাইজ করবি। আমার নিজের শরীরটা যে ভাল আছে তার প্রধান কারণ এই বুড়ো বয়সেও কোদাল দিয়ে মাটি কোপাই। শরীর ঠিক রাখার জন্যে সবারই একসারসাইজ দরকার শুধু গাছের বেলায় ভিন্ন ব্যবস্থা। গাছের একসারসাইজ লাগে না।

ফরহাদ হাসল। জোবেদ আলি বললেন, তোর কাছে টাকা থাকলে আমাকে শ দুই টাকা দিয়ে যা। দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা নিয়েছিলাম এই নিয়ে হুলুস্থুল ব্যাপার হয়ে গেছে। এত লোক থাকতে দারোয়ানের কাছ থেকে কেন টাকা ধার করলাম। বড়লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করলে সমস্যা নেই। দারোয়ান টাইপ মানুষদের কাছ থেকে টাকা ধার করলেই সমস্যা। আছে তোর কাছে টাকা?

ফরহাদ দুশ টাকা বের করে দিল। জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, যদি থাকে আরো একশটা টাকা দিয়ে যা। ছেলের কাছ থেকে ভিক্ষুকের মত টাকা নিতে হচ্ছে। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমার এই অপমানটা হচ্ছে। মানুষ না হয়ে গাছ হয়ে জন্মালে আমার এই অপমানটা হত না। তুই কখনো শুনেছিস একটা বটগাছ, চারা বট গাছের কাছে কোন জিনিস ধার চাইছে।

গাছ ছাড়া তুমি আর কিছু ভাব না বাবা?

গাছ নিয়ে ভাবা কি অন্যায়?

ফরহাদ বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, কোন অন্যায় না। তুমি যেহেতু মানুষ, গাছ না। সেহেতু মাঝে মধ্যে আশেপাশের মানুষদের কথাও ভাববে।

ভাবি না তোকে কে বলল। ভাবিতো। খুবই ভাবি।

না বাবা তুমি ভাব না। একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। দাদাজান মারা যাওয়ায় বিয়েটা হয় নি। তারপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তুমি কখনো তার কথা জানতে চাও নি। মেয়েটাকে একবার দেখতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করোনি।

জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, চল যাই দেখা করে আসি। আজই যাই। হাত ধুয়ে লুঙ্গি বদলে পাজামা পরে আসি। পাঁচ মিনিটের মামলা। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। হরলিক্স, ডাব, কলা, এইসব নিয়ে যেতে হবে। তোর কাছে টাকা আছে না?

ও দেশে নেই বাবা। চিকিত্সার জন্যে বাইরে গেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল হয়ে আসুক, তারপর ইনশাল্লাহ দেখতে যাব। তোর কাছে সিগারেট থাকলে দেতো খাই।

ফরহাদ সিগারেট দিল। জোবেদ আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ঐ মেয়েটার কথা যে কিছু জিজ্ঞেস করি না, তোর মায়ের ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। তোর মার ধারণা আমাদের সংসারে এত সব ঝামেলা যে হচ্ছে সব ঐ মেয়েটার জন্যে হচ্ছে।

তার মানে?

ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হল। তোর চাকরি চলে গেল। বিয়ের দিন তোর দাদাজান মারা গেলেন। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। এখন পরের বাড়িতে অনুদাস হয়ে আছি।

তুমি কি মার কথা বিশ্বাস কর?

তুই পাগল হয়েছিস? তোর মা যখন সত্যি কথা বলে তখনো আমি বিশ্বাস করি না। ঐ দিন মঞ্জু টাকার জন্যে এসেছিল—কি কান্নাকাটি। তোর মা তাকে একটা পয়সা দেয় নি। শেষে সে এসেছে আমার কাছে। আমি জন্মদাতা পিতা। বিপদে পড়লে আমার কাছেতো আসবেই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা আমাকে টাকা জোগাড় করে দাও।

ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, ওর টাকা দরকার কেন?

জানি না কেন। আজকাল আমি কিছু জানতে চাই না। জানতে চেয়েতো কোন লাভ নেই। কিছু করতে পারব না। শুধু শুধু জেনে কি হবে। চা খাবি রে ব্যাটা?

চা? বাড়িতে চা খেয়ে লাভ নেই, বাসার সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে চল। সেখানে বাপ বেটায় চা খাই। ওরা চা-টা ভাল বানায়।

চল যাই।

জোবেদ আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে আমি ভালই আছি। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কাজে কর্মে ব্যস্ত আছি। তবে মাঝে মধ্যে পুরানো দিনের কথা মনে হয়। তখন মনটা খুব খারাপ হয়।

পুরানো কোন কথা?

তুই যখন চাকরি করতি। ঢাকার বাইরে থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরতি। বাপ ব্যাটা এক সঙ্গে ভাত খেতাম। মনে নেই ঔ যে কাতল মাছের বিরাট এক মাথা তুই আমার পাতে তুলে দিলি। তবে এইসব ভেবে মন খারাপ করি না। মন খারাপ করলেতো কোন লাভ নেই। শুধু শুধু মন খারাপ করব কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *