১২. স্বাধীনতা ও মহাবিদ্যালয়সমূহ

১২. স্বাধীনতা ও মহাবিদ্যালয়সমূহ

[এই প্রবন্ধটি ১৯৪০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের সিটি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে বিচারক ম্যাগিহান রাসেলকে অনুপযুক্ত সাব্যস্ত করার কিছুদিন পরেই এই প্রবন্ধটি রচিত হয়।]

(১)

বর্তমান বিদ্যালয় সম্পর্কিত স্বাধীনতার মান সম্পর্কে আলোচনা করার আগে শব্দটির দ্বারা আমরা কি বোঝাতে চাই সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করে নিতে পারি। বিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা হল সেই রকম শিক্ষককে নির্বাচিত করা যে শিক্ষকের দক্ষতার বিচারক হবে অন্যান্য দক্ষ শিক্ষকেরা। একজন দক্ষ অঙ্কবিদ, পদার্থবিজ্ঞানবিদ ও রসায়নবিদ্যাবিদ অবশ্যই অন্য অঙ্কবিদ, পদার্থবিজ্ঞানবিদ ও রসায়নবিদ্যাবিদদের দ্বারা বিবেচিত হবেন। একমাত্র তাদের দ্বারাই ঐক্যসম্মতভাবে এই বিচার করা যেতে পারে।

কলেজ বা মহাবিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা তারা মনে করেন শিক্ষকদের নিজস্ব বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়াও অন্যান্য গুণ থাকাও প্রয়োজন। তারা মনে করেন যে একজন শিক্ষক কখনই তাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করবে না যারা ক্ষমতা ধারণ করে আছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নীতি অগ্রাহ্যকারী রাষ্ট্রসমূহ এই বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কঠিন পথ অবলম্বন করে থাকে। কেরেনস্কির সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের বাইরে রাশিয়া কোনদিনও মহাবিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু আমি মনে করি জারদের রাজত্বকালের থেকেও এই বিষয়ে অনেক কম স্বাধীনতা বর্তমানে সেখানে দেওয়া হয়ে থাকে। যুদ্ধের আগে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অনেক অভাব থাকলেও জার্মানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিষয়ে মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার আদর্শকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও কিছুজন ছাড়া প্রায় সব দক্ষ পণ্ডিত মানুষকে নির্বাসনে পাঠাবার ফল হিসেবে সবই বদলে গেছে। কিছুটা কম আকারে হলেও ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই একই ধরণের স্বৈরাচারিতা চলে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাধারণত এই ধরণের প্রবণতা খুবই দুঃখজনক। তাই এই বিষয়টিকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে এই ধরণের প্রবণতা সেখানেও এই একই ধরনের অশুভ ঘটনার জন্ম দেবে।

বিপদ এমনই বস্তু যা গণতন্ত্র হাজার চেষ্টা করেও দূর করতে পারে না। গণতন্ত্র হল তাই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একজন একনায়কের মতোই স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে যদি তারা তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবহার করে। একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠদের জন্য সহনশীল মনোভাব একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান, কিন্তু বাস্তবে এই উপাদানটি যথেষ্টভাবে মনে রাখা হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে সেইসব বিচক্ষণতাকে অনুসরণ করা দরকার যা বিশেষভাবে তাদের জন্যই প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অবশ্যই বিশেষভাবে জ্ঞানী ও বিশেষভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হবেন যার দ্বারা তারা বিতর্কিত প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে যেমন সমর্থ হবেন, অন্যদিকে সেইসব প্রশ্নের উপর আলোকপাত করতে পারবেন। বিতর্কিত বিষয়ের উপর আলোচনা করবার বিষয় তারা যদি নীরব ভূমিকা পালন করেন তবে যতটা পরিমাণ নীরবতা তারা পালন করবেন, ধরে নেওয়া হবে, ততটা পরিমাণে পক্ষপাতিত্ব করে তারা জনসাধারণের মঙ্গলকে বঞ্চনা করছেন। বহু বছর আগে চীনের সম্রাট সরকারের সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এই জন্য তিনি একটি বিশেষ পরীক্ষকমণ্ডলী নির্মাণ করেন যে মণ্ডলী সেইসব প্রখ্যাত ও জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে তৈরি হত যারা সম্রাট ও তার সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে সমর্থ হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সব কিছুর মতোই এই প্রথাটিও সেখানে প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে পড় গেল। পরবর্তীকালে বিশেষ কিছু বিষয় নির্ধারিত হল যার উপর তারা সমালোচনা করতে পারত। এক্ষেত্রে নৃপুংসকদের ক্ষমতা ছিলো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কিন্তু যদি তারা তাদের উপর প্রদত্ত অধিকারের বাইরে গিয়ে সমালোচনার প্রচলিত রীতি লঙ্ন করে কিছু করবার চেষ্টা করত তবে সম্রাট তাদেরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারটি ভুলে যাবার অধিকারী ছিলেন। অনেকটা একই রকম ঘটনা আমাদের মধ্যে ঘটে। একটি বিরাট ক্ষেত্রে সমালোচনা অনুমোদনীয়। কিন্তু যেখানে সমালোচনা সত্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সেখানে সমালোচনাকারী বা লেখকের ভাগ্যে শাস্তি জুটবেই।

এই দেশে মহাবিদ্যালয়ের স্বাধীনতা দুদিক থেকে বিপদগ্রস্ত। এদের মধ্যে একটি হল ধনিক শ্রেণীর সরকার আর অন্যটি হল গীর্জাগুলি। যারা এইসব মহাবিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক ও ধর্মতত্ত্বমূলক বিবাচন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকে। সাম্যবাদের অভিযোগের খোঁচায় এই দুজন সহজেই মিলে গেছে এবং যাদেরই মতামতকে তারা অপছন্দ করছে তাদের বিরুদ্ধেই তারা অন্ধভাবে সাম্যবাদের অভিযোগ ছুঁড়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আমি এটা খুব ভালো করে দেখেছি যে ১৯২০ সাল থেকে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বারবার সমালোচনা করে এসেছি এবং বলেছি যে সেখানকার সরকার নাৎসী সরকারের মতোই মন্দ কিন্তু আমার সমালোচক সেইসব কথা উল্লেখ

করে কেবলমাত্র আমি আমার লেখাতে যে দু’একটি আশাব্যঞ্জক কথা সেই সরকারের সম্পর্কে বলেছি সেগুলোরই উল্লেখ করেছেন।

যাদের মতামতকে অপছন্দ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার কৌশল কিছু বিশেষ শক্তিশালী ব্যক্তি সম্প্রদায়ের দ্বারা ক্রমশই এমন নিপুণ হয়ে উঠছে যে শৃঙ্খলিত অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা বিপজ্জনক। যদি কোন যুবক এ বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে তবে যে-কোন সময় তার অফিসের বড়বাবু তাকে পেশাগত দিক দিয়ে অযোগ্য ভাবতে পারেন এবং তার চাকরিটি চলেও যেতে পারে। বৃদ্ধ মানুষেরা এই পদ্ধতিটিকে না করে উঠতে পারার ফলে তাদের সঙ্গে জনগণের বিরোধ বাড়তে থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই এই ধরণের বিপদ নিজের জন্য কখনই ডেকে আনার চেষ্টা করেন না, এইজন্য তারা জনসমক্ষে অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাব কখনই প্রকাশ করেন না। এটা একটা বিপজ্জনক বিষয়, এইজন্যই নিরপেক্ষ বুদ্ধি পক্ষপাতদুষ্ট নীরবতা পালন করে থাকে এবং তারা যাতে তাদের নিজেদের জায়গাটাতে ঠিকঠাক থাকতে পারেন তার জন্য সংরক্ষণশীলতা ও প্রচ্ছন্নতার শক্তিকে মেনে নিতেই হয়।

(২)

আমেরিকার সংবিধান রচয়িতাদের অনুপ্রাণিত করেছিল যে উদার গণতন্ত্রের আদর্শ, সে সম্পর্কে উখিত প্রশ্নসমূহের সমাধান গায়ের জোরে সমাধান না করে যুক্তির মধ্য দিয়ে করতে হবে। উদারপন্থীরা সর্বদাই মনে করে থাকেন যে মতামত সমূহকে অবশ্যই বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে হেঁকে নিতে হবে, শুধুমাত্র এক পক্ষের কথা শুনেই তা গ্রহণ করলে চলবে না। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগে স্বৈরাচারী সরকার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আমার দিক থেকে বলতে গেলে এই ব্যাপারে ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করার কোন কারণ আমি দেখতে পাই না। যদি আমার ক্ষমতা থাকত তবে আমি আমার বিরুদ্ধ পক্ষের মতামতকে দমাতে কখনই সুযোগ খুঁজতাম না। আমি সব ধরণের মতামতকে সমানভাবে সুযোগ দিতাম এবং বিতর্ক ও আলোচনার থেকে বেরিয়ে আসা ফলাফলকে ত্যাগ করতাম। আমি যতদূর জানি পোল্যান্ডে জার্মান নির্যাতনের বলি যে ক’জন শিক্ষক ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু প্রাচীন যুক্তিবিদ ছিলেন যারা গোড়া ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্তু আমি তাদের সহযোগী ধর্মবিদরা কোন রকম অভিনন্দন আমাকে জানাবে না তা জেনেও আমার ক্ষমতায় তাদের মহাবিদ্যালয়গত অবস্থাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতাম।

উদার ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটির হল যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সব প্রশ্ন আলোচনাযোগ্য এবং সব মতামত কম বা বেশি সন্দেহযোগ্য। কিন্তু অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশেষ কিছু মতামতা এমনই চরম যে তা উত্তরযোগ্য নয় এবং সেইসব প্রশ্নের বিরুদ্ধে কোন মতামতকে অবশ্যই অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে যেটা সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক তা হল সেই বিশ্বাস, যে যদি এ সম্পর্কে কোন নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের অনুমোদন দেওয়া হয় তবে তা মানুষকে ভুল সিদ্ধান্তে নিয়ে যাবে, এইজন্য ভুলের বিরুদ্ধে বাঁচার অস্ত্র অজ্ঞতা। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি কখন সেই ধরণের মানুষ গ্রহণ করতে পারে না যারা মানুষের কার্যকে সংস্কারের থেকে মুক্তি দিয়ে বিচার করতে চায়।

ধর্মযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডে উদার দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ঘটে। ১৩০ বছর ধরে প্রচণ্ড হিংস্রতা ও ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ ঘটলেও তা কোন পক্ষকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করতে পারেনি। প্রতিটি পক্ষই মনে করেছিল যে তারা নিজের ক্ষেত্রে সঠিক এবং মানবজাতির জন্য তাদের বিজয় একান্তই গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে সচেতন মানুষ বহুদিন ধরে এই যুদ্ধের অশেষ দুঃখ-কষ্টকে সহ্য করে বুঝতে পেরেছিল যে উভয় পক্ষই তাদের গোঁড়া মনোভাবের দিক থেকে ভুল ছিল। জন লক এই নতুন যুগের শুরুতেই নতুন ধরণের দর্শন ও রাজনীতি সম্পর্কে লিখতে শুরু করলেন। মানুষের বিচার কখনও যে সঠিক হতে পারে না সে সম্পর্কে তিনি জোর দিয়েই বললেন এবং অগ্রগতির যুগের সূচনা করলেন যা ১৯১৪ সাল পর্যন্ত টিকে রইল। লক ও তাঁর অনুগামীদের জন্য ক্যাথলিকেরা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর প্রতি সহ্যশক্তি প্রদর্শন করতে পেরেছিল। যেখানে সপ্তদশ শতকে দেখা যায় যে তখন মানুষ কম বা বেশি সহনশীলতার পাঠ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু মহাযুদ্ধের (The Great War) শেষে উদারনীতিবাদের দার্শনিকদের উচ্চ আদর্শগুলোকে সবাই ভুলে গেল। দ্বিতীয় চার্লসের বিচার-সভার খ্রীষ্টীয়দের সময় কোয়েকারদের আমরা যেমন ভয় করে চলতাম সেরকম আর বেশিদিন ভয় করে চলতে হল না আমাদের। কিন্তু সপ্তদশ শতকে কোয়েকার-রা তৎকালীন যুগে সমস্যা সমূহকে যে আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতেন সেই একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শে যখন কিছু মানুষ বর্তমান সমস্যা সমূহকে অমান্য করেছি যেগুলো প্রাচীনতার দোষে দুষ্টু, কিন্তু এটা দুঃখজনক এবং অনিবার্যভাবে একটা ধাক্কা যে আমরা নতুন মতবাদ গুলোকেও মেনে নিতে পারছি না।

গণতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতায় সম্ভবত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সমস্ত ক্ষেত্রেই চরমভাবে জয়লাভ করতে পারে। আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যেখানে সাধারণ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই সেখানে যতদূর সম্ভব অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের মতামতের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত সংখ্যাগত হার অনুযায়ী। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যখন কোন মত সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সমর্থিত হয় তখন অন্যান্যদের মতামত প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া আবশ্যিকভাবেই উচিত নয়। যদিও তা প্রকাশ করতে দেওয়াও হয় তবে তা অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। অন্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ মতোই সংখ্যালঘিষ্ঠদের মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত, তবে তা সংক্ষিপ্ত ছোট্ট আকারে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এই একই বিষয়ের প্রয়োগ হয়। রাষ্ট্রের অধীনে যে-সব পুরুষ ও মহিলা শিক্ষকের পদে আসীন আছেন তাদের মতামতকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বলে প্রকাশ করা উচিত নয়। যদিও স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ শিক্ষকই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকেই নিজের মত হিসেবে প্রকাশ করে থাকেন। শিক্ষকদের মতামতের মধ্যে একরূপতা কখনও চাওয়া যেতে পারে না কেননা তাদের মতামতের মধ্যে বিচিত্রতাই উত্তম শিক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন। এমন প্রশ্নসমূহ যাকে কেন্দ্র করে জনগণ দ্বিধাবিভক্ত সেই প্রশ্নটির একপেশে উত্তর দিয়ে কোন মানুষই পাশ করে শিক্ষিত হতে পারে না। গণতন্ত্রের শিক্ষা সম্পর্কীয় কোন প্রতিষ্ঠানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যুক্তি সমূহকে ওজন করে দেখে নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ও মনকে মুক্ত করার শিক্ষা দেওয়া যাতে যে পক্ষটি বা দিকটি সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত তাকে আগেভাগেই গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি আসে। শিক্ষকদের অকপটে মতামত প্রকাশ করার উপর যখন নিয়ন্ত্রণ আসে তখন শিক্ষা তার সেবামূলক কাজ বন্ধ করে দিয়ে মানুষের দ্বারা গঠিত জাতি (Nation of men) গঠনের পরিবর্তে এক দল উন্মাদগ্রস্ত ধর্মান্ধকে তৈরি করে। মহাযুদ্ধের (Great War) অবসানের পর থেকে উন্মাদগ্রস্ত ধর্মান্ধতা জগতের বেশিরভাগ অংশ ছেয়ে ফেলল তার তীব্র বিষে যা ধর্মযুদ্ধের সময়গুলোতে ঘটেছিল। যারা স্বাধীন আলোচনার বিরোধিতা করে এবং যে মতামতের উপর নির্ভর করে যুবকেরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারে তার উপর যারা নিয়ন্ত্রণ চাপায় তারাই ধর্মান্ধতার বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে এবং জন লক ও তার অনুগামীরা অতলস্পর্শী গভীর বিবাদ ও অসহনশীলতার হাত থেকে যে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল সেই পৃথিবীকে তারা সেখানেই ঠেলে দেয়।

এমন দুটি প্রশ্ন দেখা যায় যে দুটির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। এদের মধ্যে একটি হল উত্তম ধরণের সরকারের কাঠামো নিয়ে এবং অন্যটি সরকারের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে। গণতন্ত্রই সরকারের উত্তম কাঠামো সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার কার্যের সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথা বলতে হয় যে তা অন্য যে-কোন সরকারের কার্যের মতোই বাজে। এমন কিছু বিশেষ বিষয় আছে যার উপর সাধারণ ক্রিয়ার প্রয়োজন। এই কারণেই সাধারণ সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজনও নেই আবার, তা আকাক্ষিতও নয়। এই অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে মত প্রকাশের পরিধিটিও পড়ে। কিন্তু মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা যাঁদেরই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে তাদেরই থাকে, তাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার যাতে একটা সীমা থাকে তার জন্য সেখানে অবশ্যই সেই সব রীতিনীতিকে কার্যকরী করে তোলার জন্য সংগঠিত পরিচালকমণ্ডলী থাকার প্রয়োজন যারা হয় বাস্তবে অথবা তত্ত্বগত দিক থেকে তা করতে পারবে। মধ্যযুগে ইউরোপে গীর্জা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদের মধ্য দিয়ে সেখানে যে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল সেই সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিলো যেসব দেশ সেখানে এই ধরনের স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে সেই স্বাধীনতার উৎসকে প্রমাণও করা যায়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে গীর্জা রাষ্টের দ্বারা অবদমিত হয়েছিল এইভাবেই সেই রাশিয়াতে স্বাধীনতার যে-কোন ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির কারণটিকেও আমরা সম্ভবত চিহ্নিত করতে পারব যে রাশিয়া কনস্টান্টিনোপলের সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমা দেশগুলোতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথমে ক্যাথলিক গীর্জা এবং পরে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় ক্রমশ বিশেষ কিছু স্বাধীনতা অর্জন করে।

শিক্ষাগত স্বাধীনতা গীর্জার স্বাধীনতার একটি অংশ ছিলো এবং এর ফলে অষ্টম হেনরীর সময় তা জ্ঞানের আলো থেকে বিচ্যুত ছিলো। আমি আবারও বলতে চাই প্রতিটি রাষ্ট্রে সরকারের কাঠামো যাই হোক, স্বাধীনতার সংরক্ষণের বিষয়ে এমন একটি পরিচালক বর্গের অস্তিত্ব থাকবে যাদের হাতে রাষ্ট্রের সীমিত স্বাধীনতার অধিকার থাকবে এবং এইসব পরিচালক বর্গের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমেরিকায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে শিক্ষাগত স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায় সেই স্বাধীনতা গণতন্ত্রের কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লক্ষ্য করা যায় না এবং এর কারণ হল সরকারের যথার্থ কার্যসমূহের সম্পর্কে বিস্তৃত ভুল ধারণা।

(৩)

খাজনা প্রদানকারীরা ভেবে থাকেন যেহেতু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দিয়ে থাকেন সেইহেতু কিভাবে তারা শিক্ষা দেবেন তা ঠিক করার অধিকার তাদের। এই আদর্শকে যদি যুক্তিগতভাবে বিচার করা যায় তবে যে অর্থটি দাঁড়াবে তা হল উচ্চ বিদ্যার জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা পেয়ে থাকেন সেগুলো নিষ্ফল এবং তাদের শিক্ষার বিষয়েও ওই একই কথা বলা যেতে পারে। তাদের বিশেষ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা তা ব্যবহার করতে পারেন না। ‘নির্বুদ্ধিতা, চিকিৎসকদের মতো নিয়ন্ত্রণের কৌশল’ (‘Folly, Doctor-like, Controlling skill’) এমন এক বস্তু যা সেক্সপীয়রকে শান্ত-মৃত্যুর জন্য কাঁদিয়েছে। তাই বেশিরভাগ আমেরিকান গণতন্ত্র বলতে যা বোঝে তা হল সমস্ত রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর এই ধরণের নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতি থাকা একান্ত দরকার। ক্ষমতার ব্যবহার অবশ্যই দরকার তবে জ্ঞানী ব্যক্তির উপর অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে প্রয়োজন। যে রোমান সেনা আর্কিমিডিসকে হত্যা করেছিল সে যদি তার যুবক বয়সে জ্যামিতি শিখতে বাধ্য হত তবে সে এই সুপ্রসিদ্ধ অপরাধীর জীবনের অবসান করবার সময় দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর আনন্দ উপভোগ করতে পারত। কোন মূর্খ আমেরিকান ধর্মান্ধ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার গণতান্ত্রিক শক্তিকে ব্যবহার করে একই ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করে যে ব্যক্তি অশিক্ষিত ব্যক্তি সম্পর্কে ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে।

সম্ভবত ক্ষমতার গণতান্ত্রিক অপব্যবহারের মধ্যেই বিশেষ বিপদ নিহিত থাকে, বিশেষ করে তখন যখন সম্মিলিতভাবে সেগুেলো উন্মত্ত জনতার দ্বারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জনতার ডাইনি শিকারের প্রবৃত্তিকে উস্কে দেবার কৌশল যে মানুষের জানা আছে সে গণতন্ত্রের অশুভ দিকটিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতাও ধারণ করে। গণতন্ত্র হল সেই জায়গা যেখানে ক্ষমতার ব্যবহার সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা হয়ে থাকে। ফলে স্বৈরাচারের দিকে যাবার ভাবাবেগ ও মাদকতা সেখানে খুব সহজেই তৈরি হয় যা অনিবার্যভাবে তাড়াতাড়ি বা ধীরগতিতে কর্তৃত্বের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এই বিপদের বিরুদ্ধে প্রধান রক্ষাকবচটি হল সঠিক শিক্ষা। সম্মিলিত ঘৃণার অযৌক্তিক উদ্রেকের প্রবণতার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষেত্রে যাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকই এই ধরণের শিক্ষা প্রদান করতে আগ্রহী। কিন্তু অভিজাততন্ত্র ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রভুরা এই কর্তব্যকে সঠিকভাবে পালন করার ক্ষেত্রে তাদের যতদূর সম্ভব বাধা দিয়ে থাকেন। কেননা এইসব মানুষদের ক্ষমতা আসে জনতার অযৌক্তিক ভাবাবেগের থেকে। তারা জানে যে যদি যৌক্তিক চিন্তার ক্ষমতা তাদের মধ্যে আসে তবে তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। তাই নীচে মূর্খতার পরস্পর-সংযুক্ত ক্ষমতা এবং উপরে ক্ষমতার প্রতি ভালোবাসা যুক্তিবান মানুষদের প্রচেষ্টাকে পঙ্গু করে দেয়। এই দেশে আজ পর্যন্ত জনগণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি শিক্ষাগত স্বাধীনতা এই অশুভ দিকটিকে নিবৃত্ত করতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তির অ-জনপ্রিয় আকারের নির্যাতন যে-কোন দেশের পক্ষে গভীরভাবে বিপজ্জনক এবং জাতীয় ধ্বংসের কারণ হিসেবে যা প্রায়শই ঘটে থাকে। চোখের সামনে আমরা স্পেনকে উদাহরণস্বরূপ দেখাতে পারি যেখানে ইহুদি ও মুরদের নির্বাসনের ফলে কৃষি-ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে গেছে এবং সেখানে সম্পূর্ণ পাগলের মতো অর্থ-ব্যবস্থার পরিচালনা গ্রহণ করা হয়েছে। স্পেন এই দুটি কারণের জন্যই ইউরোপে তার শক্তিশালী অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছিলো যদিও পঞ্চম চার্লস সর্বপ্রথম এই দুটি কারণপ্রসূত কার্যকে ঢাকা দেবার চেষ্টা করেন। খুব সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই একই কারণ জার্মানীতে একই কার্যকে উৎপাদন করবে, যদি তা নিকট ভবিষ্যতে না-ও হয় অদূর ভবিষ্যতে তা ঘটবেই। এই একই ঘটনা রাশিয়াতেও অনেক দিন ধরে চলছে এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থায় তাদের অযোগ্যতা থাকলেও, ভবিষ্যতে সেখানে যে কার্য ঘটতে চলেছে তা সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য।

এই মুহূর্তে রাশিয়া একটি দেশ হিসেবে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। সেখানে মূর্খ ধর্মান্ধদের উপর যথেষ্ট পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত থাকায় তারা নিউইয়র্কে চলে যাবার চেষ্টা করছে। অধ্যাপক এ.ভি. ছিল ১৯৩৮ সালের অ্যাট্রোনমিক্যাল জার্নাল অব সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর থেকে যে কথাগুলির উল্লেখ করেছেন সেগুলো হল :

১) প্রকৃত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অর্থাৎ সময় ও স্থানের (Time and space) পরিপ্রেক্ষিতে অসীমকে বিচার করার ধারণা গ্রহণ না করার ফলে আধুনিক বুর্জোয়াদের বিশ্বতত্ত্বের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা এক গভীর বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়েছে।

২) ফ্যাসিবাদের দালালরা একটা সময় মহাকাশবিদ্যা থেকে অন্যান্য বিষয় ও সংবাদমাধ্যম (Press) সবাইকে নিজের অধীনে আনতে পেরেছিলো, কিন্তু তাদের শত্রুভাবাপন্ন এই সব কাজের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সাহিত্যে এখন প্রতি বৈপ্লবিক বুর্জোয়া আদর্শের বৈপ্লবিক প্রচার চলছে।

৩) বিশ্বতত্ত্বের সমস্যার উপর বর্তমান সোভিয়েতের বস্তুবাদমূলক কার্যসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে এবং জনগণের শত্রুদের দ্বারা এখনো পর্যন্ত অবদমিত।

৪) বিজ্ঞান অনুরাগীদের একটি বিরাট অংশ বুর্জোয়াদের সাম্প্রতিক বিশ্বতত্ত্বের তত্ত্বসমূহের আদর্শগত দিকের প্রতি উদাসীন থাকার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে।

৫) সোভিয়েতের জনসাধারণের শত্রুদের অনাবৃত করতে নব্য সোভিয়েত বস্তুবাদমূলক বিশ্বতত্ত্বের উন্নতি একান্ত প্রয়োজন।

৬) দর্শনগত পদ্ধতিবিদ্যার (Philosophic methodolgy) উপর ভিত্তি করে বিশ্বতত্ত্বের তত্ত্বসমূহ গঠনের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের রণাঙ্গণে সোভিয়েত বিজ্ঞানের প্রবেশ করাটা বর্তমানে বিশেষ প্রয়োজন।

কেননা আমেরিকার স্থানে ‘সোভিয়েত’কে বসতে হবে। সাম্যবাদকে ‘ফ্যাসীবাদের স্থানে বসতে হবে। ক্যাথলিক সত্যের স্থানে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’কে বসতে হবে। আপনাদের শুধু সেই তথ্যকে খুঁজে বের করতে হবে যার উপর এদেশের শিক্ষাগত স্বাধীনতার শত্রুরা তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছে।

(8)

এদিকে একটি উৎসাহব্যঞ্জক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার নতুনভাবে বেড়ে না উঠে আজ থেকে একশ বছর আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে। যে কেউ ডি. টকিউভেলির ‘ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ নামক গ্রন্থে উপসংহারটি পড়ে দেখতে পারেন। সেই গ্রন্থে তিনি যা বলেছেন তার বেশিরভাগ অংশ এখনো প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ আর সত্য হিসেবে টিকে থাকতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, আমি তার এ ধরণের কথাকে মেনে নিতে পারি না যে, সভ্য জগতে আর কোন দেশেই দর্শনের প্রতি এত কম মনোযোগ দেওয়া হয় না যতটা আমেরিকায় দেওয়া হয়। কিন্তু আমি মনে করি এখনো সেখানে ন্যায়বিচারের কিছু অস্তিত্ব আছে যদিও তা হয়ত ডি. টকিউভেলির সময়ের চেয়ে কম। তিনি লিখেছেন।

মতামতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা এক মারাত্মক বেড়াজাল সৃষ্টি করে। এই বেড়াজালের ভেতরেই একজন লেখক যা খুশী তাই লিখতে পারেন, কিন্তু যদি তিনি এই বেড়াজাল অতিক্রম করতে চান তাহলে তাকে অনুশোচনা করতে হয়। তাকে শুধু জনগণের সন্ত্রাসই সহ্য করতে হয় না, প্রতিদিন গালাগালের নির্যাতন ও অবজ্ঞাও সহ্য করতে হয়। তার রাজনৈতিক জীবন চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু তিনি সেই একমাত্র কর্তৃত্বকে অসন্তুষ্ট করেছেন যে তার জীবনে সফলতাকে আনাতে পারত। সব ধরণের ক্ষতিপূরণ তার ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হয়। এমনকি তার খ্যাতির দিকটিও কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি তার মতামত প্রকাশের আগে কল্পনা করতে পারেন যে তার মতামতটি তিনি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরবেন এবং অন্যান্য অনেকেই তাকে সমর্থন করবে কিন্তু যেই না তিনি তা প্রকাশ করেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে সশব্দে দমিয়ে দেয় এবং যারা তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে চান না, বুঝতে হবে তারা তাঁকে পছন্দ করে এবং নীরবতায় তাকে পরিত্যাগ করেন। শেষে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন। প্রতিদিন তিনি যা চেষ্টা করেছেন তার জন্যই উৎপীড়িত হয়েছেন, তারপর একসময় নীরবতায় তাকে থিতিয়ে যেতে হয়। এ যেন সত্য বলার অপরাধে তীব্র মনস্তাপে জ্বলে-পুড়ে মরার অবস্থা।

গণতন্ত্রে একজন ব্যক্তির উপর সমাজের ক্ষমতা সম্পর্কে ডি. টকিউভেলি যা বলেছেন আমি মনে করি তা অবশ্যই মেনে নিতে হয়। তিনি বলছেন, যখন একটি গণতান্ত্রিক দেশের একজন প্রতিবেশী ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে দেশের অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে তুলনা করে তখন সে এই ভেবে গর্ব বোধ করে থাকে যে সে তাদের যে-কোন কারুর সঙ্গে এক ও সমান। কিন্তু যখন সে তার দেশের জনসাধারণের সমগ্রতাকে জরিপ করে এবং সেই বিরাট অংশকে নিজের বিপরীতে তুলনা করতে চায় তখন সে নিজের তুচ্ছতা ও দুর্বলতাকে মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পেরে অভিভূত হয়ে যায়। এই একই বোধ তাকে বুঝতে শেখায় যে সে তার প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে স্বাধীন (আলাদাভাবে নয়) এবং তখন সে বুঝতে পারে এই বিরাট সংখ্যক জনসাধারণের প্রভাবের কাছে সে অরক্ষিত ও একা। গণতান্ত্রিক জনসাধারণের মধ্যে জনগণই একটি অদ্বিতীয় ক্ষমতা, যার সম্পর্কে কোন অভিজাততান্ত্রিক জাতি ঠিকমতো করে কোন ধারণা করে উঠতে পারে না, কেননা এরকম দেশ কোন বিশেষ মতামতকে প্ররোচিত করে না। সে ওই মতামতসমূহকে জোর করে কার্যক্ষম করে তোলে এবং পারস্পরিক যুক্তির উপর নির্ভর করে সর্বজনের মনের বিরাট চাপে সেই মতামতসমূহ কার্যকরী মতামতে পরিণত হয়ে ওঠে।

ডি. টকিউভেলির সময় থেকে লেভিয়াথানের (Leviathan) বিরাটত্ব ব্যক্তি সত্তাকে গিলে ফেলে বহু গণতান্ত্রিক দেশেই নিজের বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা পশ্চিমা সভ্য জগতের পক্ষে আসন্ন একটি মারাত্মক বিপদের সংকেত। যদি এটিকে এখনি রোধ করা না হয় তবে বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির সমাপ্তি ঘটবে। কেননা সব বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির জন্য দরকার এমন এক বিশেষ স্বাধীনতা যা বাইরের মতামতের দ্বারা বিঘ্ন হবে না। কিন্তু যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে বিশেষ ধর্মীয় সম্মানে দেখা হয় সেখানে এই ধরণের স্বাধীনতা থাকতে পারে না, কেননা সেখানে গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা উক্ত ইচ্ছাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মনে করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি সম্মানের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার প্রতি সম্মান আরও বেশি ক্ষতিকর, কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে নিরূপণ করা যায়। সম্ভবত চল্লিশ বছর আগে ডারবান শহরে Flat Earth Society-র একজন সদস্য সমগ্র জগৎকে বিতর্কে আহ্বান করেছিলেন। এই আহ্বানে জগতের সপক্ষে সাড়া দিয়েছিলেন একজন জাহাজের ক্যাপটেন। তাঁর একটি মাত্রই যুক্তি ছিল যে পৃথিবীটি গোলাকার কেননা সমগ্র পৃথিবীটি ঘোরবার পর তিনি তাকে গোলাকারই দেখেছেন। তাঁর এই যুক্তিটি খুব সহজেই দমিত হল এবং Flat Earth সংঘের প্রচারকরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল। জনগণের কণ্ঠ এইভাবে ঘোষিত হয়ে আসছে। একজন সত্যনিষ্ঠ গণতন্ত্রবাদী অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত নেবেন যে ডারবানে পৃথিবীটা সমতল। আমি আশা করি সেদিন থেকে ডারবানের সাধারণ বিদ্যালয়ে আর কেউ শিক্ষা দিতে পারেনি (আমার বিশ্বাস যে সেখানে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই) যতক্ষণ না সে এই সম্মতি জ্ঞাপন করেছে যে পৃথিবী গোল বিষয়টি এমন একটি নাস্তিক মতো যা সাম্যবাদের দিকে মানুষকে নিয়ে যাবার একটা কৌশল হিসেবে তৈরি হয়েছে এবং পরিবার প্রথাকে ধ্বংস করবার জন্য তৈরি। এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার তথ্য ত্রুটিপূর্ণ।

দুঃখের বিষয় সমবেত প্রজ্ঞা (Wisdom) বা সমষ্টিগত জ্ঞান ব্যক্তিদের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতিভূ নয়। যে-সব ব্যক্তি গৃহীত মতামতসমূহের বিরোধিতা করে তারাই সমস্ত ধরণের অগ্রগতির উৎস হয়ে আসছে আজ পর্যন্ত। তারা নৈতিক ও বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির উৎস। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা জনপ্রিয় নয়। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের নিন্দায় সক্রেটিস, ক্রাইস্ট এবং গ্যালিলিও সমানভাবে বিপদে পড়েছেন। আগেকার দিনে দমন করার জন্য যে পন্থা ব্যবহার করা হত তা আজকে আমাদের দিনের থেকে যথেষ্ট দুর্বল ছিলো এবং সে সময় প্রচলিত ধর্মমতের যারা বিরোধিতা করত তারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলেও যথেষ্ট প্রচার পেতেন। শহীদের রক্তই গীর্জার বীজ। কিন্তু জার্মানীর মতো দেশে এই ব্যাপারটি সত্য রইল না। সেখানে শহীদের দুঃখ-যন্ত্রণাকে গোপন রাখা হয় এবং প্রচারিত শহীদের মতবাদের কোন চিহ্নই রাখা হয় না। শিক্ষাগত স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা আছেন তারা যদি কোন পথ পান তবে এই দেশকে তারা জার্মানের নীচেও নামাতে পারেন যাতে তারা যে মতবাদসমূহকে অমনোনীত করেছে তা প্রচার না পায়। ব্যক্তিচিন্তার প্রতিভূ হিসেবে তারা সংগঠিত স্বৈরাচারের সৃষ্টি করে। যা-কিছু নতুন তাকেই তারা বে আইনী বলে ঘোষণা করে। তারা মনুষ্যসমাজকে ফোপরা করে ছাড়ে এবং পরিশেষে এমন এক মনুষ্যধারার সৃষ্টি করে যারা মানব-ইতিহাসের কোন রকম চিহ্ন না রেখে জীবন-মৃত্যুর তরঙ্গের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। কারুর কারুর মনে হতে পারে যে তারা এই মুহূর্তে যেটা দাবি করছে সেটা খুব একটা গভীর বিষয় নয়। এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে, যে জগৎ যুদ্ধের দ্বারা নির্যাতনের নিদারুণ যন্ত্রণায় জর্জরিত এবং তাদের জন্য বহুসংখ্যক নির্যাতন-শিবির বা বন্দী-শিবিরে (Con-centration camp) পূর্ণ, যারা কোন পাপকর্ম করতে নারাজ, সে জগতে শিক্ষাগত স্বাধীনতার গুরুত্ব কতখানি? আমি স্বীকার করি এইসব কিছুর তুলনায় শিক্ষাগত স্বাধীনতা গুরুত্বের দিক দিয়ে কখনই প্রথম শ্রেণীভুক্ত নয়। কিন্তু এটি একই যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এ কথা যেন স্মরণ রাখি যে বিষয়টি এখন সংকটে। যাকে বড় বড় সমস্যার সামনে খুব ছোট বলে মনে হতে পারে তা হল মনুষ্যজাতির ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও আশা প্রকাশ করবার জন্য ব্যক্তি-মানব-আত্মার স্বাধীনতা, সেই আশা ও বিশ্বাস বহুজনের দ্বারা সমর্থিত হোক, কিংবা কতিপয় জনের দ্বারাই হোক অথবা কারুর দ্বারা নাই বা হোক। নতুন আশা, নতুন বিশ্বাস এবং নতুন চিন্তা মনুষ্যজাতির জন্য সর্বদাই প্রয়োজনীয় এবং সৃষ্টিশীলতাহীন সমভাব থেকেই যে তা উখিত হবে তা আশা করা যেতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *