1 of 2

১৩. অতীন প্যান্টে বেল্ট বেঁধে

অতীন প্যান্টে বেল্ট বেঁধে বেরুবার জন্য তৈরি হচ্ছে, এমন সময় ঝনঝন করে বেজে উঠলো। টেলিফোন। অতীন মুখ ফিরিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। টেলিফোনটা সে ধরবে, কি ধরবে না? আর আধ মিনিট বাদে, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলে সে ঐ টেলিফোনের আওয়াজ শুনতেই পেত না। আধ মিনিটে কী আসে যায়! এই ভর সন্ধেবেলা কেউ জরুরি টেলিফোন করে না!

কয়েকবার বেজে থেমে গেল ঝনঝনানি। অতীন নিশ্চিন্ত হয়ে জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিতে যাবে, আবার টেলিফোন বাজলো। দু’বার ডাকের মধ্যে একটা ব্যাকুলতা থাকে। এবারে ধরতেই হয়।

প্রথমে একজন অপারেটরের কৃত্রিম কণ্ঠস্বর। কালেক্ট কল, শ্যান্টা রেচাড্রি কথা বলতে চাইছে, অতীন কি নেবে?

অতীন বললো, ইয়াপ!

–হ্যালো সিদ্ধার্থ? আমি শান্তা বৌদি বলছি, একটা মুশকিলে পড়েছি ভাই।

–সিদ্ধার্থ এখনো বাড়ি ফেরেনি, আপনি যদি কোনো মেসেজ দিতে চান–

–আপনি কে? অতীনবাবু? সিদ্ধার্থ কখন ফিরবে?

–এই সময়েই ফেরার কথা! পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়েবে বোধ হয়।

–আপনি কি বাড়িতে আছেন? আমি একটু আসতে পারি? আমার বিশেষ দরকার আছে, আমি কাছাকাছি এক জায়গা থেকেই বলছি।

ভদ্রমহিলা এখানে আসতে চাইছেন, অতীন না বলতে পারে না। কিন্তু অতীনের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হলো। কেন সে ফোনটা ধরতে গেল? অতীন তত বেরিয়েই যাচ্ছিল, তা হলে উনি কোনো সাড়া পেতেন না।

শান্তা বৌদির বাড়িতে গিয়ে অতীন অভদ্র ব্যবহার করেছিল, তারপর একদিন সে টেলিফোনে ক্ষমা চেয়েছে বটে কিন্তু ওঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেছে। এখন সেই শান্তা বৌদির মুখোমুখি পড়ে যেতে হবে? সর্বনাশের ব্যাপার!

ভদ্রমহিলা কালেক্ট কল করলেন কেন, তাও কাছাকাছি থেকে? সিদ্ধার্থর সঙ্গে ওঁর দরকার, অতীন বসে থেকে কী করবে? ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই আসবেন বললেন, অতীন কী করে দরজা বন্ধ করে চলে যাবে! অতীনের কোনো কাজ নেই অবশ্য, সারাদিন বাড়িতে বসে ছিল বলেই সে একবার ঘুরে আসতে চাইছিল রাস্তা থেকে।

সিদ্ধার্থ এসে পড়লে সে কেটে পড়তে পারে। অফিস থেকে সাধারণত এই সময়েই ফেরে সিদ্ধার্থ, কিন্তু আজ যদি কোনো কারণে আটকে যায়? ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতেই হবে, সেরকম তো কোনো মাথাব্যথা নেই।

সিগারেট ধরিয়ে সে বিরক্তমুখে অ্যাপার্টমেন্টে পায়চারি করতে লাগলো। অকারণে ফ্রিজটা খুলে দেখলো একবার। জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলো রাস্তায়। অনেক নীচের রাস্তাটা যেন তাকে টানছে। বাইরের টাটকা বাতাস, রেস্তোরাঁর গান-বাজনা…

দশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়লেন শান্তা বৌদি। অতীন দরজা খোলা মাত্র তিনি এক গাল হেসে বললেন, যা একখানা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে আজ! এমন বিপদে পড়ে গেছি! আমার হ্যাঁন্ডব্যাগটা চুরি হয়ে গেল!

ভেতরে এসে বললেন, কী কাণ্ড বলুন তো! আমার আগে কক্ষনো এরকম হয়নি। ব্যাগের মধ্যে আমার চেক বই, টাকাপয়সা, ড্রাইভিং লাইসেন্স সব কিছু। কী ভাগ্যিস গাড়ির চাবিটা অন্যমনস্কভাবে হাতের মুঠোয় রেখেছিলুম, ব্যাগে ঢোকাইনি!

অতীন আড়ষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো, ব্যাগটা কী করে চুরি গেল? শান্তা বৌদি বললেন, কী জানি, বুঝতেই পারলুম না। একটা গ্রসারি স্টোরের কাউন্টারের ওপর ব্যাগটা রেখে দু’একটা জিনিস দেখছিলুম, বোধ হয় এক মিনিটও হয়নি, তার মধ্যেই ব্যাগটা হাওয়া! কত খোঁজাখুঁজি হলো, দশ বারোজন মাত্র লোক ছিল দোকানে, তাদেরই কেউ নিয়েছে, না বাইরে থেকে কেউ এসে… আপনাদের এই পাড়াটায় বড় চোরের উপদ্রব!

অতীন বললো, আপনি কুইনসে থাকেন, অত দূর থেকে এ পাড়ায় গ্রসারি স্টোরে বাজার করতে এসেছিলেন কেন?

শান্তা বৌদি চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, আমাকে একটা কাজে ম্যানহাটনে আসতেই হয়েছিল, তারপর অফ ব্রডওয়ে থিয়েটারের টিকিট কাটলুম দুটো, সেই টিকিটও গেল, ঐ ব্যাগের মধ্যে ছিল! এদিকে এলে আমি বাজার করে নিয়ে যাই, এ পাড়ায় একটা দোকানে খুব ফ্রেস ক্যাবেজ পাওয়া যায়। এমনিতে তো এদেশের বাঁধাকপিতে কোনো স্বাদই নেই। ফিফথ স্ট্রিটের ঐ সারি স্টোরটা দেখেছেন? ওরা পৃথিবীর সব দেশের ভেজিটেবল রাখে, আমি একদিন চেঁকির শাক পর্যন্ত পেয়েছি, লাউ পেয়েছি…। আপনাদের ঘরটা বড় গরম হয়ে আছে, বাইরে কিন্তু আজ বেশ ঠাণ্ডা!

অতীন একটা জানলা খুলে দিল।

শান্তা বৌদি বললেন, ব্যাগটা চুরি যাওয়ায় একেবারে বোকা বনে গেছি! সঙ্গে তো আর একটাও পয়সা নেই, বাড়ি ফিরবো কী করে? আমার কতা অফিসের কাজে শিকাগো গেছেন, বাড়িতে ফোন করে কোনো লাভ নেই। গাড়িটা রেখেছি একটা পার্কিং লটে, সেখানে দু’তিন ডলার দিতে হবে, গাড়িটা ওখানে রেখে দিয়ে ট্রেনে যে ফিরবো, সে টিকিট কাটারও উপায় নেই, তাই ভাবলুম, কাছেই সিদ্ধার্থর অ্যাপার্টমেন্ট, যদি তার সাহায্য পাওয়া যায়।

অতীন টেবিলের প্রথম ড্রয়ারটা খুললো। এখানে সিদ্ধার্থ আর সে খুচরো পয়সাগুলো রাখে। এদেশে অনেক খুচরো জমে যায়। অতীন দেখলো, কোয়াটার আর ডাইম মিলিয়ে সাত-আট ডলার হয়ে যাবে। সে বললো, পার্কিং লট থেকে আপনার গাড়িটা ছাড়াবার ব্যবস্থা। হয়ে যেতে পারে!

শান্তা বৌদি বললেন, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও যে ব্যাগের মধ্যে ছিল! পার্কিং লটে গিয়ে যদি বলতুম আমার ব্যাগ চুরি গেছে, তা হলে ওরা এমনিই ছেড়ে দিত নিশ্চয়ই, পরে ওদের পাওনাটা চেকে পাঠিয়ে দিতুম, কিন্তু লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাবো কী করে? ধরলে জেলে দিয়ে দেবে!

এ দেশে সবাই গাড়ির ওপর নির্ভরশীল, আবার গাড়ি একটা ভয়েরও বস্তু বটে। শহরে এসে গাড়ি রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়াই বিরাট ঝামেলা, যেখানে সেখানে রাখলে পুলিশ টিকিট দিয়ে দেবে কিংবা গাড়ি টো করে নিয়ে যাবে। পার্কিং লটে রাখতে গেলে অনেক পয়সা দিতে হয়। গাড়ি খুব জোরে চালালে পুলিশ ধরে, আস্তে চালালেও ধরে, ড্রাইভিং লাইসেন্স সঙ্গে রাখতে হবে সব সময়। তা বলে, একদিন কি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া যাওয়া যায় না?

শান্তা বৌদি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? তা হলে আপনি আমায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারেন, গাড়িতে অনেক জিনিসপত্রও আছে।

–আমি গাড়ি চালাতে জানি না!

–তা হলে তো সিদ্ধার্থর জন্য অপেক্ষা করতেই হয়। একটু চা খাওয়াতে পারবেন? আমিই তৈরি করে নিতে পারি।

–না, না, আমি করে দিচ্ছি। টি ব্যাগ আছে, অসুবিধে কিছু নেই।

–আপনি কি বেরুচ্ছিলেন? কোথাও যাবার তাড়া আছে?

–হ্যাঁ, একটু আছে। আপনাকে চা-টা করে দিই, আশা করি সিদ্ধার্থ একটু বাদেই এসে পড়বে!

কেটলিতে জল ভরে স্টোভে চাপিয়ে দিল অতীন। এখনও তার অস্বস্তি যাচ্ছে না। সিদ্ধার্থটা আসছে না কেন? আজই সে সেই বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে কোথাও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে কি না কে জানে!

অতীন শান্তা বৌদির দিকে পেছন ফিরে আছে। ভদ্রমহিলা দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু রূপের জন্য অহঙ্কারের ভাবটা নেই, ব্যবহার চমৎকার। এই যে ব্যাগ হারিয়ে বিপদে পড়েছেন, সেটা নিয়েও হেসে হেসে কথা বলছেন। এই রকম একজন মহিলার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে তো। যে-কোনো মানুষেরই ভাল লাগার কথা। অতীন নিজেই বুঝতে পারছে না, সে কেন এই মহিলার উপস্থিতি পছন্দ করতে পারছে না। ওঁর সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনেই গণ্ডগোল করে ফেলার জন্য। উনি তো একবারও কোনো ভাব দেখান নি যে উনি তার সেদিনের ব্যবহারে আহত হয়েছেন!

শান্তা বৌদি কাছে এসে বললেন, বাচেলরদের ঘরে ভীষণ পুরুষ পুরুষ গন্ধ থাকে। জানেন, আমার পরিষ্কার বাতিক আছে। এই রকম কোনো ঘরে এলেই আমার হাত দুটো নিশপিশ করে, ইচ্ছে করে সব কিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করে দিই। রান্নাঘরের ওয়ালপেপারেও ঝোলের দাগ লাগিয়েছেন?

অতীন শুকনো ভাবে জিজ্ঞেস করলো, আপনার ক’ চামচ চিনি?

–এক চামচ। কিন্তু দুটো টি ব্যাগ দেবেন।

–দুধ মেশাবো, না লেবু?

–লেবুও আছে নাকি?

আসল লেবু নয়, একটা প্লাস্টিকের তৈরি অবিকল হলদে রঙের লেবু, তার মধ্যে এক আউন্স। রস, টিপলে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে। সেটা হাতে নিয়ে শান্তা বৌদি বললেন, এই জিনিসটা আমি কখনো ব্যবহার করিনি। আমি ফ্রেস লেবুই পছন্দ করি।

চায়ের কাপটা শান্তা বৌদির হাতে তুলে দিয়ে অতীন একটু দূরে সরে গেল। ভদ্রমহিলা একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন। অন্য কোনো মতলব আছে না কি? দরজা বন্ধ, ঘরের মধ্যে দু’ জন নারী আর পুরুষ, এত কাছে এসে কথা বলার দরকার কী?

অতীন মনে মনে ঠিক করলো, এই মহিলা যদি তার সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করেন, তা হলে সে এমন শিক্ষা দেবে, যা উনি জীবনে ভুলবেন না! এদেশে এসে মেমসাহেব হয়েছেন, যার তার সঙ্গে ব্যাভিচার করে বেড়ান মনে হচ্ছে। সিদ্ধার্থ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে বলবে, তুই যে শান্তা বৌদির এত প্রশংসা করছিলি, ইনি যে আমার সঙ্গে শুতে চাইছিলেন রে! এই সব। মেয়েছেলেদের আমার ছুঁতেও ঘেন্না করে।

অতীন আড় চোখে শান্তা বৌদির দিকে তাকালো। বারোয়ারি বৌদি, থিয়েটার করেন, সবাইকে ডেকে ডেকে খাওয়ান, আর একলা ছেলেদের অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসেন যখন তখন!

শান্তা বৌদি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ! থ্যাঙ্ক ইউ! আপনার সম্পর্কে বি জানি না। আপনি কি চাকরি করেন, না এখনো পড়ছেন?

–আমি কুলিগিরি করি!

শান্তা বৌদি মধুরভাবে হাসলেন।

অতীন আবার জোর দিয়ে বললো, আমি কাছেই একটা সুপার মার্কেটে লরি থেকে মালপত্তর নামাই। সপ্তাহে তিন দিন।

–প্রথম প্রথম এসে অনেককেই এরকম অড জব করতে হয়। কত ছাত্র-ছাত্রী হোহাটেল-রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার কাজ করে। এদেশে ডিগনিটি অফ লেবার আছে।

–ডিগনিটি অফ লেবার আবার কী! এদেশে টাকা ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা যায় না। বলেই লোকে বাধ্য হয়ে যে-কোনো কাজ করে। লেখাপড়া শিখে কুলিগিরি কিংবা ঝি-চাকরগিরি করার মধ্যে কোনো ডিগনিটি অফ লেবার নেই!

–আমার এক দেওর অনেকদিন গ্যাস স্টেশনে অ্যাটেনডেন্ট-এর কাজ করেছে। এখন সে হোয়াইট কলার জব পেয়েছে। প্রথম কিছুদিন কষ্ট করতে হয়।

–এখানে লাথি ঝাঁটা খেয়েও দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হয়, যদি একদিন বড়লোক হওয়া যায় এই আশায়!

শান্তা বৌদি এবার এত জোর হেসে উঠলেন যে তাঁর হাতের চায়ের কাপ চলকে গেল, খানিকটা চা পড়লো শাড়িতে। তাড়াতাড়ি কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, পেপার ন্যাপকিন আছে?

অতীন দু’তিনখানা কাগজ এনে দিল। শান্তা বৌদি শাড়ি মুছতে মুছতেও হাসতে লাগলেন। অতীনের গা জ্বলতে লাগল। এরকম অকারণ হাসি মেয়েরাই শুধু হাসতে পারে।

অতীন এবার আর সরে গেল না। শান্তা বৌদি হাসি থামিয়ে একদৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। অতীন ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করছে, সে মহিলাকে সিডাকশান শুরু করার সুযোগ দিচ্ছে।

–আপনি নাকি সেদিন আমার বাড়ি থেকে ফেরার সময় চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছিলেন?

–এ কথা কে বলেছে আপনাকে?

–যে-ই বলুক, ঘটনাটা কি সত্যি?

–হ্যাঁ।

–কেন, ঐ রকম করেছিলেন কেন?

–আমার ইচ্ছে হয়েছিল।

–প্রথমে শুনে ভেবেছিলুম, আমি কিংবা আমার বাড়ির কেউ সেদিন আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার এত লজ্জা হয়েছিল।

শান্তা বৌদি একটা হাত তুললেন। অতীন ভাবলো, এইবার উনি তাকে ছোঁবেন, সান্ত্বনা দেবার ছলে সিডাকশনের প্রথম স্তর। ওর বুকের আঁচলটা খসে গেছে অর্ধেকটা, ইচ্ছে করেই করেছেন নিশ্চয়ই।

শান্তা বৌদি তাঁর ফস, নরম বাঁ হাতের তালুটা অতীনের মুখের কাছে এনে বললেন, এই দেখছেন, কত বড় একটা কাটা দাগ, একবার একজন আমাকে ছুরি মারতে এসেছিল, আর একটা দাগ আছে ঘাড়ে, সেটা চুলের তলায় ঢাকা পড়ে যায়।

হাতটা নামিয়ে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

কেন যে তিনি হঠাৎ এই কথাটা বললেন তা বোঝা গেল না। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আপনি আমাকে দু ডলার ধার দিন। সিদ্ধার্থের আসতে দেরি হবে মনে হচ্ছে, আমি ট্রেনে। করেই বাড়ি চলে যাই।

একটু অবাক হলেও অতীন ড্রয়ার থেকে বেশ কিছু খুচরো তুলে নিল। শান্তা বৌদি হাত পেতে সেগুলো নিলেন, তারপর বললেন, আপনি চা খাওয়ালেন, পয়সা দিলেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। সিদ্ধার্থ ফিরলে বলবেন একটা ফোন করতে। গাড়িটা থাক আজকে।

অতীন বললো, আপনি ইচ্ছে করলে আর একটু অপেক্ষা করতে পারেন। সিদ্ধার্থ জেনারেলি এই সময়েই ফেরে।

–নাঃ, আপনার নিশ্চয়ই অন্য কাজ আছে, আপনার সময় নষ্ট করবো না।

–আমি যদি আপনাকে আর কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি, মানে, আপনার একা ট্রেনে। যাওয়ার অভ্যেস আছে তো?

শান্তা বৌদি আবার হেসে বললেন, হ্যাঁ, অভ্যেস আছে। একসময় তো আমি চাকরিও। করেছি।

দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছন ফিরে তিনি বললেন, জীবনের যেমন অনেক খারাপ দিক আছে, তেমন ভালো দিকও আছে, তাই না? সব সময় খারাপ দিকগুলিই দেখা ঠিক না। কত সময় মানুষ কত সামান্য জিনিস পেলেই দারুণ খুশী হয়ে যায়!

–হঠাৎ আমাকে এই কথাটা বলছেন কেন?

–এমনিই মনে এলো। আমি মাঝে মাঝে এরকম উল্টোপাল্টা কথা বলি। এখানকার সবাই জানে, কেউ কিছু মনে করে না।

–এর আগে আপনি ছুরি মারার কথা বললেন। আপনি কি কোনো কারণে আমাকে ভয় পেয়েছিলেন?

–না, না, আপনাকে ভয় পাবো কেন? আপনাকে প্রথম দিন দেখেই আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল। তারও ঠিক আপনার মতনই রাগী রাগী স্বভাব আর বয়েসের তুলনায় ছেলেমানুষ। সে আবার কট্টর কমিউনিস্ট। এই দেশটাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। আমি এদেশে থাকি বলে আমাকেও সে অ্যামেরিকান মনে করে। তা হলে আজ চলি!

দরজায় চাবি ঘোরাবার শব্দ হলো, শান্তা বৌদিকে প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সিদ্ধার্থ। তারপরই সে চেঁচিয়ে উঠলো, কী ব্যাপার, শান্তা বৌদি, আবার নেমন্তন্ন নাকি? কবে, কবে?

শান্তা বৌদি বললেন, হ্যাঁ, এই শনিবার। এবারে তাড়াতাড়ি আসতে হবে কিন্তু, সেই যে তোমরা রাত দুপুর করে আসো, সেদিন গান বাজনা হবে, সামনের রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রোগ্রাম ঠিক হবে।

–টেলিফোনে না বলে আপনি নিজে এত দূর চলে এসেছেন?

–এ পাড়ায় এসেছিলুম, ভাবলুম নিজের মুখে বলেই যাই। তোমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করাও হলো।

–আপনি অতীনের সঙ্গে গল্প করলেন? ও গল্প করতে জানে? ও তো একটা টিপিক্যাল হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা, মুখে তার হাসি নাই দেখেছো? ও আপনার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি বা রাগারাগি করেনি তো?

–না, না, আমার সঙ্গে রাগারাগি করবেন কেন? উনি তো নিজের ওপরেই খুব রেগে আছেন মনে হলো! যাই হোক, আমাকে চা-টা খাইয়েছেন। সিদ্ধার্থ, আমি আজ চলি, শনিবার ঠিক এসো, তোমার বন্ধুর যদি খুব আপত্তি না থাকে তা হলে সঙ্গে নিয়ে এসো!

অতীন এবারে প্রকৃতই অবাক হয়ে গেছে। এই ভদ্রমহিলার চরিত্রটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ব্যাগ হারানোর কাহিনীটা তা হলে কি রসিকতা, সেই জন্যই হাসতে হাসতে বলছিলেন? কিন্তু ঐ ছুতোয় এসেও তিনি অন্য কিছু তো করলেন না!

সে বললো, আপনার তা হলে হ্যাঁন্ডব্যাগ হারায় নি?

সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁন্ডব্যাগ হারিয়েছে? কবে?

শান্তা বৌদি অতীনকে চোখ দিয়ে ধমকে বললেন, আপনি আমার কথা শুনে বুঝতে পারলেন।

যে ও কথাটা ওকে এখন বলতে চাইনি! বেচারি অফিস থেকে খেটেখুটে এসেছে, এখন আমি ওকে কোনো ট্রাবল দিতে চাই না। গাড়িটা কাল নিয়ে গেলেই হবে। যা যাবার তা তো গেছেই!

সিদ্ধার্থ বললো, হ্যাঁন্ডব্যাগ? গাড়ি? কী হয়েছে বলুন তো! বসুন, শান্তা বৌদি, এত হুড়োহুড়ি করছেন কেন?

সিদ্ধার্থ সব শুনে একগাল হেসে বললো, আপনি যে একদিন বলেছিলেন আপনার কিছু হারায় না! ইউ ক্যান অলওয়েজ টেক কেয়ার অফ ইয়োরসেলফ? এবার ঠ্যালা বুঝলেন তো? গ্রীনিচ ভিলেজে কবি, টুরিস্ট আর চোর সব সময় গিসগিস করছে। একদিন কী হয়েছে জানেন, একটা টুরিস্ট ফ্যামিলি, বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে সব মিলিয়ে চারজন, এখানকার রাস্তা দিয়ে ঘুরছে আর খচাখচ ছবি তুলছে। কিন্তু সবার ছবি তো একসঙ্গে উঠছে না, যে তুলছে, তারটা বাদ যাচ্ছে, সেইজন্য রাস্তার একজন লোককে ডেকে, ক্যামেরাটা তার হাতে দিয়ে বললো, ভাই, তুমি আমাদের একটা ছবি তুলে দেবে? সেই লোকটা ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে একটু পোজ মারলো, তারপর হঠাৎ এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। আর ধরাই গেল না তাকে। নেশাখোর, বুঝলেন না? ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়ে পন্ শপে বিক্রি করে গাঁজা কিনবে!

শান্তা বৌদি বললেন, বাবাঃ, আমি আর তোমাদের পাড়ায় কক্ষনো বাজার করতে আসছি। দরকার নেই আমার ফ্রেস ভেজিটেবলে!

সিদ্ধার্থ বললো, শান্ত হয়ে বসুন! নো প্রবলেম। এ পাড়ার পার্কিং লট দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে, আমি গাড়ি বার করে দেবো, কোনো চিন্তা নেই, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। অতীন ব্যাটা নিশ্চয়ই কিছু রান্না করে রাখেনি আমার জন্য, আপনার বাড়িতে গেলে ডাল-ভাত খাওয়াবেন নিশ্চয়ই। দেয়ার ইজ অ্যানাদার গ্রেট নিউজ টু ডে! সেলিব্রেট করতে হবে!

শান্তা বৌদি বললেন, তুমি গাড়ি কিনছো, তাই তো? আজই কিনে এনেছো নাকি? সিদ্ধার্থ হাসতে হাসতে বললো, গাড়ি কেনা তো সামান্য ব্যাপার। এদেশে গাড়ি কেনা আবার কোনো নিউজ নাকি? বেকাররাও গাড়ি কেনে! এই অতীন হারামজাদা, ফ্রিজে কয়েকটা বীয়ারের ক্যান ছিল না? বার কর, বার কর, সব শেষ করে দিসনি তো? আমাকে দে, শান্তা বৌদিকে দে।

শান্তা বৌদি বললেন, আমি এখন বীয়ার খেতে পারবো না! আমি বীয়ার ভালোও বাসি না, তুমি জানো।

সিদ্ধার্থ বললো, ভালো না বাসলেও আজ একটু খেতে হবে আমাদের সঙ্গে। আপনার ব্যাগ হারিয়েছে বটে, কিন্তু আপনি দারুন গুড লাক নিয়ে এসেছেন আজ এই অ্যাপার্টমেন্টে! আপনি এত ছটফট করছেন কেন, পাঁচুদা তো নেই শহরে। বাড়িতে কে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে?

সোফায় বসে পড়ে সিদ্ধার্থ সামনের লো টেবিলে পা তুলে দিল। তারপর গলার টাইয়ের গিট আলগা করতে করতে বললো, শান্তা বৌদি, আপনি কতক্ষণ আগে এসেছেন?

শান্তা বৌদি বললেন, তা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তোমার বন্ধু এর মধ্যে আমাকে চা করে খাইয়েছেন।

সিদ্ধার্থ বললো, এতক্ষণের মধ্যে ও আপনাকে একাধিকবার শোনায় নি যে ও কুলিগিরি করে? আই বেট! এই কথাটা ও সবাইকে গর্ব করে জানাতে ভালবাসে!

শান্তা বৌদি সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ইউ লুজ, সিদ্ধার্থ! না, উনি এ কথা আমাকে একবারের বেশী বলেন নি তো!

ফ্রিজ খুলে বীয়ার ক্যান বার করতে গিয়ে অতীন ওদের দু’জনের দিকে বক্র দৃষ্টিতে তাকালো। ওরা কৌতুক করছে তাকে নিয়ে। সে যেন একটা বোকাসোকা ভ্যাবা গঙ্গারাম। অথচ সে কোনো উপযুক্ত উত্তরও দিতে পারছে না।

সিদ্ধার্থ আবার মুরুব্বি চালে জিজ্ঞেস করলো, এই অতীন! লেজি বোন্স! তুই আজ সারাদিনে ঘর থেকে বার হসনি, তাই না?

অতীন সঙ্গে সঙ্গে বললো, হ্যাঁ, একবার বেরিয়েছিলুম।

সিদ্ধার্থ শান্তা বৌদির দিকে তাকিয়ে বললো, সেলফ পিটি মানুষের কতখানি ক্ষতি করে দেখলেন তো? এ ছেলেটা আগে ভাল ছিল, এখন অনবরত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে ভুগতে মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে।

তারপর মুখ ফিরিয়ে বললো, শালা, তুই নীচে গেলে একবার লেটার বক্সও দেখতি না? আমাকে ভোগা দিচ্ছিস?

পকেট থেকে সে দুটি চিঠি বার করলো। একটি লম্বা, সাদা লেফাফা, অন্যটি ভারতীয় খাম। সেই দুখানা চিঠি সে বাঁ হাতে তুলে ধরে নাটকীয় ভাবে বললো, র‍্যাগ টু রিচেস! র‍্যাগ টু রিচেস! দা গ্রেট আমেরিকান মিথ! যে অতীন মজুমদার গতকাল পর্যন্ত ছিল সুপার মার্কেটের কুলি, আজ থেকে সে রেসপেকটেবল স্কলার! অ্যাই অতীন, এই দুটো চিঠিই তোর। তার মধ্যে এই একটা আমি খুলে ফেলেছি, কিউরিয়সিটি দমন করতে পারিনি ভাই! তুই বস্টন ইউনিভার্সিটির কাজটা পেয়ে গেছিস! পোস্ট ডক্টরেট করবি, প্লাস অ্যাসিস্টান্টশীপ, মাসে সাড়ে ছ’শো ডলার করে পাবি!

অতীনের দু’ হাতে বীয়ারের টিন, সে মর্মরমূর্তির মতন স্থির হয়ে গেল। সে জানে, সিদ্ধার্থ এরকম একটা গুরুতর ব্যাপার নিয়ে ইয়ার্কি করবে না। তবু, এ কী সত্যি হতে পারে? সেমেস্টারের শুরুতে সে চিঠি পায়নি, অথচ এখন, ও, এবার তো সামার কোর্স শুরু হবে!

সিদ্ধার্থ বললো, আমার কাছে তোর তিন শো নব্বই ডলার ধার, সব কিন্তু কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে দিতে হবে ভাই! তোর ঋণ জীবনে শোধ করতে পারবো না, এই ধরনের ফালতু কথাবার্তা আমি শুনতে চাই না। মানি ইজ মানি!

অতীনের ইচ্ছে করলো, দৌড়ে গিয়ে সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ধরতে। তিন শো নব্বই ডলার তো অতি সামান্য, তার চেয়ে অনেক বেশী টাকা সিদ্ধার্থ খরচ করেছে তার জন্য। সিদ্ধার্থর এইটাই। একটা বড় গুণ, সে সব কথাই হাল্কা সুরে বলে। সিদ্ধার্থর সঙ্গে এতদিন থেকেও অতীন তা শিখতে পারলো না।

অতীন মনে মনে ছুটে যাবার কথা ভাবলেও সে দাঁড়িয়ে রইলো একই জায়গায়। তার পা দুটো যেন পেরেক পুঁতে আটকে দিয়েছে। সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সে বস্টনে যাবার সুযোগ পেয়েছে? সাড়ে ছ’শো ডলার দেবে? অনেক টাকা! এই শান্তা বৌদি

আজ সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন।

সিদ্ধার্থ শান্তা বৌদিকে বললো, কীরকম লাকি ডগ জানেন? রোজ রাত্তিরে বস্টনে শর্মিলা বলে একটা মেয়েকে ফোন করে অতীন। লং ডিসটেন্স কল করতে করতে আমাকে ফতুর করে দিল, বুঝলেন, শান্তা বৌদি! পুরোনো বন্ধু, মুখে কিছু বলতেও পারি না। তা ছাড়া প্রেমের ব্যাপার। এখন দেখুন, কাজ পেল সেই বস্টনেই। আর টেলিফোন খরচ করার ঝামেলা রইলো না। প্রেমিকার সঙ্গে দু বেলাই দেখা হবে!

শান্তা বৌদি বললেন, বাঃ, খুব ভালো কথা তো। এবার আশা করি ওর রাগ কমে যাবে। শর্মিলা, মানে কোন শর্মিলা? যে খুব ভালো গান করে?

সিদ্ধার্থ হাতটা লম্বা করে বললো, এই নে চিঠি দুটো। সেকেন্ডটা আমি খুলিনি, আমি কক্ষনো পার্সোনাল চিঠি পড়ি না।

অতীন হাত বাড়িয়ে চিঠি দুটো নিল। তবে, যে-চাকরির ওপর তার ভবিষ্যৎ জীবন, নিরাপত্তা, তার আত্মীয়বন্ধুদের খুশী হবার ব্যাপার আছে, সেই দরকারি চিঠিটা দেখবার আগে সে দেশের চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখলো। দেশ থেকে খুব কমই চিঠি আসে। তবু এক একখানা এলেই অতীন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, চিঠিখানা ছুঁয়েই সে যেন দেশের মাটির স্পর্শ পায়।

দ্বিতীয় চিঠিখানা খুলতেও হলো না। ঠিকানার হাতের লেখা দেখেই অতীন বুঝতে পারলো, সেটা অলির চিঠি! অতীনের সবঙ্গের রোম সতর্ক হয়ে উঠলো। অনেকদিন অলির সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ নেই। কিন্তু প্রতিদিনই সে অলির সঙ্গে কথা বলেছে মনে মনে। অতীনের। চিঠি না পেয়ে অলিও বোধ হয় অভিমান করে চিঠি দেয়নি। আজই অলির চিঠি এলো!

1 Comment
Collapse Comments

Please Upload Kalbela Trilogy By Samaresh Majumder……..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *