১৩. আজকের কাগজে খবরটা আছে

হ্যাঁ। আজকের কাগজে খবরটা আছে। ঠিক বোঝা যায় না, তবু বোধহয় এটাই সেই খবর।

প্রথমে কিছুক্ষণ নিজের চোখ, বোধশক্তি এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে বিশ্বাস হয় না শ্যামের। তারপর আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে ঘটনাটা বোধহয় ঘটে গেছে। সত্যিই। কিছুকাল আগে দক্ষিণ কলকাতায় এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত শ্রীগৌর ভৌমিক (৩২) গতকাল দুপুরবেলা শুকলাল কারনানি হাসপাতালে মারা গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল না। মৃত্যুর দু’বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল এবং তার একটি শিশুকন্যা আছে। আছে বাবা মা এবং তিন ভাইবোন। লোকটা খুব অখ্যাত ছিল না, রেডিয়োতে গান গাইত এবং তার দুটি রেকর্ডও আছে। যদিও গান শোনেনি শ্যাম, এবং লোকটার নামও তার জানা ছিল না।

এই সেই লোক কি না কে জানে! শ্যাম জানে না। আস্তে আস্তে খবরের কাগজটা সে মাটিতে রেখে দিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা সিগারেট ধরায়। আজও সেই রকম রোদ, অবিকল তেইশে ডিসেম্বরের মতো। ওই সেই রাস্তার তে-মাথার বাঁক। লোকটা ডান দিকে মোড় ঘুরতে গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় আছড়ে পড়েছিল। গেীর ভৌমিক! গান গাইত! একটি শিশু মেয়ে আছে তার। আছে বউ! আছে বাবা মা ভাইবোন! আশ্চর্য, এত সম্পর্কের মধ্যে বাঁধা ছিল লোকটা! অথচ শ্যাম টেরও পায়নি। সে শুধু দেখেছিল একটা মোটরসাইকেলের কালো ভোতা মুখ, আর অচেনা একটা মানুষের ছুটন্ত শরীর। কে জানত যে লোকটার অত পরিচয় আছে!

তবু এই সেই লোক কি না কে জানে! শ্যাম জানে না। যদি এই সেই লোক হয়ে থাকে তবে শ্যাম এ-জন্মের মতো বেঁচে গেল। কোনও দিনই অকারণে আয়নার আলো ফেলার জন্য কেউ তাকে দায়ি করবে না। সমস্ত প্রমাণ লোপ পেল, গোপন রইল কারণ। শুধু জানা গেল যে লোকটা মারা গেছে।

অনেক দিন হয় আর আয়না দেখেনি শ্যাম। তাকের ওপর থেকে আয়নাটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল অনেক ধুলো জমে আছে। নিজের আবছা অলীক এক মুখচ্ছবির দিকে সে একটু তাকিয়ে রইল। বলল, আমি নই। তারপর মাথা নেড়ে নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলল, তুমি! তুমি করেছিলে! তারপর হাসল শ্যাম।

না। তোমাকে চিনি না। শ্যাম বলল।

ময়লা এন্ডির চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল শ্যাম। সাবধানে তালা দিল ঘরে। ধীর পায়ে বেরিয়ে এল।

এসে বসল সেই ছোট্ট নির্জন চায়ের দোকানটায়। এক কাপ চা নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, সিগারেট ধরাল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতে সে বাচ্চা বয়টাকে ডেকে আর-এক কাপ চা দিতে বলল। চা দিয়ে গেলে সে চায়ের কাপটা উলটো দিকের শূন্য চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর রাখে, ছাইদানিটা বসায় চায়ের কাপটার পাশে, একটা সিগারেট ধরিয়ে যত্নে রাখে ছাইদানিটার ওপর। বাচ্চা বয়টা চোখ গোল করে এই দৃশ্য দেখে, দোকানের বুড়ো মালিক তাকে লক্ষ করে, দুটি ছোকরা খদ্দের কথা থামিয়ে চেয়ে থাকে। শ্যাম লক্ষও করে না তাদের। শূন্য চেয়ারটার সামনে টেবিলের ওপর নিঃশব্দে পুড়তে থাকে একটি আস্ত সিগারেট, ধোঁয়া উঠে উঠে ঠান্ডা হয়ে আসে এক কাপ চা। মনে মনে নত হয়ে কথা বলে শ্যাম, গৌর ভৌমিক, যদি পারো তবে আবার জন্ম নিয়ো। আমি জানি, আবার জন্ম নেওয়া বড় সহজ হবে না। শূন্য থেকে, জল থেকে, বাতাস থেকে, মাটি থেকে আবার নিজের শরীর সংগ্রহ করে আনা, এবং তারপরও আবার ভুল, কেবল ভুল জীবন যাপন করে যাওয়া…তবু বড় ইচ্ছে হয়। আর-একবার, আরও একবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে…গৌর ভৌমিক হয় না! যদি পারো আরও-একবার জন্ম নিয়ো, ততদিনে আমি পৃথিবীকে সুন্দর করে দেব, তুমি নিরাপদে পেরিয়ে যাবে, রাস্তার প্রতিটি বাঁক ঝড়ের বেগে পার হবে…লীলার কোলে শিশু হয়ে এসসা, আমি যত্নে তোমাকে বড় করে তুলব…

তারপর সে ওঠে। দুকাপ চায়ের দাম দিয়ে দেয়। বেরিয়ে পড়ে। তুমি ছেলে ছিলে, তুমি স্বামী ছিলে, তুমি ছিলে বাবা। তুমি এত কিছু ছিলে কেউ জানতই না। আবার দেখো, তুমিই উড়ন্ত মোটরসাইকেলে ছুটে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। তুমি পৃথিবীর কেউ না।…গৌর ভৌমিক, আমার ওপরওয়ালা বাস্‌টার্ড বলে গাল না দিলে আমি কি চাকরি ছাড়তুম? চাকরি না ছাড়লে আমি খেলার ছলে তোমার মুখে ফেলতুম আয়নার আলো? দেখো, এ-সবকিছুই একটি রহস্যময় কার্যকারণসূত্রে বাঁধা। তুমি কাকে দায়ি করবে? এই দুহাত শূন্যে তুলে ধরে বলছি আমি দায়ি নই। আবার দেখো মাথা নিচু করে আমিই স্বীকার করছি, আমি দায়ি। তুমি কাকে দায়ি করবে? মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের ঘোরে আমি ডাক দিয়ে উঠি, শ্যাম! আবার নিজেই উত্তর দিই, যাই। নিজের সঙ্গে সব বোঝাপড়া আমার শেষ হয়নি। এখনও আমার ভিতরে রয়েছে একজন অচেনা শ্যাম।…না, পৃথিবী এখনও তেমন সুন্দর নয়, তবু আমি অপেক্ষায়

আছি…জন্ম নাও, আর-একবার জন্ম নাও, আমাদের কাছে এসো…

অনেকক্ষণ ধরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বিচিত্র সব রাস্তার ভিতর দিয়ে চলে গেল শ্যাম। কখনও মাথার ভিতরে, কখনও বুকের ভিতরে ভ্রমরের গুনগুন শব্দের মধ্যে গভীর থেকে গভীরে চলে গেল একটি মোটর-সাইকেলের শব্দ। মাঝে মাঝে চমকে উঠল শ্যাম। নিজেকে ডেকে বলল, তুমিও…তুমিও উড়ন্ত মোটর-সাইকেলে ছুটে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। তুমি পৃথিবীর কেউ না…

না, তা নয়। শ্যাম জানে। সে শ্যাম চক্রবর্তী, বাবা কমলাক্ষ চক্রবর্তী, বিক্রমপুরের বানিখাড়া গ্রামে তার দেশ, সে ছিল সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের ছোটসাহেব। এ-সব কিছুর মধ্যে সে বাঁধা আছে। অথচ সে জানে না সে কে! কিংবা সে কীরকম!

1 Comment
Collapse Comments

Excellent reading sitting in my home desk.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *