১৩. কমলাপুর রেলস্টেশন

কমলাপুর রেলস্টেশনে শুভ্ৰ দাঁড়িয়ে আছে।

এত লোকজন চারপাশে সে কাউকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মানুষগুলোই মনে হচ্ছে ছায়া মূর্তি, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেও সে তিন জনের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ভেবেছিল এ রকম সমস্যা হবে। দলের অন্যদেরই বা সে কি করে খুঁজে বের করবে। একমাত্র উপায় যদি ওদের কেউ তাকে দেখতে পায়। এখনো কেউ দেখতে পায় নি। ওরা কি আসে নি? সাড়ে নটা বাজে। এর মধ্যেতো এসে পড়া উচিত। এত দেরী করছে কেন?

আপনি, আপনি এখানে?

শুভ্ৰ তাকাল। তার সামনে একটি তরুণী মূর্তি তা সে বুঝতে পারছে, কিন্তু চিনতে পারছে না। গলার স্বরও অচেনা। নিশ্চয় ক্লাসের কোনো মেয়ে। ক্লাসের মেয়েরা ছেলেদের তুমি তুমি করে বলে, শুধু শুভ্রের বেলায় আপনি। দোষটা অবশ্যি শুভ্রর। সে ক্লাসের কোনো মেয়েকে তুমি বলতে পারে না।

আপনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারছেন না। আমার নাম জরী। সাবসিডিয়ারীতে আমরা এক সঙ্গে ক্লাস করি।

ও আচ্ছা।

এখনো আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি? আপনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার কথা হয়েছে।

শুভ্ৰ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমি চিনতে পেরেছি।

তাহলে বলুন আমার নাম কি?

শুভ্র বিব্রত গলায় বলল, আমি চোখে কিছুই দেখতে পারছি না। এই জন্যে কিছু চিনতেও পারছি না। আমার চশমা ভেঙ্গে গেছে। চশমা ছাড়া আমি কিছুই দেখি না।

জরী বলল, আমরা সবাই এই খবর খুব ভালো জানি। আপনার নাম হচ্ছে কানা বাবা। আমরা মেয়ের অবশ্যি কানা বাবা বলি না।

আপনারা কি বলেন?

আমরা বলি–The learned blind father.

Learned?

লারনেড না ডেকে উপায় আছে। যে ছেলে জীবনে কোনো দিন কোনো পরীক্ষায় ফাস্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় নি তাকে ইচ্ছে না থাকলেও লারনেড ডাকতে হয়।

শুভ্ৰ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছে।

বিব্রত বোধ করার প্রধান কারণ সে এখনো মেয়েটিকে চিনতে পারে নি।

জরী বলল, আপনি কি দারুচিনি দ্বীপে যাচ্ছেন?

জ্বি।

আমাকে এত সম্মান করে জ্বি বলতে হবে না। আমিও আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এই প্লাটফরম থেকে ময়মনসিংহ লাইনের গাড়ি যায়। আপনার গাড়ি ছাড়বে চার নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে।

শুভ্ৰ হাসি মুখে বলল, আমিতো এ সবের কিছুই জানি না। এক জন লোক হাত ধরে ধরে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে দাঁড়িয়েই আছি।

জরী বলল, চলুন হাত ধরে ধরে আপনাকে চার নম্বর প্ল্যাটফরমে নিয়ে যাই। ধরুন হাত ধরুন। সংকোচ করার কিছু নেই। আপনি হচ্ছেন কানা বাবা।

জরী ভেবে পেল না সে হঠাৎ এত কথা বলছে কেন? সে তো চুপচাপ ধরনের মেয়ে। এত কথাতো সে কখনো বলে না। আজ তার হয়েছেটা কি?

শুভ্ৰ হাত ধরল। খানিকটা ইতস্ততঃ করে বলল, আপনিই বা কেন এদিকে এলেন? আপনারাওতো চার নম্বর প্ল্যাটফরমে থাকার কথা।

কেউ এখনো আসে নি। তাই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আচ্ছা আপনার চোখ এত খারাপ আপনারতো উচিত বাড়তি চশমা রাখা।

শুভ্র বলল, এক্সট্রা চশমা বাড়িতে আছে।

জরী বলল, আপনার ব্যাগ কে গুছিয়ে দিয়েছে বলুনতো?

আমার মা।

তাহলে ব্যাগ খুললেই বাড়তি চশমা পাওয়া যাবে। দেখি আপনার ব্যাগটা খুলি। চাবি দিনতো।

শুভ্র বলল, আমার মনে হয় না। মা বাড়তি চশমা দিয়েছেন।

অবশ্যই দিয়েছেন। কোনো মা এত বড় ভুল করবে না। দিন চাবি দিন।

ব্যাগ খুলতেই খাপে মোড়া দুটা চশমা পাওয়া গেল।

চোখে চশমা দিয়ে শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি এত সেজেছেন কেন? আজ রাতে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। এটা হচ্ছে বিয়ের সাজ। বিয়ে হয়নি বলেই যেতে পারছি।

শুভ্র বলল, ভাগ্যিস হয় নি। বিয়ে হলে আপনার সঙ্গে দেখা হত না। আমারো দারুচিনি দ্বীপে যাওয়া হত না। বোকার মতো একা একা ভুল প্ল্যাটফরমে দীড়িয়ে থাকতাম। কেউ আমাকে খুঁজে পেত না। আর পেলেও কেউ বুদ্ধি করে বলতে পারত না যে আমার ব্যাগে এক্সট্রা চশমা আছে। আমাকে যেতে হত। অন্ধের মতো।

জরী হাসল।

এখন তার সব কিছুই ভালো লাগছে। পৃথিবীটা অনেক বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে। ন্টেশনের হৈচৈ আলো সব মিলিয়ে কেমন যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে পৃথিবী এত সুন্দর কেন? আরেকটু কম সুন্দর হলে তো ক্ষতি ছিল না। দুই জন হাঁটছে ছোট ছোট পা ফেলে। শুভ্ৰ হঠাৎ কি মনে করে বলে ফেলল, চশমাটা পাওয়া না গেলেই ভালো হত।

কেন?

আপনি আমাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যেতেন। আপনি যখন আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন আমার অসম্ভব ভালো লাগছিল। কিছু মনে করবেন না- কথাটা বলে ফেললাম। বেশির ভাগ সময় আমরা মনের কথা বলতে পারি না বলে কষ্ট পাই। আমি ঠিক করেছি। আমি এই ভুল কখনো করব না। যা বলতে ইচ্ছা করে— তা বলব। আপনি কি রাগ করলেন?

জরী সহজ গলায় বলল, না রাগ করি নি। আপনি বরং এক কাজ করুন চশমাটা খুলে পকেটে রেখে দিন। আমি আপনাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাই। নয়ত ওরা দেখলে হাসাহসি করবে।

শুভ্র চশমা খুলে পকেটে রাখল।

জরী তাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দলটির সঙ্গে দেখা হলো। সবাই একসঙ্গে চেচিয়ে উঠল— কানা বাবা। কানা বাবা।

আনুশকা ছুটে এসে বলল, জরী তোরতো যাওয়ার কথা ছিল না।

জরী বলল, চলে এলাম।

খুব ভালো করেছিস। খুব ভালো। তুই কানা বাবাকে কোথায় পেলি?

পেয়ে গেলাম। বেচারা চশমা ভেঙ্গে ফেলেছে। হাত ধরে আনা ছাড়া উপায় কি?

দলের সবাই আবার চেঁচিয়ে উঠল— কানা বাবা। কানা বাবা।

 

সঞ্জুর বাবাও এসেছেন।

সঙ্গে মুনাকে নিয়ে এসেছেন। সঞ্জু খুব অস্বস্তি বোধ করছে।

সে বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে গা টেপাটেপি হচ্ছে। মোতালেব ফিস ফিস করে বলল, দেখ সবাই দেখা খোকাবাবুর বাবা ফিডিং বোতল হাতে চলে এসেছে। লোকটার কি বুদ্ধি শুদ্ধি নেই?

সবাই ট্রেনে উঠেছে। প্রথম শ্রেণীর রিজার্ভ করা কামরায় নয়। থার্ড ক্লাসে। তাতে কারোর আনন্দে ভাটা পড়ছে না। হাসাহাসি, আনন্দ উল্লাসের সীমা নেই। আনুশকা পাশের অচেনা এক ভদ্রলোককে বলল, ব্রাদার আপনি কি সেন্ট মেখেছেন গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে। সেই লোক হতভম্ব।

জরী শুভ্ৰকে বলল, আপনি চশমা পরছেন না কেন?

শুভ্ৰ হাসিমুখে বলল, আমি চশমা পরব না বলে ঠিক করেছি।

বেশ তাহলে হাত ধরুন। আপনাকে ট্রেনে নিয়ে তুলি।

মোতালেব চেঁচিয়ে বলল, ভাইসব রাস্তা করে দিন, কানা বাবা আসছে কানা বাবা। দি লারনেড ব্লাইন্ড ফাদার।

নীরা চেঁচিয়ে বলল, অবিকল এই রকম একটা দৃশ্য আমার কল্পনায় ছিল। সুনীল অন্ধ হয়ে গেছে। আমি তার হাত ধরে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সুনীল এই পৃথিবীকে দেখছে আমার চোখ দিয়ে। বানিয়ে বলছি না। বিশ্বাস করা। এই দ্যাখ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

আনুশকা বলল, লারনেড ব্লাইন্ড ফাদারকে সারাক্ষণ হাত ধরে ধরে কে টানবে? চিটাগাং নেমেই ওর জন্যে চশমার ব্যবস্থা করতে হবে। শুনুন লারনেড ব্লাইন্ড ফাদার, সব সময় আমরা আপনাকে আপনি বলেছি, এখন আর বলব না। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।

শুভ্ৰ হাসল। মাথা ঝাকিয়ে বলল, আমি খুব খুশি হব। যদি তা করেন।

আরেকটা কথা এমন ফরম্যাল ভঙ্গিতে কথা বলবেন না, বললে চিমটি খাবেন।

জ্বি আচ্ছা। আর বলব না।

রানা বলল, একটা গান ধরলে কেমন হয়?

নীরা বলল, খুব খারাপ হয়। আচ্ছা আমি বসব কোথায়? আমার তো বসার জায়গা নেই।

রানা বলল, তুমি এবং সুনীল তোমরা দুই জন দাঁড়িয়ে যাও। হাত ধরা ধরি করে দাঁড়িয়ে থাক।

আমার দাঁড়িয়ে যেতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সুনীলকে বসতে দাও। জানালার পাশে বসতে দাও। বেচারা কবি মানুষ।

সত্যি সত্যি জানালার পাশে খানিকটা জায়গা খালি করা হলো। সেখানে কেউ বসল না।

 

মুনা লক্ষ্য করল। সবাই আছে শুধু অয়ন নেই।

সে কি যাচ্ছে না? কাউকে জিজ্ঞেস করতে তার খুব লজ্জা লাগছে। তবু লজ্জা ভেঙ্গে মোতালেবকে জিজ্ঞেস করল।

মোতালেব বিরক্ত মুখে বলল, যাওয়ারতো কথা, গাধাটা এখনো কেন আসছে না কে জানে। ট্রেন মিস করবে। গাধারা সব সময় এ রকম করে। আগে একবার পিকনিকে গেলাম। সে গেল না। পরে শুনি চাঁদার টাকা জোগাড় হয় নি। আরে এক জন চাঁদা না দিলে কি হয়। সবাইতো দিচ্ছি।

মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, উনার কি টাকার জোগাড় হয় নি?

মোতালেব বলল, কি করে বলব। আমাকেতো কিছু বলে নি।

মুনা অসম্ভব রকম মন খারাপ করে বাবার কাছে চলে এল। আর তখনি সে অয়নকে দেখল। অয়ন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় সে চাচ্ছে না কেউ তাকে দেখে ফেলুক। মুনা চেঁচিয়ে ডাকল, অয়ন ভাই। অয়ন ভাই।

অয়ন প্ল্যাটফর্মে গাদা করে রাখা প্যাকিং বাক্সগুলোর আড়ালে সরে গেল। মুনা এগিয়ে গেল। পিছনে পিছনে এলেন সোবাহান সাহেব।

মুনা বলল, অয়ন ভাই আপনি যাচ্ছেন না। ট্রেনতো ছেড়ে দিচ্ছে।

অয়ন কি বলবে ভেবে পেল না। সোবাহান সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, দৌড়ে গিয়ে উঠ। সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে।

অয়ন নীচু গলায় বলল, চাচা আমি যাচ্ছি না।

যাচ্ছ না কেন?

টাকা জোগাড় করতে পারি নি। এক জনের দেয়ার কথা ছিল সে শেষ পর্যন্ত…

গার্ড বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। ট্রেন নড়তে শুরু করেছে। অয়ন ছোট্ট করে নিঃশাস ফেলল।

মুনার চোখে পানি এসে গেছে। সে জল ভেজা চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

সোবাহান সাহেব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে শান্তগলায় বললেন, বাবা এই নাও এখানে ছয়শ টাকা আছে। তুমি যাও দৌড়াও।

অয়ন ধরা গলায় বলল, বাদ দিন চাচা। আমি যাব না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে সে কখনোই কোথাও যেতে পারে না। তার জন্যে খুব কষ্টতো তার হয় না। আজ কেন হচ্ছে?

সোবাহান সাহেব বললেন, এক থাপ্পর দেব। বেয়াদপ ছেলে। দৌড় দাও। দৌড় দাও।

মুনা বলল, যান। অয়ন ভাই যান। প্লীজ।

অয়ন টাকা নিল।

সে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে মুনা। সে কেন ছুটছে তা সে নিজেও জানে না।

দলের সবাই জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকাচ্ছে। মোতালেব এবং সঞ্জু হাত বের করে রেখেছে—কাছাকাছি এলেই টেনে তুলে ফেলবে। এইত আর একটু। আর একটু… ।

সোবাহান সাহেব চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছেন—হে মঙ্গলময় ঈশ্বর। এই ছেলেটিকে দারুচিনি দ্বীপে যাবার ব্যবস্থা তুমি করে দাও।

ট্রেনের গতি বাড়ছে।

গতি বাড়ছে অয়নের। আর ঠিক তার পাশাপাশি ছুটছে মুনা। সে কিছুতেই অয়নকে ট্রেন মিস করতে দেবে না। কিছুতেই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *