১৩. অপরাজিত লালদুর্গে
বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের চতুর্থ মেয়াদ শেষ হতে আর কয়েকটা মাস বাকি। এ সময়টা পিছন ফিরে তাকানো আর কাজকর্মের খতিয়ান বিচার করার সময়। বসুর নিজের দল নিয়ে তেমন কোন সমস্যা নেই, শৃঙ্খলাবদ্ধ জোটও ঠিকঠাক চলছে, সি. পি. আই. (এম)-এর ১৮২জন বিধায়ক আছেন, কোয়ালিশন সরকার চলছে তৈলনিষিক্ত লোহার চাকার মত, ঘর্ষণের শব্দ তেমন শোনা যায় না। বিরোধী পার্টি কংগ্রেসের অবস্থা দেখে শত্রুরও দুঃখ হয়, অন্তর্দ্বন্দ্বে, উপদলে দীর্ণ এক নৈরাশ্যজনক অবস্থা। তবু আত্মসন্তুষ্টি বসুর ধাতে নেই। প্রতিটি জনসভায় বসু বলতে শুরু করেন কমরেডদের নিবিড় জনসংযোগের প্রয়োজনীয়তার কথা, বলেন কমরেডদের আচরণ শোধরানোর কথা, বলতে থাকেন মানুষের মনে আস্থার শিকড় আরও দৃঢ় করার কথা।
ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও বসুর উদ্বেগ কম নয়। ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে বসু দিল্লী গেলেন পলিটব্যুরো আর চণ্ডীগড়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিঙে যোগ দিতে। ২৬ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত রইলেন বঙ্গভবনে, সে সময় জাতীয়স্তরের বহু নেতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের বহু মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে গেলেন। চণ্ডীগড়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং চলাকালীন একটা বেলা বসুর শরীর একটু অসুস্থ হয়ে পড়ল। সম্ভবতঃ অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে। বসু অবশ্য সভায় যোগ দেওয়া থেকে বিরত হলেন না। মে জুন মাসে তাঁর অন্যান্য কর্মসূচীও আগের মতই রইল। ঐ সময় তাঁর ঠাসা প্রোগ্রাম, ঘন ঘন তাঁকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়, মফস্বলে, জেলায়-জেলায়, কখনও বা রাজধানীতে। ৬ই জুন ‘ফসেট’ (ফোরাম অব্ সায়েন্টিস্টস্-ইনজিনিয়রস এ্যান্ড টেকনোলজিস্টস্) আয়োজিত এক সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বসু রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতির উল্লেখ করেন, বলেন, “আগে খবরের কাগজগুলো আমাদের রাজ্যে বিদ্যুতের টানাটানি নিয়ে নানা কথা লিখত কিন্তু এখন আমাদের বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত এবং আমাদের এখন এটা বজায় রাখার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়াবার কথা ভাবতে হবে।” লোডশেডিং-এর জমানা শেষ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন সেটা ভালই বুঝতে পারছেন। এটা কম বড় কাজ নয়। তাছাড়া দার্জিলিং হিল কাউন্সিলের সমস্যা সমাধানের জন্যও রাজ্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে এসেছে, একথাও বসু জানান।
১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মে বসু রওনা হলেন ইংল্যাণ্ড। এবারের ভ্রমণসূচী সম্পূর্ণ সরকারী। আমেরিকাতেও বসু যাবেন। উদ্দেশ্য শিল্পবাণিজ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আমেরিকায় ইউ এস চেম্বার অব কমার্সের ইন্দো-ইউ এস কাউন্সিল-এর এক সভায় বসু তাঁর রাজ্যের শিল্প বিনিয়োগ নীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ওয়াশিংটন, বোস্টন, নিউ ইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায় কয়েকদিন কাটাবার পর বসু আবার লন্ডনে ফেরেন। সেখান থেকে যান হল্যাণ্ডে ফিলিপস-এর কারখানা পরিদর্শন করতে। ইচ্ছা ছিল ব্রিস্টলে, রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখতে যাওয়ার, সময়াভাবে হয়ে উঠল না, কেননা যেতে হল স্ট্যাটফোর্ড অন-অ্যাভন্-এ। সেখানে শেক্সপীয়রের কটেজের সামনে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ মূর্তি বসানোর কথা ছিল।
১৯৯৫ সালের ৮ই জুলাই বসু ৮১ বছর পূর্ণ করে ৮২ বছরে পা রাখলেন। সকাল থেকে ফোন বাজছে। অভিনন্দনের পর অভিনন্দন। প্রথম অভিনন্দন এসেছিল দেশ থেকে। সহকর্মী, বিরোধী-নেতা কেউই বাকী ছিলেন না। জন্মদিন নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা বসুর একেবারেই পছন্দ নয়। একটা সময় ছিল নিজের জন্মদিন মনেও থাকত না, কিন্তু আবার একটা সময়ের পর বাইরের লোকই তাঁকে এদিনটা ভুলতে দেয় না। “মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ দিন কোথাও পালিয়ে গেলে ভাল হয়”, বসু বললেন। সেবার জন্মদিনের সন্ধ্যায় বসু ইংল্যান্ডে, হবর্নের কনট হলে। আপত্তি থাকলেও বসুকে থাকতে হয়েছিল এক মনোজ্ঞ সান্ধ্য অনুষ্ঠানে।
দেখতে দেখতে যাবার দিন এগিয়ে এল। দেশে ফেরার সময় প্লেনে বসেই বসু পুরসভার নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকেন। খবরটা আগেই লন্ডনে বসেই টেলিফোনে পেয়েছিলেন। যিনি ফোন করে খবরটা জানিয়েছিলেন তিনি কিছু বলার আগেই বসু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “কি হেরে গেছো?”…”না, এখনও ঠিক হার হয় নি, তবে…’ বসু ফলাফলটা শুনে নিয়েছিলেন। মাথার ভেতর একধারে যেন ব্যাপারটা গচ্ছিত রাখা ছিল, দেশে ফেরার সময় দীর্ঘ সময় প্লেনে বসে বিষয়টা যেন মাথা থেকে বার করে মন দিয়ে গভীরভাবে যাচাই করতে লাগলেন— ফলাফল তো আশাপ্রদ হয়নি, কারণটা কি…। দেশে ফিরে পার্টিকর্মীদের সঙ্গে বসে সঠিক কারণ অনুধাবন করার চেষ্টা করেন।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস। হঠাৎ বসুর কোমরের স্পন্ডিলাইটিস-এর পুরোনো ব্যথাটা ফিরে এল। বললেন, “সকালবেলা বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে দেখি, উঠতে পারছি না, অসম্ভব ব্যথা।” সমস্ত কর্মসূচী বাতিল করে দেওয়া হল, কয়েকটা অত্যাবশ্যক সরকারী কাজ বাড়িতে সারলেন, বাইরে যাওয়াও স্থগিত রইল, কোমরে কলার বেল্ট পরতে হল, ‘রে’ চিকিৎসা চললো এবং পরে চালু হল বিশেষ ব্যায়াম। সে এক অসহ্য অবস্থা। পিঠসোজা কাঠের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে কখনও কখনও বৈঠকখানায় পার্টির সহকর্মীদের সঙ্গে, মন্ত্রীসভার সদস্য, সরকারী অফিসারদের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য কাজকর্ম, আলাপ আলোচনা, তারপরই বিছানায় বিশ্রাম। পনের দিনের মধ্যেই বসু আগের মত কর্মক্ষম হয়ে উঠলেন, যদিও সম্পূর্ণ সুস্থ তখনও হন নি। প্রথম দিন গেলেন রাইটার্সে, খানিকক্ষণ কাজকর্ম করে চলে এলেন, বেল্ট পরে গিয়েছিলেন, শীতকাল, নতুন বছরের জানুয়ারি মাস, ধুতি পাঞ্জাবির বদলে সেদিন পরেছিলেন হালকা গ্রে রঙের সাফারি স্যুট।
মার্চ মাসের প্রথম তিনদিন রইলেন দিল্লীতে, পার্টির পলিটব্যুরো মিটিং ছিল। কলকাতা ফিরলেন ঠিক চারদিনের জন্য, ৮ই মার্চ যেতে হল কুচবিহার আর শিলিগুড়ি সফরে। একদিন বাদেই আবার দিল্লীতে মিটিং। এবার ফিরে শহরে রইলেন এক সপ্তাহ। ঠিক এই সময়ে নির্বাচন কমিশন একাদশ লোকসভা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করল। ২৯শে এপ্রিল, ২রা মে এবং ৭ই মে নির্বাচন হবে। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে দুটি পর্যায়ে যথাক্রমে ২রা এবং ৭ই মে।
২৪শে মার্চ বসু ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিলেন। গনগনে রোদ। উপস্থিত ছিলেন ভি. পি. সিং এবং লালুপ্রসাদ যাদব। ২৭শে মার্চ বসু চলে গেলেন দার্জিলিং। জি. এন. এল. এফ-এর সঙ্গে আলোচনা করবেন, কারণ তারা তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দার্জিলিং সমস্যার প্রতি কেন্দ্রের উদাসীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তারা লোকসভা নির্বাচন বয়কট করবে। তবে বিধানসভা নির্বাচনে তারা দার্জিলিং, কার্সিয়াং, কালিম্পং এবং শিলিগুড়ি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। রাজ্য কংগ্রেসে তখন চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।
জোরকদমে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়ে গেল। বসু কখনও রাজ্যে, কখনও রাজ্যের বাইরে। আগরতলায় সারকিট হাউসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বসু কংগ্রেসের দুর্নীতির কথা মানুষকে মনে করিয়ে দেন; তিনি বলেন কংগ্রেসের পক্ষে রাজ্যে কোন বিকল্প সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তবে আত্মসন্তোষের কোনও কারণ নেই, কারণ নেতিবাচক ভোটের ফলে কংগ্রেস লাভবান হয়ে যেতে পারে। গণমাধ্যমকে আক্রমণ করে বসু বলেন “এক শ্রেণীর সংবাদপত্র আমাদের পর পর জয় মেনে নিতে পারছে না, তারা একটা নতুন শব্দ তৈরি করেছে—’সায়েন্টিফিক রিগিং’, কথাটার মানে যাই হোক, মূল উদ্দেশ্য হল আমাদের ছোট করা।” জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বসু নিজের থেকে কোনও কথা বলতে অস্বীকার করেন কিন্তু সাংবাদিকদের পীড়াপীড়ির পর তিনি বলেন জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট জোট অবশ্যই কেন্দ্রে জয়ী এবং সফল হবে। তিনি বলেন যে তিনি আশা রাখেন ছোট ছোট আঞ্চলিক দলও কেন্দ্রের সরকারে যোগ দেবে। বসু কি প্রধানমন্ত্রী হবেন?—সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে বসু এই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেন। নির্বাচন কমিশনের কড়া নিয়ম কানুন মেনে বসু হেলিকপ্টার নিলেন না। আইনী ব্যাপারে বসু নিয়মের খুঁটিনাটি মানার পক্ষপাতী। বাইরের জেলাগুলিতে বসু ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করলেন। সিউড়ি, আসানসোল, দুর্গাপুর, মালদা—প্রত্যেক জায়গায় ভাষণ দিলেন। বহু দূরের জায়গাগুলোতে কখনও ট্রেনে কখনও গাড়িতে যাতায়াত করে কাজ সারলেন। নিজের খাওয়ার পরিমাণ সচেতনভাবে কমিয়ে দিলেন; “আমাকে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে”, প্রায়ই বলতে থাকেন, “এখন শরীর খারাপ হলে মুস্কিল।” নির্বাচনী প্রচার চলতে থাকে। ২৯ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে বসু বলেন কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত, ফলে সংসদে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তিনি আরও বলেন এর ফলে কয়েকটি দল তৃতীয় ফ্রন্টের সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হবে, “তবে তাদের উদ্দেশ্য এবং মতামত ভালভাবে যাচাই করেই আমরা তাদের ফ্রন্টে যোগ দিতে দেব।” সুযোগ এলে আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেবেন—এখানেও আবার সেই একই প্রশ্ন। “রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার না করে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখন নেওয়া সম্ভব নয়”—বসু জবাব দেন।
৪ঠা মে বসু গেলেন নিজ নির্বাচনী কেন্দ্র সাতগাছিয়ায়। সেদিন ছিল তৃতীয় নির্বাচনী সভা। স্থান নওয়ালি ফুটবল মাঠ। ব্যক্তিগত সংযোগ তেমন না থাকলেও সাতগাছিয়ার মানুষের জন্য বসু গভীরভাবে চিন্তা করেন। “এটাই বোধকরি আমার শেষ নির্বাচন”–বসু মনে মনে বলেন। ভাষণ ঠিক শুরু করার আগে একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাঁর মনকে ছেয়ে ফেলে এবং সেটা ঝেড়ে ফেলে বসু বক্তৃতা শুরু করেন, বার বার তাঁকে নির্বাচিত করার জন্য তিনি সাতগাছিয়ার মানুষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং এবারের ভোটে তাঁর জেতার মার্জিন বাড়ানোর জন্য তাঁদের বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে থেকেই বসু চেষ্টা করেন অযথা উত্তেজনার ‘সুইচ অফ’ করে দিতে। চিন্তাভাবনা, উদ্বেগ, সংশয় থেকেই যায়, কিন্তু সচেতনভাবে সেটা বাড়তে দেন না। ৬ই মে তিনি বিদায়ী মন্ত্রীসভার বৈঠক করেন রাইটার্সে, তারপর সন্ধ্যবেলায় আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে পার্টি অফিসে কমরেডদের সঙ্গে প্রাক-নির্বাচনী পর্ব নিয়ে আলোচনায় বসেন। দীর্ঘক্ষণ চলে এই আলাপ আলোচনা। নির্বাচন এসে যায়। ৭ই মে সকাল দশটাতেই স্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে নিজের ভোটটি দিয়ে আসেন। তাঁকে টেলিফোনে সারাদিন খবরাখবর দেয় পার্টি কমরেডরা। বিকেলে রাইটার্স বিল্ডিংস্-এ সাংবাদিক সম্মেলনের পর সন্ধ্যাবেলা আবার পার্টি অফিস। পরের দিন গণনা শুরু হয়। সন্ধ্যায় বসুর বাড়ি ইন্দিরা ভবনে বেশ কয়েকজনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। বসু অন্যদিনের তুলনায় একটু দেরীতে রাতের খাওয়া সারলেন। ঠিক করলেন রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে থাকবেন, রেজাল্ট জানাবে পার্টি অফিস থেকে। ফলাফল আসতে শুরু করল পরের দিন থেকে। রেকর্ড করলেন বসু, পঞ্চমবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেসের চিত্তরঞ্জন বাগ। রাজ্যে লালদুর্গ অক্ষত রইল কিন্তু অসংগঠিত কংগ্রেস বিধানসভায় তাদের আসন প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলল—তারা পেল মোট ৮২টি আসন। সি. পি. আই. (এম) পেল ১৫০টি আসন।
জাতীয় স্তরে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউই পেল না, বি. জে. পি-ও নয়, কংগ্রেস নয়। কোনও একক দলই প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন জিততে পারল না। রাজনীতিতে ঘোর অনিশ্চয়তা দেখা দিল, বহু পার্টির আলাপ আলোচনায় দিল্লী সরগরম হয়ে উঠল। প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য বি. জে. পি-কে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে রাখা। রাও- এর কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলির মধ্যে অভিন্নতা একেবারেই ছিল না কিন্তু বি. জে. পি-কে ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তারা জোট বাঁধতে রাজি হল। জি. কে. মুপানারের তামিল-মানিলা কংগ্রেস, বি. জে. পি-র দ্বারা প্রভাবান্বিত না হয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রণ্টেই যোগদান করল। ১৩ পার্টির কোয়ালিশন সরকার হল। এবার প্রশ্ন নেতা নির্বাচনের। প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন কি না এ নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে উঠল।
২
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। আশির শেষভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবাদটাকে যেন একটা নতুন মাত্রা দেওয়া হল। বসু প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে চাইলেন যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং কঠিন পরিশ্রম দ্বারা শ্রমজীবী মানুষ এবং শিল্পপতি উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা করাটা সোনার পাথরবাটির মত কোনও ‘অ্যাবসার্ড স্বপ্ন’ নয়। ১৯৯৪ সালে কলকাতায় ‘মারচেণ্ট চেম্বার অব্ কমার্স’-এর ৯৩তম বণিকসভায় বসু বলেছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পবাণিজ্যের একটা প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। চল্লিশ দশকের শেষভাগ পর্যন্ত সংগঠিত ক্ষেত্রে এই রাজ্যের স্থান ছিল প্রথম। তারপর দেশ ভাগ হল, উদ্বাস্তুর স্রোত এল এবং দুঃখের কথা তখন সরকার পরিস্থিতির মোকাবিলা সঠিকভাবে করতে পারেন নি বরং লোহা, কয়লার মত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের ওপর মাসুল সমীকরণের ফলে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে, শিল্পপতিরা কেন্দ্রের নীতিতে বিভ্রান্ত হয়ে অন্য রাজ্যে বিনিয়োগ করতে শুরু করে ফলে এই রাজ্যে রুগ্নশিল্প ধুঁকতে থাকে, শিল্পক্ষেত্রে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ভূমিসংস্কার, কৃষিউন্নয়ন, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। শিল্পবাণিজ্য উন্নয়নের নতুন ভিত্তি তৈরী করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।”
পৃথিবীর বহুদেশে ইতিমধ্যে মার্কসবাদ মুছে গেছে, সেখানে ধনতন্ত্রের জয়পতাকা ওড়ানো হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদের ফ্রেমের মধ্যে থেকেও শিল্পবাণিজ্যের উন্নয়ন যে অসম্ভব নয়—একথা বসু প্রতিটি শিল্পসভায়, এমন কি সাধারণ জনসভাতেও বার বার বলতে থাকেন। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উদারনীতিকে বসু স্বাগত জানান কিন্তু সম্পূর্ণ মুক্তকণ্ঠে এই নীতির পক্ষে কথা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। তাঁর সার কথা, আজকের অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে, স্বয়ংভর হতে গেলে অবশ্যই কতগুলো বিষয়ে বড় রকমের পরিবর্তন আনা দরকার, তিনি বলেন, “কিন্তু এটা এমন হওয়া উচিত নয় যাতে গরীবরা আরও বেশী গরীব হয়ে পড়ে আর বড়লোকেরা আরও বেশী বড়লোক।” “এখনও পর্যন্ত”, বসু বললেন, “যা হয়েছে তাতে মোটে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ লোকের সুবিধে হচ্ছে—এই অবস্থাটা আমাদের কাটাতে হবে।”
৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যের শিল্পনীতি সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা করেন। এখানেও বসু বার বার মনে করিয়ে দেন যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রই কিন্তু শিল্পনীতি নির্ধারণে প্রথম এবং চূড়ান্ত কথা বলার অধিকার রাখে। এমনকি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিরও কেন্দ্রের ছাতার নীচেই অবস্থান। ফলে রাজ্যকে বেশ কয়েকটি নিয়ম নিগড়ে বাঁধা অবস্থায় কাজ করতে হয়। ‘ডিলাইসেন্সিং’ এবং ‘মাসুল সমীকরণ প্রকল্পের অবসান’-এর ফলে রাজ্যে শিল্প উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিদেশী কারিগরি দক্ষতা অথবা বিদেশী পুঁজি নেওয়ার ব্যাপারে বসুর দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও ছুঁৎমার্গ একেবারেই নেই। বহু প্রকাশ্য জনসভায় তিনি বার বার বলতে থাকেন “কয়েকটি নির্বাচিত ক্ষেত্রে বিদেশী পুঁজি বা নতুন কারিগরি জ্ঞান গ্রহণ করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। স্বয়ংভর হওয়ার জন্য এগুলোর অবশ্যই দরকার আছে।”
আসলে উদারনীতি সার্বিক প্রয়োগ বসুর পছন্দ নয়। তিনি চান কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে এই নীতি রূপায়িত করতে। তাঁর মতে, “প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশ হোক তবে সেটা পাবলিক আর জয়েন্ট সেক্টরের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়।” বহুজাতিক সংস্থার অনুপ্রবেশও তাঁর নীতির পরিপন্থী। তিনি বলেন, “প্রতিযোগিতা থাকুক, তবে সমানে সমানে প্রতিযোগিতাই ভাল, বহুজাতিকদের সঙ্গে নয়।”
শিল্পোন্নয়ন বলতে বসু বোঝেন, উৎপাদনশীলতা এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো, রুগ্নশিল্পের পুনরুজ্জীবন এবং বর্তমান অবস্থার আধুনিকীকরণ। বসুর মতে, ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পস্থাপন করা কেন যাবে না? এর ভৌগোলিক অবস্থাটা তো খুবই সুবিধাজনক। হলদিয়া বন্দর, কলকাতা বন্দর, ভাল রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে ভাল বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতিও হয়েছে, তাছাড়া রয়েছে এক স্থায়ী ও অসাম্প্রদায়িক সরকার। শিল্প গড়তে এখানে বাধা কোথায়?’ রাজ্যের শিল্পপতিদের কাছে বসু শিল্পের ব্যাপারে মূর্তিমান প্রেরণা, তাঁদের মতে ৯২ সালে মাসুল সমীকরণ নীতি, লাইসেন্স-রাজের অবসানের ফলে শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন বদলে গেছে। তাছাড়া শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্রও আগের মত অত ভয়ংকর আর নেই।
