বারো
হস্টেলে কেমন একটা থমথমে ভাব। এমনিতেই খুব হইহল্লা না-হলেও যে স্বাভাবিক চেহারাটা থাকে সেটা নেই। সবাই গুজগুজ করছে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, যেন মারাত্মক কিছু হয়ে গেছে। ওকে দেখতে পেয়ে গোবিন্দ এগিয়ে এল, ‘আজকে এখানে একটা কেস হয়েছে।’
‘কেস, কী কেস?’ অনিমেষ তাকাল।
‘অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরে মহিলা এসেছেন।’
‘আচ্ছা!’ অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘কখন?’
‘সেই সন্ধেবেলায়, স্টিল চালিয়ে যাচ্ছে।’ উষ্মা গোবিন্দর গলায়।
‘তাতে কী হয়েছে?’ অনিমেষের মজা লাগছিল।
‘কী হয়েছে মানে? এ হস্টেলের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনে স্পষ্ট লেখা আছে কারও ঘরে মেয়েদের আসা চলবে না, সে মা কিংবা বোন যাই হোক না কেন। আমাদের প্রত্যেকের বেলায় নিয়মটা কড়াকড়ি করে রাখা হয়েছে। এ এস ব্যাচেলার, ওঁর ক্ষেত্রে তা শিথিল হবে কেন?’
কথাটা ঠিক। এ নিয়ে কিছুদিন আগে থম্বোটোর বন্ধুর সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল। ছেলেটা ব্যবস্থাটাকে গালাগালি দিচ্ছিল। নিয়ম যা তা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রত্যেক ব্যবস্থার সাদা কালো দুটো দিকই আছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও লোকে মেনে নেয় যখন দেখে সবাই একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে এ এস নিয়ম ভেঙে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছেন। তবু কে বলতে চাইল, ‘যিনি এসেছেন তিনি ওঁর মা বা বোন নয় তো?’
গোবিন্দর সঙ্গে ততক্ষণে আরও অনেকেই জুটে গেছে। এতক্ষণ ধরে ব্যাপারটা নিয়ে ওরা জটলা করছিল, ফুঁসছিল, কিন্তু কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন অনিমেষকে দেখতে পেয়ে অনেকেরই দেখা বা শোনা দৃশ্যটার কথা মনে পড়ল। ইউনিভার্সিটির জি এস-এর সঙ্গে অনিমেষের যোগাযোগ এবং পুলিশের গুলিতে একদা আহত হওয়ার গল্প। গোবিন্দ বলল, ‘তুমি খেপেছ! সেরকম হলে আমরা কিছু বলতাম না। শ্রীলা এসেছে।’
‘সে আবার কে?’
‘স্কটিশের মক্ষীরানি। ফোর্থ ইয়ারের পাশ ক্যান্ডিডেট। দারুণ অভিনয় করে।’
ব্যাপারটা ভাল লাগল না অনিমেষের। কিন্তু এদের এতখানি উত্তেজনার তেমন কী কারণ আছে বোধগম্য হচ্ছিল না। ও শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘সুপারকে ব্যাপারটা জানাও, জানিয়েছ?’
‘সুপার নেই। তা ছাড়া সুপার কি আর এ এস-এর এগেনস্টে স্টেপ নেবে। ওরা সব এক জাতের লোক।’ ভিড়ের মধ্যে একটা গলা চেঁচিয়ে উঠল।
অনিমেষ বলল, ‘বেশ, তোমরা কী করতে চাও?’
‘মেয়েটাকে এখান থেকে বেরুতে দেব না।’ একজন বেশ দৃঢ় গলায় জানাল।
‘সেটা অন্যায় হবে, সুপারের কাছে একটা রিট্ন কমপ্লেন করলে হয় না? সবাই সই করব।’ আর-একটা গলা মিনমিন করল।
‘ছিঁড়ে ফেলবে, কোনও কাজ হবে না। শালা প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা মারছে আমাদের কলা দেখিয়ে— ও করবে সুবিচার!’
‘মাইরি, মার্বেল প্যালেসে ভিখিরিদের এর চেয়ে ভাল খাবার দেয়। ডাল না তো, আমাশার পায়খানা! মাছগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে আনে।’
অনিমেষ হাত তুলে সবাইকে থামাল। গোলমালটা বাড়তে শুরু করলে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার ঠিক নেই। সে বলল, ‘ব্যাপারটা যদি আমার ওপর ছেড়ে দাও তা হলে আমি চেষ্টা করতে পারি। আমি প্রথমে এ এস-এর সঙ্গে কথা বলব। তোমরা কি আমার সঙ্গে যাবে?’
