১৩. ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য প্রদর্শনী

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য প্রদর্শনী উপলক্ষে খুব ভিড়। অপু অনেকদিন হইতে ইনস্টিটিউটের সভ্য, তাহাদের জনকয়েকের উপর শিশুমঙ্গল ও খাদ্য-বিভাগের তত্ত্বাবধানের ভার আছে। দুপুর হইতে সে এই কাজে লাগিয়া আছে। মন্মথ বি.এ. পাস করিয়া অ্যাটর্নির আর্টিকল ক্লার্ক হইয়াছে। তাহার সহিত একদিন ইনস্টিটিউটের বসিবার ঘরে ঘোর তর্ক। অপুর দৃঢ় বিশ্বাস-যুদ্ধের পর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাইবে। বিলাতে লয়েড জর্জ বলিয়াছেন, যুদ্ধশেষে ভারতবর্ষকে আমরা আর পদানত করিয়া রাখিব না। ভারতকে দিয়া আর ক্রীতদাসের কার্য করাইয়া লইলে চলিবে না। Indians must not remain as hewers of wood and drawers of water.

এই সময়েই একদিন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে কাগজ খুলিয়া একটা সংবাদ দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। জোয়ান অব আর্ককে রোমান ক্যাথলিক যাজকশক্তি তাহাদের ধর্মসম্প্রদায়ের সাধুর তালিকাভুক্ত করিয়াছেন।

তার শৈশবের আনন্দ-মুহূর্তের সঙ্গিনী সেই পল্লীবালিকা জোয়ান-ইছামতীর ধারে শান্ত বাবলা-বনের ছায়ায় বসিয়া শৈশবের সে স্বপ্নভরা দিনগুলিতে যাহার সঙ্গে প্রথম পরিচয়! ইহার পর সে একদিন সিনেমাতে জোয়ান অব আর্কের বাৎসরিক স্মৃতি উৎসব দেখিল। ডমরেমির নিভৃত পল্লীপ্রান্তে ফ্রান্সের সকল প্রদেশ হইতে লোকজন জড়ো হইয়াছে—পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হইতে কত নরনারী আসিয়াছে…সামরিক পোশাকে সজ্জিত ফরাসি সৈনিক কর্মচারীর দল…সবসুদ্ধ মিলিয়া এক মাইল দীর্ঘ বিরাট শোভাযাত্রা…জোয়ানের সঙ্গে তার নাড়ীর কি যেন যোগ…জোয়ানের সম্মানে তার নিজের বুক যেন গর্বে ফুলিয়া উঠিতেছিল…শৈশবের স্বপ্নের সে মোহ অপু এখনও কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই।

বড়ো হইয়া অবধি সে এই মেয়েটিকে কি শ্রদ্ধার চোখে ভক্তির চোখে দেখিয়া আসিয়াছে এতদিন, সে কথা জানিত এক অনিল-নতুবা কল্পনা যাহাদের পঙ্গু, মন মিনমিনে, পানসে—তাহাদের কাছে সেকথা তুলিয়া লাভ কি? কলেজে পড়িবার সময় সে বড়ো ইতিহাসে জোয়ানের বিস্তৃত বিবরণ পড়িয়াছে—অতীত শতাব্দীর সেই অবুঝ নিষ্ঠুরতা, ধর্মমতের গোঁড়ামি, খুঁটিতে বাঁধিয়া হৃদয়হীন দাহন-সূর্যদেবের রথচক্রের দ্রুত আবর্তনে অসীম আকাশে যেমন দুপুর হয় বৈকাল, বৈকাল হয় রাত্রি, রাত্রি হয় প্রভাত—মহাকালের রথচক্রের আবর্তনে এক শতাব্দীর অন্ধকারপুঞ্জ তেমনি পরের শতাব্দীতে দূরীভূত হইয়া যাইতেছে। সত্যের শুকতারা একদিন যে প্রকাশ হইবেই, জীবনের দুঃখদৈন্যের অন্ধকার শুধু যে প্রভাতেরই অগ্রদূত-কলকাকলিময়, ফুলফোটা অমৃতঝরা প্রভাত।

অন্যমনস্ক মনে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া সে খাদ্য-বিভাগের ঘরে ঢুকিতে যাইতেছে, কে তাহাকে ডাকিল। ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া প্রথমটা চিনিতে পারিল না—পরে বিস্ময়ের সুরে বলিল-প্রীতি, না? এগজিবিশন দেখতে এসেছিলে বুঝি? ভালো আছ?

প্রীতি অনেক বড় হইয়াছে। দেখিয়া বুঝিল, বিবাহ হইয়া গিয়াছে। সে সঙ্গিনী প্রৌঢ়া মহিলাকে ডাকিয়া বলিল—মা, আমার মাস্টার মশায় অপূর্ববাবু—সেই অপূর্ববাবু।

অপু প্রণাম করিল। প্রীতি বলিল—আচ্ছা আপনার রাগ তো? এক কথায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন, দেখুন! কত ছোট ছিলুম, বুঝতুম কি কিছু? তারপর আপনার কত খোঁজ করেছিলুম, আর কোনও সন্ধানই কেউ বলতে পারলে না। আপনি আজকাল কি করছেন মাস্টার মশায়?

—ছেলেও পড়াই, রাত্রে খবরের কাগজের আপিসে চাকরিও করি—

–আচ্ছা মাস্টার মশাই, আপনাকে যদি বলি, আমাদের বাড়ি কি আপনি আর যাবেন না?

অপুর মনে পূর্বতন ছাত্রীর উপর কেমন একটা স্নেহ আসিল। কথা গুছাইয়া বলিতে জানিত, কি বলিতে কি বলিয়া ফেলিয়াছিল সে সময়—তাহারও অত সহজে রাগ করা ঠিক হয় নাই। সে বলিল—তুমি অত অপ্রতিভ ভাবে কথা বলছ কেন প্রীতি! দোষ আমারই, তুমি না হয় ছেলেমানুষ ছিলে, আমার রাগ করা উচিত হয় নি

ঠিকানা বিনিময়ের পর প্রীতি পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বিদায় লইল।

আবার অপুর একথা মনে না হইয়া পারিল না–কাল, মহাকাল, সবারই মধ্যে পরিবর্তন আনিয়া দিবে…তোমার বিচারের অধিকার কি?

 

আরও মাস দুই কোন রকমে কাটাইয়া অপু পূজার সময় দেশে গেল। সেদিন ষষ্ঠী, বাড়ির উঠানে পা দিয়া দেখিল পাড়ার একদল মেয়ে ঘরের দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া হাসিকলরব করিতেছে-অপু উপস্থিত হইতে অপর্ণা ঘোমটা টানিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল। পাড়ার মেয়েদের সে আজ ষষ্ঠী উপলক্ষে বৈকালিক জলযোগের নিমন্ত্রণ করিয়া নিজের হাতে সকলকে আলতা সিঁদুর পরাইয়াছে। হাসিয়া বলিল—ভাগ্যিস এলে! ভাবছিলাম এমন কলার বড়াটা আজ ভাজলাম—

-সত্যি, কই দেখি?

-বা রে, হাত মুখ ধোওঠাণ্ডা হও—অমন পেটুক কেন তুমি?…পেটুক গোপাল কোথাকার!

পরে সে রেকাবিতে খাবার আনিয়া বলিল, এগুলো খেয়ে ফেলো, তারপর আরও দেবদ্যাখো তো খেয়ে, মিষ্টি কম হয় নি তো?-তোমার তো আবার একটুখানি গুড়ে হবে না!

খাইতে খাইতে অপু ভাবিল—বেশ তত শিখেছে করতে! বেশ–

পরে দেওয়ালের দিকে চোখ পড়াতে বলিল—বাঃ, ও-রকম আলপনা দিয়েছে কে? ভারি সুন্দর তো!

অপর্ণা মৃদু হাসিয়া বলিল—ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপুজোতে তো এলে না! আমি বাড়িতে পুজো করলাম,-মা করতেন, সিঁদুরমাখা কাঠা দেখি তোলা রয়েছে, তাতে নতুন ধান পেতে-বামুন খাওয়ালাম। তুমি এলেও দুটি খেতে পেতে গো—তারই ওই আলপনা

তাই তো! তুমি ভারি গিন্নি হয়ে উঠেছ দেখছি! লক্ষ্মীপুজো, লোক খাওয়ানো—আমার কিন্তু এসব ভারি ভালো লাগে অপর্ণা—সত্যি, মাও খুব ভালোবাসতেন—একবার তখন আমরা এখানে নতুন এসেছি—একজন বুড়োমতোলোক আমাদের উঠোনের ধারে এসে দাঁড়িয়ে বলে— খোকা ক্ষিদে পেয়েছে, দুটো মুড়ি খাওয়াতে পারো?—আমি মাকে গিয়ে বললাম, মা, একজন মুড়ি খেতে চাচ্ছে, ওকে খানকতক রুটি করে খাওয়ালে ভারি খুশি হবে—খাওয়াবে মা? মা কি করলেন বলো তো?

-রুটি তৈরি করে বুঝি—

—তা নয়। মা একটু করে সরের ঘি করে রাখতেন, আমি বোর্ডিং থেকে বাড়ি-টাড়ি এলে পাতে দিতেন। আমায় খুশি করবার জন্য মা সেই ঘি দিয়ে আট-দশখানা পরোটা ভেজে লোকটাকে ডেকে, দাওয়ার কোলে সিঁড়ি পেতে খেতে দিলেন। লোকটা তো অবাক, তার মুখের এমন ভাব হল!

রাত্রে অপর্ণা বলিল—দ্যাখো, মা চিঠি লিখেছেন,-পুজোর পর মুরারিদা আসবেন নিতে, পাঁচ-ছমাস যাই নি, তুমি যাবে আমাদের ওখানে?

অপুর বড়ো অভিমান হইল। সে তো আশা করিয়া পূজার সময় বাড়ি আসিল, আর এদিকে কিনা অপর্ণা বাপের বাড়ি যাইবার জন্য পা বাড়াইয়া আছে! সে-ই তাহা হইলে ভাবিয়া মরে, অপর্ণার কাছে বাপের বাড়ি যাওয়াটাই অধিকতর লোভনীয়!

অপু উদাস সুরে বলিল—বেশ, যাও। আমার যাওয়া ঘটবে না, ছুটি নেই এখন। কথাটা শেষ করিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইয়া বই পড়িতে লাগিল।

অপর্ণা খানিকক্ষণ পরে বলিল—এবারে যে বইগুলো এনেছ আমার জন্যে, ওর মধ্যে একখানা চয়নিকা তো আনলে না? সেই যে সে-বার বলে গেলে জন্মাষ্টমীর সময়? এক-আধ কথার জবাব পাইয়া ভাবিল সারা দিনের কষ্টে স্বামীর হয়তো ঘুম আসিতেছে। তখন সেও ঘুমাইয়া পড়িল।

দশমীর পরদিনই মুরারি আসিয়া হাজির। জামাইকেও যাইতে হইবে, অপর্ণার মা বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছেন, ইত্যাদি নানা পীড়াপীড়ি শুরু করিল। অপু বলিল-পাগল! ছুটি কোথায় যে যাব আমি? বোনকে নিতে এসেছ, বোনকেই নিয়ে যাও ভাই—আমরা গরিব চাকরে লোক, তোমাদের মতো জমিদার নই-আমাদের কি গেলে চলে?

অপর্ণা বুঝিয়াছিল স্বামী চটিয়াছে, এ অবস্থায় তাহার যাইবার ইচ্ছা ছিল না আদৌ, কিন্তু বড়ো ভাই লইতে আসিয়াছে সে কি করিয়াই না বলে? দোটানার মধ্যে সে বড় মুশকিলে পড়িল। স্বামীকে বলিল-দ্যাখো আমি যেতাম না। কিন্তু মুরারিদা এসেছেন, আমি কি কিছু বলতে পারি?…রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, তুমি এখন না যাও, কালীপুজোর ছুটিতে অবিশ্যি করে যেয়োভুলো না যেন।

অপর্ণা চলিয়া যাইবার পর মনসাপোতা আর একদিনও ভালো লাগিল না। কিন্তু বাধ্য হইয়া সে রাত্রিটা সেখানে কাটাইতে হইল, কারণ অপর্ণারা গেল বৈকালের ট্রেনে। কোনদিন লুচি হয় না কিন্তু দাদার কাছে স্বামীকে ছোট হইতে না হয়, এই ভাবিয়া অপর্ণা দুইদিনই রাত্রে লুচির ব্যবস্থা করিয়াছিল—আজও স্বামীর খাবার আলাদা করিয়া ঘরের কোণে ঢাকিয়া রাখিয়া গিয়াছে। লুচি কখানা খাইয়াই অপু উদাস মনে জানালার কাছে আসিয়া বসিল। খুব জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, বাড়ির উঠানের গাছে গাছে এখনও কি পাখি ডাকিতেছে, শূন্য ঘর, শূন্য শয্যাস্ত-অপুর চোখে প্রায় জল আসিল। অপর্ণা সব বুঝিয়া তাহাকে এই কষ্টের মধ্যে ফেলিয়া গেল। বড়োলোকের মেয়ে কিনা?…আচ্ছা বেশ।…অভিমানের মুখে সে এ কথা ভুলিয়া গেল যে, অপর্ণা আজ ছমাস এই শূন্য বাড়িতে শূন্য শয্যায় তাহারই মুখ চাহিয়া কাটাইয়াছে।

পরদিন প্রত্যুষে অপু কলিকাতা রওনা হইল। সেখানে দিনচারেক পরেই অপর্ণার এক পত্র আসিল—অপু সে পত্রের কোনও জবাব দিল না। দিন পাঁচ-ছয় পরে অপর্ণার আর একখানা চিঠি। উত্তর না পাইয়া ব্যস্ত আছে, শরীর ভালো আছে তো? অসুখ-বিসুখের সময়, কেমন আছে পত্রপাঠ যেন জানায়, নতুবা বড়ো দুর্ভাবনার মধ্যে থাকিতে হইতেছে। তাহারও কোন জবাব গেল না।

 

মাসখানেক কাটিল।

কার্তিক মাসের শেষের দিকে একদিন একখানা দীর্ঘ পত্ৰ আসিল। অপর্ণা লিখিয়াছে—ওগো আমার বুকে এমন পাষাণ চাপিয়ে আর কতদিন রাখবে, আমি এত কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে?…আজ একমাসের ওপর হল তোমার একচ্ছত্র লেখা পাই নি, কি করে দিন কাটাচ্ছি, তা কাকে জানাব? দ্যাখো, যদি কোন দোষই করে থাকি, তুমি যদি আমার উপর রাগ করবে তবে ত্রিভুবনে আর কার কাছে দাঁড়াই বলল তো?

অপু ভাবিল-বেশ জব্দ, কেন, যাও বাপের বাড়ি!—আমাকে চাইবার দরকার কি, কে আমি? সঙ্গে সঙ্গে একটা অপূর্ব পুলকের ভাব মনের কোণে দেখা দিল—পথে, ট্রামে, আপিসে, বাসায়, সব সময় সকল অবস্থাতেই মনে না হইয়া পারিল না যে পৃথিবীতে একজন কেহ আছে, যে, সর্বদা তাহার জন্য ভাবিতেছে, তাহারই চিঠি না পাইলে সে-জনের দিন কাটিতে চাহে না, জীবন বিস্বাদ লাগে। সে যে হঠাৎ এক সুন্দরী তরুণীর নিকট এতটা প্রয়োজনীয় হইয়া উঠিয়াছে—এ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অভিনব ও অদ্ভুত তাহার কাছে। অতএব তাহাকে আরও ভাবাও, আরও কষ্ট দাও, তাহার রজনী আরও বিনিদ্র করিয়া তোল।

সুতরাং অপর্ণার মিনতি বৃথা হইল। অপু চিঠির জবাব দিল না।

 

এদিকে অপুদের আপিসের অবস্থা বড়ো খারাপ হইয়া আসিল। কাগজ উঠিয়া যাইবার জোগাড়, একদিন স্বত্বাধিকারী তাহাদের কয়েকজনকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, কি করা উচিত সেসম্বন্ধে পরামর্শ। কথাবার্তার গতিকে বুঝিল কাগজের পরমায়ু আর বেশি দিন নয়। তাহার একজন সহকর্মী বাহিরে আসিয়া বলিল—এ বাজারে চাকরিটুকু গেলে মশাই দাঁড়াবার জো নেই একেবারেবোনের বিয়েতে টাকা ধার, সুদে-আসলে অনেক দাঁড়িয়েছে, সুদটা দিয়ে থামিয়ে রাখার উপায় যদি না থাকে, মহাজন বাড়ি ক্রোক করে দেবে মশাই, কি যে করি।

ইতিমধ্যে সে একদিন লীলাদের বাড়ি গেল। যাওয়া সেখানে ঘটে নাই প্রায় বছর দুই, হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে তাহাকে দেখিয়া লীলা আনন্দ ও বিস্ময়ের সুরে বলিয়া উঠিল—এ কি আপনি? আজ নিতান্তই পথ ভুলে বুঝি এদিকে এসে পড়লেন?

অপু যে শুধু অপ্রতিভ হইল তাহা নয়, কোথায় কেন সে নিজেকে অপরাধী বিবেচনা কবিল। একটুখানি আনাড়ির মতো হাসি ছাড়া লীলার কথার কোন উত্তর দিতে পারিল না। লীলা বলিল–এবার না হয় আপনার পরীক্ষার বছর, তার আগে তো অনায়াসেই আসতে পারতেন?

অপু মৃদু হাসিয়া বলিল-কিসের পরীক্ষা? সে সব তো আজ বছর দুই ছেড়ে দিয়েছি। এখন খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করি।

লীলা প্রথমটা অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কথাটা যেন বিশ্বাস করিল না, পরে দুঃখিতভাবে বলিল,-কেন, কি জন্য ছাড়লেন পড়া, শুনি? আপনি পড়া ছেড়েছেন।

লীলার চোখের এই দৃষ্টিটা অপুর প্রাণে কেমন একটা বেদনার সৃষ্টি করিল—অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার দৃষ্টি, তবুও সে হাসিমুখে কৌতুকের সুরে বলিল—এমনি দিলুম ছেড়ে, ভালো লাগে না আর, কি হবে পড়ে?

তাহার এই হালকা কৌতুকের সুরে লীলা মনে আঘাত পাইল, অপূর্ব কি ঠিক সেই পুরানো দিনের অপূর্বই আছে? না যেন?

অপু বলিল—তুমি তো পড়ছ, না?

লীলা নিজের সম্বন্ধে কোন কথা হঠাৎ বলিতে চায় না, অপুর প্রশ্নের উত্তরে সহজভাবে বলিল—এবার আই.এ. পাশ করেছি, থার্ড ইয়ারে পড়ছি। আপনি আজকাল পুরোনো বাসায় থাকেন, না, আর কোথাও উঠে গিয়েছেন?

লীলার মা ও মাসিমা আসিলেন। লীলা নিজের আঁকা ছবি দেখাইল। বলিল–এবার আপনার মুখে স্বর্গ হইতে বিদায় টা শুনব, মা আর মাসিমা সেই জন্য এসেছেন।

আরও খানিক পরে অপু বিদায় লইয়া বাহিরে আসিল, লীলা বৈঠকখানার দোর পর্যন্ত সঙ্গে আসিল, অপু হাসিয়া বলিল-লীলা, আচ্ছা ছেলেবেলায় তোমাদের বাড়িতে কোন বিয়েতে তুমি একটা হাসির কবিতা বলেছিলে, মনে আছে? মনে আছে সে কবিতাটা?

–উঃ! সে আপনি মনে করে রেখেছেন এতদিন। সে সব কি আজকের কথা?

অপু অনেকটা আপনমনেই অন্যমনস্কভাবে বলিল—আর একবার তুমি তোমার জন্যে আনা দুধ অর্ধেকটা খাওয়ালে আমায় জোর করে, শুনলে না কিছুতেই—ওঃ, দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল!

বলিয়া সে হাসিল, কিন্তু লীলা কোনও কথা বলিল না। অপু একবার পিছন দিকে চাহিল, লীলা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কি যেন দেখিতেছে।

ফিরিবার পথে একটা কথা তাহার বারবার মনে আসিতেছিল। অপর্ণা সুন্দরী বটে, কিন্তু লীলার সঙ্গে এ পর্যন্ত দেখা কোন মেয়ের তুলনা হয় না, হওয়া অসম্ভব। লীলার রূপ মানুষের মতো নয় যেন, দেবীর মতো রূপ, মুখের অনুপম শ্রীতে, চোখের ও ভূর ভঙ্গিতে, গায়ের রং-এ, গলার সুরে, গতির ছন্দে।

অপু বুঝিল সে লীলাকে ভালোবাসে, গভীর ভাবে ভালোবাসে, কিন্তু তা আবেগহীন, শান্ত, ধীর ভালোবাসা। মনে তৃপ্তি আনে, স্নিগ্ধ আনন্দ আনে, কিন্তু শিরায় উপশিরায় রক্তের তাণ্ডব নর্তন তোলে না। লীলা তাহার বাল্যের সাথী, তাহার উপর মায়ের পেটের বোনের মতো একটা মমতা, স্নেহ ও অনুকম্পা, একটা মাধুর্য-ভরা ভালোবাসা।

 

দিন কয়েক পরে, একদিন লীলার দাদামশায়ের এক দারোয়ান আসিয়া তাহাকে একখানা পত্র দিল, উপরে লীলার হাতের ঠিকানা লেখা। পত্ৰখানা সে খুলিয়া পড়িল। দু-লাইনের পত্র, একবার বিশেষ প্রয়োজনে আজ বা কাল ভবানীপুরের বাড়িতে যাইতে লিখিয়াছে।

লীলা সাদাসিধা লালপাড় শাড়ি পরিয়া মাঝের ছোট ঘরে তাহার সঙ্গে দেখা করিল। যাহাই সে পরে, তাহাতেই তাহাকে কি সুন্দর না মানায়! সকাল আটটা, লীলা বোধহয় বেশিক্ষণ ঘুম হইতে উঠে নাই, রাত্রির নিদ্রালুতা এখনও যেন ডাগর ডাগর সুন্দর চোখ হইতে একেবারে মুছিয়া যায় নাই, মাথার চুল অবিন্যস্ত, ঘাড়ের দিকে ঈষৎ এলাইয়া পড়িয়াছে, প্রভাতের পদ্মের মতো মুখের পাশে চুর্ণকুন্তলের দু-এক গাছা। অপু হাসি-মুখে বলিল-থার্ড ইয়ার বলে বুঝি লেখাপড়া ঘুচেছে? আটটার সময় ঘুম ভাঙল? না, এখনও ঠিক ভাঙে নি?

লীলা যে কত পছন্দ করে অপুকে তাহার এই সহজ আনন্দ, খুশি ও হালকা হাসির আবহাওয়ার জন্য! ছেলেবেলাতেও সে দেখিয়াছে, শত দুঃখের মধ্যেও অপুর আনন্দ, উজ্জ্বলতা ও কৌতুকপ্রবণ মনের খুশি কেহ আটকাইয়া রাখিতে পারিত না, এখনও তাই, একরাশ বাহিরের আলো ও তারুণ্যের সজীব জীবনানন্দ সে সঙ্গে করিয়া আনে যেন, যখনই আসে–আপনা-আপনিই এসব কথা লীলার মনে হইল। তাহার মনে পড়িল, মায়ের মৃত্যুর খবরটা সে এই রকম হাসিমুখেই দিয়াছিল লালদিঘির মোড়ে।

—আসুন, বসুন, বসুন। কুড়েমি করে ঘুমুই নি, কাল রাত্রে বড়ো মামিমার সঙ্গে বায়োস্কোপে গিয়েছিলাম সাড়ে-নটার শোতে। ফিরতে হয়ে গেল পৌনে বারো, ঘুম আসতে দেড়টা। বসুন চা আনি।

জাপানী গালার সুদৃশ্য চায়ের বাসনে সে চা আনিল। সঙ্গে পাউরুটি-টোস্ট, খোলসুদ্ধ ডিম, কি এক প্রকার শাক, আধখানা ভাঙা আলু-সব সিদ্ধ, ধোঁয়া উঠিতেছে। অপু বলিল—এসব সাহেবি বন্দোবস্ত বোধ হয় তোমার দাদামশায়ের, লীলা? ডিম, তা আবার খোলাসুদ্ধ, এ শাকটা কি?

লীলা হাসিমুখে বলিল—ওটা লেটু। দাঁড়ান ডিম ছাড়িয়ে দি। আপনার দাড়ির কাছে ও কাটা দাগটা কিসের? কামাবার সময় কেটে ফেলেছিলেন বুঝি?

অপু বলিল-ও কিছু না, এমনি কিসের। বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, তুমি চা খাবে না?

লীলার ছোট ভাই ঘরে ঢুকিয়া অপুর দিকে চাহিয়া হাসিল, নাম বিমলেন্দু, দশ-এগাবো বছবেব সুশ্রী বালক। লীলা তাহাকে চা ঢালিয়া দিল, পরে তিনজনে নানা গল্প করিল। লীলা নিজের আঁকা কতকগুলি ছবি দেখাইল, নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলিল। সে এম.এ. পাশ করিবে, নয় তো বি.এ. পাশ করিয়া বিদেশে যাইতে চায়, দাদামশায়কে রাজি করাইয়া লইবে, ইউরোপের বড়ো আর্ট গ্যালারিগুলির ছবি দেখিবে, ফিরিয়া আসিয়া অজন্তা দেখিতে যাইবে, তার আগে নয়। একটা আলমারি দেখাইয়া বলিল—দেখুন না এই বইগুলো?…ভ্যাসারির লাইভস্ এডিশনটা কেমন?…ছবিগুলো দেখুন-সেন্ট অ্যান্টনির ছবিটা আমার বড়ো ভালো লাগে, কেমন একটা তপস্যাস্ত ভাব, না?—ইনস্টলমেন্ট সিসটেমে এগুলো নিছি-আপনি কিনবেন কিছু? ওদের ক্যানভাসার আমাদের বাড়ি আসে, তা হলে বলে দি।

অপু বলিল—কত কবে মাসে?…ভ্যাসারির এডিশনটা তাহলে না হয়—

—এটা কেন কিনবেন? এটা তো আমার কাছেই রয়েছে—আপনার যখন দরকার হবে, নেবেন—আমার কাছে যা যা আছে, তা আপনাকে কিনতে হবে কেন?—দাঁড়ান, আর একটা বইয়ের একখানা ছবি দেখাই

অপু ছবিটার দিক হইতে আর একবার লীলার দিকে চাহিয়া দেখিলবতিচেলির প্রিন্সেস দে খুব সুন্দরী বটে, কিন্তু বতিচেলির বা দ্য ভিঞ্চির প্রতিভা লইয়া যদি লীলার এই অপূর্ব সুন্দর মুখ, এই যৌবন-পুষ্পিত দেহলতা ফুটাইয়া তুলিতে পারিত কেউ!…

কথাটা সে বলিয়াই ফেলিল—আমি কি ভাবছি বলব লীলা? আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম, তোমাকে মডেল করে ছবি আঁকতাম

লীলা সে কথার কোন জবাব না দিয়া হঠাৎ বলিল—ভালো কথা, আ অপূর্ববর, একটা চাকরি কোথাও যদি পাওয়া যায়, তো করবেন?

অপু বলিল—কেন করব না; কিসের চাকরি?

লীলা বিবরণটা বলিয়া গেল। তাহার দাদামশায় একটা বড়ো স্টেটের অ্যাটর্নি, তাদের অফিসে একজন সেক্রেটারি দরকার-মাইনে দেড়শো টাকা, চাকরিটা দাদামশায়ের হাতে, লীলা বলিলে এখনই হইয়া যায়, সেই জন্যই আজ তাহাকে এখানে ডাকিয়া আনা!

অপুর মনে পড়িল, সেদিনকার কথায় সে লীলার কাছে নিজের বর্তমান চাকুরির দুরবস্থা ও খবরের কাগজখানা উঠিয়া যাওয়ার কথাটা অন্য কি সম্পর্কে একবারটি তুলিয়াছিল।

লীলা বলিল–সেদিন রাত্রে আমি তার মুখে কথাটা শুনলাম, আজ সকালেই আপনাকে পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি, আপনি রাজি আছেন তো? আসুন, দাদামশায়ের কাছে আপনাকে নিয়ে যাই, ওঁর একখানা চিঠিতে হয়ে যাবে।

কৃতজ্ঞতায় অপুর মন ভরিয়া গেল। এত কথার মধ্যে লীলা চাকুরি যাওয়ার কথাটাই কি ভাবে মনে ধরিয়া বসিয়াছিল।

লীলা বলিল—আপনি আজ দুপুরে এখানে না খেয়ে যাবেন না! আসুন,-পাখাটা দয়া করে টিপে দিন না।

কিন্তু চাকুরি হইল না। এসব ব্যাপারের অভিজ্ঞতা না থাকায় লীলা একটু ভুল করিয়াছিল, দাদামশায়কে বলিয়া রাখে নাই অপুর কথা। দিন দুই আগে লোক লওয়া হইয়া গিয়াছে। সে খুব দুঃখিত হইল, একটু অপ্রতিভও হইল। অপু দুঃখিত হইল লীলার জন্য। বেচারি লীলা! সংসারের কোন অভিজ্ঞতা তাহার কি আছে? একটা চাকুরি খালি থাকিলে যে কতখানা উমেদারির দরখাস্ত পড়ে, বড়োলোকের মেয়ে, তাহার খবর কি করিয়া জানিবে?

লীলা বলিল—আপনি এক কাজ করুন না, আমার কথা রাখতে হবে কিন্তু, ছেলেবেলার মতো একগুয়ে হলে কিন্তু চলবে না—প্রাইভেটে বি.এটা দিয়ে দিন। আপনার পক্ষে সেটা কঠিন না কিছু।

অপু বলিল—বেশ দেব।

লীলা উৎফুল্ল হইয়া উঠিল—ঠিক? অনার ব্রাইট?

-অনার ব্রাইট।

শীতের অনেক দেরি, কিন্তু এরই মধ্যে লীলাদের গাড়িবারান্দার পাশে জাফরিতে ওঠানো মার্শালনীলের লতায় ফুল দেখা দিয়াছে, বারান্দার সিঁড়ির দু-পাশের টবে বড়ো বড়ো পল নিরোন ও ব্ল্যাক প্রিন্স ফুটিয়াছে। বর্ষাশেষে চাইনিজ ফ্যান-পামের পাতাগুলো ঘন সবুজ।

পদ্মপুকুর রোডে পা দিয়া অপুর চোখ জলে ভরিয়া আসিল। লীলা, ছেলেমানুষ লীলা—সে কি জানে সংসারের বৃঢ়তা ও নিষ্ঠুর সংঘর্ষের কাহিনী? আজ তাহার মনে হইল, লীলার পায়ে একটা কাঁটা ফুটিলে সেটা তুলিয়া দিবার জন্য সে নিজের সুখ শান্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য কবিতে পারে।

বিবাহের পর লীলার সঙ্গে এই প্রথম দেখা, কিন্তু দু-একবার বলি বলি করিয়াও অপু বিবাহের কথা বলিতে পারিল না, অথচ সে নিজে ভালোই বোঝে যে, না বলিতে পারিবার কোন সংগত কারণ নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *