ঐতিহাসিক ভীমসেন
সম্রাট আওরংজীবের রাজত্বকালের (১৬৫৭-১৭০৭ খ্রি.) একখানি সম্পূর্ণ ইতিহাস আছে, তাহা মুহম্মদ সাকী মুস্তাদ খাঁর লেখা। সম্রাটের মৃত্যুর মাত্র তিন বৎসর পরে সরকারী কাগজ-পত্র ও নিজের স্মৃতির সাহায্যে মুস্তাদ খাঁ এখানি লেখেন। ঘটনার পরম্পরা, কর্মচারী পরিবর্তন ও শাসনের নিয়মাবলী, লোক ও জায়গার নাম ও তারিখ প্রভৃতির হিসাবে বইখানি অমূল্য। কিন্তু বইখানি খুব ছোট, প্রতি বৎসরের ইতিহাস মাত্র দশ পৃষ্ঠার মধ্যেই শেষ করা হইয়াছে। সুতরাং প্রতি পরিচ্ছেদ এখনকার সরকারী গেজেটের মত কৰ্ম্মচারী বিনিয়োগ ও পরিবর্তনের তালিকা ও ঘটনার চুম্বকে পূর্ণ। কি করিয়া এবং কেন ঐ সকল ঘটনা ঘটিল, তখনকার দেশের অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহার কোনও পরিচয় ইহাতে পাওয়া যায় না।
এইসব বিষয়ে ভীমসেনের লেখা বিবরণ নুস্থা-ই-দিলকশা সৰ্ব্বাঙ্গ সুন্দর, বিলাতের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে একখানি সম্পূর্ণ পুঁথি আছে। ইণ্ডিয়া অফিসের পুঁথিখানি তেমন নির্ভুল নয় এবং এই অসম্পূর্ণ বইখানি গোলকুণ্ডা বিজয়ের (১৬৮৭ খ্রি.) ইতিহাস দিয়া হঠাৎ থামিয়াছে। প্যারির জাতীয় পুস্তকালয়ের (Bibliotheque Nationale)-তেই একখানি সম্পূর্ণ নির্ভুল পুঁথি আছে, আর কোনও হস্তলিখিত গ্রন্থের সন্ধান জানা যায় নাই। জোনাথন স্কটের ইংরাজী দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস (১৭৯৪ খ্রি.) ইহার একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ বাহির হইয়াছিল। কিন্তু অনুবাদটি বহু ভ্রমপ্রমাদে পূৰ্ণ।
ভীমসেনের পিতার নাম রঘুনন্দন দাস। রঘুনন্দন দাসেরা ছিলেন ছ’ভাই। অন্যান্য ভাইদের নাম ছিল ভগবান দাস, শ্যামদাস, গোকুল দাস, হরিদাস ও ধৰ্ম্মদাস। জাতিতে ইঁহারা শাক্সেনা শ্রেণীস্থ কায়স্থ ছিলেন। ভগবান দাস তখনকার দিনের হিন্দুদের পক্ষে সর্ব্বোচ্চ-সম্ভব চাকুরী পাইয়াছিলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের মুঘল রাজত্বের দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং ১৬৫৭ খ্রি. ‘দিয়ানত্রায়’ এই উপাধি পান।
ভ্রাতৃ-বিরোধের সময়ে দিল্লী জয় ও সিংহাসন লাভ পর্যন্ত তিনি আওরংজীবের সঙ্গে ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন (১৬৬৪ খ্রি.) পর্যন্ত দিল্লীতে সম্রাট-সান্নিধ্যে অবস্থান করিয়াছিলেন। তাঁর আশা ছিল আওরংজীব তাঁকে সাম্রাজ্যের প্রধান দেওয়ান নিযুক্ত করিবেন; কিন্তু ১৬৫৮ খ্রি. জুন মাসে যখন আওরংজীব পিতাকে আগ্রা দুর্গে বন্দী করিলেন, তখন সম্রাট শাজাহানের সহকারী দেওয়ান রায়-ই-রায়ান রঘুনাথ রায় (ইনি সহকারী হইলেও প্রধান দেওয়ানের একটিনি কার্য্য করিয়া আসিতেছিলেন) শাজাহানের পক্ষ অবলম্বন করেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার-স্বরূপ রঘুনাথ রায়কে প্রধান দেওয়ান নিযুক্ত করা হইল, যদিও তাঁকে ঐ পদের উপাধি দেওয়া হইল না। দিয়ানৎ-রায়ের উচ্চাশা নিৰ্ম্মল হইল।
রঘুনন্দন দাক্ষিণাত্যের গোলন্দাজ বিভাগের মুশরিফ (হিসাব লেখক ) ছিলেন। শেষ জীবন সুখ শান্তিতে কাটাইবার জন্য ১৬৭০ খ্রি. ইনি সরকারী কাজ ছাড়িয়া দেন। ১৬৭৪ খ্রি. তিনি আওরঙ্গাবাদে মারা যান।
১৭০৫ সম্বৎ (১৬৪৯ খ্রি.)-এ তাপ্তি নদীতীরস্থ খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুরে ভীমসেন জন্মগ্রহণ করেন। আট বৎসর বয়সে তিনি বুরহানপুর ত্যাগ করিয়া পিতার নিকট আওরঙ্গাবাদে আসেন। সেই বৎসর ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি বিশেষ স্মরণীয় বৎসর। তখন পিতার হস্ত হইতে রাজদণ্ড কাড়িয়া লইবার জন্য সম্রাট পুত্রদের মধ্যে সংগ্রাম চলিতেছিল। এই সংগ্রামের যে-সকল সংবাদ ও গুজব সুদূর আওরঙ্গাবাদে পৌঁছিত তাহার একটা স্পষ্ট স্মৃতি ভীমসেনের মনে জাগরূক ছিল। দশ বৎসর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে নাসিকের গিরিগুহা ও ত্র্যম্বক দুর্গ দেখিয়া আসেন। দিল্লিতে দিয়ানৎ রায়ের (১৬৬৪ খ্রি.) মৃত্যুতে পরিবারের সকলের উচ্চ রাজপদ পাইবার আশা লোপ পাইল। দিয়ানৎ রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র জগরামকে সম্রাট হাতীশালার মুশরিফ নিযুক্ত করিলেন। হাতীশালার মুশরিফ কোনও বড় চাকুরী নয়। কিন্তু এই চাকুরীও তিনি বেশী দিন করিতে পারিলেন না, কয়েক বৎসর পরেই তিনি মারা যান। তারপর দিয়ানৎ রায়ের অপর পুত্র সুখরাজ রাজকীয় ‘পানীয়ও তাম্বুল বিভাগের মুশরিফ নিযুক্ত হন।
আওরঙ্গাবাদে থাকাকালীন (৯-১৫ বৎসর পর্যন্ত) ভীমসেন পিতার নিকট ফার্সী ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। তারপর সাত বৎসর পিতার প্রতিনিধিরূপে কাজ করেন। রঘুনন্দন বৃদ্ধ ও দুর্ব্বল হইয়া পড়িতেছিলেন, সবসময় রাজসভায় ও গোলন্দাজ বিভাগের কার্য্যে যাইতে পারিতেন না। সেইজন্য সম্রাট যদি শোনেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে মাত্র ২১ বৎসর বয়স্ক তাঁহার পুত্ৰ কাৰ্য্য পরিচালনা করিতেছে, তাহা হইলে সম্রাটের রোষে পড়িতে হইবে, এই আশঙ্কায় ১৬৭০ খ্রি. তিনি কার্য্যে ইস্তফা দেন।
ভীমসেনকে এইবার কাজের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িতে হইল। অনেক মুরুব্বিকে তিনি ধরিলেন, কিন্তু কোন কাজই হইল না, অবশেষে তিনি সৈন্যাধ্যক্ষ দাউদ খাঁর অধীনে যুদ্ধাশ্ব পরীক্ষা ও দাগানের কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। তাঁর ঠিক উপরিতন কর্মচারী ছিলেন সৈন্যাধ্যক্ষের বখ্শী আব্দল মামুদ। এই কার্য্য প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দিতে ও কার্য্যের উপযুক্ত সম্মান বজায় রাখিবার জন্য সাজ-সরঞ্জাম কিনিতে ও লোকজন রাখিতে তাঁহার বহু ঋণ হইল। তিনি দাউদ খাঁর সহিত দেখা করিতে জুন্নারে যাইতেছিলেন। তাঁহাকে জুন্নারে যাইতে হইল না, পথেই দাউদ খাঁর সহিত দেখা হয়। দাউদ খাঁর সঙ্গে আওরঙ্গাবাদে যুবরাজ মুয়াজ্জমের দরবারে ফিরিলেন। মুয়াজ্জম তখন দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধি ও শাসনকর্তা। এই সময় মুয়াজ্জমের সঙ্গে সৈন্যাধ্যক্ষ দিলির খাঁর ভয়ানক বিরোধ উপস্থিত হইল। দাউদ খাঁ দিলির খাঁর পক্ষ অবলম্বন করিলেন, সুতরাং যুদ্ধ স্থগিত হইল, ভীমসেনের চাকুরী গেল। কিন্তু মহারাজ যশোবন্ত সিংহ অনুগ্রহ করিয়া একটা চাকুরী দিলেন। মহারাজের সঙ্গে ভীমসেন তাপ্তির দিকে দিলির খাঁকে ধরিবার উদ্দেশ্যে রওনা হইলেন। এই সুযোগে ভীমসেন জন্মভূমি বুরহানপুর দেখিলেন। ১৬৭০ খ্রি. তাঁরা আওরঙ্গাবাদে ফিরিয়া আসেন।
এই সময় শিবাজী সুরাট দ্বিতীয়বার লুঠ করিয়া ফিরিতেছিলেন। কুমার দাউদ খাঁকে শিবাজীকে ধরিতে পাঠাইলেন। পূর্ব্ব চাকুরীর সহিত বখ্শীর কেরানীগিরি চাকুরী এবার ভীমসেনের জুটিল। ভীমসেন দাউদ খাঁর সহিত রণক্ষেত্রে ছুটিলেন। বাণীদিন্দোরীর যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই যুদ্ধে মুঘলবাহিনী শিবাজীর নিকট পরাজিত হইয়া ছিল। তারপর ভীমসেন দাউদখাঁর সৈন্য-সামন্তের সহিত নাসিক ও আমদনগরে যান।
চান্দোর পর্ব্বত শ্রেণীস্থ ধোড়প দুর্গে মারাঠারা তখন ভারী উৎপাত লাগাইয়াছিল। মারাঠাদের উৎপাত বন্ধ করিবার জন্য দাউদ খাঁ আনকাই টঙ্কাইএ গমন করিলেন। তারপর সালের দুর্গ অবরোধের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্য বগলনায় যান। এই যাত্রায় ভীমসেন সৈন্যসামন্ত সঙ্গ ছাড়া হইয়া পড়িয়া ভয়ানক বিপদগ্রস্ত হন, কিন্তু নুরখাঁ নামক মারাঠা সৈন্যদলের একজন বেতনভুক কর্ম্মচারী তাঁহাকে রক্ষা করেন। নুরখাঁ আওরঙ্গাবাদে থাকাকালীন ভীমসেনের পিতার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু দাউদ খাঁ ঠিক সময় আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই। শিবাজী সালের দুর্গ দখল করিয়া লইলেন। দাউদ খাঁ তবুও চান্দোরের নিকট যুদ্ধ করিয়া অতি কষ্টে অহিবন্ত দুর্গ অধিকার করেন।
এইসময় সম্রাটের নিকট হইতে একখানা চিঠি আসিল। তাহাতে সম্রাট কুমারের অনুরোধে ভীমসেনকে যুদ্ধাশ্ব পরীক্ষা ও দাগানের কার্য্য দিতে হুকুম দিয়াছিলেন। যশোবন্ত সিংহ ভীমসেনকে চাকুরী দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন, তাতেই কুমার সম্রাটকে এই অনুরোধ করেন। কিন্তু তখন দাক্ষিণাত্যে নূতন সৈন্যাধ্যক্ষ মহাবত খাঁ আসিয়াছেন। তিনি তাঁহার অধীনস্থ হিন্দু মোসাহেবেদের প্ররোচনায় দারার দেওয়ানের পুত্র বৃন্দাবনকে কাজ দেন। মুখের গ্রাস এইরূপে অপরে কাড়িয়া লইল। ভীমসেন বহুদিন কোনও কাজ না পাইয়া অতি দুঃখে কষ্টে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। এইসময় তাঁর অবস্থাপন্ন উচ্চ পদস্থ বন্ধুরা তাঁহাকে যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করিয়াছিল।
কিছুদিন পর বাহাদুর খাঁ দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা হইয়া আসেন (১৬৭২ খ্রি.)। তিনি ভীমসেনকে এই চাকুরী দেন।
১৬৭২ খ্রি. নভেম্বর মাসে মারাঠা রামগীর (হায়দ্রাবাদের ১১০ মাইল উত্তর-পূর্ব্ব কোণে) লুঠ করে। এই সময় ভীমসেনের সহিত একজন দরবেশের সাক্ষাৎ হয় ও ভারী কৌতূহলোদ্দীপক এক ঘটনা ঘটে। পরের দুই বৎসর ভীমসেন বহু অর্থ উপার্জ্জন করিয়া সুখে কালাতিপাত করেন। এত সমারোহে তিনি থাকিতেন যে, তিনি নিজেই বলিয়াছেন, অত সমারোহে বড় বড় ওমরাহগণও থাকিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ। এইসময়ে তাঁহার অনেক আত্মীয় মারা যান, খুল্লতাত গোকুলদাস, ভ্রাতা শীতলদাস, পিতা রঘুনন্দন এবং পরে হররায় ও হররায়ের পিতা শ্যামদাস একে একে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
বহুদিন ধরিয়া ভীমসেন নিঃসন্তান ছিলেন। সেইজন্য ভ্রাতা শীতলদাসের এক পুত্রকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন। ছেলেটি ১৬৭১ খ্রি. জন্মগ্রহণ করে। দৈবজ্ঞেরা ছেলেটির নাম উমীচাঁদ রাখেন, কিন্তু ভীমসেন রাখেন ব্রজভূষণ। ১৬৭৮ খ্রি. ছেলেটির বিবাহ হয়।
১৬৮৬ খ্রি. পরিশ্রান্ত হইয়া ভীমসেন গোমস্তাদের উপর কাজের ভার দিয়া নিরিবিলিতে থাকিবার জন্য নলদুর্গে অবস্থান করেন। নলদুর্গ সোলাপুরের ২৫ মাইল উত্তরপূর্ব্ব কোণে। এইখানে ১৬৮৮ খ্রি. তাঁর এক পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই পুত্রের নাম শম্ভুনাথ। এই পুত্র জন্মগ্রহণ করিলেও তিনি ব্রজভূষণকে জ্যেষ্ঠ পুত্রের ন্যায়ই দেখিতে লাগিলেন
ইহার কিছুদিন পর ভীমসেন নলদুর্গ ত্যাগ করিয়া সোলাপুরে আসিয়া মুঘলবাহিনীর সহিত যোগ দেন। এইখানে তিনি আওরংজীবের অপর এক সেনাপতি, দাতিয়ার বুন্দলা রাজা দলপৎ রাও-এর নিজ কার্য্যকারক নিযুক্ত হন। বুন্দেলখণ্ডে ১২,০০০ হাজার টাকা আয়ের জায়গীর মাহিয়ানা স্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয়। দলপৎ রাও ইহার পর ১৮ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। সে অবধি ভীমসেন দলপতের সংস্রব ত্যাগ করেন নাই।
দলপৎ রাও বাদশার উজীর আসদ খাঁর পুত্র জুলফফর খাঁ বাহাদুর নসরৎ জঙ্গের অধীনে সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৬৯১ খ্রি. দক্ষিণ আরকট জেলায় জিঞ্জি দুর্গ পর্যন্ত জঙ্গল ভাঙ্গিয়া ভীমসেনকে দলপৎ রাও-এর সহিত যাইতে হইয়াছিল। মুঘলবাহিনীকে এই দুর্গ অবরোধ কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখিতে হয়, এই সুযোগে দলপৎ ভীমসেনকে সঙ্গে করিয়া বিখ্যাত ইয়োরোপীয় চিকিৎসকগণ কর্তৃক চিকিৎসিত হইবার জন্য প্রথম বন্দীবাসে এবং পরে মাদ্রাজে যান। রাও-এর অসুখ ভাল হইল না, কিন্তু প্রচুর অর্থ ব্যয় হইয়া গেল ৷
দলপত্রাও-এর কার্য্যোপলক্ষে ভীমসেনকে ব্রহ্মপুরীতে বাদশাহী শিবিরে আসিতে হইল। ব্রহ্মপুরী ভীমানদীর তীরে এবং পংঢারপুরের দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব কোণে অবস্থিত। এই কাজ শেষ করিয়া তিনি জিঞ্জিতে ফিরিয়া আসেন। কিন্তু জিঞ্জিতে বেশীদিন থাকা হইল না; পুত্র শম্ভুনাথের বিবাহোপলক্ষে নলদুর্গে ফিরিতে হইল। বিবাহ হায়দ্রাবাদে সম্পন্ন হয়। ইহার কয়েকদিন পরেই দলপত্রাও-এর আর একটি কার্য্যোপলক্ষে তাঁহাকে আগ্রায় যাইতে হইল। আগ্রা হইতে ফিরিয়া পুনরায় তিনি নলদুর্গে আসেন। জিঞ্জির পতনের পর (১৬৯৮ খ্রি.) দলপত্রাও নলদুর্গে আসেন। ভীমসেন এইখানে প্রভুর সহিত মিলিত হয়। এই আট বৎসর ঘুরিয়া ঘুরিয়া ভীমসেন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অনেক বিখ্যাত তীর্থ ও মন্দির দর্শন করেন। তিনি এইসব স্থানের সংক্ষিপ্ত মূল্যবান বর্ণনা লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন।
১৬৯৮ খ্রি. মাঝামাঝি সময়ে পন্হালা দুর্গ অবরোধের জন্য একদল মুঘলবাহিনী প্রেরিত হয়। এই দুর্গ কোলাপুরের দশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। দুর্গ অবরুদ্ধ, হাতেও কোন কাজ নাই, ভীমসেন কি করিয়া সময় কাটাইবেন? এই দুর্গ-পাদমূলে শিবিরে বসিয়া তাঁর বিখ্যাত ইতিহাসখানি লিখিতে শুরু করেন। আওরংজীবের দীর্ঘকাল ব্যাপী যুদ্ধের ফলে দাক্ষিণাত্য জনশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছিল। চারিদিকেই দুর্ভিক্ষ- শাসন সংরক্ষণলোপ পাইয়াছিল বলিলেই চলে। এই ভীষণ অরাজকতার মধ্যে বাস করা কোন ক্রমেই নিরাপদ নহে। সুতরাং, ভীমসেন পরিবার পরিজন সকলকে নলদুর্গ হইতে প্রথমে আওরঙ্গাবাদে ও পরে দলপত্রাও-এর রাজধানী দাতিয়ায় পাঠাইয়া দেন। (১৭০৬ খ্রি.)।
পর বৎসর সম্রাটের মৃত্যু হয়। তাঁহার তৃতীয় পুত্র আজম দাক্ষিণাত্যে নিজেকে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিয়া সৈন্যসামন্ত লইয়া দিল্লী ও আগ্রা অধিকারে রওনা হন। আগ্রা হইতে ২০ মাইল দক্ষিণে জাজাউতে আজম জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রথম বাহাদুর শাহের নিকট পরাজিত ও হত হইলেন। জাজাউ-এর যুদ্ধক্ষেত্রে একটা গোলা আসিয়া দলপত্রাওকে উড়াইয়া লইল, ভীমসেনের হাতও আহত করিল। ভীমসেন প্রভু দলপত্রাও-এর সহিত একই হস্তীপৃষ্ঠে ছিলেন। আহত হইয়াও অত যন্ত্রণার মধ্যেও ভীমসেন প্রভুর শেষ কার্য্য করিতে বিরত হন নাই। আগ্রা হইতে ১৬ মাইল দূরে ধামসীতে দলপত্রাও-এর দেহ সৎকার করিয়া, উন্নতির সমস্ত আশা ভরসার জলাঞ্জলি দিয়া, দাতিয়ায় ফিরিয়া গেলেন। ভীমসেনের দুরদৃষ্ট আরও বাড়িল। দলপত্রাও-এর দুই পুত্রের মধ্যে গদি লইয়া যুদ্ধ বাধিল। ভীমসেন বিপদ বুঝিয়া ও বিরক্ত হইয়া সপরিবারে দাতিয়া ত্যাগ করিয়া গোয়ালিয়রে চলিয়া আসিলেন। ভীমসেন দলপত্রাও-এর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন, দলপৎ আজম শাহের দরবারে এক অতিশয় প্রতিপত্তিশালী সেনানী ছিলেন; সেইজন্য আজম শাহ ভীমসেনকে পঁচিশ মনসবদারীর পদ দেন। এবং জাজাউর যুদ্ধক্ষেত্রে আজম নিহত না হইলে হয়ত ভীমসেনের আরও উন্নতি হইতে পারিত।
দাতিয়া হইতে চলিয়া আসিয়া ভীমসেন ভয়ানক বিপদে পড়িলেন। উপার্জ্জনের কোনও উপায় নাই– সংসার চলে কি করিয়া? প্রথম বাহাদুর শাহের অধীনে বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কোন চাকুরী সুবিধা করিতে পারিলেন না। তবে রায়-ই-রায়াণ গুজর মলের সাহায্যে খুজিস্তা আতর-জাহান-শাহের অধীনে দুই পুত্র ব্রজভূষণ ও শম্ভুনাথের জন্য সাধারণ কেরানীগিরি জোগাড় করিতে পারিলেন। তিনি নিজে গোয়ালিয়রে ফিরিয়া আসিয়া ধর্ম্মে কৰ্ম্মে জীবন কাটাইতে সঙ্কল্প করিলেন। এর পরের আর কোনও সংবাদ, এমন কি তাঁহার মৃত্যুর কোন খবরও জানা যায় না।
ভীমসেনের বইখানি দুই কারণে মূল্যবান। প্রথমত: তিনি স্বচক্ষে এইসব ঘটনা দেখিয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত: তিনি যে পদস্থ ব্যক্তি ছিলেন তাহাতে তাঁহার এইসব দেখিবার সুযোগ ও সুবিধা ছিল, মুঘলবাহিনীর কেরানী থাকায় এবং কয়েকজন বড় সৈন্যাধ্যক্ষের সহিত মেলামেশার ফলে সরকার সংক্রান্ত অনেক গুপ্ত খবরেরও সঠিক বৃত্তান্ত ও কাগজপত্র দেখিবার সুযোগ তাঁর ঘটিয়াছিল। তাছাড়া তাঁহার ইতিহাসখানি সম্রাটের জন্য ও সম্রাটের তত্ত্বাবধানে রচিত হয় নাই। সেইজন্য সম্রাটের কিম্বা সম্রাটের সভাসদগণের দোষগুণ ঢাকিয়া লেখা হয় নাই। মুঘল সম্রাটদের অন্যান্য ইতিহাসের যে সর্ব্বপ্রধান দোষ আছে, তাঁহার বইখানি সে দোষ শূন্য। ভীমসেন সত্য অবগত ছিলেন এবং বলিতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না। ঐতিহাসিক বহু ব্যক্তির তিনি সঠিক পরিচয় দিয়াছেন এবং দোষ দেখাইতেও দ্বিধা বোধ করেন নাই। তারপর তিনি হিন্দু ছিলেন, প্রকৃতিও অনেকটা চিন্তাশীল ছিল; সেইজন্য আওরংজীবের রাজত্বের ঘটনাবলীর কার্য্যকরণ সম্বন্ধ-নির্ণয়ে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব দেখাইবার প্রয়োজন হয় নাই। দাক্ষিণাত্যের মুঘল যুদ্ধ সম্বন্ধে, বলিতে গেলে তাঁর প্রদত্ত বর্ণনাই একমাত্র সঠিক চাক্ষুষ বর্ণনা।
আজকালকার ঢক্কানিনাদী বড় বড় ঐতিহাসিকগণ যে-সকল কথা লিখিতে দ্বিধা বোধ করেন– যেমন সমসাময়িক লোকের আমোদ-প্রমোদ, রাস্তাঘাটের অবস্থা, সরকারী কর্মচারীদের জীবন-যাপন প্রণালী– এইসব তিনি লিখিয়া ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের ১৭শ শতাব্দীর ইতিহাস হিসাবে তাঁহার বইখানি মহামূল্যবান।
তাঁহার এই জীবন-স্মৃতি পড়িলেই তিনি যে কি চরিত্রের লোক ছিলেন তাহা বোঝা যায়। তাঁর দুর্ব্বলতা, প্রভুভক্তি, আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী পুত্রগণের প্রতি মমতা বোধ ও হিন্দুধর্ম্মের প্রতি গভীর আস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি খুব আমোদ ভালবাসিতেন, কিন্তু দুঃখে অতিশয় ম্রিয়মান হইয়া পড়িতেন। তিনি ছিলেন অতিশয় সরল, অনাড়ম্বরপ্রিয় কোমল প্রকৃতির লোক। তাঁর লেখার মধ্যেও কোনরূপ ঘোর-প্যাঁচ নাই- সব কথা সরল সুন্দর ভাবে লেখা। ফার্সী লেখকদের এইটীরই প্রধান অভাব। যদি লেখা দেখিয়া লোককে বুঝিতে হয় তবে এই সরল অনাড়ম্বর প্রকৃতি লেখক যে কি প্রকৃতির লোক ছিলেন তাহা নিঃসন্দেহে বুঝা যাইতে পারে।
[প্রভাতী, পৌষ, ১৩২৯। ভারতী, ৪৬ ভাগ, সংখ্যা ১০, মাঘ, ১৩২৯-এ পুনঃমুদ্রিত।]