॥ ১২ ॥
পাথরের বেঞ্চে হাতলের ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে শেখর হেলান দিয়ে বসেছিল। খুব আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটছে। বহুদিন শেখর এইরকম সূর্যোদয় দেখেনি। বাতাস এখন বেশ ঠাণ্ডা, ভোরের আলোও হিম, সূর্যের এখনো দেখা নেই, শুধু দূরের জঙ্গলের মাথায় নীলচে আলো। সূর্য উঠলেও জঙ্গলের আড়ালে বহুক্ষণ দেখা যাবে না, শেখর তবুও দৃষ্টি দিয়ে ভেদ করার চেষ্টায় জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইলো। জানে, এই জঙ্গলের বিস্তার বেশিদূর নয়, তবু রাত্রিবেলা মনে হয়েছিল সীমাহীন। ভোরের আলোয় এখন আবার সবকিছুর যথাযথ আয়তন ফিরে আসছে।
সারারাত অসংখ্য সিগারেট খেয়েছে, ভোরের দিকে তাই কাশি আসছিল বার বার। হাতের জ্বলন্ত অর্ধেক সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দু’তিনটে ঝরা ইউক্যালিপটাসের পাতা কুড়িয়ে নিয়ে রগড়ে নাকে ঘ্রাণ নিতে ভারী আরাম লাগলো।
পেছন থেকে কে এসে শেখরের কাঁধে হাত রাখলো। শেখর চমকালো না, ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বললো, রুণি! ঘুমোওনি? একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতে!
অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না। ঘুরে এসে শেখরের পাশে বসলো। একটুক্ষণ কোনো কথা না বলে, রুণি তাকিয়ে রইলো বাগানের গেটের দিকে। জয়াদের বাড়ির গেটটা আজ আর বন্ধ করা হয়নি, খোলাই আছে। সারারাত ঘুমোয়নি, কিন্তু অপর্ণার চোখ দুটিতে কোনো ক্লান্তির চিহ্ন নেই।
একটু পরে অপর্ণা জিজ্ঞেস করলো, আপনি আজ কলকাতায় যাবেন?
শেখর একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, অপর্ণার প্রশ্ন শুনে মন ফিরিয়ে এনে বললো, উঁ? না, এখন কিছু ঠিক করিনি। দেখা যাক, বেলা হোক।
—ওঁর বাড়িতে খবর দেবেন না?
—না, এখন নয়।
—কে কে আছেন ওঁর বাড়িতে?
—মা, দাদা-বৌদি, এক বোন, খুব ছোট, আট-ন’ বছর বয়েস…বলতে বলতেই তপতীর কথা মনে পড়লো শেখরের। একসময় তারা সবাই তপতীকে রবির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হিসেবেই ভাবতো। বারাসতে সেই বাগানবাড়ির পিকনিকে বৃষ্টির মধ্যে তপতী আর রবির হাত ধরাধরি করে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য—মনে হয়েছিল বহুকাল বহু শতাব্দী ধরে সেই ছবিটা থাকবে। এখন নিউ আলিপুরে সন্তানসম্ভবা তপতীর কাছে রবির খবর পৌঁছে দেবার কোনো মূল্য আছে কি?
শেখর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চলো!
অপর্ণা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোথায়?
—চলোই না! রবির কাছে কেউ আছে তো? অসীম তো ঘুমোচ্ছে।
—দিদি আছে।
—ঠিক আছে, চলো, আমরা একটু ঘুরে আসি। খালি পায়েই যাবে?
