কলকাতার হারিয়ে যাওয়া মেলা
আজ যাঁরা চল্লিশ এমনকী পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই তাঁরাও কল্পনাতেই আনতে পারবেন না দৃশ্যটা। ষাটের দশকের গোড়ার কথা। একটা অন্যরকম, রূপকথামার্কা কলকাতা। রাস্তায় বাঘ-ছাপ লাল রঙের দোতলা বাস। মোড়ের মাথায় ট্র্যাফিক সিগনালে হাফপ্যান্ট পরিহিত কনস্টেবল। ভোরবেলা করপোরেশনের রাস্তা ধোয়া গাড়ি। ময়দানে চুনি-পিকে-বলরাম-আমেদকে দেখার জন্য কাঠফাটা দুপুর আর কাদা মাখামাখি লম্বা লাইন। ঘরের সিলিঙে আড়াআড়ি টাঙানো এরিয়ালের নীচে টেবিলে সাজানো গাম্বাট সাইজের জি ই সি কিংবা মারফি রেডিয়ো, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার, কমল ভটচায, পিয়ারসন সুরিটা…। মাংসের দোকানে টাঙানো লাল শালু— ‘খাসির মাংস— ৫ টাকা Kg’। ব্রয়লার চিকেন বাজারে খেলতে নামেনি তখনও। বেশিরভাগ গেরস্ত বাড়িতে মুরগি তখনও ‘রামপাখি’ এবং নিষিদ্ধ। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়িতে কালেভদ্রে দেশি মুরগির মাংস তখনও বাঙালির ‘ডেলিকেসি’। লোয়ার সার্কুলার রোড তখনও ঠিকঠাক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড হয়ে ওঠেনি। আজও মনে আছে শ্রীমানি বাজারের উলটোদিকে রামমোহন লাইব্রেরির গা ঘেঁষে আমাদের বাড়ির সামনে ফুটপাতের ওপর দিয়ে একটা রেললাইন সোজা চলে গেছিল শেয়ালদার দিকে। রেলগাড়ি যেতে দেখিনি কোনওদিন তবে পাড়ার কাকা জ্যাঠাদের কাছে শুনেছিলাম মার্টিন বার্ন না করপোরেশন কার যেন একটা ময়লা ফেলার ওয়াগন গাড়ি নাকি হুইসল বাজাতে বাজাতে চলে যেত ধাপায়, ফি দুপুরবেলা। আমাদের পাড়ার সামনে লাইনটা পিচের ফুটপাতে বসে গেছিল প্রায়, দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ার ফলেই হয়তো বা। তবে শেয়ালদার কাছে প্রাচী সিনেমার উলটোদিকে লাইনটা মাথা উঁচিয়ে ছিল তখনও অবধি। স্পষ্ট মনে আছে এন আর এস হাসপাতালের দুটো গেটের মাঝখানে আজ যেখানটায় ছাউনি দেয়া বাসস্টপ ঠিক সেখানে একটা জং ধরে যাওয়া ভাঙাচোরা ওয়াগন দাঁড় করানো ছিল দীর্ঘদিন। আর সেখানেই রেললাইন ঘেঁষে ফুটপাতের দু’ধার জুড়ে বসত অদ্যাবধি কলকাতার সবচেয়ে বড় মেলা। শেয়ালদার রথের মেলা। রথের দিন থেকে শুরু হয়ে চলত টানা এক মাস। জানি, এই অবধি পড়েই অনেকে হই হই করে উঠবেন— “সবচে বড় মেলা? গুল মারবার আর জায়গা পাননি মশাই? আমাদের বুক ফেয়ার, শিল্প মেলা… এগুলো সব কী তা হলে?” ধীরে বন্ধু ধীরে, আগে আমার কথাটা শেষ করতে দিন, তারপর না হয় মন খুলে গালাগাল করবেন। প্রথমে মেলার দৈর্ঘ্যের কথাটা বলি তা হলেই বোধ হয় আমার দাবির সত্যতা প্রমাণিত হবে। শেয়ালদা ফ্লাইওভার