১৩. ওসমান সাহেব

১৩

সন্ধ্যাবেলা ওসমান সাহেব নিজে গিয়ে পরীক্ষা করলেন, গেট বন্ধ করা হয়েছে কি না। তালা টেনে-টেনে দেখলেন। দারোয়ানকে বললেন, ‘ভোর হবার আগে গেট খুলবে না। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবে, বাড়িতে কেউ নেই।

‘জ্বি আচ্ছা।’

গেটের তালার চাবি কাউকে দেবে না। এমন কি ফিরোজ যদি চায়, তাকেও দেবে না।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘রাতটা মোটামুটি সজাগ কাটাবে। কোনো শব্দটব্দ হলে বের হয়ে দেখবে কী ব্যাপার।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

ওসমান সাহেব চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকলেন। ফরিদার সঙ্গে তাঁর দেখা হল, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হল না। দু’ জন এমন ভাব করছেন, যেন কেউ কাউকে চেনেন না। অনিদ্রাজনিত কারণে ফরিদার চোখ লাল। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। ওসমান সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারটাতে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থেকে মৃদু স্বরে বললেন, ‘ফিরোজ কেমন আছে?’

ফরিদা জবাব দিলেন না।

ওসমান সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। কানে যায় নি?’

ফরিদা কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন। ওসমান সাহেব চাপা স্বরে বললেন, ‘কথার জবাব দাও। ফিরোজ কেমন আছে?’

‘ভালো।’

‘ভালো মানেটা কী? গুছিয়ে বল।’

‘গুছিয়ে বলতে পারব না। তুমি দেখে এস। আর শোন, আমার সঙ্গে এ রকম ভঙ্গিতে কথা বলবে না।’

ফরিদা উঠে গেলেন। রওনা হলেন ফিরোজের ঘরের দিকে। ক্রুদ্ধ আওয়াজ আসছে সে-ঘর থেকে। চাপা আওয়াজ। কোনো মানুষের কণ্ঠ থেকে এ-ধরনের আওয়াজ হওয়া সম্ভব নয়। যে এমন আওয়াজ করছে, সে মানুষ হতে পারে না। ফরিদার গা কাঁপতে লাগল। কী হচ্ছে এ-সব! তিনি কি এগিয়ে যাবেন, না ফিরে আসবেন? এগিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা করছে না, কিন্তু তিনি গেলেন।

কাছাকাছি যাওয়ামাত্র ক্রুদ্ধ গর্জন থেমে গেল। তিনি দেখলেন, ফিরোজ বেশ ভালোমানুষের মতো চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। হাতে একটি বই। সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। ফরিদা বললেন, ‘কেমন আছিস তুই?’

‘ভালো। তুমি কেমন আছ মা?’

ফরিদার চোখে পানি এসে গেল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে এই প্রথম ফিরোজ এমন স্বরে কথা বলল।

‘ফিরোজ, তুই আমাকে চিনতে পারছিস তো?’

‘চিনতে পারব না কেন? কী বলছ তুমি!’

‘গত দু’ দিন তো চিনতে পারিস নি।’

‘তোমারও তো আমাকে চিনতে পার নি।’

‘আমরা চিনতে পারব না কেন?’

‘না, চিনতে পার নি। চিনতে পারলে নিজের ছেলেকে তালাবদ্ধ করে রাখতে না। তোমরা বিশাল একটা তালা দিয়েছ। হা হা হা।’

ফরিদা কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, ‘কিছু খাবি ফিরোজ?’

‘হ্যাঁ, খাব। কিন্তু মা, টেবিলে খাবার দেবে। তালা খুলে ফেলবে। আমি খাবার ঘরে টেবিল-চেয়ারে বসে খাব।’

ফরিদা কোনো উত্তর দিলেন না। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফিরোজ যা বলছে তা সম্ভব নয়। তালা খুলে তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

‘কি মা, কথা বলছ না যে? তালা খুলবে না?

ফরিদা জবাব দিলেন না।

‘কিন্তু মা তালাবন্ধ করে কাউকে আটকে রাখা ঠিক না। খুব অন্যায়। অন্যায় নয়?’

‘হ্যাঁ, অন্যায়।’

‘বেশ, তালা খোল।’

ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। তার কোলের ওপর রাখা বইটি মেঝেতে পড়ে গেল, ফিরোজ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সে এগিয়ে এসে জানালার শিক ধরে দাঁড়াল। ফরিদা জানালার পাশ থেকে একটু দুরে সরে গেলেন।

‘দূরে চলে গেলে যে মা? ভয় লাগছে? হা হা হা। খুব ভয় লাগছে, না?’

ফিরোজ জানালার শিক ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

ফরিদা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, ‘এ-রকম করছিস কেন?’

‘লোহার শিকগুলো কেমন শক্ত, তাই দেখছি।’

‘এ রকম করিস না বাবা।’

‘তালা খুলে দাও, এ রকম করব না। আমি চিড়িয়াখানার জন্তু নই মা, যে, আমাকে খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখবে। যাও, বাবার কাছে যাও। চাবি নিয়ে এস। বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে আসছে। আমি খোলা মাঠে খানিকক্ষণ হাঁটব। যাও, যা করতে বলছি কর।’

ফরিদা বসার ঘরের দিকে এগুলেন। ফিরোজ জানালার শিক ধরে ঝাঁকাচ্ছে। তার মুখ হাসি-হাসি। যেন শিক ঝাঁকানো খুব-একটা মজার ব্যাপার। আনন্দের একটা খেলা। খুব ছোটবেলায় ফিরোজ এ-রকম করত। জানালায় উঠে শিক ধরে ঝাঁকাত।

ওসমান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। কঠিন স্বরে বললেন, ‘কী পাগলের মতো কথা বলছ। তালা খুলব মানে? কী হয়েছে, তুমি জান না?’

ফরিদা চুপ করে রইলেন।

‘একটা ছেলে মারা গেছে। তার পরেও তুমি বলছ তালা খুলব।’

‘তালা দিয়েই-বা লাভ কী হচ্ছে? ঐ রাতেও তো তালাবন্ধ ছিল। ছিল না?’

ওসমান সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। হ্যাঁ, ঐ রাতে তালাবন্ধ ছিল। এবং ভোরবেলা ঘর তালাবন্ধই পাওয়া গেছে।

ফরিদা বললেন, ‘ঐ ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে ফিরোজের কোনো সম্পর্ক নেই। ফিরোজ ঘরেই ছিল।’

‘ঘরে থাকলেই ভালো।’

ফরিদা স্বামীর পাশে বসলেন। তাঁর মুখ শান্ত। তাঁর চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ। ওসমান সাহেব বললেন, ‘তুমি কিছু বলবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বলে ফেল। এভাবে তাকিয়ে থেক না।’

‘ফিরোজ প্রসঙ্গে তুমি যে ডিসিসন নিয়েছ, আমার মনে হয় তা ঠিক নয়। তুমি কতদিন তাকে তালাবন্ধ করে রাখবে? ওর চিকিৎসা করাও। মিসির আলিকেই-বা আসতে দিচ্ছ না কেন?

‘ঐ ছেলেটির মৃত্যুর প্রসঙ্গ চাপা না-পড়ার আগে আমি কাউকে এ-বাড়িতে আসতে দেব না। উনি টেলিফোন করলে বলবে–ফিরোজ মামার বাড়ি গেছে।‘

‘এতে ফিরোজের অসুখ বাড়তেই থাকবে।’

‘বাড়ুক। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, তোমার ছেলেকে ওরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিক। চাও?’

‘না, চাই না।’

‘তাহলে চুপ করে থাক। একটা তালা আছে, আরেকটা তালা লাগাও।’

‘ফিরোজকে তুমি শুধু শুধু সন্দেহ করছ। তালাবন্ধ ঘর থেকে সে কীভাবে বের হবে?’

‘তা জানি না। কিন্তু সে বের হয়েছে, এটা আমি যেমন জানি–তুমিও তেমন জান। এই নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তুমি অন্য ঘরে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।’

ঝনঝন শব্দ হচ্ছে ফিরোজের ঘরে। সে প্রচণ্ড শব্দে জানালা ঝাঁকাচ্ছে।

ফরিদা নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলেন। ওসমান সাহেব বের হয়ে এসে কঠিন স্বরে ফিরোজকে বললেন, ‘এ-রকম করছিস কেন? স্টপ ইট।’

ফিরোজ হাসিমুখে বলল, ‘রাগ করছ কেন বাবা?’

ওসমান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

‘দরজা খুলে দাও বাবা। আমি খাবার ঘরে বসে ভাত খাব। খিদে লেগেছে। কি, খুলবে না?’

‘লোহার রডটা আমার কাছে দে, আমি তালা খুলে দিচ্ছি।’

‘না বাবা, ওটা সম্ভব নয়। লোহার রডটা দেয়া যাবে না।’

‘কেন দেয়া যাবে না?’

‘ও রাগ করবে।‘

‘কে রাগ করবে?’

‘নাম বললে চিনবে? শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছ কেন? তালা খুলবে কি খুলবে না?’

ওসমান সাহেব জবাব না দিয়ে চলে এলেন। ফিরোজ জানালা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে খুব হাসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *