১৩. গ্রিফিন্ডর বনাম র‍্যাভেনক্ল

১৩. গ্রিফিন্ডর বনাম র‍্যাভেনক্ল

মনে হচ্ছে রন এবং হারমিওনের বন্ধুত্বের ইতিই হয়ে গেছে। দুজনেই একে অন্যের উপর এত ক্রুদ্ধ হয়ে আছে যে হ্যারি ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না কিভাবে আবার ওদের মধ্যে মিটমাট হবে।

রন ক্ষেপে আছে কারণ, সে মনে করে কশ্যাংকস যে স্ক্যাবাকে খাবার চেষ্টা করেছে সেটা হারমিওন কখনই গুরুত্ব দেয়নি। কখনই চেষ্টা করেনি ক্রুকশ্যাংকস-এর উপর নজর রাখতে। বরং ছেলেদের হোস্টেলের বিছানার নিচে স্ক্যাবার্সকে খুঁজে দেখতে বলে সে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ক্রুকশ্যাংকস আসলেই নির্দোষ। অন্যদিকে হারমিওন ভীষণভাবে বিশ্বাস করে যে কশ্যাংকসই যে স্ক্যাবার্সকে খেয়েছে রনের কাছে এমন কোন প্রমাণ নেই। এবং লালচে হলুদ রঙের লোমগুলো হয়তো ওখানে ক্রিসমাসের সময় থেকে পড়েছিল। আসলে ম্যাজিক্যাল মেনাগেরিতে রনের মাথায় কুকশ্যাংকস লাফ দেয়ার সময় থেকেই সে বিড়ালটার বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছে।

ব্যক্তিগতভাবে, হ্যারি বিশ্বাস করে যে কশ্যাংকসই স্ক্যাবার্সকে খেয়েছে, কিন্তু যখন সে হারমিওনকে বোঝাতে চেষ্টা করল সবগুলো প্রমাণই ওই কথা বলছে, তখন সে হ্যারির ওপরও ক্ষেপে গেল।

ঠিক আছে, রনের পক্ষেই থাকো, আমি জানি তুমি ওর পক্ষেই থাকবে! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল সে। প্রথমে ফায়ারবোল্ট, এখন স্ক্যাবার্স, সবকিছুই আমার দোষ, তাই না! আমাকে একা ছেড়ে দাও, আমার অনেক কাজ আছে!

ইঁদুরের মৃত্যুটা রনের খুব লেগেছে।

ওহ্ রন, তুমি সব সময় বলতে স্ক্যাবার্স কত বিরক্তিকর, চাঙ্গাস্বরে বলল ফ্রেড। এবং ওর বয়সও হয়ে গিয়েছিল, এমনিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল ইঁদুরটা। হয়তো এটাই ভালো হয়েছে দ্রুত ওর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। এক গ্রাসে–ও হয়তো এটা বুঝতেও পারেনি।

ফ্রেড! ক্রুদ্ধ স্বরে বলল জিনি।

রন, তুমি নিজেই কতবার বলেছো ইঁদুরটা শুধু খেত আর ঘুমাত, বলল জর্জ।

একবার তো আমাদের হয়ে ও গয়লকে কামড়ে দিয়েছিল! বলল মনমরা রন। তোমার মনে আছে হ্যারি?

হ্যাঁ, সত্যি, বলল হ্যারি।

ওটাই ছিল ওর সবচেয়ে ভালো সময়, সোজাসাপ্টা বলল ফ্রেড। গয়ল-এর আঙুলের দাগটা ওর স্মৃতির প্রতি আমাদের অশেষ সম্মান হয়ে থাকুক। মন খারাপ করো না, রন, যাও হগসমিডে অরেকটা নতুন ইঁদুর কিনে নিয়ে এসো। শোক করে কী লাভ?

রনকে চাঙ্গা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে হ্যারি ওকে গ্রিফিন্ডর টিমে প্র্যাকটিসে নিয়ে গেল, যেন ও ফায়ারবোল্টে চড়তে পারে, ওদের প্র্যাকটিসের পর। মনে হয় এর ফলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্ক্যাবার্স-এর দিক থেকে হ্যারির মন সরে গেল (চমৎকার! আমি এটা দিয়ে গোলে কয়েকটা শট মারতে পারি?), এক সঙ্গে ওরা কুইডিচ পিচের দিকে রওনা হল।

মাডাম হুচ, তখনও হ্যারির উপর নজর রাখার জন্য গ্রিফিন্ডর টিমের প্র্যাকটিসের সময় পিচে থাকছেন। ফায়ারবোল্টটা দেখে অন্যদের মতো তিনি নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্র্যাকটিস শুরু হওয়ার আগে ওটা হাতে নিয়ে নিজের পেশাদারী মন্তব্য করলেন।

এটার ভারসাম্যটা দেখ! নিম্বাস সিরিজের একটা দোষ আছে লেজের দিকে একটু বাঁকা হয়ে থাকে–কয়েক বছর পর প্রায়ই দেখা যায় ওগুলো গতি হারিয়ে ফেলেছে। হাতলটাকে উন্নত করা হয়েছে, ক্লিনসুইপ থেকে পাতলা, আমাকে পুরনো দিনের সিলভার অ্যারোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে–ওরা এখন আর ওটা বানায় না। আমি নিজে ওরকম একটা চড়ে উড়তে শিখেছিলাম এবং ওটা ছিল খুবই চমৎকার একটা ব্রুম…।

একই সুরে আরও কিছুক্ষণ চালিয়ে গেলেন মাদাম হুচ, অবশেষে উডকে বলতে হলো, ইয়ে মানে–মাদাম হুচ? হ্যারি যদি ফায়ারবোল্টটা ফিরে পায় তাহলে কী কোন অসুবিধা হবে? আমরা শুধু প্র্যাকটিস করবো…।

ওহ্–ঠিক আছে-এই যে নাও, পটার, বললেন মাদাম হুচ। আমি এখানে উইজলির সঙ্গে বসে থাকব।

তিনি এবং রন পিচ ছেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে বসলেন। গ্রিফিন্ডর টিম আগামীকালের খেলার আগে চূড়ান্ত নির্দেশের জন্যে উডের চারপাশে জড়ো হলো।

হ্যারি, এইমাত্র জানতে পারলাম র‍্যাভেনক্লদের সিকার হচ্ছে চো চ্যাং, চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী এবং বেশ ভালো… আমি শুধু আশা করতে পারি যেন সে খেলার জন্য ফিট না থাকে, কতগুলো আঘাত নিয়ে তার কিছু সমস্যা হয়েছে… কিন্তু চো চ্যাং সম্পূর্ণ সুস্থ, খুবই অসন্তুষ্ট হলো উড, তারপর বলল, অন্যদিকে সে চড়ে কমেট ২৬০, ফায়ারবোল্টের পাশে ওটাকে একটা তামাশা বলে মনে হয়। হ্যারির ব্রুমটার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, ঠিক আছে, সবাই চল যাওয়া যাক।

এবং অবশেষে, ফায়ারবোল্টে চড়ল হ্যারি, এক লাফে পা থেকে শূন্যে উঠে গেল।

ও স্বপ্নে যা ভেবেছিল তার চেয়েও ভালো। সামান্য স্পর্শেই ফায়ারবোল্ট ঘুরতে পারে; মনে হয় ওর হাতের ঠার চেয়ে চিন্তার নির্দেশই যেন পালন করছে। পিচের উপর দিয়ে এত দ্রুত গতিতে উঠতে পারে যে স্টেডিয়ামটাকে সবুজ আর ধূসর অস্পষ্ট বলে মনে হয়; এত দ্রুত ওটাকে ঘোরালো যে অ্যালিসিয়া স্পিনেট ভয়ে চিৎকার করে উঠল, তারপর একটা নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত ডাইভ দিল, ঘাসে ভরা পিচটাকে আঙুলের ডগা দিয়ে ছুঁয়ে আবার উপরে উঠল ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ফিট উপরে আকাশে

হ্যারি আমি এখন স্নিচটা ছাড়ছি! ডেকে বলল উড।

হ্যারি ঘুরল একটা ব্লজারকে ধাওয়া করে নিয়ে গেল গোলপেস্টের দিকে খুব সহজেই ওটাকে অতিক্রম করে গেল, দেখল উডের পেছন থেকে স্নিচটা উড়ে আসছে এবং দশ সেকেন্ডের ভেতরে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলল ওটাকে।

ওর পুরো দলটা পাগলের মতো উল্লসিত হলো। স্নিচটাকে আবার হাত থেকে ছেড়ে দিল হ্যারি মিনিট খানেক যেতে দিল, তারপর এর ওর ফাঁক দিয়ে ওটার পেছনে ধাওয়া করে দেখল ওটা ক্যাটি বেল-এর হাঁটুর কাছে ঝুলছে এক গোত্তা মেরে ওকে পাশ কাটিয়ে আবার ধরে ফেলল মিচটাকে।

ওদের টিমের এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো প্র্যাকটিস। ফায়ারবোল্টটাকে পেয়ে উৎসাহিত, ওদের সেরা মুভগুলো নিখুঁতভাবে দিতে পারল এবং সবশেষে মাটিতে নামার পরে এবারই প্রথম জর্জ উইজলির মতে, উড কোন সমালোচনা করতে পারল না।

আমি তো দেখতে পাই না আগামীকাল আমাদেরকে কে রুখবে! বলল উড। অবশ্য যদি না–হ্যারি, তুমি তোমার ডিমেন্টার সমস্যার সমাধান করেছো? তাই না?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি, মনে মনে অবশ্য ভাবছে ওর দুর্বল পেট্রোনাসের কথা, যদি ওটা আরও শক্তিশালী হতো।

আর ডিমেন্টার আসছে না, অলিভার, ডাম্বলডোর ওঁর কাজ করে রেখেছেন, বলল ফ্রেড, বেশ জোরের সঙ্গে।

বেশ, আশাকরি আর আসছে না, বলল উড। যাইহোক–আজ খুব ভালো হয়েছে, সবারই। চল ফিরে যাওয়া যাক–কাল সবাইকে সময়মতো আসতে হবে…।

আমি একটুক্ষণের জন্য থেকে যাচ্ছি, রন একবার ফায়ারবোল্টটায় চড়তে চাচ্ছে, উডকে বলল হ্যারি। টিমের বাকি সবাই কাপড় বদলাতে গেল। হ্যারি হেঁটে গেল রনের কাছে, মাদাম হুচ ইতোমধ্যে তার আসনে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

এই যে নাও, বলল হ্যারি, রনের হাতে ফায়ারবোল্টটা তুলে দিয়ে।

রন, মুখে ওর পরম আনন্দের অভিব্যক্তি, ব্রুমটায় চড়ল শূন্যে জমা হওয়া অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল, হ্যারি পিচের ধারে হাঁটছে, ওকে দেখছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠলেন মাদাম হুচ, রাত নামছে দেখে হ্যারি এবং রনকে বললেন এখন তাদেরকে ফিরে যেতে হবে।

ফায়ারবোল্টটা কাঁধে নিয়ে ছায়াঘন স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এল সে আর রন, ওটার অসাধারণ স্বচ্ছন্দ অ্যাকশন, অতুলনীয় গতি এবং বাক খাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে করতে। ওরা প্রাসাদের মাঝামাঝি দূরত্বে আসার পর বাঁদিকে তাকিয়ে হঠাৎ এমন কিছু দেখল হ্যারি যে ওর হৃৎপিণ্ডটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হলো-একজোড়া চোখ অন্ধকারের মধ্যে চকচক করছে।

পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেল সে, বুকের পাঁজরায় জোরে জোরে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।

কী হলো? রন জিজ্ঞাসা করল।

আঙুল তুলে দেখালো হ্যারি। জাদুর কাঠিটা বের করে রন বলল, লুমস!

ঘাসের ওপর আলোর একটা রশ্মি পড়ল, গাছের গোড়ায় গিয়ে শাখাগুলোকে আলোকিত করল; ওখানে নতুন গজিয়ে ওঠা পাতার মাঝখানে বসে রয়েছে ক্রুকশ্যাংকস।

ওহ্ ওখান থেকে ভাগ! রন গর্জন করে উঠল, নিচু হয়ে ঘাসের উপর থেকে একটা পাথর তুলে নিল কিন্তু ও কিছু করার আগেই বেড়ালটা লালচে হলুদ রঙের লেজ নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেখেছো? ক্ষিপ্ত স্বরে বলল রন। পাথরটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। এর পরও সে বিড়ালটাকে যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়াতে দিচ্ছে–স্ক্যাবার্সের পরে এখন হয়তো কয়েকটা পাখি খেয়ে ফেলেছে ওটা…।

হ্যারি কিছু বলল না। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে; কয়েক মুহূর্তের জন্যে ও নিশ্চিত ছিল যে ওই চোখ দুটো গ্রিম-এর। আবার প্রাসাদের দিকে রওনা হলো ওরা। মুহূর্তের আতঙ্কের জন্য মনে মনে লজ্জিত হলো হ্যারি, অবশ্য রনকে কিছু বলল না-এবং প্রাসাদে না পৌঁছানো পর্যন্ত ডানে বায়ে তাকালো না।

***

পরদিন অন্যান্য সকলের সঙ্গে নাস্তা খেতে গেল সে। সবাই ভাবছে ফায়ারবোল্টকে গার্ড অফ অনার দেয়া উচিত। গ্রেট হলে হ্যারি ঢোকার সাথে সাথে সবার দৃষ্টি পড়ল ফায়ারবোল্টের উপর, উত্তেজিত কিছু মন্তব্যও শোনা গেল। সন্তষ্টির সঙ্গে হ্যারি দেখল যে স্লিথারিন টিম বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে আছে ওটার দিকে।

ওর চেহারাটা একবার দেখেছো? দাঁত বের করে বলল রন ম্যালফয়ের দিকে তাকিয়ে। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না! চমৎকার!

উড নিজেও ফায়ারবোল্টের সম্মানে উৎসাহিত।

এটা এখানে রাখ হ্যারি, টেবিলের মাঝখানে ব্রুমটাকে রেখে বলল সে, এমনভাবে যেন নামটা উপরের দিকে থাকে। র‍্যাভেনক্ল এবং হাফলপাফ-এর টেবিল থেকে সবাই এল ওটা দেখতে। নিম্বাসের বদলে ওমন একটা অসাধারণ ব্রুম পাওয়াতে সেডরিক ডিগরি হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। পার্সির র‍্যাভেনক্ল গার্ল ফ্রেড পেনেলপি ক্লিয়ারওয়াটার অনুমতি চাইল ওটাকে ধরবার।

দেখ, পেনি, কোনরকম ষড়যন্ত্র নয়! উৎসাহের সঙ্গে বলল পার্সি, যখন ও খুব কাছে থেকে ফায়ারবোল্টকে দেখছে। পেনেলপি এবং আমার মধ্যে বাজি হয়েছে, টিমকে বলল সে। দশ গ্যালিয়ন ম্যাচের ফলাফলের উপর!

ফায়ারবোল্টটা নামিয়ে রেখে, হ্যারিকে ধন্যবাদ জানিয়ে পেনেলপি ওর টেবিলে ফিরে গেল।

 হ্যারি–তোমাকে জিততেই হবে, বলল পার্সি ফিসফিস করে। আমার কাছে দশ গ্যালিয়ন নেই। হ্যাঁ, আমি আসছি পেনি! ছুটে চলে গেল ও।

তুমি কী নিশ্চিত যে এই ব্রুমটাকে ম্যানেজ করতে পারবে, পটার? একটা শীতল একঘেয়ে স্বর শোনা গেল।

কাছে থেকে শোনা গেল এগিয়ে এসেছে ড্র্যাকো ম্যালফয়, ওর ঠিক পেছনে ক্রেব এবং গয়ল।

হ্যাঁ, মনে হয়, সাধারণভাবে বলল হ্যারি।

এর অনেক ধরনের গুণ আছে তাই না? বলল ম্যালফয় বিদ্বেষে চকচক করছে ওর চোখ। কি লজ্জা, এর সঙ্গে একটা প্যারাসুট নেই–যদি তুমি কোন ডিমেন্টারের খুব কাছে চলে যাও।

ক্রেব আর গয়ল বিদ্রুপে চাপা হাসি হাসল।

আহা, তোমার ব্রুমটায় একটা অতিরিক্ত হাত লাগানো যায় না; ম্যালফয় বলল হ্যারি। গেলে ওটাই তোমার জন্য মিচটাকে ধরতে পারত।

গ্রিফিন্ডর টিম জোরে হেসে উঠল। ম্যালফয়ের ভাবলেশহীন চোখ দুটো সরু হয়ে গেল, পা টেনে টেনে চলে গেল ও। ওরা দেখল স্লিথারিন টিমের অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কি যেন আলোচনা করছে ওরা, সন্দেহ নেই ম্যালফয়কে জিজ্ঞাসা করছে হ্যারির ব্রুমটা আসলেই ফায়ারবোল্ট কি না।

পৌনে এগারটার সময় গ্রিফিন্ডর টিম জার্সি বদলানোর জন্য গেল। হাফলপাফদের সঙ্গে খেলার দিনের মতোই আবহাওয়া পরিষ্কার। পরিষ্কার এবং ঠাণ্ডা একটা দিন, সামান্য বাতাস রয়েছে; এবার দেখতে কোন অসুবিধা হবে না। এবং হ্যারি যদিও একটু নার্ভাস, কিন্তু এরই মধ্যে কুইডিচ ম্যাচের উত্তেজনা ফিরে এসেছে ওর মধ্যে। স্কুলের বাকি সবাই স্টেডিয়ামে চলে এসেছে। হ্যারি ওর স্কুলের কালো পোশাক খুলে ফেলল, পকেট থেকে জাদুর কাঠি বের করল, এবং কুইডিচ জার্সির নিচে যে টি–শার্টটি পড়বে তার ভেতরে ওটা রেখে দিল। হঠাৎ সে ভাবল ভিড়ের মধ্যে কী প্রফেসর লুপিন রয়েছেন, দেখছেন?

তুমি জান আমাদের কি করতে হবে, বলল উড ড্রেসিং রুম থেকে বেরুতে বেরুতে। যদি আমরা এই ম্যাচটি হ্যারি তাহলে আমরা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ। প্র্যাকটিসের সময় যেরকম করেছিলে সেইভাবে শুধু উড়বে তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক আছে!

প্রচুর হাততালির মধ্যে ওরা পিচে এল। র‍্যাভেনক্ল টিম, নীল জার্সি, এরই মধ্যে পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের সিকার চো চ্যাং টিমের একমাত্র মেয়ে। হ্যারির চেয়ে বেটে এবং হ্যারি স্বীকার না করে পারল না, যদিও সে একটু নার্ভাস, যে মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। দুই টিম মুখোমুখি দাঁড়ালো ওদের ক্যাপ্টেনের পেছনে, মেয়েটি হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসলো। পেটে একটা মোচড় অনুভব করল হ্যারি এবং সেটা নার্ভাস হওয়ার কারণে নয়।

উড, ডেভিস, হাত মেলাও, মাদাম হুচ সংক্ষেপে বললেন র‍্যাভেনক্ল ক্যাপ্টেনের সঙ্গে হাত মেলালো উড।

যার যার ব্রুমে চড়ো . আমার হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে তিন–দুই-এক

লাফিয়ে শূন্যে উঠল হ্যারি এবং ওর ফায়ারবোল্ট অন্য ব্রুমগুলোর চেয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেল; স্টেডিয়ামের চারদিকে উড়ে বেড়াল এবং চোখ সরু করে মিচটাকে খুঁজছে, ধারা বিবরণী শুনছে একই সঙ্গে। ধারা বিবরণী দিচ্ছে উইজলি জমজ ভাইদের বন্ধু লি জর্ডন।

ওরা উড়ে গেছে, এই ম্যাচের সবচেয়ে বড় উত্তেজনা হচ্ছে ফায়ারবোল্ট, যেটায় হ্যারি পটার গ্রিফিন্ডরের পক্ষে চড়েছে। কোন ব্রুমস্টিক অনুসারে এ বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যে জাতীয় টিমে ফায়ারবোল্টকেই পছন্দ করা হবে।

জর্ডন, ম্যাচে কি হচ্ছে দয়া করে আমাদেরকে কী সেটা জানাবে? বাধা দিয়ে বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

ঠিক বলেছেন প্রফেসর–আমি শুধু একটু ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। ফায়ারবোল্ট ঘটনাক্রমে, ওর ভেতরে অটোব্রেক রয়েছে এবং

জর্ডন!

ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন গ্রিফিন্ডরের দখলে রয়েছে, গ্রিফিন্ডরের কেটি বেল গোল দিতে যাচ্ছে…।

কেটিকে পেরিয়ে হ্যারি ভেতরের দিকে চলে গেল, চারদিকে তাকাচ্ছে সোনালী রঙের একটু ঝিলিকের জন্য, খেয়াল করল চো চ্যাং খুব কাছে থেকে ওকে অনুসরণ করছে। সন্দেহ নেই সে খুব ভালো উড়তে পারে–বার বার ওর পথ কেটে যাচ্ছে, বাধ্য করছে ওকে দিক পরিবর্তনে।

গতি বাড়াও, ওকে তোমার গতি দেখাও হ্যারি! চিৎকার করল ফ্রেড পাশ দিয়ে একটা ব্লাজারের পিছু ধাওয়া করতে করতে। ওটা অ্যালিসিয়ার দিকে যাচ্ছিল।

র‍্যাভেনক্ল গোলপোস্টের দিকে এসে হ্যারি ফায়ারবোল্টের গতি বাড়িয়ে দিল এবং পেছনে পড়ে গেল চো। কেটি প্রথম গোলটা করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিফিন্ডর সমর্থকরা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। হঠাৎ ও দেখল ওটাকে স্নিচটা মাটির খুব কাছাকাছি, একটা হ্যারিয়ারের কাছ দিয়ে উড়ছে।

ডাইভ দিল হ্যারি: চো দেখল ও কি করছে এবং ওর পেছনে এলো ছুটে। হ্যারি গতি বাড়িয়ে দিয়েছে, ওর ভেতরে উত্তেজনা দৌড়াচ্ছে; ডাই হচ্ছে ওর। বিশেষত্ব। মাত্র দশ ফুট দূরে হ্যারি

তখন, র‍্যাভেনক্ল বিটারের ছুঁড়ে দেয়া একটা ব্লাজার যেন কোথা থেকে ছুটে এলো; এক ইঞ্চি দূরে দিয়ে ওটাকে পাশ কাটিয়ে গেল হ্যারি এবং ওই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেকেন্ডের মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেল স্নিচটা।

গ্রিফিন্ডর সমর্থকদের হতাশা প্রকাশ পেল বিরাট একটা উউউউউউহ এর মধ্যে। অবশ্য র‍্যাভেনক্লদের সমর্থকরা হাততালিতে ফেটে পড়ল। জর্জ উইজলি তার রাগ প্রকাশ করল দ্বিতীয় ব্লাজারটাকে সরাসরি বিটারের দিকে মেরে, মধ্য আকাশে এক পাক ডিগবাজি খেল আক্রান্ত দুটো।

গ্রিফিন্ডর এগিয়ে রয়েছে আশি–শূন্য পয়েন্টে, এবার দেখ ফায়ারবোল্ট যাচ্ছে। পটার এবার সত্যি ওটাকে তীব্র গতিতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখ ওটা ঘুরছে–চ্যাং-এর কমেট ওটার কাছে কিছুই না। ফায়ারবোল্টের নিখুঁত ভারসাম্য লক্ষ্য করবার মতো–

জর্ডন! ফায়ারবোল্টের পক্ষে ওকালতি করার জন্যে কি তোমাকে পয়সা দেয়া হয়? ধারাবিবরণী চালিয়ে যাও!

র‍্যাভেনক্লরা একটু গুটিয়ে গেল; ইতোমধ্যে তারা তিনটি গোল করেছে, এখন গ্রিফিন্ডররা মাত্র পঞ্চাশ পয়েন্ট এগিয়ে যদি হ্যারির আগে চো মিচটাকে ধরতে পারে তাহলে জিতে যাবে র‍্যাভেনক্ল। হ্যারি আরও নিচে নামল, কোন রকমে ব্ল্যাভেনক্ল চেসারকে এড়িয়ে গেল। পুরো পিচটাকে পাগলের মতো খুঁজছে সে। সোনালী একটা ঝিলিক ছোট ছোট ডানার চমক–স্নিচটা গ্রিফিন্ডর গোলপোস্টের উপর ঘুরছে …।

গতি বাড়িয়ে দিল হ্যারি, সামনের সোনালী বিন্দুটার উপর ওর চোখ–কিন্তু পরের মুহূর্তেই, যেন হাওয়া থেকে উড়ে এলো চো, ওর পথটা আটকে দিল

হ্যারি, এখন ভাল মানুষ হওয়ার সময় না! গর্জন করল উড, ধাক্কা লাগাটা এড়িয়ে গেল হ্যারি। যদি দরকার হয় ওকে ওর ব্রুম থেকে ফেলে দাও!

হ্যারি ঘুরল চোর দিকে নজর গেল; দাঁত বের করে হাসছে মেয়েটা। মিচটা আবার হারিয়ে গেছে। ফায়ারবোল্টটাকে উপরমুখী করল হ্যারি, বিশ ফিট উপরে উঠে গেল। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ওকে অনুসরণ করছে চো মেয়েটা ঠিক করেছে নিজে মিচটাকে না খুঁজে হ্যারিকে নজরে রাখবে। ঠিক আছে যদি সে ওরই পিছু নিতে চায়, তাহলে এর পরিণতিও ভোগ করতে হবে।

ডাইভ দিল ও আবার এবং চো মনে করল আবার মিচটাকে দেখতে পেয়েছে হ্যারি, ওকে অনুসরণ করল। তীক্ষ্ণভাবে ডাইভ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল হ্যারি, কিন্তু চো নিচের দিকেই যাচ্ছে; আবার হ্যারি বুলেটের মতো উপরে উঠে গেল এবং তার পর স্নিচটাকে দেখল, তৃতীয় বারের মতো মিচটা র‍্যাভেনক্লদের পিচের উপরে চকচক করছে।

গতি বাড়িয়ে দিল সে অসম্ভব; অনেক ফিট নিচে চো তাই করল। কিন্তু ওর গতি বেশি এগিয়ে যাচ্ছে হ্যারি মিটার কাছে প্রতি সেকেন্ডে–তারপর

ওহ! চিৎকার করে উঠল চো আঙুল দিয়ে কি যেন দেখাল। মনোযোগ সরে গেল হ্যারির, তাকাল নিচের দিকে।

তিনটা ডিমেন্টার, তিনটা লম্বা, কালো, মাথা ঢাকা ডিমেন্টর তাকিয়ে আছে। উপরে ওর দিকে।

চিন্তা করবার জন্যও থামল না হ্যারি। পোশাকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল, বের করে আনল জাদুর কাঠিটা চিৎকার করল, এক্সপেক্টো পেট্রোনাম!

রূপালী একটা কিছু তীব্র ঝিলিক, ওর জাদুদণ্ডের শীর্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। ও জানে ওটা সরাসরি ডিমেন্টারদের গায়ে গিয়ে লেগেছে কিন্তু দেখার জন্য থামল; আশ্চর্যজনকভাবে ওর মনটা তখনও পরিষ্কার, সামনের দিকে তাকাল হ্যারি প্রায় পৌঁছে গেছে সে। জাদুর লাঠিটা ধরা হাতটা বাড়িয়ে দিল সে এবং কোনরকমে ছোট স্নিচটাকে মুঠো করে ফেলতে পারলো।

বেজে উঠল মাদাম হুচ-এর হুইসেল। মধ্যাকাশে ঘুরলো হ্যারি, দেখলো ছয়টি আবছা টকটকে লাল রঙের মূর্তি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পর মুহূর্তে পুরো টিমটাই ওকে এত জোরে জড়িয়ে ধরেছে যে ব্রুম থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল আর কি! নিচে শোনা যাচ্ছে গ্রিফিন্ডর সমর্থকদের উল্লাস।

এই যে আমার সেরা ছেলে! বলল উড। অ্যালিসিয়া, অ্যাঞ্জেলিনা এবং কেটি সবাই আনন্দে হ্যারিকে চুমু খেল, এবং এত জোরে জড়িয়ে ধরলো ফ্রেড যে ওর মনে হলো মাথাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। এলোমেলোভাবে টিমটা নিচে নেমে এল। ব্রুম থেকে নামল হ্যারি মুখ তুলে দেখল একদল গ্রিফিন্ডর সমর্থক দৌড়ে নিচের দিকে আসছে, সামনে রন। কিছু বোঝার আগেই উল্লসিত সমর্থকরা তাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলল।

এইবার, হ্যাঁ এইবার!রন চিৎকার করল, হ্যারির হাত আকাশের দিকে তুলে, হ্যা! হ্যা!

খুব ভালো করেছে, হ্যারি! বলল পার্সি, ওকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। আমি দশ গ্যালিওন পাবো, পেনিলোপিকে খুঁজতে হবে, আমি যাই

তোমার মঙ্গল হোক হ্যারি! গর্জন করে উঠল সিমাস ফিনিগান।

অতি চমৎকার! বিশৃঙ্খলভাবে ঠেলাঠেলি করা গ্রিফিন্ডরদের মাথার উপর দিয়ে হ্যাগ্রিডের গম্ভীর গলা শোনা গেল।

চমৎকার পেট্রোনাস তৈরি হয়েছিল, হ্যারির কানে কানে বলল একটি কণ্ঠস্বর।

ঘুরে প্রফেসর লুপিনকে দেখল হ্যারি, মনে হলো তিনি একটা ঝাঁকুনি খেয়েছেন আবার খুশিও।

এইবার ডিমেন্টাররা আমাকে মোটেই ভয় দেখাতে পারেনি! উত্তেজিতভাবে বলল হ্যারি। আমি অনুভবই করিনি।

এর কারণ হচ্ছে ওইগুলো–মানে–ডিমেন্টার ছিল না, বললেন প্রফেসর লুপিন। এসো দেখে যাও।

ভিড় থেকে হ্যারিকে নিয়ে পিচের কিনারায় এলেন প্রফেসর।

মিস্টার ম্যালফয়কে তুমি যা একখানা ভয় দেখিয়েছো না, বললেন প্রফেসর লুপিন।

হ্যারি তাকিয়ে দেখল, মাটির উপরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে একজনের ওপর একজন ম্যালফয়, ক্রেব, গয়ল এবং মার্কাস ফ্লিন্ট, স্লিথারিন টিমের ক্যাপ্টেন,সবাই লম্বা কালো মাথাটাকা পোশাক থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে ম্যালফয় যেন গয়ল-এর কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবার উপর মুখে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

একটা অর্থহীন কৌশল! চিৎকার করছিলেন প্রফেসর। গ্রিফিন্ডর সিকারকে ঠকাবার জন্য এটা খুব নিচু মানের কাপুরুষোচিত উদ্যোগ! তোমাদের সবাইকে ডিটেনশন দেয়া হলো, স্লিথারিন থেকে কাটা হলো পঞ্চাশ পয়েন্ট। এই সম্পর্কে আমি প্রফেসর ডাম্বলডোরের সঙ্গে কথা বলব, তোমাদের যেন কোন ভুল ধারণা না থাকে! আহ, ওই যে তিনি আসছেন!

গ্রিফিল্ডারদের বিজয় যদি কোন কিছু নিশ্চিত করে থাকে তাহলে এটাই সেই ঘটনা। রন দৌড়ে এসেছিল হ্যারির পাশে, তখনও ম্যালফয়কে কালো পোশাকটা থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় রত দেখে জোরে হেসে উঠল, গয়ল-এর মাথাটাও ওটার ভেতরে ঢুকে রয়েছে।

চলে এসো হ্যারি! বলল জর্জ, ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে ও। পার্টি! গ্রিফিন্ডর কমনরুমে এখন পার্টি হবে!