তখনও সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে। অতএব মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করুন একবার। বেলেঘাটা রেলব্রিজের নীচ থেকে শুরু হয়ে বাঁক খেয়ে পুরো এন আর এস চত্বর, আর আহমেদ ডেন্টাল হসপিটাল হয়ে মৌলালী যুবকেন্দ্রের (তখনও হয়নি) গা ঘেঁষে লালমোহন ভট্টাচার্য রোডে ঢুকে যেত মেলাটা। শেষ হত সি আইটি রোডের মোড়ে ফিলিপস বাস স্টপেজের সামনে। কম সে কম কিলোমিটার দেড়েক তো হবেই। শুধু কি বিশালত্ব? বৈচিত্রের দিক থেকেও অনন্য ছিল এই মেলা। বেলেঘাটা রেলব্রিজ থেকে নেমে শেয়ালদামুখো যে রাস্তাটায় আজ ফুটপাতের দু’পাশে সারি সারি স্থায়ী গাছের স্টল, সেগুলো স্থায়ী ছিল না তখন। তার বদলে রথের একমাসই বসত, ওই একই জায়গায়। তখন ক্লাস ফোর। ওখান থেকেই কিনে এনেছিলাম নাইন-ও-ক্লকের চারা। ছোট্ট টব। এতটুকু লতানে গাছে ঠিক সকাল ন’টাতেই ফুল ফোটে— এই অপার বিস্ময়ের ঘোরটা কাটেনি আজও।
মোড় ঘুরেই এন আর এসের প্রথম গেটটার দু’ধারে পশুপাখির হাট। আজকে অবিশ্বাস্য মনে হবে (হয়তো বা গুলও), বড় বড় মোটা জালের খাঁচায় ভরে অবাধে বিক্রি হত ভালুকছানা, বাঁদর, চিতল হরিণের বাচ্চা, অধুনা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির তালিকায় চলে যাওয়া ডাঙার তারা কচ্ছপ (স্টার টরটয়েজ), দেশি টিয়া, তোতা, ফুলটুসি, ডিউস বলের মতো বড় মাথা আর ইয়া লম্বা ল্যাজঝোলা পাঞ্জাবি চন্দনা, আসামি ময়না, কুচকুচে কালো গা, গালে গাঢ় কমলা রঙের গালপাট্টা, কথা নকল করার ওস্তাদ, বেনে বউ, শ্যামসুন্দর, লালমুনিয়া, চিনে বুলবুল, ধানচড়াই, চোখ বাঁধা ময়ূর (আজ বুঝতে পারি কেন প্রকৃতির এইসব না-মানুষি সন্তানরা এত দ্রুত পা বাড়িয়েছে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার রাস্তায়)… একচুলও বাড়িয়ে বলছি না। বিশ্বাস করুন। এর পাশাপাশি বিদেশি পাখিও বিক্রি হত প্রচুর পরিমাণে। নীল সবুজ সাদা রঙের বদ্রিকা, আকারে চড়াইয়ের চেয়েও ছোট টুকটুকে লাল ঠোঁট আর দুধসাদা রঙের ফিঞ্চ, সর্বদা জোড় বেঁধে থাকা লাভবার্ড, ক্যানারি— উজ্জ্বল হলুদ গায়ে কালো কালো ছিট ছিট, বড় লোহার দাঁড়ে বসে থাকা গম্ভীরমুখো কাকাতুয়া, চিনে মুরগি, রাজহাঁস… এককথায় পাখির স্বর্গোদ্যান! আর আসত কুকুর। মূলত টিবেটিয়ান লাসা অ্যাপসো সিডনি সিল্কির বাচ্চা। এক গা ভরতি সোনালি লোম। মিহি খেউ খেউ চিৎকার… অধুনা ভোডাফোনের পাগ আর ল্যাব্রাডরের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে গেছে কলকাতার পোষ্য মানচিত্র থেকে। পশুপাখির স্টলের গায়েই বসত রঙিন মাছের বাজার। সারি সারি অ্যাকোয়ারিয়াম আর কাচের শিশিতে অ্যাঞ্জেল, সোর্ডটেইল, ব্ল্যাকমলি, ফাইটার, কিসিং গোরামি, টাইগার বার্ব… এ যেন সেই ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে’ ফুটপাতের পাশে কাচাধারে। মুগ্ধচোখে দাঁড়িয়ে দেখত ক্লাস থ্রি ফোরের একটা বাচ্চা ছেলে, বাবার হাত ধরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই যে পশুপাখি পোষার শখটা ঝিলিক মেরে উঠেছিল মাথার মধ্যে তার শুরুয়াতও কিন্তু হাতিবাগান হাট আর ওই শেয়ালদার রথের মেলায়। ষাট-ষাটটা বসন্ত পেরিয়ে এসেও আজও সেই শখটা মরে যায়নি ছেলেটার মনের মধ্যে।
পশুপাখির মেলার উলটোদিকেই টগর কুমারের ম্যাজিক শো। ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া, করাতে মানুষ কাটা আর পরমুহূর্তেই জুড়ে দেওয়া… শ কিসিমের ভানুমতীর খেল। ম্যাজিক স্টলের গায়েই লম্বাটে তাঁবু। তাঁবুর সামনেই বাইরে একটা মাচামতো। মাচার সামনে ক্লাউন সেজে নেচে কুঁদে ভিড় জমাত একটা লোক। হাতে একটা বাঁকাত্যাড়া চোঙা। ঘন ঘন অ্যানাউন্সমেন্ট— ‘আসুন, আসুন। এক্ষুনি শো চালু হয়ে যাবে… স্পাইডার গার্ল, ইলেকট্রিক গার্ল, দু’মাথাওয়ালা মেয়ে, জীবন্ত রাক্ষস মানুষ— জ্যান্ত হাঁসমুরগি ধরছে আর গপাগপ গিলছে… জলদি করুন! আর মাত্র কয়েকটা টিকিট পড়ে আছে। মূল্য মাত্র উনিশ পয়সা…।’ পিছনে টাঙানো লম্বা চওড়া একটা ক্যানভাস। অপটু হাত আর চড়া রঙে আঁকা উদ্ভিন্নযৌবনা স্বল্পবসনা বিদ্যুত্সুন্দরী, মাকড়সা কন্যাদের ছবি। দেহাতি মানুষজনের ভিড়। টিকিটের চাহিদাও মন্দ না। সেটা কতটা ক্লাউনের কথার জাগলারি আর কতটা পরদায় আঁকা ছবির আকর্ষণে সেটা বলা মুশকিল। তাঁবুটার গায়ে লেগে আরেকটা তাঁবু। আকারে একই রকম। ছোট চিড়িয়াখানা। আগের তাঁবুটার সঙ্গে তফাত একটাই। সামনে টাঙানো ক্যানভাসে মাকড়সা কন্যাদের বদলে পাহাড়, জঙ্গল, ঝরনা, নদী… চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর সব বন্যপ্রাণী। সোঁদরবনের বাঘ থেকে শুরু করে ঝকঝকে করাতের মতো দাঁত খিঁচিয়ে থাকা টিরেনসোরাস রেক্স— কে নেই সেই ছবির লিস্টে! পরদার দু’পাশে টাঙানো দুটো মাইক থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে হিংস্র বাঘের গর্জন— ‘উঁউম্ম্ম্ উঁউম্ম্ম্।’ টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলে দেখা যেত ওপর নীচ সার সার দশ-বারোটা ছোট ছোট খুপরি খাঁচা। ভাল করে উঠে দাঁড়ানোই অসম্ভব, চলাফেরা তো দুরস্থান। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, দুর্গন্ধময় খাঁচার খোপে একটা রুগ্ন লোমওঠা চিতাবাঘ। দাঁতভাঙা, পাঁজরের হাড় ঠেলে বেরোনো হায়না একটা। বিষণ্ণ চোখে গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকা বুড়ো বাঁদর, শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে যাওয়া অজগর, ঘুমন্ত এবং অভুক্ত বনবেড়াল… কেন জানি না ওই ছেলেবেলাতেই মনটা খুব ভারী হয়ে গেছিল দেখার পর। আর কোনওদিন ঢুকিনি ওই ‘মিনিয়েচার জু’-র তাঁবুটায়।
চিড়িয়াখানা-তাঁবুর পাশে অনেকটা উঁচু এবং গোলাকৃতি টিন ঘেরা জায়গা। টিনের গায়ে আঁটা সাইনবোর্ড— ‘মরণকূপের খেলা’। টিকিট কেটে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হত ওপরে। একটা গোলাকার গভীর কুয়ো। একটা ফাইভ হানড্রেড সি সি ডাবল সিলিন্ডার রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট মোটরবাইক নিয়ে মৃত্যুকূপের খেলা দেখাতেন চুঁচুড়ার তপনকুমার কুণ্ডু ওরফে তপনকুমার। একশো চল্লিশ-পঞ্চাশ স্পিডে কুয়োর দেয়ালে কাত হয়ে যাওয়া বাইকে চড়ে চক্রাকারে ওপর থেকে নীচ, নীচ থেকে ওপর প্রদক্ষিণ করতেন ভীমগতিতে, দেখতে দেখতে পেটের মধ্যে খামচে ধরত ভয়। কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ। দম আটকে আসত আতঙ্কে। পরবর্তীতে সার্কাসে গ্লোব প্যাটার্নের খাঁচায় বহুবার দেখেছি খেলাটা। অনেকটা দূর থেকে। কিন্তু রথের মেলার সেই হাড় হিম করে দেয়া অনুভূতিটা অনুভব করিনি কখনও।
মরণকূপের পর থেকেই লাইন দিয়ে শুরু হয়ে যেত মাটির খেলনার দোকান। এক ছাঁচের ঢালে গড়া কালীয় দমন, তারকা রাক্ষসীর বিশালকায় স্তনে রক্তপানরত শ্রীকৃষ্ণ, বাসুকিনাগের ফণার ছাতায় কৃষ্ণকোলে যমুনা পার হওয়া বাসুদেব, গলায় স্প্রিং-এর মাথা নাড়া বুড়ো, ইয়া মোটা আর সদা হাস্যময় কৃষ্ণনগরের জোড়া বুড়োবুড়ি, আলখাল্লা পরিহিত দাড়িওয়ালা রবিঠাকুর… মাটির খেলনা বহুদিন হল হারিয়ে গেছে শহর থেকে কিন্তু বাকি সব মূর্তি রঙিন হওয়া সত্ত্বেও রবিঠাকুর কেন আপাদমস্তক সাদা, এ ব্যাখ্যাটা পাইনি আজও। অধুনা এই চিনে খেলনা অধ্যুষিত শহরে।
রথের মেলা বলতেই সবাই বোঝে পাঁপড়ভাজা। এরকম একটা অদ্ভুত ধারণা, প্রায় মিথের পর্যায়ে, কীভাবে গড়ে উঠল বোঝা দায়। অথচ পাঁপড়ের পাশাপাশি জিলিপি, খাজা, লাঠিগজা আর তেলেভাজাও মেলার অন্যতম মূল আকর্ষণ। অথচ সেসবের কথা বলা-ই হয় না প্রায়। একটা দুটো নয় অন্তত দশ-বারোটা এরকম অস্থায়ী খাবারের দোকান বসত শেয়ালদার রথের মেলায়। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিলিপি আর খাজার ওপর প্রথম উড়তে দেখা মৌমাছি… দৃশ্যটা গেঁথে রয়েছে মনের মধ্যে, আজও।
এর পাশাপাশি জৈন শিল্প মন্দিরের আচারের দোকানে গোটা পাঁচেক লম্বা লম্বা র্যাকে সাজানো রকমারি আচারের বয়াম। কুল থেকে শুরু করে আম হয়ে চালতা, আদা, রসুন, তেঁতুল মায় ফুলকপি, বাঁশের কোঁড় (ব্যাম্বুশুট) অবধি। এক কথায় বিরাটাচারও বলা চলে। জৈন শিল্প মন্দিরের গায়ে লাইন দিয়ে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র আর এয়ারগানে বেলুন ফাটানোর স্টল। স্টলের পিছনে চাঁদমারিতে গোলাকার বৃত্তে সাজানো লাল, নীল, সবুজ বেলুন। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাক করে ফাটাতে হত বাঁশে কনুই ভর দিয়ে। পার শট দু’-নয়া পয়সা। ক্লাস এইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সেটা বেড়ে চৌকোনা পাঁচ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। তবে পাকা নিশানাবাজদের কাছে বেলুনের চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল সুতোয় ঝোলানো পয়সা। অব্যর্থ টিপে নড়ে উঠত বন্দুকবাজের গর্বিত হাসিটা আরেকটু চওড়া করে।
বেলুন স্টলের উলটো ফুটপাতে মাটিতে উলকির পসার সাজিয়ে বসত যাযাবরী মহিলারা। আঁটসাঁটো চেহারা, খাটো ব্লাউজ, পেঁচিয়ে টাইট করে পরা শাড়ি, কনুই অবধি ঢাকা অজস্র চুড়িতে। নিজেদের গায়েও অসংখ্য উলকি। যখনকার কথা বলছি, তখনও উলকি ‘ট্যাটু’ হয়ে উঠতে প্রায় অর্ধশতক বাকি। মূলত দেহাতি ঝি-বহুরিরাই ছিলেন এই উলকিওয়ালিদের প্রধান গ্রাহক। উলকিওয়ালি, সামনে বিছানো একটা আধময়লা কাপড়ে আঁকা উলকির নমুনা। বিষয় নানাবিধ। এক হাতে গন্ধমাদন অন্য হাতে গাম্বাট সাইজের গদা নিয়ে ফ্লাইং বজরঙ্গবলী, বংশীবাদনরত কেষ্টঠাকুর, ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্ট, হিন্দি লেটারহেডে লেখা ‘রাম’… ইত্যাদি ইত্যাদি। সামনে হাত পেতে বসা দেহাতি বউ। হাতের কবজিতে পেতল-তামা-রুপো আর দস্তা মেশানো চারধাতুর ইয়া মোটা খাড়ু। কানের ফুটো ঝুলে ইঞ্চিখানেক হাঁ হয়ে গেছে ভারী পেতলের মাকড়ির টানে। তুঁতে রং মাখানো অপরিশোধিত সুচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে উলকি এঁকে দিচ্ছে যাযাবরী উলকিওয়ালি (ভাগ্যিস তখন এইচ আই ভি জুজুর ভয় ছিল না)। রঙের সঙ্গে ফুটে উঠছে বিন্দু বিন্দু রক্ত। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও পরম পরিতৃপ্তির ছাপ দেহাতি বহুরির মুখে। মরদের নাম লেখাচ্ছেন যে। দিনেকালে উলকির সঙ্গে সঙ্গে কানঝোলা মাকড়ি আর মোটা খাড়ুর দেহাতিনিরাও যে কোথায় হারিয়ে গেলেন এই ‘ট্যাটু’ শহরে কে জানে।
চারটে খেলনা। স্টলে নয়, ঘুরে ঘুরে বিক্রি হত রথের মেলায়। মোটা বাঁশের লাঠির ডগায় ঝোলানো রং বেরঙের বেলুনের সঙ্গে পেপার পাল্পের মুখোশ, মুখোশের চরিত্র মূলত দুটি। ভল্লুক আর রাক্ষস। প্লাস্টিকের ব্যাটম্যান, মিকিমাউস আর ছোটা ভীম মুখোশের দাপটে এরাও বহুদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে শহর থেকে। এর পাশাপাশি বিক্রি হত কাঠির ডগায় ল্যাগবেগে হাত পা ছোঁড়া তালপাতার সেপাই, কাঠির ডগায় পাতলা দেশলাই কাঠের লিভারের চাপে লাফ দিয়ে ওঠা শোলার কাঠবেড়ালী আর সরু তারের স্টিক আঁকড়ে থাকা প্লাস্টিকের বাঁদর। তারটাকে উলটে ধরেই ফের সোজা করে দিলে থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে নেমে আসত নীচে। এরাও সবাই নিরুদ্দিষ্ট অনেকদিন। এদের মধ্যে তালপাতার সেপাই, বছর দুয়েক আগে বিক্রি করতে দেখেছিলাম একজনকে বইমেলার গেটে। দু’-চারটে কিনে নিয়ে উপহারও দিয়েছিলাম পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনের ভাইপো ভাইঝি নাতিপুতিকে। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাওয়া, বার্বি আর কমপিউটার গেমস প্রজন্ম সব। হাত পেতে নিল বটে তবে তেমন একটা উত্সাহ দেখাল বলে মনে হল না।
আজ যেখানে মৌলালি যুবকেন্দ্র, ঠিক সেখানটায় তখন বড় একফালি ফাঁকা জমি। ইলেকট্রিক নাগরদোলার জন্ম হয়নি তখনও। ওই ফাঁকা জমিটায় বসত কাঠের নাগরদোলা। মজবুত কাঠের চারটে ঘেরাটোপ। একেকটায় চারজন করে বসতে পারে দু’জন শা-জোয়ান চালকের হ্যাঁচকা হাতের টানে ওপর থেকে নীচ ঘুরে যেত বনবন করে। কিন্তু পাঁচতলা বাড়ি সমান উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলার বিদ্যুত্গতিতে নীচে নেমে আসার সময় সেই পেট খামচে ধরা আতঙ্ক আর অসম্ভব গা গোলানো ভাবটা ছিল না একদম। তার বদলে হালকা শিরশিরে মজাদার একটা অনুভূতি। হাতে কাঠি আইসক্রিম বা পাঁপড়ভাজা… অলৌকিক একটা ছেলেবেলা। সেটা যারা কাঠের নাগরদোলা না চড়েছেন তাঁদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
মেরি-গো-রাউন্ড। নাগরদোলার পাশাপাশি তত্কালীন মেলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ। মাথার ওপর গোল ছাতার মতো রঙিন চাঁদোয়া। নাগরদোলার মতো এটিও কাঠের তৈরি এবং সম্পূর্ণভাবে হস্তচালিত। বাহন হিসেবে রডে আটকানো কেশর ফোলানো কাঠের ঘোড়া এবং হাতি। একদম খুদেদের জন্য কাঠের বাক্স। হুবহু নাগরদোলার মতোই। তবে চাহিদার তুঙ্গে সবসময় হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা বাঘ। কয়েকপাক ঘুরে এসে থামলেই নতুন সওয়ারিদের মধ্যে রেষারেষি বেধে যেত বাঘের পিঠে কে সওয়ার হবে এই নিয়ে। তবে চালকদের মধ্যস্থতায় অধিকাংশ সময় মোটামুটি একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানই হত বলা চলে।
এই মেরি-গো রাউন্ডেরই আর একটা ক্ষুদ্র সংস্করণও আসত মেলায়। তলায় চাকা লাগানো মোটা লোহার পাইপের ওপর আঁটা গোল একটা লোহার রিং। রিঙের গায়ে ফিট করা চারটে ছোট ছোট চেয়ার। সবে মুখে বোল ফুটেছে অথবা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে এরকম খুদেদের জন্য। বেশি লোকজনের প্রয়োজন নেই। একজন চালকের হাতের টানেই ঘুরত রিংটা এবং বড় মেরি গো রাউন্ডের চেয়ে অনেক আস্তে। চড়বার দক্ষিণাও তুলনামূলকভাবে কম। ঘোরানোর সময় কট কট শব্দ হত একটা। তলায় চাকা লাগানো থাকায় ঠেলে নিয়ে যাওয়া যেত এদিক ওদিক। বিকেলের দিকে পাড়াগুলোতেও আসত মাঝে মাঝে। চোখে পড়া মাত্র বাপ-মায়ের ওপর বায়নায় হামলে পড়ত কচিকাঁচার দল। পরবর্তীতে গ্রামের মেলাগুলোয় কাঠের নাগরদোলা আর মেরি-গো-রাউন্ডের দেখা মাঝেমধ্যে মিললেও এই মোবাইল মিনিয়েচার মেরি-গো-রাউন্ড চোখে পড়েনি একটিবারের জন্যও। আপনাদের মধ্যে কারও পড়েছে কি? পড়ে থাকলে জানাবেন।
মৌলালি থেকে হাতের বাঁদিকে ঘুরেই রাস্তার দু’পাশে আর অধুনা বিলুপ্ত বুলেভার্ডের নীচে সার সার সস্তা ফার্নিচারের দোকান। সেগুন, বার্মা টিক বা মেহগনির বদলে কমদামি কাঁঠাল, পেয়ারা বা কেরোসিন কাঠের আলমারি, খাট, চেয়ার ড্রেসিং টেবিল, ঠাকুরের আসন… পুরনো সেই রথের মেলায় সেসময় নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মেলা থেকে কেনা সস্তা কাঠের আলমারি বা ড্রেসিং টেবিল হাতে টানা রিকশায় চাপিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন সদ্যবিবাহিত নিম্নবিত্ত দম্পতি— এ অতি পরিচিত দৃশ্য পঞ্চাশ-ষাট দশকের কলকাতায়। আসবাবপত্রের চত্বরটা টপকেই শুরু হয়ে যেত কাঠ, বেত আর লোহার জিনিসপত্রের বিশাল বাজার। হাঁড়ি, কড়াই, ছুরি, কাঁচি, দা, কোদাল, বেলচা, বেতের ধামা-কুলো-ঝুড়ি, কাঠের বারকোশ এমনকী লাঙলের ফাল, কী না পাওয়া যেত এখানে। সেসময় কারা এসব কিনত সেটা আজও এক অপরিসীম রহস্য আমার কাছে। মোটামুটি সত্তর দশকের প্রথমভাগ থেকেই গড়ে ওঠা ফ্লাইওভার, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং একই সঙ্গে ফুটপাত সংকোচন— এই ত্রিফলা আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমগত ছোট হয়ে যেতে থাকে বিশাল এই মেলার পরিসর। নব্বইয়ের গোড়াতেই সংকুচিত হতে হতে এসে ঠেকে যায় মৌলালির মোড়ে মাত্র মিটার ত্রিশেক জায়গায়। পরবর্তীতে প্রায় উঠে যেতে যেতে কোনওমতে টিকে গিয়ে স্থানান্তরিত হয় অদূরে রামলীলা পার্কে। মেলার পরিসর ছোট হয়ে গেলেও সময়টা একই আছে। প্রতিবছর রথের দিন শুরু হয়ে চলে টানা একমাস। তবে অতীতের সেই বৈচিত্র্য আর জৌলুস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি কোনওদিনই। নিজের ক্ষুদ্র সংস্করণকে রামলীলা ময়দানে বাঁচিয়ে রেখে বরাবরের মতো এ শহরকে আলবিদা জানিয়েছে কলকাতার সবচেয়ে বড় মেলা। শেয়ালদা রথের মেলা।