সকাল দশটা। হাতে অ্যাটাচি কেস নিয়ে নতুন জীবন আরম্ভ করতে বেশ লাগছে সোমনাথের। অ্যাটাচি কেসটা কমলা বউদি জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলেন বড়দার নাকি একাধিক আছে, কোনো কাজে লাগছে না।
এবারেও ওর পকেটে ফল গুঁজে দিলেন কমলা বউদি। আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি মানুষ হবে—আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
সোমনাথ মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, মানুষ হওয়া কাকে বলে? তারপর ওর মনে হলো, নিজের অন্ন নিজে জটিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা মানুষ হবার প্রাথমিক পদক্ষেপ।
সোমনাথ বুঝতে পারছে, বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এখনও নিজের পায়ে না দাঁড়ালে, আর মনুষ্যত্ব থাকবে না।
কানোরিয়া কোর্টের বাহাত্তর নম্বর ঘরে বিশুবাবু বসেছিলেন। সোমনাথকে দেখেই উল্ল বিশুবাবু বললেন, “এসো এসো।”
সোমনাথ তখনও বুঝতে পারছিল না, হৃদয়হীন উদাসী সময় তাকে কোন পথে নিয়ে চলেছে।
এসব চিন্তা তার মাথায় হয়তো আজ আসতো না, যদি-না বাস স্ট্যান্ডের কাছে সুকুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো। সোমনাথের ফসা জামাকাপড় দেখে সুকুমার বললো, “বেশ বাবা! লুকিয়ে লুকিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিস।”
সুকুমারের রক্ষ চাহনি ও খোঁচাখোঁচা দাড়ি দেখে কষ্ট হচ্ছিল সোমনাথের। সুকুমার বললো, “মিনিট দশেক দাঁড়া–জামাকাপড় পাল্টে আমিও তোর সঙ্গে ইন্টারভিউ দিয়ে আসবো।”
সোমনাথকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুকুমার কাতরভাবে বললো, “আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি লাট সাহেব, চীফ মিনিস্টার, টাটা, বিড়লা কেউ আমার সঙ্গে জেনারেল নলেজে পেরে উঠবে না।”
সোমনাথ ওর হাত দুটো ধরে বললো, “বিশ্বাস কর, আমি ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি না।”
“তুইও আমাকে মিথ্যে কথা বলছিস?” হঠাৎ চীৎকার করে উঠলো সুকুমার। তারপর অকস্মাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। বললো, “আমার যে একটা চাকরি না হলে চলছে না, ভাই।”
সোমনাথের গম্ভীর মুখ দেখে বিশুবাবু ভুল বুঝলেন। বললেন, “কী ব্রাদার। অফিসার হয়ে বিজনেসম্যানদের খাতায় নাম লেখাতে হলো বলে মন খারাপ নাকি?”
সোমনাথ বললো, “চাকরি যখন আমাকে চাইছে না, তখন আমি চাকরিকে চাইতে যাবো কেন?”
বিশুবাবু বললেন, “পাকিস্তানে সব খুইয়ে যখন এসেছিলুম তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। মুরগীহাটায় মুটেগিরি করেছিলুম ক’দিন। তারপর চড়া সুদে দশ টাকা ধার করে একঝুড়ি কমলালেবু কিনতে গেলাম। আনাড়ী লোক, ফলের বাক্সর ওপর লাল-নীল সাঙ্কেতিক দাগ থেকে কী বুঝবো? আমার অবস্থা দেখে চিৎপুর পাইকারী বাজারে এক বুড়ো মুসলমানের দয়া হলো। দেখে-শুনে কমলালেবুর একটা বাক্স ভদ্রলোক কিনিয়ে দিলেন। প্রথম দিন বেশ মাল বেরুলো। পাঁচ ঘণ্টা রাস্তায় বসে দু টাকা নেট লাভ করে ফেললম—মনের আনন্দে নিজের অজান্তে দুটো লেবুও খেয়ে ফেলেছি। চড়া সুদে-কোম্পানির গোঁফওয়ালা ষণ্ডামাকা যে লোকটা সন্ধ্যেবেলায় পাওনা টাকা আদায় করতে আসতো, সে তো অবাক। ভেবেছিল আমি টাকা শোধ করতে পারবো না। দশ টাকা দশ আনা তাকে ফেলে দিলুম। রইলো এক টাকা ছ’ আনা।”
নিজের গল্প বন্ধ করলেন বিশুবাবু। বললেন, “থাক ওসব কথা। এখন তোমার হাতেখড়ির ব্যবস্থা করি। মল্লিকবাবুকে ডেকে পাঠাই।”
সেনাপতি ছুটলো মল্লিকবাবুকে ডাকতে। একটু পরেই চোখে একটা হ্যান্ডেল-ভাঙা চশমা লাগিয়ে হাজির হলেন বুড়ো মল্লিকবাবু। পরনে ফতুয়া, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। ভদ্রলোক এ-পাড়ার ছাপাখানা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করেন।
বিশুবাবু বললেন, “মল্লিকমশাই, সোমনাথের লেটার হেড এবং ভিজিটিং কার্ডের ব্যবস্থা করে দিন। আমার ঘরের নাব্বার এবং টেলিফোন দিয়ে দেবেন।”
“নাম কী হবে?” মল্লিকবাবু ঝিমোতে ঝিমোতে জিজ্ঞেস করলেন।
“সত্যি তো, নাম একটা চাই,” বিশুবাবু বললেন। “কিছু, প্রিয় নাম-টাম আছে নাকি?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
প্রিয় নাম একটা আছে কমলা। কিন্তু এই জীবনের জটের সঙ্গে তাঁকে শুধু শুধু জড়িয়ে ফেলে কী লাভ? তার থেকে বরং দায়িত্বটা পুরোপুরি নিজের ওপরেই থাক কোম্পানির নাম দেওয়া যাক : সোমনাথ উদ্যোগ।
নাম শুনেই বিশুবাবু বললেন, “ফার্স্ট ক্লাস। এই উদ্যোগ কথাটা মাড়ওয়ারীরা খুব ব্যবহার করছে। আর তোমার নিজের নামখানিও খাসা। কার সাধ্য ধরে বাঙালীর কারবার? প্রয়োজন হলে গজরাতী কনসান বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। সোমনাথ নামটা গুজরাতীদের খুব প্রিয়—ওদের সেন্টিমেন্টেও লাগে। সোমনাথ মন্দিরটা কতবার যে বিদেশীরা এসে ঝেড়েঝড়ে সাবাড় করে দিলো।
মল্লিকবাবু চলে যেতেই বিশুবাবু বললেন, “এই যে পাড়া দেখছো, এখানে লাখ-লাখ কোটি কোটি টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। যে ধরতে জানে সে হাওয়া থেকেই টাকা করছে। এসব গল্প কথা নয়—দ-দশটা লাখপতি এই কলকাতা শহরে এখনও প্রতিমাসে তৈরি হচ্ছে। আমি বাপ, তোমাকে জলে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু সাঁতার নিজে থেকেই শিখতে হবে। ঝিনুকে করে এই লাইনে দুধ খাওয়া শেখানো হয় না।”
বিশুবাবু কথা বলতে বলতেই ঘরের মধ্যে কম বয়সী এক ছেকারা ঢুকলো। বয়স সতেরো-আঠারোর বেশি নয়। বিশুবাবু বললেন, “অশোক আগরওয়ালা। ওর বাবা শ্রীকিষণজী আমার ফ্রেন্ড। রাজস্থান ক্লাবের অন্ধ ভক্ত। তবে শীন্ডে রাজস্থান হেরে যাবার পর ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করে।”
অশোককে ডাকলেন বিশুবাবু। “অশোক কেমন আছো? পিতাজীর তবিয়ত কেমন?”
পিতাজী যে ভালো আছেন, অশোক বিনীতভাবে বিশুবাবুকে জানালো। বিশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “অশোক তুমি কার সাপোর্টার?”
অশোক নির্দ্বিধায় বললো, “রাজস্থান অ্যান্ড ইস্টবেঙ্গল।”
“রাজস্থান তো বুঝলাম। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কেন, আমার ফ্রেন্ড মিস্টার সোমনাথকে একটু বুঝিয়ে বলো তো।”
অশোকের উত্তরে জানা গেলো, ইস্টবেঙ্গল তার বাবার জন্মস্থান। নারায়ণগঞ্জে তাদের পাটের কারবার ছিল। তাই ওরা ভালো বাংলা জানে। কিষণজী তো বাংলা নবেলও পড়েন।
ওদের দুজনের আলাপ হয়ে গেলো। অশোক ছেলেটি বেশ ভালো। বিশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কিছু জালে পড়লো?”
অশোক বললো, “বাজার খারাপ, কিছুই হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত চল্লিশখানা ফ্ল্যাট ফাইলের অর্ডার ধরেছি। মাত্র চার টাকা থাকবে।”
অশোকের হাতে একটা বড় কাগজের প্যাকেট। অশোক বললো, “ট্যাক্সি চড়তে গেলে কিছুই থাকবে না। তাই বাসের ভিড় কম থাকতে থাকতে ডেলিভারি দিয়ে আসবো ভাবছি।”
ফাইলের তাড়া নিয়ে অশোক বেরিয়ে গেলো। বিশুবাবু বললেন, “ওর বাবা টাকার পাহাড়ে বসে আছেন। দু-তিনটে বড় বড় কোম্পানির মালিক। তিন-চারশ’ লোক ওঁর আন্ডারে কাজ করে। আবার একটা কেমিক্যাল ফ্যাকটরি বানাচ্ছেন। অশোক মর্নিং ক্লাসে বি-কম পড়ে। বাবা কিন্তু ছেলেকে দুপুরবেলায় ধান্দায় লাগিয়ে দিয়েছেন।”
সোমনাথ শুনলো অশোকের জন্যে নিজের কোম্পানিতে থান করেননি শ্রীকিষণ আগরওয়ালা। ছেলের হাতে আড়াইশ’ টাকা দিয়ে চরে খেতে পাঠিয়েছেন। শ্রীকিষণজী চান ছেলে নিজের খুশী মতো বিজনেস করুক। বিশবাবার অফিসে বসে অশোক। আর বাজারে একলা ঘরে ঘরে ঠিক করে কোন বিজনেস করবে।
“বাঙালী বড়লোকেরা এসব ভাবতে পারে?” বিশুবাবু দুঃখ প্রকাশ করলেন। তাঁদের ছেলেদের গায়ে একটু রোদ লাগলে ননী গলে যাবে।”
অশোকের উৎসাহ আছে। নিজের কলেজেই বিজনেসের সুযোগ নিয়েছে। ওখানেই ফাইলগুলো সাপ্লাই করবে।
বিশুবাবু বললেন, “বিজনেসের অনেক জিনিস গোপন রাখতে হয়। সুতরাং তোমাকে আমি রোজ পাখি-পড়া করাবো না। নিজের ময়লা নিজে সাফ করবে, নিজের গোলমাল নিজে মেটাবে। আমি জিজ্ঞেস করতেও আসবে না।”
বিশুবাবুর নিজের কিন্তু তেমন ব্যবসায় মন নেই। কোনোরকমে চালিয়ে নেন। সেনাপতি বলে, “সায়েবের আর কী? বিয়ে-থা করেননি। সংসারের টান বলতে মা ছিলেন। দু-বছর হলো মা দেহ রেখেছেন। এখন দুর্বলতা বলতে ওই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবটুকু। ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে মাঠে যাবেনই। তাতে বিজনেস থাকুক আর যাক।”
বিশববির আর একটা দোষ আছে। সন্ধেবেলা একটু ড্রিঙ্ক করেন বিশুবাবু! ওঁর ভাষায়, “রাত্রে একটু আহিকে বসতে হয় ব্রাদার। ব্যাড় হ্যাবিট হয়ে গিয়েছে। ঐ এলফিনস্টোন বার-এ গিয়ে বসি। ইয়ার বধদের সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা হয়। ওখান থেকেও মাঝে মাঝে দু-চারটে বায়না এসে যায়। গত সপ্তাহে এলফিনস্টোন বার-এ শুনলাম এক ভদ্রলোক একখানা লরি বেচবেন। শ্রীকিষণজীর একখানা লরি কিছুদিন আগে ধানবাদের কাছে অ্যাক্সিডেন্টে নষ্ট হয়ে গিয়েছে শুনেছিলাম। এলফিনস্টোন বার থেকে পোদ্দার কোর্টে শ্রীকিষণজীকে ফোন করলাম। তারপর গডেস কালীর নাম করে দই পার্টিকে ছাঁদনাতলায় হাজির করিয়ে দিলাম। পকেটে পাঁচশ’ টাকা এসে গেলো উইদাউট এনি ইনভেস্টমেন্ট। এব নাম ভগবানের বোনাস। হঠাৎ হয়তো বিশ্বনাথ বোসের কথা মনে পড়ে গেলো ভগবানের ভাবলেন, হতভাগার জন্যে অনেকদিন কিছু করা হয়নি।”
বিশববি, এরপর সোমনাথকে নিয়ে বাজারে বেরিয়েছিলেন। ভিড় ঠেলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিশুবাবু বলছিলেন, “দুনিয়াতে যত ব্যবসা আছে তার মধ্যে এই অর্ডার সালায়ের ব্যবসাটা সবচেয়ে সহজ। সুখেরও বলতে পারো—অবশ্য যদি চলে।”
ব্যাপারটা কি জানতে চাইলো সোমনাথ। বিশুবাবু বললেন, “অপরের শিল অপরের নোড়া, তুমি শুধু কারুর দাঁতের গোড়া ভেঙ্গে টু-পাইস করে নিলে।”
এরপর বিশুবাবু ব্যাখ্যা করলেন, “অপরের ঘরে মাল রয়েছে। তুমি খোঁজখবর করে দাম জেনে নিলে। তারপর যদি একটা খদ্দের খুঁজে বার করতে পারো যে একটু বেশি দামে নিতে রাজী আছে—তা হলেই কম ফতে।”
“তাহলে দাঁড়ালা কী?” বিশুবাবু প্রশ্ন করলেন। বাজারে কোন জিনিস কত সস্তায় কার ঘরে পাওয়া যায় জানতে হবে। তারপর সেই মাল কাকে গছানো যায় খবর করতে হবে। ব্যস—আমার কথাটি ফরলো, নোটের তাড়াটি পকেটে এলো!”
এই নতুন জগতে সোমনাথ এখনও বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না। কোনো অজানা জগতে বেপরোয়াভাবে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের মনস্কামনা সিদ্ধি করবার মতো মানসিকতা সোমনাথের নেই। থাকবেই বা কী করে? বড় নিরীহ প্রকৃতির মানুষ সে। কলকাতার লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের মতোই সে মানুষ হয়েছে—জন-অরণ্যে নিরীহ মেষশাবক ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই এদের তুলনা করা চলে না।
বিশুবাবু এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। আপন মনে তিনি বললেন, “বিজনেসের ডেফিনিশন দিতে গিয়ে যে-ভদ্রলোক বলেছিলেন-ব্যবসা মানে সস্তায় কেনা এবং বেশি দামে বেচা, তাঁকে অনেকে সমালোচনা করে। কিন্তু সার সত্যটি এর মধ্যেই আছে।”
কয়েকটা লোক দেখিয়ে বিশুবাবু বললেন, “এই বাজারের হাজার হাজার লোক অর্ডার সাপ্লায়ের ওপর বেঁচে আছে। অফিসের আলপিন থেকে আরম্ভ করে চিড়িয়াখানার হাতি পর্যন্ত যা বলবে সব সাপ্লাই করবে এরা। তবে মার্জিন চাই।”
হাতির কথা শুনে বোধহয় সোমনাথের মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। বিশুবাবু বললেন, হাসছো? বিশ্বাস হচ্ছে না। চলো শ্যামনাথবাবুর কাছে।”
একটা ছোট্ট আপিসে মুখ শুকনো করে বসে আছেন শ্যামনাথ কেদিয়া। মোটা-সোটা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। একটু তোতলা। বিশুবাবুকে দেখে কেদিয়াজী মদ, হাসলেন। বললেন, “কী বোসবাবু কুছ এনকোয়ারি পেলেন?”
বিশুবাবু বললেন, “না কেদিয়াজী, দুটো-তিনটে সার্কাস কোম্পানির খবরাখবর করলাম—কিন্তু হাতির বাজার খুব নরম। সামনে বর্ষা, কেউ এখন স্টকে হাতি তুলতে চাইছে না।”
কেদিয়াজী ঠোঁট উল্টে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, “এখোন লিচ্ছে না—পরে আফসোস করবে। একই হাতি তিন হাজার রপীয়া জাদা দিয়ে লিতে হোবে।”
বিশুবাবু বললেন, “সাকাস কোম্পানি তো-মাথায় অত বুদ্ধি নেই। আপনি বরং হাতিটাকে শোনপুরের মেলায় পাঠিয়ে দিন। ওখানে এক গ্রোস হাতি বিক্রি করতেও অসুবিধা হবে না।”
“সোব জায়গায় গণ্ডগোল। হাতির ওয়াগন মিলতেই বহুত টাইম লেগে যাচ্ছে,” দুঃখ করলেন কেদিয়াজী।
“আপনি তাহলে এক্সপোটের চেষ্টা করুন। পৃথিবীর অন্য জায়গায় হাতির খুব কদর।” বিশুবাবু মতলব দিলেন।
কেদিয়াজী সে-খোঁজও নিয়েছিলেন। ওয়েলিংটন বলে এক সাহেব মাঝে মাঝে জন্তুজানোয়ার কিনতে কলকাতায় আসেন। তিনি এলেই কেদিয়াজী সাডার স্ট্রীটে ফেয়ারল্যান্ড হোটেলে লোক পাঠাবেন। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের আগে ওয়েলিংটন সায়েবের কলকাতায় আসবার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া ‘ফরেন মার্কেটে কেবল বেবি হাতির কদর। এরোপ্লেনে পাঠাতে খরচ কম। পকেট থেকে প্লেন ভাড়া দিয়ে কয়েক টন ওজনের বাড়ি হাতি বিদেশে পাঠাতে হলে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে।
বিশুবাবু এবার সোমনাথের পরিচয় দিয়ে কেদিয়াজীকে বললেন, “ইয়ং মিস্টার ব্যানার্জি হাই সোসাইটিতে ঘোরেন। ওঁর আত্মীয়স্বজন সব বড় বড় কোম্পানির বড় বড় পোস্টে রয়েছেন।
কেদিয়াজী এবার বিশুবাবুকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কি সব আলোচনা করলেন। তারপর ফিরে এসে কেদিয়াজী ফিক-ফিক করে হাসতে লাগলেন। সোমনাথকে বললেন, “আচ্ছা কোনো কোম্পানিকে আপনি হাতিটা সেল করুন। আচ্ছা কমিশন মিলবে।”
“বড় বড় কোম্পানি কেন হাতি কিনতে যাবে?” বিজনেসে অনভ্যস্ত সোমনাথ খোলাখুলি সন্দেহ প্রকাশ করলো।
এ-লাইনে কোনো সেলসম্যান এইভাবে প্রশ্ন করে না। কিন্তু কেদিয়াজী বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। বললেন, “জানা-শোনা থাকলে ফোরেন কোম্পানির বড় সায়েবরা সোব চিজ লিয়ে লিবে।”
কেদিয়াজীর ওখান থেকে বেরিয়ে বিশুবাবু বললেন, “অতি লোভে কেদিয়া ড়ুবতে বসেছেন। ইলেকট্রিক্যাল গুডসের দালালি করে হাজার পঁচিশেক কামিয়েছিলেন লাস্ট ইয়ারে। এ-বছরের গোড়ার দিকে এক হিন্দী সিনেমা কোম্পানির খপ্পরে পড়েছিলেন। ওরা একটা হাতি কিনে শুটিং করছিল। শুটিং-এর শেষে ফিল্ম কোম্পানি বোম্বাইতে হাতি ফিরিয়ে নিয়ে গেলো না। জলের দামে হাতি পাচ্ছেন ভেবে কেদিয়া কিনে ফেললেন। তখন এক সাকাস কোম্পানির দালালের সঙ্গে কেদিয়াজীর যোগাযোগ ছিল, সে লোভ দেখিয়েছিল মোটা দামে হাতি বেঁচে দেবে।”
যা জানা গেলো সেই দালালই কেদিয়াজীকে ড়ুবিয়েছে। হাতির বাজারে উন্নতির জন্যে কেদিয়াজী মাস কয়েক অপেক্ষা করতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু হাতির খোরাক যোগাতে প্রতিদিন যে পঞ্চাশ-ষাট টাকা খরচ করতে হবে, এই হিসেবটা তিনি ধরেননি।
“খোঁজখবর না নিয়ে হাতির ব্যবসায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে এই হয়,” বিশুদা বললেন। “এখন হাতির খরচ এবং একটা মাহতের মাইনে গোনো! তার ওপর পুলিশের হাঙ্গামা। হাতির জন্যে যে লাইসেন্স করতে হয় তাও জানতেন না কেদিয়াজী।” হাতি বাজেয়াপ্ত হতে বসেছিল। জানা-শোনা এক পুলিশের সাহায্যে বিশুদা ক’দিন বহু চেষ্টা করে ম্যানেজ করে দিয়েছেন। কিন্তু এবার হাতি সরাতেই হবে। তাই জলের দামে হাতি বেঁচে দিতে চাইছেন কেদিয়াজী।
বিশুদা নিজেও মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, “আমরা হাসছি কিন্তু সিরিয়াসলি কাজ করলে এর থেকেও হাজার খানেক টাকা রোজগার করতে পারে। বলা যায় না, বড় কোনো কোম্পানির পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট প্রচারের জন্যে হাতি লিজ নিতে পারে। তারপর পুজো নাগাদ শিক্ষিত হাতির দাম বেশ উঠে যাবে। সার্কাস কোম্পানিদের তখন ঘুম ভাঙবে।
সমস্ত ব্যাপারটা রসিকতা মনে হয়েছিল তখন। কিন্তু পরের দিন বিকেলেই সোমনাথ শুনলো কেদিয়াজীর হাতি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কোনো এক দালাল দশ পারসেন্ট কমিশনে হাতি হাওয়া করে দিয়েছে। কেদিয়াজী অবশ্য প্রতিজ্ঞা করেছেন যে-লাইনে অভিজ্ঞতা নেই। সে ব্যবসায় তিনি আর হাত বাড়াবেন না।