ঠিক আছে, বলল হ্যারি, কয়েক বছরের মধ্যে যেন এত আনন্দ হয়নি তার, টিমের অন্যান্যদের সঙ্গে এগিয়ে চলল সে, তখনও ওদের পরনে লাল রঙের জার্সি, স্টেডিয়াম থেকে ফিরে গেল প্রাসাদে।

***

মনে হচ্ছে যেন ওরা কুইডিচ কাপ জিতে নিয়েছে; পার্টি চলল সারাদিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত। কয়েক ঘণ্টার জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল ফ্রেড আর জর্জ উইজলি, ফিরে এল হাত ভর্তি বাটার বিয়ারের বোতল, কুমড়ার পানীয় এবং কয়েক ব্যাগ হানি ডিউকসের মিষ্টি নিয়ে।

ওগুলো কীভাবে পেলে? চিৎকার করল অ্যাঞ্জেলিনা জনসন, জর্জ তখন ভিড়ের মধ্যে সকলকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পিপারমিন্টের ব্যাগ দিচ্ছে।

মুনি, ওয়ার্মটেল, প্যাডফুট এবং প্রঙ্গস-এর কাছ থেকে সামান্য কিছু সাহায্য নিয়ে, হ্যারির কানে কানে বিড় বিড় করে বলল ফ্রেড।

একজন মাত্র এই উৎসবে যোগ দেয়নি। হারমিওন। অবিশ্বাস্য, এক কোণে বসে রয়েছে সে, হোম লাইফ অ্যান্ড সোশ্যাল হ্যাবিটস অফ ব্রিটিশ ম্যাগলস নামের বিশাল একটা বই পড়ার চেষ্টা করছে। বাটার বিয়ারের দুটো বোতল জাগল করতে করতে হ্যারি টেবিলের কাছ থেকে সরে ওর কাছে গেল।

তুমি কি আসলে ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল হারমিওনকে।

নিশ্চয়ই গিয়েছিলাম, বলল হারমিওন, অদ্ভুত রকমের তীক্ষ্ণ এবং উচ্চস্বরে, মুখ না তুলে। এবং আমরা যে জিতেছি তাতে আমি খুব খুশি, আমার মনে হয় তুমি খুবই ভালো খেলেছো, কিন্তু সোমবারের মধ্যে আমাকে এই বইটা পড়ে শেষ করতে হবে।

এসো, হারমিওন, এসো কিছু একটা খাও, বলল হ্যারি, মুখ তুলে রনের দিকে একবার তাকাল, ভাবল ঝগড়া মিটিয়ে ফেলার জন্যে প্রয়োজনীয় ভালো মেজাজ কি রনের তৈরি হয়েছে।

আমি পারি না হ্যারি, আমার এখনো চারশত বাইশ পৃষ্ঠা পড়তে হবে! বলল হারমিওন, এখন ওকে খানিকটা বিকারগ্রস্ত মনে হচ্ছে। ঠিক আছে … সে রনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ও চায় না আমি পার্টিতে যোগ দেই।

এ সম্পর্কে মনে হয় কোন বিতর্ক চলে না, কারণ ঠিক ওই মুহূর্তেই রন চিৎকার করে বলে উঠল, স্ক্যাবার্সকে যদি খেয়ে ফেলা না হতো তাহলে, সে এই ফাজ মাছিগুলো খেতে পারতো, ও ওগুলো খুব পছন্দ করতো।

হারমিওনের দু চোখ ফেটে জল বের হলো। হ্যারি কিছু বলার আগেই বিশাল বইটা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড় চলে গেল মেয়েদের হোস্টেলের সিঁড়ির দিকে এবং দৃষ্টির বাইরে।

তুমি কী ওকে একটা সুযোগ দিতে পার না? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল রনকে শান্ত স্বরে।

না, সোজাসাপটা জবাব রনের। সে যদি শুধু এমন ভাব করতো যে সে দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু সে তো তার দোষ কখনও স্বীকার করে না। এখনও সে এমন ভাব করছে যেন কোন ছুটিতে বা ওই ধরনের কিছু করতে গিয়েছে স্ক্যাবার্স।

রাত একটায় প্রফেসর ম্যাকগোনাগল যখন কমনরুমে এসে সবাইকে শুতে যেতে বললেন পার্টি তখন শেষ হলো। হ্যারি এবং রন হোস্টেলে ফেরার পথে খেলা সম্পর্কে আলোচনা করছিল। অবশেষে ক্লান্ত হ্যারি বিছানায় উঠে চারদিকের চাদরগুলো ফেলে দিল, যেন চাঁদের আলো ওর উপর এসে না পড়ে, চিৎ হয়ে শুয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল।

অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল হ্যারি। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছে সে, কাঁধে ফায়ারবোল্ট, ও যেন রূপালী সাদা একটা কিছুকে অনুসরণ করছে। সামনের গাছের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে ওটা, পাতার ফাঁকে ফাঁকে ওটার এক ঝলক দেখতে পাচ্ছে হ্যারি। ওটা ধরার জন্য আগ্রহে গতি বাড়িয়ে দিল সে, কিন্তু ও যত দ্রুত হাঁটছে ওর লক্ষ্যবস্তুও তত জোরে যাচ্ছে। দৌড়াতে শুরু করল হ্যারি সামনে দ্রুত ধাবমান খুঁড়ের শব্দ শুনতে পেল সে। এখন সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে, আর সামনে শুনতে পাচ্ছে ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ। তারপর একটা কোণা ঘুরে পরিষ্কার জায়গায় এল এবং

আআআআআআআআআআআআআররররররররররররররঘঘঘঘঘ ঘঘঘঘঘঘঘঘঘঘঘঘঘ! নাআআআআআআআআ!

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল হ্যারির যেন কেউ ওর মুখে মেরেছে কিছু দিয়ে। গাঢ় অন্ধকারে কোন কিছুই চিনতে পারছে না সে, চারদিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে–নিজের চারপাশে কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, রুমের অন্যদিক থেকে সিমাস ফিনিগানের গলা শুনতে পেল।

কি হচ্ছে?

হ্যারির মনে হলো হোস্টেলের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হলো। অবশেষে পর্দার মাঝখানের বিভাজন পেয়ে ওগুলোকে সরিয়ে দিল হ্যারি, ঠিক সেই মুহূর্তে ডিন থমাস বাতি জ্বালল।

বিছানার উপর বসে রয়েছে রন, ওর বিছানার পর্দাগুলো একদিক থেকে ছেঁড়া, চেহারায় চরম ভীতি।

ব্ল্যাক! সাইরিয়াস ব্ল্যাক! ছোরা সহ!

কী?

এইখানে ছিল! এইমাত্র! আমার এই পর্দাগুলো ছোরা দিয়ে ফালাফালা করেছে! আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে!

তুমি নিশ্চিত যে স্বপ্ন দেখছ না? বলল ডিন।

পর্দাগুলো দেখ! আমি তোমাদের বলছি, ও এখানে এসেছিল!

সবাই বিছানা থেকে নামল; হোস্টেলের দরজায় হ্যারি প্রথম পৌঁছাল, এবং সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামল সবাই। ওদের পেছনে দরজাগুলো খুলে গেল এবং ঘুম ঘুম স্বরে ওদেরকে ডাকল অন্যরা।

কে চিৎকার করেছে?

তোমরা কী করছ?

নিবু নিবু আলোর ছটায় কমনরুমটা তখনও আলোকিত, পার্টির ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্রের নোংরা কিন্তু জনশূন্য।

রন, তুমি কি নিশ্চিত যে, স্বপ্ন দেখছিলে না?

আমি তোমাদেরকে বলছি, আমি তাকে দেখেছি!

 কিসের এতো শব্দ হচ্ছে?

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল আমাদের শুতে যেতে বলেছে! কয়েকটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে, হাই তুলতে তুলতে। কয়েকটি ছেলেও এসেছে।

চমৎকার, আমরা কী আবার পার্টি চালিয়ে যাব? চাঙ্গা স্বরে বলল ফ্রেড উইজলি।

সবাই উপরে যাও! বলল পার্সি, দ্রুত কমনরুমে ঢুকে পায়জামায় হেডবয় ব্যাজটা লাগাতে লাগল।

পার্স–সাইরিয়াস ব্ল্যাক! ক্ষীণ স্বরে বলল রন। আমাদের হোস্টেলে। ছোরাসহ! আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে।

পুরো কমনরুমটা স্থির নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

ননসেন্স! বলল পার্সি, ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। তুমি হয়তো বেশি খেয়ে ফেলেছো রন–দুঃস্বপ্ন দেখেছো

আমি তোমাদের বলছি

এই যে, যথেষ্ট হয়েছে। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ফিরে এসেছেন। রেগে গিয়ে তাকাচ্ছেন সবার দিকে।

গ্রিফিন্ডররা ম্যাচ জিতেছে আমি খুশি, কিন্তু ব্যাপারটা এখন উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে। পার্সি তোমার কাছে আমি আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম।

আমি এটা করার অনুমতি দিইনি, প্রফেসর! বলল পার্সি। আমি এই মাত্র ওদেরকে বিছানায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছিলাম! আমার ভাই রন একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে–

ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না! রন চিৎকার করল। প্রফেসর, আমি জেগে উঠলাম এবং দেখলাম ছোরা হাতে সাইরিয়াস ব্ল্যাক আমার উপর ঝুঁকে রয়েছে!

এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

উদ্ভট কথা বলো না, উইজলি, ও ছবির ফুটোর মধ্য দিয়ে কীভাবে যাবে?

ওকে জিজ্ঞাসা করন! বলল রন, স্যার ক্যাডোগানের ছবির দিকে কম্পিত আঙুল তুলে। ওকে জিজ্ঞাসা করন দেখেছে কি না

রনের দিকে অবিশ্বাসের চাহনি দিয়ে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ছবিটাকে সরিয়ে বাইরে গেলেন। দম আটকে শুনছে কমনরুমের সবাই।

স্যার ক্যাডোগান, একটু আগে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে আপনি কী কাউকে যেতে দিয়েছেন?

নিশ্চয়, মহিয়সী নারী! চিৎকার করলেন স্যার ক্যাডোগান। বজ্রাহতের মতো নিঃশব্দতা নেমে গেল কমনরুমের ভেতরে এবং বাইরে।

আপনি–আপনি দিয়েছেন? বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। কিন্তু কিন্তু পাসওয়ার্ড!

ওর কাছে ছিল! গর্বের সঙ্গে বললেন স্যার ক্যাডোগান। পুরো সপ্তাহেরটাই তার কাছে ছিল, মাই লেডি! ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো থেকে সবকয়টা পড়ে শোনাল!

ছবির ফুটোর কাছ থেকে কমনরুমে ফিরে বজ্রাহত ছাত্রদের মুখোমুখি হলেন তিনি। মুখের সব রক্ত সরে গেছে। চক-এর মতো সাদা।

কে সেই লোক, বললেন তিনি, তার স্বর কাঁপছে, এরকম বোকা কে যে সপ্তাহের পাসওয়ার্ডগুলো কাগজে লিখে আবার হারিয়ে ফেলেছে? সম্পূর্ণ নীরবতা, কিন্তু খানিক পরে ভেঙে গেল ভীতসন্ত্রস্ত চি চি কণ্ঠস্বরে। নেভিল লংবটম, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে, ধীরে ধীরে হাত তুলল উপরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *