১৩. এক জন ডাক্তার

আনিস লোকটিকে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। আগে আরো দু-এক বার দেখা হয়েছে। আজ যদিও অনেক দিন পরে দেখা, তবু চিনতে একটুও দেরি হল না। লোকটি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। আনিসকে তাকাতে দেখে মৃদু গলায় বলল, ভেতরে আসব?

আসুন।

লোকটি ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল। মাথার চুল পেকে গেছে। কপালের চামড়া কোঁচকান। চোখ দুটি ভাসা— ভাসা। সমস্ত মুখাবয়বে একটা ভালোমানুষী আত্মভোলা ভঙ্গি আছে।

আমি একটু বসলে তোমার অসুবিধে হবে?

বসুন বসুন। অসুবিধে হবে কেন?

আমাকে চিনতে পেরেছ তো বাবা?

হ্যাঁ।

আমি তোমার মাকে নিয়ে এসেছি। আনিস চুপ করে রইল। লোকটির বসবার ধরন কেমন অদ্ভুত। পা তুলে পদ্মাসন হয়ে চেয়ারে বসেছেন। সারাক্ষণই হাসছেন আপন মনে। আনিস কী কথা বলবে ভেবে পেল না। দু জন লোক চুপচাপ কতক্ষণ বসে থাকতে পারে? একসময আনিস বলল, আপনার ছেলেমেয়ে কয়টি?

দুই মেয়ে এক ছেলে। বড়ো মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কেমিস্ট্রিতে অনার্স, এইবার সেকেণ্ড ইয়ার।

ছেলেমেয়েদের কথা বলতে পেরে ভদ্রলোকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি ঝুঁকে এলেন আনিসের দিকে। গাঢ় স্বরে বলতে লাগলেন, বড়ো মেয়ের নাম নীলা, তোমার মা রেখেছেন। ছোট মেয়ের নাম আমি রেখেছি ইলা। ছেলেটির নাম শাহীন।

ভদ্রলোক মহা উৎসাহে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধারালেন। তেমনি অন্তরঙ্গ সুরে বলতে লাগলেন, গত ঈদের সময় নীলা তোমাকে একটা ঈদকার্ড পাঠিয়েছিল। নিজেই এঁকেছে, নদীতে সূর্যাস্ত হচ্ছে। দুটি বক উড়ে যাচ্ছে। তুমি পাও নি বাবা?

পেয়েছিলাম।

নীলা ভেবেছিল, তুমিও তাকে একটা পাঠাবে। সে রোজ জিজ্ঞেস করত।–বাবা, তোমার ঠিকানায় আমার কোনো ঈদকার্ড এসেছে?

আনিস লজ্জা পেল খুব। লজ্জা ঢাকবার জন্য জিজ্ঞেস করল, ইলা কত বড়ো হয়েছে?

ক্লাস নাইনে পড়ে। বৃত্তি পেয়েছে নন-রেসিডেনশিয়াল।

দেখতে কেমন হয়েছে?

আমার কাছে খুব ভালো লাগে। তবে শ্যামলা রং। নাকটা একটু চাপা। স্কুলের মেয়েরা তাকে চায়না ডেকে ক্ষেপায়।

আনিস হো-হো করে হেসে ফেলল। নীলা ও ইলার সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো হত। আনিস মনে মনে ভাবল, ইলার সঙ্গে যদি কখনো দেখা হয় তাহলে সে বলবে–

ইলা হল চায়না
ব্যাঙ ছাড়া খায় না।

ভদ্রলোক বললেন, তোমার ভাই-বোনগুলির খুব শখ ছিল তুমি কিছুদিন তাদের সঙ্গে থাক। এক বার তোমার মা খুব করে লিখেছিল, ঠিক না?

আনিস লজ্জিত হয়ে মাথা নাড়ল। তার মা সেবার শুধু চিঠিই লেখেন নি, একশটি টাকাও পাঠিয়েছিলেন। সে টাকা ফেরত পাঠান হয়েছিল।

ভদ্রলোক উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ইলা আবার কবিতাও লেখে। স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে তার কবিতা—’রুগ্‌ন হওয়ার রহ্স্য’ কবিতার নাম। ভীষণ হাসির কবিতা। দাঁড়াও তোমাকে শোনাই। আমার মনে আছে কবিতাটি।

ভদ্রলাক চেয়ার থেকে পা নামিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলেন–

কয়েক হাঁড়ি পাটালী গুড
সঙ্গে কিছু মিষ্টি দই,
সেরেক খানি চিড়ে ছাড়াও
লাগবে তাতে ভাল খাই……কি, সবটা বলব?

আনিস সে-কথার জবাব দিল না, ঘোলাটে চোখে তাকাল। তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে। ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কী হয়েছে বাবা? তুমি খুব ঘামছ!

সে—ব্যথাটি আবার শুরু হয়েছে। পা দুটো কেউ যেন জ্বলন্ত আগুনে ঠেসে ধরল। আনিস গোঙাতে শুরু করল। ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মৃদু স্বরে ডাকলেন, ও বাবা শোন, ও আনিস।

আনিস বিকৃত স্বরে বলল, আপনি এখন যান। একা থাকতে দিন আমাকে।

ভদ্রলোক নড়লেন না। একটা হাত-পাখা নিয়ে সজোরে বাতাস করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, পানি খাবে বাবা? মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?

আনিস কথা বলতে পারছিল না। ভদ্রলোক অসহায় গলা বললেন, কেউ কি এক জন ডাক্তার ডেকে আনবে, আহা বড় মায়া লাগে।

আনিসের মা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে দেখলেন, আনিস চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে আর ইলা-নীলার বাবা প্রবল বেগে হাওয়া করছেন। আনিসের মা ঘরের ভেতর ঢুকলেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে। শুনলেন ইলার বাবা মৃদুস্বরে বলছেন, ইয়া রহমানু, ইয়া রহিমু, ইয়া মালিকু…

তখন নিচে তুমুল হৈচৈ-এর সঙ্গে বর এসেছে বর এসেছে শোনা গেল, আতর বৌ নিচে নামলেন। তাঁকে এক জন ডাক্তার খুঁজতে হবে। আনিসের জন্য এক জন ডাক্তার প্রয়োজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *