১৩. এনএসএফের কিছু পাণ্ডা

অক্টোবর মাস।

পনেরো তারিখ।

এনএসএফের কিছু পাণ্ডা তুমুল আড্ডায় বসেছে। চপ-কাটলেট এসেছে। কফি এসেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় কেবিন অন্ধকার। স্থান ‘লিবার্টি কাফে’। কাফের কোনার দিকে শুকনো মুখে নির্মলেন্দু গুণ একা বসে আছেন। তিনি খানিকটা বিষণ্ণ। তার পকেট ধুপখোলার মাঠ। এক কাপ চা কিনবেন সেই উপায় নাই। নির্মলেন্দু গুণ কবিতা লেখা শুরু করেছেন, তবে কবি স্বীকৃতি তখনো পাননি। কবিতা নিয়ে তাকে শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে আড্ডা দিতে দেখা যায়। সেই আড্ডায় কবিতা-বিষয়ক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাথা থেকে উকুন বাছেন এবং সশব্দে উকুন ফোটান। তার পাশের লোকজনদের বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাস করেন, উকুন ফোটাবেন? নেন আমার কাছ থেকে। কোনো অসুবিধা নাই। সাপ্লাই আছে। তখন তার বিষয়ে প্রচলিত ছড়াটা হলো—

নির্মলেন্দু গুণ
মাথায় উকুন।

লিবার্টি কাফেতে নির্মলেন্দু গুণ উকুন বাছা শুরু করেছেন। তার সামনে এক কাপ কফি। এবং একটা চিকেন কাটলেট। খাবারের দাম কীভাবে দেবেন—এই নিয়ে তার মধ্যে সামান্য শঙ্কা কাজ করছে। তবে তিনি প্রায় নিশ্চিত দুপুরের মধ্যে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কপাল ভালো থাকলে তার ওপর দিয়ে দুপুরের খাবারটা হয়ে যাবে। লিবার্টি কাফের মোরগপোলাও অসাধারণ।

নির্মলেন্দু গুণের মাথায় একটা কবিতার কয়েকটা লাইন চলে এসেছে। লাইনগুলি তাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিচ্ছে। লিখে ফেললে যন্ত্রণা কমত। সঙ্গে কাগজকলম না থাকায় যন্ত্রণা কমাতে পারছেন না।

কী মনে করে মাথার একটা উকুন তিনি কফির কাপে ফেলে দিলেন। কফি খেতে খেতে একটা উকুন কীভাবে মারা যায়, সম্ভবত এই দৃশ্য তার দেখতে ইচ্ছা করল। মাথার ভেতরের কবিতা এবং চুলে উকুন এই দুইয়ের যন্ত্রণায় তিনি অস্থির। কবিতার প্রতিটি শব্দ আলাদা করা যাচ্ছে। উকুনগুলি আলাদা করা যাচ্ছে না। নির্মলেন্দু গুণ মনে মনে একের পর এক লাইন সাজাতে লাগলেন।

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর–;
আমার শরীরে ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।

অতি বিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘হুলিয়া’। এই একটি কবিতাই তার নামের আগে কবি শব্দটি চিরস্থায়ীভাবে বসিয়ে দিল।

কবি নির্মলেন্দু গুণের পাশের কেবিনে আলোচনা বন্ধ হয়েছে। এনএসএফের খোকা এসে সবাইকে নিয়ে গেল। লিবার্টি কাফেতে সময় নষ্ট করার কিছু নাই। আজ নানান আমোদের ব্যবস্থা আছে। মহসিন হলে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা জুয়া চলবে। সন্ধ্যাবেলায় এসএম হলে ফিস্ট। ফিস্ট শুধুমাত্র এসএম হলের ছাত্রদের জন্যে, কিন্তু এনএসএফের নেতারা সব ফিস্টের বিশেষ সম্মানিত অতিথি। ফিস্টে যাওয়ার আগে জ্বিনের খেলা। ছাত্রলীগের এক পাণ্ডা, নাম রোস্তম, ভৈরব থেকে জ্বিনসাধক ধরে এনেছে। সে জ্বিন নামাবে।।

খোকা লিবার্টি কাফের ম্যানেজারকে সবার খাবারের বিল দিল। কবি নির্মলেন্দু গুণের বিলও দিল। খোকা কবি গুণের দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা কী করেন?

গুণ হাসিমুখে বললেন, উকুন মারি।

মারেন, উকুন মারেন উকুন মারার প্রয়োজন আছে।

 

সেই সময় মহসিন হলে এনএসএফের দখলে তিনটি রুম ছিল। একটা অ্যাসিসটেন্ট হাউস টিউটরদের বরাদ্দের দুই কামরার বড়ঘর। এটি ব্যবহার করা হতো মেয়েঘটিত অসামাজিক কার্যকলাপে। দোতলায় সাউথ ব্লকের একটিতে জুয়া খেলা হতো।

সেই দুপুরের জুয়া অসম্ভব জমে গেল। সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। জুয়াড়ির সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় রোস্তম খেলায় অংশ নিতে পারল না। সে জুয়াড়িদের সাহায্যে নিয়োজিত থাকল। প্রধান সাহায্য বিশেষ পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে দেওয়া। কর্মকাণ্ড দেখে জ্বিনসাধক সামান্য ভড়কে গেছে। খোকা আসরে নেই। সে গেছে এসএম হলে। ফিস্টের তদারকিতে।

সন্ধ্যার পরপর এসএম হলে সবার যাওয়ার কথা। কিন্তু তিন তাসের খেলা এমনই জমে গেল যে কেউ উঠতে পারছে না। আরেক দান আরেক দান করে খেলা চলছেই।

রাত আটটায় ঘরে ঢুকল খোক। তার চক্ষু রক্তবর্ণ। চেহারা উদ্ভ্রান্ত। তার কাছেই জানা গেল, কিছুক্ষণ আগে এসএম হলে পাচপাত্তুরকে ছুরি মারা হয়েছে। অবস্থা গুরুতর। পাচপাত্তুর খাওয়াদাওয়া করে নিজের ঘরে আরাম করে সিগারেট খাচ্ছিল, তখন ছাত্র ইউনিয়নের মজনু এবং করিম গল্প করার ছলে পাচপাত্তুরের ঘরে ঢুকে তাকে ছুরি মেরে নিমিষের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়।

পাচপাত্তর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২০ তারিখ মারা যায়। এর দু’মাসের মাথায় খোকার ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটে। তাকে নারায়ণগঞ্জের এক পতিতাপল্লী থেকে ধরে খুন করে ফেলে রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

যে-কোনো মহৎ আন্দোলনের পেছনে বড় কিছু মানুষের ভূমিকা থাকে। জাতি এদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে মনে রাখে। তাদের নামে সড়কের নাম হয়, মহল্লার নাম হয়। ঋণাত্মকভাবে এখানে আসে খোকা এবং পাচপাত্তুরের নাম।

ঘৃণ্য দুই ঘাতকের মৃত্যু ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে বেগবান করে। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাদের কর্মকাণ্ড বিপুল উৎসাহে শুরু করে। খোকা এবং পাচপাত্তুর জীবিত থাকলে তা এত সহজ হতো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *