১৩. গভর্নর দার্জিলিং যাবেন

কদিন পরেই গভর্নর দার্জিলিং যাবেন। গ্রীষ্মবকাশে। ডারবি-সায়ারের কেডস্টন হলের অনুকরণে ক্যাপ্টেন ওয়েট যখন কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসের পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন গরমের দিনে এর বাসিন্দাকে পালিয়ে যেতে হবে ভাবেননি। যার জন্য এই প্রাসাদের জন্ম, সেই লর্ড ওয়েলেসলীও কল্পনা করেননি। বিয়াল্লিশ বছরের উন্মত্ত ওয়েলেসলী সব ঋতুতেই সমানভাবে খুশিতে থেকেছেন এই গভর্নমেন্ট হাউসে।

তারপর যুগ পাল্টে গেল। ক্লাইভ স্ট্রিটের সাহেব-সুবাদের সঙ্গ দেবার জন্য ওয়েলেসলির উত্তর সাধকরা দার্জিলিং যাতায়াত শুরু করলেন।

ওয়েলেসলি-কার্জন-বেন্টিকের চৌদ্দ পুরুষকে গালাগালি দিয়ে যারা এই গভর্নমেন্ট হাউস দখল করল, তারাও হয়তো এই ক্লাইভ স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গীর সাহেব-সুবাদের মুখ চেয়েই দার্জিলিং শৈল শিখরে বসে বসে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ঠাট্টা করার লোভ সম্বরণ করতে পারলেন না।

তাই তো লাটসাহেবকে আজও গরমের দিনে পালাতে হয় লর্ড ওয়েলেসলির স্বপ্নের প্রাসাদ ছেড়ে।

কলকাতায় তবু ভিজিটার্স আসে, মিটিং-কনফারেন্স-সেমিনার আছে। ভাগ্য ভালো হলে ঘুষখোর সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের তদারকিতে তৈরি নতুন সরকারি অপকর্মশালার উদ্বোধন করার সুযোগও জুটে যায়। ফটো তোলার আরো অনেক সুযোগ আছে কলকাতায়। কিন্তু দার্জিলিং-এ? থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-ঘোড়। সেই বাজার, মোটর স্ট্যান্ডের পাশে লয়েড জর্জ বোটানিক্যাল গার্ডেনে একদিন ঘুরে-বেড়ান, ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গিয়ে বোকার মতো হাঁ করে থাকা, অবজারভেটরি হিল-এ গিয়ে ঘোমটা দেওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা।

দার্জিলিং-এ লাটসাহেবের আরো কিছু কম আছে। একদিন লেবং-এর রেস কোর্সে গিয়ে খচ্চরের দৌড় দেখে হাসি মুখে কোনো মাতাল জুয়াড়ির হাতে কাপ-মেডেল তুলে দিতে হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার মতো এগুলো সব লাটসাহেবকেই করতে হয়। সরকারি ভাষায় প্রিসিডেন্ট। হয়ে গেছে। প্রিসিডেন্ট-এর মতো কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ছাড়াও লাটসাহেবকে আরো আরো কিছু পূজা-পার্বণ-ব্রত পালন করতে হয় শৈল শিখরে গিয়ে। কোটিপতি পাটের দালালেরা মেয়ের। আর্ট একজিবিশন ওপন করতে হয়। ইনভিটেশন কার্ডে অবশ্য লেখা থাকে ওপনিং অফ আর্ট সেলুন। একবার-আধবার ক্যাপিট্যাল থিয়েটার বা রিস্ক সিনেমায় গিয়ে কিছু ব্যভিচারিণীদের চ্যারিটি শো-তে মদত করতেও হয় লাটসাহেবকে। এসব না করলে বর্ষায় তিস্তা ভদ্র হয়ে উত্তর বাংলার মানুষদের শান্তিতে থাকতে দেবে, এমন কোনো কারণ নেই। তবু করতে হয়। করতে হয় বাজেট বরাদ্দের কয়েক লক্ষ টাকা হরির লুঠের বাতাসার মতো উড়াবার জন্য। হাজার হোক সারা বাংলার জনপ্রতিনিধিদের পাশ করা বাজেটের তো একটা প্রেস্টিজ আছে?

তেনজিং হিমালয়ের ছাদে চড়ার পর সারা দেশের ভি-আই-পিদের মতো লাটসাহেবকেও পাহাড়-প্রেমিক হতে হয়েছে। যে লাটসাহেব দার্জিলিং বা বেনারসের কোনো পুরনো সিঁড়ি দিয়ে দু-ধাপ উঠতে পারেন না, তাকে মাউন্টিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপালের তৈরি তিন পাতা টাইপ করা বক্তৃতা রিডিং পড়ে পর্বতারোহণে উৎসাহ দিতে হয় একদল ছেলেমেয়েকে।

আগের দিনে জমিদারবাবুরা আদুরে বারবনিতা গোলাপির বিড়ালের বিয়েতে লক্ষ টাকা ওড়াতেন। একালে লাটসাহেবের ফালতু লাটসাহেবিপনায় লক্ষ লক্ষ টাকা উড়ছে বলেই বোধহয় জমিদারের বিড়ালের বিয়ে বন্ধ হয়েছে।

যে যাই হোক। লাটসাহেব রওনা হবার পনের দিন আগেই অ্যাডভান্স পার্টি চলে গেছে। দার্জিলিং রাজভবনেও বহু ছোট-বড় মাঝারি কর্মচারী আছেন। তারা সব কিছুই জানেন। সবকিছু ব্যবস্থাই করতে পারেন। তবু অ্যাডভান্স পার্টিকে যেতেই হয়। বিড়ালের বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য অ্যাডভান্স পার্টিতে ডেপুটি সেক্রেটারি ও এ-ডি-সি লেফটন্যান্ট ভাটিয়া আর কিছু অফিস স্টাফ চলে গেছে।

স্বাধীনতার আগে ও পরে শুধু একটি পার্থক্য হয়েছে। সে হচ্ছে হিজ এক্সেলেন্সির সিকিউরিটি। গভর্নরের ডিভ্যালুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটি ব্যবস্থারও অধঃপতন হয়েছে। একজন ছোঁকরা সাব-ইন্সপেক্টরই এখন মহামান্য রাজ্যপালের একমাত্র ত্রাণকর্তা। অ্যাডভান্স পার্টিতে তাই কোনো সিকিউরিটি অফিসার থাকেন না।

দিল্লীর কিছু হাফ-গেরস্ত, হাফ-সাহেবরা প্রতি সামারে যেমন অন্তত একবেলার জন্য মুসৌরি ঘুরে এসে অক্ষয় প্রেস্টিজের অধিকারী হন, কলকাতার কিছু মানুষের মধ্যেও এ রোগ আছে। টাইগার হিলে গভর্নরের মুচকি হাসি না দেখে কলকাতার কিছু মানুষ পার্ক স্ট্রিটের কেক খেতে পারেন না। গভর্নরের অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওঁরাও গরম জামা-কাপড় ইস্ত্রি করা শুরু করেন।

ক্যাপ্টেন এসব জানে। জানে আরো অনেক কিছু। জানে অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার পরই শুরু হবে বিশ্বনিন্দিত কলকাতা রেডিও স্টেশনের অনুরোধের আসর! যে এ-ডি-সি গভর্নরের সঙ্গে যাবার জন্য থেকে যান, তাকেই এই অনুরোধের আসরের জ্বালা সহ্য করতে হয়। নিয়মিত, প্রতি বছর। বৈচিত্র্য নেই সে অনুরোধে। তাছাড়া এসব রিকোয়েস্ট আসেও ওই একই অতি পরিচিত মহল থেকে। ওরা উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার লোক নন। মধ্য কলকাতারও না; কলকাতায় বাস করেও কলকাতাবাসী নন যাঁরা, সেই লাউডন-রডন-ক্যামাক-ময়রা স্ট্রিটের কিছু মানুষের কাছ থেকেই এসব অনুরোধ আসে, আসবে। ওরা সত্যি বিচিত্র! ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের প্লেনে চড়ে কাঠমাণ্ডু যেতে ওদের প্রেস্টিজে লাগে কিন্তু বিলেত-আমেরিকা গিয়েও ভব্য-সভ্য হবার সুযোগ পান না বিশেষ। তবে হাতের কাছে বি-ও-এ-সি বা প্যান-এমের টাইম টেবিল রাখেন প্রায় সবাই। ফিফথ এভিনিউ বা অক্সফোর্ড স্ট্রিটে সপিং করার সৌভাগ্য না হলেও নিউ মার্কেটের নিন্দায় পঞ্চমুখ।

ওরা আরো অনেক কিছু। কলকাতায় থেকেও বেলেঘাটা নারকেলডাঙ্গা-উল্টাডাঙ্গা দেখেন না। ওরা জলযোগের পয়োধি পেলেও দূরে সরিয়ে রাখেন কিন্তু ক্রেডিটে ফেরাজিনির কেক না খেয়ে পারেন না। স্বপ্ন দেখেন সুইস আলপস্-এর, যান শুধু দার্জিলিং।

অনুরোধ আসে ওই ওদের কাছ থেকে। প্রস্তাবিত, সম্ভাবিত আক্রমণের জন্য ক্যাপ্টেন রায় প্রস্তুত হচ্ছিল।

এই অনুরোধ-উপরোধ নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। কিছু লোককে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট করতে হয় বহুজনকে। এবার তাই ক্যাপ্টেন রায় আগে থেকেই সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে গভর্নরের কাছেই চলে গেল।

স্যার! আই অ্যাম সিওর প্রত্যেক বছরের মতো এবারও বহু রিকোয়েস্ট আসবে…

ডু ইউ থিঙ্ক সো?

ডেফিনিটলি। বহু চিঠিপত্র অলরেডি এসে গেছে। কালকের পেপারে আপনার দার্জিলিং যাবার ডেট অ্যানাউল হবার সঙ্গে সঙ্গে পার্সোন্যাল রিকোয়েস্ট আসা শুরু হবে। দ্যাট ইজ

হোয়াই…

অফিসিয়াল প্রোগ্রাম কতগুলো আছে?

একটা।

ওনলি ওয়ান? অবাক, বিস্ময়, হতাশায় গভর্নর এ-ডি-সির দিকে চাইলেন।

ইয়েস স্যার। খুব নরম গরম গলায় ক্যাপ্টেন রায় জানাল।

দার্জিলিং-এ গভর্নর থাকবেন তিন সপ্তাহ আর সরকারি এনগজেমেন্ট মাত্র একটা? হ্যাঁ। ওই রকমই হয়। দিল্লিতে হোম মিনিস্টারের করকমলে প্রতিদিন প্রতি রাত্রি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে ও চীফ মিনিস্টারের সানুগ্রহে গভর্নর হলে এর চাইতে বেশি অনার পাওয়া যায় না। গভর্নর ও তার এ-ডি-সি দুজনেই একথা জানেন। তাই কেউই আর এ বিষয়ে আলোচনা করলেন না।

সরকারি ভোগ্ৰাম কি?

স্যার, টু গিভ অ্যাওয়ে সার্টিফিকেটস টু গ্রামসেভিকাস।

মর্মাহত হলেন হিজ এক্সেলেন্সি। যারা বি-ডি-ওর আন্ডারে চাকরি করবে, তাদের সার্টিফিকেট দিতে হবে ওকে? তবে সান্ত্বনা এই যে ডেভলপমেন্ট কমিশনার তার বক্তৃতায় নিশ্চয়ই বলবেন, গ্রাম বাংলার রূপ বদলাবে তোমরা-ইউ গার্লস। বি কেয়ারফুল, কি দারুণ রেসপন্সিবিলিটি তোমাদের এবং তাইতো হিজ এক্সেলেন্সি ইউ ভেরি কাইভলি প্রেজেন্ট হিয়ার টু-ডে। কলকাতার। খবরের কাগজে এ অনুষ্ঠানের রিপোর্ট ছাপা না হলেও পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টের কাগজে ছবি ও রিপোর্ট ভালোভাবেই বেরোবে।

সরকারি নেমন্তন্নর অভাবে চুপচাপ তো রাজভনের মধ্যে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে থাকা যায় না। গভর্নর তাই এ-ডি-সিকে বললেন, না, না, ডোন্ট ডিসঅ্যাপয়েন্ট অল অফ দেম্।

বাট স্যার, কতজনকে আর খুশি করতে পারব? তাছাড়া ইউ আর গোয়িং দেয়ার টু টেক রেস্ট।

নো, নো। পাবলিক রিকোয়েস্ট করলে আই মাস্ট ট্রাই টু অনার দেম।

কিছু লোকের তৈল মর্দন পাবার জন্য গভর্নর ব্যাকুল ছিলেন। তাছাড়া কোনো ইনভিটেশন থাকলে ওর ফ্যামিলীর লোকজনই বা ভাববেন কি?

স্যার সেক্রেটারি ওয়াজ সাজেস্টিং যে ডেইলি একটা এনগেজমেন্ট নেওয়াই ঠিক হবে।

শেষে গভর্নর জানালেন যে বেশি অনুরোধ-উপরোধ এলে মাঝে-মাঝে দুটো-তিনটে এনগেজমেন্ট থাকলেও আপত্তি নেই।

দারিদ্র্যের প্রতিযোগিতা নেই কিন্তু ঐশ্বর্যের প্রতিযোগিতার শেষ নেই। গ্রীষ্মের দার্জিলিং-এ দেখা যায় সেই প্রতিযোগিতা। কলকাতার ইমপোর্টেড ব্যবসাদার আর লোক্যাল প্লান্টর্সরা পাগল হয়ে ওঠেন নেশায়। মিস এটা সেনের চারটি পেন্টিং কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিল্পপতি সানইয়াল ওর আর্ট সেলুনের ওপেনিং-এ সভাপতির পদ কিনলেন। কেন? চীফ গেস্ট যে গভর্নর। ওভার নাইট সানইয়াল সাহেবকে নিয়ে মেতে উঠলেন সোসাইটি লেডিরা। দার্জিলিং সামার কুইন প্রতিযোগিতায় ওকে চিফ গেস্ট করার প্রস্তাব এলো বহুজনের কাছ থেকে।

মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলের ডাইনিং হলের এসব আলোচনা, জিমখানা ক্লাবের বিলিয়ার্ড রুমে পৌঁছতে দেরি লাগেনি। প্লান্টার্স খৈতান সাহেবদের বাগান কিনে সাহেব হবার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া বাপ-দাদা কলকাতার স্টক-এক্সচেঞ্জ আর খিদিরপুরের তিন-চারটে কলকারখানা সামলাতে এত মত্ত যে জুনিয়র খৈতান নতুন বিজনেস সামলাতে এসে প্রমত্ত হবার অফুরন্ত সুযোগ পাচ্ছেন।

ক্যাপ্টেন রায় এইসব নোংরা প্রতিযোগিতার নেপথ্য কাহিনি সব জানে। প্রতিবছর এর পুনরাবৃত্তি হয়। এবার না হবার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি ক্যপ্টেন। তাইতো অনুরোধ আসার আগেই সেক্রেটারি আর হিজ এক্সেলেন্সির সঙ্গে আলাপ করে নিল।

পরের দিন খবরের কাগজে গভর্নরের দার্জিলিং প্রোগ্রাম বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল হাই সোসাইটির পাগলামি। লেটন্যান্ট ভাটিয়া চলে গেছে। নর্মাল এ-ডি-সি ইন ওয়েটিং-এর কাজ তো আছেই, তারপর সারাদিন এই ঝামেলা। দিনরাত্রি-চব্বিশ ঘণ্টা। তাছাড়া প্রায় রোজই একবার ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দমদম যেতে হয় কোনো না কোনো গেস্টকে রিসিভ বা সি-অফ করতে। এরই ফাঁকে ফাঁকে অতিথিদের দেখাশুনাও করতে হয় ওকেই।

শান্তশিষ্ট ক্যাপ্টেনও যেন মেজাজ হারিয়ে ফেলে। অধিকাংশ গেস্টদের ডিপারচার হচ্ছে ভোরবেলায়। ছটা নাগাদ। পাঁচটায় উঠেই ক্যাপ্টেনকে তৈরি হতে হয় ওদের বিদায় জানাবার জন্য। তাছাড়া যেখানে বাগের ভয়, সেখানেই রাত হয়। সিঙ্গাপুরে সিয়াটো কনফারেন্সের জন্য ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি, টার্কিশ ডিফেন্স মিনিস্টার, ইটালিয়ান ফরেন মিনিস্টার আর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার অফ ইরান সিঙ্গাপুরের পথে দমদম হয়ে গেলেন। পরপর তিনদিন মাঝরাতের পর বা শেষ রাতের গভর্নরের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেনকে অভ্যর্থনা জানাতে হল। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতের ঘুমটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হল।

একদিন মাত্র মিনিট পনেরোর জন্য মণিকাঁদের ওখানে গিয়েছিল। তাছাড়া রোজ টেলিফোনে কথা বলবারও সুযোগ থাকে না। মণিকাও দুদিন রাজভবনে এসেছিল। দেখা হয়েছিল একদিন।

কেমন আছ?

খুব ভালো।

ঠোঁটের কোণায় সামান্য একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে মণিকা বলল, তা আমি জানি। খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে ছবি বেরোচ্ছে, ভালো থাকবে না?

সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে ক্যাপ্টেন ওপাশের কৌচটা ছেড়ে মণিকার পাশে এসে বসল। একবার হাসল, একবার চাইল। আলতো করে আঙুল দিয়ে মণিকার আধোবদন তুলে ধরল।

দারুণ রাগ করেছ, তাই না?

মণিকা জবাব দিল না। মুখাট আবার নিচে করল।

ক্যাপ্টেন একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, আরতি চলে গেছে?

হ্যাঁ।

আবার একটু নিস্তব্ধতা।

আচ্ছা আরতি বোধহয় ঠিক হ্যাপি নয়, তাই না?

সঙ্গে সঙ্গে মণিকা জবাব দেয়, হু ইজ হ্যাপি?

ডান হাত দিয়ে মণিকাকে কাছে টেনে নিয়ে মুখোনা তুলে ধরে বলে, তুমি তো সুখী।

ঘোড়ার ডিম।

ঘোড়ার ডিম? বলো কি?

মণিকা কি জবাব দেবে? চুপ করে থাকে।

ক্যাপ্টেন আবার বলে, সেদিন রাত্রের পরও তুমি কি একথা বলছ?

বলব না? সেদিন রাত্রের পর তুমি আমাকে উপেক্ষা করে চলেছ, আমি সুখী হব না?

একটু আদর-টাদর করে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ক্যাপ্টেন সেদিন নিজে গিয়ে ছেড়ে এসেছিল মণিকাকে।

রাজভবনে ফিরে এসে চুপচাপ বসে বসে ভাবছিল মণিকার কথা! অনেকক্ষণ, অনেক কিছু। ধীরে ধীরে কত কাছে এসে, কত নিবিড় হয়েছে। কত গম্ভীর হয়েছে, দুটি প্রাণের বন্ধন। প্রথম দিনের প্রথম অধ্যায়ের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন-সাধনা আজ পূর্ণ। তবুও কেন এই অপূর্ণতার বিস্বাদ? মণিকা কেন এখনও বিবর্ণ? পূর্ণ হয়েও পরিপূর্ণ হয় না কেউ। কেন?

সেন্টার টেবিলে পা দুটো তুলে দিয়ে কৌচে প্রায় শুয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন। সিগারেট খেতে খেতে দৃষ্টিটা ঘুরে যায় বাইরের দিকে রাজভবনের চারপাশের শ্যামল সীমান্তে। মাটির তলায় লুকিয়ে থাকে বীজ। অঙ্কুরিত হবার সাধনায় সে উন্মাদ হয়ে ওঠে। একদিন সে সাধনার শেষ হয়। ধরিত্রী বিদীর্ণ করে সে বীজ আত্মপ্রকাশ করে, সূর্যের আলো দেখে সে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সে আবার পাগল হয়ে ওঠে। সুর্যের হাসি দেখার পর পরই সদ্য অঙ্কুরিত বীজ চারপাশে দেখে বিরাট বনানী। ওরা সবাই আকাশের কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দশ দিকে নিজেকে বিস্তারিত করেছে। প্রচার করেছে নিজের সাফল্য, কৃতিত্ব, অস্তিত্ব। ওই বিরাট বনানীর মতো নিজের কৃতিত্ব প্রচারের জন্য সদ্যজাত শিশু-মহীরূহ আবার নতুন নেশায় মেতে ওঠে। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে আশা-নিরাশা। আকাশের কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শান্তি পায় না ওরা। ফুলে ফলে নিজেকে সাজাতে চায়। চায় আরো কত কি!

প্রকৃতির কি বিচিত্র খেয়াল? গাছপালা পশুপক্ষী মানুষ–সবাই এক সুরে, এক ছন্দে বাঁধা। কেউ থামতে চায় না।

মণিকাও না। এক স্বপ্নের পরিণতিতে জন্ম নিয়েছে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা। নতুন প্রত্যাশা। হয়তো নতুন দাবিও। সে কি অন্যায়?

অন্যায় কেন হবে? তবে এত ব্যস্ততা কেন। এত হতাশ হবার কি আছে?

আপন মনে ক্যাপ্টেন ভাবে। স্বপ্ন কি ওর নেই? মণিকাকে নিয়ে কত কি ভাবে, কত কি আশা করে! কত অপূর্ণ বাসনা চাপা দিয়ে রেখেছে হাসি মুখে। কর্তব্যের আড়ালে, সামাজিক পরিবেশের চাপে।

মণিকাকে কি সব কথা বলা যায়? সারাদিন সবার সঙ্গে ওকে হাসতে হয়, কিন্তু…কিন্তু কি?

ক্যাপ্টেন মণিকার কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। উৎকণ্ঠাভরা আরো একটা দিনের শেষ হয়।

দিন ফুরিয়ে যায় কিন্তু উৎকণ্ঠা? চিন্তা? ব্যথা-বেদনা, হতাশা? সব লুকিয়ে থাকে। চাপা থাকে।

সব কিছু চাপা দেবার জন্যই তো এলাহাবাদ ছেড়ে পালিয়েছিল। ভেবেছিল দৈনন্দিন জীবনেরা উত্তেজনায় ভুলতে পারবে সেই অবিস্মরণীয় নাতিদীর্ঘ ইতিহাস। ভেবেছিল মত্ত-প্রমত্ত থাকবে। দিনের বেলায় কাজের নেশায়, রাত্রে অফিসার্স ক্লাবে, বারে। বোতল বোতল হুইস্কি গলা দিয়ে ঢেলে মুছে ফেলবে সব স্মৃতি।

পারেনি। বহু চেষ্টা করেও পারেনি। প্রথম প্রথম অনেক দূর এগিয়েছিল। পরে ফিরে এসেছে। ও পথ ছেড়ে দিয়েছে। পুরনো বন্ধুরা তো ক্যাপ্টেন রায়কে দেখে অবাক হয়। চব্বিশ ঘণ্টা সিগারেট খাবে কিন্তু কোনো অকেশন না হলে এক পেগও খাবে না।

কি করে ক্যাপ্টেন হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা ওর দুটি হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন?

অনুরোধ?

না, না। ওকে কি অনুবোধ বলে? দুই হাত ধরে ভিক্ষা চেয়েছিলেন মা। জননী। গর্ভধারিণী। চির কল্যাণী, চির শুভাকাক্ষিনী।

তুই নিজেকে যদি অমন শেষ করে দিস তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বল তো?

প্রয়াগ সঙ্গমের ধারে হনুমানজীর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মা-র পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল ক্যাপ্টেন। পরে মনে মনে বলেছিল, আমার জন্য আর ওই হতভাগিনীকে চোখের জল ফেলতে হবে না। না। কোনোদিন না। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কে আমার জন্য এমন করে…

রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মনে পড়ছিল সেই সর্বনাশা দিনগুলোর কথা। স্মৃতি। বেদনা।

মাঝে মাঝে অসতর্ক মুহূর্তে মনটা আরও পিছিয়ে যেতে চায়। ভয়ে আঁতকে ওঠে। পারে না। রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায় সারা শরীরটা জ্বলতে থাকে। একটা অব্যক্ত বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বহুঁকাল ভুলে ছিলেন। নিজের কথা চিন্তাই করতেন না ক্যাপ্টেন। দিনরাত্রির লীলাখেলার মধ্য দিয়ে শ্লথ পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছিলেন অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। সে ভবিষ্যতের কাছে কোনো প্রত্যাশা ছিল না ওর, কেন দাবি ছিল না, দিনের আলোয় কোনো স্বপ্ন জন্ম নিত না, রাত্রের অন্ধকারে কোনো স্বপ্ন মিলিয়েও যেত না।

বেশ ছিলেন ক্যাপ্টেন। কলকাতায় এসেও বেশ ছিলেন। আমজাদ রমজানের কাছে গল্প শুনে বেশ কাটছিল দিনগুলো। কোনো শূন্যতা অনুভব করতেন না। রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত কোনো দিন। বৈভব তীর্থ গভর্নমেন্ট হাউসে থেকেও বেশ নিরাসক্ত ছিলেন ক্যাপ্টেন রায়।

প্রলোভন যে আসেনি, তা নয়। এসেছে। কখনও মিস গুপ্তা বা মিসেস রায়চৌধুরির কাছ থেকে, কখনও আবার কোনো অতিথিনীর কাছ থেকে। আরো কত জায়গা থেকে। মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন। মনে কোনোদিন আলোড়ন আসেনি। উত্তাপ বোধ করেছেন মনে মনে কদাচিৎ।

কিন্তু হঠাৎ সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল।

A gentle shock of mind surprise.
Has Carried far into his heart the voice
Of mountain torrents.

একটু পরে আবার সহেন্দহ দেখা দিয়েছিল। তবে কি—

Two lovely black eyes,
Oh, what a surprise!
Only for telling a man he was wrong,
Two lovely black eyes!

ওয়ার্ডওয়ার্থ ঠিক, নাকি চার্লস কোবর্ণ? বিচার করতে পারেনি ক্যাপ্টেন। সার্জেন যেমন সবার অপারেশন করতে পারেন কিন্তু নিজের স্ত্রী? ছেলেমেয়ের? পারেন না। কেন ডাক্তাররা? নিজের চিকিৎসা কখনও করেন না, করতে পারেন না। ক্যাপ্টেনও পারেননি। কে ঠিক? কোনটা ঠিক?

তিনি শুধু জানলেন অজ্ঞাতসারেই নিজের হাতেই গাড়ির স্টিয়ারিংটা ঘুরে গেল। কেন, কেমন করে? জানেন না। জানবার প্রয়োজন বোধ করেননি। বহুদিন জানতে চান কি। কি প্রয়োজন? কি সার্থকতা? জীবনের সব প্রশ্নের কি উত্তর পাওয়া যায়? কেউ পায়নি, কেউ পাবে না। যৌবনেই জীবনের এই মর্মকথা জেনে গেছেন ক্যাপ্টেন। নিজের জীবন নিয়ে মর্মে মর্মে সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন যে!

মণিকা অভিমান করেছে। হয়তো রাগও। কিন্তু ক্যাপ্টেন কি করে বোঝাবেন সব কথা? রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়তে চাইলেই কি তা সম্ভব? বিধাতা-পুরুষ ক্যাপ্টেনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তিনি তো চাননি কারুর জীবন নিয়ে খেলা করতে। মণিকাকে নিয়েও নয়। কখনই নয়। যে সম্মান, ভালোবাসা, ঐশ্বর্য মণিকা ওকে দিয়েছে, তা নিয়ে কি খেলা করা। যায়? আর কেউ পারলেও ক্যাপ্টেনের সে ক্ষমতা নেই, ইচ্ছাও নেই।

মণিকা নিশ্চয়ই একটু আহত মন নিয়ে ফিরে গেছে কিন্তু তিনি তো চাননি ওর ভালোবাসার অমর্যাদা করতে, চাননি ওকে আহত করতে। সেকথা বোঝাবেন কেমন করে। বরং ক্যাপ্টেন স্বপ্ন দেখেন মণিকাকে সসম্মানে ওর জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে।

তাছাড়া মণিকার কাছে ক্যাপ্টেন কৃতজ্ঞ। অশেষ কৃতজ্ঞ। বহুদিন ধরে মহাশূন্যে বিচরণ করার পর মণিকাই ওকে ফিরিয়ে এনেছে এই পৃথিবীতে। প্রেম, ভালোরাসা, স্নেহ, মায়া-মমতার রাজ্যে। দেহ ছিল কিন্তু তার চাইতে বেশি ছিল দাহ। মণিকাই মুক্তি দিয়েছে সে দাহ থেকে, সে অব্যক্ত অসহ্য বেদনা থেকে।

আরও অনেক কিছু দিয়েছে মণিকা। মানুষকে আর পৃথিবীতে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। ক্যাপ্টেন তো নিজেকেও ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছিল। আজ সে নিজেকে ভালোবাসে। সকালবেলায় তাইতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে গান গায়, এ মণিহার আমায় নাহি সাজে…

আগে?

ইউনিফর্ম চাপিয়েই ক্যাপ্টেন খুশি থাকতো। কসমেটিক্স তো দূরের কথা, মাসের পর মাস। আফনার সেভ লোশন পর্যন্ত কিনতে ভুলে যেত।

মনের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে, জীবনের প্রতি মুহূর্তের আশা-ভরসা, আনন্দ-বেদনার সঙ্গে ক্যাপ্টেন আজ অনুভব করে মণিকাকে। মণিমালাকে?

মণিমালা?

হ্যাঁ, মণিমালা। ক্যাপ্টেনের খুব বেশি অভিব্যক্তি নেই কিন্তু তাই বলে তার স্বপ্ন নেই? যেদিন মণিকাকে ও কাছে পাবে, নিজের করে পাবে, ফুলের জলসায় নীরব কবির মতো সলজ্জভাবে আসন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রতিক্ষা করবে, সেদিন থেকে ক্যাপ্টেন তো ওকে মণিমালা বলেই ডাকবে।

.

ক্যাপ্টেন জানে মণিকার কথা মাকে জানালে তিনি খুশি হবেন। নিশ্চিত হবেন। খুশি হবেন এই কথা ভেবে যে তার একমাত্র পুত্র সুস্থ স্বাভাবিক হয়েছে। নিশ্চিন্ত হবার কারণও অনেক। এক মুহূর্তে একটা বুলেটের গুলিতে যে সুখের সংসারটা ছারখার হয়ে গিয়েছিল কবছর আগে, সে সংসার হয়তো সুখের, শান্তির হবে। এই কবছরের অস্বাভাবিক চাপা উত্তেজনাটা বিদায় নেবে। নিশ্চিন্ত হবেন না?

তাছাড়া একমাত্র ছেলে আর্মিতে, তাতেই মার ঘুম নেই। মার ধারণা যেখানেই যুদ্ধ-বিগ্রহ বা মারামারি কাটাকাটি হোক, তার ছেলেকেই সব কিছু সামলাতে হবে। আর দিন-রাত্রির অত-শত বিপদের মধ্যে থাকলে কখন কি হয় বলা যায়? একে অমন চাকরি তার উপর সংসারধর্ম করল না। করতে পারল না। চিন্তার শেষ নেই মার।

মণিকার কথা জানলেই হল। হয়তো পরের ট্রেনেই ছুটে আসবেন। কিছু বলা যায় না। মণিকাকে দেখলে মার-র মাথার ঠিক থাকবে কিনা, তাই বা কে জানে? হয়তো মণিকারই হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভিক্ষা চাইবেন তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য। আরো কত কি করবেন, কে বলতে পারে?

তাছাড়া কিছু না জানিয়েও যদি মণিকার সঙ্গে মার আলাপ করিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও হয়তো মা প্রস্তাব না করে পারবেন না। অমন শান্ত-স্নিগ্ধ অথচ সুন্দরী মেয়েকে দেখলেই মার পছন্দ হবেই। আর পছন্দ হলে নিশ্চয়ই…

গান শুনলে? মণিকা যদি আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব শোনায়? মা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, শেষের লাইনটা আর একবার কর না মা। বড় ভালো লাগে ওই কটি কথা! এই বলে হয়তো নিজের মনে মনেই আবৃত্তি করবেন–

আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী–
হল না সারা, কত না যুগ ধরি
কেবলই আসি লব।

.

ক্যাপ্টেন অনেকবার ভেবেছে মাকে সব কিছু জানাবে, কিচ্ছু লুকোবে না। দুএকবার চিঠি লেখার কাগজপত্র নিয়েও বসেছিল। শেষ পর্যন্ত লেখেনি। লিখতে পারেনি। নিজেকে বিচার করতে চেয়েছিল ভালোভাবে। বিচার করতে চেয়েছিল, কোনো মোহের ঘোরে ও মণিকাকে চাইছে না তো? একটু মোহ আছে বৈকি। হাজার হোক মণিকাকে দেখে, আলাপ করে, এত নিবিড় ভাবে মেলামেশা করে নিশ্চয়ই কিছুটা মোহ জন্মেছে কিন্তু শুধুই মোহ নয় তো? আপন মনে বিচার করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন চিঠিপত্র লেখার কাগজপত্তর সরিয়ে রেখেছে। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। আরো ভালোভাবে নিজের মনকে, নিজের সত্তাকে বিচার করতে চেয়েছে। পরীক্ষা করতে চেয়েছে মণিকার প্রতি তার ভালোবাসা।

হয়তো মণিকাকেও পরীক্ষা করতে চেয়েছে। আর্মি অফিসারদের প্রতি কিছু মেয়ের মোহ থাকে, আকর্ষণ থাকে। দুর্বলতাও থাকতে পারে। দুনিয়ার সবার থেকে নিজেকে একটু স্বতন্ত্রভাবে দেখার লোভ কোনো মেয়েই সামলাতে পারে না। সর্বত্র, সব পরিবেশেই। কুলি-মজুর, কেরানী-অফিসার, বীমার দালাল, বিজনেসম্যান যাকেই বিয়ে করুক না কেন, বিয়ের পর মেয়েরা অনন্যা হয়ে ওঠে। গভর্নরের এ-ডি-সি-কে বিয়ে করে সে হয়তো সেই আত্মতৃপ্তি একটু বেশি করে উপলব্ধি করার প্রয়াস পারে। এ-ডি-সি-র প্রতি আকর্ষণ হবার আরো অনেক কারণ আছে। যুক্তিতর্কে সে কারণ না টিকলেও আছে। থাকে। ক্যাপ্টেন তা জানে। বুঝতে পারে। মণিকাও সেই মরীচিৎকার মোহে এগিয়ে আসেনি তো? যৌবনের মোহনায় দাঁড়িয়ে জোয়ারের টানে কিছু দূর ভেসে যেতে চায়নি তো? উত্তাল উন্মত্ত যৌবনের মোহনা থেকে দূরে এসে ভাটার টানেও মণিকা ভালোবাসবে তো? নিজের মনপ্রাণ সত্তা দিয়ে ক্যাপ্টেনের কল্যাণ চাইবে তো?

ক্যাপ্টেন এখন নিশ্চিন্ত। মণিকাকে নিয়ে মনের দ্বন্দ্ব, শঙ্কা ভালোভাসার পলিমাটির তলায় বহুদিন আগেই চাপা পড়েছে। ওকে না পাবার জন্য মণিকার মনে অব্যক্ত ব্যথা, শূন্যতা ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে। বেশ লাগে। এতকাল তো ওর জন্য কেউ এমন শূন্যতা অনুভব করেনি। ভালো লাগবে না?

ক্যাপ্টেন নিজেও তো ওই একই ব্যথা বেদনা শুন্যতা অনুভব করছিল। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। রাজভবনের আকর্ষণ, সোসাইটির গ্ল্যামার, লাঞ্চ-ডিনার-ককটেলের হার্সিঠাট্টাতেও নিজেকে ভরিয়ে তুলতে পারছিল না। বড় বেশি অপূর্ণ, অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল। সবকিছু পেয়েও যেন ওর অভাব মিটছিল না। কিছুতেই না।

অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার পর কয়েকটা দিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। তারপর যখনই একটু সময় পেল, কাগজপত্র নিয়ে বসল মাকে চিঠি লিখতে। আর দেরি করতে পারল না, চাইল না। মার জ্বর হলে, সদ্যজাত শিশুরও জ্বর হয়, সর্দি লাগে। আজ আমি বড় হয়েছি। তোমার জ্বর হলে সর্দি লাগলে আমার হয় না। হতে পারে না। তোমার দুধ খেয়ে, কোলে চড়ে আমি বড় হয়েছি। আর ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে আমার স্বতন্ত্র সত্তা। জন্ম নিয়েছি আবার আমি। দূরের মানুষের কাছে আমি একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ। একটা পরিপূর্ণ সত্তা। কিন্তু তা কি হয়? সে কি সম্ভব। আজ আমার মুখে হাসি না দেখলে তোমার মুখে হাসি ফুটবে না, আমার দুঃখে তোমার চোখের জলের বন্যা বইবে। আমার মনের শূন্যতায় তোমার মনপ্রাণ হাহাকার করে। এসব তো আমি জানি। তাইতো তোমার মুখোমুখি হতে আমার এত ভয়, এত দ্বিধা।

আমি নিরুপায় হয়ে অদৃষ্টের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি তোমার চোখের জল মোছাতে পারব, মনের শূন্যতা, হাহাকার দূর করতে পারব। বহুদিন বহু বছর ভাবতে পারিনি। কলকাতা এসেও না। কিন্তু

এতক্ষণ বেশ লিখছিল। এবার ক্যাপ্টেন একটু থামল। একটা সিগারেট ধরাল। দু-একবার টান দিল। একটু ভাবল, একটু হাসল।

একটু লজ্জা করল নাকি।

হয়তো হবে। মা-র কাছে আবার লজ্জা কিসের? তাছাড়া অমন মা কজনের হয়?

সিগারেটটা অর্ধেক না খেয়েই ফেলে দিল। আবার লিখতে শুরু করল।

…তোমার অব্যক্ত ইচ্ছায় যে আমার জীবনটা এমন মোড় ঘুরবে ভাবতে পারিনি। প্রথমে বেশ কিছুকাল দ্বিধা ছিল, সঙ্কোচ, সন্দেহ ছিল। দীর্ঘদিন ধরে আপন মনে বিচার করেছি। তবুও মনে হচ্ছে, না জীবনটা সত্যিই মোড় ঘুরছে, মনে হচ্ছে মণিকাকে নিয়ে নতুন জীবন সম্ভব হতে পারে।

মণিকার সম্পর্কে তোমাকে বেশি কিছু লিখব না। তুমি নিজে এসে দেখবে, বিচার করবে। আমার দৃষ্টি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই তোমার দেখার শুরু হবে। আমার অদেখা, অজ্ঞাত তুমি দেখতে পারবে, জানতে পারবে।

কয়েকদিনের মধ্যেই গভর্নর দার্জিলিং যাচ্ছেন। আমিও ওর সঙ্গে যাব তবে দু একদিন পরেই ফিরব। কলকাতা দিয়ে অনেক ভি-আই-পি যাতায়াত করবেন এর মধ্যে। ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি ও আরো দুএকজন হয়তো এক রাত্রি রাজভবনের থাকতেও পারেন। সেজন্য আমাকে এখানে থাকতে হবে। তুমি ওই সময় এসো। মণিকাঁদের ওখানেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। ওর বাবা ডক্টর ব্যানার্জি ও মিসেস ব্যানার্জি নিশ্চয়ই খুশি হবেন।

একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি। মনে মনে দুজনেই অনেকটা এগিয়েছি। তবুও আমি কোনো পাকা কথা দিইনি, দিতে পারিনি। আর কাউকে না হোক মণিকাকেই তো সব কথাই বলতে হবে। আমার পক্ষে সেসব কথা বলা অসম্ভব। কোনোদিন কাউকে আমি ওই কাহিনি বলতে পারব না। সব কিছু শুনেও যদি ও রাজি হয় তাহলে ডক্টর ব্যানার্জি ও তার স্ত্রীকে বলা ভালো হবে।

মণিকা জানতে পারল না এই চিঠির কথা। ক্যাপ্টেন কিছু বলল না। দার্জিলিং যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ কাটিয়েছিল ওদের ওখানে। খাওয়া-দাওয়ার আগে ঘণ্টা খানেকের জন্য দুজনে একটু ঘুরতেও গিয়েছিল।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?

যেখানে খুশি।

কোথায় গেলে তুমি খুশি হবে?

আমাকে খুশি করার জন্য তোমার এত চিন্তা?

ক্যাপ্টেন সেকেন্ড গিয়ার দিয়ে একটু হাসতে হাসতে জানতে চাইল, তোমাকে খুশি করার জন্য আমার একটুও চিন্তা নেই?

মণিকাও হাসল। অভিমান-মেশা সামান্য বিদ্রুপের হাসি। আমাকে সুখী করা ছাড়া তোমার আর কি চিন্তা?

ক্যাপ্টেনের কাছে মণিকার অনেক আশা, অনেক দাবি। সে আশা, সে দাবি মেটাতে পারছে ক্যাপ্টেন। মণিকা যেন আর সহ্য করতে পারে না। অভিমান তো হবেই। হয়তো দুঃখও। লুকিয়ে লুকিয়ে দুফোঁটা চোখের জলও পড়তে পারে। মণিকার কথায় ইঙ্গিত পায় ক্যাপ্টেন।

থার্ড গিয়ার দিয়েই স্পীড দেয় না ক্যাপ্টেন। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাতে একটা সিগারেট বের করে দুটি ঠোঁটের মাঝে নেয়। নিউ আলিপুর ছাড়িয়ে বড় রাস্তা এসে গেছে। মিন্টটা একটু দূরেই। ক্যাপ্টেন দুএকবার চাইল মণিকার দিকে।

খুব রাগ করেছ?

কার ওপর রাগ করব?

তোমার এই ড্রাইভারের ওপর।

তোমার ওপর রাগ করবার কি অধিকার আমার?

সে প্রশ্নের জবাব পরে দেব! আগে স্বীকার কর রাগ করেছ।

বিন্দুমাত্রও না।

তবে যে লাইটারটা জ্বেলে ধরছ না?

মণিকা সত্যি এবার লজ্জা পায়। প্রফেসর মঙ চুরুট মুখে দিলেই ও লাইটার জালত। বেশ লাগত। ডক্টর ব্যানার্জির ওসব নেশাফেশা নেই, মণিকার লাইটার জ্বালার নেশাটাও বন্ধ ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে কাছে পাবার পর থেকেই আবার শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন সিগারেট তুলতে না তুলতেই মণিকা লাইটার জ্বেলে ধরত। অভিমানী মন খেয়াল করেনি ক্যাপ্টেনের মুখে সিগারেট। অভিমানী হলেও সে তো ওকে অবজ্ঞা করতে চায়নি।

মণিকা সঙ্গে সঙ্গে ত্রুটি স্বীকার করল, সরি, ক্ষমা কোরো।

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে মণিকার মুখের পর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ফাইনাল বিচারের রাত্রি সমাগতপ্রায়। তখনই তোমার বিচার হবে।

ঠিক বুঝতে পারে না মণিকা। তার মানে।

একটু ধৈর্য ধর।

বেহালা-ঠাকুরপুকুর পার হয়ে চলে গিয়েছিল ওরা। ড্যাসবোর্ডের আবছা আলোয় মণিকাকে বারবার দেখছিল ক্যাপ্টেন। লুকিয়ে লুকিয়ে আড়চোখে।

হঠাৎ ধরা পড়ে মণিকার কাছে। অমন করে বারবার কি দেখছ?

তোমাকে?

আমাকে কোনোদিন দেখনি?

নিশ্চয়ই দেখেছি।

তবে আবার অমন করে দেখছ কেন?

দেখছি তুমি আরো কত সুন্দর হয়েছ।

ঠাট্টা করছ?

ঠাট্টা করব কেন?

না, না। আর পারে না ক্যাপ্টেন। বাঁ হাতটা দিয়ে মণিকার একটা হাত চেপে ধরে। একটু চাপ দেয়। একবার তুলে নিয়ে নিজের মুখের পর দিয়ে বুলিয়ে নেয়। আর্মি অফিসারের পোশাক পরেও ক্যাপ্টেনের মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। একটু যেন অসংযত হয় মন।

তুমি জানো না মণিমালা, তুমি আমার কি উপকার করেছ…

মণিকা অবাক না হয়ে পারে না, মণিমালা? মণিমালা কে?

বলতে চায়নি, হঠাৎ মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে গেছে।

কে আবার? তুমি।

কই কোনোদিন তো মণিমালা বলে ডাকতে শুনিনি।

ভেবেছিলাম তোমার-আমার জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় রাত্রিতে তোমার নতুন নামকরণ করব।

মণিকা নিশ্চয়ই মনে মনে খুশি হয়। আপনমনে কি যেন ভাবে। হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনের একটু হিসাব-নিকাশ করে নেয়।

স্লো-স্পিডে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। এক হাতেই ক্যাপ্টেন স্টিয়ারিং ধরে আছে। দুএক মিনিট কেটে গেল।

মাণিক চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, সত্যি?

মিথ্যার পর ভিত্তি করে তো তোমাকে পেতে চাই না। সব সত্য জানিয়েই তোমাকে চাইব।

তার মানে?

আমার সব কথা তোমাকে জানাব না?

কেন আমি কি সব কিছু জানি না?

আমি জোচ্চর-লম্পটও তো হতে পারি।

মণিকা রেগে যায়। বাজে বকো না।

দুজনের কেউই আর এগোয়নি। গাড়ি ঘোরাবার পরই কথার মোেড় ঘোরাল ক্যাপ্টেন। আচ্ছা তুমি আমজাদ-রমজানকে কি বলেছ?

কি বলেছি?

ক্যাপ্টেন সরাসরি সে কথার জবাব দেয় না। একটু হাসে। একবার ভালো করে মণিকাকে দেখে। আমি সিগারেট খেতে খেতে ঘুমোই বলে এত দুশ্চিন্তা?

মণিকা জবাব দেয় না।

বাঁ হাত দিয়ে ক্যাপ্টেন মণিকাকে একটু কাছে টেনে নেয়। মণিকা আপত্তি করে না। আমার জন্য তুমি এত ভাব?

একটু চুপ করে থেকে মণিকা বলে, শুধু আমি কেন? আরো অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবেন।

অনেককেই আর কোথায় দেখলে?

এত কথা হল কিন্তু চিঠির কথা বলল না ক্যাপ্টেন। রাত্রে খেতে বসে মণিকার মাকে বলল, মাসিমা, এবার বোধহয় আমার মা আসছেন।

কবে আসছেন?

ঠিক জানি না তবে দুএক উইকের মধ্যেই।

মণিকা শুধু শুনল। কিছু বলল না।

ডক্টর ব্যানার্জি জানতে চাইলেন, তোমার বাবাও আসছেন?

বাবা যে কোনোদিন তার পুত্রের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না, সে কথা কি বলতে পারে? না। এখন তো ওঁর হাইকোর্ট ভোলা।

মিসেস ব্যানার্জি বললেন, তোমার মাকে আবার রাজভবনেই তুলো না যেন। আমাদের এখানেই…

তুমি বরং কালকেই ওর মাকে একটা চিঠি লিখে দিও।

স্বামীর প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন মিসেস ব্যানার্জি।

মনে মনে খুশি হলেও ক্যাপ্টেন বলল, না, না, ওসব ঝামেলার কি দরকার। মা আমার ওখানেই থাকবেন!

প্রতিবাদ করলেন ব্যানার্জি-দম্পতি, এতে আবার ঝামেলার কি আছে?

ওদের সামনে বেশ গাম্ভীর্য বজায় রাখলেও হঠাৎ ক্যাপ্টেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু মণিকা কি তা পছন্দ করবে?

জবাব দেবে কি মণিকা? লজ্জায় জিভ কেটে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে। ব্যানার্জি-দম্পতিও দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

কি আর করবে ক্যাপ্টেন? একটু স্বাভাবিক হবার জন্য মণিকার মাকে বলল, আচ্ছা মাসিমা, তিনজন নিয়েই তো আপনার সংসার। আপনি আর মেলোমশাই মাকে এখানে থাকার কথা বললেন অথচ মণিকা একটা কথা বলল না…।

আর মণিকা চুপ করে থাকে না। রাজভবনের স্টাফদের সবাই কি মিন-মাইন্ডেড হয়?

পরের দিনই ক্যাপ্টেন গভর্নরের সঙ্গে দার্জিলিং চলে গেল। লেফটন্যান্ট ভাটিয়াকে গভর্নরের সব প্রোগ্রাম বুঝিয়ে দিয়েই ক্যাপ্টেন ফিরে এলো তিন দিনের দিন।

ফিরে এসেই ডাক দেখল। মা-র চিঠি না দেখে মনে একটু খটকা লাগল ক্যাপ্টেনের। তবে কি মা-র মত নেই? না, না, তা কেমন করে হয়? আমার মা-কে আমি চিনি না। তবে কি মা অসুস্থ? নাকি বাবাকে নিয়েই আবার কিছু হল?

সেই ঘটনার পর বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই ক্যাপ্টেনের। নববর্ষ-বিজয়ার পোস্টকার্ডও আসে না, যায় না। মা-র চিঠিতে অনেক কথা, অনেক খবর থাকে কিন্তু বাবার বিষয়ে কিছু লেখেন না। তাইত বার বার ভাবছিল বাবাকে নিয়েই আবার কোনো ঝামেলা হল নাকি?

অন্যান্য চিঠিপত্র পড়তে না পড়তেই টেলিফোন এলো। গভর্নমেন্ট হাউস পি-বি-এক্স থেকে অপারেটর ফোন করছে। স্যার গতকাল এলাহাবাদ থেকে ট্রাংকল এসেছিল…।

অপারেটরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, কলিং পার্টি কে ছিল?

আপনার মা।

মা?

ইয়েস স্যার।

কি বললেন?

আমি বলছি আপনি আজ ফিরবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ।

খবরটা শুনে মনটা অনেক আশ্বস্ত হল কিন্তু শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। ভীষণ মাথা ধরেছিল। সারা গা-হাত-পা কেমন ব্যথা লাগছিল। এক কাপ কফি আর একটা স্যারিডন ট্যাবলেট খেয়ে একটু শুয়ে পড়ল। একটা সিগারেট ধরাল। দুচার টান দেবার পর আর সিগারেট খেতেও ইচ্ছা করল না। ফেলে দিল। ঘুমিয়ে পড়ল।

একটা নতুন বেয়ারা ডিনার এনে দরজা নক করল কয়েকবার। কোনো জবাব পেল না। ফিরে গেল। ট্রে ভর্তি ডিনার নিয়ে ফিরে যেতে দেখে আমজাদ জিজ্ঞাসা করল, সাব নেই হ্যায় কামরামে?

বোধহয় না। নক্ করেও জবাব পেলাম না।

আমজাদের সন্দেহ হল। এইতো একটু আগেই দার্জিলিং থেকে ফিরলেন। আবার এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন? এ-ডি-সি সব বাইরে গেল আমি তো দেখতে পেতাম। আমি দেখতে না পেলেও আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলে যেতেন।

চলিয়ে মেরে সাথ। সাব শো গ্যায়া হোগা।

আমজাদ নক্ করেও জবাব পেল না। তারপর হাতলটা ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। সব টায়ার্ড হয়ে শুয়ে পড়েছেন।

নতুন বেয়ারাটা টেবিলে খাবার রাখল। আমজাদ আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, সাব, সাব!

ক্যাপ্টেন অঘোরে ঘুমুচ্ছে!

আমজাদ আবার ডাকল, সাব, খানা তৈয়ার হ্যায়। সাব!

ওরা জানে ক্যাপ্টেনের ঘুম খুব পাতলা। একবার ডাকলেই উঠে পড়েন। শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো? সন্দেহ হল আমজাদের। আরো কয়েকবার ডাকল! তারপর একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই এ-ডি-সি সাহেবের কপালে হাত দিল আমজাদ। আপন মনেই বলে উঠল, সাব কা বুখার হুয়া।

দার্জিলিং কলকাতার ঠাণ্ডা গরমে এমন হতেই পারে। দুতিনদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায় কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেবকে তো দুতিনদিন শুয়ে থাকলে চলবে না। অনেক ভি-আই-পিকে তার রিসিভ-সি-অফ করতে হবে। আমজাদ ভেবে-চিন্তে ডাক্তার সাহেবকে খবর দিল।

ডাক্তার সাহেব একটু পরেই এলেন। ভালোভাবেই দেখলেন। না বুকে কোনো কমপ্লিকেশন নেই। সাডেন চেঞ্জ অফ ক্লাইমেট হয়েছে।

ক্যাপ্টেন বললে, কি কাণ্ড বলুন তো! এত রাত্তিরে আমজাদ আবার আপনাকে ডিসটার্ব করল।

না, না। ডিসটার্বের কি আছে? একটু হেসে বললেন, একটা ক্যাপসুল পাঠিয়ে দিচ্ছি একটু কিছু খাবার পর ওটা খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে আবার আসব।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল টেলিফোনের রিং শুনে। রিসিভারটা তুলতেই অপারেটর বলল, স্যার, ট্রাংকল ফ্রম এলাহাবাদ।

অনেক দিন বাদ মা-র সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। জানালেন, মণিকার মা-ও একটা সুন্দর চিঠি লিখেছেন। কালই জবাব দিয়েছি, হয়তো আজই পাবেন।

তুমি কি আসছ?

আসব না? আজই বোম্বে মেলে রওনা হচ্ছি তুই হাওড়ায় থাকবি তো?

ক্যাপ্টেন মজা করে বলল, আমাকে স্টেশনে যেতে হবে?

বাঁদরামি করিস না…

এলাহাবাদ ট্রাংক-অপারেটর জানাল, টাইম ইজ ওভার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *