ইহার কয়দিন পর আকাশ তখনও মেঘলা হইয়া আছে। অপরান্ত্রের দিকে কমল বিগ্রহ-মন্দিরের দাওয়ার উপর বসিয়া মালা গাঁথিতেছিল। রঞ্জন সেই গিয়াছে, আজও ফেরে নাই। সে যেন কমলকে লুকাইয়া একটা কিছু করিতেছে। কমলও কোনো ঔৎসুক্য প্রকাশ করে নাই। মনের মধ্যে একটি অভিমানাহত উদাসীনতা তাহাকে ম্নিয়মাণ করিয়া রাখিয়াছে। সে আপনার মনে মৃদুস্বরে গাহিতেছে—
সুখের লাগিয়া যে করে পীরিতি
দুখ যায় তার ঠাঁই।
বাহিরের আগড় ঠেলিয়া কে যেন প্রবেশ করিল। কমল চাহিয়া দেখিল, সে রঞ্জন। রঞ্জনের বেশে আজ পরম পারিপাট্য ছিল। কপালে চন্দনের তিলক, গলায় ফুলের মালা, পরনে রেশমি বহির্বাস, গলায় উত্তরীয়। কমল মুগ্ধ হইয়া গেল। রঞ্জন কিশোর সাজিয়া তাহার কাছে ফিরিয়া আসিল। সে সব ভুলিয়া গেল এক মুহূর্তে। সব ভুলিয়া গিয়া সে হাতের মালাগাছি লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। হউক দেবতার নামে গাথা মালা! সেও আজ কিশোরী সাজিবে!
হাসিমুখে কাছে আসিয়া সে বলিল, এ কি, এ যে নটবর বেশ! দুই হাত তুলিয়া রঞ্জনের গলায় মালা দিতে গেল, কিন্তু পরমুহূর্তে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত নিশ্চল হইয়া গেল সে, আর্তম্বরে প্রশ্ন করিল, ও কে মহান্ত?
মহান্তের পিছনে ঠিক দরজার মুখে একটি তরুণী দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিল।
মেয়েটি শ্যামাঙ্গী, কিন্তু সর্বাঙ্গব্যাপী একটি চটুলতায় সে মনোহারিণী। তাহার সে চটুল রূপ ষোলকলায় পূর্ণ বিকশিত। রঞ্জনকে উত্তর দিতে হইল না। মেয়েটি বাড়ি ঢুকিল। অদ্ভুত চপলা, মেয়ে, দেখিলেই তাহার প্রকৃতি বোঝা যায়; সর্বাঙ্গে একটি হিল্লোল তুলিয়া হাসিতে হাসিতে সে-ই বলিল, আমি নতুন সেবাদাসী গো!
তারপর একটু আগাইয়া আসিয়া সে আবার বলিল, তুমিই বুঝি কমল বোষ্টমী রাইকমল? তবে যে শুনেছিলাম গাইয়ে-বাজিয়ে বলিয়ে-কইয়ে-রূপে মরি-মার! ও হরি তুমি এই!
ঠোঁটের আগায় সে একটা পিচ কাটিয়া দিল। ধীরে ধীরে কমল মুখ তুলিল, কিছুক্ষণ রঞ্জনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। বিচিত্র দৃশ্য দেখিতে দেখিতে মুখেও তাহার ফুটিয়া উঠিল বিচিত্র এক হাসি। রঞ্জন সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছিল। মেয়েটিও কেমন যেন অভিভূত হইয়া গেল সে-দৃষ্টির সম্মুখে। কমল এইবার কথা বলিল, হাসিয়া বলিল, হঁয়া আমিই রাইকমল। এখন এস, মহান্তকে পাশে নিয়ে দাঁড়াও দেখি—বরণ করে ঘরে তুলি। দাঁড়াও, পিঁড়িখানা নিয়ে আসি।
ঝুলনের জন্য আলপনা-আঁকা পিড়খানা আনিয়া সে পাতিয়া দিল। সেদিনের সে আলপনা। আজও ঝকঝকি করিতেছে, দুই জনের জন্য দুই পাশে দুইটি পদ্ম। দেবী ন্দির হইতে শঙ্খঘণ্টা বাহির করিয়া আনিল, জল ভরিয়া ঘট পাতিয়া দিল, তারপর বলিল, পিঁড়ির উপর উঠে দাঁড়াও।
রঞ্জন বলিল, থাক।
হাসিয়া কমল বলিল, এ যে করণীয় কাজ গো! ছিঃ, উঠে দাঁড়াও, আমি বরণ করি।
সন্ধ্যায় সে নিজের হাতে ফুলশয্যা সাজাইয়া দিল। আপনি শুইতে গেল, পরী যে ঘরে মরিয়াছিল, সেই ঘরে।
পরদিন সকালে উঠিয়া কমল স্নান করিয়া দেবতার ঘরে ঢুকিয়া বসিল, অনেকক্ষণ পর ঘর হইতে বাহির হইয়া রঞ্জন ও নূতন বৈষ্ণবীর বাসর—দুয়ারে গিয়া দাঁড়াইল। দরজা খোলা, উঁকি মারিয়া দেখিল, রঞ্জন শুইয়া নাই। এদিক-ওদিক সে খুঁজিয়া দেখিল। না, রঞ্জন বাড়িতে নাই। কমল অগত্যা পরীর ঘরেই বসিয়া রহিল। ও—ঘরে তরুণীটি এখনও ঘুমাইতেছে।
কিছুক্ষণ পর রঞ্জন ফিরিল। কমলকে দেখিয়া সে লজ্জিত হইল, ব্যস্ত হইয়া বলিল, কি বিপদ, রাখালটা আসে নাই!
সে তাহাকে আড়াল দিয়া চলিবার চেষ্টা করিতেছে। হাসিয়া কমল ডাকিল, লঙ্কা! দীর্ঘকাল পর সে রঞ্জনকে ‘লঙ্কা’ বলিয়া ডাকিল। এতদিন হয় ‘ওগো’ বলিয়াছে, অথবা ‘মহান্ত’।
রঞ্জন নতমুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
কমল হাসিয়া কহিল, এমন লুকিয়ে ফিরছ কেন বল তো?
নতচক্ষেই রঞ্জন বলিল, আমায় মাপ করা কমল।
প্রশান্তকণ্ঠে কমল উত্তর দিল, আর ‘কমল নয়, ‘চিনি’ বল। বহুকাল পরে তুমি আমার ‘লঙ্কা’, আমি তোমার ‘চিনি’। কিন্তু রাগ কি তোমার উপর করতে পারি লঙ্কা? রাগ আমি করি নাই।
ব্যগ্রভাবে রঞ্জন বলিল, সত্যি কথা বল কমল।
না না, ‘কমল’ নয়, ‘চিনি’ বল।
অগত্যা রঞ্জন বলিল, সত্যি কথা বল চিনি।
কমল হাসিমুখে বলিল, রাগ করি নাই, রাগ করি নাই, রাগ করি নাই-তিন সত্যি করলাম, হল তো?
রঞ্জন এবার আদর করিয়া কমলকে বুকে টানিয়া লইতে গেল। কিন্তু কমল বেশ মর্যাদার সহিত আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া বলিল, ছিঃ! তুমি লঙ্কা, আমি চিনি!
তারপর ঘরের ভিতর হইতে একটা পোটলা বাহির করিয়া কাঁখে তুলিয়া লইল, বলিল, এইবার আমায় বিদেয় দাও।
সে কি!
হ্যাঁ, আমি যাই।
তবে তুমি যে বললে, আমি রাগ করি নাই?
না, রাগ করি নাই। তবে-তবে, পরীর কথা মনে পড়ে তোমার—যেদিন আমি প্রথম আসি? আমার এই ভ্রূর পানে তাকিয়ে দেখ, মনে পড়বে।
রঞ্জন নীরবে কমলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কমল আবার বলিল, আমিও তো সেই পরীর জাত, আমার বুকে তো মেয়ের পরান আছে লঙ্কা!
সে সেই আশ্চর্য হাসি হাসিল।
রঞ্জন কমলের হাত ধরিয়া অনুনয় করিয়া বলিল, না না কমল, এ রাজত্ব তোমারই। ও তোমার দাসী হয়ে থাকবে। তুমি তো জান, বৈষ্ণবের সাধনা–রাধারানীর কল্পনা-যৌবন-রূপ–
বাধা দিয়া কমল বলিল, ওরে বাপ রে! অনেক এগিয়েছ তুমি। তা বটে, যৌবন-রূপ সামনে না থাকলে ধ্যান-ধারণায় বাধা পড়ে, রূপ-রাসের উপলব্ধি হয় না, মনে রাধারানী ধরা পড়েন না। ঠিক কথা। একটু হাসিয়া আবার বলিল, তুমি আমার গুরু গো! তোমার সাধন— পথেই তো যাচ্ছি। আমি। আমিও তো বৈষ্ণবী, আমারও তো চাই একটি শ্যাম-কিশোর।
রঞ্জন নির্বাক হইয়া গেল। কমল দুয়ারের কাছে গিয়াছে, তখন সে বলিয়া উঠিল, বলি, তারই সন্ধানে চললে বুঝি?
কমল রঞ্জনের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ গো, তারই সন্ধানে চলেছি আমি। তুমি আশীৰ্বাদ করা।
সে হাসিতে, সে স্বরে ব্যঙ্গ নাই, শ্লেষ নাই, ব্যথা নাই; বিচিত্র সে হাসি-বিচিত্র সে কলস্বর!
কমল পথে বাহির হইয়া পড়িল।
পথ—অজয়ের কূলে কুলে পথ। ঘাট, মাঠ, মাঠের পর গ্রাম। গ্রামের মধ্যে পথের দুই পাশে গৃহস্থের দুয়ার।
বৈষ্ণবী পথের পর পথ পিছনে ফেলিয়া চলে। র দ্বারে গান গাহিয়া ভিক্ষা চায় বিনীত হাসিমুখে। ভিক্ষা লয় সন্তোষের আশীর্বাদে গৃহস্থের ভিক্ষা-দেওয়া শূন্য পাত্ৰখানি ভরিয়া দিয়া। পরিতুষ্ট পুরনারীরা ভিক্ষা দিয়া নিমন্ত্রণ করে, আবার এসো বোষ্টমী। হাসিয়া বৈষ্ণবী বলে, তোমাদের দুয়ারই যে আমাদের ভাণ্ডার, আসব বৈকি।
হাটে-বাজারে বৈষ্ণবী গান গায়। রসিক শ্রোতার দল নানা প্রশ্ন করে। বৈষ্ণবী মিষ্ট হাসি হাসিয়া অবগুণ্ঠনটা একটু টানিয়া দেয়। শ্রোতার হাসিয়া বলে, বোষ্টমীর গান যেমন মিষ্টি, হাসিও তেমনই মিষ্টি।
বৈষ্ণবী হাসিয়া উত্তর দেয়, বৈষ্ণবীর ওই তো সম্বল প্ৰভু।
পথের ধারে অজয়ের ঘাটের পাশে গাছতলায় সেদিনের ঘরকন্ন পাতে, রান্নার উদ্যোগ করিতে করিতে মনে পড়ে রসিকদাসের কথা। রাইকমল দুইটি হাত কপালে স্পর্শ করিয়া বার বার বলে, তোমার সাধনা সফল হোক, তোমার সাধনা সফল হোক। অজয়ের ঘাটে নামিয়া সযত্নে অঙ্গমার্জনা করিয়া স্নান করে; মলিন পরিধেয় সাবান দিয়া কাচিয়া লয়। কাঁচা ধবধবে কাপড়খানি পরে। তারপর স্নানান্তে দর্পণের সম্মুখে নাকে সযত্নে রাসকলি আঁকে। আঁকিতে আঁকিতে অকস্মাৎ চোখ তাহার সজল হইয়া আসে, সে গুনগুন করিয়া মৃদুস্বরে গান ধরে—
সখি বলিতে বিদরে হিয়া
আমারই বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া।
কিন্তু এ গান কোনোদিন সে শেষ করিতে পারে না। অভিশাপের কলি তাহার কণ্ঠে ফোটে না।
মধ্যে মধ্যে তাহার মনে হয়, তাহার পূর্বের রূপ আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। সে সেই রাইকমল। নিজেকে দেখিয়া সে নিজেই মুগ্ধ হইয়া যায়। সেদিন সে গুনগুন করিয়া গান ধরে—
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্ৰতি অঙ্গ মোর।
অজয়ের নির্জন তীর, নিজের গান সে নিজেই শোনে। সব সারিয়া গাছতলার ঘর ভাঙিয়া আবার সে পথ চলে।
পড়লাম