স্বাধীন চিন্তা এবং সরকারী প্রচারণা
মন কিউর কনওয়ে যার সম্মানার্থে আজ আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি, তিনি চিন্তার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা এই দুই মহান লক্ষ্যের জন্য প্রাণপাত করেছেন। এ দু’ বিষয়ে তাঁর সময় থেকে এ পর্যন্ত অনেক নতুন কিছুর প্রকাশ এবং অনেক কিছুর বিলোপ ঘটেছে পুরনো যুগের তুলনায় নতুন বিপদ আলাদাভাবে এ দু’জাতীয় স্বাধীনতা হরনের ভীতি প্রদর্শন করেছে। এ দু’রকমের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করার জন্য যদি অতন্দ্র জনমতকে জাগরিত করা না হয় তাহলে আজ থেকে একশ বছর পর্যন্ত এ-দুরকমের স্বাধীনতার ঘাটতি পূরণ হবে না। আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য দোষগুলোকে দেখানো এবং কিভাবে সেগুলোর সঙ্গে মোকাবেলা করা যায় তা বিবেচনা করা।
স্বাধীন চিন্তা বলতে কি বোঝায় তাই নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক। এ বক্তব্যের আবার দু’রকম তাৎপর্য আছে। সংকীর্ণ অর্থে স্বাধীন চিন্তা বলতে প্রাচীন ধর্মসমূহের মতবাদকে অস্বীকার করা বোঝায়। এ অর্থে যে লোক মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সিন্টো ধর্মমত অথবা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অন্য কোন মতবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন না তাঁকে স্বাধীন চিন্তাবিধ বলা যায়। খ্রিষ্টান অধিবাসীদের দেশে যে মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করেন না তাঁকে স্বাধীন চিন্তাবিদ বলা হয়, আবার বৌদ্ধদের দেশে শুধুমাত্র স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাসই স্বাধীন চিন্তাবিদ হওয়ার প্রয়োজনীয় গুনাবলী নয়।
এ অর্থে স্বাধীন চিন্তার প্রয়োজনীয়তা আমি কম করে দেখতে চাইনে। আমি নিজে সর্ব প্রকার ধর্মমতকে অধিকার করি এবং বিশ্বাস করি যে সব প্রকারের ধর্ম বিশ্বাসের বিলয় ঘটবে। ধর্মীয় বিশ্বাস আল্লাহকে পাওয়ার শক্তি বিশেষ একথায় আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি না। আমি সব সময় স্বীকার করতে রাজি আছি বিশেষ বিশেষ যুগের বিশেষ বিশেষ স্থানে ধর্মের কিছু সুফল ফলেছে, তখন ছিল মানুষের বিচার বুদ্ধির শৈশব অবস্থা আমরা এখন সে স্তর অতিক্রম করে যাচ্ছি।
কিন্তু এ ছাড়াও স্বাধীন চিন্তার বৃহত্তর দিগন্ত রয়েছে, আমি তার প্রয়োজন আরো তীক্ষ্ণতম বলে মনে করি। প্রকৃত প্রস্তাবে পুরনো ধর্মগুলো যে মানুষের উদারতার দিগন্ত সম্বন্ধে চিন্তার পথ রুদ্ধ করেছে এ সত্য অনুসন্ধান করলে জানা যাবে সংকীর্ণ অর্থে স্বাধীনচিন্তাকে যত সহজে সংজ্ঞায়ন করা তত সহজ নয় এবং এর মূল তাৎপর্যে পৌঁছুতে হলে কিছু সময় ব্যয় করা সুবিধাজনক হবে।
যখন আমরা কোন কিছুকে স্বাধীন বলি তা কী এবং কিসের থেকে স্বাধীন তা–বলা পর্যন্ত কোন সুনিদিষ্ট অর্থ ফুটে উঠেনা। কোন কেউ অথবা কোন কিছু যখন বাহ্যিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত তখন তাকে স্বাধীন বলা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের বলা উচিত তা কী ধরনের বাধ্যবাধকতা। সব সময় বর্তমান কিছু পরিমাণ বাহ্যিক বাধা থেকে মুক্ত যখন তখনই চিন্তাকে স্বাধীন বলা যায়।এর মধ্যে কতেক স্পষ্ট প্রতিবন্ধক আছে, চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সে গুলোর অপসৃতি একই প্রয়োজন। কিন্তু এ ছাড়া আরো বাধা আছে, যেগুলো সূক্ষতর এবং সহজে ধরা যায় না।
স্পষ্টতর প্রতিবন্ধক সমূহকে নিয়ে শুরু করা যাক। চিন্তা তখন স্বাধীন থাকতে পারে না, যখন কোন মতামতকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করলে দণ্ড দিতে হয় অথবা কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করা বা বিশ্বাস না করার জন্যে কৈফিয়ত দিতে হয়। পৃথিবীর খুব স্বল্পসংখ্যক দেশে এখন পর্যন্ত এ সামান্য স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত নেই। ইংল্যাণ্ডে আল্লাহর আইনানুসারে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসের কথা উচ্চারণ করা বেআইনী; যদিও সঙ্গতিপন্নদের বিরুদ্ধে সে আইন কখনও কার্যকরী নয়। খ্রিষ্ট যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যে বিষয়গুলো খ্রিস্টের শিক্ষার পরিপন্থী সেগুলো শিক্ষা দেওয়াও বেআইনী। সুতরাং যে কেউ অপরাধী হতে না চাইলে তাকে বলতে হবে তিনি যীশুখ্রিস্টের শিক্ষার সঙ্গে একমত কিন্তু খ্রিস্ট কী বলে গেছেন তা মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। নৈরাজ্যবাদ এবং বহুবিবাহে বিশ্বাস করে না এবং একবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তাকে সাম্যবাদকেও অবশ্যই অবিশ্বাস করতে হবে। জাপানে মিকাডোর স্বর্গীয় উত্তরাধিকারীত্বের প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করা বেআইনী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর চারদিকে ভ্রমণ করে আসাটা বিপজ্জনক অভিযানের মতো। একজন মুসলমান একজন তলস্তয় পন্থী একজন বলশেভিক অথবা একজন সাম্যবাদী কিছু অংশে অপরাধী না হয়ে এ কাজ করতে পারে না অথবা তিনি গুরুত্বপূর্ণ সত্য বলে মনে করেন সে ব্যাপারে তার জিহ্বা একেবারে বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু এ ব্যবস্থা তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য সেলুনে যারা ভ্রমণ করেন তারা গায়ে পড়ে কোন ক্ষতিকর কিছু না করে যা ইচ্ছে তা বিশ্বাস করতে পারেন।
এটা পরিস্কার যে চিন্তাকে স্বাধীন করতে হলে প্রথমতঃ মতামত প্রকাশের জন্য যে আইনতঃ দণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। কোন বিশাল দেশ এখনো এই স্তরের স্বাধীনতাও অর্জন করেনি, যদিও অনেক দেশ মনে করে যে তারা জনসাধারণকে অনুরূপ স্বাধীনতা দিয়েছে। যে মতবাদগুলো এখন মানুষকে ভয়ঙ্করভাবে পীড়ন করছে সেগুলোর প্রকোপ এত ভয়ানক এবং এগুলো এতই নীতিহীন যে তার প্রতি অধিকাংশ মানুষকে সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে বলা এরকম অসম্ভব। যে কারণে মনের অনুসন্ধিৎসু প্রবৃত্তি নিপীড়ত, একই কারণে এ সকল দৈত্যের মতো প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি হয়েছে। আজকের যুগের বলশেভিক মতবাদকে যে রকম ভাবা হয়, এমন এক সময় ছিল যখন প্রোটেষ্টান্ট মতবাদকেও তেমনি মারাত্মক ভাবা হতো। দয়া করে এ মন্তব্য থেকে আমাকে কেউ বলশেভিক অথবা প্রোটেষ্টান্ট ভাববেন না।
সে যাহোক আধুনিক পৃথিবীতে আইনতঃ শাস্তি হলো চিন্তার স্বাধীনতার প্রাথমিক প্রতিবন্ধক। আর অন্য দুটো বাধা হলো অর্থদণ্ড এবং প্রমাণকে বিকৃত করবার বাধা। যদি কোন মতবাদের ফলে মানুষের জীবনধারণের পেশা মুক্ত হতে না পারে তাহলে চিন্তার যে স্বাধীনতা থাকতে পারে না সে কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আরো পরিষ্কার যে কোন বিতর্কিত বিষয়ে অন্যদিকের যুক্তি শ্রমসাধ্য অনুসন্ধানের দ্বারা আবিস্কার না করে একদিকের যুক্তিকে পুনঃ পুনঃ সুন্দরভাবে আকর্ষণীয় করে তুললে সেখানেও চিন্তার স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়। আমার জানা মতো চীনদেশ ছাড়া সকল বড় দেশে এ দুরকমের প্রতিবন্ধক বর্তমান স্বাধীনতার শেষ আবাসস্থল ছিল (বা আছে) চীনদেশ। এ সকল বাধা তাদের বর্তমান ব্যাপকতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা, এবং তা হ্রাস কিভাবে করা যায় তাই হলো আমার আলোচনার বিষয়।
বিশ্বাসসমূহের সঙ্গে স্বাধীন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পারলে আমরা চিন্তাকে স্বাধীন বলতে পারি। তার মানে, যখন সকল রকমের বিশ্বাস নিজস্ব বা কোন প্রকার আইনগত অথবা অর্থনৈতিক সুবিধা বা অসুবিধা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম। এটা হচ্ছে একটা আদর্শ, বিভিন্ন কারণে তার পুরোপুরি কখনো অর্জন করা যাবে না। আমরা বর্তমানে যেমন করি তেমনি না হাতড়ে অধিকতর সন্নিকটে এর আহবান গিয়ে পৌঁছবে।
আমার জীবনের তিনটি ঘটনা প্রমাণ করবে যে আধুনিক ইংল্যাণ্ডে খ্রিষ্টান ধর্মের স্বপক্ষেই সকল কিছু করা হয়। প্রকাশ্যে নিরীশ্বরবাদে বিশ্বাস করবার যে কি বিপদ অনেক মানুষ এখনো জানে না বলেই আমার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল আমার জীবনের খুবই শৈশবকালে। আমার বাবা ছিলেন স্বাধীন চিন্তাবিদ। আমার তিন বছর বয়সের সময় তিনি মারা যান। তার ইচ্ছে ছিলনা যে আমি কোনরকমের কুসংস্কারের মধ্যে বেড়ে উঠি; এজন্য দু’জন স্বাধীন চিন্তাবিদকে তিনি আমার অভিভাবক নিযুক্ত করেছিলেন। আদালত তার উইলকে অগ্রাহ্য করে আমাকে খ্রিষ্টধর্মে শিক্ষা দিলো। আমি ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু এর কোন প্রভাব আমার ওপর পড়েনি; তা বলে সে দোষ আইনের নয়। যদি তিনি আমাকে খ্রিস্টমতে লফিয়ান, মিউগলটোনিয়ান অথবা সেভেনথডে এডভেটিষ্ট হিসেবে শিক্ষিত করার কথা বলে যেতেন তাহলে আদালত স্বপ্নেও আপত্তি করার কথা ভাবতোনা। একজন বাবার মৃত্যুর পরে তার ছেলেকে কল্পিত কুসংস্কারে দীক্ষিত করার জন্যে বলে যাবার অধিকার আছে, কিন্তু তার ছেলে কুসংস্কার মুক্ত হিসেবে বেড়ে উঠবে একথা বলে যাবার অধিকার নেই।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ১৯১০ সালে। উদারনৈতিক পার্টির থেকে তখন আমার পার্লিয়ামেন্টের নির্বাচনে দাঁড়াবার ইচ্ছে ছিল। পার্টি হুইপ বিশেষ একটি নির্বচনী এলাকা থেকে আমার নাম সুপারিশও করেছিলেন। আমি উদারনৈতিক সভায় বক্তৃতা দান করলাম। তারা সকলে আমার সম্বন্ধে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন, সুতরাং আমার অংশ গ্রহণ করার সবকিছু এরকম ঠিকঠাক হয়ে গেলো। এর পরে আভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র একটি অভিসন্ধিপরায়ন দল আমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিরীশ্বরবাদী কিনা। জবাবে আম স্বীকার করলাম যে, আমি একজন নিরীশ্বরবাদী। তারা আরো জিজ্ঞেস করলেন যে মাঝে মাঝে গির্জায় যেতে রাজি আছি কিনা। জবাবে আমি রাজি নই বলে জানিয়ে দিলাম। তারপরে তারা আরেকজন সদস্যকে মনোনয়ন দান করলেন, যিনি ঠিকমত পাশ করে গেলেন এবং তখন থেকে পার্লামেন্টের সদস্য। তিনি বর্তমান সরকারে ও (১৯২২) একজন সদস্য।
এর অল্প কিছুদিন পরেই তৃতীয় ঘটনাটি ঘটল। আমাকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ট্রিনিটি কলেজে লেকচারারের পদ গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো, কিন্তু ফেলো হিসেবে নয়। ফেলো এবং লেকচারারের মধ্যে মাইনের কোন প্রভেদ নেই। প্রভেদ হলো কলেজের পরিচালনা ব্যবস্থায় ফেলোর ভূমিকা আছে, খুব গুরুতর নৈতিকতাহীনতার অপরাধ ছাড়া মেয়াদ ফুরাবার আগে ফেলোকে বরখাস্ত করা যায় না। কেরাণি-গোষ্ঠীর অকেরাণি সুলভ একটি ভোট বাড়ানোর ইচ্ছে না-থাকার জন্যেই আমাকে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়নি। এর ফল হলো ১৯১৬ সালে যুদ্ধ সম্বন্ধে আমার মতামতের সঙ্গে তাদের যখন মিল হলো না তখন তারা আমাকে বরখাস্ত করতে সক্ষম হলো। আমাকে যদি লেকচারারশিপের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হতো, তাহলে আমাকে অনাহারে মরতে হতো।
এমনকি আধুনিক ইংল্যান্ডেও এ তিনটি ঘটনা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনরকমের অসুবিধার দৃষ্টান্ত। অন্যান্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ স্বাধীন চিন্তাবিদেরা ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আরো ভয়াবহ দৃষ্টান্তের কথা বলতে পারবেন। নগদ ফল হলো, যে লোক পয়সাওয়ালা নয়,ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে তার অকপট ভাবে কথা বলার সাহস করা উচিত নয়। শুধু মাত্র ধর্মীয় কারণে যে স্বাধীনতার ঘাটতি ঘটেছে অথবা ধর্ম স্বাধীনতাকে বাধা দিয়েছে এটা সম্পূর্ন সত্য নয়। নিরীশ্বরবাদীতার চাইতেও সাম্যবাদের বিশ্বাস অথবা স্বাধীন ভালোবাসা একজন মানুষকে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন করে। বিশ্বাস করার চাইতেও এদের সমর্থনে যুক্তি দেখিয়ে প্রচার করা ঢের বেশী বিপজ্জনক পক্ষান্তরে রাশিয়াতে প্রকৃতভাবে এর সুবিধা অসুবিধাগুলো সম্পূর্ণভাবে আমাদের বিপরীত, সেখানে নাস্তিকতা, সাম্যবাদ এবং স্বাধীন ভালোবাসার কথা প্রচার করলে আরাম আয়েশ এবং সুযোগ সুবিধা ভোগ করা যায়। এর বিরুদ্ধে অন্য কোন রকমের মতামত প্রচার করার কোন সুযোগ সেখানে নেই। এর ফল হলো, রাশিয়াতে একদল গোঁড়া লোক কতেক সন্দিগ্ধ বিশ্বাসকে চূড়ান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, অন্যদিকে পৃথিবীর বাকি অংশে এর বিপরীত কতেক বিশ্বাসকে অন্য কোন রকমের মতামত প্রচার করার কোন সুযোগ সেখানে নেই। এর ফল হলো, রাশিয়াতে একদল গোড়া লোক কতেক সন্দিগ্ধ বিশ্বাসকে চূড়ান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, অন্যদিকে পৃথিবীর বাকি অংশে এর বিপরীত কতেক বিশ্বাসকে অন্য অবস্থার ফলে দু’দিকেই অনিবার্যভাবে যুদ্ধ, নির্যাতন এবং তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
উইলিয়াম জেমস বিশ্বাস করার ইচ্ছে (Will to believe) প্রচার করতেন, আমি ‘সংশয় পোষণ করার ইচ্ছে’ (Will to doubt) প্রচার করতে চাই। আমাদের কোন বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যের সঠিক মিল নেই। প্রত্যেক রকমের বিশ্বাসে কিছু পরিমাণ অস্পষ্টতা, এবং ভুলের মরীচিকা বুৰ্তমান। আমাদের বিশ্বাসে অধিক পরিমাণ সত্যের আমদানি কি করে ঘটাতে হয় তা সকলেরই জানা পদ্ধতি। সবদিকের বক্তব্য মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ করে, আমাদের নিজস্ব গোঁড়ামিকে বিপরীতধর্মী গোঁড়ামিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে, নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং যে সমস্ত অনুমান এবং যুক্তি অসিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে সে সমস্ত যুক্তিকে বর্জন করার মনোভাব গড়ে তুললে আমাদের বিশ্বাসকে সত্যের নিকটবর্তী করে তুলতে পারি। এ সকল পদ্ধতি বিজ্ঞানে অনুসৃত হয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করেছে। বিজ্ঞানের প্রত্যেক মানুষ যার প্রকৃত বৈজ্ঞানিক জ্ঞামের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, অবশ্যই স্বীকার করতে রাজি হবেন সে সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করতে হবে নব-আবিস্কারে প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়কেও সংশোধন করে নিতে হবে। সংশোধন করে না নেয়া হলে সকল ক্ষেত্রে অসমর্থ হলেও বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে তা বাস্তব সত্যের কাছাকাছি পৌঁছুতে সমর্থ হবে। বিজ্ঞানে যখন অনুমানে নির্ভরশীল কোনো জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় তখন তা পরীক্ষামূলক এবং সন্দেহে পরিপূর্ণ।
ধর্ম এবং রাজনীতি যদিও পক্ষান্তরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কোন আবেদন নেই তবুও প্রত্যেকে চায় যে ক্ষুধা, কারাবাস এবং যুদ্ধের ওপর নির্ভরশীল এমন একটা গোড়া নীতি তাতে থাকা প্রয়োজনীয়তাকে অন্যান্য মতামতের সঙ্গে যুক্তির আলোকে ঝালিয়ে পৃথক করে দেখবার কোন প্রয়োজন নেই। এ সমস্ত ব্যাপার মানুষ যদি পরীক্ষামূলকভাবে নিরীশ্বরবাদী ধাঁচের মনের অধিকারী হতে পারে তাহলে আধুনিক পৃথিবী দশভাগের নয় ভাগ দোষমুক্ত হতে পারত। এক পক্ষ যখন হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হবে যে উভয়পক্ষের দোষ আছে তখন যুদ্ধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তখন নির্যাতনের অবসান হবে। শিক্ষার লক্ষ্য হবে মনকে প্রসার করা সংকীর্ণ করা নয়। ক্ষমতাসীনদের অযৌক্তিক খেয়ালের অনুসারে না হয়ে মানুষকে তার ক্ষমতানুসারে কাজের জন্য বাছাই করা হবে। সুতরাং একমাত্র বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সংশয় যদি প্রবর্তন করা হয় তাহলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর সুখ সন্তুষ্টি বিধান করা যাবে।
আপেক্ষিক গুরুত্ব মতবাদের (Theory of relativity) প্রবর্তন এবং পৃথিবীতে তার ব্যাপক প্রসারে মনের বৈজ্ঞানিক মেজাজের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জার্মান সুইস শান্তিবাদী ইহুদী আইনস্টাইনকে যুদ্ধের প্রাথমিক বছরগুলোতে জার্মান সরকার গবেষণা অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করলেন। একটি ইংরেজ অভিযাত্রীদল ১৯১৯ সনে অস্ত্র সংবরণ চুক্তির পরে একটি সূর্যগ্রহণে তার মতামতের সত্যতা যাচাই করলেন। তার থিয়োরি পদার্থবিদ্যার পুরোনো থিয়োরিগত ধারণাতে এক বিপ্লবের সঞ্চার করে। ডারউইনের মতবাদ যেমন সৃষ্টিতত্ত্বের ধারণাকে চুরমার করে ফেলে তেমনি তার মতবাদও গোড়া গতিবাদের ধারণার সম্পূর্ণ নিরসন করে। তা সত্ত্বেও তার মতবাদের সমর্থনে যখন ব্যাপক প্রমাণ প্রদর্শিত হলো পদার্থবিজ্ঞানীরা সর্বত্র তা গ্রহণ করতে কোন রকমের উষ্ম প্রকাশ করেননি। তাদের কেউ, এমন কি আইনস্টাইন নিজে দাবি করতে পারবেন না যে তিনি শেষ কথা বলেছেন, একথা তিনি নিজেও বলবেন না। তিনি সমাধান করতে পারেন নি, এমন বহু সমস্যা রয়ে গেছে। সুতরাং নিউটনের মতবাদকে তিনি যেমন বিশুদ্ধ করে নিয়েছেন, তার মতবাদেরও তেমনি বিশুদ্ধিকরণের প্রয়োজন রয়েছে। এই বিশ্লেষণাত্মক গোঁড়ামিমুক্ত মনের গ্রহণশীলতা হলো সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ধর্ম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে আইনস্টাইন কিছুর উদ্ভাবন যদি করতেন তাহলে কি হতো? ইংরেজরা তার মধ্যে প্রশিয়ান উপাদান খুঁজে পেতো, ইহুদী বিরোধীরা তার মধ্যে ইহুদী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতো। সমগ্র বিশ্বের জাতীয়তাবাদীরা তার মধ্যে পুষ্প সৌগন্ধময় শান্তিবাদের কীট এবং সামরিক পেশা এড়িয়ে যাবার ফন্দী আবিষ্কার করতো। পুরনো মতাবলম্বী অধ্যাপকবৃন্দ তাঁর লেখা আমদানী নিষিদ্ধ করার জন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা বিভাগকে আবেদন করত। কোন শিক্ষক তার লেখাকে সমর্থন করলে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হতো। এই সময়ের মধ্যে তার মতাবলম্বী দল যদি কোন অনুন্নত দেশের সরকার পদে বরিত হতো, যেখানে তার মতবাদ ছাড়া আর কিছু শিক্ষা দেয়া বেআইনী হয়ে দাঁড়াত এবং ধীরে ধীরে তা রহস্যময় বিশ্বাসে রূপ লাভ করত, আসল তাৎপর্য কেউ বুঝতে পারত না। স্বপক্ষে বিপক্ষে টাটকা যুক্তির অনুসরণ না করে তার মতামতের সত্যতা অথবা অসারতা যুদ্ধক্ষেত্রেই নির্ধারিত হবে। এই পদ্ধতি হলো উইলিয়াম জেমসের বিশ্বাস করার ইচ্ছা করার (Will to believe) যুক্তিসঙ্গত ফলাফল থেকে উদ্ভূত।
বিশ্বাস করার ইচ্ছা বা (Will to believe) আমাদের কাঙ্খিত বিষয় নয়, যা আমাদের প্রয়োজনীয় তা হলো খুঁজে নেয়ার ইচ্ছে বা উইল টু বিলিভ বা বিশ্বাস করার ইচ্ছা সম্পূর্ণ বিপরীত।
যুক্তিগত সংশয়ের কিছু প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে সে কথা অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীতে অনেক বেশি যে অযৌক্তিক নিশ্চয়তা রয়েছে সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা জরুরী প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গড়পড়তা মানুষের চরিত্রের বিশ্বাস প্রবণতা এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অযৌক্তিক বিশ্বাস থেকে এর অনেকগুলো উদ্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক পাপের এ আদি বীজগুলো যে বিভিন্ন উপায়ে অঙ্কুরিত এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তার মধ্যে শিক্ষা, প্রোপাগাণ্ডা এবং অর্থনৈতিক চাপই প্রধান। আমরা সেগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করছি।
(১) শিক্ষাঃ প্রত্যেক প্রাগ্রসর দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভার রয়েছে রাষ্ট্রের হাতে। কতেক জিনিস যে মিথ্যা সে কথা সকল সরকারি চাকুরেরা পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করেন তাঁরাও জানেন। আর কিছু যে মিথ্যা নিদেনপক্ষ অত্যন্ত সন্দেহাত্মক তা সংস্থার মুক্ত মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। উদাহরণস্বরূপ ইতিহাস শিক্ষাদানের ব্যাপারে ধরা যাক। স্কুলপাঠ্য বইয়ে প্রত্যেক জাতির লক্ষ্য থাকে নিজস্ব ইতিহাসের গৌরব বৃদ্ধি করা। একজন মানুষ আত্মজীবনী রচনা করার সময় কিছু বিনয় প্রকাশ করবেন এটা আশা করা স্বাভাবিক, কিন্তু একটা জাতি যখন আত্মজীবনী লেখে তখন এর গর্ব এবং দম্ভের সীমা থাকেনা। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন পড়ানো হতো ফরাসিরা খারাপ, জার্মানেরা ভালো। এখন তারা উল্টো শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ দু’য়ের মধ্যে কোথাও সত্যের লেশমাত্র নেই। জার্মান স্কুলপাঠ্য বইতে ওয়াটার যুদ্ধ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে ওয়িলংটন যখন প্রায় পরাজিত তখন বুচার এসে পরাজয়ের হাত থেকে আত্মরক্ষা করলেন। কিন্তু ইংরেজি স্কুলপাঠ্য বইতে বুচারের কথা কদাচিৎ উল্লেখিত হয়েছে। এখানে ইংরেজ এবং জার্মান ঐতিহাসিকদের দু’জনের কেউ সত্য কথা বলছেন না। আগেকার আমেরিকান স্কুলপাঠ্য বইয়ের বৃটিশের প্রবল নিন্দা করা হতো। যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকান স্কুলপাঠ্য বইগুলো কোন ব্যাপারে আসল সত্য উদ্ঘাটন না করে ভয়ঙ্কর ভাবে বৃটিশভক্ত হয়ে পড়েছে। আগে এবং বর্তমানে আমেরিকান শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাইরে থেকে আগত বিচিত্র ছেলেদেরকে খাঁটি আমেরিকান হিসেবে গড়ে তোলা। যে অর্থে জার্মানেরা ভালো জার্মান হিসেবে গড়ে ওঠে, জাপানিরা গড়ে ওঠে ভালো জাপানী হিসেবে সে অর্থে আমেরিকানরা ভালো আমেরিকান হিসেবে গড়ে ওঠেনা; বরঞ্চ গড়ে ওঠে খারাপ মানুষ হিসেবে। যে ভদ্রলোক অথবা ভদ্রমহিলা সব সময় আমেরিকা পৃথিবীর সুন্দরতম দেশ এ বিশ্বাসে গদগদ এবং যে কোন ঝগড়ায় উৎসাহের সঙ্গে তা সমর্থন করে, সে ভদ্রলোক অথবা ভদ্র মহিলাকে ভালো আমেরিকান বলা যেতে পারে। এ বিশ্বাসগুলো যদি সত্য হতো তাহলে একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের তাদের সঙ্গে ঝগড়া করার কিছু থাকতো না। কিন্তু এগুলো সত্য হলে সেগুলো শুধু আমেরিকায় কেননা সর্বত্র শিক্ষা দেয়া উচিত। কোন বিশেষ দেশ যে সকল প্রস্তাবনার মাধ্যমে আত্মগৌরব বৃদ্ধি করে সে বিশেষ দেশের বাইরে কোথাও সে প্রস্তাবনা সমূহ যে বিশ্বাস করা হবে এতে প্রচুর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
বস্তুতঃ সকল দেশই ছেলেদেরকে বিনা বাধায় উদ্ভট কুসংস্কারে দীক্ষিত করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হলো সত্যের নামে কতকগুলো দুষিত স্বার্থের সমর্থনে মৃত্যুবরণ করবার জন্য মনকে দৃঢ় করা। অথচ তারা জানতে পারে না যে ন্যায় এবং সত্যের নামে কি মন্দ সংকল্পে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। যে অসংখ্য পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়, এ হচ্ছে তার মধ্যে একটি; যার উদ্দেশ্য সত্যিকারের জ্ঞানদান করা নয়, মানুষকে শাসকদের ইচ্ছানুসারে নতিস্বীকার করানো। প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার নামে যে প্রবঞ্চনা করা হয় একটি ব্যাপক পদ্ধতির মাধ্যমে তার নিরসন না ঘটালে গণতন্ত্রের প্রচলন অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে না।
শিক্ষা সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ করার আগে আমি আমেরিকা থেকে আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরব, তুলে ধরবো এ কারণে যে আমেরিকা অন্যান্য দেশের চাইতে খারাপ। তারপরেও হলো সর্বাধুনিক দেশ; সে-কারণে বিপদগুলোর নিরসনের চাইতে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি ঘটছে অত্যাধিক হারে। নিউইয়র্ক স্টেটে জনসাধারণের পয়সায়ও রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোন স্কুল খোলা যায় না। সাম্প্রতিক একটি আইনের ঘোষণা হলো “প্রতিষ্ঠিত সরকারকে শক্তিবলে, প্রতিহিংসা বলে অথবা অন্য কোন বেআইনী পদ্ধতিতে উৎখাত করার মতবাদ শিক্ষা দেয়ার মত কিছু পাঠ্যসূচীতে যোগ করা হলে তেমন কোন প্রতিষ্ঠানকে সরকার স্কুল খোলার অনুমতি দেবে না। নিউ রিপাবলিক পত্রিকা ঘোষণা করেছে আরো, এ সরকার সে সরকারের প্রভেদের কোনো সীমারেখা নেই। সুতরাং যুদ্ধের সময়ে কাইজারের সরকারকে উৎখাত করা যাবে না। এ মতবাদ শিক্ষা দেয়াকে বেআইনী করা উচিত। সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে ডেনিকিন এবং কেলচাকদের সমর্থনকেও উচিত বেআইনী ঘোষণা করা। এরকম ফলাফল অপ্রত্যাশিত, তবে খারাপ খসড়ার দরুণ মাঝে মাঝে প্রকৃত ফলাফল প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এই আইন অনুসারে কেবল সে সমস্ত লোক এই সমস্ত স্কুলে শিক্ষকতা করতে পারবে যারা বিশেষ বিশেষ স্টেটের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দেখাতে পারবে। যারা সে বিশেষ স্টেটের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বদলে অন্য ধরণের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, কখন বলেছে, এবং কোথায় বলেছে তার কোন হদিশ না জেনেও তাদেরকে স্টেটে চালিত স্কুলে শিক্ষকতা করতে দেয়া হবেনা। যে কমিটি এ সমস্ত আইন প্রণয়ন করেছে, সে সম্বন্ধে নিউ রিপাবলিক কাগজ লিখেছে যে শিক্ষক, বর্তমান সামাজিক পদ্ধতির সঙ্গে একমত নয় তাকে অবশ্যই চাকুরি ছেড়ে দিতে হবে। যে লোক সামাজিক পরিবর্তনের থিয়োরির ব্যাপারে ঝগড়া করতে রাজি নয়, তাদের ওপরই যুবক এবং বুড়োদেরকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ভার দেয়া হয়। সুতরাং নিউইয়র্ক স্টেটের নিয়মানুসারে যিশুখৃষ্ট নিউইয়র্কে গিয়ে বলতেন, “ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কাছে আসার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। নিউইয়র্কের স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট তখন তাকে জবাব দিতেন, “জনাব আপনি সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে বাদানুবাদে যে আগ্রহী তার কোনো প্রমাণ আমি দেখছিনে। আমি ঠিকই শুনেছি আপনি স্বর্গরাজ্যের ওকালতি করেন, কিন্তু খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ এ দেশ হচ্ছে প্রজাতন্ত্র। নিউইয়র্ক রাজ্যের সরকারের সঙ্গে আপনার স্বর্গরাজ্যের সরকারের আকাশ পাতাল প্রভেদ। সুতরাং কোনো ছেলেমেয়েকে আপনার কাছে যেতে দেয়া হবে না।“ যদি তিনি উপরোক্ত উত্তর দিতে অসমর্থ হন তাহলে আইনের শাসন তার কাঁধে যে দায়িত্ব চাপিয়েছে তা ঠিক ঠিকভাবে পালন করছেন না।
এ ধরণের প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়ঙ্কর। যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যাক নিউইয়র্ক রাজ্যের সরকার এবং সমাজব্যবস্থা আমাদের এ গ্রহে সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তা সত্ত্বেও ও দুটোকে আরো ভালো করা যেতে পারে একথা আমরা সত্য বলে ধরে নিতে পারি। যদি কোন ব্যক্তি এ স্পষ্ট যুক্তিকে বিশ্বাস করে তাহলে তাকে স্টেট চালিত স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ দেয়া হবে না। সুতরাং আইনের ঘোষণা অনুসারে শিক্ষকদেরকে হয়ত কপট নয়ত বোকা হতে হবে। একই সংস্থা তা রাষ্ট্র অথবা ট্রাষ্টের ফেডারেশন যাই হোক না কেননা একচেটিয়াভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার ফলে নিউইয়র্ক রাজ্যের আইন ব্যবস্থার মধ্য থেকে ক্রমবর্ধমান বিপত্তির দৃষ্টান্ত সমূহের কয়েকটা তুলে ধরা হলো। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকায় রাষ্ট্রের না পছন্দ কোন মতবাদ শিশুদেরকে শুনতে নিবৃত্ত করা হয়। আমার বিশ্বাস এখনো কিছু সংখ্যক মানুষ আছে যারা গণতন্ত্রকে জনসাধারণের চাইতে আলাদা করে দেখে। সে যাহোক তাহলো এক ধরণের অবাস্তব পরিকল্পনা। রাষ্ট্র হলো বিভিন্ন চাকুরেদের দ্বারা গঠিত যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত, এবং সুখে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার মতো টাকা পয়সা আয় করে থাকে। আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে পরিবর্তন আনাই হলো তাদের একমাত্র সম্ভাব্য পরিবর্তনশীল পন্থা। সমর উত্তেজনার সুযোগ গ্রহণ করে অধীনস্থ কর্মচারীদের ওপর দমননীতি যে চালাবে তাদের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক। অধীনস্থ কোন কর্মচারী যদি তাদেরকে বাধা দেয় তাহলে এ সুযোগে অনাহারে রাখার ক্ষমতাও তারা করায়ত্ত করে থাকে। শিক্ষার মতো অন্যান্য যে সমস্ত উপাদানে এভাবে মনকে গড়ে তোলে তা ভয়ঙ্কর। এর ফলে প্রগতি স্বাধীনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার সম্ভাবনার অবসান ঘটে। তাহলেও সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একচেটিয়াভাবে একটি সংস্থার অধীনে আনয়ন করার স্বাভাবিক পরিণতি আলাদা হতে পারে না।
ধর্মের ব্যাপারে সহনশীলতার পরিমাণ কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায়, সেহেতু মানুষ ধর্মকে এখন তেমন প্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে না। বর্তমানে রাজনীতি এবং অর্থনীতি ধর্মের পূর্বতন স্থান অধিকার করেছে, অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার পরিধি শুধুমাত্র একটি পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ কোন কারণেই নয়। যে কোন ধর্মতান্ত্রিক দেশের তুলনায় রাশিয়াতে মতামতের ওপর নির্যাতন করা হয় সবচেয়ে বেশি। পেত্রোগ্রাদে আলেকজাণ্ডার ব্লক নামে একজন বিখ্যাত রাশিয়ান কবির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, যাকে কারাবাসে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বলশেভিকরা তাকে সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষাদান করতে নিয়োগ করেছিল কিন্তু তারা তার শিক্ষা পদ্ধতিকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে রূপ দেয়ার জন্যে চাপ দিচ্ছিলো বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। সে যা হোক অনাহার এড়িয়ে যাবার জন্যে ছন্দের সঙ্গে মার্কসবাদের সম্বন্ধ আবিষ্কার করার জন্যে তিনি যারপর নাই চেষ্টা করলেন। বলতে গেলে তা ছিল অসম্ভব, কেননা, একবছর পূর্বে বলশেভিক সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করেছে, যে বিশ্বাসের ওপর তাদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে সে বিশ্বাসের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে সবকিছুর সমালোচনা তখনো মুদ্রিত হয়নি।
আমরা আমেরিকা এবং রাশিয়ার কথা বর্ণনা করে যে সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তা হলো মানুষ যতদিন রাজনীতির প্রয়োজনে এ গোড়া বিশ্বাসকে পরিহার না করবে ততদিন রাজনীতিতে স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ অসম্ভব। রাশিয়াতে যেমন তেমনি অন্যান্য ব্যাপারে স্বাধীনতার ঘাটতি হলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু পরিমাণ রাজনৈতিক সংশয়বাদ আমাদেরকে এ দুর্ভাগ্য হতে রক্ষা করতে পারে।
শিক্ষা বিভাগীয় কর্তারা যে তরুণেরা শিক্ষিত হোক এ কামনা করে তা কখনো বিশ্বাস করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে তাদের যা সমস্যা তা হলো বুদ্ধি বৃত্তির বিকাশ সাধন না করে তাদেরকে সংবাদ বিশেষজ্ঞ করে তোলার সমস্যা। শিক্ষার দু’রকমের লক্ষ্য থাকা উচিত। প্রথমতঃ পড়া, লেখা, ভাষা শিক্ষা, অঙ্ক ইত্যাদি ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান দান করা। দ্বিতীয়তঃ যে সকল মানসিক অভ্যাস মানুষকে জ্ঞান অর্জন এবং সুস্থবৃত্তি গঠন করতে অনুপ্রাণিত করে মানুষের মধ্যে সে সকল অভ্যাসের সঞ্চার করা। এর প্রথমটিকে সংবাদ এবং দ্বিতীয়টিকে আমরা মেধা বলে অভিহিত করতে পারি সংবাদের থিয়োরিগত প্রয়োজনীয়তা যেমন আছে, বাস্তবেও তার কি তেমন প্রয়োজন? শিক্ষিত মানুষ ছাড়া বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলতে পারেনা। কিন্তু মেধার থিয়োরিগত প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে তা তেমন কাজে আসেনা। সাধারণ মানুষ যে নিজের জন্য চিন্তা করবে এটা আশা করা যায়না, কারণ যে সকল লোকে তাদের নিজেদের জন্য চিন্তা করে তারা নিজেদেরকেই বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যায় এবং শাসকদের বিষ নজরে পতিত হয়। প্লেটোর ভাষায় বলতে গেলে একমাত্র অভিভাবকেরাই চিন্তা করবে এবং বাকি সকলে তা মেনে নেবে অথবা একপাল মেষের মতো নেতার অনুসরণ করবে। অবচেতনভাবে এই মতবাদ খুব ক্ষীণভাবে হলেও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পরেও টিকে আছে এবং সোজাসোজি সমস্ত রকমের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পদ্ধতির আইন কানুন অগ্রাহ্য করেছে।
বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া সংবাদ পরিবেশন করতে পুরোপুরি যে দেশটি সাফল্য অর্জন করেছে, আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠায় যার নাম সম্প্রতি লিখা হলো, সে দেশটি জাপান। পদ্ধতিগত দিক দিয়ে জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রসংশনীয় বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে, সে উদ্দেশ্যটি হলো মিকাডোকে পূজা করার শিক্ষা দেয়া, যার প্রবণতা আধুনিক জাপানে পূর্বাপেক্ষা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং স্কুল সমূহকে একই সঙ্গে জ্ঞান বিস্তার এবং কুসংস্কার প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিকাডোকে পূজা করার কোন যৌক্তিকতা আমাদের কাছে নেই বলে জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্ভট দিকটি আমরা পরিষ্কার চোখে দেখতে পাই। আমাদের নিজস্ব জাতীয় কুসংস্কারগুলো আমাদের কাছে এত স্বাভাবিক এবং আবেগসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে জাপানিদের সম্বন্ধে অত সহজে আবিস্কার করা যায় না। একজন ভ্রমণকারী জাপানি আমাদের স্কুলে সমূহে মিকাডোর স্বর্গীয় উত্তারাধিকারিত্বের মতো বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধ কুসংস্কারগুলো আবিস্কার করে যদি থিসিস লিখেন, আমার মতো তিনি ঠিক কাজই করবেন। যদি আমি একজন ছোট দোকানদারকে গিয়ে বলি, ”দেখো তোমার প্রতিযোগী রাস্তার ওপাশে। সে তোমার ব্যবস্থা কেড়ে নিচ্ছে, সুতরাং তোমার ব্যবস্থা বাঁচাতে চাইলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে তোমাকে গুলি করার আগে তুমি তাকে গুলী করে হত্যাকর “ তাহলে সে ক্ষুদ্র দোকানদার আমাকে পাগল ঠাওরাবে। সরকার যখন একই কথা জোড় দিয়ে ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করে তখন ছোট ছোট দোকানদারেরা পরম উৎসাহিত হয়ে ওঠে, কিন্তু পরে তারা দেখতে পায় তার ফলে তাদের ব্যবস্থা ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে।
বিজ্ঞাপনদাতারা যে পদ্ধতি অনুসারে সাফল্য অর্জন করে একই পদ্ধতিতে সকল উন্নতদেশে, মতামত প্রচারে উপযুক্ত পন্থা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে; বিশেষ করে এ পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক মতবাদ সৃষ্টি করা হয়।
হালে যে প্রচার প্রোপান্ডা চলছে তাতে দু’ধরনের আলাদা দোষ বর্তমান। এক ধরনের দোষ হলো, এর আবেদন সাধারনতঃ বিশ্বাসের অযৌক্তিক কারণে, সুচিন্তিত যুক্তির ধার দিয়েও ঘেঁষেনা। আরেক ধরণের দোষ হলো সম্পদ অথবা ক্ষমতার মাধ্যমে প্রেপাগান্ডা কতেক মানুষকে অন্যায় সুযোগ দান করে থাকে। প্রেপাগান্ডার বাক্য জাল যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রধান্য বেশি দেয় বলে আমি মনে করি। অনেক মানুষ যেমন ভাবে যুক্তি এবং আবেগের তেমন কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবধান নেই। অধিকন্তু একজন চালাক মানুষ কোন সুযোগে প্রতিষ্ঠিত কোন কিছুর সমর্থনে প্রচুর ভালো যুক্তি তৈরি করে নিতে পারে। কোন বিষয়ের স্বপক্ষে-বিপক্ষে দুপক্ষেই ভালো যুক্তি থাকে। নির্দিষ্ট ভাবে বিষয়কে না ব্যক্ত করলে আইনমতে আপত্তি করা যেতে পারে, কিন্তু তার বিশেষ প্রয়োজন নেই। নাশপাতি, সাবান এসব শব্দ কিছু না বোঝালেও মানুষ ও সকল জিনিস ক্রয় করে। শ্রমিক পার্টি যদিও এ শব্দের মধ্যে কোনও আকর্ষণ নেই-তবু লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শুধু নামের জন্য শ্রমিক পার্টির সমর্থনে ভোটদান করবে। দুপক্ষের বিরোধ নিস্পত্তি করার জন্যে আইন করে প্রখ্যাত নৈয়ায়িকদের একটি কমিটি যদি দোষগুণ বিচারার্থে নিয়োগ করা হয়, তাহলেও বর্তমান প্রোপাগাণ্ডার আসল দোষ দূর করা যাবে না। ধরা যাক দুদলের অবস্থা একই রকম আশাপ্রদ, একপক্ষের প্রোপাগাণ্ডার হাতে ব্যয় করার জন্য হয়েছে লক্ষ পাউণ্ড অন্য পক্ষের হাজার পাউণ্ড। গরিব পার্টির তুলনায় অপেক্ষাকৃত ধনী পার্টির বক্তব্য অধিক সংখ্যক মানুষ জানতে পারবে। সুতরাং নির্বাচনে ধনী পার্টিই জয়যুক্ত হবে। এরকম অবস্থা সাধারণতঃ যে সকল দেশে একপার্টি সরকার বর্তমান সে সকল দেশে হয়ে থাকে, তবে তার দরকার নেই। এমনিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে জয়লাভ করাবার জন্যে তাই যথেষ্ট, যদি না পরিস্থিতি ভিন্নরকম রূপ পরিগ্রহ করে।
অযৌক্তিক বিশ্বাসকে ফাঁপিয়ে ফেনিয়ে তোলে বলে প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে আপত্তি নয়; ধনী এবং ক্ষমতাবানদের অন্যায় সুযোগ দান করে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করে। সত্যিকারের চিন্তার স্বাধীনতার জন্য চিন্তার সাম্যের প্রয়োজন অপরিহার্য। সকল মতামতকে সমান সুযোগ দেয়ার জন্য ঐ উদ্দেশ্যে প্রণীত প্রাঞ্জল আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এরকম আইন ক্রিয়াশীল হবেনা। এমন আশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রাথমিকভাবে এ সমস্ত আইনের মধ্যে প্রতিবিধান মিলবে না, আরো ভালো শিক্ষা এবং অধিক হারে সংশয়াপন্ন জনমতের মধ্যে এর আরোগ্যের উপাদানগুলো নিহিত। বর্তমান মুহূর্তে আমি আরোগ্যের ব্যাপারে কোন আলোচনা করবনা।
অর্থনৈতিক চাপ-আমি চিন্তার স্বাধীনতার বিভিন্নদিকের বাধাগুলো সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি, এখন আমি আসল দিকে আলোকপাত করতে চাই যে দিকের বিপদ সম্পর্কে সঠিক পন্থা অবলম্বণ না করলে বিপদ আরো বাড়তে বাধ্য। চিন্তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক চাপ যে সকল দেশ সৃষ্টি করে সোভিয়েত রাশিয়া তার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত। যে দেশে বাণিজ্য, চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন লোকের মতামত না পছন্দ হলে তাকে অনাহারে রাখার নিয়ম ছিল। উদাহরণ স্বরূপ ক্রোপেটিকিনের নাম বলা যেতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাশিয়া একমাত্র দেশ যে অন্যান্য দেশের চেয়ে অগ্রসর। ফরাসিদের ড্রিফাস (Dreyfus) মামলার শুরুতে তাকে যে সমস্ত শিক্ষক সমর্থন এবং শেষের দিকে বিরোধিতা করেছেন তাদের সকলকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে আমার সন্দেহ, একজন অধ্যাপক তিনি যতই খ্যাতনামা থোক না কোন, ষ্ট্যান্ডার্ড তেল কোম্পানির সমালোচনা করলে চাকুরি পাবেন, কেননা সকল কলেজের প্রেসিডেন্টরা মি. রাফেলারের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন অথবা উপকৃত হওয়ার আশা রাখেন। সমগ্র আমেরিকাতে সমাজবাদীরা মার্কা মারা মানুষ খুব মহান অবদান না থাকলে তাদের পক্ষে চাকুরি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেখানে শিল্পের প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে সেখানে কিছু সংখ্যক বিশ্বাসী কর্মচারী রাখার মনোভাব খুবই প্রবল যাতে করে তাদের সাহায্যে সমস্ত শিল্প একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অনায়াসসাধ্য হয়ে পড়ে। এ জন্য তারা গোপনে কৃষ্ণ মলাটের বইতে সে সব কর্মচারির নাম লিখে রাখে যাদেরকে বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র করতে পারা না যায় এবং অনুগত কর্মচারীদের উপোষ থাকতে বাধ্য করা হয়। আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিবাদে রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন সমাজতন্ত্রের অনেকগুলো দোষকে পুণঃ প্রবর্তন করা হচ্ছে। স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মানুষের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্র বা অছি কমিটি যাই হোকনা কেন, দূয়ের মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই।
শিল্পের দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত আমেরিকাতে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে, যেগুলো ভবিষ্যতে আমেরিকার পর্যায়ে পৌঁছুবার আশা রাখে, সেখানে গড়পড়তা নাগরিককে বিশেষ বিশেষ বৃহৎ মানুষের বিদ্বেষ পরিহার করে বেঁচে থাকতে হয়। আমেরিকাতে এ আবহাওয়া সর্বাধিক। আবার এসব বড় মানুষদের যে ধর্মীয়, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে তাদের কর্মচারীরা তার সঙ্গে অন্ততঃ বাহ্যিক দিকে হলেও একমত হবে এ প্রত্যাশা তারা করে খুব বিখ্যাত লেখক না হয়ে কোন মানুষ যদি খ্রিষ্টান ধর্মে অবিশ্বাস পোষণ করে অথবা বিবাহ আইনের শিথিলতায় বিশ্বাসী অথবা কোন বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিষ নজরে পড়ে তার কাছে আমেরিকা সব চেয়ে অপ্রিয় দেশ হয়ে দাঁড়াবে। যে সকল দেশে অর্থনীতি বাস্তবে একচেটিয়াভাবে পরিচালিত হয়, একই ভাবে সে সকল দেশেও চিন্তার স্বাধীনতা বাধা প্রাপ্ত হয়। উনিশ শতকে অন্ততঃ পক্ষে স্বাধীন প্রতিযোগিতা চলতো কিন্তু এখন চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার কাজ তখনকার চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক। যে লোক মনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাকে অবশ্যই পুরোপুরি অকপট ভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে দাঁড়াতে হবে; সেই সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে শিল্পযুগের শৈশবে যে সকল পদ্ধতি অবলম্বন করে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে এখন সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে, দুটো সরল নীতি অবলম্বন করলেই প্রায় সকল সামজিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তার প্রথমটা হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় অভীষ্ট সমূহের একটা হবে যখন কোনো বিষয়ের পেছনে যুক্তির জোর থাকবে তা সত্য বলে গ্রহণ করা। দ্বিতীয়তঃ দক্ষতার ভিত্তিতে সকলের কর্মসংস্থান করা।
দ্বিতীয় নীতিটি সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করা যাক। কোন মানুষকে চাকুরিতে বহাল করার আগে তার রাজনৈতিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে জানার অভ্যাস হলো আধুনিক কায়দার নির্যাতন। তার এসব জানার অনুসন্ধিৎসা দিয়ে তো তার কর্মদক্ষতা যাচাই করা হয় না। পুরনো স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে আইনমতো যাচাই করা হয় না। পুরনো স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে আইনমতে সহি সালামতে রক্ষা করা যায়। কোন মতামতে বিশ্বাস করার জন্যে কোন মানুষকে অনাহারে থাকতে হলে তার মতবাদ আইনতঃ শাস্তিযোগ্য নয়, জানা তার কাছে আরামপ্রদ কিছু নয়। ক্ষুধার্ত মানুষেরা ইংল্যাণ্ডের গির্জার অধীনে নয় বলে অথবা রাজনৈতিক মতবাদে গোঁড়ামিমুক্ত বলে তাদের জন্য অনুভূতি দিয়ে ভাবে অনেক মানুষ। নাস্তিক মর্মন ধর্মাবলম্বী, গোঁড়া সাম্যবাদী অথবা স্বাধীন ভালোবাসার প্রচারকদের সম্বন্ধে কোমল ধারণা কদাচিত পোষণ করা হয়। এ ধরণের মানুষকে সব সময় খারাপ বলে ধরে নেয়া হয় এবং স্বাভাবিক ভাবে চাকুরি দেয়ার অযোগ্য বলে পরিগণিত করা হয়। মানুষ এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এখনো ভাবনা-চিন্তা করেনি। পরিপূর্ণরূপে শিল্পায়িত রাষ্ট্রে এ ধরণের ব্যাপক অত্যাচার করা হয়।
মানুষ যদি এ বিপত্তি সম্বদ্ধে ব্যাপকভাবে ওয়াকেবহাল হয়, তাহলে তা জনমত জাগাতে সমর্থ হবে এবং তা করতে হলে মানুষের বিশ্বাসকে তার চাকুরির নীরিখ হিসাবে গণ্য করা উচিত নয়। সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার দায়িত্ব অপরিসীম। আমাদের যারা খুব ভয়ঙ্কর গোঁড়া তারাও কোনদিন সংখ্যালঘুতে পরিণত হতে পারে, সুতরাং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অত্যাচারের বাধা দান করা একান্তই উচিত। জনমত ছাড়া আর কোন কিছু এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। ব্যতিক্রমী মালিকদের কাছে যে সুবিধা পাওয়া যায় সমাজতন্ত্র তার নিরসন করে সমস্যা আরো ঘোলাটে করে তুলবে। শিল্পের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নতুন হস্তক্ষেপের ফলে অবস্থা অধিকতর সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াবে, যেহেতু এর ফলে স্বাধীন বিনিয়োগ কর্তার সংখ্যা, কমতে থাকবে। একচেঠিয়া মালিকানায় যেমন তেমনি সমাজতন্ত্রেও বিশ্বাসের অবক্ষয় চূড়ান্ত সত্য বলে প্রমাণিত হবে। মানুষ যখন ক্যাথলিক অথবা প্রোটেষ্টান্ট মতবাদের চূড়ান্ত সত্যতায় বিশ্বাস করে,তাহলে একে অপরকে অত্যচার করার ইচ্ছা পোষন করে। মানুষ যখন তাদের আধুনিক ধর্মমত সম্বন্ধে জেনে ফেলেছে তারাও বিরুদ্ধবাদীদের নিজস্ব পদ্ধতিতে নির্যাতন করবে। থিয়োরিতে না হলেও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে সহনশীলতার জন্য কিছু পরিমাণ সংশয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে। এর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় দফার সংযোগ রয়েছে, শিক্ষার অভীষ্ট ছিল যার আলোচ্য বিষয়।
পৃথিবীতে সহনশীলতা আনতে হলে স্কুল সমূহে যা যা শিক্ষা দিতে হবে তার একটি হলো প্রমাণের গুরুত্ব বিচার সম্পূর্ন ভাবে বিশ্বাস করার যুক্তি না থাকলে কোন বক্তব্যকে সত্য বলে মেনে না নেয়ার অভ্যাস শিক্ষা দেয়া। উদাহরণস্বরূপ সংবাদপত্র পাঠ করার কায়দা কসরত শিখিয়ে দেয়া উচিত। অনেকদিন আগে ঘটে গেছে এবং ঐ সময় আবেগ জড়িয়ে তুলেছিল, শিক্ষকদের এমন কতক ঘটনা বেছে নেয়া উচিত। একপক্ষের সংবাদ পত্র বিশেষ একটি ঘটনার ওপর কি মন্তব্য করেছিল এবং অন্য পক্ষের সংবাদপত্রের সে ঘটনার ওপর কি বক্তব্য ছিল তা ছাত্রের কাছে পড়ে শুনিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে কি ঘটেছিল ছাত্রদের কাছে বলে দেয়া শিক্ষকের উচিত। প্রত্যেক দিকের পক্ষপাতিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা সংবাদপত্রে যা লেখা হয় কম বেশী তাতে মিথ্যা থাকে একথা বুঝিয়ে দেয়া উচিত। এর ফলে ছেলে মেয়ের মনে যে বিদ্রুপাত্নক সংশয়ের সৃষ্টি হবে তার দরুন চালবাজদের পরিকল্পনায় ভালো লোকদের যে ভাবে ব্যবহার করা হয়, তার থেকে পরবর্তী জীবনে ছাত্রেরা বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে।
এই পদ্ধতিতে ইতিহাস শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। উদাহরণ স্বরূপ নেপোলিয়ানের ১৮১৩-১৪ সালের অভিযানসমূহকে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। নেপলিয়ান কর্তৃক প্রত্যেক যুদ্ধে পরাজিত মিত্রশক্তির সৈন্যেরা যখন প্যারি নগরীর প্রাচিরে এসে হানা দিলো তখন প্যারির নগরবাসীরা কি রকম বিস্ময় অনুভব করেছিল। মৃত্যুর প্রতি ঘৃণা জাগাবার জন্যে লেনিন কতোবার টটস্কি কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন উচ্চশ্রেণীর ছাত্রদেরকে তা জানতে অনুপ্রাণিত করা উচিত। ছেলেমেয়েদেরকে এমন এক স্কুলে দেয়া উচিত যে স্কুলে সরকার অনুমোদিত ইতিহাস পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত এবং আমাদের সঙ্গে ফরাসিদের যুদ্ধের ইতিহাস ফরাসি স্কুলে কি রকম তা অনুমান করতে নির্দেশ দেয়া উচিত। কতেক মানুষ যেমন বিশ্বাস করে নৈতিকতার বাণী প্রচার করে নাগরিক কর্তব্য শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব শেষ করা হয়। তার চেয়ে এরকমের শিক্ষা পদ্ধতি অনেক বেশি নাগরিক কর্তব্যের শিক্ষা সহায়ক হয়ে দাঁড়াবে।
আমার মতে এটা স্বীকৃত সত্য যে পৃথিবীর অশান্তির মূলে যতটুকু নৈতিক বিচ্যুতি রয়েছে অবশ্যই ততটুকু বুদ্ধিহীনতার প্রভাব বর্তমান। কিন্তু মানব সম্প্রদায় আজ পর্যন্ত নৈতিক দোষ সংশোধন করবার কোনও পন্থা আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রচার এবং কপটতা,শুধু পুরনো পাপের তালিকায় নতুন দোষের সংখ্যা বাড়ায়। পক্ষান্তরে প্রত্যেক দক্ষ শিক্ষাবিদদের জানা পদ্ধতি অনুসারে সহজে বুদ্ধিবৃত্তি উৎকর্ষ সাধন করা যায়। সুতরাং নৈতিকতা শিক্ষার কোন পদ্ধতি না অবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত প্রগতিকে নীতির বদলে বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের ওপরেই নির্ভর করতে হবে। বিশ্বাস প্রবণতা হলো বুদ্ধিবৃত্তির প্রধান প্রতিবন্ধক সমূহের একটি এবং প্রচলিত পদ্ধতিতে মিথ্যা খবর নিরসন ঘটিয়ে বিশ্বাস প্রবণতার পরিমাণ হ্রাস করা যেতে পারে। বিশ্বাস প্রবণতা বর্তমান দুনিয়াতে আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে পড়েছে এবং গণতন্ত্রের জন্যে আগের চাইতে অনেক বেশি মিথ্যা খবর প্রচারের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে, সে কারণে সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীতে পূর্বোক্ত দুটো পদ্ধতি (১) উপযুক্ততার ভিত্তিতে চাকুরিতে বিনয়োগ করা। (২) শিক্ষার একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রমাণহীন বিষয়ে বিশ্বাস করার অভ্যাস পরিহার করা কি ভাবে প্রয়োগ করা উচিত, তাহলে আমি শুধু বলব সুশিক্ষিত জনমত গঠনের দ্বারাই তা সম্ভব। যারা এ পদ্ধতি চালু হোক কামনা করবে একমাত্র তাদের চেষ্টার ফলেই সুশিক্ষিত জনমত গঠন করা সম্ভব হবে। সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যে আরোগ্যের কথা বলেন, তাতে আলোচ্য দোষগুলোর কিছু হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করিনে। রাজনীতিতে যাই ঘটুক না কেন, অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে মানসিক স্বাধীনতা অটুট রাখা বরঞ্চ অত্যাধিক বিপজ্জক হয়ে দাঁড়াবে যদি জনমতের চাপে পড়ে বিনিয়োগকর্তা কর্মচারীদের শুধু কাজ ছাড়া জীবনের বিশ্বাস সমূহ নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা পরিহার না করে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিদর্শন, টাকা পয়সা দেয়া এবং বিশেষ পদ্ধতির রক্ষণাবেক্ষণ করার মধ্যে সীমিত করার পর ইচ্ছে করলেই শিক্ষার স্বাধীনতা অর্জন করা যায়। কিন্তু তাতে করে শিক্ষা ব্যবস্থার ভার এসে পড়বে গির্জাগুলোর ওপর। দুর্ভাগ্যবশতঃ স্বাধীন চিন্তাবিদেরা তাদের সংশয় সমূহ শিক্ষা দিতে যতটুকু সচেষ্ট তারা তাদের বিশ্বাস সমূহের প্রচারের জন্যে অনেক বেশী তৎপর। সে যা হোক সত্যিকার ভাবে চাইলে উদারনৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার একটি ক্ষেত্র আবিষ্কার করা অসম্ভব হবে না। কিন্তু তা যতদূর সম্ভব আইনের আওতামুক্ত থাকবে।
এ প্রবন্ধে সর্বত্র আমি বলতে চেয়েছি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্ভূত ফলাফল থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক, বৈজ্ঞানিক মেজাজের মাধ্যমে মানুষের মনের সজীবতা ফিরে পাওয়া যায় এবং আমাদের সকল রকমের অসুবিধা দূর করার পদ্ধতি প্রদান করতে সক্ষম। বিজ্ঞাপনের ফলাফল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে, বিষাক্ত গ্যাসে, সংবাদপত্রের প্রচারে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করার হুমকী প্রদর্শন করেছে। যুদ্ধবাজেরা খণ্ডিত আনন্দে বিভোর হয়ে যা করে সভ্যতার পক্ষে তা অত্যন্ত মারাত্মক। কিন্তু আমাদের কাছে তা জীবন মরণের শামিল। এরই ওপর নির্ভরশীল আমাদের পৌত্র পৌত্রেরা অধিকতর সুখী পৃথিবীতে বসবাস করবে না বিজ্ঞাপনের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে একে অপরের বিনাশ সাধন করবে। মানব গোষ্ঠীর মধ্যে বোধ হয় শুধু নিগ্রো এবং পেপুয়ানেরাই বেঁচে থাকতে পারবে।