এদিকে সবাই তো শ্যামাদাসকাকার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তখন দুই পকেট উলটে দিয়ে, দুই হাত শূন্যে তুলে বললে, প্রমিস্, আমার কাছে নেই। দেখতে পারেন ঝেড়ে ঝুড়ে। মালা কোন কালে ওই গুপে লক্ষ্মীছাড়াকে দিয়ে দিয়েছি। কী দরকার রে বাবা পরের জিনিসে, বিশেষ করে যখন তার মধ্যে এত বিপদ! গুপে, মালা দিয়ে দে, ভালো চাস তো।
আমিও তখুনি শার্ট খুলে ফেলে দিয়ে, প্যান্টেলুন ঝেড়েঝুড়ে সবার সামনে দেখিয়ে দিলাম যে আমার কাছে মালাটালা তো নেই-ই, অনেকগুলো বোতামও নেই।
ইন্সপেক্টরবাবু অবাক হয়ে গেলেন।
–তাহলে সেটাই-বা গেল কোথায় আর এটাই-বা কার?
ঝাঁকড়াচুল আবার এগিয়ে এসে মাথা চুলকে বললে, আজ্ঞে স্যার, ওটা আমার। বাবার মনোহারি দোকান থেকে নিয়েছিলুম।
বেচারা ভদ্রলোক অনেক সয়ে ছিলেন, এবার কিন্তু দারুণ রেগে, ছেলের দুই কান মলে দিয়ে বললেন, কেন নিয়েছিলি হতভাগা, বল নিয়েছিলি কেন? তাই চেনা চেনা লাগছিল।
ছেলে বললে, পরে প্রাইভেটলি বললে চলত না? আহা, অত চটো কেন বলো তো? দু-জনারই লাভ হত।
ইন্সপেক্টরবাবু আবার নোট বই খুলে বললেন, ধীরে ধীরে বল, নইলে টোকা যায় না।
ঝাঁকড়াচুল বললে, বলে-টলে শেষটা ফ্যাসাদে পড়ব না তো?
–আরে না না। তা ছাড়া, পুরুষ-বাচ্চা, পড়লেই-বা অত ভয় করলে চলবে কেন?
–না, তবে জেলে দিলে তো আর চন্দননগরে খেলতে যাওয়া যাবে না। আচ্ছা, দশ টাকা দেন তো বলতে পারি।
ইন্সপেক্টর হতাশ হয়ে শঙ্কুকে বললেন, তাই দাও তো ওকে।
ছোকরা ভারি খুশি হল।
–বুঝলেন স্যার, ভেবেছিলাম জমিদারবাবুর কাছে এইটে চালিয়ে দিয়ে, আসলটা বেচে সারাটা জীবন সুখে থাকব।
জমিদারবাবু হতভম্ব।
–ইস্! কী সাংঘাতিক বিশ্বাসঘাতক।
বুড়ি দারুণ চটে গেল।
–দেখুন, সাবধানে কথা বলবেন। খোকার একটা মানসম্মান আছে তো। তা ছাড়া যে নিজের স্ত্রীর মালা নিজে চুরি না করে তোক ভাড়া করে করায়, তার মুখে অত কথা শোভা পায় না।
বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা আর আমি বলতে লাগলাম, তারপর? তারপর কী হল?
ঝাঁকড়াচুল বিরক্ত হয়ে বললে, হবে আবার কী ছাই! তোমরা আসল মালা নিয়ে হাওয়া। আমি নকল মালা নিয়ে বাড়ি এসে দেখি, মার দিয়া কেল্লা– শিকার ঘরের মধ্যে। কিন্তু হবে কী, গোর-খোজা করেও তো মালাটা পেলুম না। কী করলে বলো দিকিনি? ভুল করে আমার মালাটাও কার যেন পকেটে ফেলে রাখলাম। ওদিকে আসলটা কোথাও পেলাম না।
ইন্সপেক্টরবাবু আমার দিকে তাকালেন।
–কচি মুখ দেখে বোঝা যায় না তুমি কত বড়ো শয়তান। মালা বের করে দাও।
সেজোদাদামশাইও ধমক দিতে লাগলেন। ভালো চাস তো এখুনি দিয়ে দে হতভাগা। আগে থেকেই জানি শেষটা এমনি হবে। তোর বাবাকে তখুনি বলেছিলাম, দিনা ওকে হাতঘড়ি কিনে, ওতেই ওর কাল হবে। তা কে শোনে বুড়োর কথা। দে শিগগির মালা। কী করবি ও দিয়ে তুই? তোকে–ইয়ে তোকে এত্তগুলো চুইংগাম দেব।
বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই আবার বললেন, বাস্তবিক এতগুলো ধড়িবাজ একসঙ্গে একটা ফ্যামিলির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না।
ঘরের মধ্যে আর বাকি যারা ছিল তারাও মহা কাঁওম্যাও লাগিয়ে দিলে, দিয়ে দে রে ব্যাটা, দিয়েই দে-না।
–আরে দে দেও রে, আউর কেয়া, ইত্যাদি।
শেষে জমিদারবাবু আমার কাছে এসে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, আমার অবস্থাটা এক বার ভেবে দেখো বাবা, মালা না পেলে গিন্নি আমার একখানা হাড়ও আস্ত রাখবেন না। দে বাপ মালাটা, আমিও তোকে এক ডজন চুইংগাম দেব।
কী আর করা। দাড়িওয়ালাকে বললাম, সর্দার, তুমি পথ দেখিয়ে আগে আগে চলল।
দাড়িওয়ালা তখুনি রওনা দিল, আমরা একের পর এক তার পেছন-পেছন চললুম।
নিমেষের মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। কে যেন মোমবাতির টুকরোটাও তুলে নিল। আমাদের পেছনের চোরাকুঠুরি অন্ধকারে মিশে গেল।
ঘরের বাইরে সরু গলি এঁকেবেঁকে শেষে কয়েকটা ধাপ বেয়ে একেবারে রান্নাঘরে গিয়ে শেষ হল।
রান্নাঘরের দরজার বাইরে মোটা খুঁটিতে শেকল দিয়ে কেঁপি আর তার বাচ্চা বাঁধা রয়েছে দেখলাম। আমাদের দেখে তারা দুজন সামনের পা মাটিতে ঠুকে জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল।
আমরা খানিকটা তফাত রেখে পেরোলাম। দাড়িওয়ালা বললে, আহা আমার টেপু-সোনার বুঝি আবার খিদে পেল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এর মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল; কিন্তু বাড়ির বাইরেটা ঠিক তেমনি আছে। বনের গাছপালাও এতটুকু বদলায়নি। শুধু রাতটা কেটে গিয়ে কখন দিন হয়ে গেছে। আকাশের মাঝখানটা ঘন নীল, গাছের ডালপালা রোদে ঝলমল করছে আর অনেক ওপরে একটা চিল ছোট্ট একটা কালো দাগের মতো কেবলই ঘুরছে।
বাড়ি ছেড়ে যেই জঙ্গলের পথ ধরলাম, কোত্থেকে আরও গোটা কতক লোক এসে জুটল। আমার মনে হচ্ছিল প্রায় সিকি মাইল লম্বা একটা লাইন হয়ে আমরা চলেছি।
শুনলাম ওরা জমিদারবাবুর সেই ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোক।
চলতে চলতে বিরিঞ্চিদা পিসেমশাইয়ের কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, তা হলে বিয়েটা
পিসেমশাই বললেন, থাক্, তোর আর অত ভাবতে হবে না, আমার ভাগনে বেটার সঙ্গে তার বিয়ে হবে। সে তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো।
শ্যামাদাসকাকা এবার সাহস পেয়ে বলল, তা হলে আমার ইয়ে—
পিসেমশাই বললেন, আরে সে ব্যাটা কি অত সহজে মরে? আমি যে ওর কাছে টাকা ধারি। দিব্যি চাঙা হয়ে উঠেছে। মারলিই যখন আরেকটু ভালো করে মারলি না কেন?
সেজোদাদামশাই ঠানদিদিকে বললেন, কী বউঠান, স্যাঙাতরা তো যে-যারটা গুছিয়ে নিচ্ছে, তোমার কিছু বলবার নেই?
ঠানদিদি কোনো কথা না বলে কাপড়ের মধ্যে থেকে একটা বড়ো লাল বটুয়া বের করলেন। চলতে চলতে তার মুখ খুলে দু-চারটে জিনিস বেছে নিয়ে বটুয়াটা সেজোদাদামশায়ের পায়ের কাছে ফেলে দিলেন।
সেজোদাদামশাই যেমনি সেটি তুলে নিলেন ঠানদিদি বললেন, গুপি, বাবাকে বলিস অর্ধেক যেন চেয়ে নেয়।
ততক্ষণে আমরা গাছতলায় বিরিঞ্চিদার গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি। সেখানে এসেই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, মাঝখানে রইলাম আমি। বললাম, একটা খোঁচা-মতন জিনিস চাই। সোয়েটার বোনার একটা কাঁটা দাও ঠানদিদি।
ঠানদিদি হাঁড়িমুখ করে বললেন, এ বেঘোরে সে আমি কোথায় পাব?
মেয়েদের যা কাণ্ড, সঙ্গে একটা দরকারি জিনিস অবধি রাখে না। বললাম, তা হলে একটা লাইন-টানা রুলার হলেও চলবে।
সবাই চুপচাপ। বললাম, তা হলে কি জিনিসের অভাবে সব পণ্ড হয়ে যাবে?
তখন শ্যামাদাসকাকা গাড়ির ভেতরের খোপ থেকে একটা লম্বা শক্ত তার বের করে দিল। আমি সেটি নিয়ে সামনের বাঁ-দিকের জানলার ভেতরে গুঁজে দিয়ে অনেক কসরত করে মালাটা বের করলাম।
কাল জানলার কাচ তোলবার সময়, হাত থেকে ফসকে কাচের পাশ দিয়ে, খাঁজের ভেতর পড়ে গেছল।
মালাটাকে পেন্টেলুনে ঘষে তুলে দেখালাম। মাঝখানকার হিরেটা ধুকধুক্ করতে লাগল। জমিদারবাবু ছুটে এসে বললেন, আরে এই তো আমার হারানিধি! এরই জন্যে তো আমি ঘরছাড়া। দে রে বাপ, একটু বুকে করি।
সঙ্গেসঙ্গে ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোকেরাও এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজনের চোখ হঠাৎ ছোটো হয়ে উঠল।
–সে কী মশাই! এটাও যে মেকি।
আমরা ধমক দিয়ে উঠলাম, বললেই হল মেকি। এইটেই জমিদারবাবুর গিন্নির আদত মালা। মেকি হবে কেন।
সে লোকটা কিছুতেই থামবে না। আরে মণি চেনাই আমার পেশা। তারজন্য এরা আমাকে তিন-শো টাকা মাইনে দেয়, আমি নকল মুক্তো চিনব না? কী যে বলেন। এ যদি সাচ্চা হয় তো আমি।
জমিদারবাবু বললেন, স-স-স–চুপ চুপ, ওকথা মুখে আনবেন না, গত বছর নেহাত ঠেকায়। পড়ে সেটি বেচতে বাধ্য হয়েছিলাম। তা এটাই-বা মন্দ কীসের? পঁচিশ টাকার পক্ষে কী-এমন। খারাপ বলুন? গিন্নিই যখন টের পাননি, আপনাদের আর কি আপত্তি থাকতে পারে?
তারা বললে, আপত্তি কিছুই নয় তবে কোম্পানিতে রিপোর্ট করে দিতে বাধ্য আমরা।
তা করুনগে রিপোর্ট, করুন পাসপোর্ট, খালি আমার গিন্নি যেন না শোনেন। চেপে যান মশাই, পাঁচ টাকা খাইয়ে দেব সবাইকে।
দাড়িওয়ালা বলল, পাঁচ টাকাই নেই আপনার, খাওয়াবেন কী দিয়ে?
ইন্সপেক্টর বললেন, সবই বুঝলাম বাড়ির তলার গোলকধাঁধা ছাড়া।
বুড়ি বললে, বলুন আমাদের সবাইকেই ছেড়ে দেবেন, তা হলে বলি। খোকা ইস্কুলে পড়বে, আমরাও রিটায়ার করব।
ইন্সপেক্টর হাসলেন, কাজটা আপনারা যে খুব ভালো করেছেন বলছি নে; তবে কিনা আপনাদের নামে তো আর কেস হচ্ছে না ঠাকরুন। জমিদারবাবুর গিন্নির মালা খুঁজে দেবার কথা, সে তো দিয়েইছি। গিন্নিমাই আমাকে পুরস্কার দেবেন। আপনাদের নামে কেস যখন হবে তখন হবে। আপাতত জিনিসগুলো সব জমা দিয়ে দেবেন।
বুড়ি বললে, আর আমার খোকা?
শম্ভু বলল, ঘুস খায়, আবার খোকা!
খোকা রেগে গেল। এক পয়সা পেলাম না মশাই, আবার ঘুস খাই, মানে?
জমিদারবাবু দাড়িওয়ালার দিকে তাকালেন। সে বললে, নেই বলছি ওঁর টাকা।
বুড়ি বলল, শুনুন তা হলে। সেকালে বাড়িটা ছিল এক সাহেবের। সে জুতো পচিয়ে এখানে মদ তৈরি করত। দেখতে দেখতে বড়োলোক হয়ে গিয়ে দেশে চলে গেল। পরে সে লাটসাহেব না বড়ো ডাক্তার না কী যেন হয়ে আবার এসেছিল। খুব সস্তায় বাড়ি বেচে দিয়ে গেল। ঠাকুরদা কিনে রাখলেন, বাবা আমাকে যৌতুক দিলেন। অমন ভালো সুড়ঙ্গ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দেখে, আমরা ওগুলোকে একটু কাজে লাগালাম। দোষ তো আমাদের এইটুকু।
ইন্সপেক্টরবাবু খাতা পেনসিল পকেটে পুরে জমিদার গিন্নির মালা হাতে নিয়ে জমিদারবাবুকে বললেন, চলুন।
বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে অনুনয়-বিনয় করতে করতে চললেন।
অমনি কর্পূরের মতো সবাই যার যেখানে মিলিয়ে গেল। পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই পর্যন্ত চলে গেলেন। বাকি রইলাম আমি ঠানদিদি, বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা।
আমরা ফ্যালফ্যাল করে এ-ওর দিকে চেয়ে রইলাম। খানিক বাদে আমি বললাম, এক ডজন চুইংগাম কি সত্যি কেউ কাউকে দেয়!
বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা একসঙ্গে বলে উঠল, কক্ষনো দেয় না। বরাবর তোকে বলছি-না জীবনটা হচ্ছে খানিকটা রাবিশ, একটা ডাস্টবিন। এখন চল, একটা কারখানার চেষ্টা করা যাক।
ভারি খুশি লাগল, ভাবলাম বগাই নিশ্চয় আমাকে কাল সারা দিনরাত খুঁজেছে!