একদা প্রাতঃসূর্য্যকিরণোদ্ভাসিত কদলীকুঞ্জে শ্রীমান্ হনূমান বায়ু সেবনার্থ পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। তাঁহার পরম রমনীয় লাঙ্গুলবল্লী চক্রে চক্রে কুণ্ডলীকৃত হইয়া কখন পৃষ্ঠে, কখন স্কন্ধে, কখন বৃক্ষশাখায় শোভিত হইতেছিল। চারি পাশে মর্ত্তমান, চাঁপা, কাঁঠালি প্রভৃতি নানাজাতীয় সুপক্ক এবং অপক্ক রম্ভা বৃক্ষ হইতে থরে থরে, কাঁদিতে কাঁদিতে শোভা পাইয়া সুগন্ধে দিক্ আমোদিত করিয়াছিল। বীরবর, কখন কোন গাছ হইতে এক আধটা পাড়িয়া কখন আঘ্রাণ, কখন চুম্বন, কখন লেহন এবং কদাচিৎ চর্ব্বণ করিয়া কদলীজাতীয় ফলমাত্রের অনন্ত মাধুর্য্য সম্বন্ধে বহুতর মানসিক প্রশংসা করিতেছেন। এমত সময়ে দৈবযোগে বুট, কোট, পেন্টালন, চেন, চসমা, চুরুট, চাবুকধারী টুপ্যাবৃতমস্তক এক নব্য বাবু তথায় উপস্থিত। হনূমান্চন্দ্র দূর হইতে এই অপূর্ব্ব মূর্ত্তি দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন, “কে এ? আকার ইঙ্গিতে বোধ হইতেছে, নিশ্চয় কিষ্কিন্ধ্যা হইতে এ আসিতেছে। এরূপ পরানুকৃত বেশ, গমন, চাহনি প্রভৃতি অন্য কোন দেশে অসম্ভব। এ আমার স্বদেশী ও স্বজাতি, অতএব ইহাকে আমি অবশ্য আদর করিব |”
এই ভাবিয়া, মহাত্মা পবনাত্মজ এক সরস চম্পককদলীবৃক্ষ হইতে উজ্জ্বল হরিদ্রাবর্ণ এক গুচ্ছ সুপক্ক কদলী উন্মোচন করিয়া আঘ্রাণ করিলেন। এবং তাহা ঘ্রাণে পরিতুষ্ট হইয়া অতিথিসৎকারে তৎপ্রয়োগে মনে মনে স্থির করিলেন। ইত্যবসরে সেই টুপিকোটপরিবৃত মোহন মূর্ত্তি বীরবরের সম্মুখাগত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিল। বলিল-“Good morning Mr. Hanuman! How do you do? So glad to see you! Ah! I see you are at break-fast already.”
হনূমান কহিলেন, “কিমিদং? কিং বদসি?”
বাবু। What’s that? I suppose that is the Kishkinda patois? It is a glorious country-is it not? “There is a land of every land the pride.”-and so on, as you know.
হনূ। কস্ত্বং! কস্মাজ্জনপদাৎ আগতোসি?
বাবু। (জনান্তিকে) It seems most barbarous gibberish-that precious lingo of his; but I suppose I must put up with it. (প্রকাশ্যে) My dear Monkey, I am ashamed to confess that I am not quite familiar with your beautiful vernacular. I dare say it is a very polished language. I presume you can talk a little English.
তখন সেই মহাবীর পবননন্দন সহসা মহাচক্ষুর্দ্বয় ঘূর্ণিত করিয়া বৃহৎ লাঙ্গুলপাশ বিস্তারণ পূর্ব্বক তাহা বাবুজি মহাশয়ের গলদেশে অর্পিত করিলেন। এবং কুণ্ডলী জড়াইতে লাগিলেন। তখন বাবু মহাশয় হাঁ করিয়া ফেলিলেন, মুখের চুরুট পড়িয়া গেল। বলিলেন,“I say-this seems somewhat___”
লেজের আর এক পেঁচ।
“Somewhat unmannerly-to say the least___”
আর এক পেঁচ।
“Dear Mr. Hanuman-you will hurt me.”
আর এক পেঁচ।
“Kind-good Mr. Hahneman.”
হনূমান্ তখন বাবু মহাশয়কে লেজে করিয়া ঊর্দ্ধ্বে তুলিয়া ফেলিলেন, বাবুর টুপি, চসমা, এবং চাবুক পড়িয়া গেল; কোট-পকেট হইতে ঘড়ি বাহির হইয়া চেনে ঝুলিতে লাগিল। তখন বাবুর মুখ শুকাইল-ডাকিলেন, “ও হনূমান্ মহাশয়, ঘাট হয়েছে, ছাড়! ছাড়! ছাড়! রক্ষা কর! গরিবের প্রাণ যায় |”
তখন হনূমান্, বাবুর প্রতি সদয় হইয়া তাঁহাকে ভূতলে স্থাপন পূর্ব্বক লাঙ্গুলপাশ হইতে তাঁহাকে বিমুক্ত করিলেন। অবসর পাইয়া বাবু টুপি, চসমা, চাবুক কুড়াইয়া করিলেন। হনূমান্ বলিলেন, “মহাশয়! দুঃখিত হইবেন না। আপনার বুলি ইংরেজি, বেশ কিষ্কিন্ধা, এবং মূর্খতা পাহাড়ে-রকম দেখিয়া আপনার জাতি নিরুপণার্থ আপনাকে এতটা কষ্ট দিয়াছি। এক্ষণে___”
বাবু। এক্ষণে কি?
হনূ। এক্ষণে বুঝিয়াছি যে, আপনার জন্ম বঙ্গদেশীয় কোন মহিলার গর্ব্ভে। এখন আপনি ক্লান্ত আছেন-একটা কদলী ভোজন করিবেন?
এখন বাবুজির যেরূপ জিব শুকাইয়া আসিয়াছিল, তাহাতে একটু সরস কদলী ভোজন অতিশয় আবশ্যক বলিয়া বোধ হইল-তিনি তখন প্রীত হইয়া উত্তর করিলেন,করিলেন,“With the greatest pleasure.”
হনূ। আপনার যে দেশে জন্ম, কদলী এবং বার্ত্তাকু অনুসন্ধানে আমি মধ্যে মধ্যে সে দেশে গমন করিয়া থাকি; এবং তদ্দেশীয়া সুন্দরীগণ বড়ি নামে যে সুস্বাদু ভোজ্য প্রস্তুত করিয়া থাকে, তাহাও কদাপি বিনানুমতিতে রামানুচর- সেবায় নিযুক্ত করিয়াছি। অতএব আমি বাঙ্গালা উত্তম বুঝি। অতএব মাতৃভাষাতেই আমার সঙ্গে বাক্যালাপ কর।
বাবু। তার আশ্চর্য্য কি? আপনি কলা দিতে চাহিতেছেন? আমি অতিশয় আহ্লাদের সহিত আপনার কদলী ভক্ষণ করিব।
হনূমান তখন বাবু মহাশয়কে এক ছড়া কলা ফেলিয়া দিলেন। যে দেবদুর্ল্লভ কদলী খাইয়া বাবু অতিশয় প্রীত হইলেন। হনূমান্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন কলা?” বাবু। অতি মিষ্ট-delicious!
হনূ। হে টুপ্যাবৃত মহাপুরুষ! মাতৃভাষায় কথা কও।
বাবু। ওটা আমার ভুল হইয়াছে, এইবার আমাকে Excuse করুন-
হনূ। তাই বা কাকে বলে?
বাবু। আমাকে মাপ করুন-আমি বড়-কি বলব?-ইংরেজি কথাটা forgetful- তার বাঙ্গালা কি?
হনূ। বৎস! তোমার কথোপকথনে আমি প্রীত হইয়াছি। তুমি আরও কলা খাইতে পার। যত ইচ্ছা তত খাইতে পার। গাছে আছে, পাড়িয়া দিতেছি। আর আমা হইতে তোমার যদি কোন কার্য্য সিদ্ধ হইতে পারে, তবে তাহাও আমাকে বল, আমি তৎসাধনে তৎপর হইব।
বাবু। ধন্যবাদ, হে, আমার প্রিয় বানর মহাশয়! এক্ষণে আপনার প্রতি আমি অতিশয় বাধ্য বোধ করিব, আপনি যদি দয়ালুরূপে আমাকে একটি বিষয় বুঝাইয়া দেন।
হনূ। কি বিষয়, হে বিদ্বন্?
বাবু। সেই বিষয়, হনূমান্, যাহার অনুরোধে আপনার এখানে আসিয়াছি। আপনি রামরাজ্য দেখিয়াছেন। রামরাজ্যের মত রাজ্য না কি কখন হয় নাই-কেহ কেহ বলেন, সে সকল গল্প মাত্র, fable-
হনূ। (চক্ষু আরক্ত, এবং দ্রংষ্ট্রা বিমুক্ত) রামরাজ্য গল্প! বেটা, তবে আমিও গল্প? তবে আমার এই লাঙ্গুলও একটা গল্প? দেখ্, তবে কেমন গল্প!
এই বলিয়া মহাক্রোধে হনূমান্ সেই অনন্ত কুণ্ডলীকৃত মহালাঙ্গুল আবার বাবু বেচারার স্কন্ধে স্থাপন করিলেন। তখন বাবু বিশুষ্কবদনে বলিলেন, “থাম, থাম, হে মহালাঙ্গুল, তুমিও গল্প নও-তোমার লাঙ্গুল ত নহেই-সে বিষয়ে আমি শপথ করিতে পারি। কাজে কাজেই তোমার রামরাজ্যও গল্প নহে-The proof of the pudding is in the eating thereof-কথাটা কি, তুমি রামের দাস-আমি ইংরেজের দাস। তোমার রাম বড়, কি আমার ইংরেজ বড়? আমার ইংরেজ রাজ্যে একটা নূতন জিনিস হইতেছে-তোমার রামরাজ্যে তা ছিল কি?
হনূ। জিনিসটা কি? সুপক্ক কদলী?
বাবু। তা না। local self-government.
হনূ। সে কি?
বাবু। স্থানীয় আত্মশাসন। ছিল তোমাদের?
হনূ। ছিল না ত কি? স্থানীয় আত্মশাসন ত স্থানবিশেষে আত্মশাসন? তাহা আমরা সর্ব্বদাই করিতাম। আমার আত্মশাসন ছিল লাঙ্গুলে। লাঙ্গুলে আমি আত্মশাসন না করিলে, ত্রেতাযুগের অর্দ্ধ্বেক লোক সমুদ্রে চুবনি খেয়ে মরিত। যখনই আমার লেজ সড়্ সড়্ করিত, ইচ্ছা হইত অমুকের গলায় দিই; তখনই আমি লাঙ্গুল স্থানে আত্মশাসন করিতাম-লেজটাকে পদদ্বয়মধ্যে লুক্কায়িত করিতাম। এমন কি, যে দিন স্বয়ং রামচন্দ্র সীতা দেবীকে অগ্নিতে প্রবেশ করিতে বলেন, সে দিন আমার এই স্থানীয় আত্মশাসন না থাকিলে- এই লাঙ্গুল রামচন্দ্রের গলাতেই যাইত-আমার স্থানীয় আত্মশাসনগুণে লেজ পদদ্বয়মধ্যে বিন্যস্ত হইল। আরও আমরা যখন লঙ্কা অবরুদ্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম, তখন আহারাভাবে আমাদের সকলেরই আত্মশাসন উদরে নিহিত হইয়া সে অঞ্চলে স্থানীয় হইয়া পড়িয়াছিল।
বাবু। মহাশয়ের বুঝিবার ভুল হইতেছে-সেরূপ আত্মশাসনের কথা বলিতেছি না।
হনূ। শোনই না, স্থানীয় আত্মশাসন বড় ভাল। যথা-স্ত্রীলোকের আত্মশাসন, রসনায় হইলে উত্তম স্থানীয় আত্মশাসন হইল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের আত্মশাসন শুনিয়াছি না কি ছানা সন্দেশের হাঁড়িতে স্থানীয় হইলেই বড় ভাল হয়। তোমাদের আত্মশাসন-
বাবু। কোথায়? পৃষ্ঠে?
হনূ। না। তোমাদের পৃষ্ঠ শাসনান্তরের ক্ষেত্র বটে-কিন্তু তোমাদের আত্মশাসনের যথার্থ ক্ষেত্র তোমাদের চক্ষু দুইটি।
বাবু। সে কি রকম?
হনূ। তোমাদের কান্না পাইলেও তোমরা কাঁদ না। সে ভাল। রাত্রিদিন ঘ্যান ঘ্যান, প্যান প্যান করিলে, প্রভুগণ জ্বালাতন হইবার সম্ভাবনা।
বাবু। সে যাহাই হউক, আমি সে অর্থে স্থানীয় আত্মশাসনের কথা বলিতেছিলাম না।
হনূ। তবে কি অর্থে?
বাবু। শাসন কাহাকে বলে, জানেন ত?
হনূ। অবশ্য। তোমাকে চড় মারিলে তুমি শাসিত হইলে। এই ত শাসন?
বাবু। তা নয়, রাজশাসন জানেন না?
হনূ। তা জানি। কিন্তু সে অর্থে, তুমি নিজে রাজা না হইলে আত্মশাসন করিবে কি প্রকারে?
বাবু। (স্বগত) একেই বলে বাঁদুরে বুদ্ধি! (প্রকাশ্যে) যদি রাজা দয়া করিয়া আপনার কাজ আমাদের কিছু ছাড়িয়া দেন?
হনূ। তা হলে সে রাজারই লাভ। তিনি আপনার কাজ পরের ঘাড়ে দিয়া পাটরাণী নিয়ে রঙ্গ করুন, আর আমরা তাঁর খাটুনি খেটে মরি! এই বুঝি তোমাদের রামরাজ্য? হা রাম!
বাবু। কথাটা এখনও আপনার বোঝা হয় নাই। Freedom-liberty কাহাকে বলে জানেন?
হনূ। কিষ্কিন্ধ্যার কলেজে ওসব শেখায় না।
বাবু। Freedom বলে স্বাধীনতাকে। স্বাধীনতা কাহাকে বলে জানেন ত?
হনূ। আমি বনের পশু, স্বাধীনতা জানি না ত কি তুমি জান?
বাবু। ভাল। তা যে পরিমাণে মনুষ্য স্বাধীন হইবে, সেই পরিমাণে মনুষ্য সুখী।
হনূ। অর্থাৎ যে পরিমাণে মনুষ্য পশুভাব প্রাপ্ত হইবে, সেই পরিমানে মনুষ্য সুখী।
বাবু। মহাশয়! রাগ করিবেন না। কিন্তু এ কথাগুলো নিতান্ত হনূমানের মত হইতেছে।
হনূ। আমি ত তাহাই, বাবুর মত কথাগুলি কি শুনি।
বাবু। স্বাধীনতাশূন্য মনুষ্যজন্মই পশুজন্ম। পরাধীনেরা গো মহিষাদির ন্যায় রজ্জুবদ্ধ হইয়া তাড়িত হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের রাজপুরুষেরা আজন্ম স্বাধীন-Free-born.
হনূ। আমাদের মত।
বাবু। আত্মশাসন সেই স্বাধীনের লক্ষণ।
হনূ। আমরাও সেই লক্ষণবিশিষ্ট। আমাদের মধ্যে আত্মশাসন ভিন্ন রাজশাসন নাই। আমরা পৃথিবীমধ্যে স্বাধীন জাতি। তোমরা কি আমাদের মত হইতে চাও?
বাবু। ছি! ছি! বুঝিলাম, বাঁদরে আত্মশাসন বুঝিতে পারে না।
হনূ। ঠিক কথা ভাই! আইস, দুই জনে কদলী ভোজন করি।
যোগ ও মনবিজ্ঞান পড়লাম মনে হল অমৃত পানকরলাম