গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে এবার ভাইয়ান। মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে। চটপটে, মুখশ্রী সুন্দর, বয়সটাও কম। এই শেষ দিকটাই ভাইয়ানকে মাতিয়ে রাখে। অধিকাংশ বাঙালির মতোই তার মজ্জাগত যে কয়েকটি রক্ষণশীলতা রয়ে গেছে, তার একটি হচ্ছে, মেয়েদের বারো বছর বয়স থেকেই সহবাসযোগ্য মনে করা, বিয়ের জন্যে মোলর ধারে কাছে পাত্রী খোজা। সে একেবারে আটখানা হয়ে থাকে। বারীকে না বলে এতদূর টেনে আনবার জন্যে কিছু সময় আগেও যে অপরাধবোধ ও কুণ্ঠা ছিল, এখন আর তা নেই। বরং বারীর উপস্থিতিকে সে এখন অবাঞ্ছিত মনে করছে, শাপশাপান্ত করছে। বেশ হয়েছে, বারী যেমন যুবতী পাগল, তার ভাগ্যে পেছনের সিটে পড়েছে ন বছরের পুঁচকে নাসরিন।
সাঁৎ করে গাড়ি পথে নামায় ভাইয়ান।
তোমাকে তুমি করেই বলি, কেমন?
মাহজাবীন নিঃশব্দে সুন্দর করে হাসে। সে জানে, ঠিক কোন হাসিটি কোথায় গিয়ে টুং করে শব্দ তোলে। ভাইয়ান উৎসাহের সঙ্গে গাড়ি চালায়, ঘন ঘন আয়নায় নিজের চেহারা দ্যাখে। লাইব্রেরির কাছে গাড়ি আসতেই মাহজাবীন বলে, সহসা মনে পড়িল। বাম দিকে মোড় নিন।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাইয়ান বাম রাস্তায় গাড়ি আনে, এনেও ধীরে চালাতে থাকে।
একটি বাড়ি হইতে একটি ব্যাগ তুলিতে হইবে।
পেছন থেকে নাসরিন বলে ওঠে, কীসের ব্যাগ।
আমার সহিত আসিলেই দেখিতে পাইবে। মাহজাবীন মনে মনে বিরক্ত হয়। এই মেয়েটিই সব ভণ্ডুল করে দেবে। অথচ একে না নিলে মা বেরুতেই দিতেন না। চমক্কারভাবে সে গাড়ির কথা তুলে, বারবার গাড়ির প্রশংসা করে বেরুবার পথ করে এনেছিল, ফাঁদে পা দিয়ে ভাইয়ান তাকে নিয়ে বেরুতে চেয়েছিল, মাটি করে দিল নাসরিন।
এই বাড়ি।
চন্দনাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই দাঁড় করায় সে ভাইয়ানকে।
এক মিনিটে ফিরিব। নাসরিন, আইস।
যখন নিশ্চিত যে, এতদূর থেকে তাদের কথা ওরা শুনতে পাবে না, মাহজাবীন বলে, নাসরিন, একটি গোপনীয়তা রক্ষা করিতে হইবে। নহিলে বড় দিন আসিতেছে, সান্তাক্লজকে বলিয়া দিব, তোমাকে আর উপহার দিবে না। যদি আমার কথা শোন, তোমাকে আগামী সপ্তাহেই বায়োনিক উম্যান পুতুলটি কিনিয়ে দিব।
নতুন এই পুতুলটা বাজারে বের হবার পর থেকেই নাসরিন বায়না ধরেছিল। আলি বা নাহার কেউই তা পাত্তা দেয় নি বলে নাসরিনের একটা ক্ষোভ ছিল। সে এখন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সত্য বলিতেছ?
হাঁ। আগামী শনিবারেই পাইবে।
কী গোপন করিতে হইবে?
আমি আজ যেখানে যাই, যাই করি, বাড়িতে মাম বা ড্যাডি জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে, কী বলিবে পরে তাহা আমি শিখাইয়া দিব। এই লও, দশ পেনি অগ্রিম দিতেছি।
চন্দনা দরোজা খুলে দেয়। মাহজাবীন ও নাসরিনকে এক সঙ্গে দেখে উপলক্ষ্যটা ঠিক বুঝতে পারে না।
কী ব্যাপার?
ব্যাগটি লইতে আসিয়াছি। ভিতরে আর যাইব না। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
ব্যাগ দিয়ে দরোজা বন্ধ করেও পুরো বন্ধ করে না চন্দনা। একটু ফাঁক রেখে চোখ চালিয়ে মাহজাবীনের গতিবিধি লক্ষ করে। তাকে একটা ঝকঝকে বড় গাড়িতে উঠতে দেখে অবাক হয়। এ গাড়ি কার! দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে তার। নাহ্, মাহজাবীন সত্যিই ভাগ্যবতী।
গাড়িতে বসতেই ভাইয়ান বলে, ব্যাগের ভেতরে কী?
মহিলাদের ব্যাগের খবর লইতে নাই। বলেই সে আবার সেই টুং করা হাসিটা উপহার দেয়।
আর কোনো ব্যাগ লইতে নাই? ভাইয়ান রসিকতা করে।
না, নাই।
কোনদিকে তাহলে যাব?
মুশকিলে ফেলিলেন। মাহজাবীন ভালো করেই জানে, কোথায় তার এখন গন্তব্য, তবু কপাল কুঁচকে চিন্তা করবার ভান করে।
পেছন থেকে বারী বলে ওঠে, মুশকিল তো কেবল শুরু হইল।
মাহজাবীন সায় দেয়। হাঁ, তা হইল।
নাসরিন উদগ্রীব হয়ে বলে, তোমাদের কি গোপন কোনো কথা হইতেছে?
মাহজাবীন তাকে ধমক দেয়, নাসরিন। বায়োনিক উম্যান স্মরণ রাখিও।
নাসরিন চুপ করে যায়।
মাহজাবীন স্টিয়ারিং হুইলে চাপড় দিয়ে বলে, উপকার যখন করিতেছেন, আরো একটি করিবেন?
ভাইয়ান বিগলিত হয়ে যায়। মাহজাবীন কী সুগন্ধ মাখে? নামটা জেনে নিতে পারলে, আজই একটা শিশি কিনে উপহার দেওয়া যেত।
এই ব্যাগটি পৌঁছাইতে হইবে।
কোথায়?
অলবানি স্ট্রীটে।
অলবানি স্টীট কোথায়?
আমি জানি না। আপনার গাড়িতে মানচিত্র নাই?