কয়েক দিন অনবরত বৃষ্টি হয়েছে। সব রাস্তায় পানি। এই পানি আরো বাড়বে, কারণ আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হবে। এ বছরে বৃষ্টি বিকেলের দিকে হচ্ছে। সারাদিন আকাশ থাকে মেঘশূন্য। অফিস আদালত ছুটি হবার আগে আগে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে।
আমার পকেটে কিছু টাকা আছে। বেশি না, একশ পঁচিশ। মন চাইছে টাকাটা খরচ করে ফেলি। নিঃস্ব অবস্থায় রাস্তায় হাঁটার একধরনের আনন্দ আছে। এটা আমার কথা না, বাবার কথা। বাবার হঠাৎ হঠাৎ দার্শনিক কথাবার্তা বলার অভ্যাস আছে। দার্শনিক কথা বলার পরপরই তিনি খানিকটা উদাস হয়ে যান। তারপর ইংরেজিতে বিড়বিড় করে বলেন, Life, this is life! দার্শনিক কথা বেশির ভাগ তিনি বলেন রিকশায় করে যাবার সময়। একবার তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি। তিনি এক হাতে আমাকে ধরে রেখেছেন যেন আঁকুনি খেয়ে পড়ে না যাই। আমাকে বললেন, বাবলু, বল দেখি আমার পকেটে কত টাকা আছে?
আমি বললাম, জানি না বাবা।
অনুমান কর।
এক হাজার টাকা।
হয় নাই।
পঁচাত্তর হাজার তিনশ।
এত টাকা?
আমার এই প্রশ্নে বাবা উদাস হয়ে বললেন, পকেটভর্তি টাকা নিয়ে রাস্তায় বের হবার যে মজা, পকেট খালি অবস্থায় রাস্তায় বের হওয়ারও একই মজা।
আমি বললাম, কীভাবে?
বাবা বললেন, Life, this is life! তখন তার মধ্যে উদাস ভাব চলে এসেছে। তিনি পঁচাত্তর হাজার তিনশ টাকা পকেটে নিয়ে উদাসী হয়ে পড়েছেন। একটা সময় ছিল যখন তিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। তখন তিনি মূর্তির ব্যবসা করতেন। রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর থেকে আমের ঝুড়িতে মূর্তি আসত। কষ্টি পাথরের মূর্তি, পিতলের মূর্তি, ব্রোঞ্জের মূর্তি। মূর্তি কেনার জন্যে নানান ধরনের লোকজন বাড়িতে ঘোরাঘুরি করত। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ঘরের চেয়ারে জাপানি এক লোক বসে আছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই সে বাংলায় বলল, কুকা কমন আছ? বলেই সে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। কুকা মানে থোকা, এটা বুঝতেও আমার অনেক সময় লাগল।
বাবার কাছে শুনেছি জাপানি এই সাহেবের নাম নিশিমিশি। তার কাজ হচ্ছে পৃথিবী ঘুরে ঘুরে মূর্তি কেনা। বাবার কাছ থেকে সে শিব-পার্বতীর একটা মূর্তি কিনে নগদ দশ লাখ টাকা দিয়েছিল। নগদ দশ লাখ টাকা আর এক বোতল জাপানি মদ। বাবা মদের বোতল হাতে নিয়ে বলেছিলেন, থাপ্পড় দিয়ে হারামজাদার দাঁত ফেলে দেয়া দরকার ছিল। মুসলমানের বাড়িতে মদ নিয়ে। এসেছে, এত বড় সাহস!
সেই মদের বোতল (নাম সাকি) অনেকদিন আমার ঘরের শেলফে রাখা ছিল। একদিন মা সেই বোতল বাথরুমে ভেঙে ফেললেন। পচা ভাতের দুর্গন্ধে বাড়ি ভরে গেল!
বাবা মূর্তির ব্যবসা বেশিদিন করতে পারেন নি। তাঁর মূল যে অ্যাসিসটেন্ট শওকত (আমি ডাকতাম শওকত মামা। খুব ভালো ম্যাজিক দেখাতেন। পয়সার ম্যাজিক। পয়সা অদৃশ্য করে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে বের করতেন।) পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলেন। তার পাঁচ বছরের জেল হয়ে গেল। সেই সময় বাবাও জেলে যাবার জন্য তৈরি ছিলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন শওকত মামা তার নাম বলবেন। পুলিশ তাকেও এসে ধরে নিয়ে যাবে। শওকত মামা কারো নামই বলেন নি। একা জেল খাটতে গেলেন। দুই বছরের মাথায় নিউমোনিয়ায় জেলখানায় তার মৃত্যু হয়।
শওকত মামার কথা উঠলেই বাবা বলতেন, সে সাধারণ মানুষের পর্যায়ের কেউ না। সে অতিমানব। মহাপুরুষ।
মহাপুরুষদের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম।
মেঘলা দিনে মন মেঘলা হয়ে যায়। মেঘলা মন নিয়ে আমি অনেকক্ষণ রাস্তায় হাঁটলাম। একটা স্টেশনারি দোকান থেকে লাল-নীল পেনসিল কিনলাম, খাতা কিনলাম, তারপর রওনা হলাম বাবার ফ্ল্যাট-বাড়ির দিকে। কেন জানি মনে হচ্ছে কাউকে পাব না। ফ্ল্যাট বাড়িতে তালা ঝুলবে। কিংবা কড়া নাড়ার শব্দে অপরিচিত একজন মহিলা দরজা খুলে বিরক্ত-মুখে বলবে, কাকে চাই?
আমি মিনমিন করে বলব, যূথীর কাছে এসেছিলাম।
মহিলা কঠিন গলায় বলবেন, যূথী বলে এ বাড়িতে কেউ থাকে না। আমরা নতুন ভাড়াটে।
আমি বলব, যূথীরা কোথায় গেছে জানেন?
তিনি বলবেন, আমাদের তো জানার কথা না।
মুখের ওপর খট করে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ ধরে দরজা নক করছি, কেউ দরজা খুলছে না। দরজার ওপাশে কেউ একজন যে আছে সেটা বুঝতে পারছি। নড়াচাড়ার শব্দ পাচ্ছি। সে যে ছিটকিনি টানাটানি করছে এটাও বুঝতে পারছি।
একসময় দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে যূথী। সে আমাকে দেখে গায়ের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তার ধাক্কায় আরেকটু হলে আমি পড়েই যেতাম। সে কাঁদতে কাঁদতে যা বলল, তার অর্থ হচ্ছে সকালবেলা তার মা তাকে বলেছে দুই ঘণ্টার জন্য সে বাইরে যাচ্ছে। খুবই জরুরি কাজ। তারপর সারাদিন কেটে গেছে সে আসে নি। যূথী কিছু খায় নি। তার খুব ক্ষিধা লেগেছে।
আমি বললাম, বার্গার খাবে?
যূথী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, হুঁ। আর কোক খাব।
বিশাল একটা বিফ বার্গার যূথী দুই হাতে ধরে খাচ্ছে। পরপর কয়েকটা কামড় দিয়ে সে বার্গারটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও।
আমি বললাম, তুমি খাও।
না, তুমি খাও। ক্ষুধার্ত এই মেয়েটি আমার প্রতি তার মমতা দেখাতে চাচ্ছে। আহা বেচারি। আমি বার্গারে কামড় দিলাম।
সে কয়েক কামড় খায়, তারপর বার্গার আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি এক কামড় খাই। সে অতি দ্রুত কয়েকটা কামড় দেয়, আবার বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।
যূথীর মা বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যার পর। কাঁদতে কাঁদতে ফিরলেন। তাঁর কাছে জানলাম তিনি গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। একজন দালাল ধরেছিলেন। দালাল পাঁচশ টাকার বিনিময়ে কাজটা করে দেবে বলেছিল। দালালের কারণে সারাদিন তিনি জেলখানার সামনে বসা। বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা, চা খাবে?
আমি বললাম, না।
তিনি শান্ত গলায় বললেন, বাবা, আমি কী করব বলো তো? কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আমি কি তোমার মার কাছে যাব?
আমি বললাম, তাকে কী বলবেন?
তিনি হতাশ গলায় বললেন, তাও তো জানি না। আসলেই তো, আমি কী বলব!