কিন্তু এ কাহিনীর শেষ এখানেই নয়। তেঁতুলিয়ার শাখা নদীর উজানে ইয়াসিন মাঝির নৌকোয় পলাতক দুজনকে যাত্রা করিয়ে হয়ত এ কাহিনীর সমাপ্তি টানা যেত কিন্তু দেড় বছর পরের আর একটি কথা যদি না লিখি তাহলে গোটা কথাই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। এর প্রস্তুতি হিসেবে গোটা কয়েক ছোট ঘটনা বলা দরকার।
ছনম্বর প্লট থেকে আশরাফের কাজ শেষ হলো দিন পাঁচেক পরে। সদরে সামান্য কাজ আছে, তাছাড়া আবিদকে একবার তার দেখে আসা দরকার।
নৌকোঘাটায় বোট বাঁধল গফুর। আশরাফ নেমে এলো। হাসপাতালে ঢুকতেই বারান্দায় দেখা আবিদের সাথে। একটা লাঠি ভর করে রেলিংয়ের কাছে সে দাঁড়িয়েছিল। আশরাফ এগিয়ে এসে শুধালো, কেমন আছ এখন? বেরিয়েছ দেখছি।
আবিদ ম্লান হেসে উত্তর করল, হ্যাঁ। ভালো, অনেকটা ভালো। স্টিক ভর করে চলতে পারছি কাল থেকে।
আর কদ্দিন লাগবে?
প্রায় তো ভাল হয়েই এলুম। তবে ডান পা বোধ হয় দুর্বল থেকেই যাবে। স্টিক ছাড়া হাঁটতে পারব বলে আর মনে হচ্ছে না।
তবু ভালো।
তারপর ওর কাঁধে স্নেহের ভঙ্গিতে হাত রেখে বলল একটু পরে, কী বলছ তুমি। কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবিদ একহাতে ওকে ধরে বেডের দিকে এগুতে এগুতে বলল, দাঁতটা বসিয়ে ছিল জোর। এমন কোনদিন আর হয়নি। ভাবলে এখনো মনে হয় বুঝি রক্তপাত হবে। কদিন এত যন্ত্রণা ছিল যে শুধু ভেবেছি, আবদুল যখন গুলি করল তখন কুমিরের গায়ে না লেগে আমাকে বিধলে ভালো হোতো।
থাক ওসব কথা। বেশি কথা বোলো না।
আবিদ বেডে এসে শুয়ে পড়ল। পাজামা তুলে পাটা দেখাল একবার। তারপর চুপ করে পড়ে রইল। সারা কামরায় শুধু শুভ্রতা। আর ওষুধের একটা ঝাঁঝালো মিশেল গন্ধ। ধবধবে পর্দা টাঙানো দরোজায়, জানালায়। বেডের পাশে একটা ছোট টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিতে কয়েকটি ফুল। আজ সকালেই বদলানো হয়েছে। আবিদ একটা ফুল তর্জনী আর মধ্যমার ভেতরে রেখে দোলাতে দোলাতে শুধালো. সোজা সদরেই এলেন?
না, দিন পাঁচেক আগে বেরিয়েছি। গিছলাম ছম্বর প্লটে। কয়েকটা বড় অর্ডার ছিল, সে ব্যাপারে দেখাশোনা করতে। সেখান থেকেই সোজা ফিরছি।
কোন ফার্ম থেকে?
চাটগাঁর সেই বড় পার্টি।
আবিদ একটুকাল ভ্রু কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করল তারপর বলল, ও।
আশরাফ চাদরের একটা ভাঁজ নখ দিয়ে মিলিয়ে দিতে দিতে বলল, তাহলে ভালোই আছো এখন। তাহমিনা আর আসে নি?
না।
ও।
কেমন আছে ওরা?
ভালো সবাই।
আবিদ তাহমিনার মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। এ কদিন কি করেছে ও? তারপর আর একবারও এলো না সে আবিদ ভাবল। আবিদ এত অপেক্ষা করেছে তার জন্যে।
আশরাফ বলল, তাহলে আজকেই তোমাকে নিয়ে যাই।
আমিও তাই ভাবছি।
আশরাফ বুঝল আবিদ বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ভালো লাগছে না তার হাসপাতালে। তাই আর সে কোনো কথা না বলে ঐ কথা বলল। তারপর উঠে গেল সার্জেনের কামরায়। একবার ভেবেছিল ফারুকের কথা বলে আবিদকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভেবেছে, এখন বেশি বকানো ভালো হবে না। তাই আর কিছুই বলেনি।
সার্জন যা বললো, এক কথায় তার মানে দাঁড়ায় এই যে, এখন অবশ্যি আর কোন ভয় নেই, ঘা প্রায় শুকিয়ে আসবার পথে, তবে শরীর বড় দুর্বল। আর কিছুদিন রাখতে পারলে ভালো, তবে নিয়ে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না—- প্রেসক্রিপসন ফলো করলেই চলবে। তিনি সময় পেলে মাঝখানে নিজে একবার গিয়ে দেখে আসবেন। আশরাফ ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলে গেল, বাইরে কাজ সেরে আজ বিকেলেই ওকে নিয়ে যাবে।
.
নৌকোঘাটায় আবিদ স্টিকে ভর করে আস্তে আস্তে নেমে এলো আশরাফের সাথে। অ্যাশ শেড উলেন ট্রাউজার পরনে। আর মেরুন রঙের শার্ট। ক্রোম মেটালিক স্টিক হাতে। আগের মতই দীর্ঘ, সবল, আর উদ্ধত। দেখে চট করে বোঝা যায় না যে এতবড় একটা বিপর্যয় তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকে বলল, গফুর, আমি একটু শোবো।
.
ঘাটে এসে যখন নৌকা ভিড়ল তখন প্রায় সন্ধ্যে। এখন শুধু স্টিকে ভর করে আবিদ হাঁটতে পারল না, আশরাফের কাঁধে সে হাত রেখে ভর করল। যেতে যেতে জিগ্যেস করল, আলো দেখছিনে বাংলায়? এখনো জ্বালে নি নাকি?
জ্বলবে হয়ত।
এতক্ষণে তো পেট্রোম্যাক্স জ্বলার কথা।
হ্যাঁ। তোমার অসুবিধা হচ্ছে নাতো?
না। একটু।
বাংলোর কাছে এসে অবাক হলো আশরাফ। সারাটা বাংলো ঘিরে এক অশুভ নির্জনতা। আলো নেই। কেউ নেই। কেমন থোকা থোকা অন্ধকার ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। সে বলল, গফুর টর্চটা তুই ধর। আমি ওকে নিয়ে ওঠছি।
গফুর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল টর্চ নিয়ে। জ্বালালো। আশরাফ আর আবিদ উঠে এলো। বারান্দায়। আবিদ বলল, কারো সাড়া পাচ্ছিনে, কি ব্যাপার?
কী জানি। আমার ওখানে যায়নি তো!
ভেতরের বারান্দা ঘুরে যেতে সে আবদুলের নাম ধরে দুবার ডাকল।
আবদুল হারিকেন হাতে প্রায় ছুটে এলো। হুজুর এসেছেন?
আশরাফ শুধালো, মেমসায়েব কই? উনি কই?
তিনি তো আজ তিনদিন হলো সদরে গেছেন!
আর প্রায় সাথে সাথে আবিদ উত্তেজিত স্বরে জিগ্যেস করল, কে? উনি কে?
সাথে সাথে প্রলয় ঘটে গেল যেন। আবদুল একে একে বলে গেল সব কথা। ফারুকের আসবার কথা থেকে তাহমিনা আর তার ভোরে চলে যাবার দিন অবধি। আশরাফ হতভম্ভ হয়ে গেল। আবিদ স্তম্ভিত হয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল। এক মুহূর্তের জন্য কিছুই সে ভাবতে পারল না। কিছুই করতে পারল না। কেবল একটা অদ্ভুত বিস্মৃতি এসে তাকে আচ্ছন্ন, অবশ করে ফেলল যেন। সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকারে ভালো করে তার মুখ দেখা গেল না। সে আশরাফের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, কেন আপনি চলে গেলেন এখান থেকে? কি হত আমার অমন দুদশটা অর্ডার নষ্ট হলে? আমাকে কেন জানালেন না ফারুকের কথা? কী ভরসায় রেখে গেলেন সব একলা ফেলে? কেন? কেন?
আবিদ তুমি থামো।
ততক্ষণে আবিদ তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তাহমিনা নেই। আবদুল, তুই যেতে দিলি কেন?
হুজুর।
আবিদ, থামো। অসুখ বেড়ে যাবে তোমার। আমি দেখছি সব।
আর কী দেখবেন আপনি?
বলতে বলতে আস্তে আস্তে থেমে গেল আবিদ। যেন আর কিছু তার বলবার নেই। সে কী যেন বুঝতে পারল। ঠোঁট কাপল কিছু বলবার জন্য, কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না। আশরাফের দিকে, আবদুলের দিকে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
আবদুল শোবার ঘরের তালা ভেঙে ফেলল একটু পরেই। জ্বালল পেট্রোম্যাক্স। আশরাফ দুজন খানসামাকে ডেকে আফিয়াকে নিয়ে আসতে পাঠালো। সাথে গেল গফুর। আরো বলে দিল, খোকাকেও যেন নিয়ে আসে। আজ রাতে এখানেই হয়ত থাকতে হবে। আশরাফের সমস্ত ব্যাপারটা লাগছিল দুঃস্বপ্নের মত। তাহমিনার ওপর ভীষণ রাগ হলো তার। সমস্ত স্নেহ আর মমতা নিমেষে মুছে গেল তার ওপর থেকে। কেন সে এমন করল? কেন সে ফারুকের সাথে পালিয়ে গেল? কিসের অভাব ছিল তার? নিজে দেখে তাহমিনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল সে, তাই নিজেকে আজ বড়ো অপরাধী বলে মনে হলো তার। পর মুহূর্তে ভাবল, এমন তো নাও হতে পারে। কিন্তু সে দুরাশা শুধু মুহূর্তের জন্য। এ হচ্ছে এমন কিছু যা দুরাশারও অতীত।
আবদুল শোবার ঘরে নিয়ে গেল পেট্রোম্যাকস। আবিদ আর আশরাফ ঢুকলো তার পেছনে পেছনে। আবিদ প্রথমত ভয়ে তারপর যেন ঘৃণায় ভালো করে তাকাল না কোনদিকে, কী জানি কি চোখে পড়ে যায়। চুপ করে সে ঠায় বসে রইল। তারপর এক সময়ে তার বিস্ফারিত চোখ ঘুরে বেড়াতে লাগল তার অজান্তে মরার সর্বত্র। খাটের বালিশে এখনো মাথা রাখবার গভী: ভাঁজ। চাদরটা এলেমেলো হয়ে পড়ে আছে। তাহমিনা ভোরে উঠে যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি। আলনায় এখনো তার তাল পাকানো ছেড়ে রাখা কয়েকটা শাড়ি লুটিয়ে পড়ে আছে। আর কয়েকটা ধোয়া শাড়ি, চোলি আর ব্রা। এখনো ভাঁজ ভাঙা হয়নি তার। তাহমিনা পরেনি। নিচে কয়েক জোড়া স্যাণ্ডেল আর চটি—- তাহমিনার পায়ের ভারে কোনটায় আঙ্গুলের আবছা দাগ পড়েছে আবিদ তা জানে। আজ হঠাৎ তার মনে হলো কখন সে সব কিছুই জেনে ফেলেছে গাঁথা হয়ে রয়েছে তার মনে। আলমিরায় থরে থরে সাজানো তার কাপড়। কোনটায় তাকে মানাতো এখন স্পষ্ট হয়ে মনে পড়ল। আর মনে পড়ল ভীষণ লাল সেই চোলির কথা—-আঁটসাঁট বাঁধা পড়ত যাতে তার সুগৌর সুন্দর স্বাস্থ্য। সবচে মানাত তাকে ওই চোলিতে। সেটা বুঝি আলমিরাতেই রাখা। যে সোফায় সে বসে রয়েছে সেখানে হয়ত শেষবার বসেছিল তাহমিনা। ছোট্ট টেবিলের ওপর তাহমিনার ফটো কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। আর তার পাশে নিভিয়ে রাখা, কিছুটা ধোঁয়ায় ম্লান হয়ে যাওয়া বেডল্যাম্প। আর বাতাসে যেন তাহমিনার গাত্রসৌরভ মিহি প্রসাধনের ভারী ঘ্রাণ। সমস্ত ঘরে প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে তার স্পর্শ। শুধু সে নেই। অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো তার। মনে হলো এখুনি সে ফিরবে। তাহমিনার চিবুকের আঁটি পর্যন্ত তার মনে আছে। আর ওই জানালায় তাহমিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখত। টুকরো টুকরো ছবির মত সমস্ত চিত্র এসে উঘাটিত হলো তার সমুখে। মিলিয়ে গেল। আর চারদিকে তাহমিনার স্পর্শ এত গাঢ় যে বুঝি হাত দিয়ে ধরা যায়। আবিদের এখন ইচ্ছে হলা হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বিকট বিভৎস একটা হাসিতে সব কিছু ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু তার ভয় হলো। মনে হোলো সমস্ত শক্তি যেন তার লুপ্ত হয়ে গেছে। তার সাহস হারিয়ে গেছে।
তোষকের নিচে পেল চাবি আর একটা চিঠি। তাহমিনার চিঠি। আশরাফ দুর্বল হাতে ভাঁজ খুলে পড়ল; তাহমিনার সুন্দর হাতের অক্ষরে গোটা গোটা করে লেখা, “আবিদ, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। যদি পারো আমাকে ভুলে যেও। ইতি, তোমার তাহমিনা” কোন তারিখ নেই। আর কিছু লেখা নেই। কাগজের উল্টোপিঠ শাদা।
চাবি হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে নিঃশব্দে চিঠিটা এগিয়ে দিল আবিদের সামনে। ঘরের ভেতরে জ্বলছে উজ্জ্বল শুভ্র আলো। আবিদ চিঠিটা মেলে ধরল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না সে। সমস্ত কিছু যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা রয়েছে, কিছুতেই তার অর্থ উদ্ধার করা যাবে না।
এমন সময়ে বারান্দায় পায়ের শব্দ উঠলো। আবিদ উৎকর্ণ হয়ে তাকাল। আশরাফ বলল, আফিয়াকে নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিলাম। বোধ হয় এলো। আবদুল কফি আছে?
আছে হুজুর।
এক কাপ কফি কর আবিদের জন্যে।
আবিদ প্রতিবাদ করল। উত্তরে আশরাফ বলল, তোমার দুর্বলতা কেটে যাবে।
আফিয়ার কাছ থেকেই সব খবর পাওয়া গেল। আশরাফ খাটের ওপর বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল। আবিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আফিয়া চাবি খুলে দিল আঁচল থেকে, কান্নাধরা গলায় বলল, যাবার সময় দিয়ে গিছল রাক্ষসী।
আর কোন কথা বললো না কেউই। যেন পাথরের মত নিশ্চল নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই। সবাই ভাবছে গভীর মাথা ঝুঁকিয়ে। আবদুল কফি করে নিয়ে এলো।
বাইরে এসে আশরাফ আফিয়াকে বলল, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারনি?
আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তাহমিনা যে এমন করে চলে যাবে, কেলেঙ্কারী করবে, তা কে জানতো?
আশ্চর্য।
আমার মন কেমন করছে।
আজ রাতে এখানেই থাকো। আবিদের এমন দুর্বল শরীর কখন কী হয়, কী করে বসে, কে জানে?
সেই ভালো।
তুমি ওকে একটু বোঝাও। নইলে ও সইতে পারবে না।
আফিয়া বিছানা পেতে দিল আবিদের। ছেলেমানুষের মত ধরে শুইয়ে দিল। আবিদ যেন বোবা হয়ে গেছে! আর কোন কথা বলে নি তারপর থেকে। একবার শুধু আফিয়ার হাত ধরে বলেছে, ভাবী, তাহমিনা কিছুই বলে যায় নি?
আফিয়া মুখ ফেরাল চাপা কান্নায়। আবিদ বালিশে মুখ ফিরিয়ে আপন মনেই যেন আরেকবার বলল, তাহমিনা চলে গেছে ভাবী!
আফিয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানেই থাকো। আমি ও ঘরে খোকাকে নিয়ে আছি।
অনেকক্ষণ পর আবিদ পাশ ফিরে দেখল আশরাফ পাশে বসে আছে।
আপনি যান নি?
তুমি ঘুমোও।
হ্যাঁ, আমি ঘুমোবো।
তোমার খারাপ লাগছে খুব?
না।
তুমি ঘুমোও তারপর আমি যাবো।
আবিদ কষ্টের একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করল। আশরাফ একটু এগিয়ে এলো, ব্যথা করছে?
না, এমনি।
আশরাফ বুঝল। একটু পর সে স্নেহের সুরে বলল, তুমি ভেবো না, ও ফিরে আসবেই।
আর সে আসবে না।
তাহমিনা না এসে পারে না। আমি তাকে ফিরিয়ে আনবো। এখনো ও ছেলেমানুষ। তুমি ভেবো না। তুমি ঘুমাও।
আপনি জানেন না। আমি জানি, ও আর ফিরবে না।
তুমি ঘুমোও।
আবিদ পাশ ফিরে শুলো। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। তখন সে দরোজা ভেজিয়ে পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। অনেক রাতে আবিদের মনে হলো তাহমিনা যেন পাশে শুয়ে। সে চমকে উঠে দেখল, ভুল। বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। ব্যর্থ পৌরুষত্বের প্রতি ধিক্কার এলো। ঘুম তার এলো না। তাহমিনা নেই, সে ভাবতে পারল না। বিরাট শূন্যতা যেন আজ তার চারদিকে। তাকে যেন গ্রাস করে ফেলবে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আবিদ। পেট্রোম্যাক্স তখনো জ্বলছে, কেউ নিভিয়ে দিয়ে যায়নি। আবিদ কাপড় রাখা আলমিরার কাছে, আলনার পাশে, গিয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শ বুলোলো তাহমিনার শাড়ির ওপরে। অনেকক্ষণ ধরে। তাল পাকানো ছেড়ে রাখা শাড়িটাকে তুলল কিছুটা মুঠোর ভেতরে। নিল তার আশ্চর্য ঘ্রাণ অনেকক্ষণ ধরে। তাহমিনা যে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াত, তারপর সেখানে এসে দাঁড়াল। স্পর্শ করল তার সূক্ষ্ম ঝালর দেয়া পর্দা। আবিদ প্রেতাত্মার মত সমস্তটা কামরায় বিস্ফারিত চোখে কম্পিত হৃদয়ে জেগে রইল।
সে রাতে নাও বাইতে গিয়ে দুএকজন দেখেছে আবিদের নিশুতি বাংলোর শার্সীতে অনেক। রাত অবধি উজ্জ্বল আলো থামের মত নেমে এসে বাইরের মাটি স্পর্শ করে আছে।
.
এরপর থেকে আবিদ শান্ত হয়ে গেছে অসম্ভব রকমে। আর কোনোদিন সে শিকারে বেরোয়নি। সব সময়ে সারামুখে কেমন একটা স্তব্ধতা, ক্লান্তির ছায়া ছড়ানো। কথা বলে খুব কম। ব্যবসার কাজে প্রায় বেরোয় না বললেই চলে। আশরাফ নিজেই এখন সব দেখে। আর মাঝে মাঝেই অনুযোগ করে, তুমি এমন করে থাকলে, শরীর যে টিকবে না।
আবিদ উত্তরে হাসে। ম্লান হাসে। এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তর সে দেয় না।
কোনো কোনো সকালে তাকে দেখা যায় দীর্ঘ দুপুর অবধি বারান্দায় ডেক চেয়ার পেতে বসে থাকতে দূর অরণ্যের দিকে। দিনের খবরের কাগজ পাশেই পড়ে থাকে, পড়ে না। কিংবা হয়ত বিকেলে বসে চেক–বোর্ড নিয়ে। একেলাই খেলে। অনেক রাত হয়ে যায় তবুও ওঠে না। মাঝে মাঝে অনেক রাত্তিরে তাকে দেখা যায় ডান পা একটু টেনে টেনে বেডল্যাম্প হাতে বাংলোর প্রত্যেকটি কামরা ঘুরে বেড়াতে।
কয়েকদিন একেলা বেরোয় সমুখের পথ দিয়ে। অনেকদূর অবধি চলে যায়। আফিয়া তার জানালা দিয়ে দেখে, কিন্তু ডেকে বসাতে সাহস পায় না। মনে হয় মানুষটা যেন কাঁচের তৈরি, সামান্য স্পর্শেই চুর চুর হয়ে যাবে। কোনো কোনোদিন আফিয়া আসে বাংলোয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তত্ত্ব নেয় আবিদের। আবদুল আর খানসামাদের মৃদু তিরস্কার করে কোনো ভুলের জন্য। বারবার করে বলে যায় ভালো করে লক্ষ্য রাখবার জন্য। দাঁড়িয়ে থেকে ঘর গুছিয়ে দিয়ে যায়। বদলে দিয়ে যায় ফুলদানির ফুল।
কিন্তু তবু বাসি ফুলের মত হয়ে থাকে যেন সারাটা আবহ। আফিয়ার দুঃখ হয়, রাগ হয়। স্বামীকে সে তিরস্কার করে, তাহমিনার খোঁজ না নেয়ার জন্যে। উত্তরে আশরাফ বলে, আবিদ তাকে কিছুতেই যেতে দিতে চায় না। আফিয়া বলে, তাই বলে কি সে চুপ করে থাকবে নাকি? একটা কিছু করা দরকার।
আশরাফ একদিন এসে আবিদকে বলল, কাল আমি ঢাকা যাচ্ছি।
কেন?
এমন করে আর কদ্দিন চলবে?
আবিদ তার হাত ধরে বাধা দেয়, না, দরকার নেই। তাহমিনা সুখে থাক, তাকে ফিরিয়ে আনবেন না।
এ তোমার পাগলামো। কোন মানে হয় না এর।
তাহমিনা আসবে না।
তাই বলে চুপ করে বসে থাকবে নাকি? আমি কালই যাচ্ছি।
আশরাফ আজ ঠিক করেই এসেছিল যে আবিদকে সে রাজি করাবেই। একটা কোন খবর নেয়া হবে না, এ কী রকম কথা?
অবশেষে আবিদ একে একে তাকে বলল সব কথা। বিয়ের বছর খানেক পর থেকে শুরু সেই সন্দেহের কথা। ডাক্তারের রিপোর্টের কথা। সবকিছু। এই প্রথম সে জানালো আশরাফকে। বলল, তাহমিনা ঠিকই করেছে। আমার কাছে থেকে কী সে পেত? আমি ওকে কী দিতে পারি যে ওকে ফিরিয়ে আনতে যাব? আমার কি আছে, ওকে ফিরিয়ে আনি?
একথা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?
তাতেও কিছু হতো না।
তবুও।
সারবার কোনো আশাই ছিল না।
তুমি নিজেও বুঝতে পারনি বিয়ের আগে?
না।
আশরাফ চুপ করে রইল। তার বলবার আর কিছু নেই। নতুন করে অর্থময় হয়ে উঠলো তাহমিনার প্রতিটি আচরণ। স্পষ্ট হলো তাহমিনার আর ফারুকের ঘনিষ্ঠতার কারণ। তার মনে হলো, তার মুঠো আলগা হয়ে গেছে। ঝুর ঝুর করে ফ্রেম ধ্বসে ভেঙে পড়ছে। আবিদ বলল, একটা কথা আমার রাখবেন?
কী?
আমি যেমন আছি, তেমনি থাকতে চাই। তাহমিনাকে কোনোদিন আপনি ফেরাবেন না। যাবেন না। আমি মনে করবো, তাহমিনা মরে গেছে।