এতদিন ধরে আমাদের বৈঠকের পুরনো কাহিনীই আপনাদের নিয়ে এসেছি, এবার বলি হালফিলের একটা ঘটনা।
আনন্দ পুরস্কার কমিটি স্থির করলেন অনিন্দবাজার পত্রিকার তরফ থেকে সুরেশচন্দ্র মজুমদার স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে স্বৰ্গত উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকে, যার কথা ইতিপূর্বে আপনাদের শুনিয়েছি। দেশ পত্রিকার তরফ থেকে প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে বনফুলকে, তার সাহিত্যকর্মে সামগ্রিক দানের কথা বিবেচনা করেই।
আনন্দ পুরস্কার কমিটির একজন প্রধান সদস্য বললেন–বনফুলকে আনন্দ পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত করে সমীচীন কাজই হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছি আমি। কিন্তু কিছুকাল যাবৎ লক্ষ্য করেছি সাহিত্যিকদের সরকারী পুরস্কার দেওয়াটাকে বনফুল তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে আসছেন নানা সভা সমিতির বক্তৃতায়। সুতরাং আনন্দ পুরস্কারের এই সিদ্ধান্ত পত্রিকায় প্রকাশের আগে তার একটা মৌখিক অনুমতি নিয়ে রাখা উচিত। যদি প্রত্যাখান করেন?
অপর একজন সদস্য এ-কথার মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন—আমাদের এই পুরস্কার তো সরকারী পুরস্কার নয়, নিতান্তই বেসরকারী। তা ছাড়া এই পত্রিকার তিনি একজন নিয়মিত লেখক, পত্রিকা প্রকাশের প্রথম আমল থেকে আজও লিখে আসছেন। তা ছাড়া যার স্মৃতিবিজড়িত এই পুরস্কার তার সঙ্গেও বনফুলের ছিল দীর্ঘদিনের প্রীতির সম্পর্ক। আমাদের তো মনে হয় না এ-পুরস্কার তিনি প্রত্যাখান করবেন।
প্রধান সদস্য বললেন–সবই তো বুঝলাম। তবুকথায় বলে সাবধানের মার নাই। তার সম্মতিটুকু জেনে নিয়ে ঘোষণা করলে দোষ কি?
অন্যান্য সদস্যরা অত্যন্ত ভাবিত চিত্তে মাথা নেড়ে সায় দিলেন সেটা চিন্তার বিষয়। সম্মতি নিলে দোষটা কি?
এক বাক্যে যখন স্থির হল সম্মতি নিয়েই ঘোষণা করা উচিত, তখন আমার উপর ভার পড়ল পরদিনই বনফুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অনুমোদন আদায় করে আনা চাই। সম্প্রতি বনফুল কলকাতায় তার ছেলের বাড়িতে আছেন, দু-একদিনের মধ্যেই ভাগলপুর চলে যাবেন।
বনফুলের সঙ্গে পত্ৰযোগে আমার পরিচয় বিশ বছরের কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না বললেই চলে। বর্মণ-স্ট্রীটের অফিসে থাকতে যখন স্থবির উপন্যাস ধারাবাহিক প্রকাশের কথা পাকাপাকি স্থির হলো তখন পাণ্ডুলিপি নিয়ে সেঅফিসে একবার এসেছিলেন, দু-চার মিনিটের মামুলী কথাবার্তার পর চলে গেলেন। এর পর দীর্ঘ বছর পার হয়ে গেছে। চিঠিপত্রেই আদান প্রদান চলে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ আর হয় নি।
সেদিন যখন সবাই কাজের ভারটা আমার উপর চাপিয়ে দিলেন, আমি মনে-মনে প্রমাদ গনলাম। প্রথমত বনফুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ কোন দিনই আমি পাই নি। বেশীরভাগ সময়েই তিনি থাকেন কলকাতার বাইরে ভাগলপুরে। মাঝে-মাঝে দু-চার দিনের জন্য কলকাতায় যখন আসেন তখন তার কাছে যাবার পাঁয়তারা কষতে কষতেই শুনি বনফুল ভাগলপুরে ফিরে গেছেন। তাছাড়া বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমার নিজেরই একটা সঙ্কোচ আছে, ভয়মিশ্রিত সঙ্কোচ। একে নামী ও মানী সাহিত্যিক, তদুপরি বয়সে অনেক বড়। কাছে না হয় গেলাম। কিন্তু আমার নিতান্ত নিম্নমধ্যবিত্ত বুদ্ধি আর বিদ্যা নিয়ে কী কথা বলব? কাজ তত করি যজ্ঞিবাড়ির পাচক ঠাকুরের। ভিয়েন চড়ানো আর পরিবেশন করা। দু-চার লাইন লিখবার ক্ষমতাও যদি থাকত সেই সুবাদে সাহিত্যিক-তকমা এঁটে লেখকমহলে নিশ্চিন্ত হয়ে যোরাফেরা করতে পারতাম। কিন্তু এখন উপায়? বনফুলের কাছে একলা যেতে ভরসা হয় না, যদি চিনতে না পারেন? শুনেছি কাগজের লোক আর পুস্তক প্রকাশকদের উপর নাকি ভীষণ খাপ্পা। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গেলেই পাণ্ডারা যেমন নিমেষে প্রাণটা কণ্ঠাগত করে তোলে-কলকাতায় এলেই কাগজের লোকরা লেখার জন্য মাছির মত লেগে থাকে। আজকাল তাদের দেখলেই নাকি ব্লাডপ্রেশার চড়চড় করে বেড়ে যায়, মুখে যাচ্ছেতাই করেন। এহেন মেজাজী মানুষটার কাছে একা-একা যাই কোন ভরসায়! অগত্যা উপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের বৈবাহিক সুবল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলাম। সুবলবাবু সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘকাল শনিবারের চিঠি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই কারণে বহু প্রবীণ সহিত্যিকের সঙ্গেই ওঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আমার সঙ্গেও সুবলবাবুর পরিচয় দীর্ঘ দিনের, উপস্থিত সে পরিচয় অনুজের প্রতি জ্যেষ্ঠের স্নেহশীল সহৃদয়তার পর্যবসিত। আমার সঙ্গে সুবলবাবুর চরিত্রগত কিছু মিল আছে, আমরা উভয়েই পানদোষে দুষ্ট। আমাদের অফিসের উল্টোদিকে ছোট্ট একটা পানের দোকান আছে। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দোকানে গিয়ে জর্দা দিয়ে পান খাই। আমাকে দূর থেকে দেখলেই পানওয়ালা তরিবত করে আগে ভাগেই পান সেজে রাখে, এটা এখন ওর চিরাচরিত প্রথায় দাঁড়িয়ে গেছে।
পানের দোকানে আমাকে দেখলেই সুবলবাবুরও পান খাবার নেশা চাগিয়ে ওঠে। কাজে-অকাজে সবসময় সুবলবাবু একটু ব্যস্তবাগীশ লোক। পানের দোকানে পান খেতে এলেও ব্যস্ততার অন্ত নেই, যেন এখনই ট্রেন ধরতে হবে।
একদিন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সুবলবাবু হঠাৎ গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার কাছে এসেই বললেনদোকানের জর্দা খেয়ো না, বেনারস থেকে তিন হেঁচকির পাতি জর্দা এনেছি, খেয়ে দেখ।
তিন হেঁচকির জর্দা? সে আবার কি! পান-জর্দা বহুকাল ধরেই খেয়ে আসছি কিন্তু এরকম একটা উদ্ভট নাম তো কোনদিন শুনি নি।
আমাকে একটু বিস্মিত হতে দেখে সুবলবাবু পকেট থেকে একটা কৌটা বার করে বললেন।–বেনারসে পাঁচ হেঁচকির জর্দাও আছে। সে-জর্দার পিক গিললে মিনিটে পাঁচবার হেঁচকি ওঠে। এটা অনেক মাইল্ড, মিনিটে মাত্র তিন বার হেঁচকি উঠবে। খেয়েই দ্যাখ না।
ভয়ে ভয়ে আমি বললাম-খেতে রাজি আছি কিন্তু হেঁচকি তুলতে রাজি নই।
এ কথার পর সুবলবাবু যেন একটু চটেই গেলেন। বিরক্তির সঙ্গে বললেন–তোমার কথা শুনে কি মনে হয় জানো? পৃথিবীতে এক জাতের মানুষ আছে যারা মদ খায়, নেশা করে না। প্রেম করে, বিয়ে করে না। ঘোড়দৌড়ের মাঠে যায়, জুয়া খেলে না। জেনে রেখো, এরা সাংঘাতিক মানুষ। কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক হচ্ছে যারা জর্দা খায়, হেঁচকি তোলে না।
মানব চরিত্র সম্পর্কে সুবলবাবুর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশী, কারণ উনি অনেক ঘাটের জল-খাওয়া লোক। তাই ওঁর কথায় প্রতিবাদ না করে বললাম-আমাকে একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিতে হবে।
কী বিপদ?
কাল দুপুরে বনফুলের কাছে আমাকে যেতে হবে, সঙ্গে আপনার থাকা চাই। আমাকে তো চেনেন না। শেষকালে যদি তাড়িয়ে দেন।
অভয় দিয়ে সুবলবাবু বললেন–ঠিক আছে, যাব তোমার সঙ্গে। বনফুল আমার বহুকালের পরিচিত অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমি সঙ্গে যখন আছি তোমার কাজ হাসিল হবেই।
পরদিন দুপুরে বেলা তিনটা নাগাদ সুবলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম জোড়াসাঁকোর দক্ষিণে সি আই টি বিল্ডিং-এ। বনফুল এখানে তার বড় ছেলের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছেন। চারতলার সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দরজার কড়া নাড়তেই একটি কিশোরী কন্যা এসে দরজা খুলে দিল।
সুবলবাবু বললেন–কী রে, তোর বাবা বাড়ি আছেন? মেয়েটি বললে—বাবা আছেন কিন্তু ঘুমুচ্ছেন।
এ-কথার পর আমি সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। অসময়ে এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে যদি ওঁর মেজাজ বিগড়ে যায়।
সুবলবাবু সে-কথায় কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে চৌকাট পার হয়েই ভিতরে চুকে বললেন–ঘুমোচ্ছে তো কী হয়েছে। ডেকে তোেল, বল সুবল কাকা এসেছে।
ডেকে তুলতে হল না। গলার আওয়াজ শুনেই পাশের ঘর থেকে উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বান এল
কে সুবল? এস এস, আমি জেগেই ঘুমোচ্ছি।
এই ছোট্ট কথাটির মধ্যে অন্তরঙ্গতার সুর যেন মিশে ছিল। সুবলবাবুর পিছনে আমিও ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
দক্ষিণের জানলার ধারে একটি খাটে বিশাল বপু বনফুল খালি গায়ে শুয়ে আছেন, পরনে লুঙ্গি। বলবায়ু পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আমি প্রণাম করে নিজের নাম বললাম। উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন বনফুল। আমার হাত ধরে বিছানার পাশে বসিয়ে বললেন–
আরে, তোমার চেহারা যে অনেক পাল্টে গেছে। বহু বছর আগে তোমাকে দেখেছিলাম পাতলা চেহারা, এখন মোটা হয়ে গেছ।
এ কথার পর বনফুল সম্বন্ধে আমার ভয় কেটে গেল, ধারণাও বদলে গেল। বিছানায় শুয়েই তিনি আলাপ জুড়ে দিলেন, যেন কত কালের . চেনা মানুষ আমি। বনফুলের বিশাল দেহের দরাজ হৃদয়ের অর্গল একে একে খুলে যেতে লাগল।
হঠাৎ আলাপ থামিয়ে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে গেলেন-এই দ্যাখো, কথায় কথায় আসল কথাই ভুলে গেছি। কী খাবে বল?
আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম-অসময়ে খাওয়ায় আমার উৎসাহ নেই। সুতরাং ওর জন্য ব্যস্ত হবেন না।
অবাক হয়ে বললেন—সে কি হে, সংবাদ পত্রের আপিসে তো শুনেছি এনি টাইম ইজ টা টাইম। এক পেয়ালা চা তো অন্তত খাবে।
সুবলবাবু বললেন—ও ব্যাপারে আমরা কখনও না বলি না। তবে তা খাবার আগে যে জন্য আপনার কাছে এসেছি, সেটা বলে নেওয়াই ভাল।
বনফুল বললেন–তাই তো হে, কিছু একটা মতলব নিয়ে দুজনে আমার কাছে এসেছ, সেটা তো আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
তা মতলব টা কী শুনি?
আনন্দ পুরস্কারের বিষয়টা সবিস্তারে বুঝিয়ে বলার পর তাকে অনুরোধ জানিয়ে বললাম—এই পুরস্কার আপনাকে গ্রহণ করতে হবে এবং বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে সাহিত্যিকদের এক বিশেষ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে হবে।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কী যেন ভাবলেন। আমি সশংকিত চিত্তে উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি, এই বুঝি রক্তের চাপ বাড়ল। আমার সমস্ত উৎকণ্ঠা দূর করে দিয়ে বললেন–
এ-পুরস্কার আমি গ্রহণ না করে কি পারি? আমি তো ভাগলপুর চলে যাচ্ছি। কখন আসতে হবে আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে, আমি নিশ্চয় আসব।
একথার পর সুবলবাবু বললেন, যাক, একটা দুর্ভাবনা ঘুচল। তাহলে এবার শুধু চা নয়, মিষ্টিও চাই।
বনফুল সহাস্যে বললেন–মিষ্টিমুখ না করিয়ে কি তোমাদের ছেড়ে দেব? যাও, তোমার বউদির কাছে খবরটা দাও আর তোমার মিষ্টির আবেদনটাও পেশ কর।
সুবলবাবু পাশের ঘরে চলে যেতেই বনফুল আমাকে বললেন–জানো, আনন্দবাজারের সুরেশবাবু, ছিলেন সাহিত্যিকদের পরম হিতাকাঙ্খী বন্ধু। শুধু আমার জীবনেরই একটি ছোট্ট ঘটনা শুনলেই বুঝতে পারবে যে সাহিত্যিকদের তিনি কতখানি ভালবাসতেন। আমার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ব্যাঙ্কে যা-কিছু সঞ্চয় ছিল তা প্রায় নিঃশেষ করেই বিয়ের বাজার করেছি। তখন এক সিনেমা কোম্পানী আমার একটা গল্প নিয়েছিল, কথা ছিল আমার মেয়ের বিবাহের আগেই দু-হাজার টাকা দিয়ে যাবে। তাদের কথার উপর নির্ভর করে আমি মেয়ের জন্যে একটা নেকূলে-এর অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্ত আছি, নির্দিষ্ট দিনে টাকাটা পেলেই নেকলেসটা নিয়ে আসব। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, যে-দিন দেবার কথা সেদিন তারা এসে অত্যন্ত কাতরভাবে জানালে যে টাকাটা যোগাড় করে উঠতে পারে নি। আরও কিছু দিন দেরি হবে। আমার তখন অবস্থাটা বোঝ। চার দিন বাদে মেয়ের বিয়ে, নেকলেস-এর অর্ডার দিয়ে বসে আছি, সেদিনই কথা ছিল নিয়ে আসার। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সে তো আজকের কথা নয়, বহু বছর আগের ঘটনা। তখন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না, যে একসঙ্গে দু-হাজার টাকা বার করে দিতে পারে। তখন কলকাতায় সজনীই ছিল আমার একমাত্র অন্তরঙ্গ বন্ধু যাকে আমার সুখদুঃখের কথা সবসময় অকপটেই বলে থাকি। সুবলও তা জানে। সজনী সব শুনে বললে-টাকার জন্যে মেয়েকে বিয়েতে নেকলেস দিতে পারবে না, সে কি হতে পারে? আমাদের সুরেশদা থাকতে তুমি ভাবছ কেন। তুমি নিজে সুরেশদার সঙ্গে দেখা করে সব বল, ব্যবস্থা একটা কিছু হবেই।
সুরেশবাবু তথন থাকতেন দেশবন্ধু পার্কের উত্তরে। সজনীর কথামত পরদিন সকালেই চলে গেলাম ওঁর কাছে।
সব শুনে সুরেশবাবু বললেন–আপনার কত টাকা প্রয়োজন?
আমি বললাম প্রয়োজন আমার দু হাজার টাকার। আপনি যদি আমাকে এক হাজার অত দিতে পারেন বাকি এক হাজার আমি আমার বইয়ের প্রকাশকদের কাছে থেকে চেয়েচিন্তে যোগাড় করে নিতে পারব।
সুরেশবাবু বললেন–কী দরকার আপনার টাকার জন্য আবার এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করার। দু-হাজার টাকায় আপনার হবে তত? প্রয়োজন হলে আরও কিছু নিয়ে রাখুন। মেয়ের বিয়ে, কখন কি দরকার হয়।
মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। দু-হাজার টাকাই আমার প্রয়োজন ছিল। তিনি আমাকে একটু বসতে বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন, কোথায় কার কাছে লোক পাঠিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই ক্যাশ দু-হাজার টাকা এনে আমার হাতে দিলেন। টাকাটা দিলেন, কিন্তু কোনও রসিদ চাইলেন না। আমার মনে খটকা লাগল। টাকাটা যে আমি ধার হিসেবে নিয়েছি দান হিসেবে নয়, সেটা তো আমার জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি তাই ওকে বললাম—টাকাটার বদলে একটা হাওনোট আপনাকে লিখে দিই।
এ-কথার উত্তরে সুরেশবাবু কি বললেন জানো? বললেন–বলাইবাবু, আপনার হাতই আমার হাণ্ডনোট। যে-দিন খুশি লিখে শোধ দেবেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বনফুল। হয়তো সেদিনের সেই ঘটনা স্মৃতির সমোবরের স্তব্ধতাকে আন্দোলিত করেছে, আর্দ্র কণ্ঠে তিনি আবার বললেন–সেদিনের ঘটনার পর আমি মনে মনে স্থির করে ফেললাম যে এমন একটা নতুন বিষয় নিয়ে লিখতে হবে যা বাংলা সাহিত্যে এর আগে আর কেউ লেখে নি এবং সেটাই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ-সাহিত্য কীতি। প্রস্তুতির জন্যে পড়াশুনোয় ডুবে রইলাম, বই কিনলাম প্রচুর। তারপর লিখলাম স্থাবর উপন্যাস, যা দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল। তোমার তো মনে থাকবার কথা।
আমি বললাম-মনে আছে বইকি। গুহা-মানবের আদিম প্রয়ুক্তি নিয়ে সেই উপন্যাস তো আমার হাত দিয়েই ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কথা ছিল স্থাবরের দ্বিতীয় খণ্ড আপনি লিখবেন। তার কি হল?
একটু হেসে বললেন–আশা ছাড়ি নি। ওঁ গণেশায় নমঃ করে খাতায় লেখা শুরুও করে দিয়েছি, এবার ফিরে গিয়ে লেখাই হবে আমার একমাত্র কাজ। ডাক্তারী থেকে তো প্রায় অবসর নিয়েছি, এখন আমার অফুরন্ত সময়।
এমন সময় চা আর প্লেট ভরতি রসগোল্লা এসে হাজির। ভৃত্যের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নিজের চিনি ছাড়া কাপটি নিয়ে বললেন–আচ্ছা, তোমাদের কাগজে জ্যোতিষ নিয়ে কে লেখেন বল তো?
নামটা বললে চিনতে পারলেন বলে মনে হল না। শুধু বললেন–রাশিফল তোমাদের কাগজে যে-ভাবে লেখা হয় তার অসুবিধা কি জানো? জ্যোতিষ সম্পর্কে পাঠকদের জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছে না। যেমন ধর লেখা হলো ভৃগুর মতে বৃষ রাশিতে যাদের জন্ম এ-সপ্তাহে তাদের আর্থিক ক্ষতি ঘটবে। হাজার-হাজার পাঠকের বৃষ রাত্রিতে জন্ম। তাদের সকলের কি আর্থিক ক্ষতি ঘটে? অনেকের আর্থিক লাভও হয়ে থাকে। অর্থাৎ কিনা একের সঙ্গে আরের মিল হয় না। তাই বলছিলাম ওভাবে না লিখে প্রতি সপ্তাহে একটি রাশি নিয়ে গ্রহের অবস্থান সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে আলোচনা থাকলে পাঠকরা নিজেরাই তার ফলাফল গণনা করে বার করতে পারবে।
জ্যোতিষ সম্পর্কে বনফুলের এতখানি উৎসাহ দেখে বিস্মিত হলাম। জ্যোতিষে আমার নিজেরই বিশ্বাস নেই। আমি তাই আমার জন্মলগ্ন জন্মরাশি নক্ষত্র ইত্যাদি কিছুই জানি না, জানবার আগ্রহও নেই। আগ্রহ ছিল না। বলে বেঁচে গিয়েছি। যা হয়েছি তারই দুশ্চিন্তায় মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। তার উপর অতীতে যা হতে পারতাম আর ভবিষ্যতে যা হতে পারব সেই দুশ্চিন্তা যদি চাপে তাহলে পাগলা গারদে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ-রকম রাশি-নক্ষত্রের পাগল আমি দু-চারজন দেখেছি বলেই আমার এই ধারণা।
বনফুল নিজে ডাক্তার, তার উপর আজীবন বিজ্ঞানের ছাত্র। তার যে এমন জ্যোতিষের ব্যামো আছে কী করে বিশ্বাস করি। তাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায় যে আপনার মন বিজ্ঞানভিত্তিক। আপনি কি মানবজীবনের ভূত ভবিষ্যতে বিশ্বাস করেন?
বনফুল বললেন–দ্যাখো, মানুষের জীবনে এমন অনেক অঘটন ঘটে-যুক্তি দিয়ে যার বিচার চলে না। আমারই জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার একটা কাহিনী তোমাকে বলি।
মনিহারীতে আমাদের বাড়িতে সাধু সন্ন্যাসীর যাতায়াত আগে ছিল। সেখানে আচমকা প্রায়ই সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটত। কোথা থেকে আসেন কী তাঁর পরিচয়, কোথায় যাবেন তা জানবার কোন প্রয়োজন হত না। তাঁরা। আসতেন, একদিন বা দুদিন আমাদের বাড়িতে থেকে চলে যেতেন। বহু অনুরোধ করলেও দু-একদিনের বেশ কিছুতেই তারা থাকতেন না। এঁদের দেখলে মনে পড়ে যায় সন্ত কবিরের বিখ্যাত সেই উক্তি—বহতা পানি রমতা সাধু। এমনি এক সাধুর আবির্ভাব ঘটেছিল আমাদের বাড়িতে আমাদের চরম বিপর্যয়ের সময়ে। তুমি যদি মনিহারীতে কখনও আমার বাড়িতে আস তাহলে দেখবে গঙ্গা আমার বাড়ির প্রায় গা ঘেষেই বয়ে চলেছে। কিন্তু আমি যে দিনের কথা বলছি তখন গঙ্গা ছিল বহু দুরে, আমার বাড়ি থেকে আধমাইলের ওপর দুর দিয়ে গঙ্গা বইত। হঠাৎ গঙ্গার পাড় ভাঙতে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে মাস খানেকের মধ্যেই গঙ্গা একেবারে আমার বাড়ির খুব কাছে এসে পড়ল। আমার ভয় হলো যে আর দিন সাতেকের মধ্যে আমার বাড়ি গঙ্গা গর্ভে বিলীন হবে। আমাদের তখন মানসিক অবস্থা কি বোঝ। সেই সময়েই আমার পরিবারে দেখা দিল আরেক বিপদ। আমার এক ছোট ভাই, সেও ডাক্তার। তখনকার দিনে ছোট ডিস্ট্রিক টাউনে সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে চক্রান্তের অন্ত ছিল না। আজও যে নেই তা নয়। হঠাৎ আমার ভাইয়ের নামে ট্রান্সফারের এক নোটিস এসে হাজির। আর এমন জায়গায় ট্রান্সফারের আদেশ এল যে সেখানে নতুন করে ঘর-সংসার পেতে চাকরি করা ওর পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ দিকে বাড়ি যায়, ওদিকে ভাইয়ের বদলি। এই ঘোর বিপদের সময় আমাদের বাড়িতে এক সাধু এসে হাজির। আমার এক আত্মীয় আমাকে পরামর্শ দিলে, সাধুকে এই আসন্ন বিপদের কথা খুলে বলতে। সাধুর কাছে আমার বিপদের কথা খুলে বললাম। চুপ করে সাধু সব শুনলেন, কোন প্রশ্ন করলেন না। ঝোলা থেকে পাস খেলার ঘুটির মত তিনটে পিতলের পাশার খুঁটি বার করলেন, সেগুলির উপর কতকগুলি সংখ্যা লেখা। ঠিক যেমন ভাবে পাশার ঘুটি চালে, সেই তিনটি সেইভাবে মেঝেতে চাললেন। সংখ্যাগুলি যা দেখা দিল তা নিয়ে মনে মনে যেন কী হিসাব করলেন। খুব গম্ভীর আর চিন্তান্বিত মুখ সাধুর। তাহলে কি এ-বিপদ থেকে মুক্তির কোন আশাই নেই? কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম সাধুর মুখে উজ্জ্বল হাসি দেখে। আমার মুখের উপর প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে সাধু বললেন–গঙ্গা মাঈ যহাতক আ পেীছি উহিই ঠহর গয়ী, ঔর আগে ন বঢ়েগী।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করলাম—মেরা ভাইয়া কো বদলি?
সাধু আবার মেঝের উপর ঘুটি চেলে নম্বর গুনলেন। আবার সেই চিন্তাষিত মুখ, আবার উদ্বেগ। এবারেও সাধুর মুখে সেই প্রসন্ন হাসি। তিনি বললেন—ফিক্র মত করে বেটা, তুমাহারা ভাইয়াকো বদলি ন হোগা।
সাধু সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—উনি কি তিব্বতী সাধু ছিলেন?
বনফুল বললেন–ওঁর চোস্ত হিন্দী জবানী শুনে তিব্বতী বলে তো মনে হল না। কিন্তু তিব্বতী বলে তোমার ধারণা হল কেন?
আমি বললাম-সম্প্রতি একটি ইংরেজী বইয়ে পেয়েছি এই ধরনের গণনা পদ্ধতির প্রচলন তিব্বতী জ্যোতিষীদের মধ্যেই বেশী।
বনফুল বললেন—এমনও হতে পারে যে কোন তিব্বতী গুরুর কাছ থেকেই উনি এই ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। আমি তো আগেই বলেছি যে এসব সাধুর পূর্বপরিচয় পাওয়া দুঃসাধ্য। যাক, যে-কথা বলছিলাম। তারপর কি হল জান? সত্যি সত্যি গঙ্গা অজি যেখানে রয়েছে সেদিন থেকে সেখানেই থেকে গেল। এত বছর পার হয়ে গিয়েছে, এক ইঞ্চি আর এগোয় নি। যদি কখনও মনিহারীতে আমার বাড়ি আস তুমি নিজেই দেখে বিস্মিত হবে।
অবিশ্বাসীর মন নিয়েই আমি বললাম-ও রকম কাকতালীয় ব্যাপার প্রায়ই হয়। ভৌগোলিক কারণেই গলা আপনার বাড়ি পর্যন্ত এসে তার গতি পালটেছে।
বনফুল সাধুসন্ন্যাসীতে বিশ্বাসী হলে কি হবে। যুক্তিবাদী মনটা যাবে কোথায়। আমার কথাকে সরাসরি উড়িয়ে না দিয়ে বললেন–মানলুম সে কথা। ওটা কাকতলীয় ব্যাপার হলেও হতে পারে। কিন্তু পরদিন সকালেই টেলিগ্রাম এল, ভাইয়ের বদলির অর্ডার ক্যানসেলড। এটাকেও কি তুমি কাকতলীয় বলে উড়িয়ে দিতে চাও?
এ-কথার পর মচকালেও ভাঙ্গি নি। তাই বললাম—এ ঘটনার পিছনেও অন্য কোন কার্য-কারণ ছিল, অনুসন্ধান করলেই জানতে পারতেন।
বনফুল বললেন–তা-ও কি আর জানি নি, জেনেছি। ব্যাপারটা কি হয়েছিল শোন। ভাইয়ের বদলির আদেশ দিয়েছিলেন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু তখন এক সিভিল সার্জন ছিলেন বাঙালী। তাঁর সঙ্গে চেয়ারম্যানের তেমন বনিবনা ছিল না। তিনি বললেন, ডাক্তারকে বদলি করবার মালিক আমি, আপনি নন। আমি যখন কাউকে বদলি করতে বলব তখন আপনি তার ব্যবস্থা করবেন। তার আগে নয়। এখনই বদলি নাকচ করে টেলিগ্রাম করে দিন।
সেই টেলিগ্রাম এল কি না সাধুর গণনার পরের দিন সকালে। সাধুকে আমি প্রণামী হিসেবে কিছু টাকা ও কাপড়চোপড় দিতে চাইলাম, কিছুতেই গ্রহণ করলেন না। বিকেলেই উনি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। সেদিনের পর আজ পর্যন্ত সেই সাধুর কোনও সন্ধান আমি পাই নি।
এবার সত্যিই আমার অবাক হবার পালা। বনফুল আমার বিমূঢ় অবস্থা দেখে বললেন–কি, আর যে তর্ক করছ না। শুনে অবাক হয়ে গেলে তোত? এ আর কি শুনলে? এর চেয়েও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে।
ধীরে ধীরে কী যেন একটা নেশা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সেটা কি বনফুলের মুখে গল্প শোনার নেশা? না কি অলৌকিক ঘটনা শোনার নেশা যা যুক্তি আর বুদ্ধিকে আস্তে আস্তে অবশ করে ফেলে। আমি শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠতেই বনফুল বললেন–
বিহারের ভূমিকম্প যেবার হয়েছিল সে-সময় ভাগলপুরে আমি ছোট্ট একটা একতলা বাড়িতে থাকতাম। ছোট সংসার। স্ত্রী, একটি মেয়ে, একটি ছেলে। ছেলেটি তখন কোলের শিশু। সামনের ঘরে ছিল আমার ল্যাবরেটরি, ডাক্তারী যন্ত্রপাতি সব থাকত। পিছনে থাকতাম আমরা। ভূমিকম্প যেদিন শুরু হল সেদিনটি আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে। দুপুরবেলা হঠাৎ শুরু হল প্রচণ্ড কম্পন। দরজা জানলা খাট টেবিলগুলোকে যেন কোন এক অদৃশ্য হাত আছড়ে ভাঙতে চাইছে। তৎক্ষণাৎ স্ত্রী, কন্যা আর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে একেবারে যাকে বলে একবস্ত্রে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম সামনের ফাকা মাঠে। সেখানে কম্পনের তীব্রতা এত বেশী যে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, আছড়ে ফেলে দেবে। তাই মাটি আঁকড়ে পড়ে রইলাম সেই মাঠে, আর চোখের সামনে দেখলাম আমার বাড়িটা ফেটে চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ল, একেবারে ভগ্নস্তুপে পরিণত হল। নতুন দামী যন্ত্রপাতি কিনে সবে প্যাথলজির লেবরেটরি করেছিলাম তা ইটের স্তপে চাপা পড়েছে। আমার নতুন তৈরী লেবরেটরিটা গেল, সেইটিই আমার দুঃখ। আমার স্ত্রীর দুঃখ তার গয়না থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় জিনিস ইটের তলায় হয়তো তছনছ হয়ে গেছে। সমস্ত ভাগলপুর শহরটাই মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, চারিদিকে কান্নার রোল আর হাহাকার। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কোনরকমে রাতটা আমার এক পরিচিত বন্ধুর আস্তানায় কাটিয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম কুলির সন্ধানে। ভূমিকম্পের সময় যে-পাঞ্জাবিটা গায়ে ছিল তার পকেটে ছিল মাত্র দুটি টাকা। সেই দুটি টাকাই ছিল আমার শেষ সম্বল। পোস্টাফিস ভেঙেচুরে একাকার, উপায় ছিল না টাকাকড়ি তুলবার। টাকা যোগাড় করব কোথায়? সকলেরই তো এক অবস্থা, শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই যথেষ্ট। সেই দুটি টাকার করে জন চার কুলি সংগ্রহ করলাম আমার বাড়ির সেই ভগ্নস্তুপ থেকে জিনিসপত্র উদ্ধারের জন্য। বাড়ির কাছেই ছিল একটা ছোেট্ট ক্যালভার্ট। কুলিরা কাজ করছে, আমি ক্যালভার্টে বসে তদারক করছি। মাঘ মাসের শীত, হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা। কনকনে সেই ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ের চামড়ায় ছুচের মত বিধছে। অনেক কষ্টে রক্তপরীক্ষার যন্ত্র মাইক্রসকোপ, আর কোলোরিমিটারটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা গেল কিন্তু মল-মূত্র পরীক্ষার ইলেকটিক সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রটা ভেঙে চুরমার। পাঁচ শ টাকা দিয়ে যন্ত্রটা নতুন আনিয়েছিলাম। চুপচাপ বসে আছি। দুপুর বেলা, রাস্তায় লোক চলাচল কমে এসেছে। কুলিরা এক-এক করে জিনিসপত্র উদ্ধার করে আনছে আর আমি সেই ভাঙাচোরা জিনিসগুলোর দিকে শ্মশানবৈরাগ্যের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি।
হঠাৎ কোত্থেকে এক বেহেড, মাতাল আমার কাছে এসে উপস্থিত। খালি গা, পরনে একটুকরো ছেড়া কাপড়। প্রায়-উলঙ্গই বলা চলে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া, কিন্তু তাতে যে তার কোনরকম কষ্ট হচ্ছে বোঝা গেল না। টলতে টলতে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বিড়বিড় করে কী যে বলল, প্রথমে বুঝতেই পারলাম না। কথা জড়িয়ে গেছে, সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। অনেক কষ্টে ওর কথা যখন উদ্ধার করতে পারলাম তখন বুঝলাম ও আমার কাছে টাকা চায়, আরও মদ খাবে। আমার কাছে টাকা নেই বলাতে বিশ্বাস করল না। পাঞ্জাবির বঁ হাতের পকেটটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে—তুমহারা জেব মে দোঠো রুপাইয়া হয়, মুঝকো দেও, হাম শরাব পিউঙ্গা। তাজ্জব ব্যাপার। লোকটা জানল কি করে যে আমার পকেটে দুটো টাকাই সম্বল। টাকা দুটো পকেট থেকে বার করে লোকটাকে দেখিয়ে বললাম যে, দুটো টাকাই আছে বটে কিন্তু তা আমাকে কুলিদের দিতে হবে। লোকটা টাকার জন্যে আর পীড়াপীড়ি না করে শুধু বললে-অভী তুমকো বত্রিশ রুপাইয়া মিল যায় গা। তব মুঝকো দে রুপাইয়া জরুর দেনা পড়ে গা। হাম শরাব পিউলা।
মাতালের কথা! কোথায় টাকা পাব, কে আমাকে দেবে। ওকে একেবারে হেসে উড়িয়ে না দিয়ে এক কথায় ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। লোকটা বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে টলায়মান অবস্থায় রাস্তার মোড় ঘুরে ভাঙাচোড়া বাড়ি ঘরের আড্ডালে মিলিয়ে গেল।
মিনিট দশ-ও পার হয় নি। দেখতে পেলাম স্টেশনের দিকের রাস্তা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে আসছে। গাড়ির ছাতে বাক্স-বিছানা বাঁধা। গাড়িটা আমার বাড়ির সামনেই থেমে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আমারই কাটিহারবাসী পরিচিত এক রুগীর পুত্র আর পুত্রবধু। প্রণাম করে বললে—ডাক্তারবাবু, আপনার কাছেই আমরা এসেছি। যাচ্ছিলাম কাটিহারে, ভাগলপুরে এসে ট্রেন আর গেল না, লাইন খারাপ। কাল সকালের আগে লাইন ঠিক হবে না।
মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার নিজের অবস্থা তখন শয়নং হট্ট মন্দিরে। এক রাত্রির এই অতিথি দম্পতিকে কোথায় আশ্রয় দিই। আমাকে চিন্তান্বিত দেখে ছেলেটি বললে-আমরা কিন্তু আশ্রয়ের জন্যে আপনার কাছে আসি নি। ট্রেন তো স্টেশনেই দাঁড়িয়ে আছে, ট্রেনেই থাকব সে বন্দোবস্ত করে এসেছি। ভাগলপুরে যখন কয়েক ঘণ্টা আটকা পড়েই গেছি তখন আমরা ভাবলাম আপনাকে দিয়ে আমাদের ব্লাড ও ইউরিনটা পরীক্ষা করিয়ে নিই। আমরা দুজনেই ডায়াবিটিসে ভুগছি, বাবা বহুদিন আগেই বলেছিলেন আপনাকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিতে। আজ যখন এখানে আটকা পড়েই গেলাম তখন পরীক্ষাটা করিয়ে নেওয়াই স্থির করলাম।
হায় রে কপাল। পরীক্ষা যে করব সে-যন্ত্রপাতি তত ভেঙ্গে চৌচির হয়ে ধুলোয় পড়াগড়ি খাচ্ছে। ছেলেটির বাবা ব্লাডপ্রেশারের রুগী, তার উপর নানা উপসর্গও আছে। বরাবরই আমার কাছে রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়ে নেন, আমার ডায়োগনসি-এর উপর তার আস্থা আছে। কিন্তু তাঁর পুত্র ও পুত্রবধুর কী একজামীন করব? ভগ্নস্তুপের দিকে দেখিয়েই বললাম–দেখ আমার অবস্থা। রক্ত পরীক্ষার যন্ত্রটা কোন রকমে উদ্ধার পেয়েছে, কিন্তু অন্যটা একেবারেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সুতরাং আমি তো তোমাদের কোন কাজেই লাগব না।
ছেলেটিও নাছোড় বান্দা।
বললে—তাহলে আমাদের রক্তটাই নিয়ে রাখুন।
হতাশ হয়ে আমি বললাম—তা না হয় নিয়ে রাখলুম। রেজাল্ট তত দু-এক দিনের মধ্যে জানাতে পারব না। লেবরেটরি আবার কোথাও খাড়া করতে সময় তো লাগবেই।
ছেলেটি বললে-তা লাগুক। অবিলম্বে রেজাল্ট জানার তাড়াহুড়ো আমাদেরও তেমন নেই, এক মাসের মধ্যে রেজাল্ট আপনার কাছ থেকে পেলাম তো ভালই না পেলে তখন অন্য ব্যবস্থা করা যাবে। আপনি আমাদের রক্তটা নিয়েই রাখুন।
বলব কি ভাই, সেই দুপুর নোন্দরে ধুলো বালি ঝেড়ে টেস্ট টিউব আর oxalate বার করে কোনক্রমে দুজনের রক্ত নিয়ে ব্যাগে ভরে রাখলাম।
ওরাও ৩২ টাকা ভিজিট দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চেপে স্টেশনের দিকে চলে গেল।।
বনফুল থামলেন। আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে তাকালেন। অর্থাৎ এর কী ব্যাখ্যা তুমি করবে। আমি নিরুত্তর। সুবলবাবু বলে উঠলেন-টাকাটা পেয়েই মাতালটাকে দুটো টাকা দিয়েছিলেন তো?
বনফুল বললেন—আর বল কেন ভাই। সেও এক দুর্ভোগ। কুলিদের কাজ দেখা পড়ে রইল, রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে বেড়িয়েছি সেই লোকটাকে। কোথাও তার আর দেখা পেলাম না।
ভেবে দেখলাম এর পরে আর বনফুলের কাছে বসে থাকা নিরাপদ নয়। আমার মত ঘোর অবিশ্বাসীকে প্রায় পেড়ে ফেলেছেন। এখনও পালাতে পারলে আত্মরক্ষা করলেও করতে পারব। সেকথা বলতেই বনফুল বাধা দিয়ে বললেন—উহুঁ, সেটি হচ্ছে না। তোমাকে সহজে ছাড়ছি নে। এটাকেও তুমি কাকতালীয় গোছের একটা কিছু যুক্তি দেখালেও দেখাতে পার। কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক ঘটনা আমার নিজের চোখের সামনে ঘটেছে, সেটা অন্তত শুনতেই হবে।
এর আগের দুটো ঘটনা আমার কাছে পাতিয়ালা পেগ-এর সামিল। একেবারে ভোম মেরে গেছি। এর উপর যদি আরেকটা স্টিফ, ভোজ পড়ে তাহলে একেবারে না হয়ে যাব। কিন্তু এ ধরনের কাহিনীর একটা মজা হচ্ছে এই যে, শ্রোতাকে শেষ পর্যন্ত এ-নেশার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হয়, আমিও করে বসলাম।
বনফুল বললেন–আমি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। গরমের সময় দুপুরে আমাদের একমাত্র কাজ ছিল কলেজ ফাঁকি দিয়ে মির্জাপুর আর কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে প্যারাগন বলে যে শরবতের দোকান আছে সেখানে বসে আড্ডা দেওয়া আর ঘোলের শরবত খাওয়া। শরবতের দোকানের পাশেই ছিল একটা বোয়াক, সেখানে প্রায়ই দেখতাম একটা পাগল তার উস্কোখুস্কো চেহারা আর খোঁচাখোঁচা দাড়ি গোঁফ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকত। চেঁচামেচি সে কখনও করত না। তার কাজই ছিল রাস্তা দিয়ে যে-সব লোক যাতায়াত করত তাদের মুখের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।
এপ্রিলের শেষ, দুপুরে প্রচণ্ড গরম। রাস্তার পিচ গলে এমন অবস্থা যে জুতো আটকে যায়, হাঁটতে গেলে পা খুলে বেরিয়ে আসে। জনবিরল রাস্তা, কিন্তু পাগলটা ঠিক সেই বোয়াকে চুপচাপ বসে আছে। আমরা যথারীতি শরবতের দোকানে আসর জমিয়েছি।
হঠাৎ শুনি পাগলটা কাকে যেন প্রচণ্ড ধমকে বলছে—খবরদার, ওদিকে এগোসনি, ফিরে যা। ইনসিওর করেছিস? না করে থাকলে এখুনি ফিরে গিয়ে কাছে পিঠে লাইফ ইনসিওরের অফিসে গিয়ে এক্ষুনি ইনসিওর করিয়ে পাগলটাকে প্রায়ই তো আমরা দেখি এবং চুপচাপ বসে থাকতেই দেখি। হঠাৎ ক্ষেপে গেল কেন? কৌতূহল হল। দোকান থেকে উঁকি মেরে দেখি রাস্তায় ফুটপাতে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন আর পাগলটা কিছুতেই তাকে মির্জাপুর স্ট্রীট দিয়ে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে যেতে দেবে না। বারবার বলছে-ওদিকে খবরদার যাবি না। ফিরে যা।
পাগলের কথা তো। ও পাড়ার দু-একজন দোকানদার পাগলটাকে ধমকে দলে, ভদ্রলোকও পাগলের পাগলামিতে কান না দিয়ে যে দিকে যাচ্ছিলেন সেই দিকেই পা বাড়ালেন।
বেশীদূর যেতে হল না। রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট পর্যন্ত গেছেন, এমন সময় গলি থেকে ঝড়ের বেগে একটা ট্যাক্সি বেরিয়ে এসে লোকটাকে চাপা দল। হইহই চিৎকার শুনে আমরা ছুটে গেলাম, ভদ্রলোকের রক্তাক্ত দেহটা তুলে তখনি নিয়ে গেলাম মেডিক্যাল কলেজে। কলেজ পর্যন্ত পৌঁছবার মাগেই সব শেষ। ফিরে এসে পাগলটাকে ধরেছিলাম।বল তুই কী করে ঝিলি লোকটা মারা যাবে। কিছুই বলে না, গু হয়ে বসে থাকে। অনেক সাধাসাধির পর বলেছিল—লোকটার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম। তাকিয়ে দেখি সামনের রাস্তার মোড়টায় সাক্ষাৎ যম ওর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। বারণ করেছিলাম, শুনলে না। আমার কী।
বনফুল থামলেন, আমি তখন বেঁহুঁশ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। সুবলবাবু বললেন—সেই পাগলটা কি তার পরেও ওখানে বসে থাকত?
বনফুল বললে—সেটা আরেক রহস্য। তারপরদিন থেকে পাগলটাকে আর কোনদিন ও তল্লাটে দেখি নি।
বনফুল আমার দিকে তাকিয়েই বললেন–কি হে, কিছু বলছ না যে। এটাকেও কি তুমি কাকতালীয় বলবে? তাহলে আরেকটা ঘটনা বলি শোন–
এবার আমি প্রায় জোর করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। বললাম—বলাইদা, ঢের হয়েছে। আর নয়। পাঁচটা বাজে, অফিসে প্রচুর কাজ ফেলে এসেছি। এবারে চলি।
বলতে বলতে ঘরের বাইরে এসে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছি, তখনও বনফুল চিৎকার করে বলছেন—দু-চারদিনের ছুটি নিয়ে একবার ভাগলপুরে এস। অনেক ঘটনা তোমায় বলব—আমি ততক্ষণে রাস্তায় নেমে ভাগল।
আপনারাই বলুন। এর পরেও কি ভাগলপুরে যাওয়াটা আমার পক্ষে উচিত হবে?