—সকালবেলা খালি পায়ে হাঁটতে খারাপ লাগবে না।
শিশির-ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে ওরা হেঁটে গেল। পর্টুলেকা ফুলগুলো ফুটি-ফুটি করছে। রাত থাকতেই ফুটে আছে অতসীর ঝাড়, ঘন সবুজ পাতার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটি গন্ধরাজ। গোলাপক্ষেতে অনেকগুলো গভীর পায়ের ছাপ, কয়েকটা চারা দুমড়ে নেতিয়ে আছে, কাল রাতে রবিকে ধরাধরি করে বয়ে আনার সময় গোলাপক্ষেতের কাছে কেউ সাবধান হয়নি।
গেটের কাছাকাছি এসে শেখর আবার মত বদলে ফেললো। অপর্ণাকে বললো, না থাক, রুণি, তুমি বাড়িতেই থাকো—আমি একটু একা ঘুরে আসছি।
—আমিও যাবো, চলুন না।
—না, তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও। দুপুরের দিকেই আবার জামসেদপুর যেতে হতে পারে—
—আপনি এখন কোথায় যাবেন?
—স্টেশনের দিকে। আমার একটু কাজ আছে—
ভোরের নরম নির্মল আলোতেও শেখরের মুখ প্রশান্ত হয়নি। মুখে অনেকগুলো চিন্তার রেখা। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অপর্ণা কি বুঝলো কে জানে, সে দৃঢ়স্বরে বললো, না, আপনাকে এখন একা কোথাও যেতে হবে না!
অপর্ণা নিজেই গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। বললো, এমনিই দু’জনে কাছাকাছি একটু হেঁটে আসি। সকালবেলা হাঁটতে ভালো লাগবে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে যাবে।
শেখর বললো, চলো—
সেই সময় দোতলার বারান্দা থেকে সদাশিবের গমগমে গলায় মন্ত্র-উচ্চারণ শোনা গেল। সদাশিব সর্বপাপঘ্ন দিবাকরকে প্রণতি জানাচ্ছেন। কাল রাত্রে সদাশিব নিজে গাড়ি চালিয়ে ঘাটশীলা থেকে ডাক্তার ডেকে এনেছেন। তবু আজ ঠিক ব্রাহ্মমুহূর্তে সূর্যবন্দনা করতে তাঁর ভুল হয়নি।
ওরা কিছু ঠিক করেনি, তবু ওরা বাংলোর দিকেই এগুলো। পথ দিয়ে এর মধ্যেই তোক চলাচল শুরু হয়েছে। আপাতত নিস্তরঙ্গ জীবন, তবু এত ভোরে উঠে মানুষ কিসের জন্য ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে কে জানে।
অপর্ণা বললো, ওকে জামসেদপুরের হাসপাতালেই নিয়ে যাবেন? না কলকাতায়….
—দেখি। দুপুরে ডাক্তার আবার আসুক। জ্ঞান ফিরুক।
—কখন জ্ঞান ফিরবে?
অপর্ণার গলার আওয়াজে এমন একটা বিষণ্ণ ভয় ছিল যে, শেখর সচকিত হয়ে তাকালো। হাসলো। আলতো ভাবে অপর্ণার হাত ছুঁয়ে বললো, রুণি, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? রবির কিছু হবে না! শক্ত ছেলে, জীবনে ওরকম অনেক আঘাত খেয়েছে।
—ডাক্তার যে বললেন, নার্ভের ওপর—
—ডাক্তাররা ওরকম বলে! আমি রবিকে অনেক ভালো চিনি।
—আপনি কতদিন চেনেন? খুব একরোখা লোক, তাই না?
—হুঁ। ছেলেবেলা থেকেই চিনি—খুব ইমোশনাল…আচ্ছা রুণি, তুমি এ পর্যন্ত কারুকে চোখের সামনে মরতে দেখেছো? কোনো আত্মীয়-স্বজন?
—না। না মরার পর দেখেছিলাম, বড় মামার মুখ…. কিন্তু চোখের সামনে—না, এ পর্যন্ত কারুকে না!
—আমিও দেখিনি! আমার বাবা যখন মারা যান, তখন একটুর জন্য—আমি ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলাম, গলির মোড়ে এসেছি, সেই সময় কান্না…। তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?
—কি?
—চোখের সামনে কারুকে মরতে? আমার ইচ্ছে করে, কেউ মরছে—আমি চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি—শেষ মুহূর্তে নাকি শরীরটা প্রবল ভাবে মুচড়ে ওঠে, চোখ ঘুরে যায়।
—আঃ, চুপ করুন! কি হচ্ছে কি?
—না, সত্যিই আমার ধারণা, নিজের মরার আগে একবার অন্য একটা মৃত্যু চোখে দেখা দরকার। কাল রবিকে প্রথম দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম—মৃত্যু ধারে-কাছে নেই-তোমরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলে—তুমি ওরকম ছটফট করছিলে কেন?
—আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলুম। রবিদাকে ওরকম দেখে—কখনো আগে ওরকম দৃশ্য তো দেখিনি—হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল—আগের দিন রবিদা আমাকে ডেকেছিলেন ওঁর সঙ্গে যাবার জন্য, আমি যাইনি—আমি অন্যায় করেছি, মানুষকে বুঝতে এরকম ভুল আমার কখনো হয় না।
—হঠাৎ ঐ কথাটাই তোমার তখন মনে হলো?
—হ্যাঁ। আমার মাসতুতো ভাই হিরণ্ময়ের কথাও হঠাৎ মনে পড়েছিলো একবার—
—কেন, তার কথা কেন?
—ঠিক জানি না। তবে, তার সঙ্গে গিয়ে একবার আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
—বুঝেছি।
বাংলোর সুরকি ঢালা পথের সামনে ওরা থমকে দাঁড়ালো। এক জায়গায় কয়েক ফোঁটা রক্ত তখনো চাপ বেঁধে আছে। সেদিকে চোখ পড়তেই শেখর চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্বাভাবিক ভাবে বললো, জিনিসপত্রগুলো সব চুরি হয়ে গেছে কিনা একবার দেখে আসি। ঘর বোধহয় ভোলাই ছিল সারারাত।
সিঁড়ি দিয়ে ওরা বারান্দায় উঠলো। দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ। কাচের জানলা দিয়ে দেখা গেল, সঞ্জয় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, মুখ এক পাশে ফেরানো। সঞ্জয় এদিকের ঘটনা কিছুই জানে না। কাল রাত্রে সারা পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র মানসিক স্বস্তির সঙ্গে ঘুমিয়েছে—তার মুখে সেই চিহ্ন! চোখের পাশটা একটু কুঁচকে রইলেও, ঠোঁটে হাসির আভাস—সঞ্জয় কোনো স্বপ্ন দেখছে।
আওয়াজ করলো না, ডাকলো না। শেখর ফিসফিসিয়ে অপর্ণাকে বললো, থাক, ঘুমোক। ওকে এখন জাগাবার কোনো দরকার নেই।
সিঁড়ি দিয়ে আবার নেমে এসে ওরা পরস্পরের দিকে তাকালো। শেখর বললো, রুণি, তোমার ক্লান্তি লাগছে? নইলে, চলো, কাল রবি যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাটা একবার দেখে আসি।
অপর্ণা বললো, আমিও সেই কথাটাই ভাবছিলুম।
রাস্তা চিনতে ভুল হলো না। পুরোপুরি সকাল হয়ে গেছে, পাখির কোলাহল চলেছে অবিশ্রান্ত। দু’জন আদিবাসী কাঁধে কুড়ল নিয়ে বনের পথ ভেঙে বড় রাস্তার দিকে চলে গেল, তাদের কুড়ুলের ফলায় রোদের ঝলসানি অনেকক্ষণ চোখে পড়লো। একটু দূর যেতেই দু’জোড়া চটি জুতো দেখা গেল—অসীম আর অপর্ণার। কাল জুতো খুলে ওরা অরণ্যে প্রবেশ করেছিল। সেদিকে তাকিয়ে অপর্ণা হাসলো। নিজের চটি পায়ে গলিয়ে নিয়ে বললো, অসীমদার জুতো, কি হবে? হাতে নেবো?
—জুতো এখন কে বইবে? এই সকালে? দাও আমাকে—
অসীমের চটি জোড়া নিয়ে একটা একটা করে শেখর জোরে ছুঁড়ে মারলো বাংলোর দিকে। বললো, যাক, পরে খুঁজে নেওয়া যাবে!
একটু পরে ওরা সেই জায়গায় পৌঁছুলো। ফুল গাছটার নিচে অনেকখানি কালচে রক্ত, জামার ছেঁড়া একটা টুকরো আটকে আছে কাঁটায়। একটা কাঠবিড়ালী রক্তের ওপর বিভ্রান্ত ভাবে গন্ধ শুঁকছিল—ওদের দেখে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেল। অপর্ণা প্রথমেই বললো, কাল আমরা এই ফুল গাছটা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, অনেক ঘুরেও পাইনি, শেষ পর্যন্ত এটার সামনেই—
দিনের আলোয় ফুল গাছটার বিশেষত্ব কিছু নেই। সাদা ফুলগুলোকে মনে হয় কাগজের ফুল, পাতাবিহীন গাছটাকে মনে হয় মরা গাছ, শুধু কাঁটাগুলো তীক্ষ হয়ে আছে। শেখর কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে অপর্ণার দিকে বাড়িয়ে বললো, এই নাও।
অপর্ণা দু’হাত জোড় করে ফুলগুলো নিলো, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকে বললো, খুব সামান্য গন্ধ, কিসের মতন যেন, কি রকম একটা ছেলেবেলা-ছেলেবেলার ভাব আছে।
শেখর খর চোখে চারপাশটা তাকিয়ে দেখছে। মাটিতে ঐ রক্ত আর দু’একটা ভাঙা ডাল ছাড়া আর কোনো বৈষম্য নেই। কাঠবিড়ালীটা শাল গাছের ওপর থেকে ব্যগ্রভাবে ওদের দেখছে। একটা কেন্নো খুব মন্থর ভাবে চলে যাচ্ছে পায়ের পাশ দিয়ে, এক ঝাঁক শালিক হাসাহাসি করতে করতে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
শেখর একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, খুব বদলে গেছি আমরা, সেটা আজ টের পেলাম।
—কেন?
—কাল রবিকে ওরকম ভাবে মেরেছে, আর আজ সকালে আমি তোমাকে ফুল ছিঁড়ে দিচ্ছি। দু’তিন বছর আগে হলে—
—কি করতেন তখন?
—জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিতুম! তুমি জানো না রুণি, কি অসম্ভব রাগ ছিলো আমার—যে হারামজাদারা রবিকে মেরেছে—তাদের খুঁজে এনে জিভ উপড়ে নিতুম—রবি একটা ছুরি এনেছিল সঙ্গে—সেটা আমিই সরিয়ে রেখেছি—এক একবার ইচ্ছে করছে ছুটে যাই, আবার এক একবার কি রকম যেন—
—আপনাকে কিছুই বোঝা যায় না। আপনি ভীষণ চাপা লোক—
—ছিলুম না এ রকম, পাজী বদমাইস ছিলুম—এখন কী রকম যেন মনে হচ্ছে, পৃথিবীর একটা নিজস্ব নিয়ম আছে—সেই নিয়ম অনুযায়ীই সব কিছু চলছে, রবির মার খাওয়াটাও তার মধ্যে পড়ে—
—ওকে কারা মারলো? কেন মারলো?
—ঠিক জানি না। তবে আন্দাজ করতে পারি।
—কেন?
—রবি নিজেকে ভাঙতে চেয়েছিল। এখানে মার না খেলেও অন্য কোথাও ওকে একদিন মার খেতেই হতো!
—কেন?
—আত্মহত্যা তো সবাই করতে পারে না—তোমার জামাইবাবুর মতন! রবি তাই ইচ্ছে করে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে—
—কেন রবিদার এরকম—
শেখর অসহিষ্ণু বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলো, আঃ, কি একঘেয়ে কেন কেন জিজ্ঞেস করছো! তুমি মেয়ে হয়ে যদি এটা বুঝতে না পারো—তোমায় আমি কি করে বোঝাবো!
অপর্ণা আর কোনো কথা বললো না। মুখ নিচু করলো। শেখর সন্দেহ করে অপর্ণার দিকে তাকালো। হ্যাঁ, ঠিক, দু’ফোঁটা জল টলটল করছে চোখে, এক্ষুনি গড়িয়ে নামবে। শেখর একটু জোরে বললো, রুণি! ও কি? কী ছেলেমানুষ তুমি!
অপর্ণা মুখ তুললো, চোখের জলের ফোঁটা দুটোকে কোন অলৌকিক উপায়ে ভিতরে ফেরত পাঠিয়ে দিলো, কাঁদলো না। ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বললো, কি? কিছু হয়নি তো!
ফুল গাছটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে অপর্ণা। তার কমনীয় তন্বী শরীরের ওপর জাফরিকাটা রোদ এসে পড়েছে। নিঃশ্বাসে দুলছে তার বুক, চিবুকের পাশে বহু ভাষার ব্যঞ্জনা। অঞ্জলিবদ্ধ হাত থেকে ফুলগুলো সে ঝরঝর করে মাটিতে ফেলে দিলো।
শেখর বললো, রুণি, কাল পর্যন্ত তুমি কি রকম হাসিখুশী ছেলেমানুষ ছিলে। আজ কেমন গম্ভীর আর চাপা, সে রকম হাসছো না—জঙ্গলে এসে তুমিও বদলে গেলে?
—বদলাবো না? সবাই বদলায়।
—তুমি কেন বদলাবে! যারা সরল আর নিস্পাপ, তারা সব জায়গাতেই একরকম।
অপর্ণা এবার স্পষ্ট করে হেসে বললো, আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুন তো? আমি কি কচি খুকী নাকি?
—কচি খুকী না হলেও, তুমি সত্যিই সরল মেয়ে।
—আপনি মেয়েদের চেনেন না। মেয়েদের সম্পর্কে আপনার কোনো জ্ঞান নেই মনে হচ্ছে!
—তোমাদের আজকালকার মেয়েদের এই একটা ফ্যাশান হয়েছে। সরল কিংবা নিস্পাপ শুনলে খুশি হও না। নিজেকে খুব একটা জটিল আর রহস্যময়ী ভাবতে খুব ভালো লাগে, তাই না?
—না শেখরদা, আমি সরল থাকতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। আমি অনেক মানুষকে দুঃখ দিয়েছি।
—তোমাদের ঐ সব শখের দুঃখ তো! প্রেম-প্রেম খেলা! তোমাকে একজন ভালোবেসেছিল, তুমি তাকে ভালোবাসোনি—তারপর তার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেল—এইসব তো? তোমরা মেয়েরা এই ভেবে খুব আনন্দ পাও, কিন্তু মানুষের জীবন অত সহজে ব্যর্থ হয় না!
—আপনি বুঝি ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন না?
—এইসব ছেলেমানুষী ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না।
—আপনি কোথাও নিশ্চয়ই কঠিন আঘাত পেয়েছেন!
—কোনো আঘাত পাইনি। তোমাকে পাকামি করতে হবে না!
—আমি কিন্তু ভালোবাসার কথা বলতে চাইনি। আমার দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এই, আমি এ পর্যন্ত ভালোবাসার ব্যাপারটা নিজের মধ্যে টেরই পেলাম না। আমার ব্যাপারটা শুনবেন? আমাদের বাড়ি থেকে বরাবরই আমরা খুব স্বাধীনতা পেয়েছি। যখন খুশি যার সঙ্গে বেড়াতে যেতে পারি, আমি ড্রাইভিং জানি, গাড়ি নিয়ে যখন-তখন বেরিয়ে গেছি—আমাদের দেশে এ রকম স্বাধীনতা অনেক মেয়েই পায় না। অনেক ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তারা আমাকে দামী রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গেছে, গাড়িতে করে বেড়িয়েছে, আর একটু আড়াল হলেই ভালোবাসার কথা বলেছে, কিন্তু—
—কিন্তু আবার কি? দু’তিন বছর ওরকম অনেকের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে প্রেমের রিহার্সাল দিয়ে তারপর ওদের মধ্যে কেঁদে-কেঁটে সবচেয়ে যে ভালো চাকরি করে আর সবচেয়ে যাকে ভালো দেখতে—তাকে একদিন বিয়ে করে ফেলবে—তোমাদের মতন মেয়েদের পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক!
—মোটেই স্বাভাবিক নয়! আপনি ভাবেন আপনি সব বোঝেন, তাই? মোটেই বোঝেন না! ঐ সব ছেলেদের মুখে ভালোবাসার কথা শুনলেই আমার কি রকম অ্যালার্জি হয়। সবাই একই কথা বলে! কেউ একটু রসিকতা করতে জানে, কেউ ভালো ইংরিজিতে বলে, কিন্তু কথা সবারই এক! এটা কি করে হয়? একটা মেয়ের সঙ্গে একটু আড়াল পেলেই সবার মধ্যে ভালোবাসা জেগে ওঠে? ঘেন্না ধরে গেছে আমার ওরকম ভালোবাসায়—
শেখর যেন অপর্ণার কথায় বেশ মজা পাচ্ছে—এই ভাবে মুচকি হাসতে লাগলো! সিগারেট খেলেই কাশি হচ্ছে, তবু আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে শেখর বললো, আমি বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপারটা। তুমি বড়লোকের মেয়ে, এক ধরনের হাল্কা বড়লোকের ছেলের সঙ্গেই তোমার আলাপ হয়েছে। তারা ঐরকমই তো। অন্য ধরনের ছেলেদের সঙ্গে তো মেশোনি।
অপর্ণা ঝাঁঝালো গলায় বললো, বড়লোক-গরীবের কথা এর মধ্যে তুলবেন না! গরীবের ছেলেদেরও দেখেছি-~-তারা প্রেম নিয়ে আরও বেশি প্যানপ্যানানি করে—তারা রসিকতা করতেও জানে না—সব সময় একটা কাতর-কাতর ভাব দেখায়। আমি আপনার বন্ধুদের ঐরকম ভেবেছিলাম!
—আমার বন্ধুদের? তারা কেউ ওরকম ন্যাকা নয়!
—আপনার কথা বলছি না, আপনি তো সাধু-পুরুষ দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আপনার অন্য বন্ধুরা—
—বন্ধুরাও কেউ দু’একদিনের আলাপে প্রেমের কথা শোনাবে না।
অপর্ণা একটু চুপ করে রইলো, সাদা ফুলগাছটার তীক্ষ্ণ কাঁটায় আঙুল বুলোতে বুলোতে আবার বললো, আমি রবিদাকেও তাই ভেবেছিলাম। রবিদা যখন একা একা আমাদের বাড়িতে গিয়ে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমাকে ডাকলো—আমি সেটাকেও হাল্কা ব্যাপার ভেবেছিলাম—কিন্তু তারপর থেকে সব সময় আমি মনের মধ্যে রবিদার সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি! এরকম আমার আগে কখনো হয়নি! আমার মনে হচ্ছে—এই প্রথম আমার জীবনে একটা সত্যিকারের ডাক এসেছিল—কিন্তু আমি সেটা ফিরিয়ে দিয়েছি! আমি বোকা, দারুণ বোকা! হয়তো, আমার ভুলের জন্যই রবিদার এরকম হলো!
শেখর একটু অন্যমনস্কভাবে বললো, ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে, তুমি খানিকটা দায়ী নিশ্চয়ই। তোমারই মতন আর একটা মেয়ে, তপতী তার নাম—সে-ও…
অপর্ণা হঠাৎ ব্যাকুলভাবে বললো, বলবেন না! আর কারুর কথা আমাকে বলবেন না! রবিদার জীবনের অন্য কোনো কথা আমি শুনতে চাই না!
শেখরের দিকে পেছন ফিরে অপর্ণা দাঁড়িয়ে রইলো। তার সারা শরীরটা কাঁপছে। বেশ কিছুক্ষণ তাকে সেইভাবেই থাকতে দিলো শেখর। ওর ব্যাকুলতা দেখেও শেখরের মুখ-টেপা হাসিটা মেলায়নি। যেন সারা রাত জেগে থাকার পর ভোরবেলার এই রকম ঘটনাই ঠিক মানায়—এইরকম তার ভাব। একটু পরে, অপর্ণা নিজেকে একটু সামলে নিতে শেখর জিজ্ঞেস করলো, রুণি, এখানে একটু বসবে?
—আমার এই জায়গাটায় থাকতে কি রকম অস্বস্তি লাগছে! চলুন এবার ফিরে যাই।
—এসো। শেখর হাত বাড়িয়ে দিলো।
সদাশিব সেই একই ভঙ্গিতে বারান্দার ইজিচেয়ারে বই হাতে নিয়ে বসে আছেন। দেবকুমারকে নিয়ে বাগানে খেলা করছে পরমেশ্বর। দূর থেকে ট্রেনের শব্দ শোনা গেল। এই রকম সময়েই শেখররা এই স্টেশনে নেমেছিল।
ওরা সদাশিবের সামনে এসে দাঁড়ালো! সদাশিব চোখ তুলে বললেন, মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে। ভয় নেই। স্বাস্থ্যবান ছেলে, সহ্য করে নেবে—
কাল রাত্রে সদাশিব একবারও প্রশ্ন করেননি, কারা রবিকে মেরেছে, কেন মেরেছে। জঙ্গলে অত রাত্রে ওরা কেন ঘুরছিল! শুধু আহত মুমূর্ষ রবিকে দেখে তিনি বলেছিলেন, একি, এমন সুন্দর ছেলে, তার এই অবস্থা কেন? আমি এক্ষুনি ঘাটশীলার কপার মাইনস্ থেকে ডাঃসরকারকে নিয়ে আসছি, তোমরা গরম জল করে ভালো ভাবে ওয়াশ করে দাও—
শেখর জিজ্ঞেস করলো, ওকে কি আজই হাসপাতালে রিমুভ করবো?
সদাশিব চোখের ইঙ্গিতে চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বসো।
অপর্ণা ওদের পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠে গেল। সিঁড়িতে দেখা হলো জয়ার সঙ্গে। জয়া উদ্ভাসিত মুখে বললো, জ্ঞান ফিরে আসছে। জ্ঞান ফেরার পরেই কি চিৎকার! কষ্ট হচ্ছে তো খুব!
সে দিদির দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বললো, কথা বলতে পারছে?
—মাঝে মাঝে। বেশিক্ষণ জ্ঞান থাকছে না একসঙ্গে।
—তোকে চিনতে পেরেছে?
—হ্যাঁ। তোরা কোথায় গিয়েছিলি?
অপর্ণা ঘরে ঢুকলো। মাথার কাছে টুলে বসে আছে অসীম, অতক্ষণ পর সে তখন একটু ঘুমে ঢুলছে। অপর্ণাকে দেখে সে-ও একই কথা বললো, জ্ঞান ফিরে এসেছে রবির। তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?
অপর্ণা কথার উত্তর দিলো না। রবির মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। সারা মুখ জোড়া ব্যাণ্ডেজ—চোখ দুটো আর নাকটা শুধু খোলা। পায়েও ব্যাণ্ডেজ। বিছানার পাশ দিয়ে একটা হাত করুণ ভাবে ঝুলছে। অপর্ণা সেই হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো।
রবি চোখ খুলে তাকালো। আবছা ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। চোখে কয়েকটা তরঙ্গ খেলা করে গেল। অস্ফুট ভাবে বললো, কে? তপতী?
—না, আমি রুণি। অপর্ণা!
রবি আবার স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠলো শরীর, তবু একদৃষ্টে রুণির দিকে তাকিয়ে থেকে যেন সত্যিই ভালো করে চিনতে পারলো। সঙ্গে সঙ্গে রবি হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। বিকৃত গলায় বললো, শেখর কোথায়? অপর্ণা শক্ত করে রবির হাতটা চেপে ধরে থেকে বললো, না, হাত ছাড়িয়ে নেবেন না!
রবি আবার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। পারলো না। তখন সে মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো।
***