সোবাহান সাহেব ভোরবেলায় কাপে করে এক কাপ পানি খেলেন। আর কিছুই খেলেন না। মিনু বললেন, তুমি সত্যি সত্যি কিছু মুখে দেবে না?
না।
কেন?
কেনর জবাবতো দিয়েছি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাই।
রাগে দুঃখে মিনুর চোখে পানি এসে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ যদি এরকম যন্ত্রণা করে তাহলে কিভাবে হয়? মিলির ইউনিভার্সিটিতে যাবার খুব প্রয়োজন ছিল সে গেল না। বাসার আবহাওয়া মনে হচ্ছে ভাল না। বাবার প্রেসারের কি অবস্থা কে জানে। ডাক্তারকে খবর দেয়া প্রয়োজন। তবে এক্ষুনি ছুটে যাওয়ার দরকার নেই। দুপুর পর্যন্ত যাক তারপর দেখা যাবে।
দুপুরে ফরিদ দুলাভাইয়ের অনশনের খবর পেল। তার উৎসাহের সীমা রইল না। কাদেরকে ডেকে বলল, সাবজেক্ট পাওয়া গেছে–অসাধারণ সাবজেক্ট–ছবি হবে ক্ষুধা নিয়ে। ক্ষুধা কি একজন জানতে চাচ্ছে। ক্যামেরা তার মুখের ওপর ধরে রাখা। মাঝে মাঝে ক্যামেরা সরে নানান ধরনের খাবার দাবারের উপর চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে তার মুখে। লোকটার অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃষ্ণা। ক্যামেরা প্যান করে চলে গেল ঝর্ণায়। বিরবির করে ঝর্ণার পানি পড়ছে–অথচ ঐ মানুষটির মুখে এক ফোঁটা পানি নেই। ক্যামেরা চলে গেল আকাশের মেঘে।
কাদের উৎসাহী গলায় বলল, আবার ছবি হইব মামা?
ফরিদ বলল, ছবি হবে না। মানে? একটা প্রজেক্ট ফেল করেছে বলে সব কয়টা প্ৰজেক্ট ফেল করবে নাকি? বলতে গেলে আজ থেকেই ছবির কাজ শুরু হল। ছবির নাম — হে ক্ষুধা।
কি নাম কইলেন মামা?
হে ক্ষুধা।
হে-কথাডা বাদ দেন মামা। অপয়া কথা। এর আগের বারও হে আছিল। বইল্যা ছবি অয় নাই।
কথা মন্দ বলিস নি। তাহলে বরং হে টা পেছনে নিয়ে যাই। ছবির নাম–ক্ষুধা হে কি বলিস?
মন্দ না।
কাগজ কলম দে। ইমিডিয়েট যেসব চিন্তা মাথায় আসছে সেগুলো নোট ডাউন করে ফেলি। দুলাভাইয়ের সঙ্গেও আলাপ দরকার। ছবিটা যখন তাঁকে নিয়েই হচ্ছে।
কাদের ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার কোন পাট থাকত না মামা?
থাকবে! তবে সাইড রোল। সেন্ট্রাল ক্যারেকটার হচ্ছে দুলাভাই! দেখি আপার সঙ্গে ব্যাপারটা আগে ফয়সালা করে নিই।
মিনু রাগ করে বিলুর ঘরে শুয়ে আছেন। সকালে তিনিও নাস্তা করেননি। তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যে বাড়ি থেকে চলে যাবার কথাও মনে আসছে। রাগারাগী তাঁর স্বভাবে নেই। তবু সবাই বেশ কয়েকবার তার কাছে ধমক খেয়েছে। তিনি বলে দিয়েছেন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। কাজেই ফরিদ যখন বিশাল একটা খাতা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আপা আসব?
তিনি কড়া গলায় বলেন, ভাগ এখান থেকে।
তুমি যা বলবে তাই হবে কিন্তু তার আগে তোমার কয়েকটা মিনিট সময় আমাকে দিতে হবে। দুলাভাইকে নিয়ে ছবি করছি আপা। ছবির নাম ক্ষুধা হে। দুলাভাই সেখানে মানুষ না। দুলাভাই হচ্ছেন ক্যামেরা — যে ক্যামেরা ক্ষুধা কি বুঝতে চেষ্টা করছে। পনেরো মিনিটের ছবি। পনেরো মিনিটই যথেষ্ট। শেষ দৃশ্যটা নিয়েছি সুকান্তের কবিতা থেকে। ঘন নীল আকশে পূর্ণিমার চাঁদ। হঠাৎ সেই চাঁদটা হয়ে গেল একটা আটার রুটি। দুটা রোগা রোগা হাত আকাশ থেকে সেই চাদটা অর্থাৎ রুটিটা নামিয়ে এনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল। কেমন হবে। আপা বলতো? অসাধারণ না?
মিনু একটিও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ফরিদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। সে নিজের মনে বকবক করতে থাকুক।
মানুষের অবহেলা ফরিদকে তেমন বিচলিত করে না। এবারো করল না। আসলে এই মুহুর্তে ক্ষুধা হে ছবির শেষ দৃশ্য তাকে অভিভূত করে রেখেছে। রোগা রোগা দুটা হাত আকাশ থেকে চাঁদটা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে কপ কপি করে খেয়ে ফেলছে। এই দৃশ্যের কোন তুলনা হয় না।
ফরিদ ঘর থেকে বের হয়েই পুতুলের মুখোমুখি পড়ে গেল। ফরিদ কড়া গলায় বলল, এই যে মেয়ে দাড়াও তো। দেখি হাত দুটা মেলতো। পুতুল ভয়ে ভয়ে হাত মেলল।
হুঁ রোগা রোগা হাত আছে— মনে হচ্ছে তোমাকে দিয়ে হবে। তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?
কি কাজ?
অতি সামান্য কাজ। পারবে কি পারবে না সেটা বল।
পুতুল ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব।
ভেরী গুড। কাজটা অতি সামান্য। আকাশ থেকে চাদটা টেনে নামাবে তারপর ছিঁড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলবে!
পুতুল অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার সব চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে।
ফরিদ দাঁড়াল না— লম্বা লম্বা পা ফেলে বারান্দায় চলে গেল। ছবিটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা দরকার। খুবই ঠাণ্ডা মাথায়। দরকার হলে ছবির লেংথ কমিয়ে পনেরো থেকে দশ মিনিটে নিয়ে আসতে হবে। তবে সেই দশ মিনিটও হবে। অসাধারণ দশ মিনিট — গোল্ডেন মিনিটস!