দেখা গেল সবাই একসঙ্গে যেতে চাইছে। এত লোক গেলে কথা বলা যাবে না। গোবিন্দ আর একটি অবাঙালি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অনিমেষ কথা বলতে যাবে ঠিক করল, বাকি সবাই সিঁড়িতে অপেক্ষা করবে। ত্রিদিবকে এই ক্ষুব্ধদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল না সে। হয়তো হস্টেলেই নেই, কিংবা সে এইসব বারোয়ারি ঝামেলা পছন্দ করে না। হস্টেলের সবাই ভিড় করে এসেছে, কিন্তু থম্বোটোর বন্ধু বা থম্বোটো আসেনি, যদিও অবাঙালি ছাত্রদের সংখ্যা কম নয়। এবারে থম্বোটোর বন্ধুর অভিযোগ সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত ছিল।
দোতলায় উঠতেই অনিমেষ থম্বোটোকে দেখতে পেল। রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনিমেষ হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যালো, হোয়ার ইজ ইয়োর ফ্রেন্ড?’
উত্তরে দু’কাঁধ নাচিয়ে ঘাড় নেড়ে জানাল থম্বোটো, সে জানে না।
অনিমেষ একবার ভাবল থম্বোটোর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবে কি না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত পালটাল। সেটা হয়তো থম্বোটো বিদেশি বলে কিংবা ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়, তাই।
অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরটা একদম কোনার দিকে। বড় ঘর, সঙ্গে বাথরুম আছে। এই কোনা থেকে তাকালে হস্টেলের অর্ধেকটা দেখা যায়। সুপারিনটেনডেন্ট থাকেন ঠিক বিপরীত দিকের দোতলায়। তাঁর জানলা থেকে হস্টেলের বাকি অংশটা চোখে পড়ে। ব্যবস্থাটা এইভাবে করা যাতে দু’জনের চোখের ওপর ছেলেরা থাকে। এখন অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরের একটা দরজা ভেজানো, পরদার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে বাইরে।
অনিমেষরা দরজার বাইরে এসে দাঁড়াতেই গোবিন্দ বলল, ‘চলো, আচমকা ঢুকে হাতে হাতে ধরে ফেলি।’
অবাক হয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ধরবে? মেয়েটি তো আছেই!’
ঘাড় নাড়ল অবুঝ ভঙ্গিতে গোবিন্দ, ‘আরে, সে তো আছে। আমি মাল কট করার কথা বলছি। উলটাপালটা অবস্থায় থাকলে সবাইকে ডেকে আনব।’
হঠাৎ অনিমেষের মনে হল ব্যাপারটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এরা এই ঘটনাতে এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে অথচ অনিমেষের মনে তার আঁচ একটুও লাগছে না। সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না। আমরা ভদ্রভাবে বলব এবং তোমরা যদি অন্য কিছু করতে চাও তা হলে আমি নেই।’
গোবিন্দ হতাশ ভঙ্গিতে একবার ওর দিকে আর একবার নীচে অপেক্ষায় থাকা ছেলেদের দেখে কোনওরকমে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
অনিমেষ ভেজানো দরজায় কড়া নাড়ল একবার। ওরা এতক্ষণ কথা বলছিল প্রায় ফিসফিসিয়ে কিন্তু ঘরের ভেতর থেকেও তো কোনও শব্দ বাইরে আসছিল না! দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তেই এ এস-এর গলা শোনা গেল, ‘আয়’।
খুব স্বাভাবিক এবং একটুও নার্ভাসনেস গলায় নেই। ওরা অবাক হল। অনিমেষের মনে হল ভদ্রলোক বোধহয় বুঝতে পারেননি যে ওরা এসেছে।
দরজাটা ঠেলে অনিমেষ প্রথমে ভেতরে ঢুকল। জানলার ধারে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এ এস কিছু লিখছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলো ওঁর মুখ, শরীর এবং ঘরে একটা কোণে ছড়িয়ে আছে। ঘরে এক পাশে বইয়ের আলমারি, আলনা আর স্প্রিং-এর খাট। অনিমেষ দেখল একটি মেয়ে সেই খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। শোয়ার ভঙ্গিতে বোঝা যায় যে সে গভীর ঘুমে মগ্ন। এরকম দৃশ্য দেখতে পাবে বলে সামান্য প্রস্তুত ছিল না গোবিন্দরা, স্বভাবতই হকচকিয়ে গেল।
এ এস লিখতে লিখতেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাই?’
‘আপনার সঙ্গে কথা আছে।’ অনিমেষ শান্তস্বরে বলল।
চমকে মুখ ঘোরালেন এ এস। মাঝবয়সি ভদ্রলোক এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন খানিকক্ষণ মুখ থেকে কথা সরছিল না। হয়তো ভেবেছিলেন ঠাকুর চাকর কেউ এসেছে। তাই খেয়াল করেননি। এখন ওদের দেখে চট করে বিছানায় নজর বুলিয়ে নিলেন। সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ঘুমোলে মানুষ শিশু হয়ে যায়।
‘কথা? কীসের কথা?’ চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে নিলেন ভদ্রলোক।
‘আপনি একটু বাইরে আসুন।’ অনিমেষ একটুও উত্তেজিত হচ্ছিল না।
‘বাইরে যাব কেন? হোয়ট ডু উই মিন?’
‘আমরা যে বিষয়ে কথা বলতে এসেছি সেটা ওঁর সামনে শুনতে হয়তো আপনার ভাল লাগবে না।’ কথাটা শেষ করে চোখের ইঙ্গিতে বিছানাটাকে দেখাল অনিমেষ।
এ এস এবার সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বলতে চাইছ?’
‘আপনার সম্পর্কে আমাদের অভিযোগ আছে।’
‘আমার সম্পর্কে? হাউ ফানি! কী ব্যাপার?’
‘আপনি কি এখানেই শুনতে চান?’
‘ও, ইয়েস!’
‘আপনি হস্টেলের আইন ভাঙছেন। এবং সেটা হস্টেলের ছেলেরা ভালভাবে নিতে পারছে না। আইন সবার ওপর সমান প্রযোজ্য।’
কথাটা বলার সময় লক্ষ করল অনিমেষ মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ খুলে শুনছে কথাগুলো। যদিও এখনও উপুড় হয়ে রয়েছে তবু মুখ বালিশের ওপর পাশ ফিরে রাখার ফলে চোখের পাতার নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে সে।
‘বুঝতে পারছি না কী বলতে চাইছ!’
‘ভিজিটারদের জন্যে একটা ঘর বাইরে আছে। আপনি সেটা না-ব্যবহার করে একজন মহিলাকে ঘরে নিয়ে এসেছেন। এটা অন্য ছেলে করলে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হত।’
‘অফ কোর্স! কিন্তু সে নিয়মটা আমাকে মানতে হবে কে বলল?’
‘কারণ আপনি এই হস্টেলে থাকেন।’
‘দেখো ছোকরা এতক্ষণ অনেক বাড়াবাড়ি করেছ, কিন্তু আমি আর অ্যালাউ করব না। তুমি ভুলে যেয়ো না আমি অ্যাসিস্টেন্ট সুপারিনটেনডেন্ট এবং তার জন্য ফ্রি কোয়ার্টার পাচ্ছি, ফুড পাচ্ছি। বাট ইউ আর টু পে ফর অল। তোমরা ছাত্র আর আমি কলেজে পড়াই। কোন সাহসে তোমাদের সঙ্গে আমার কমপেয়ার করছ আমি বুঝতে পারছি না।’ ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
‘ঠিকই, আপনি সবই ঠিক বললেন, শুধু আইনটা সবার জন্যই এটা ভুলে গেলেন। আপনি ঘরে মহিলাকে আসতে দিলে সেটা অন্যদের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। অনেকেই তাই চাইবে, যেহেতু আপনার আদর্শ সামনে আছে। তা ছাড়া হস্টেলের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনে কোথাও বলা নেই যে ছাত্রদের একরকম চলতে হবে আর অবিবাহিত এ এস-এর সাত খুন মাফ। এটা কি ঠিক বললেন?’
‘পরের ব্যাপারে নাক গলানো বাঙালির নোংরা অভ্যেস।’ একটুও না-নড়ে মহিলাটি কথা বললেন। অনিমেষ দেখল মহিলা কথাটা বলার পর আবার চোখ বন্ধ করলেন।
এ এস বললেন, ‘গেট আউট ফ্রম হিয়ার! আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’
অনিমেষের পেটের ভেতরে হঠাৎ একটা যন্ত্রণা জন্ম নিল। সে তবু স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘কথা আপনাকে বলতে হবে।’
‘মানে?’
‘আমরা যা চাইছি তাই শুনতে হবে।’
‘তুমি আমাকে হুকুম করছ? হাউ ফানি!’
‘হ্যাঁ। কারণ আইন আপনি ভেঙেছেন।’
‘তা কী করতে হবে আমাকে?’
‘ওই মহিলাকে এখনই বাইরে পৌঁছে দিয়ে এসে ছেলেদের কাছে ক্ষমা চান। কারণ ওরা খুব উত্তেজিত।’
‘হো-য়া-ট!’ ভদ্রলোকের চোয়াল যেন ঝুলে গেল।
এইসময় মেয়েটি তড়াক করে খাটের ওপর উঠে বসল। ওঠার সময় কাপড়ে টান পড়ায় ওর শরীরের কিছু কিছু জায়গা উন্মুক্ত হয়ে গেলেও সে একটু অপ্রস্তুত না-হয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঠিকঠাক করে নিল। অনিমেষ দেখল মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। এমন একটা সৌন্দর্য যার ধার আছে কিন্তু আধার নেই। একে কোনওদিন অনিমেষ দেখেনি। হয়তো ও কলেজ ছাড়ার পর ভরতি হয়েছে। মেয়েটি বলল, ‘হু ইজ হি?’
‘আমার নাম অনিমেষ মিত্র, এই হস্টেলের একজন বোর্ডার। শুনুন, আমার অনুরোধ আপনি এখনই এখান থেকে চলে যান। যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে এবং ছেলেরা উত্তেজিত।’
এ এস উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি— তুমি আমার সামনে ওকে অপমান করছ? আই উইল টিচ ইউ, তোমাকে আমি হস্টেল থেকে তাড়াব। ভীষণ বাড় বেড়ে গেছে তোমাদের। গেট আউট, গেট আউট ফ্রম মাই রুম!’
এতক্ষণে যন্ত্রণাটা সারা শরীরে ছড়াল। অনিমেষ প্রথমে ঠাওর করতে পারছিল না সে কী করবে। কিন্তু এত উত্তেজনার মধ্যে সে সূক্ষ্মভাবে একটা চিন্তা করতে পারছিল যে হুট করে কিছু করে ফেলা ঠিক হবে না। সে গোবিন্দদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উনি যখন ভাল কথায় শুনবেন না তখন আমাদের বাধ্য হতে হচ্ছে ওঁকে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে। চলো।’
কথাটা শোনামাত্র মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেয়ে উঠল। যেন একরাশ বিদ্রূপের নোংরা জল ওদের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে আনন্দ পেল সে।
বারান্দায় বেরিয়ে এসে অনিমেষ দেখল সিঁড়ির মুখটায় ভিড় মৌমাছির চাকের মতো জমে আছে। সঙ্গীদের নিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে যেতে ছেলেরা চুপ করল। সবাই বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে। অনিমেষ বলল, ‘এ এস কোনও কথা শুনতে চাইছেন না। বলছেন আইন নাকি ওঁর ওপর প্রযোজ্য নয়। আমাকে ভয় দেখিয়েছেন হস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেবেন বলে। রেগে গিয়ে যা-তা কথা বললেন।’
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হল যেন, ছেলেরা চিৎকার করে গালাগাল শুরু করে দিল এ এস-এর নাম ধরে। এই গালাগালগুলো হজম করা অনিমেষের পক্ষেও খুব শক্ত ব্যাপার, কারণ সবগুলোই আদিরসাত্মক ও মেয়েটিকে জড়িয়ে ইতর ভাষায় বলা। কেউ কেউ চাইছিল লোকটাকে বাইরে বের করে একটু শিক্ষা দিতে। কিন্তু অনিমেষ বাধা দিল। সবাইকে চুপ করাতে সে হাত তুলে অনুরোধ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত গলাগুলো নেমে এলে সে প্রস্তাব দিল, ‘খামোকা এমন কিছু আমরা করব না যাতে এ এস সুবিধে পেয়ে যান। আমাদের অভিযোগ হল: আইন সবার জন্যে এবং এ এস সেটা মানছেন না। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ কেউ মাথা গরম কোরো না। এ এস-কে বাইরে যেতে হলে এই বারান্দা দিয়েই যেতে হবে। আমরা সবাই এখানে বসে থাকব। আমাদের মাড়িয়ে তো তিনি যেতে পারছেন না! যতক্ষণ না ভদ্রলোক তাঁর সবরকম আচরণের জন্য ক্ষমা না-চাইছেন ততক্ষণ তাঁকে যেতে দেব না। কী, রাজি?’
ঢেউয়ের মতো শব্দটা গড়িয়ে এল, সবাই রাজি।
গোবিন্দ প্রশ্ন তুলল, ‘কিন্তু ওই মেয়েটা? ও যেতে চাইলে কী হবে?’
অনিমেষ হেসে ফেলল প্রশ্নটা বলার ধরনে, ‘না, ওঁকেও যেতে দেওয়া হবে না। কারণ আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম চলে যেতে, তিনি বিদ্রূপ করেছেন।’
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, ‘ওকে আপনি বলে সম্মান দিয়ো না, অনিমেষদা। কলেজে কত ছেলের বারোটা বাজিয়েছে তা জানো না।’
আর-একজন বলল, ‘তোর বাজায়নি তো?’
‘প্রায় বাজিয়ে দিয়েছিল। তিনমাস ধরে আমার পয়সায় খেয়ে শেষে বলে কিনা তোমরা ছেলেরা সব এক রকম। একটু প্রশ্রয় দিলেই নিজেকে জমিদার ভাবতে শুরু করো।’
কথাটা শেষ হলেই সবাই হইহই করে উঠল।
মুহূর্তের মধ্যে বারান্দাটা ভরতি হয়ে গেল। সবাই যেন ফুর্তির সঙ্গে গুলতানি শুরু করে দিল। এখন কারও পক্ষে ওদের ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে কে একজন গিয়ে থম্বোটোকে ধরে নিয়ে এল ওখানে। সকলের অনুরোধে সে রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মাউথ অর্গানে ঠোঁট রাখল। একটা ঝমঝমে সুর ক্রমশ হস্টেলটায় ছড়িয়ে পড়ল। সুরটার মধ্যে এমন একটা মাদকতা আছে যে ছেলেরা একসময় হাততালি দেওয়া শুরু করল তালে তালে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাটিতে বসে অনিমেষ এই সুরের মধ্যে থেকেও অন্য কথা ভাবছিল। পেটের যন্ত্রণাটা এখন থিতিয়ে এলেও সমস্ত শরীর অবসন্ন করে দিয়েছে। এটা কেন হয় জানা নেই, কিন্তু উত্তেজিত হলেই যদি এইরকম শারীরিক অবস্থা হয়— তা হলে?
হঠাৎই সব বাজনা কথাবার্তা আচমকা থেমে গেল। এ এস ঘরের বাইরে এসেছেন। সবাই এখন ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে। এতগুলো ছেলেকে একসঙ্গে যাতায়াতের পথের ওপর বসে থাকতে দেখে এ এস যে চিন্তিত তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। ভদ্রলোক দু’ পা এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ব্যাপারটা তোমরা ঠিক করছ না। তোমাদের এজন্যে শাস্তি পেতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কেউ একজন সিটি দিয়ে উঠল, শেয়ালের ডাক ডেকে উঠল কেউ কেউ।
এ এস চিৎকার করে উঠলেন, ‘স্টপ ইট, সরে যাও এখান থেকে! রাত দশটা বাজে, যে যার নিজের ঘরে ফিরে যাও ইমিডিয়েটলি।’
‘রাসলীলা শেষ হয়ে গেল নাকি?’ একটা গলা ভেসে এল।
‘রাসলীলা? কে বলল কথাটা? ছাত্রী অধ্যাপকের কাছে পড়তে এলে তোমরা এইরকম ব্যবহার করবে, ছি ছি!’
সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো গলা ছি-ছি-ছি-ছি’র ধুয়ো তুলল।
এ এস এবার অনিমেষের দিকে তাকালেন, ‘তুমি তো এদের নেতা, এদের এখান থেকে সরে যেতে বলো।’
অনিমেষ বসে বসেই মাথা নাড়ল, ‘তা হয় না, স্যার। প্রথমে আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
এবার মেয়েটিকে দেখা গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে সে যেভাবে হেঁটে আসছে তাতেই বোঝা যায় যে বেচারার মনের জোর কমে এসেছে। সোজাসুজি অনিমেষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে এবার যেতে দিন।’
গলার স্বরে এমন একটা কাকুতি ছিল যে অনিমেষ মেয়েটির মুখের দিকে না-তাকিয়ে পারল না। মেয়েরা কী দ্রুত নিজেদের মুখ পালটে ফেলতে পারে। সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আপনি ওঁকে ক্ষমা চাইতে বলুন।’
এ এস বললেন, ‘আঃ, তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলছ কেন?’
মেয়েটি হাত নেড়ে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলুন, আমার কী দোষ? আমি তো স্যারের কাছে পড়তে এসেছিলাম। হস্টেলের নিয়মকানুন আমার জানার কথা নয়। যদি উনি অন্যায় করে থাকেন তবে তার দায় আমাকে বইতে হবে?’
‘নেকু রে নেকু— খাও ঢুকু ঢুকু।’ ছড়া কেটে বলল কেউ।
এ এস বললেন, ‘চলে এসো, এই স্কাউনড্রেলগুলো—।’
মেয়েটি ফুঁসে উঠল, ‘আঃ, চুপ করুন। অনেক বীরত্ব দেখিয়েছেন। ওরা ইচ্ছে করলে আপনাকে ছুড়ে নীচে ফেলে দিতে পারে তা জানেন? শুনুন, আপনি মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন, একটা মেয়ের পক্ষে এভাবে আটকে থাকা সম্ভব? আমি বাড়িতে কী কৈফিয়ত দেব?’ মেয়েটি আবার অনিমেষের শরণাপন্ন হল।
‘নেকু রে নেকু— খাও ঢুকু ঢুকু!’ ছড়া উঠল।
অনিমেষ এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘একটু আগের আপনি আর এই আপনি কি এক? যদি তা না-হন তা হলে ওঁকে বলুন ক্ষমা চাইতে।’
‘বেশ, আমি ওঁর হয়ে ক্ষমা চাইছি!’ মেয়েটি বুকে হাত দিল।
‘ওরে কে কার হচ্ছে দেখ।’ টিপ্পনী কাটল কেউ।
‘কিন্তু আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে!’ মেয়েটি প্রায় কেঁদে ফেলল।
‘বাঃ, একটু আগে তো দেখলাম বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছিলেন। পড়তে এসে কেউ বুঝি ঘুমোয়?’ গোবিন্দ কথা বলল।
এমন সময় নীচ থেকে কেউ চিৎকার করে জানাল, ‘সুপার এসেছে।’
কথাটা শুনে অনিমেষ ছেলেদের দিকে ঘুরে বলল, ‘তোমরা কেউ এখান থেকে নড়বে না। আমি ওঁকে ডাকছি।’
ভিড় বাঁচিয়ে রেলিং-এর ধারে গিয়ে অনিমেষ নীচে তাকাল। বাস্কেট বলের মাঠের মাঝখানে সুপার দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো মানুষটিকে আরও বেঁটে দেখাচ্ছে ওপর থেকে। অনিমেষ চিৎকার করল, ‘স্যার, আপনি একটু ওপরে আসুন।’
ভদ্রলোক ওপরে আসবার সময় যেটুকু সময় পেয়েছিলেন তাতেই জেনে গিয়েছিলেন কী ঘটনা ঘটেছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে দাঁড়াতেই অনিমেষ তাঁর সামনে দাঁড়াল, ‘স্যার, হস্টেলের আইন ভেঙেছেন বলে আমরা এ এস-কে বলতে গিয়েছিলাম, তাতে উনি খামকা অপমান করেন। তাই ছেলেরা ওঁকে ঘেরাও করেছে যতক্ষণ না উনি ক্ষমা চান!’
‘কী আইন?’ ভদ্রলোকের গলা খুবই সরু।
‘মেয়েদের নিয়ে ঘরে যাওয়াটা গুরুতর অপরাধ।’ অনিমেষ জানাল।
‘ওসব আইন আমাকেও মানতে হবে?’ এ এস-এর গলা ভেসে এল।
সুপার বললেন, ‘এরকম ঘটনা এই হস্টেলে প্রথম হল। যা হোক, কী চাইছ তোমরা?’
অনিমেষ বলল, ‘ওঁকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
সুপার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাতেই তোমরা খুশি হবে?’
‘আর এরকম ঘটনা যাতে আর না-ঘটে তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এখানে অনেক ছেলে আছে যারা এর সুযোগ নিতে চাইবে।’
‘আ-চ্ছা! আপনি অ্যাপলজি চেয়ে ব্যাপারটা শেষ করুন।’ সুপার ছেলেদের মাথা ডিঙিয়ে তাঁর অ্যাসিস্টেন্টের উদ্দেশে বললেন।
‘স্ট্রেঞ্জ! আপনি এ-কথা বলছেন?’ সুপারের দিকে বিস্ময়ে প্রশ্নটা ছুড়লেন এ এস।
এবার মেয়েটি বলে উঠল, ‘ঠিকই তো! অন্যায় করলে দোষ স্বীকার করতে লজ্জা নেই কিছু।’
‘ইউ স্টপ!’ চেঁচিয়ে উঠলেন এ এস, ‘আপনি কি এই ছেলেদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলছেন আমাকে?’
‘হ্যাঁ। একজন মেয়ে এখানে সারারাত আটকে থাকলে সম্মান বাড়বে না।’ সুপার কথাটা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। তাঁর কোয়ার্টারে যাওয়ার রাস্তা এদিক দিয়ে নেই।
এবার সবাই এ এস-এর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ভদ্রলোক দুটো হাত শূন্যে নাচালেন, তারপর বললেন, ‘ওয়েল, যদি এটা অন্যায় হয় আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।’
সঙ্গে সঙ্গে একটু খুশির শব্দ বোমার মতো ফাটল। অনিমেষ বলল, ‘তা হলে আইন সবার জন্য, মানছেন?’
ভদ্রলোক এবারে ঘাড় নেড়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। উৎফুল্ল ছেলেরা নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটাকে দেখার জন্য।
মেয়েটি এবার অনিমেষকে বলল, ‘একটু কষ্ট করবেন?’
‘বলুন!’
‘বুঝতেই পারছেন এখন আমি সবার চোখে কীরকম ছোট হয়ে গেছি। একা একা নীচে নামতে ভয় করছে। আপনি একটু এগিয়ে দেবেন?’ সত্যি সত্যি ভয় পাবার মতো মুখ করল মেয়েটি।
অনিমেষের মাথায় চট করে একটা মতলব খেলে গেল। সে নিরীহ মুখ করে বলল, ‘এতটা ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না, তবু আপনি যখন বলছেন তখন আমি একজনকে সঙ্গে দিচ্ছি।’
ছেলেরা সবাই সরে গেলেও ছোটখাটো জটলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অনেকেই দূর থেকে মেয়েটিকে লক্ষ করে বেশ মজা পাচ্ছে। অনিমেষ সেই ছেলেটিকে খুঁজছিল যে মেয়েটিকে আপনি বলে সম্মান দিতে নিষেধ করেছে এবং বারোটা বাজানোর কথা বলেছিল। ছেলেটির সঙ্গে ওর তেমন আলাপ নেই কিন্তু মুখ চেনে। চট করে তাকে খুঁজে না-পেয়ে অনিমেষ গোবিন্দকে মৃদু স্বরে ছেলেটিকে ডেকে আনতে বলে সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোথায় থাকেন?’
দ্রুত একটা হাসির আলতো ঢেউ উঠল মেয়েটির ঠোঁটে, বলল, ‘কেন বলুন তো?’
‘এত রাতে যেতে অসুবিধে হবে কিনা জানতে চাইছি।’
‘তাই বলে আমি সারারাত এখানে থাকতে পারি না।’
অনিমেষ মনে মনে বলল, এতক্ষণ তো ছিলেন! সামনাসামনি ঘাড় নাড়ল, ‘তা নিশ্চয়ই নয়। বেশি দূর হলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম।’
‘আপনি যাবেন?’
‘না, আমি খুব ক্লান্ত!’
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকাল। মেয়েটির রূপে যে ধারালো চমক আছে সেটা এত প্রখর যে, কোনও স্নিগ্ধতা সেখানে ছায়া ফেলে না। এই তাকানোর ভঙ্গি তাই শুধু কটাক্ষই হয়ে রইল। হাসল মেয়েটি, ‘এত সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন আপনি! না, আমি একাই যেতে পারব।’
ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না অনিমেষ, ‘অবশ্য আপনি যাঁর কাছে এসেছিলেন তাঁরই উচিত ছিল আপনাকে পৌঁছে দেওয়া।’
‘উচিত? ছেলেরা যখন দেখে বদনামের নোংরা গায়ে লাগবে না তখন তারা আকাশ ছুঁতে পারে, একটু সেরকম অবস্থায় পড়লে গুটিয়ে কেন্নো হয়ে যায়। আমি ঋণ শোধ করতে এসেছিলাম, অনেক হয়েছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক সে সময় গোবিন্দ ছেলেটিকে নিয়ে ফিরে এল।
অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে বলল, ‘শোনো ভাই, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। উনি তো তোমাদের ক্লাস-মেট, তুমি তাই ওঁকে একটু বাসস্টপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসো। রাত হয়েছে, ওঁর একা যাওয়া ঠিক নয়।’
এরকম প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না ছেলেটি, বলল, ‘কিন্তু হস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে, এখন যাওয়া অসম্ভব।’
অনিমেষ হাসল, ‘আমি সুপারের পারমিশন নিয়ে নেব। স্পেশাল কেস হিসেবে যেতে পারো। তোমরা একসঙ্গে পড়ো, তাই বলছি।’
ছেলেটি খুব বিব্রত বোধ করছে দেখে অনিমেষের মজা লাগছিল। সে বলল, ‘মেয়েদের সম্মান রাখা আমাদের কর্তব্য। যান, আপনি ওর সঙ্গে চলে যান।’
‘ধন্যবাদ।’ মেয়েটি কথাটা বলেই দ্রুত নামতে শুরু করল। একান্ত অনিচ্ছায় ছেলেটি ওর সঙ্গ নিল।
ওরা চলে গেলে গোবিন্দ চাপা গলায় বলল, ‘নির্ঘাত যেতে যেতে ভাব হয়ে যাবে।’
অনিমেষ বলল, ‘তুমি একবার সুপারকে ওর কথা বলে এসো, ভাই। আমার শরীরটা ভাল লাগছে না, আমি ঘরে যাচ্ছি।’
নিজের ঘরের দরজায় তালা নেই। তার মানে ত্রিদিব ফিরে এসেছে। এতক্ষণে অনিমেষের খেয়াল হল যে ওপরের ভিড়ে ত্রিদিবকে সে দেখেনি। সবাই গিয়েছে আর ও ঘরে বসে রইল। ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতে যেতেই ত্রিদিবের জড়ানো গলা কানে এল, ‘নো লাইট, প্লিজ।’
অনিমেষ হেসে বলল, ‘আজকেও খেয়েছ?’
ত্রিদিব প্রথমে কিছু বলল না। অনিমেষ নিজের খাটে গিয়ে বসলে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার বিপ্লব হয়ে গেল?’
‘বিপ্লব?’ অনিমেষ বিস্মিত।
‘কাজকর্মগুলো নাকি বাড়ি থেকেই শুরু করতে হয়। তুমি তোমার বিপ্লব হস্টেল থেকেই আরম্ভ করলে। ব্রাভো ব্রাদার। যখন ফিরলাম তখন শুনছিলাম তুমি বক্তৃতা দিচ্ছ। এই প্রথম নেতা হয়ে গেলে, গুড! সামনে খোলা ময়দান, এগিয়ে যাও, ফরোয়ার্ড মার্চ। সম্ভাবনার ঢেউ আছে তোমার মধ্যে, তোমার হবে।’ নাটুকে গলায় বলল ত্রিদিব।
‘কী যা-তা বকছ?’ অনিমেষ বিরক্ত হল।
‘যা-তা নয়, বন্ধু। এ ঘটনা কাল অন্য ছেলেরা জানবে। অটোমেটিক্যালি তুমি হিরো হয়ে যাবে। নেক্সট স্টেপ ইউনিভার্সিটির ইলেকশনে জেতা, তারপর ইউনিয়নের সেক্রেটারি, তারপর এম এল এ, মন্ত্রী। স্বর্গের সিঁড়ি— উঠে যাও।’
‘তুমি মাতাল হয়ে গেছ।’ অনিমেষ সহজ করার চেষ্টা করল।
‘একটা মেয়েকে নিয়ে তুমি যা করলে তার চেয়ে মাতাল হওয়া ঢের ভাল।’