১৩. খ্রিস্ট্রীয় মিশর

১৩. খ্রিস্ট্রীয় মিশর

উৎপীড়ন

সাম্রাজ্যের প্রথম শতাব্দীগুলিতে খ্রিস্টধর্মের প্রসার পরিপূর্ণভাবে মসৃণ ছিল না, বিরোধমুক্তও ছিল না। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী মতবাদ ছিল: সম্রাটের দাপ্তরিক মতবাদ, গ্রিক রহস্যময় ধর্মমত, মিশরের সেরাপিও এবং আইসিস আচার অনুষ্ঠান সবগুলি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।

এ সবের চাইতে শক্তিশালী ছিল মিথ্রীয়বাদ, উৎস পারসিক ধর্ম, যা ছিল মূলত সূর্য-দেবতার পূজা। অগাষ্টাস ও টাইবেরিয়াসের সময়ে রোমে এর একটি প্রতিকল্পের আবির্ভাব হয়েছিল। এর এক শতাব্দী পরে ট্রেজান ও হাড্রিয়ানের শাসনামলে এটি খুব প্রসিদ্ধি লাভ করে, প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত ধর্মমতগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়। ২০০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্য জরিপ করতে গিয়ে যে কেউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, যদি একটি ধর্মমত প্রাধান্য লাভ করতে চায় তাহলে তা হবে মিথ্রীয়বাদ, খ্রিস্টধর্ম নয়।

তবে মিথ্রীয়বাদের একটি ভয়ংকর ত্রম্নটি ছিল। এর আনুষ্ঠানিকতায় শুধু পুরুষরাই অংশগ্রহণ করতে পারত, মেয়েদেরকে সেখান থেকে বাদ দেওয়া হতো আর সেজন্য তারা প্রায়ই খ্রিস্টান হয়ে যেত। তারা শিশুদেরকে প্রতিপালন করত এবং তাদের ধর্মগ্রহণে উৎসাহিত করত। গ্রিক দর্শনেরও প্রবল প্রভাব ছিল এবং এ ব্যাপারে প্রটিনাস (জন্মসূত্রে একজন মিশরীয়) নামে এক দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন লাইকোপলিস নামে এক নগরে, যার অবস্থান ছিল হতভাগ্য ইখনাতনের শহর আখেতাতন থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ায় শিক্ষা লাভ করেন এবং এথেনীয় দার্শনিক প্লেটোর অনুকরণে এক নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটান, তবে সেটি নূতন ধর্মমতের দিকে অগ্রসরমান ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি যুক্তিবাদি গ্রিক চিন্তার সাথে রহস্যময় প্রাচ্য চিন্তার একটা সমম্বয় ঘটিয়েছিলেন যাকে বলা হয়েছিল নব্য- প্লেটোবাদ।

সাম্রাজ্যে প্রচলিত সকল ধর্মীয় মতবাদ ও দর্শনের মধ্যে খ্রিস্টধর্মই সর্বাপেক্ষা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল (যদি অবশ্য ইহুদিবাদকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিই)। খ্রিস্টীয়বাদ অন্য কোনো মতবাদের সাথে আপোস করতে রাজী ছিল না এবং নিজেকে একমাত্র সত্যধর্ম মনে করত।

অধিকন্তু প্রথম দিকে খ্রিস্টবাদ ছিল অত্যন্ত শান্তিবাদী। তারা পৌত্তলিক সম্রাটদের হয়ে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানাত (বিশেষ করে যেহেতু সম্রাটের সৈন্যদের সম্রাট পূজায় অংশগ্রহণ করতে হতো)। অপরপক্ষে তারা এই ধারণা পোষণ করত যে খ্রিস্টধর্মই একমাত্র ধর্ম যেখানে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন থাকবে না এবং এক আদর্শ সমাজের প্রতিষ্ঠা হবে। এতে করে অন্য মতাবলম্বীদের কাছে খ্রিস্টধর্ম অত্যন্ত অ-জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম দিকে খ্রিস্টানরা প্রবল উৎপীড়নের সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে নীরো ও ডমিশিয়ানের রাজত্বকালে। তবে তা ছিল তুলনামূলকভাবে স্বল্পস্থায়ী এবং বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি কিন্তু আলেক্সান্ডার সিভেরাসের হত্যার পর যে অরাজকতা শুরু হয় যখন সাম্রাজ্য নিজেই টালমাটাল, তখন খ্রিস্টানরা আবার অত্যাচারিত হতে থাকে।

২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্রাট ডিসিয়াস সারা সাম্রাজ্যে খ্রিস্টানদের উপর ব্যাপক অত্যাচারের নির্দেশ দেন এবং এতে করে খ্রিস্টানরা চরম সংকটে নিপতিত হয়। শুধু দুইটি বিষয় তাদেরকে বাঁচিয়েছিল প্রথমত খ্রিস্টানরা ছিল প্রবল ধর্মোন্মাদ এবং তাদের বিশ্বাসকে এত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরত যে তারা এ জন্য মরতেও রাজী ছিল। যাতে করে পরকালে তারা স্বর্গে মহাসুখ উপভোগ করবে। এ জন্য অসংখ্য খ্রিস্টানের বলিদান ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আর অনেকেই, যারা এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে তারা এই বিশ্বাসের গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। এই উৎপীড়নের ফলে যত লোক মারা গেছে তার চাইতেও বেশি করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এরূপ উৎপীড়ন দীর্ঘকাল ধরে চলতে পারে না এবং পরবর্তী ম্রাটগণ ধীরে ধীরে নমনীয় হতে শুরু করেন। ২৫৯ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিয়েনাস সম্রাট হলেন। তিনি ছিলেন প্রটিনাসের শিষ্য, যিনি তখন রোমে শিক্ষা দিচ্ছিলেন আর নব্য প্লেটোবাদের সহনশীলতা প্রচার করছিলেন। প্রটিনাস অনুভব করেছিলেন সত্য কখনো জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না এবং মিথ্যা যুক্তিবাদিতার শক্তির কাছে টিকে থাকতে পারে না। তাই খ্রিস্টানদের উপর চাপ অনেকটা হ্রাস পেল।

অবশ্য এক দশকের উৎপীড়ন অনেকটাই ছাপ ফেলে যায়। আলেক্সান্দ্রিয়ায় অনেক বিশপ নিহত হন, অরিগেনের উপর এত অত্যাচার করা হয় যে তিনি প্রাণে মারা না গেলেও দৈহিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং টায়ারে গিয়ে অবশেষে ২৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

অধিকন্তু একটি নমনীয় যুগের পরে আবার একটি উৎপীড়নের যুগ সৃষ্টি হয়, আর এক শতাব্দী ধরে খ্রিস্টানরা কখনো সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করতে পারেনি। ইহুদিদের মধ্যে ছিল একটি কৃসাধন গোষ্ঠী যারা মনে করত জীবনের কঠোরতা ঈশ্বর সাধনার জন্য অপরিহার্য, এবং পার্থিব প্রলোভন থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। ইহুদিদের মধ্যে অনেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করত এবং ভোগ বিলাস সম্পূর্ণরূপে পরিহার করত।

উৎপীড়নের যুগে খ্রিস্টানরা এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে এলিজা ইসরাইলের রানি জেবেলের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান। মেকাবিস, হেরড এবং রোমানরা কঠোর ইহুদি সম্প্রদায়ের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

তাহলে খ্রিস্টানরাই বা কেন নির্বাসনে যাবে না। এই পৃথিবী দুষ্ট, একে পরিহার করাই উত্তম। এই পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে পৌত্তলিকদের উৎপীড়নের মধ্যে থাকতে হবে এবং জীবন রক্ষার্থে খ্রিস্টধর্ম পরিত্যাগের লোভ আসতে পারে। তাই জঙ্গলে গিয়ে আত্মার পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।

মিশরের আবহাওয়া এমন যে, নিঃসঙ্গ নির্বাসনের জীবন সমাজ জীবনের চাইতে অধিকতর আকর্ষণীয়। নিকটবর্তী মরুভূমি নির্জন শান্ত, সেখানে হিমেল শীতের প্রাদুর্ভাব নাই, ঝড় বৃষ্টির শশনানি নাই। জীবনযাত্রা সরল নির্বিরোধ।

প্রথম নির্বাসনে যাওয়া মিশরীয়র নাম এন্থনি। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম আর বিশ বছর বয়সে তিনি কৃছু সাধনার সংকল্প গ্রহণ করেন। ২৮৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সমাজের প্রলোভন থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র পথ এবং সেজন্য তিনি নির্জন মরুভূমিতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।

তার ধার্মিকতা ও পবিত্রতার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকে তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার সিদ্ধন্ত নেয়। প্রতিবছর অনেক লোক মরুভূমিতে গিয়ে ঈশ্বরের সাধনায় আত্মনিবেদন করে আর এভাবেই কঠোর অত্মসংযমীদের দ্বারা মিশরের মরুভূমি পরিপূর্ণ হয়। তবে সবাই এন্থনির খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। প্রবাদ আছে যে তিনি ১৫০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এন্থনি খ্রিস্টধর্মে সন্ন্যাসবাদের প্রবর্তন করেন, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এভাবেই খ্রিস্টধর্মের আর একটি রূপকল্পের জন্ম হয়েছিল মিশরেই।

.

এরিয়ানগণ

২৮৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়ক্লিসিয়ান নামে একজন যোগ্য সেনাপতির সিংহাসনে আরোহণের পর রোমান সাম্রাজ্যের একটি নূতন পর্যায় শুরু হল। তিনি সাম্রাজ্যের খোলনলচে পালটে ফেলেন এবং অগাষ্টাস ও তার উত্তরাধিকারীদের রিপাবলিকান পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেন তার বদলে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের।

তার চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন যুগ্ম-ম্রাটের পদ সৃষ্টি করেন এবং তিনি ও তার সহযোগী-সম্রাটও সিজার নামে একজন করে সহকারীর নিয়োগ দান করেন। কাজেই সম্রাজ্যের প্রশাসন ও সামরিক কাজে চার জন অংশীদারের সৃষ্টি হল। পারস্য-ভীতি নিরসনের জন্য ডায়ক্লিসিয়ান মিশর এবং এশীয় প্রদেশগুলিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া মাইনরের একটি শহর নিকোমেডিয়ায় তার রাজধানী স্থাপন করেন।

তবে অরাজকতার পরিস্থিতি তখনও বিদ্যমান ছিল। সেনাধ্যক্ষরা তখনও অনুভব করতেন যে তাদের সেনাবাহিনীকে নিয়ে সুযোগ বুঝে তারাও নিজেদেরকে সম্রাট ঘোষণা করতে পারেন। একিলিয়ুস নামে মিশরের একজন সেনাপতি ২৯৫ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। আট মাস ধরে আলেক্সান্দ্রিয়া অবরোধ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা দখল করে একিলিয়ুসকে হত্যা করা হয়। ৩০৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের উপর চরম এবং সর্বশেষ নির্যাতন শুরু করেন ডায়ক্লিসিয়ান। ডায়ক্লিসিয়ানের উত্তরাধিকারী গ্যালিরিয়াসের শাসনকালেও প্রাচ্যে এই নির্যাতনের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে এবং স্বল্পমাত্রায় হলেও তার উত্তরাধিকারী লিসিনিউসের শাসনকালেও তা বলবৎ থাকে।

সাম্রাজ্যের পশ্চিমার্ধের শাসকরা সাধারণত খ্রিস্টধর্মের প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল ছিলেন। ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কনস্টান্টিন সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষমতাসীন হন। ধীরে ধীরে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ৩১২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি পুরো পশ্চিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। কনস্টান্টিন ছিলেন একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ আর তিনি ভাবলেন যদি খ্রিস্টানদের সমর্থন লাভ করা যায় (তখন পর্যন্ত তারা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ তবে সক্রিয় ও উচ্চকণ্ঠ), তাহলে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করা তার পক্ষে সম্ভব হবে। কাজেই তিনি লিসিনিয়ুসকে বাধ্য করলেন, তখন পর্যন্ত যিনি সাম্রাজ্যের পূর্বাধের ম্রাট, তিনি যেন “সহনশীলতার একটি আদেশ” জারি করেন যাতে সকল ধর্মের সমান অধিকার ঘোষণা করা হয়।

লিসিনিয়ুস এই আদেশটিকে বরং দুর্বল ভাবলেন এবং ৩২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম কনস্টান্টিনের কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত হলেন। এখনও খ্রিস্টান ধর্মের পরিপূর্ণ বিজয়ের অর্ধশতাব্দী বাকী রয়েছে তবে নির্যাতনকালের পরিসমাপ্তি ঘটেছে (এর তেরো বছর পরে তার মৃত্যুশয্যায় প্রথম কনস্টান্টিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন এবং তিনিই ছিলেন প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট)।

পৌত্তলিকদের দ্বারা উৎপীড়নের যুগের শেষ হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েই গেল। খ্রিস্টানদের মধ্যে সবসময় মতভেদ বিদ্যমান ছিল। এমনকি খ্রিস্টধর্ম প্রসারের শুরুতে পলের উপাখ্যানেও এই মতভেদের কথা লিপিবদ্ধ আছে। খ্রিস্টানরা যখন অবিরাম নির্যাতনের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত তখন শুধু ক্রুদ্ধ বাকবিতণ্ডা ছাড়া বেশি কিছু ছিল না। তবে রোমান সম্রাটের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর তারা বিভিন্ন পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে আর যারা ম্রাটের পক্ষে থাকত তারাই হতো অধিক শক্তিশালী। তাই খ্রিস্টানরা বিধর্মীদের দ্বারা উৎপীড়িত না হলেও নিজেরাই এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর নির্যাতন চালাত।

খ্রিস্টীয় চিন্তাধারার প্রধানতম কেন্দ্র হিসাবে আলেক্সান্দ্রিয়া এই বিবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এটা সত্য যে প্রথম কনস্টান্টিনের সময় যিশুর চরিত্র নিয়ে একটা তিক্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল তিনি কোনো দৈবী শক্তির অধিকারী কি না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, যাদের বলা যায় ঐক্যবাদী, যিশু মোটেই কোনো দৈবী শক্তির অধিকারী ছিলেন না। তাদের মতে ঈশ্বর মাত্র একজন এবং তিনি ওল্ড টেষ্টামেন্টের ঈশ্বর। যিশু হলেন একজন সৃষ্ট মানব, তিনি যেই হোন না কেন ঈশ্বর নহেন। যিশু শ্রেষ্ঠ মানব হতে পারেন, পবিত্রতম পয়গম্বর হতে পারেন, স্বর্গীয় আলোকে উদ্দীপ্ত শিক্ষক হতে পারেন তবে কোনোক্রমেই ঈশ্বর নন।

অন্যপক্ষের মতে ঈশ্বরের তিনটি রূপ যা সব দিক দিয়ে সমকক্ষ এবং তারা অনন্তকাল বিদ্যমান ছিল। এর একজন হলেন পিতা, যিনি প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা আর একজন পুত্র, যিনি যিশুরূপে শরীর ধারণ করেছেন; আর একজন পবিত্র আত্মা, যিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে আছেন, যার সাহায্য ব্যতিত কোনো মানুষই কর্মক্ষম থাকতে পারে না। ঈশ্বরের এই তিন রূপকে একত্রে বলা হয়েছে “ট্রিনিটি” (একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ত্রিমূর্তি)।

এই ট্রিনিটিবাদের প্রধান প্রচারক হলেন এরিয়াস নামে এক আলেক্সান্দ্রীয় পুরোহিত। তার মতবাদের প্রচার এতই দৃঢ় ছিল যে তার নামে এই মতবাদকে বলা হয়েছে এরিয়ানিজম, আর যারা এই মতের সমর্থক তাদের বলা হয় এরিয়ান। আলেক্সান্দ্রিয়ান ছাড়াও প্রথম কনস্টান্টিনের সময়ে এই মতবাদের সবচেয়ে বেশি সমর্থক ছিল এশিয়া মাইনরে। মিশর তখনও নস্টিকবাদের ছায়ায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, যাতে বলা হয়েছে যিশু একজন পবিত্র আত্মা তিনি মোটেই দেহধারী নন, তিনি একাধারে স্বর্গীয় এবং মানবীয়।

অধিকাংশ আলেক্সান্দ্রীয়রাই ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল এবং আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ আলেক্সান্ডারকে সবসময় উসকে দেওয়া হতো এর বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি কঠোর হতে। ৩২৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আলেক্সান্ডার বিশপদের একটি সম্মেলন (সিনোড) আহবান করেন। যারা সরকারিভাবে এরিয়ানদের মতবাদকে নিন্দা করেছিল, তবে এরিয়াস এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি।

ঠিক এই সময়ে কনস্টান্টিন সাম্রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন এবং তার কাছে ব্যাপারটি নিষ্পত্তির জন্য একটি আবেদন জানানো হয় (বিশপরা হয়তো তার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নাও ভাবতে পারেন তবে তা অমান্য করার সাহসও কারও ছিল না)। এই ব্যাপারে কনস্টান্টিন তার মতামত প্রদানে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি এই ধর্মীয় বিরোধের ভালোমন্দ নিয়ে মোটেই ভাবিত ছিলেন না। তবে তিনি এর রাজনৈতিক বিপদ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান সমর্থনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং সেই জন্যই খ্রিস্টানদের খ্যাপাতে চাননি। তবে খ্রিস্টানরা নিজেরাই যদি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সমর্থন তেমন কাজে আসবে না। হয়তো তার প্রতিপক্ষ বিরোধী উপদলকে সমর্থন করে সিংহাসনের দিকে হাত বাড়াতেও পারে।

তাই ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কনস্টান্টিন রাজধানী নিকোমেডিয়ার পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণে নিশিয়া নগরে বিশপদের এক বিশাল সম্মেলন আহবান করেন এবং বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার আদেশ দেন। এটাই ছিল খ্রিস্টধর্ম সংক্রান্ত প্রথম কাউন্সিল, যেখানে সমগ্র সাম্রাজ্য থেকে বিশপরা যোগদান করেছিলেন।

বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়, যদিও কাগজ কলমে। কাউন্সিল থেকে একটি ফর্মুলার পক্ষে মতদান হয় (নিসিন মতবাদ) যা সমগ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে মান্য করতে হবে। এই সম্মেলনে ট্রিনিটিবাদকে গ্রহণ করা হয়। এরিয়াস এবং গোড়া এরিয়ানদের অনেককে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

তাত্ত্বিকভাবে হলেও ট্রিনিটিবাদকে সমগ্র খ্রিস্টান জগতে গ্রহণ করা হয়, সর্বজনীন চার্চ অথবা গ্রিক ভার্সনে সর্বজনীন ক্যাথলিক চার্চ। কাজেই ট্রিনিটিবাদের সমর্থকদের বলা হয় ক্যাথলিক আর এরিয়ানদেরকে আখ্যায়িত করা হয় ধর্মদ্রোহীরূপে।

৩২৫ খ্রিস্টাব্দে মনে হয় আলেক্সান্দ্রিয়া গুরুত্বের একটি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। রোমেরই বরং একটি পশ্চাৎ আসন লাভ হয়েছিল। ডায়ক্লিসিয়ানের সিংহাসন আরোহণের পূর্বে অর্ধশতাব্দীব্যাপী যে নৈরাজ্য বর্তমান ছিল তাতে রোমের সম্পদ এবং সম্মান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৭১ খ্রিস্টাব্দে অরেলিয়ান রোমে প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। যাতে প্রমাণ হয় রোম নগরী শত্রুর আশঙ্কামুক্ত ছিল না।

তারপর যখন ডায়ক্লিসিয়ান নিকোমেডিয়ায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন তখন রোমের আরও অবনতি ঘটে কারণ এটা আর সম্রাটের আবাসস্থল রইল না। নিকোমেডিয়াও আকার আয়তনে তেমন গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি। নতুন সম্রাটের উপস্থিতি সত্ত্বেও এটা শুধু একটি প্রাদেশিক শহরই রয়ে যায়।

.

কনস্টান্টিনোপল

প্রথম কনস্টান্টিনের একটি পদক্ষেপ আলেক্সান্দ্রিয়ার অবস্থান টলায়মান হয়ে পড়ে। তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য তিনি যে জায়গাটি নির্বাচন করেন সেটি এশিয়া মাইনরের ইউরোপীয় প্রান্তে যেখানে হাজার বছর ধরে একটি গ্রিক নগরী বাইজেন্টিয়াম অবস্থিত ছিল।

এই রাজধানী নির্মাণে কনস্টান্টিন চারটি বছর ব্যয় করেন এটিকে বিশাল বিলাসবহুল করার জন্য; আর এ জন্য তিনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য নগরগুলির বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলি তার নতুন রাজধানীতে সরিয়ে আনেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমলা এবং অভিজাত সম্প্রদায়কে তার নতুন রাজধানীতে আকৃষ্ট করা। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে এই নতুন নগরকে কনস্টান্টিনের নামে উৎসর্গ করা হয় এবং তার নামকরণ করা হয় কনস্টান্টিনোপল (কনস্টান্টিনের নগরী)। আলেক্সান্দ্রিয়া আবারও হঠাৎ করেই দ্বিতীয় অবস্থানে চলে গেল, কারণ নতুন নগরীটি দ্রুতগতিতে সম্পদ, জৌলুস এবং জনসংখ্যায় সবাইকে অতিক্রম করে গেল এবং পরবর্তী হাজার বছর ধরে খ্রিস্টান জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ নগরীর মর্যাদা নিয়ে টিকে রইল।

আলেক্সান্দ্রিয়ার অবস্থান আগের যে কোনো সময়ের চাইতে অধিক সংকটের সম্মুখীন হল। রোমের কাছে দ্বিতীয় অবস্থানে যাওয়া যে নগরী বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পরিবর্তে শুধু পেশীশক্তিতে এগিয়ে ছিল তা আলেক্সান্দ্রিয়ার জন্য অবমাননাকর।

এরপর যে সব ধর্মীয় বিরোধ ছিল তা আরও তিক্ত হয়ে দেখা দিল এবং সে বিরোধ কেন্দ্রিভূত হল কনস্টান্টিনোপল ও আলেক্সান্দ্রিয়া এই দুই নগরীর মধ্যে।

নিকিয়ায় এরিয়ানরা পরাজিত হয়, তবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এশিয়া মাইনরের কিছুসংখ্যক বিশপ এরীয় মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইউসেবিয়াস, যিনি ছিলেন নিকোমেডিয়ার বিশপ।

কনস্টান্টিনোপলে দ্রুত তার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। শীঘ্রই কনস্টান্টিন আফসোস করতে থাকেন এজন্য যে নিকিয়াতে বিশপদেরকে এতটা প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেন বিশপদের কার্যকলাপ খ্রিস্ট জগতের মতবিরোধ দূর করতে সক্ষম নয়। প্রকৃতপক্ষে এশিয়া মাইনর ও তন্নিকটবর্তী প্রদেশসমূহের খ্রিস্টানরা এরিয়ানবাদকেই সমর্থন করেন আর কনস্টান্টিন এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাননি।

অতএব ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি টায়ারে বিশপদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন এবং নিকিয়ায় গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বলেন। এরিয়াস তার পদে পূনর্বহাল হন (তবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরি হওয়ার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং হঠাৎ করেই এরিয়ানবাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটে)। তবে এতে করে ক্যাথলিক মতবাদের মৃত্যু ঘটেনি যা আলেক্সান্দ্রিয়ায় টিকে থাকে।

এক দশক পূর্বে এথেনীসাস নামে একজন যুবক পুরোহিত আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ আলেক্সান্ডারের সেক্রেটারী হিসাবে নিকিয়ার কাউন্সিলে যোগ দেন। ৩২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলেক্সান্ডারের উত্তরাধিকারী হিসাবে বিশপের পদ লাভ করেন। তিনি ক্যাথলিক ত্রিত্ববাদের একজন উচ্চকণ্ঠ সমর্থকরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। টায়ারের সিনোডের সিদ্ধান্ত অনুসারে এথেনিসাসকে নির্বাসন দেওয়া হয় তবে তার কণ্ঠরোধ করা যায়নি।

৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কনস্টান্টিনের মৃত্যুর পর তার তিন পুত্র সাম্রাজ্যের তিনটি অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। মধ্যমপুত্র দ্বিতীয় কনস্টান্টিউস পূর্ব সাম্রাজ্যের অধিকারী হন। তিনি ছিলেন এরিয়ানবাদের একজন প্রবল সমর্থক এবং ৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইউসেবিয়াসকে কনস্টান্টিনোপলের প্রধান বিশপ নিয়োগ করেন। স্বাভাবিকভাবেই ইউসেবিয়াস এবং তার উত্তরাধিকারীরা অনুভব করেন যে খ্রিস্টধর্মের রাজকীয় নগরের বিশপ হওয়ার কারণে তারাই হবেন চার্চের প্রধান (এই একই কারণে রোমের বিশপরাও এই ধারণা পোষণ করত যার কারণে খ্রিস্টধর্ম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে যা বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে আছে)।

ইউসেবিয়াস এবং এথেনিসাস মতবাদগত কারণেই যে শুধু বিভক্ত হয়েছিল তাই নয়, প্রকৃত ক্ষমতা দখলই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। দ্বিতীয় কনস্টান্টিয়াসের শাসনকালে এথেনিসাস অধিকাংশ সময়ই নির্বাসনে ছিলেন। ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে কনস্টান্টিয়াসের ভ্রাতারা যখন মৃত এবং অন্যান্য ক্ষমতার দাবিদাররাও পরাজিত ও নিহত তখন দ্বিতীয় কনস্টান্টিয়াস সমগ্র সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে বসেন। এতে করে মনে হয় এরিয়ানবাদেরই পরিপূর্ণ জয়লাভ ঘটবে।

তবে কনস্টান্টিয়াস চিরজীবী ছিলেন না। ৩৬১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুস্পুত্র জুলিয়ান উত্তরাধিকার লাভ করেন (খ্রিস্টধর্মে শিক্ষা লাভ করেও তিনি নিজেকে একজন পৌত্তলিক বলে ঘোষণা করেন)। অবিলম্বে তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বুঝতে পারেন বিভিন্ন খ্রিস্ট্রীয় সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা দিলে তারা পরস্পরকে কামড়াকামড়ি করে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে।

জুলিয়ান যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন তেমনটা ঘটেনি। তিনি দুই বছরেরও কম সময় ক্ষমতায় টিকে ছিলেন এবং ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। খ্রিস্টানরাও এ সময় বুঝতে পারে যে নিজেদের মধ্যে বিরোধে লিপ্ত থাকলে পৌত্তলিকদের উত্থান ঘটবে, তাই তারা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। জুলিয়ানের স্বল্পকালীন শাসনকালে এরিয়ানদের ক্ষমতা হ্রাসে সাহায্য করেছিল। জুলিয়ানের আদেশে ক্যাথলিক বিশপরা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে স্বপদে বহাল হতে পেরেছিল। এমনকি এথেনিসাসও আলেক্সান্দ্রিয়ায় ফিরে এসেছিলেন (যদিও দীর্ঘকালের জন্য নয়)। ক্যাথলিকরা স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদেরকে আর নতুন করে টলানো সম্ভব ছিল না, কারণ পরবর্তী সম্রাটরা দ্বিতীয় কনস্টান্টিয়াসের মতো এরিয়ানবাদের তেমন গোড়া সমর্থক ছিলেন না।

৩৭৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এথেনিসিয়াসের মৃত্যুর পর পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় ক্যাথলিক মতবাদ বিজয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সে বিজয় অর্জন হয়েছিল ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে, যখন প্রথম থিওডোসিয়াস স্রাট হলেন। তিনি ছিলেন একজন গোড়া ক্যাথলিক, যতটা গোড়া এরিয়ান ছিলেন দ্বিতীয় কনস্টান্টিয়াস। ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনস্টান্টিনোপলে একটি খ্রিস্ট্রীয় ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করেন।

এরিয়ানবাদকে আবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, আর এবার রাষ্ট্রশক্তি পূর্ণশক্তিতে ক্যাথলিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এরীয় এবং অন্যসব বিধর্মী সম্প্রদায়ের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাদের গীর্জা অধিকার করে নেওয়া হয়। ক্যাথলিক মতবাদের বাইরে অন্যান্য খ্রিস্ট্রীয় সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চার কোনো অধিকার রইল না।

এবার কনস্টান্টিনোপলের উপর বিজয় হলো অন্ততপক্ষে সাম্রাজ্যের সীমার মধ্যে (কিছু জার্মান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এরিয়ানবাদ টিকে ছিল প্রায় তিন শতাব্দী ধরে যারা শীঘ্রই স্রোতের মতো রোমান সাম্রাজ্যে চলে আসতে থাকে)।

প্রথম থিওডোসিয়াস যেমন পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে তেমনি খ্রিস্টান ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও খড়গহস্ত ছিলেন। ৩৮২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমার্ধের সহ-সম্রাট গ্রেশিয়ান সিনেট থেকে পৌত্তলিক বেদী অপসারণ করেন এবং পৌত্তলিক পুরোহিতদের পন্টিফেক্স মেক্সিমাস পদবী পরিত্যাগ করান। ৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে থিওডোসিয়াস অলিম্পিক ক্রীড়ার সমাপ্তি ঘোষণা করেন যা প্রায় বার শতাব্দী ধরে পৌত্তলিক গ্রিকদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব ছিল। তারপর ৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে বর্বর আক্রমণকারীদের (যারা ছিল এরিয়ান খ্রিস্টান), তারা এথেন্সের কাছে সেরিস-এর মন্দির ধ্বংস করে। এতে করে গ্রিকদের শ্রদ্ধেয় ধর্ম-বিশ্বাস এলুসিয়ান রহস্যের চির-অবসান ঘটে।

তবু যে ভাবেই হোক না কেন পৌত্তলিকতার কিছু অবশেষ রয়ে যায়। গ্রীসের দার্শনিকরা দ্বিধাগ্রস্ত একাডেমিক (এথেন্সের স্বর্ণযুগে প্লেটোর দ্বারা যে একাডেমী প্রতিষ্ঠা) স্রোতাদের নিকট পৌত্তলিক মতবাদ প্রচার করতে থাকে। বহুযুগের মিশরীয় ধর্মও রেহাই পায়নি। একটু একটু করে মিশরের জনগণ অসিরিস থেকে যীশু, আইসিস থেকে মেরী বহুসংখ্যক দেবতা থেকে অসংখ্য সাধুতে পরিবর্তন করে। অনেক প্রাচীন মন্দির অবহেলায় পড়ে থাকে অথবা গীর্জায় পরিবর্তন করা হয়। ধ্বংসের শেষ সুর স্পষ্টভাবে শোনা যায় ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে যখন আলেক্সান্দ্রিয়ায় ছয় শতাব্দী টিকে থাকার পর ম্রাটের আদেশে সেরাপিয়ন ধ্বংস করা হয়।

আলেক্সান্দ্রিয়ার ভাগ্যে এর চেয়েও বড় দুর্ভোগ ছিল। আলেক্সান্দ্রিয়ার সবচেয়ে বড় পৌত্তলিক দার্শনিক শিক্ষক ছিলেন হাইপেসিয়া। সিরিল তাকে বিপজ্জনক ভাবত। ৪১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ নিযুক্ত হন অংশত তার আকর্ষণীয় দার্শনিক এবং অংশত একজন ধর্মনিরপেক্ষ মিশরীয় কর্মকর্তার সাথে তার সম্পর্কের কারণে।

ধারণা করা হয় সিরিলের উস্কানিতেই ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে একদল উত্তেজিত সাধু হাইপেশিয়াকে হত্যা করে এবং তারা আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির অনেক কিছুই ধ্বংস করে দেয়। যেভাবে এক শ্রেণীর খ্রিস্টান পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল তাতে মানব সমাজে এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। তবু সিরিলের সময়ে প্রাচীন ধর্মের কিছু কিছু অবশেষ টিকে ছিল।

অনেক দক্ষিণে প্রথম প্রপাতের কাছে ফাইলি দ্বীপে দ্বিতীয় নেকটানোর নির্মিত আইসিসের একটি মন্দির সাত শতাব্দী ধরে টিকে ছিল। দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফাস এবং ক্লিওপেট্রা এটা পূনর্নির্মাণ করেছিলেন। পৃথিবী যখন খ্রিস্টধর্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও সেখানে স্বর্গের রানির মৃদু হাসি দেখা যাচ্ছিল এবং গোপনে প্রাচীন আচার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো।

.

মনোফাইসাইটগণ

আলেক্সান্দ্রিয়া দীর্ঘস্থায়ীভাবে কনস্টান্টিনোপলের প্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ চলতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে জন ক্রিস্টেম কনস্টান্টিনোপলের বিশপ নিযুক্ত হন। সুন্দর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তার একটি উপাধি ছিল সোনালি মুখ।

তার বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল বিলাসিতা ও অমরত্বের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে তিনি এমনকি শ্রাজ্ঞীকেও ছাড় দেননি। বিরক্ত হয়ে স্রাজ্ঞী ক্রিসোস্টমকে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি থিওফাইলাসকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে যান যিনি ছিলেন সিরিলের পূর্বসূরি আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ। কিছু কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পেরেছিলেন, আর নির্বাসনে ক্রিস্টেমের মৃত্যু হয়। আলেক্সান্দ্রিয়া আরও একবার বিজয় লাভ করল। এটা অবশ্য ব্যক্তিত্বের বিরোধ ছিল। তাত্ত্বিকতার বিরোধ ছিল দুটি নগরের মধ্যে।

৪২৮ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া থেকে আগত একজন পুরোহিত দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস কর্তৃক রোমের বিশপ নিযুক্ত হন। এই সম্রাটের অধীনে এরিয়ান ও অন্যান্য বিধর্মীদের অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। নেস্টোরিয়াস যীশুকে কেন্দ্র করে আর একটি বিবোধ উসকে দেন। এটি একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিশ্বাস যে যিশুর একটি স্বর্গীয় রূপ ছিল। এবার এরিয়ানবাদের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটায় তার একটি মানবিক রূপ প্রকাশ পায় আর প্রশ্ন দেখা দেয় এই দুটি রূপের কিভাবে সমন্বয় করা যায়।

নেস্টোরিয়াস এই মতবাদ পোষণ করতেন যে এই দুটি রূপ সম্পূর্ণ পৃথক এবং মেরী শুধু মানবিক রূপেরই মাতা ছিলেন, স্বর্গীয় রূপের নয়। তাকে খ্রিস্টের মাতা বলা যেতে পারে, ঈশ্বরের মাতা নয়। এই মতবাদকে বলা হয়েছে নেস্টোরীয়বাদ।

একে বলা যায় এরিয়ানবাদরে দিকে পিছন ফিরে চলা এবং আলেক্সান্দ্রিয়ায় এই মতবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। আলেক্সান্দ্রিয়ার সিরিল ছিলেন একজন অক্লান্ত শত্রু। দ্বিতীয় থিয়ডোসিয়াস ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর উপকূলের একটি শহর ইফেসাসে একটি ধর্ম সম্মেলন আহ্বান করেন। এই কাউন্সিলে বিভিন্ন মতবাদী বিশপদের সমাবেশ ঘটে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরিল তার প্রাধান্য বিস্তার করেন এবং নেস্টোরীয়বাদ বেআইনী ঘোষণা করা হয়। নেস্টোরিয়াসকে তার নিজ পদ থেকেও অপসারণ করা হয় এবং মিশরে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পর পর তিনটি ধর্ম সম্মেলনে আলেক্সান্দ্রিয়ার বিজয় লাভ হয়।

তবু এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ায় নেস্টোরীয়বাদ টিকে থাকে আর এর বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্রীয় পীড়ন অসহনীয় হয়ে উঠে তখন এই মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা দেশত্যাগ করে পারস্যে চলে যায়। ঘটনাক্রমে তারা সুদূরপ্রাচ্যে চীন পর্যন্ত গ্রিক সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়।

তবে ইউটেকিস নামে কনস্টান্টিনোপলের একজন পুরোহিত বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তার মতে যিশু একটিমাত্র স্বরূপ আর তা হলো স্বর্গীয়। তিনি শুধু মানবিক রূপ ধারণ করেছিলেন। এটাই মনোফাইসাইট (অভিন্ন প্রকৃতির গ্রিক প্রতিশব্দ) মতবাদের ভিত্তি, মিশরে যে দৃষ্টিভঙ্গিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল আর কনস্টান্টিনোপলে একে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা হয়।

আলেক্সান্দ্রিয়ার সিরিল ৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন আর তার উত্তরাধিকারী কঠোরভাবে মনোফাইসাইট মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিবাদ বিপজ্জনক রূপ নেয় এক শতাব্দী পূর্বে এরিয়ান প্রশ্নে যেমনটা ঘটেছিল, এবং দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে এটা সামাল দেওয়া যাবে।

দুই রূপের তত্ত্ব কনস্টান্টিনোপল আর রোমেও গৃহীত হয়েছিল এবং এটা গোড়া ক্যাথলিক রূপ লাভ করে এবং অখণ্ডরূপী মনোফাইসাইটবাদকে ধর্মদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউটেকিসকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

এই পরাজয়কে আলেক্সান্দ্রিয়া সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। একগুয়েমিভাবে মনোফাইসাইটবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকে, বিশেষ করে যেহেতু কনস্টান্টিনোপল এর বিপরীত মতবাদ পোষণ করত।

প্রথম থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পর সামরিক বিপর্যয়ের ফলে সাম্রাজ্যে ধর্মীয় অনৈক্য (একের পর এক ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও) আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। তার মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের একজন পূর্বার্ধে এবং অপরজন পশ্চিমার্ধে শাসনভার লাভ করেন এবং এরপর সাম্রাজ্য আর কখনোই পুনরেকত্রিত হতে পারেনি। বাস্তবক্ষেত্রে দুইটি অর্ধাংশ হয়ে রয়ে যায়। একাংশ উল্লেখিত হয় পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং অপরাধ পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যরূপে। দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস এবং মার্সিয়ান যারা যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ ধর্মীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন তারাই পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে ম্রাট হন। অবশ্য মিশরও পূর্ব সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।

পশ্চিম সাম্রাজ্যকেই এই বিপর্যয়ের অধিকতর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। প্রথম থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পরবর্তী শতাব্দীতে হুণ এবং বিভিন্ন জার্মান উপজাতীয়গণ সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রদেশগুলির উপরে চড়াও হয়। ভেন্ডাল নামে একটি জার্মান উপজাতি স্পেনের সংকীর্ণ প্রণালী পার হয়ে আফ্রিকায় ঢুকে পড়ে এবং কার্থেজকে কেন্দ্র করে একটি রাজ্য গঠন করে। পূর্ব সাম্রাজ্যের কোনো কোনো প্রদেশেও অভিযান চলে। মিশর অবশ্য অধরাই রয়ে যায়। এই শতাব্দীব্যাপী হট্টগোলের মধ্যেও যেখানে শান্তি বজায় ছিল।

৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম নোম সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এই অর্থে যে, শেষ শাসক হিসাবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তার পদচ্যুতি ঘটে। পূর্ব সাম্রাজ্য অখণ্ড রয়ে যায়। এক সময় মনে হয় যা কিছু হারিয়েছিল তার সবই পুনরুদ্ধার সম্ভব। একজন সক্ষম ম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পূর্ব দিকে তার সেনা অভিযান প্রেরণ করেন বর্বরদের হাত থেকে পূর্ব সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলিকে উদ্ধার করার জন্য।

সেই বাহিনী উত্তর অফ্রিকায় ভেডাল রাজত্ব ধ্বংস এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। ইতালী এবং স্পেনের অংশবিশেষ দখল করা হয়। এক সময় মনে হয় বর্বরদের জোয়ার সম্পূর্ণরূপে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, দুই শতাব্দী পূর্বে যেমনটা ঘটেছিল অরেলিয়াসের সময়।

তবে পশ্চিমের বিজয় জাস্টিনিয়ানের সংকট ঘনীভূত করে তুলেছিল, বিশেষ করে ধর্মীয় প্রেক্ষিতে। জাস্টিনিয়ান ছিলেন একজন উৎসুক ক্যাথলিক এবং তার অধীনে পৌত্তলিকতার চিহ্ন মুছে যায়। ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে নয়শ বছর ধরে বর্তমান এথেন্সের একাডেমী তিনি বন্ধ করে দেন, আর বিমর্ষ দার্শনিকরা দেশত্যাগ করে পারস্যে চলে যান। এই শতাব্দীতেই আইসিস এবং কাইলির মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয় আর এতে করে চার সহস্রাব্দ পূর্বে মেনেসের আমলে প্রচলিত প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের সমাপ্তি ঘটে। জাস্টিনিয়ান ইহুদি এবং পৌত্তলিকদের সাথেও কঠোর ব্যবহার করেন।

তবে মনোফাইসাইটদের ভাগ্যে কি ঘটল? মিশর এবং সিরিয়ায় মনোফাইসাইটবাদ ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। সেখানে জাস্টিনিয়ানরা তেমন পাত্তা পায়নি। জাস্টিনিয়ানের স্ত্রী থিওডোরা তার স্বামীর বিপরীতে মনোফাইসাইটীয়দের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে তা ছিলেন না। অধিকন্তু, পশ্চিমে তার নতুন বিজিত স্থানগুলি মনোফাইসাইটীয়দের ঘোর বিরোধী ছিল এবং এই ধর্মদ্রোহের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাত।

জাস্টিনিয়ান চাননি পশ্চিমে বিজিত স্থানগুলিতে ক্ষোভের সৃষ্টি করতে এবং মিশর ও সিরিয়ার মতো সম্পদশালী প্রদেশগুলিতে তার অবস্থান দুর্বল করতে। ৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনস্টান্টিনোপলে পঞ্চম ধর্ম সম্মেলনের আহবান করেন। সেখানে তিনি মনোফাইসাইটীয়দের কিছুটা হলেও শান্ত করে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য তিনি আলেক্সান্দ্রিয়া ও রোমের বিশপদের উপরে রাজকীয় শক্তি প্রয়োগ করেন। তবে এটা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। পশ্চিমের খ্রিস্ট সমাজ এবং মিশর ও সিরিয়ার খ্রিস্ট সমাজ আপোসরফায় মোটেই রাজী হয়নি।

বাস্তবিকপক্ষে জাস্টিনিয়ানের প্রচেষ্টার ফলে মনোফাইসাইটীয় মতবাদ মিশর ও সিরিয়ায় জাতীয় আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় রাজকীয় চাপের ফলে গ্রিকরা কনস্টান্টিনোপলীয় অবস্থানের দিকে ঝুঁকেছিল। অপরপক্ষে মিশরীয়রা আরও দৃঢ়ভাবে মনোফাইসাইটীয়বাদকে ধারণ করে। এমনকি তারা কনস্টান্টিনোপল ও আলেক্সান্দ্রিয়ায় প্রচলিত গ্রিক ভাষা পরিত্যাগ করে প্রার্থনায় নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে।

এই স্থানীয় ভাষাকে বলা হয় কপ্টিক (ঈজিপ্টিক শব্দের বিকৃত রূপ) এবং মনোফাইসাইটীয় চার্চকে কপ্টিক চার্চ বলে আখ্যায়িত করা হয়। একভাবে বলতে গেলে বলা যায় কপ্টিক চার্চ মিশরের পুনরুত্থান সূচনা করে। বহুশতাব্দী বিদেশিদের অধীনে থাকায় মিশর তার পরিচয় ধরে রাখার জন্য তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে অবলম্বন করে। এসিরীয়া, পারস্য, গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির স্রোতের মধ্যেও মিশরীয়রা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করেনি।

শুধু খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবেই মিশরীয়রা নতিস্বীকার করে এবং বহিরাগত একটি প্রভাব অবলম্বনে বাধ্য হয়। এমনকি এখানেও খ্রিস্টধর্মের উপরে তাদের নিজস্ব জীবনধারার ছাপ রেখে দিতে চেষ্টা করে। অবশেষে তাদের নিজেদের মতো একটি ব্যবস্থা খুঁজে পায়। মিশরের কন্টিক চার্চ পূর্বের গ্রিক ও পশ্চিমের ল্যাটিন খ্রিস্টীয়বাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী প্রতিআক্রমণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *