১৩. কুতব শাহদের ক্ষয় ও পতন
১৩.১ আবুল হাসান কুতব শাহের সিংহাসনারোহণ, ১৬৭২
গোলকুপ্তার ষষ্ঠ সুলতান আবদুল্লাহ কুতব শাহ ১৬২৬ সালে তার পিতার উত্তরাধিকার পায় বারো বছর বয়সে, শাসন করে ৪৬ বছর, আর শাসনকালের পুরোটা জুড়েই সে ছিল একটা পুতুল। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন। প্রকৃতপক্ষে পরিচালনা করেছে তার মা, হায়াত বখশ বেগম, আর শক্ত চরিত্রের এই মহিলার মৃত্যুর (১৬৬৭) পর আবদুল্লাহর বড় জামাই সাঈদ আহমদ। সারা জীবন ধরেই আবদুল্লাহ ছিল একজন অলস, প্রায় জড়বুদ্ধির একজন মানুষ কখনোই সে দেশের প্রথানুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে যায়নি, এমনকি আসেনি গোলকুণ্ডা দুর্গের বাইরে। আর এ রকম পরিস্থিতিতে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, রাজ্য ছেয়ে গেছে বিশৃঙ্খলা আর কুশাসনে।
আবদুল্লাহর কোনো পুত্র ছিল না, ছিল তিন কন্যা, যাদের দ্বিতীয়টির বিয়ে হয়েছিল আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহম্মদ সুলতানের সঙ্গে, আর প্রথমটির সাঈদ আহমদের সঙ্গে, যে নিজেকে মক্কার একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় বলে দাবি করত এবং আপন যোগ্যতার বলে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী, প্রকৃতপ্রস্তাবে রাজ্যের শাসকতৃতীয় রাজকুমারীর বিয়ে ঠিক হলো সাঈদ সুলতানের সঙ্গে; কিন্তু বিয়ের দিনে সাঈদ আহমদ আবদুল্লাহকে বলল যে সে যদি সাঈদ সুলতানের সঙ্গে তার কন্যার বিয়ে দেয়, তাহলে সে এই মুহূর্তে রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। তড়িঘড়ি করে রাজকুমারীর আরেকটা সম্বন্ধ খোঁজা হলো। পছন্দের এবারের যুবকটির নাম আবুল হাসান, যে তার পিতার দিক থেকে কুতব শাহি বংশীয়, আর যার শেষ ষোলোটা বছর অলসভাবে কেটেছে সাধু সাঈদ রাজু কাতালের শিষ্য হিসেবে। এই যুবককেই প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বিয়ে দেওয়া হলো রাজকুমারীর সঙ্গে।
১৬৭২ সালের ২১ এপ্রিল আবদুল্লাহ মারা গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার নিয়ে শুরু হলো এক বিবাদ। খানিক বিশৃঙ্খলার পর, সাঈদ মুজাফফর নামক পারসি উচ্চবংশীয় এক সেনাপতি মুসা খান মহলদার আর হেরেমের অন্যান্য অফিসারদের সহায়তায় সাঈদ আহমদকে ক্ষমতাচ্যুত এবং বন্দী করল। সিংহাসনে বসল আবুল হাসান আর মুজাফফর হলো তার প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আবুল হাসান ঘুষ দিয়ে মুজাফফরের সব কাজে পারদর্শী ব্রাহ্মণ মদনা পণ্ডিতকে বশ করল, আর তার সহায়তায় বশ করল অন্যান্য অফিসারকে, ফলে মুজাফফর তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাল, আর সেই পদ লাভ করল মদনা, সূর্য প্রকাশ রাও উপাধি নিয়ে। তার শাসন চলল ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত, আর তার ভাই আকানা হলো প্রধান সেনাপতি।
মদনার মন্ত্রিত্বের বারো বছর হলো আবদুল্লাহর শাসনকালের চেয়েও খারাপ। দরবারে বিশৃঙ্খলা আর চক্রান্ত দেখে গোপনে সে হাত মিলাল মারাঠি রাজার সঙ্গে, আর গোলকুণ্ডার নিরাপত্তার বিনিময়ে তাকে নিয়মিতভাবে এক লাখ হুন করে দেওয়ার অঙ্গীকার করল।
১৩.২ গোলকুণ্ডার সুলতানের বিষয়ে মোগল কর্মপন্থা
যত দিন বিজাপুরের পতন হয়নি, গোলকুণ্ডা ছিল নিরাপদ। আওরঙ্গজেব এটা জানতেন, আর তাই প্রথমে গোলকুপ্তাকে সাম্রাজ্যে সংযুক্তির চেষ্টা করেননি। ব্যাপারটা তার জন্য জরুরিও ছিল না, যেহেতু কুতব শাহি সরকারকে ধ্বংস করার চেয়ে ওটাকে লুণ্ঠন করা আর ভয় দেখানোতেই তাঁর লাভ হচ্ছিল বেশি।
রাজকীয় ক্রিয়াকলাপ তার উজির মদনার হাতে ছেড়ে দিয়ে সুলতান আবুল হাসান তার প্রাসাদে মত্ত হয়ে রইল একদল রক্ষিতা আর নর্তকী নিয়ে। তার পূর্বসূরি হায়দরাবাদকে পরিণত করেছিল ভারতীয় ব্যাবিলনে, যেখানে সুলতানের সামনে প্রতি শুক্রবার নাচত বিশ হাজার মেয়ে, আর তাদের কোয়ার্টারের আশপাশে ছড়ানো অসংখ্য গুঁড়িখানায় প্রতিদিন উড়ে যেত ১,২০০ বড় মশকভর্তি তাড়ি। আবুল হাসান তার সঙ্গে যোগ করল বিলাসের আরও উপকরণ। সংগীতের ওপরও ভালো দখল ছিল তার।
রাজ্যের বিশাল ঐশ্বর্য আসত তার উর্বরা জমি, হীরে আর লোহার খনি এবং পুব উপকূলের বন্দর থেকে। সুলতানের নিশ্চিত আয়ই ছিল ২% কোটি টাকা। আওরঙ্গজেবের সিংহাসনারোহণের পর গোলকুণ্ডা প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ মোগল আক্রমণের হাত থেকে বিরাম পেয়েছে, কারণ, সম্রাট শিবাজী আর আদিল শাহকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন বেশি, ওদিকে কুতব শাহও নিয়মিত কর দিয়ে যাচ্ছিল।
গোলকুণ্ডার সুলতানের ওপর আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে রাগ ছিল বিধর্মী শিবাজীর সঙ্গে তার গলাগলির জন্য। ১৬৬৬ সালে শিবাজী আগ্রা থেকে পালানোর। পর তার সহায়তাতেই হাতছাড়া হয়ে যাওয়া দুর্গগুলোকে সে মোগলদের কবল থেকে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। তারপর ১৬৭৭ সালে হায়দরাবাদে মারাঠি রাজাকে কুতব শাহ এমন এক সংবর্ধনা জানিয়েছিল, যেন সে তার একজন সামন্ত; শিবাজীর ঘোড়র গলায় কুতব শাহ পরিয়ে দিয়েছিল এক ছড়া বহু মূল্য রত্বের মালা। সর্বোপরি, ব্রাহ্মণ মদনা আর আকানাকে খুব বড় পদ দেওয়ায় হিন্দুরা রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৩.৩ মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ এবং হায়দরাবাদ দখল, ১৬৮৫
আওরঙ্গজেব তাঁর বিজাপুর আক্রমণ শুরু করলেন (মার্চ, ১৬৮৫), আবুল হাসানকে সাবধান করে দিয়ে যে সে যেন কোনোভাবেই সিকান্দার আলী আদিল শাহকে সহায়তা না করে। কিন্তু জুনের শেষে প্রতিনিধির কাছে পাঠানো আবুল হাসানের একটা চিঠি ধরা পড়ল আওরঙ্গজেবের হাতে, যেখানে সুলতান লিখেছে, সম্রাট একজন মহানুভব মানুষ, তিনি বরাবর মহান আচরণই করে এসেছেন, কিন্তু এখন, সিকান্দারকে একজন অসহায় এতিম পেয়ে তিনি বিজাপুর অবরোধ করেছেন। তাই বিজাপুরী সেনাবাহিনী যেহেতু এখন শঙ্কুর অসংখ্য সেনার সঙ্গে যোগ দিয়ে একপাশ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আমারও উচিত এই পাশ থেকে খলিলুল্লাহ খানের অধীনে ৪০,০০০ সেনাকে যুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া। তাহলে দেখা যাবে, সম্রাট শক্রর কোন পাশ সামলাতে পারেন ।
আওরঙ্গজেব কালবিলম্ব না করে বিশাল এক সেনাবাহিনী পাঠালেন শাহজাদা শাহ আলমের অধীনে। কিন্তু সম্রাট-বাহিনী মালখেদের ৮ মাইল পুবের সিরামে। পৌঁছাতে পথরোধ করে দাঁড়াল গোলকুণ্ডার সেনাবাহিনী, ফলে সম্রাট-বাহিনীকে পিছিয়ে আসতে হলো মালখেদে। ইতিমধ্যে ঘোর বর্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় মোগল বাহিনীকে চুপচাপ বসে থাকতে হলো দুই মাস। সম্রাট ভীষণভাবে তিরস্কার করলেন, ফলে এবার শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দিনের শেষে শত্রুপক্ষ শিবিরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। পরদিন সকালে জানা গেল, তারা পালিয়ে গেছে হায়দরাবাদের দিকে। দাক্ষিণাত্য বাহিনীর হঠাৎ এই ভেঙে পড়ার কারণ হলো, মোগলেরা ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলেছিল তাদের প্রধান সেনাপতি মীর মুহম্মদ ইব্রাহিমকে। সামনে আর কোনো বাধা না পেয়ে শাহজাদা ধেয়ে গেলেন হায়দরাবাদ অভিমুখে।
কুতব শাহ পালাল গোলকুণ্ডা দুর্গে, আর সেখান থেকেই শাহজাদার কাছে বারবার প্রতিনিধি পাঠাতে লাগল শান্তি স্থাপনের জন্য। শেষমেশ শাহজাদার সুপারিশে ১৮ অক্টোবর সম্রাট আবুল হাসানকে ক্ষমা করতে রাজি হলেন নিম্নলিখিত শর্তাবলিতে :
(১) অতীত সমস্ত বকেয়া বাবদ অবশ্যই তাকে পরিশোধ করতে হবে এক কোটি বিশ লাখ টাকা, তার সঙ্গে বার্ষিক কর বাবদ দিতে হবে ২ লাখ হুন। (২) তাকে অবশ্যই মদনা আর আকানাকে বরখাস্ত করতে হবে। (৩) ইতিমধ্যেই সম্রাট-বাহিনীর দখলকৃত মালখেদ আর সিরামের ওপর থেকে সব দাবি তুলে নিতে হবে।
১৩.৪ মদনা পণ্ডিতের হত্যা, ১৬৮৬
শাহ আলম কয়েক মাস অবস্থান নিলেন গোলকুণ্ডার কাছে, তারপর কুতব শাহের অনুরোধে ৪৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমের কুহিরে সরে গিয়ে রইলেন যুদ্ধ-ক্ষতিপূরণ আদায়ের অপেক্ষায়। আবুল হাসান মদনাকে বরখাস্ত করার ব্যাপারে যথাসম্ভব দেরি করতে লাগল। এতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল অমাত্যদের। তাদের মতে মদনাই ছিল মোগলদের হাতে তাদের এত দুর্ভোগের মূলে। মদনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হলো, যার নেতৃত্বে রইল শেখ মিনহাজ আর বর্তমানে সুলতানের হেরেমের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারিণী আবদুল্লাহ কুতব শাহের দুই বিধবা-সরুমা আর জানি সাহিবা । ১৬৮৬ সালের মার্চের প্রথম দিকের এক রাতে প্রভুর কাছ থেকে বেরিয়ে আসতেই গোলকুপ্তার রাস্তায় মদনাকে হত্যা করল জামশেদ আর অন্য কয়েকজন ক্রীতদাস। আকানাও ভাইয়ের পরিণতি বরণ করল ঘটনাস্থলেই। শান্তি স্থাপনের সেরা উপায় হিসেবে আবুল হাসান কুতব শাহ সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিল তাদের কাটা দুই মুণ্ড।
১৩.৫ আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা অবরোধ, ১৬৮৭
সম্রাট গোলকুণ্ডার দুই মাইলের মধ্যে উপস্থিত হলেন ১৬৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি। ইতিমধ্যে আবুল হাসান আবার পালিয়ে গেছে গোলকুণ্ডা দুর্গে এবং হায়দরাবাদ শহর তৃতীয় আর শেষবারের মতো দখল করেছে মোগলরা।
মুসি নদীর ওপরের পাথরের যে সেতু হায়দরাবাদ শহরের দুই অংশকে সংযুক্ত করেছে, সেখান থেকে দুই মাইল পশ্চিমেই গোলকুণ্ডা দুর্গ। কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার ছিদ্রসহ চার মাইল লম্বা এ্যানিটের প্রকাণ্ড শক্ত এক দেয়াল দুৰ্গটাকে ঘিরে আছে। ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু অর্ধবৃত্তাকার বুরুজ রয়েছে ৮৭টা, যার কোনো কোনোটার ওজন এক টনেরও বেশি। দুর্গের আটটা বিশাল দরজা সপ্তদশ শতাব্দীর যেকোনো গোলন্দাজ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ। বাইরে রয়েছে ৫০ ফুট চওড়া গভীর এক নালা। গোলকুণ্ডা দুর্গ আসলে ভিন্ন ভিন্ন চারটে দুর্গের সমাহার, যার ভেতরে রয়েছে অমাত্যদের বাসস্থান, বাজার, মন্দির, মসজিদ, সেনাছাউনি, বারুদ ভাণ্ডার, আস্তাবল, বাগান, পাথরের সিঁড়িঅলা কুয়ো, হেরেম, এমনকি চাষাবাদের জমি। বিপদের সময় পুরো হায়দরাবাদ শহরের মানুষই বাস করত এই দুর্গের ভেতর।
সম্রাট-বাহিনীর প্রথম আক্রমণেই পালিয়ে গেল দুর্গের বাইরের সেনারা। মোগল সরকারি ইতিহাসের বর্ণনায়, ‘ঝড় এল আর মশারা পালাল।’ কালিচ খান তড়িঘড়ি দুর্গে প্রবেশ করতে গিয়ে গুলি খেল পিঠের মাঝখানে, আর ডাক্তারদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মারা গেল তিন দিন পর। অবরোধ শুরু হলো ৭ ফেব্রুয়ারি।
১৩.৬ শাহ আলমের বন্দিত্ব
শাহজাদা শাহ আলম ভাতৃসুলভ শাসক আবুল হাসানের ধ্বংস চাননি। তবে এই সহানুভূতির পেছনে শাহজাদার একটা গোপন ইচ্ছেও কাজ করেছিল: যদি তার মধ্যস্থতায় আবুল হাসান শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে তিনিই পাবেন গোলকুণ্ডা দখলের কৃতিত্ব। সুতরাং সুলতানের সঙ্গে একটা যোগাযোগ বজায় রাখলেন তিনি। সম্রাটের অজান্তে তাঁর এই কাজ ছিল আগুন নিয়ে খেলার মতো এবং সংবাদটা একদিন ঠিকই পৌঁছাল সম্রাটের কানে।
আওরঙ্গজেব তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নিলেন: তার বাহিনীর সেনারা ঘিরে ফেলল শাহজাদার শিবির। পরদিন সকালে (২১ ফেব্রুয়ারি) শাহ আলম আর তার চার পুত্রকে সম্রাটের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলো পরামর্শের কথা বলে। আর, সেখানেই তাঁকে বন্দী করা হলো। তারপর বন্দী করা হলো তাঁর পুরো পরিবার, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো, তার সেনাদের ভাগ করে দেওয়া হলো অন্য সেনাপতিদের অধীনে, তাঁর খোঁজাদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করা হলো আরও ষড়যন্ত্র জানার উদ্দেশ্যে। শাহ আলম যতই নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করলেন, ততই বেড়ে গেল সম্রাটের রাগ: শাহজাদার চুল আর নখ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, দেওয়া হলো না সুস্বাদু খাবার, আর নিজস্ব সাজপোশাক। শাহ আলম মুক্তি পেলেন সাত বছর পর ।
১৩.৭ গোলকুণ্ডা অবরোধে আওরঙ্গজেবের অসুবিধাসমূহ। কিন্তু ভিন্নমত কেবল শাহ আলমই পোষণ করেননি। সম্রাটের অনেক শিয়া কর্মচারীও চায়নি যে ভারতের শেষ শিয়া রাজ্যটা ধ্বংস হয়ে যাক । শিয়ারা ছাড়া, গোঁড়া অনেক সুন্নির কাছেও এটা ছিল মুসলমানের বিরুদ্ধে মুসলমানের যুদ্ধ এবং সেই বিচারে-একটা পাপ কাজ। ন্যায়পরায়ণ, সাধুপ্রকৃতির প্রধান বিচারপতি শেখ-উল-ইসলাম সম্রাটকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যের সুলতানাত দুটোকে আক্রমণ না করার জন্য, কিন্তু সম্রাট তা অগ্রাহ্য করায় উচ্চপদ ত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন মক্কায়।
সেনাবাহিনীর ভেতরে ছিল ব্যক্তিগত ঈর্ষা। অবরোধের সর্বাধিনায়ক ফিরুজ জং ছিল একজন তুর্কি। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান শিকন খান পারসি হওয়ায় ফিরুজ জংকে সুনজরে দেখত না। অবরোধ শুরু হয়েছিল ৭ ফেব্রুয়ারি কিন্তু শত্রুপক্ষের গোলাবারুদের যেন কোনো শেষ নেই। দুর্গপ্রাকারের ছিদ্র দিয়ে তারা করে চলল অবিরাম গোলাগুলিবর্ষণ, আর প্রত্যেক দিন মোগলদের কিছু কিছু সেনা হতাহত হলো । তবু শিকন খানের অধীন মোগল সেনারা এতটুকু পিছু হটল না।
ওদিকে যখন এই অবস্থা, ১৬ মে হঠাৎ এক আক্রমণে দুর্গ দখল করে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চালাল ফিরুজ জং । রাত ৯টায় চুপিসারে উঠে পড়ল সে এক বুরুজের ওপর, প্রহরীরা ততক্ষণে ঘুমে অচেতন। কিন্তু ঠিক ওই সময়ই দুর্গের ভেতরের এক নেড়ি কুকুর দেয়ালের ওপর থেকে নামার চেষ্টা করছিল নিচের পরিখায়। অপরিচিত মানুষ দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরটা, জেগে গেল দুর্গের সবাই, আর তাড়িয়ে দিল মোগলদের। রাজধানীকে রক্ষা করার পুরস্কার হিসেবে আবুল হাসান কুকুরটাকে দিল রত্নখচিত একটা সোনার মালা আর সোনার কারুকাজ করা একটা কোট।
কয়েক দিনের মধ্যেই মোগল শিবিরে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ, কারণ, দাক্ষিণাত্যবাসী আর মারাঠিরা একত্র হয়ে মোগলদের শস্য পরিবহনে বাধার সৃষ্টি করল। পাশাপাশি শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। নদীনালা সব ভরে উঠে হয়ে গেল পারাপারের অযোগ্য। মোগলদের কামান ছোঁড়ার জন্য নির্মিত প্ল্যাটফরম ধসে পরিণত হলো কাদার স্কুপে; পরিখার দেয়ালগুলো ধসে পড়ল একে একে পুরো এলাকাই রূপান্তরিত হলো পানির একটা পাতে, যার মধ্যে তাদের সাদা তাঁবুগুলো কেবল জেগে রইল বড় আকারের বুদ্বুদের মতো।
১৩.৮ গোলকুণ্ডা দুর্গের ঝটিকা আক্রমণ : মোগলদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
এই পরিস্থিতির সুযোগ নিল শত্রুপক্ষ। ১৫ জুন রাতে বৃষ্টির মধ্যেই তারা আক্রমণ চালাল মোগলদের গোলন্দাজ অবস্থান আর পরিখার ওপর। তাদের হাতে নিহত হলো গোলন্দাজ বাহিনীর বেশকিছু সেনা, আর বন্দী হলো গোলন্দাজ বাহিনী প্রধান ঘইরাত খান, সম্রাটের বিশ্বস্ত এক পুরাতন ভৃত্য সরবরাহ খান এবং বারোজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আবুল হাসান তাদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করে প্রত্যেককে দামি উপহার দিয়ে ফেরত পাঠাল সম্রাটের কাছে।
এবার মোগলেরা তিনটে মাইন পাতল দুর্গের তিন বুরুজের নিচে, একেকটায় ব্যবহার করা হলো ৫০০ মণ করে বারুদ।
২০ জুন ভোরে ঘটানো হলো প্রথম মাইনের বিস্ফোরণ, কিন্তু বিস্ফোরণের ধাক্কাটা এল বাইরের দিকে, ঢাল বেয়ে বিরাট বিরাট সব পাথরের টুকরো এসে পড়ল নিচে গাদাগাদি করে থাকা সম্রাট-বাহিনীর সেনাদের ওপর: দুর্গপ্রাকারের কিছুই হলো না, অথচ চোখের পলকে নিহত হলো ১,১০০ মোগল সেনা।
এই সময় শত্রুরা আবার আক্রমণ চালাল হতবুদ্ধি মোগলদের ওপর । সম্রাটের পাঠানো নতুন একটা বাহিনী অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর অতি কষ্টে পুনরুদ্ধার করল তাদের অবস্থান। ঘটানো হলো দ্বিতীয় বিস্ফোরণ, কিন্তু এবারও উড়ে যাওয়া বুরুজের পাথরখণ্ডগুলো এসে পড়ল মোগলদের ওপর। আবারও আক্রমণ চালাল শত্রুপক্ষ। এবারের যুদ্ধটা হলো ভয়াবহ; ফিরুজ জংয়ের সঙ্গে আহত হলো আরও দুই সেনাপতি-রুস্তম খান আর দলপত রাও বুন্দেলা, সেই সঙ্গে নিহত হলো অসংখ্য সেনা।
সংবাদ পেয়ে এগিয়ে এলেন আওরঙ্গজেব স্বয়ং। তার ভ্রাম্যমাণ সিংহাসনের আশপাশ দিয়ে উড়ে যেতে লাগল কামানের গোলা, যার একটার আঘাতে উড়ে গেল তার এক খানসামার বাহু। কিন্তু সম্রাট সেসবের দিকে ভ্রূক্ষেপও না করে সেনাদের উৎসাহ জোগাতে লাগলেন।
এই সময় শুরু হলো তীব্র ঝড়, বিদ্যুতের গর্জন আর মুষলধারে বৃষ্টিপাত। শুকনো নালাগুলো ভরে উঠল, নিচু রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগল পানির স্রোত। এই সুযোগে তৃতীয়বার আক্রমণ চালাল শত্রুপক্ষ, দখল করে নিল অনেক কামান, অনেকগুলো ধ্বংস করে ফেলল। সূর্যাস্তের সময় ফিরে এল পরাজিত মোগল; সম্রাট রাত কাটালেন ফিরুজ জংয়ের তাঁবুতে।
১৩.৯ মোগল ব্যর্থতা; দুর্ভিক্ষ ও মহামারী পরদিন সকালে (২১ জুন) সম্রাট তৃতীয় মাইন দিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। মাইনটা বিস্ফোরিতই হলো না। শত্রুরা পানিতে ভিজিয়ে ওটার বারুদ নষ্ট করে দিয়েছিল। আরও অনেক রকম পরিকল্পনা করা হলো, ব্যয় হলো অজগ্র টাকা, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ইতিমধ্যে শুরু হলো দুর্ভিক্ষ, আর তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পিছু পিছু এল মহামারী। হায়দরাবাদ শহর সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে গেল; বাড়ি, নদী, সমভূমি ভরে গেল কেবল লাশে আর লাশে। মোগল শিবিরেরও হলো একই অবস্থা। রাতে গড়ে উঠতে লাগল লাশের স্তূপ। কয়েক মাস পর বৃষ্টি থামলে দূর থেকে সাদা কঙ্কালগুলোকে মনে হলো বরফের টিলা।
আওরঙ্গজেব এবার ভয়ংকর জেদে ভাবলেন, অনাহারের কাছে দুৰ্গটাকে নতি স্বীকার করাবেন। গোলকুপ্তা দুর্গ ঘিরে নির্মাণ করলেন তিনি কাঠ আর মাটির একটা দেয়াল। সেটার দরজায় বসল কড়া প্রহরা, ছাড়পত্র না দেখিয়ে প্রবেশ আর বহির্গমন নিষিদ্ধ করা হলো।
১৩.১০ বিশ্বাসঘাতকতার ফলে গোলকুণ্ডার পতন
২১ সেপ্টেম্বর প্রায় আট মাস অবরোধের পর গোলকুণ্ডার পতন হলো বিশ্বাসঘাতকতার ফলে। আবদুল্লাহ পানি ওরফে সরদার খান নামক এক আফগান সেনা বিজাপুর সেনাবাহিনী ত্যাগ করে যোগ দিয়েছিল মোগল বাহিনীতে, তারপর মোগলদের ত্যাগ করে আবার ভিড়েছিল আবুল হাসানের সঙ্গে। এবার ঘুষ খেয়ে সে বিক্রি করে দিল তার প্রভুকে। খুলে দিল সে দুর্গের পেছন দিকের দরজা (খিড়কি), আর সেদিক দিয়ে বিনা প্রতিরোধে ঢুকে পড়ল কয়েকজন মোগল সেনা, ১৬৮৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাত প্রায় তিনটেয়। রুহুল্লাহ খানের অধীনের সেনাগুলো খুলে দিল প্রধান দরজা, আর সেই পথে দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে মোগল সেনা।
১৩.১১ আবুল হাসান বন্দী
মোগলদের উল্লসিত চিৎকার শুনে আবুল হাসান গিয়ে চুপচাপ বসে রইল দরবারের সিংহাসনে। অবশেষে এসে পৌঁছাল রুহুল্লাহ খান। কিছুদিন পর বার্ষিক ৫০,০০০ টাকার বৃত্তি দিয়ে আবুল হাসানকে পাঠানো হলো দৌলতাবাদে, আর সেখানেই সে কাটাতে লাগল তার বন্দিজীবন। ধরা দেওয়ার সময় তার মর্যাদাপূর্ণ আচরণ শত্রুদের বিস্মিত করেছিল। আবুল হাসান বলেছিল যে সে আনন্দ আর যন্ত্রণা দুটোকেই আল্লাহর উপহার হিসেবে সমানভাবে নিতে জানে।
গোলকুণ্ডা লুট করে পাওয়া গেল প্রায় সাত কোটি নগদ টাকা, পাশাপাশি সোনা আর রুপার থালা, রত্ন আর রত্নখচিত সামগ্রী। জয় করা রাজ্যের রাজস্ব ছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।