১৩. কথা-অবশেষ
শুরুতে যে কথা বলেছি, গ্রন্থের শেষে আবার সেই কথাটি স্মরণ করি। একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির কারণে বাল্মীকি ছদ্মনামের আড়ালে কোন সর্বশাস্ত্র বিশারদ এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন মনে করি। রাজনৈতিক অথবা সামাজিক কারণে কোন নৃপতির পরিত্যক্ত স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকারের দাবী প্রতিষ্ঠা করাই এই মহাকাব্য রচনার উদ্দেশ্য। চারণবেশী লবকুশের মুখে রামায়ণ গান শুনে রামচন্দ্র সত্য উপলব্ধি করে নির্বাসিত পত্নী সীতার সন্তানদ্বয়কে পুত্ররূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে রামচন্দ্রর ভ্রাতা শত্রুঘ্ন যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে মথুরায় পূর্ণ মৰ্যদার সঙ্গে রাজত্ব করা সত্ত্বেও এই মহাকাব্যর সূত্র ধরে নিঃশব্দে বিনা রক্তপাতে সিংহাসনের উত্তরাধিকার স্থির হয়েছিল। এজন্য দেখা যায় রামচন্দ্র কুশকে রাজ্যের মূল অংশ কোশল এবং লবকে উত্তর কোশলের দ্বায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।
মহাপণ্ডিত আদিকবি তার উদ্দেশ্যসাধনের স্বার্থে মহাকাব্যে নিপুণভাবে কৃষিভিত্তিক লোকসঙ্গীতের আধারে ঐতিহাসিক তথ্য সন্নিবেশিত করে রহস্য সৃষ্টি করেছেন।
সংস্কারমুক্ত মনে রামায়ণ পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করা যায় একদা সুদুর অতীতে কোশল নামক রাজ্যের রাজধানী তথাকথিত অযোধ্যার রাজঅন্তঃপুরে কোন এক সময়ে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এর ফলে যুবরাজ-ঘোষিত রাজপুরকে রাজধানী ত্যাগ করতে হয়। কিছুকাল পরে, আপাততঃ মহাকাব্য অনুসরণে চৌদ্দ বৎসর সময়কাল ধরা যেতে পারে, সেই নির্বাসিত রাজপুত্র হৃত পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ব্যক্তি-জীবনে এই রাজপুত্রকে কখনই সুখী বলা যায় না। কারণ নির্বাসনকালে তিনি বারংবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন; যেমন মহাকাব্যে দেখা যায় চিরকূট ত্যাগের পর বালিবধ পৰ্য্যন্ত সকল ঘটনার মধ্যে ইংগিতে রাজ্যবিস্তার তথা ক্ষমতা হস্তগত করার রাজনৈতিক কার্যকারকতা প্রকাশ পাচ্ছে। অপরদিকে পিতৃরাজ্য উদ্ধারের পর বিভিন্ন ঘটনা যথা লবণ বধ, শম্বুক বধ ইত্যাদি ঘটনা রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের সাক্ষ্য বহন করে।
মহাকাব্যটিকে স্থূলভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) অযোধ্যার রাজপ্রাসাদ হতে রামচন্দ্রর নির্বাসন, (২) কিষ্কিন্ধ্যা প্রসঙ্গ এবং (৩) লংকার ঘটনাবলী। একটি ক্ষীণ যোগসূত্র তিনটি ভাগকে বেঁধে রেখেছে। লক্ষণীয় যে রাবণের অস্তিত্ব অযোধ্যার রাজা দশরথের অজানা ছিল না। বিশ্বামিত্র দশরথের রাজ-দরবারে রাবণের দুর্ধর্ষতার কথা জানিয়েছিলেন। সুতরাং অযোধ্যাবাসীগণ পরাক্লান্ত রাবণ ও তার অত্যাচার বিষয়ে সম্যক অবগত ছিল। কিন্তু এতবড় লংকা যুদ্ধের কোন প্রতিফলন বা প্রতিক্ৰিয়া অযোধ্যা তথা কোশলরাজ্যে হয়নি, অন্ততঃ তার কোন উল্লেখ আদিকবি করেননি। দেখা যায় চিত্ৰকূটে রাম ও ভরতের সাক্ষাৎকারের পর রাবণ-বধের ঘটনা পর্যন্ত অযোধ্যা রাজ্যের কোনই উল্লেখ নাই।
বালি বধের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। রাবণের সঙ্গে বালির সখ্যতা ছিল। রাম বালিকে বধ করে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করে দিলেন, কিন্তু তার কোন ভাল বা মন্দ প্রতিক্ৰিয় লংকায় হয়নি; এই প্রসঙ্গর কোন উল্লেখ মহাকাব্যে নাই।
এমত বিভিন্ন ঘটনা অনুধাবন করলে মনে হয় অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যা
এবং লংকা এই তিন রাজ্য যেন একান্তভাবে স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন ও যোগাযোগহীন; যেন তিন গ্রহে অবস্থিত। একমাত্র রাম ও লক্ষ্মণ এই তিন রাজ্যের যোগসূত্র। মহাকাব্যে আপাতঃদৃষ্টিতে এই যে অসংগতি লক্ষিত হয়, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই অসংগতির মধ্যে অবশ্যই রহস্য আছে। রহস্য অনুভূত হয় যখন দেখা যায় কিষ্কিন্ধ্যার বানর রাজ্যে একটি মাত্র হনুমান আছে। বানর শব্দে বনচর ধরে কিষ্কিন্ধ্যাকে অন্-আর্য আদিবাসী (কিন্তু অশিক্ষিত ও অসভ্য মনে করার কারণ নাই) অধ্যুষিত রাজ্য বলা যায়। হনুমানকে সুপণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ, রণকুশলী অথচ বহিরাগত ব্যক্তি হিসাবে চেনা যায়। এক্ষেত্রে উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হনুমানের জন্মকাহিনী এবং হনুমানের সমুদ্র লঙ্ঘন নিছক নৈসর্গিক ঘটনা। কিন্তু রাম ও সুগ্ৰীবের সখ্যতা, হনুমানের সঙ্গে লংকার অশোকবনে সীতার সাক্ষাৎকার ইত্যাদি ঘটনার ঐতিহাসিকতা অস্বীকার করা যায় না। তখন হনুমান একটি ব্যক্তিবিশেষ। অতএব হনুমান নামধেয় চরিত্রটির মধ্যে ঐতিহাসিক ও নৈসর্গিক তত্ত্বের সমাবেশ এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করতে না পারলে সত্য উদ্ঘাটন সম্ভবপর নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্তমান গ্রন্থে কয়েকটি মূল চরিত্রের একাধিক সত্তা উন্মোচন করা হয়েছে। এইভাবে বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন ঘটনা প্রভৃতির বর্ণনার মর্মে উপনীত হতে পারলে দেখা যাবে অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যা ও লংকা একই মহাদেশে পরম্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং সম্পর্কযুক্ত।
প্রথমেই বলেছি রামায়ণের দুইটি সত্তা আছে; বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত। এই গ্রন্থের অল্প পরিসরে মহাকাব্যর বাহ্যিক স্বরূপটি উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সূত্র ও চরিত্রকে অবলম্বন করে রাম-কথার কৃষিসত্তাকে এখানে উপস্থাপিত করা হয়েছে। কৃষির সঙ্গে জ্যোতিবিজ্ঞান ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতিবিজ্ঞানের তথ্য বিভিন্ন উপাখ্যানে প্রকাশ্যে অথবা রহস্যে পাওয়া
যায়।
রাম ও সীতার মেঘ ও কৃষিদৈবত সত্তা অবলম্বনে কালক্রমে রাম-কথাকে ধর্মগ্রন্থে রূপায়িত করা হয়েছে। তবু এই কৃষিসত্তার সূত্রে প্রদত্ত জ্যোতিবিজ্ঞান তথ্য অতীতের একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সময়কালের নির্দেশ করছে। পূর্বোক্ত প্রকরণগুলিতে সেই সময়কালের অয়ন ও বিষুব স্থান চিহ্নিত করতে প্রচেষ্টা নিয়েছি। সেই তথ্যর সঙ্গে বর্তমান কালের সূক্ষ্ম হিসাব সম্বলিত ১৯০০ শকাব্দের ‘রাষ্ট্ৰীয় পঞ্চাঙ্গ’ পুস্তকে প্রদত্ত তথ্যাদির তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে।
উত্তরায়ণ | বাসন্ত-বিষুব | দক্ষিণায়ন | শারদ-বিষুব | |
সিদ্ধাশ্রম কাহিনী অনুসারে | ২৭৬।৪০।০০ | ৬।৪০।০০ | ৯৬।৪০।০০ | ১৮৬।৪০।০০ |
রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ অনুসারে (১৯০০শকাব্দ) | ২৪৬।১২।৩৭ | ৩৩৬।১৩।৪৫ | ৬৫।৪৩।১৯ | ১৫৬।০৩।২২ |
কালের ব্যবধান | ৩০।২৭।২৩ | ৩০।২৬।১৫ | ৩০।৫৬।৪১ | ৩০।৩৬।৩৮ |
দুই সময়কালের অয়ন ও বিষুবর ব্যবধান গড় হিসাবে (৩০।২৭।২৩+ ৩০।২৬।১৫+ ৩০।৫৬।৪১+ ৩০।৩৬।৩৮)=১২২।২৬।৫৭ / ৪= ৩০।৩৬৷৪৪ (ত্রিশ অংশ ছত্রিশ কলা চুয়াল্লিশ বিকলা)।
বাৎসরিক ৪৮” (আটচল্লিশ) বিকলা অয়নবেগ হিসাবে ৩০।৩৬।৪৪ (ত্রিশ অংশ ছত্রিশ কলা চুয়াল্লিশ বিকলা) বিষুব পশ্চাদ্গামী হতে প্রায় ২২৯৫ (দুই হাজার দুইশত পচানব্বই) বৎসর লাগে।
সুতরাং ২২৯৫ হতে ১৯৭৮ খৃষ্টাব্দ (১৯০০ শকাব্দ) বাদ দিলে খৃঃ পূঃ ৩১৭ অব্দে উত্তরায়ণ ছিল ২৭৬°৪০’ (দুইশত ছিয়াত্তর অংশ চল্লিশ কলায়)। অতএব ঐতিহাসিক রামচন্দ্রর জন্মকাল খৃঃ পূঃ ৩৩৩ অব্দ দাবী করা যায়। এই অনুসারে—
রামচন্দ্রর জন্ম খৃঃ পূঃ ৩৩৩ অব্দ
মারীচ ও সীতার হিসাবমত বারো বৎসরে বিবাহ খৃঃ পূঃ ৩২১ অব্দ
ষোল বৎসরে সিদ্ধাশ্রম ঘটনা খৃঃ পূঃ ৩১৭ অব্দ
জামদগ্ন্যর দর্পচূর্ণ খৃঃ পূঃ ৩১৬ অব্দ
চব্বিশ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পর বনগমন খৃঃ পূঃ ৩০৮ অব্দ
লংকাযুদ্ধে রাবণকে বধ করার পর ১৪ (চোদ্দ) বৎসর বনবাসকাল পূর্ণ এবং তারপরে অযোধ্যার সিংহাসনে আরোহণ খৃঃ পূঃ ২৯৫ অব্দ
রামায়ণের দুইটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রাবণ এবং হনুমান সম্পর্কে এই গ্রন্থে কোন বিশ্লেষণ সংযোজিত না হওয়ায় আপাতঃদৃষ্টিতে ত্রুটি মনে হতে পারে। রাম-কথার কৃষিসত্তা প্রমাণের ক্ষেত্রে রাবণ অনাবৃষ্টির প্রতীক একথা বলেছি। যে কথা বলা হয়নি, তা হল হনুমান সেই বায়ুপ্রবাহ যা গ্রীষ্মঋতুর শেষ পর্যায়ে মেঘকে আকর্ষণ করে এনে বৰ্ষাঋতুতে বারিবর্ষণে সহায়তা করে। হনুমানের এই নৈসর্গিক সত্তা রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে তার জন্ম ও বাল্যকাহিনীতে স্পষ্ট হয়।
হরধনু ভঙ্গ করে অযোধ্যায় ফেরার পথে জামদগ্ন্যর ঔদ্ধতার উচিত শিক্ষা কম আকর্ষণীয় নয়। জামদগ্ন্য মূলতঃ পৃথিবী হতে খালি চোখে দৃশ্যমান একটি ধূমকেতু; যেটিকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে আতঙ্ক জড়িয়ে আছে। এই ধূমকেতুটি, বর্তমানে ‘হ্যালীর ধূমকেতু’ নামে পরিচিত, প্রামাণ্য তথ্যানুসারে খৃঃ পূঃ ২৪০ অব্দে দেখা গিয়েছিল। হিসাব অনুসারে খৃঃ পূঃ ৩১৬ অব্দেও এটির আবির্ভাব ঘটেছিল; অর্থাৎ রামায়ণ কাহিনীতে যে বৎসরে দাশরথি রাম জামদগ্ন্যর দর্প চূর্ণ করেছিলেন।
এই গ্রন্থেরর অল্প পরিসরে এই সকল প্রসঙ্গর বিচার করা সম্ভব হল না, আগামীতে এই গ্রন্থের উত্তর-ভাগে রামায়ণের অন্যান্য চরিত্র ও উপাখ্যানের বিশ্লেষণ দেওয়ার বাসনা আছে। সংকল্প আছে রামায়ণের অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক তথ্যর স্বরূপ উদ্ঘাটন।