১২
সবচেয়ে যেটা অবাক লাগছিল সেটা হল দ্বিতীয় ছবিটাও জাল বেরিয়ে পড়া। কিন্তু আশ্চর্য, এটা নিয়ে ফেলুদা কোনো মন্তব্যই করল না। এমনিতে ছবিটা দেখে একেবারেই জাল বলে মনে হয়নি। লালমোহনবাবু ত বললেন, ‘ইটালিতে চারশো বছর আগে শ্যামাপোকা ছিল না—এ ব্যাপারে আপনি এত শিওর হচ্ছেন কি করে? হয়ত পশ্চিম থেকেই আমদানি হয়েছে এই পোকার। শুনিচি ত কচুরিপানাও এদেশে এককালে ছিল না, সেটা নাকি এসেছে এক মেমসাহেবের সঙ্গে।’
এতেও ফেলুদা তার একপেশে হাসিটা ছাড়া কোনো মন্তব্য করল না।
পরদিন পূর্ণেন্দুবাবু এয়ারপোর্টে এলেন আমাদের সী-অফ্ করতে। ফেলুদা তাঁকে একটা ভালো টাই কিনে উপহার দিল। ভদ্রলোক বললেন, ‘চব্বিশ ঘণ্টায় একটা ছোটখাটো ঝড় বইয়ে দিলেন মশাই হংকং-এ। তবে এর পরের বার আরেকটু বেশি দিন থাকতে হবে। আপনাদের সাপের মাংস না খাইয়ে ছাড়ছি না।’
হংকং ছাড়তে সত্যিই ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু আমি জানি ফেলুদা যে-কয়েকটা মন্ত্রে বিশ্বাস করে তার মধ্যে একটা হল ‘ডিউটি ফার্স্ট’। এত রহস্যের সমাধান বাকি আছে—নকল যীশুর রহস্য, বঙ্কিমবাবু খুনের রহস্য, কুকুর খুনের রহস্য—সেগুলির একটা গতি না করে হংকং-ভোগ ফেলুদার ধাতে নেই।
বুধবার রাত্রে রওনা হয়ে বিষ্যুদবার দুপুর সাড়ে বারোটায় পৌঁছলাম কলকাতা। এয়ারপোর্টেই লালমোহনবাবুকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে আজকের দিনটা বিশ্রাম। কাল সকাল আটটা নাগাদ ট্যাক্সিতে ওঁর বাড়িতে পৌঁছে যাব, সেখান থেকে ওঁর গাড়িতে বৈকুণ্ঠপুর। ফেরার পথে ফেলুদা একবার পার্ক স্ট্রীট পোস্টআপিসে থামল। বলল, একটা জরুরী টেলিগ্রাম করার আছে; কাকে সেটা বলল না।
বাকি দিনটা ফেলুদার পেট থেকে আর কোনো কথা বার করা গেল না। ওর এই মৌনী অবস্থাটা আমার খুব ভালো জানা আছে। এটা হচ্ছে ঝড়ের থমথমে পূর্বাবস্থা। আমি নিজে অনেক ভেবেও কূলকিনারা পাইনি। এখনো যেই তিমিরে সেই তিমিরে। তার উপর একদিনের হংকং-এর ধাক্কায় এমনিতেই সব তালগোল পাকিয়ে গেছে, চোখ বুজলেই এখনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আকাশের গায়ে ঝুলছে লম্বা লম্বা চীনে অক্ষর।
পরদিন বৈকুণ্ঠপুর পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল।
নবকুমারবাবু উদ্গ্রীব হয়ে হংকং-এর কথা জিগ্যেস করাতে ফেলুদার মাথা নাড়তে হল।
‘ছবি পাওয়া যায়নি?’
‘যেটা ছিল সেটাও জাল’, বলল ফেলুদা।
‘সে কী করে হয় মশাই? দু দুটো জাল? তাহলে আসলটা গেল কোথায়?’
আমরা সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ফেলুদা বলল, ‘ওপরে চলুন। বৈঠকখানায় বসে কথা হবে।’
বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি মহাদেব মণ্ডল বসে লেবুর সরবৎ খাচ্ছেন।
‘কী মশাই—মিশন সাকসেসফুল?’ প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
‘চোরাই মাল পাওয়া যায়নি। তবে সেটা আমারই ভুল। অন্য দিক দিয়ে সাকসেসফুল বৈকি।’
‘বটে? খুনী?’
‘সে হয়ত নিজেই ধরা দেবে।’
‘বলেন কি!’
ফেলুদা আর চেয়ারে বসল না। আমাদের জন্যও ট্রে-তে সরবৎ এসেছিল, একটা গেলাস তুলে নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রেখে ফেলুদা পকেট থেকে খাতাটা বার করল। আমরা সবাই ওকে ঘিরে সোফায় বসেছি।
‘আমার মনে হয় সুরু থেকেই সুরু করা ভালো,’ বলল ফেলুদা। তারপর খাতাটা একটা বিশেষ পাতায় খুলে সেটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল—
‘২৮শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বৈকুণ্ঠপুরে দুটো ঘটনা ঘটে—নবকুমারবাবুদের ফক্স টেরিয়ার ঠুমরীকে কে জানি বিষ খাইয়ে মারে, আর চন্দ্রশেখরের ছেলে রুদ্রশেখর বৈকুণ্ঠপুরে আসেন। এটা একই দিনে ঘটায় আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল এই দুটোর মধ্যে কোনো যোগ আছে কিনা। একটা পোষা কুকুরকে কে মারতে পারে এবং কেন মারতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে দুটো উত্তর পেলাম। কোনো বাড়ির কুকুর যদি ভালো পাহারাদার হয়, তাহলে সে বাড়ি থেকে কিছু চুরি করতে হলে চোর কুকুরকে আগে থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এখানে চুরি যেটা হয়েছে সেটা কুকুর মারা যাবার অনেক পরে। তাই আমাকে দ্বিতীয় কারণটার কথা ভাবতে হল। সেটা হল, কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে কোনো বাড়িতে আসতে চায়, এবং সে ব্যক্তি যদি সে বাড়ির কুকুরের খুব চেনা হয়, তাহলে কুকুর ব্যাঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেই কারণে কুকুরকে সরানোর প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, কুকুর প্রধানত মানুষ চেনে মানুষের গায়ের গন্ধ থেকে, এবং এই গন্ধ ছদ্মবেশে ঢাকা পড়ে না।
‘তখনই মনে হল রুদ্রশেখর হয়ত আপনাদের চেনা লোক হতে পারে। তার হাবভাবেও এ বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হল। তিনি কথা প্রায় বলতেন না, ঘোলাটে চশমা ব্যবহার করতেন, পারতে কারুর সামনে বেরোতেন না। তাহলে এই রুদ্রশেখর আসলে কে? তিনি ইটালি থেকে এসেছেন, অথচ পায়ে বাটার জুতো পরেন। তিনি তাঁর পাসপোর্ট আপনার বাবাকে দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আপনার বাবা চোখে ভালো দেখেন না, এবং চক্ষুলজ্জার খাতিরে পাসপোর্ট খুঁটিয়ে দেখবেন না, তাই জাল পাসপোর্ট চালানো খুব কঠিন নয়।
‘অথচ পাসপোর্ট যদি জাল হয়, তাহলে চন্দ্রশেখরের সম্পত্তি পাবার ব্যাপারেও তিনি ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ উকিলের কাছে তিনি কোনোদিনও প্রমাণ করতে পারবেন না যে তিনি চন্দ্রশেখরের ছেলে।
‘তাহলে তিনি এলেন কেন? কারণ একটাই—চন্দ্রশেখরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের মহামূল্য ছবিটি হাত করার জন্য। ভূদেব সিং-এর প্রবন্ধের দৌলতে এ ছবির কথা আজ ভারতবর্ষের অনেকেরই জানা।
‘যিনি রুদ্রশেখরের ভেক ধরে এসেছিলেন, তিনি একটি কথা জানতেন না, যে কথাটা আমরা জেনেছি চন্দ্রশেখরের বাক্সে পাওয়া একটি ইটালিয়ান খবরের কাগজের কাটিং থেকে। এই খবরে বলা হয়েছে, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে রোম শহরে রুদ্রশেখরের মৃত্যু হয়।’
‘অ্যাঁ!’ —নবকুমারবাবু প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, নবকুমারবাবু। আর খবরটার জন্য আমি রবীনবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ।’
‘তাহলে এখানে এসেছিল কে?’
ফেলুদা এবার পকেট থেকে একটা কাগজ বার করল। একটা ম্যাগাজিনের পাতা।
‘হংকং-এ অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এই পত্রিকার পাতাটা আমার চোখে পড়ে যায়। এই ভদ্রলোকের ছবিটা একবার দেখবেন কি নবকুমারবাবু? “মোম্বাসা” নামক একটি হিন্দি ফিল্মের ছবি এটা। ১৯৭৬-এর ছবি। এই ছবির অনেক অংশ আফ্রিকায় তোলা হয়েছিল। এতে ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এই শ্মশ্রু-গুম্ফ বিশিষ্ট ভদ্রলোকটি। দেখুন ত এঁকে চেনেন কিনা।’
কাগজটা হাতে নিয়ে নবকুমারবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
‘এই ত রুদ্রশেখর!’
‘নিচে নামটা পড়ে দেখুন।’
নবকুমারবাবু নিচের দিকে চাইলেন।
‘মাই গড! নন্দ!’
‘হ্যাঁ, নবকুমারবাবু। ইনি আপনারই ভাই। প্রায় এই একই মেক-আপে তিনি এসেছিলেন রুদ্রশেখর সেজে। আসল দাড়ি-গোঁফ, নকল নয়। কেবল চুলটা বোধহয় ছিল পরচুলা। আসবার আগে তাঁর কোনো চেনা লোককে দিয়ে রোম থেকে একটা চিঠি লিখিয়েছিল সৌম্যশেখরকে। এ কাজটা করা অত্যন্ত সোজা।’
নবকুমারবাবুর অবস্থা শোচনীয়। বারবার মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নন্দটা চিরকালই রেকলেস।’
ফেলুদা বলল, ‘আসল ছবি হঠাৎ মিসিং হলে মুশকিল হত, তাই উনি কলকাতা থেকে আর্টিস্ট আনিয়ে তার একটা কপি করিয়ে নিয়েছিলেন। কোনো কারণে বোধহয় বঙ্কিমবাবুর সন্দেহ হয়, তাই যেদিন ভোরে নন্দকুমার যাবেন সেদিন সাড়ে তিনটায় অ্যালার্ম লাগিয়ে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। এবং তখনই তিনি নিহত হন।’
বৈঠকখানায় কিছুক্ষণের জন্য পিন-ড্রপ সাইলেন্স। তারপর ফেলুদা বলল, ‘অবিশ্যি একজন ব্যক্তি নন্দবাবুকে আগেই ধরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু দেননি কারণ তাঁর বোধহয় লজ্জা করছিল। তাই নয় কি?’
প্রশ্নটা ফেলুদা করল যাঁর দিকে চেয়ে তিনি মিনিটখানেক হল ঘরে এসে এক কোনায় একটা সোফায় বসেছেন।
সাংবাদিক রবীন চৌধুরী।
‘সত্যিই কি? আপনি সত্যিই পারতেন নন্দকে ধরিয়ে দিতে?’ নবকুমারবাবু প্রশ্ন করলেন।
রবীনবাব একটু হেসে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এতদূর যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও আপনিই বলুন না।’
‘আমি বলতে পারি, কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর ত আমার জানা নেই রবীনবাবু। সেখানে আপনার আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।’
‘বেশ ত, করব। আপনার কী কী প্রশ্ন আছে বলুন।’
‘এক—আপনি যে সেদিন বললেন ইটালিয়ান কাগজের খবরটা পড়তে আপনার ডিকশনারির সাহায্য নিতে হয়েছিল, সেটা বোধহয় মিথ্যে, না?’
‘হ্যাঁ, মিথ্যে।’
‘আর আপনার সার্টের বাঁ দিকে যে লাল রংটা লেগে রয়েছে, যেটাকে প্রথম দেখে রক্ত বলে মনে হয়েছিল, সেটা আসলে অয়েল পেণ্ট, তাই না?’
‘তাই।’
‘আপনি পেণ্টিং শিখেছিলেন বোধহয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায়?’
‘সুইটজারল্যাণ্ডে। বাবা মারা যাবার পর মা আমাকে নিয়ে সুইটজারল্যাণ্ডে চলে যান। মা নার্সিং শিখেছিলেন, জুরিখে একটা হাসপাতালে যোগ দেন। আমার বয়স তখন তেরো। আমি লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্ট অ্যাকাডেমিতে ক্লাস করি।’
‘কিন্তু বাংলাটা শিখলেন কোথায়?’
‘সেটা আরো পরে। ১৯৬৬তে আমি প্যারিসে যাই একটা আর্ট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। ওখানে কিছু বাঙালীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বাংলা শেখার ইচ্ছে হয়। শেষে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ক্লাসে যোগ দিই। ভাষার উপর আমার দখল ছিল, কাজেই শিখতে মুশকিল হয়নি। বছর দু’ এক হল চন্দ্রশেখরের জীবনী লেখা স্থির করি। রোমে যাই। ভেনিসেও গিয়ে ক্যাসিনি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করি। সেখানেই টিনটোরেটোর ছবিটার কথা জানতে পারি।’
‘তার মানে আপনিও একটি কপি করেছিলেন টিনটোরেটোর ছবির। এবং সেই কপিই হীরালাল সোমানি নিয়ে গিয়েছিল হংকং-এ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তাহলে আসলটা কোথায়?’ চেঁচিয়ে উঠলেন নবকুমারবাবু।
‘ওটা আমার কাছেই আছে,’ বললেন রবীনবাবু।
‘কেন, আপনার কাছে কেন?’
‘ওটা আমার কাছে আছে বলেই এখনো আছে, নাহলে হংকং চলে যেত। এখানে এসেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে ওটাকে সরাবার মতলব করছেন জাল-রুদ্রশেখর। তাই ওটার একটা কপি করে, আসলটাকে আমার কাছে রেখে কপিটাকে ফ্রেমে ভরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘আসলটা ত আপনারই নেবার ইচ্ছে ছিল, তাই না?’
‘নিজের জন্য নয়। আমি ভেবেছিলাম ওটা ইউরোপের কোনো মিউজিয়ামে দিয়ে দেব। পৃথিবীর যে-কোনো মিউজিয়াম ওটা পেলে লুফে নেবে।’
‘আপনি মিউজিয়ামে দেবেন মানে?’ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললেন নবকুমারবাবু। ‘ওটা ত নিয়োগী পরিবারের সম্পত্তি।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন নবকুমারবাবু,’ বলল ফেলুদা, ‘কিন্তু উনিও যে নিয়োগী পরিবারেরই একজন।’
‘মানে?’
‘আমার বিশ্বাস উনি রুদ্রশেখরের পুত্র ও চন্দ্রশেখরের নাতি—রাজশেখর নিয়োগী। অর্থাৎ আপনার আপন খুড়তুতো ভাই। ওঁর পাসপোর্টও নিশ্চয়ই সেই কথাই বলছে।’
নবকুমারবাবুর মতো আমরা সকলেই থ।
রবীন—থুড়ি, রাজশেখরবাবু বললেন, ‘পাসপোর্টটা কোনোদিন দেখাতে হবে ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম ছদ্মনামে এখানে থেকে ঠাকুরদাদা সম্বন্ধে রিসার্চ করে চলে যাব, আর যেহেতু ছবিটা উত্তরাধিকারসূত্রে আমারই প্রাপ্য, ওটা নিয়ে যাব। কিন্তু ঘটনাচক্রে এবং প্রদোষবাবুর আশ্চর্য বুদ্ধির জন্য—আসল পরিচয়টা দিতেই হল। আশা করি আপনারা অপরাধ নেবেন না।’
ফেলুদা বলল, ‘এখানে একটা কথা বলি রাজশেখরবাবু—পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত চন্দ্রশেখরের চিঠি পেয়েছেন ভূদেব সিং। কাজেই আইনতঃ ছবিটা এখনো আপনার প্রাপ্য নয়। কিন্তু আমার মতে ছবি আপনার কাছেই থাকা উচিত। কারণ আপনিই সত্যি করে এটার কদর করবেন। কী বলেন নবকুমারবাবু?’
‘একশোবার। কিন্তু মিস্টার মিত্তির, আপনার সন্দেহটা হল কি করে বলুন ত? আমার কাছে ত সমস্ত ব্যাপারটা ভেলকির মতো।’
ফেলুদা বলল, ‘উনি যে বাঙলাদেশের বাঙালী নন সেটা সন্দেহ হয় সেদিন দুপুরে ওঁর খাওয়া দেখে। সুক্তো কখন খেতে হয় সেটা বাঙলার বাঙালীরা ভালো ভাবেই জানে। ইনি দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে প্রথমে খেলেন ডাল, তারপর মাছ, সব শেষে সুক্তো! তাছাড়া, সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ হল—’
এবার ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল সেটা একেবারে ম্যাজিক।
উত্তরের দেয়ালের দিকে গিয়ে চন্দ্রশেখরের আঁকা তাঁর বাবা অনন্তনাথের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুটো হাত ছবির গোঁফ আর দাড়ির উপর চাপা দিতেই দেখা গেল মুখটা হয়ে গেছে রবীন চৌধুরীর!
লালমোহনবাবু ক্ল্যাপ দিয়ে উঠলেন, আর আমি অ্যাদ্দিনে বুঝতে পারলাম রবীনবাবুকে দেখে কেন চেনা চেনা মনে হত।
কিন্তু চমকের এখানেই শেষ না।
একটি চাকর কিছুক্ষণ হল একটা টেলিগ্রাম নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার সেটা নবকুমারবাবুর হাতে এল।
ভদ্রলোক সেটা খুলে পড়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘আশ্চর্য! নন্দ লিখেছে আজ সকালের ফ্লাইটে কলকাতায় আসছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
ফেলুদা বলল, ‘ওটার জন্য আমিই দায়ী, মিস্টার নিয়োগী। আপনার নাম করে কাল আমিই ওঁকে টেলিগ্রাম করেছিলাম।’
‘আপনি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম সৌম্যশেখরবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কণ্ডিশন ক্রিটিক্যাল। কাম ইমিডিয়েটলি।’
*
নবকুমারবাবুর কাছ থেকে আরো টাকা নেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আপত্তি করেছিল ফেলুদা। বলল, ‘দেখলেন ত, তদন্তর ফলে বেরিয়ে গেল আপনার নিজের ভাই হচ্ছেন অপরাধী।’ তাতে নবকুমারবাবু বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘ওসব কথা আমি শুনতে চাই না। আপনি আমাদের হয়ে তদন্ত করেছেন। ফলাফলের জন্য ত আপনি দায়ী নন। আপনার প্রাপ্য আপনি না নিলে আমরা অসন্তুষ্ট হব। সেটা নিশ্চয়ই আপনি চান না।’
নিজের ভাই অপরাধী প্রমাণ হলেও, সেই সঙ্গে যে খুড়তুতো ভাইটিকে পেলেন নবকুমারবাবু, তেমন ভাই সহজে মেলে না। টিনটোরেটোর যীশু যে এখন উপযুক্ত লোকের হাতেই গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ইউরোপের কোনো বিখ্যাত মিউজিয়ামের দেয়ালে শোভা পাবে।
আমরা আর একদিন ছিলাম বৈকুণ্ঠপুরে। ফেরার পথে লালমোহনবাবুর অনুরোধে একবার ভবেশ ভট্টাচার্যের ওখানে ঢুঁ মারতে হল। সামনের বছর বৈশাখের জন্য জটায়ু যে উপন্যাসটা লিখবেন সেটার নাম ‘হংকং-এ হিমসিম’ হলে সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে ঠিক হবে কিনা সেটা জানা দরকার।