১২. হয়তো একদিন পৃথিবীতে

হয়তো একদিন পৃথিবীতে খুব সুসময় এসেছিল। তখন শ্যাম ছিল না। হয়তো একদিন পৃথিবীতে খুব সুসময় এসে যাবে। তখন শ্যাম থাকবে না। কেমন ছিল সেই সুসময় কে জানে! কিংবা কে জানে কেমন হবে সেই সুসময়! শ্যাম জানে না। মাঝে মাঝে সে কেবল তার চারধারে দেখতে পায় সেইসব সুসময়ের অনেক চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে। যেমন পাখির মুখ থেকে খসে পড়া ফসলের বীজ দেখে বোঝা যায় যে, কাছাকাছি এইখানে কোথাও ফসল ফলেছিল, যেমন আকাশের মেঘ দেখলে বোঝা যায় আমাদের বীজক্ষেত্রে বৃষ্টি হবে।

কিংবা কে জানে এইটাই সেই সবচেয়ে সুসময় কি না যা শ্যাম পেরিয়ে যাচ্ছে!

দুপুর রোদ মাথায় করে শ্যাম তার রোজকার পরিচিত থামটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এত আলোর মধ্যেও তার মনে হচ্ছিল যে, চারধারে ছায়ার মতো অলীক অনর্থক মানুষেরা অকাজে হেঁটে যাচ্ছে। সবকিছুই বস্তুত অবাস্তব, একমাত্র সামনের ওই কাচের দরজাটা ছাড়া। ওপাশে লীলা বসে আছে। ব্যস্ত কর্মঠ তার দুটি সাদা সুন্দর হাত, অল্প গম্ভীর ও বিষণ্ণ তার মুখ। শ্যাম জানে লীলা এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসেনি। এখনও বড় দয়ালু ওর মন, আঘাত করার আগে তাকে সতর্ক হওয়ার সময় দিচ্ছে। শ্যাম জানে, খুব শিগগিরই একদিন রাস্তার লোকেরাই তাকে ঘিরে ধরবে, চোখ পাকিয়ে তাকে সরে পড়তে বলবে। শুধু যতদিন তা না ঘটবে ততদিনই বড় সুসময়। সবচেয়ে সুসময়।

তারপর একদিন হয়তো সে ইরফানের কাছে সোজা গিয়ে বলবে, আমি পাকিস্তানে চলে যাব। আমাকে সীমানা পার করে দাও।

কিংবা সে হয়তো ঘুরে ঘুরে কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করার চেষ্টা করবে সতেরোটা ঘুমের বড়ি যা হাতে নিলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া যায়, বালিশের পাশে নিয়ে শুলে কেটে যায় ভয় কিংবা ভবিষ্যৎ-চিন্তা।

কী করবে তা ঠিক জানে না শ্যাম। কেবল মনে হয়, এখনই হয়তো সবচেয়ে সুসময়।

আজও লীলা কাচের দরজার সামনে এসে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। দ্বিধা! কিংবা অপেক্ষা! তারপর শ্যামকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে দরজা খুলে লীলা রাস্তায় নেমে এল। একা। ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগল।

প্রথমে কিছুক্ষণ এটা বিশ্বাস করল না শ্যাম। তারপর বুঝল মেয়েটা লীলাই, এবং সে একা হেঁটে যাচ্ছে। ধীর পায়ে।

নিঃশব্দে শ্যাম তার থামে হেলানো শরীব তুলে আনল। তার শরীর কাঁপতে থাকে, নানা রহস্যময় অনুভূতি তার ভিতরে খেলা করে যায়। তার খুব জোরে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে, হাঁটু গেড়ে বসে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। তুমি লীলা! তুমি কি লীলা! আমার সঙ্গে এক সমতলে তুমি হেঁটে যাচ্ছ। একা।

নিঃশব্দে বেড়ালের মতো পায়ে, গোয়েন্দার মতো সন্ধানী চোখে লীলাকে রেখে, ভিড়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে শ্যাম হাঁটে। হেঁটে যায়।

গাঢ় বাদামি জমির ওপর ফ্যাকাশে কলকা এবং আরও নানা জ্যামিতিক ছাপ দেওয়া একটা শাড়ি পরেছে লীলা, মোটা একটা বেণিতে বাঁধা তার চুল। পিছন থেকেও লীলাকে বড় পবিত্র দেখাচ্ছে। অলস মন্থরভাবে সে হাঁটছে, বাঁ হাতটা বুকের ওপর গোটানোবোধ হয় সে তার সাদা ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে আছে, গলায় জড়ানো কাশ্মীরি স্কার্ফের আঁচল উড়ছে হাওয়ায়।

রাস্তায় ভিড়, তবু ভিড়টাকে যথেষ্ট বলে মনে হয় না শ্যামের। তার এবং লীলার মধ্যে অনেকটা শূন্য জমি। লীলা ঘাড় ঘোরালেই চোখাচোখি হয়ে যেতে পারে। তার শুন্য বুকের ভিতরে লাফিয়ে ছুটছে হরিণ, শরীরের ভিতরে রহস্যময় মেঘ ডেকে ওঠে, বৃষ্টি নামে, কালো একটা রেলগাড়ি খুব লম্বা একটা পুল পেরোতে থাকে। যদি চোখাচোখি হয়—যদি চোখাচোখি হয়ে যায়। যদি কথা বলে লীলা! যদি প্রশ্ন করে, তুমি কে?