শিল্পায়নের ব্যাপারে বসু বিশেষ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছেন। গত দশক থেকেই তিনি এই উদ্দেশ্যে দেশে বিদেশে শিল্পপতিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক দেশ থেকে রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগে উৎসাহী বহু টীমও আসছেন। ১৯৯৫ সালে বসুর আমেরিকার সরকারী সফরের মূল উদ্দেশ্যই ছিল শিল্প বিনিয়োগের চেষ্টা চালানো এবং পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিদেশের মানুষের মনে শিল্প নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা দূর করা। বসু মনে করেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের নিশ্চয়ই ট্রেড ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ হবার এবং ন্যায়বিচার চাইবার অধিকার আছে। ধর্মঘট করার অধিকার তাদের আছে কিন্তু তাদের উৎপাদনে এবং উৎপাদনশীলতার প্রতি সজাগ দৃষ্টিও রাখতে হবে। “আমি কর্মচারীদের ‘প্রোডাকটিভ’ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে বলছি”, বসু বললেন, “আর ম্যানেজমেণ্টকে বলছি, একটা স্বচ্ছ মনোভাব রাখতে, যাতে তারা কর্মচারীদের নিজেদের ‘কনফিডেন্সে’ নিতে পারে।”
মার্কসবাদের সঙ্গে এই উথলে ওঠা শিল্পবাণিজ্যের সহাবস্থান কি করে সম্ভব?— এই প্রশ্নের উত্তরে বসু বলেন, “আমি মার্কসবাদী, তাই বলছি, জেনে রাখা ভাল যে প্রকৃত মার্কসবাদ বাস্তব অবস্থাটা বিশ্লেষণ করতে শেখায়। আমরা তো পশ্চিমবঙ্গ ‘রিপাবলিক’ নই, আমরা প্রজাতান্ত্রিক ভারতের একটা অংশ মাত্র, ফলে বহু বাধার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়, সাংবিধানিক নিয়ম, ধনতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কাজ করার অসুবিধা—সবই আমাদের মেনে চলতে হয়। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি ভালভাবে যাচাই করে দেখেছি এই অবস্থায় কিন্তু সমাজতান্ত্রিকসূচী এমনকি একটা সোস্যাল ডেমোক্রাটিক কর্মসূচীও চলতে পারে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য একটা ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচী অবশ্যই চলতে পারে, আমরা গত ১৯ বছর ধরে সেটাই চেষ্টা করে চলেছি। এবং পশ্চিমবঙ্গে তার আগে যেসব পার্টি রাজত্ব করেছে তাদের থেকে ভাল করার চেষ্টা করেছি।”
ভারতের শিল্পপরিস্থিতির স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কি কোনও উন্নতি হয়েছে?— বসুর মতে উন্নতি যে একেবারে হয়নি তা নয়, তবে সেটা আংশিক আর খাপছাড়া হয়েছে। “এখন সময় এসেছে”, বসু বললেন, “এখন ভারত সরকারের তথাকথিত জনস্বার্থরক্ষাকারী মনোভাব বর্জন করে মানুষের প্রকৃত স্বার্থরক্ষা করার দিকে যথার্থ দৃষ্টি দেওয়ার।” বসুর মতে বিদেশের সর্বোত্তম শিল্পনীতি বা ব্যবস্থা থেকে কিছু কিছু শিক্ষা নেওয়া যায় বটে কিন্তু পুরোটা আমাদের দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। “আসলে সেই সব নীতি বা ব্যবস্থা কতটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কতটা ফলপ্রসূ হবে—এ কথা মাথায় রেখেই তবে এগোনো উচিত।”—বসু মন্তব্য করেন।
বসুর উৎসাহে ও উদ্যোগে রাজ্যে এখন শিল্প বিনিয়োগের রমরমা চলছে। পাঁচতারা হোটেলে দেশান্তরের শিল্পপতিদের ভিড়। জমি নিয়ে স্থান সংকুলানের অভাবও ঘটছে কখনও কখনও। কলকাতায় কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটে শিল্পউন্নয়ন নিগমের অফিস সদাই সরগরম। জানলা এখন খোলা। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। আশা, অদূর ভবিষ্যতেই ফসল ফলবে।