ভাবতেই জড়িয়ে আসে শ্যামের হাত-পা। খালি রাস্তায় সে হোঁচট খায়। হাসে। আবার হাঁটে। তা হলে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে যাবে, অদৃশ্য থেকে নেমে আসবে এক ঢল জলের প্লাবন, হয়তো বা কথা বলে উঠবে রাস্তাঘাট! আর তখন নিশ্চিত নিজের পরিচয় ভুলে যাবে শ্যাম, লীলার সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ-ভুলে-যাওয়া বাচ্চা ছেলের মতো ভীত চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিড় বিড় করে বলবে—প্রশ্ন কোরো না আমি কে। আমি জানি না।

সামনের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় ভিড় জমে আছে। পুলিশের উত্তোলিত হাত চলন্ত গাড়িগুলো আটকে দিল। লীলা সামান্য থেমে আবার হাঁটে। রাস্তা পার হয়। ধীর মন্থর তার গতি কোনওখানে যাওয়ার তাড়া বা লক্ষ্য নেই তার। চারধারে অর্থহীন অলীক ছায়ার মতো লোকজন। শ্যাম এদের কাউকেই চেনে না, জানে না এরা বাস্তবিক আছে কি না। এরাও কি তা জানে! শ্যাম এইসব ছায়া ভেদ করে হেঁটে যায়। বাসস্টপ থেকে কারা যেন লীলাকে উদ্দেশ করে বলে, বাঃ বেশ। অমনি গরগর করে ওঠে শ্যাম, অন্ধের মতো রুখে ঘুরে দাঁড়ায়, ফিস ফিস করে চাপা হিংস্র গলায় বলে, সাবধান! আমি পাহারায় আছি। হাসে। আবার হাঁটতে থাকে। নিজেকে বড় জীবন্ত মনে হয় তার। শরীরের ভিতরে কলকারখানা চলার আওয়াজ। সুসময়…পৃথিবীতে এটাই বোধহয় সবচেয়ে সুসময় যা শ্যাম পেরিয়ে যাচ্ছে।

লীলার গতি ক্রমে আরও মন্থর হয়ে আসে। সে অন্যমনে ফুটপাথের আরও ধার ঘেঁষে যায়, মুখ ফিরিয়ে শো-কেসের জিনিস দেখতে দেখতে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যায়, মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখে, তারপর পা পা করে হাঁটতে থাকে। লীলাকে যতটা অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ততটা সে নয়— শ্যাম জানে। লীলার শরীর সতর্ক, কান উদগ্রীব সে জানে যে, শ্যাম তার পিছনে আছে। খোলামেলা রাস্তায় একা অরক্ষিত লীলা। কে জানে লীলা তাকে নিঃশব্দে বলছে কিনা-কাছে এসো। ভাল করে দেখতে দাও তোমার মুখ। তোমরা কি হিন্দু? তোমরা কী গোত্র? তোমার নাম পরিচয় আমাকে বলো। তোমার বাড়ি-ঘরদোরের অবস্থা আমাকে বলো। তোমরা ক’ ভাইবোন? আর তোমার চাকরি…?

এ-সবকিছুই খুব জরুরি প্রশ্ন। লীলার জানা দরকার। শ্যাম তাই মনে মনে উত্তর দিয়ে দেয়—শ্যাম চক্রবর্তী আমার নাম, বাবা কমলাক্ষ চক্রবর্তী আমরা শাণ্ডিল্য গোত্র, বিক্রমপুরের বানিখাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি…না আমার ভাই নেই, এক বোন, মুর্শিদাবাদে তার বিয়ে হয়েছিল, তারপর আর খবর জানি না…সেইন্ট অ্যান্ড মিলারে আমি ছিলাম ছোটসাহেব, ওপরওয়ালা বাস্‌টার্ড বলে গাল দেওয়ায় আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম…তবু সত্যি বলতে কী আমি জানি না আমি কে কিংবা আমি কীরকম…

লীলা আস্তে আস্তে হাঁটে, যে-কোনও দোকানের সামনে একটু দাঁড়ায়, শো-কেস দেখে নেয়, আবার হেঁটে যায়। সাহসী লোকেরা তার কাছ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে।

ক্রমে লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে চলে এল তারা। রাস্তা ক্রমে ফঁাকা হয়ে আসছে। রাস্তা পার হওয়ার আগে লীলা একবার ফিরে তাকায় অন্যমনে। অবহেলার চোখ তাচ্ছিল্য ফুটে আছে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেয়। তবু বঁড়শির মতো সেই দুটি চোখ শ্যামের বুকের মধ্যে গেঁথে যায়। তার শরীর যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে। বুকের মধ্যে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।

নিঃশব্দে লীলা বলে ওঠে, কাছে এসো।

শ্যাম আপনমনে মাথা নাড়ে। না। আমি জানি কাছে যেতে চেষ্টা করলে চারদিকের বাড়িঘর কেঁপে উঠবে, মাঠ ময়দান থেকে শিকড় ছিঁড়ে ছুটে আসবে গাছপালা, বাতাস আর্তস্বরে চেঁচিয়ে বলবে, রক্ষা করো, রক্ষা করো; আমি জানি, এখানে নয়, অন্য কোনও সুন্দর পৃথিবীতে আমাদের দেখা হওয়া ভাল। এখানেনয়— এত লোকজন আর এত ভিড়ের মধ্যে নয়। দেখো একদিন খুব শিগগিরই আমি পৃথিবীতে সুসময় এনে দেব।

সে লীলার নিঃশব্দ স্বর শুনতে পায়, কথা বলো।

না। মাথা নাড়ে শ্যাম। এখনও নয়। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যই আমি আলাদা একটা ভাষা তৈরি করব, দেখো। সেই ভাষায় থাকবে না কোনও কঠিন, রূঢ় কিংবা অশ্লীল শব্দ, তাতে থাকবে না কোনও গালাগাল। এখনও মানুষের ভাষা তেমন সুন্দর নয়। এখনও তাদের জানা বহু শব্দ রয়ে গেছে যা রহস্যময়, কিংবা যা রাগ ও বিদ্বেষের, যা অবহেলা কিংবা প্রত্যাখ্যানের। আগে তুমি সেই সব শব্দ ভুলে যাও, তারপর…

লীলা রাস্তা পার হল না। বাঁয়ে মোড় ঘুরল। কয়েক পা হেঁটে একটা খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল হঠাৎ। পিছনে ফিরে অন্যমনস্ক চোখে একবার চারদিক দেখে নিল। তারপর দরজার ভিতরে চলে গেল।

শ্যাম ধীরে ধীরে দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতরে কেবল দেখা যাচ্ছে একটা সরু সিঁড়ি স্টিমারের সিঁড়ির মতো সুন্দর, লোহার চকচকে পাত বসানো, মসৃণ রেলিং, খুব উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। সিঁড়িতে লীলা নেই। উঠে গেছে। নতুন রঙের গন্ধ পাওয়া যায়, আর মৃদু খুব মৃদু পাউডারের গন্ধ।

এটা কি রেস্তরাঁ।শ্যাম কয়েক পা পিছিয়ে এসে দরজার ওপরে দেখল— রেস্তরাঁ। সাইন বোর্ডে নাম লেখা আছে। শ্যাম জানে এখানে লীলার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে। শ্যামের জানা দরকার নোকটা কে! সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কোনও মোটর-সাইকেল দাড় করানো আছে কি না। নেই।

কোনও দ্বিধাই বোধ করল না শ্যাম। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল।

.

হলঘরের মতো প্রকাণ্ড একটা ঘর। এত উজ্জ্বল আলো জ্বলছে যে শ্যামের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পেয়ালা পিরিচ চামচ কিংবা টেবিলের কাচের চাদর থেকে ঠিকরে এসে আলো তার চোখে আলপিনের মতো বেঁধে। কিছুক্ষণ সে ভাল করে লীলাকে দেখতে পেল না। সে তার রুক্ষ চেহারা এবং এলোমেলো পোশাকে এই ঝকঝকে ঘরে বেমানান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর লীলাকে দেখতে পেল সে। প্রায় ফাঁকা রেস্তরাঁ। কয়েকটিই মাত্র লোক ছড়িয়ে বসেছে, একেবারে কোনও দূরের টেবিলে বসছে লীলা, টেবিলের ওপর অল্প নোয়ানো কাধ, মুখ নিচু—যেন টেবিলের কাচে সে তার মুখের ছায়া দেখছে। না, লীলা একা নয়, তার মুখোমুখি উলটো দিকের চেয়ারে বসে আছে সুন্দর চেহারার একটি লোক।

অরুণ না! ভ্রূ কুঁচকে শ্যাম দেখে, তারপরে মৃদু হাসে। হ্যাঁ, অরুণই।

অরুণ তাকে প্রথম দেখতে পেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো লাফিয়ে উঠল অরুণের, কপালে পড়ল ভাজ। মুখ সামান্য ফঁক হয়ে রইল একটুক্ষণ। শ্যাম বুঝল না, কেন এরকম হল অরুণের! সে মৃদু হাসিমুখে চেয়ে রইল অরুণের দিকে।

সামান্য ফিসফিস করে অরুণ বলল, শ্যাম! অনেকক্ষণ পর হাসল, আয়। আশ্চর্য যে, লীলা তার দিকে ফিরেও তাকাল না।

অরুণের ডাকটাকে গ্রাহ্য করল না শ্যাম। মাঝখানের তিনটে টেবিল সে বাদ দিয়ে বসল। একা। এক কাপ চায়ের কথা বলে দিল বুড়ো বেয়ারাকে।

আড়চোখে সব কিছু লক্ষ করে শ্যাম। অরুণের মুখ অল্প লাল। তাকে লাজুক আর ভিতু দেখাচ্ছে। খুবই আশ্চর্য হল শ্যাম। এরকম হওয়ার কথা ছিল না। তার নিজের অতীতের মতোই অরুণের চরিত্র–সে জানে। অন্য কোনও লোকের বদলে অরুণকে দেখে শ্যাম বরং স্বস্তি পায়। শ্যাম জানে যে, সে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ অরুণের কাছ থেকে লীলার কোনও ভয় নেই। শ্যাম নিজে অরুণের চেয়ে অনেক পাকা লোক ছিল।

সে লক্ষ করল, অরুণ কথা বলছে না লীলার সঙ্গে। সে কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো আলুর বড়া মুখে পুরে ভয়ংকর জোরে উত্তেজিত ভাবে চিবোচ্ছে। ঝনন করে তার চামচ পিরিচের সঙ্গে ঠুকে শব্দ করে ওঠে। অকারণে রুমালে মুখ মোছে অরুণ, তার চোখ লীলার নোয়ানো মাথার ওপর দিয়ে সামনের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়। সুন্দর চেহারা আর সুন্দর পোশাকে অরুণের ওই ভাবভঙ্গি খুব বেমানান লাগে শ্যামের কাছে।

লীলা খুব ঠান্ডা এবং সহজ ভঙ্গিতে বসেছে এখন। নোয়ানো মাথা তুলে অরুণের দিকে চেয়ে দেখছে। তার মুখে একটু স্মিত কৌতুকের ভাব। হঠাৎ সে তার একটু তীক্ষ্ণ পাখির মতো মিষ্টি গলায় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে বলল, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন।

অরুণ সামান্য অস্থির অস্বস্তির হাসি হাসে, মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

আমি এসেছি।

খুব মৃদু গলায় অরুণ কিছু বলল। শ্যাম শুনতে পেল না। শুধু দেখল, অরুণের কথার উত্তরে লীলা শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।

লীলাকে কেন এখানে ডেকে এনেছে অরুণ তা শ্যাম বোঝে। তবু লীলাকে খুব শান্ত ও দৃঢ় দেখায় যেন লীলার সঙ্গে আছে কোনও সমর্থ লোক, যে লীলাকে আপদে রক্ষা করবে। লীলার চোখে-মুখে সেই প্রত্যয় দেখে শ্যাম। লক্ষ করে, অরুণ তার শুকনো ঠোঁট চাটছে, এবং বোকার মতো এড়িয়ে যাচ্ছে শ্যামের চোখ। শ্যাম মৃদু হাসে। তার সামনের টেবিলে রাখা এক কাপ চা আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যেতে থাকে।

ওরা আর কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। লীলার সামনে রাখা খাবারের প্লেট পড়ে থাকে। শ্যাম একটু বিস্মিত হয়— লীলা কি জানে না যে শ্যাম তার খুব কাছেই বসে আছে।

লীলা জানে। একটু পরেই শ্যাম সেটা টের পায়।

বাঁ হাতে জলের গ্লাস ধরে ডান হাতে লীলা তার বেণিটা বুকের ওপর টেনে আনে। ওইভাবে কৌশলে ঘাড় কাত করে অরুণের অজান্তে লীলা হঠাৎ সোজা শ্যামের দিকে তাকায়। যেন লীলা একবারও ঘাড় না ঘুরিয়েই জানত শ্যাম কোথায় বসে আছে। তার চোখের ওপর লীলার চোখ ঝলমল করে ওঠে। আর সেই মুহূর্তে খুব চমকে উঠে শ্যাম দেখতে পায়, লীলা একটু হেসেই হাসিটা ঠোঁটে টিপে দিল, তার চোখ আঙুলের মতো একটু সংকেত করে দেখিয়ে দিল অরুণকে। নিঃশব্দে কয়েক পলকে এইসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। তারপরই স্বাভাবিকভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল লীলা।

আস্তে আস্তে বুঝতে পারে শ্যাম। বুঝতে পারে আজ বিকেলে ইচ্ছে করে কেন একা ধীরে ধীরে এতদুর হেঁটে এল লীলা। লীলা জানত শ্যাম তার পিছু নেবে। তাই এতদূর কৌশলে তাকে টেনে এনেছে লীলা। লীলা ঘাড় না ঘুরিয়েও জানত যে, সে খুব কাছেই বসে আছে। লীলা জানে যে, যে-কোনও আপদে-বিপদে শ্যাম তাকে রক্ষা করবে। তাই সে কৌশলে শ্যামকে বলে দিল—এই লোকটার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।

নিজের ভিতরে শীতল এক নিষ্ঠুরতা অনুভব করে শ্যাম। দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো শক্ত হয়ে যায় তার চোয়াল। সে অরুণের দিকে চেয়ে থাকে। তার রক্তে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে থাকে। আর একটিমাত্র ইঙ্গিতের জন্য তার সমস্ত শরীর প্রস্তুত থাকে।

মৃদু স্বরে কথা বলে অরুণ। বিরক্তিতে মাথা ঝাকায় লীলা। না। না, না। তারপর কিছুক্ষণ এরকম চলে। শান্তভাবে বসে থাকে শ্যাম। অপেক্ষা করে। তার মাথার ভিতরে ধীরে ধীরে আর সব বোধ লুপ্ত হয়ে যায়, শুধু কুয়াশার মতো জমে ওঠে রাগ।

শ্যাম দেখে, অরুণ বিল মিটিয়ে দিচ্ছে। টেবিলের ওপর থেকে সাদা হাতব্যাগ তুলে নিচ্ছে লীলা। ওরা উঠে দাঁড়াল। ওরা হেঁটে এল, সামনে লীলা। একবার–সেটাও ভুল হতে পারে মাত্র একবার শ্যামের মনে হল, লীলার চোখ তার টেবিলের একটা কোণ ছুঁয়ে গেল।

অরুণ তার দিকে চেয়ে হাসল। সে হাসিতে কোনও ইচ্ছা বা প্রাণ নেই। সেই উঁচু ফিসফিস স্বরে বলল, শ্যাম! একটু দ্বিধায় দাঁড়াল, বলল, পরে কথা হবে।

লীলা ফিরে তাকাল না। তার দরকারও নেই। শ্যাম বোঝে।

সিঁড়ির চৌখুপিতে ওরা নেমে গেলে উঠে দাঁড়াল শ্যাম। তাড়াতাড়ি একটা ট্রে হাতে ছুটে এল বুড়ো বেয়ারা। বিরক্তিকরভাবে পথ আটকাল। পকেটে হাত দিয়ে খুচরো পয়সা যতখানি হাতে পেল, তুলে এনে ঝনাৎ করে তার ট্রে-তে ফেলে দিল শ্যাম। তারপর আর ফিরেও তাকাল না।

নীচে নেমে এসে দেখল কোথাও কেউ নেই, তাড়াহুড়ো করে ওদের খুঁজল না শ্যাম। ধীরে ধীরে হেঁটে এসে নিশ্চিন্ত মনে বাস ধরল।

হোটেলে ঢুকে ভূত দেখে আঁতকে উঠল শ্যাম। সুবোধ মিত্র! অনেককালের পুরনো বন্ধুর মতো হাসল মিত্র।

কাল আসেননি। শ্যাম জিজ্ঞেস করে।

না। মিত্র মাথা নাড়ে, কাল একটা বরযাত্রী গিয়েছিলুম।

শ্যাম উলটো দিকে মুখোমুখি বসে।

মিত্র বলল, কাল একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলুম মশাই। বরযাত্রী গিয়েছিলুম পুটিয়ারি পশ্চিম না দক্ষিণ ঠিক মনে নেই, টালিগঞ্জের খাল পেরিয়ে যেতে হয়। ও-সব গ্রাম-গঞ্জ ছিল কিছুকাল আগেও। কিন্তু গিয়ে শুনলুম ওটাও নাকি কলকাতা…হাঃ হাঃ–দু’দিন পরে আপনি যে-দিকেই যাবেন, যতদূর যাবেন, দেখবেন কলকাতা আর কলকাতা…কলকাতার শেষ নেই আর…লাফিয়ে লাফিয়ে শহর বেড়ে যাচ্ছে মশাই, গ্রাম-গঞ্জ খেত-খামার যা পাচ্ছে হাতের কাছে তাতেই স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেক্যালকাট্টা!…হাঃ হাঃ…বাড়তে বাড়তে একদিন এই কলকাতাই না দুনিয়াময় হয়ে যায়!…হাঃ হাঃ…এতকাল কলকাতার মাঝখানে থেকে টেরও পাইনি যে, কলকাতা কেমন বেড়ে যাচ্ছে চারদিকে! এর পর আর কলকাতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যাওয়া যাবে না মশাই, খুব অদ্ভুত ব্যাপার হবে, দেখবেন! তখন পাহাড়ে যাবেন তাও কলকাতায়, সমুদ্রে যাবেন তাও কলকাতায়; তখন কলকাতায় জন্মে সারাজীবন কলকাতাতেই ঘুরে মরবে লোক…হাঃ হাঃ…

খাওয়া হয়ে গেলে একসঙ্গে বেরোল দু’জন। শ্যাম গুনে দেখল আজ পনেরোটা কুকুর। সে হঠাৎ বলল, কুকুর খুব বেড়ে যাচ্ছে, দেখেছেন!

হা। মাথা নাড়ে মিত্র। হেসে বলে, আমাদের ম্যানেজার লোকটা খুব কুকুরভক্ত। তারপর একটু গলা নামিয়ে বলল, বোধহয় রোজ মহাভারত পড়ে…হাঃ হাঃ…

.

মিত্রকে গড়িয়াহাটায় ছেড়ে দিয়ে ঘরের দিকে ফিরল শ্যাম। দূর থেকেই দেখল বাসার সামনে রাস্তার ফুটপাথে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে। তার টাইয়ের নট’ ঢিলে হয়ে গেছে, রাস্তার মৃদু আলোতে তার মুখটা লাল আর চোখ দুটো হতভম্ব দেখায়।

ওঃ শ্যাম! অরুণ সামান্য টলমলে পায়ে এগিয়ে আসে, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোকা-হাসি হাসে, ততার সঙ্গে কথা আছে…

শ্যাম তার হাত ছোঁয় না। দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকে দেখে। নিজের ভিতরে শীতল এক নিষ্ঠুরতাকে অনুভব করে সে। ঠান্ডা গলায় বলে, আয়।

হুইস্কির চেনা গন্ধ পায় শ্যাম। সামান্য অস্থির পায়ে অরুণ তার পিছনে হেঁটে আসে। আসতে আসতে কথা বলে, ওঃ, শ্যাম, আমার বড় কষ্ট রে। আমি আর পারছি না রে।

হুইস্কির চেনা গন্ধবহু দূর অতীত থেকে ওই গন্ধ ভেসে আসছে। স্বাদ ভুলে গেছে শ্যাম। ভাবতে ভাবতে সে সিঁড়ি ভাঙে। পিছনে অরুণ।

ঘরে ঢুকে অরুণ হাঁফায়, বিছানায় বসে পড়ে, তারপর বালিশ টেনে নিয়ে আধশোয়া হয়। তার সুটের ভাজ নষ্ট হচ্ছে, সেদিকে তবু খেয়াল করে না অরুণ। বলে, তুই দেখেছিস। তুই সব দেখে বুঝে নিয়েছিস শালা…তোকে আমি…বলতে বলতে আবার দৃষ্টি শূন্য হয়ে যায় অরুণের। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।

শ্যাম তার চেয়ার জানালার কাছে টেনে আনে, তার ওপর একখানা পা তুলে দিয়ে দাঁড়ায়। অরুণকে দেখে।

কী বলছিল তা ভুলে গিয়ে অরুণ বলল, ওঃ তোকে আমার শ্বশুরের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, না? তোর হয়ে যাবে শ্যাম, তুই ভাবিস না। আমি বাইরে যাওয়ার আগে তোকে বসিয়ে দিয়ে যাব। বোকার মতো অর্থহীন হাসি হাসে অরুণ, আমি অনেক কিছু পারি, জানিস। আমি শালা অনেক কিছু…ধীরে ধীরে চোখ বোজে অরুণ। বমি করার আগের মুহূর্তের মতো শরীর কেঁপে ওঠে তার, চোখ ঠিকরে ওঠে, মুখ লাল। আবার সামলে যায় অরুণ। হাঁফায়। বলে, তবু কী বলব, ওই বুড়োটাকে আমি ভয় পাই, ওই শালা বুড়ো আমার সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে, ইচ্ছে করলে ও আমায় বাঁদরনাচ নাচাতে পারে, শালা হারামির বাচ্চা…বলতে বলতে আবার বমির ভাব সামলে নেয় অরুণ— আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে শালা, শাসিয়েছে দরকার হলে আমাকে গুতা দিয়ে মারবে…

কে! শ্যাম ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে।

আমার বউয়ের বাপ। শালা শ্বশুর…শালা একটা সুন্দর মেয়ের জন্ম দিতে পারেনি মাইরি, তবু শালা শ্বশুর! আমার শ্বশুর!…তুই ভাবতে পারবি না শ্যাম, আমার বউটা কী কুচ্ছিত, ঘর অন্ধকার করে দেওয়ার চেহারা!…তবু আমাকে ইন টাইম ঘরে ফিরতে হবে শালা, না হলে আমি চরিত্রহীন!…আমার বউটাকে যদি তুই দেখতিস শ্যাম। ও যদি অ্যাডালটারি করতে চায় শেয়ালেও ঘেঁবে না ওকে…বলতে বলতে বিছানা থেকে মুখ বের করে মাথা নামায় অরুণ। সমস্ত শরীরে হেঁচকি তোলার মতো কাঁপুনি। শ্যাম লক্ষ করে, ঘোলা জলের স্রোত অরুণের মুখ থেকে কলের জলের মতো ধারায় নেমে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে তার ঘরের মেঝে। মুহূর্তেই হুইস্কি আর টক বমির গন্ধে ঘর ভরে যায়। বিষিয়ে ওঠে বাতাস। শ্যাম তবু একটুও নড়ে না। পাথরের চাঙড়ের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অরুণকে লক্ষ করে।

ধীরে ধীরে মুখ তোলে অরুণ। কোনও দ্বিধা না করে শ্যামের বালিশ থেকে ময়লা ভোয়ালেটা তুলে নিয়ে মুখ মোছে, আবার সেটা বালিশে পেতে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর অধৈর্য ক্লান্ত একটা হাত বাড়িয়ে বলে, সিগারেট!

শ্যাম তার সস্তা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বিছানায় ছুড়ে দেয়। অনেক কষ্টে সিগারেট ধরায় অরুণ, আগুনের ফুলকি ঠিকরে পড়ে বিছানায়।

আমার শরীরে শালা চিতাবাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তবু শালা আমাকে ইন টাইম ঘরে ফিরতে হবে, তারপর ওই কুচ্ছিত বউটা…মাইরি, একটু লাবণ্য নেই, ডায়েট কন্ট্রোল না করেও এমন হাড়গিলে…ওঃ অ্যামেরিকা…

বালিশে মাথা গুঁজে দেয় অরুণ। কিছুক্ষণ যেন স্বপ্নের ঘোরে একটু হাসে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তোলে আবার। অপরিচিতের চোখে শ্যামের দিকে ঐ কুঁচকে তাকায়, শ্যাম।

তারপর কথা ভুলে গিয়ে আবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।

তুই জানিস না শ্যাম, আমার পিছনে লোক লেগে আছে। কিছুতেই সেই লোককে ধরতে পারছিনা। আমার সব খবর সে দিয়ে দিচ্ছে শালা বুড়োকে। আমি রেস্তরাঁর পর রেস্তরা পালটাচ্ছি, কত গলিঘঁজিতে চলে যাচ্ছি মেয়েছেলে নিয়ে, কত অচেনা জায়গায় যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই পালাতে পারছি, লুকিয়ে থাকতে পারছি না। বুড়ো আমাকে দাড় করিয়ে আমার সারাদিনের সব গোপন রিপোর্ট আমাকেই শুনিয়ে দিচ্ছে।…মাইরি, তারপর চাকরবাকরের মতো ট্রিট করছে, বাচ্চা ছেলের মতো ধমকাচ্ছে…। কী করে যে খবর পাচ্ছে…

তারপর হঠাৎ হাসে অরুণ, দাঁড়া শালা, একবারই আমি শালা পালাব, ভিসাটা হাতে পাই, তারপর জেটইওর ওয়ে টু অ্যামেরিকা…ভোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ…।

যে-হাতে এরোপ্লেনের ভঙ্গি করে দেখাল অরুণ, সেই হাতটাই হঠাৎ মুঠো পাকিয়ে চাপা গলায় বলল, কিন্তু কে খবর দিচ্ছে। আমি শালা কিছুতেই ধরতে পারছি না, কে!…রাস্তায় হাঁটি, রেস্তরাঁয় বসি, বারে যাই, কিন্তু সবসময়ে আমার ঘাড় সুড় সুড় করে, পিঠের চামড়ায় যেন কার চোখ টের পাই। সবসময়ে ভয়-ভয়, চিন্তা, টেনশন। কে খবর দিচ্ছে। কে!

বাতাসে শূন্য চোখে চেয়ে অরুণ জিজ্ঞেস করে, কে! তারপর আবার ককিয়ে ওঠে, তুই জানিস না শ্যাম, অ্যামেরিকা যাওয়ার মাঝপথ থেকে ওই বুড়ো আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। ইচ্ছে করলে তছনছ করে দিতে পারে আমার ক্যারিয়ার, যখন খুশি ভয় দেখাতে পারে আমাকে…মেয়ের নামে তিনটে বাড়ি দিয়েছে শালা, দুলাখ টাকা। আমি শালা বড়লোক। কিন্তু সব কেড়েকুড়ে নিতে পারে আবার। ইচ্ছে করলে…ইচ্ছে করলে আমাকে হাওয়া করে দিতে পারে…অথচ আমার শরীরে চিতাবাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটা সুন্দর মেয়ের জন্য…একটা সুন্দর কিছুর জন্য…আমি শালা…

আস্তে আস্তে চোখের জল ঝরে পড়ে অরুণের। কোনও শব্দ হয় না, শুধু ঠোঁট দুটো কাপে। শ্যাম স্থির দাঁড়িয়ে দেখে। আস্তে আস্তে শ্যামের দিকে তাকায় অরুণ, ফোঁপানো গলায় বলে, তুই আজ আমাকে দেখেছিস!

শ্যাম মাথা নাড়ে। হ্যাঁ।

অরুণ বলে, তোকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। বলে অস্বস্তির হাসি হাসল, অনেক দিন তোর খোঁজখবর রাখিনি, জানি না সত্যিই এখন কী করছিস। সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হলে অনেক কথা বলে দিয়েছিলাম। আজ তাই হঠাৎ তোকে দেখে কেমন যেন মনে হল তুই-ই আমার শ্বশুরের সেই লোক। বলে হাসে অরুণ, তোকে পাকা মস্তানের মতো দেখাচ্ছিল।

উত্তর দেয় না শ্যাম। স্থির দাঁড়িয়ে অরুণকে দেখে।

আস্তে আস্তে অরুণের মুখ থেকে হাসি সরে যায়। ভিখিরির মতো গলায় সে বলে, আমি তোর জন্য সব করব শ্যাম। আমি অনেক কিছু পারি। আমি শালা পালাতে চাই। একবার যেতে পারলে আমি আর ফিরব না।…ওই কুচ্ছিত বউ, ওই হারামি বুড়ো আর এই ভিখিরির দেশ ছেড়ে পালাতে পারলে শালা…আবার আমি বড়লোক হয়ে যাব। বলে অসহায়ভাবে চারদিকে তাকায় অরুণ, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে, আমার এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও আমার বয়স আছে…কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাবে শ্যাম, যদি তুই একবার ফোন তুলে বুড়োকে বলে দিস যে, আমি আজ লীলার সঙ্গে ছিলুম বিকেলে…

হঠাৎ আবার শ্যামের বুকের মধ্যে গুর গুর করে মেঘ ডেকে ওঠে, চমকে ওঠে বিদ্যুৎ। হরিণ দৌড়োয়। আর কালো একটা রেলগাড়ি লম্বা একটা রেল পুল পেরিয়ে যেতে থাকে।

ধীর শান্ত গলায় সে প্রশ্ন করে, তুই লীলাকে কখনও ছুঁয়েছিস?

আঁ! বলে অরুণ অর্থহীন চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দুঃখে মাথা নাড়ে, না। তারপর বদমাশের মতো হাসে, সি ইজ ইন লাভ। ততার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলেছিলুম, না? করবি আলাপ?

শ্যাম আবার বলে, আজ বিকেলে কী কী হয়েছিল?

নাথিং। হাসে অরুণ, আমরা ভাইবোনের মতো ছিলুম। বলে বড় করে শ্বাস ছাড়ে অরুণ, আজই প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। বললুম, ভিড় ছেড়ে একটু নির্জনে চলল। বলল, না। বললুম, একটু ট্যাক্সিতে ঘুরে বেড়াই চলল। বলল, না। জিজ্ঞেস করলুম, রাত্রে একা একা লাগে না? ভীষণ রেগে গেল—বলতে বলতে অরুণ হেঁচকি তুলে হেসে উঠল, আসলে মেয়েটা একেবারে বাচ্চা, আর নতুন। তার ওপর বোধ হয় এনগেজড। তবু আমি অম্বিকা হালদারের জামাই, আমাকে এড়াতে পারে না বলে এসেছিল বলতে বলতে সামান্য অহঙ্কারী হয়ে গেল অরুণের মুখ-চোখ! হেসে বলল, দূর শালা, এর চেয়ে মিস দত্ত অনেক হট ছিল। কী বাটক মাইরি…

আস্তে আস্তে উঠে মেঝেতে নিজের বমির ওপর দাঁড়াল অরুণ। বলল, শ্যাম, আমার দিব্যি মাইরি, বুড়ো যদি জানতে পারে…তোর শালা চোখ বটে! কী করে খুঁজে খুঁজে ওই রেস্তরাঁয় বের করলি আমাকে? নাকি শালা তুই সারাদিন আমার পিছনে লেগেছিলি! অ্যাঁ?

শ্যাম চুপচাপ চেয়ে থাকে। না, তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সে বুঝে যায় অরুণকে কষ্ট দেওয়ার ভার অরুণই নিয়েছে।

অরুণ তার বমির ওপর একবার পা হড়কায়, সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে চলে যায়। হাত তোলে। হেসে বলে,টু অ্যামেরিকা…! চলে যায়। দরজা পর্যন্ত মেঝেতে তার বমিতে ভেজা পায়ের ছাপ পড়ে থাকে।

শ্যাম জানালা দিয়ে দেখে অরুণ রাস্তার ধারে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে একখানা হাত শূন্যে তুলে অদৃশ্য ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করছে।

সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অরুণ ঠিক পৌঁছে যাবে–শ্যাম জানে। কাল সকালে আজকের কথা মনে থাকবে না অরুণের। প্রতিদিনই ওইভাবে আগের দিনের কথা ভুলে যেতে যেতে ঠিকঠাক মতোই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাবে অরুণ। ঘরের মেঝের দিকে চেয়ে অর্থহীন হাসল শ্যাম।

অনেক দিন পর তার ইচ্ছে করল ঘরটাকে একটু সাজায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *