১২. স্পার্তার প্রভাব
স্পার্তা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দরকার- প্লাতনকে বুঝতে হলে এবং অবশ্যই তার পরবর্তী অনেক দার্শনিককে বুঝতে হবে। গ্রিক চিন্তার উপরে স্পার্তার দ্বৈত ক্রিয়া আছে- একটি ক্রিয়া বাস্তবের মাধ্যমে, অপরটি কল্পনার মাধ্যমে। প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধে আথিনাকে পরাজিত করতে স্পার্তানদের সাহায্য করেছিল সেই বাস্তব কল্পনা প্রভাবিত করেছে। প্লাতনের রাজনৈতিক তত্ত্বকে এবং পরবর্তী অগণিত লেখকের রাজনৈতিক তত্ত্বকে। পূর্ণ বিকশিত কল্পনাটা পাওয়া যায় প্লুতার্খ (Plutarch)-এর বই লুকুর্গসের জীবন (Life of Lycurgus)-এ। এই কল্পনা যে আদর্শের সমর্থক সে আদর্শ রুশো (Rousseau), নিটশে (Nietzsche) এবং ন্যাশনাল সোস্যালিজম (National Socialism)-এর মতবাদ গঠনে বিরাট অংশগ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিকভাবেও বাস্তবের চাইতে কল্পনার গুরুত্ব বেশি, তবুও আমরা বাস্তব দিয়েই শুরু করব। কারণ, বাস্তবই ছিল কল্পনার উৎস।
লাকেদায়েমন (Lacedaemon) বা স্পার্তা ছিল লাকনিয়া (Laconia)-র রাজধানী, এর অবস্থান ছিল পেলপনেশাসের দক্ষিণ-পূর্বে। শাসক জাতি স্পাতানরা উত্তর দিক থেকে আগত দরীয় (Dorian)-দের আগমনের সময় এই দেশ জয় করেন এবং সেখানকার যে জনগোষ্ঠীকে তারা দেখতে পান তাঁদের পরিণত করেন ভূমিদাসে। এই ভূমিদাসদের বলা হতো হেলট (helot)। ঐতিহাসিক যুগে সমস্ত জমিরই মালিক ছিল স্পার্তানরা কিন্তু রীতি এবং আইন অনুসারে তাদের জমি চাষ করা ছিল নিষিদ্ধ। তার একটি যুক্তি ছিল এটি হীনম, আর একটি কারণ সবসময়ই সামরিক কর্মের জন্য প্রস্তুত থাকা। ভূমিদাসদের ক্রয়-বিক্রয় করা যেত না তারা জমির সঙ্গে যুক্ত থাকত, জমিকে নান ভাগে বিভক্ত করা হতো, প্রতিটি সাবালক স্পার্তান পুরুষ এক কিংবা একাধিক ভূমিখণ্ডের মালিক হতেন। হেলটনদের মতো এই জমিও ক্রয়-বিক্রয় করা যেত না এবং আইন অনুসারে পিতার থেকে পুত্রের হাতে যেত। (অবশ্য উইল করা যেত)। হেলটের কাছ থেকে জমির মালিক সত্তর মিডিগ্নি (medimni- তকালীন মুদ্রাবিশেষ- প্রায় ১০৫ বুশেল) খাদ্যশস্য নিজের জন্য, বারো মিডিগ্নি স্ত্রীর জন্য এবং একটি বিশিষ্ট পরিমাণ মদ এবং ফল প্রতিবছর পেতেন।° উদ্বৃত্ত যা কিছু থাকত সবটাই হতো হেলটের সম্পত্তি। স্পার্তানদের মতোই হেলটরা গ্রিক ছিলেন এবং নিজেদের ভূমিদাস অবস্থার জন্য তাঁরা খুব বিক্ষুদ্ধ ছিলেন। সম্ভব হলেই তারা বিদ্রোহ করতেন। এই বিপদের জন্য স্পার্তানদের গুপ্ত পুলিশ থাকত, তবে এই সাবধানতার পরিপূরক। হিসেবে তারা আর একটি উপায় গ্রহণ করতেন। বছরে একবার তারা হেলটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন, তখন তাঁদের যুবকরা যাকেই অবাধ্য মনে হতো তাকেই খুন করতে পারতেন, অথচ তাঁদের নরহত্যার আইনী দায় থাকত না। রাষ্ট্র হেলটদের মুক্তি দিতে পারত কিন্তু তাদের প্রভুরা পারতেন না। যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য। তারা মুক্তি পেত কিন্তু এঘটনা ছিল খুবই বিরল।
স্পার্তানরা প্রতিবেশী দেশ মেসেনিয়া (Messenia) জয় করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময় এবং সেখানকার অধিবাসীদের প্রায় সবাইকে হেলট-এর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন। স্পার্তাতে স্থানাভাব হয়েছিল, নতুন অঞ্চল কিছুদিনের জন্য এই অসন্তোষের উৎসকে চাপা দিয়েছিল।
সাধারণ স্পার্তানদের জন্য বরাদ্দ ছিল ভূমির অংশ, অভিজাতদের ছিল নিজস্ব জমিদারি অথচ ভূমির অংশগুলো ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দিষ্ট সাধারণের জমি।
লাকনিয়া-র অন্য অংশের সাধারণ অধিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কোনো অংশ ছিল না, তাদের বলা হতোপেরিওসি (Perioeci)।
একমাত্র যুদ্ধের উপযোগী করেই জন্ম থেকেই স্পার্তান নাগরিকদের তৈরি করা হতো। উপজাতির নেতাদের পরিদর্শনের পর রুগ্ন শিশুদের ঠাণ্ডায় রেখে দেওয়া হতো, যাদের শক্তিশালী মনে করা হতো, শুধুমাত্র তাদেরই বাঁচতে দেওয়া হতো। কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত বালকদের একটি বড় স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হতো। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল তাদের কষ্টসহিষ্ণু, বেদনা সম্পর্কে নিস্পৃহ এবং নিয়মানুবর্তী করা। সাংস্কৃতিক কিংবা বৈজ্ঞানিক শিক্ষার মতো কোনো অনর্থক ব্যাপার ছিল না, শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত উত্তম সৈনিক সৃষ্টি করা।
কুড়ি বছর বয়সে শুরু হতো সত্যিকার সামরিক কার্য। বয়স কুড়ি হলে পর সবারই বিয়ের অনুমতি থাকত কিন্তু বয়স ত্রিশ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের পুরুষদের গৃহে থাকতে হতো, তাঁদের বিবাহিত জীবনটা চালাতে হতো একটি বেআইনী গোপন ব্যাপারের মতো করে। ত্রিশ বছরের পরে তারা পূর্ণ নাগরিকত্ব পেত। প্রতিটি নাগরিকই একটি সাধারণ ভোজানাগারের সদস্য ছিলেন, অন্য সদস্যদের সঙ্গে একসঙ্গেই আহার করতেন, নিজেদের জমি থেকে উৎপন্ন খাদ্যের একটা অংশ তারা ভোজনাগারকে চাঁদা হিসেবে দিতেন। রাষ্ট্রের তত্ত্ব ছিল কোনো স্পার্তান নাগরিক নিঃস্ব হবেন না এবং কেউ ধনী হবেন না। আশা করা হতো প্রত্যেকেই তাঁর নিজের জমির উৎপাদনে জীবন ধারণ করবেন, বিনামূল্যে দান করা ছাড়া তারা জমি হস্তান্তর করতে পারতেন না। সোনা কিংবা রূপার মালিক হওয়ার অধিকার কারও ছিল না এবং মুদ্রা তৈরি হতো লোহা দিয়ে। স্পার্তানদের সারল্য প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়।
স্পার্তাতে মেয়েদের অবস্থা ছিল অদ্ভুত। গ্রিসের অন্যান্য জায়গার ভ্রান্ত মেয়েদের মতো তাদের পর্দার আড়ালে রাখা হতো না। ছেলেদের মতোই মেয়েদেরও একইরকম শারীরিক শিক্ষা নিতে হতো, আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ছেলেরা এবং মেয়েরা একসঙ্গে উলঙ্গ হয়ে কসরৎ করতেন। আশা করা হতো (আমি পুখ রচিত লুকুৰ্গস এর নর্থ-কৃত অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি)ঃ
দৌড়ানো, কুস্তি করা, বার (bar-লম্বা ডাণ্ডা, যেমন প্যারালাল বার) নিক্ষেপ করা, বর্শা (dart?) নিক্ষেপ করা ইত্যাদি ক্রিয়ার সাহায্যে কুমারীদের দেহ কঠিন করা উচিত। উদ্দেশ্য, তাঁরা ভবিষ্যতে গর্ভবতী হলে শক্তিশালী এবং প্রাণবন্ত দেহ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে সন্তান সুস্থতর অবস্থায় জন্মগ্রহণ করবে এবং তারা উন্নততর বংশবিস্তার করবেন। তাছাড়া এইরকম ব্যায়ামে শক্তি সংগ্রহ করে প্রসব বেদনা সহজেই সহ্য করতে পারবেন…। যদিও কুমারীরা নিজেদের খোলাখুলিভাবে প্রদর্শন করতেন তবুও কোনো সতোর অভাব ছিল না, কেউ কোনো অসৎ ব্যবহারও করতেন না। পুরো ব্যাপারটাই ছিল খেলা আর খেলনা, যৌবনের রং এবং উজ্জ্বলতাবিহীন।
যারা বিয়ে করতেন না আইনত তাঁদের উপরে কলঙ্ক আরোপিত হতো এবং এমনকি শীতলতম দিনেও যুবক-যুবতিদের ব্যায়াম এবং নৃত্য করার স্থানের বাইরে নগ্নদেহে হাঁটাহাঁটি করতে বাধ্য করা হতো।
রাষ্ট্রের পক্ষে লাভজনক নয় এরকম কোনো ভাবাবেগ মেয়েদের কখনোই প্রকাশ করতে দেওয়া হতো না। কাপুরুষ সম্পর্কে তারা ঘৃণা প্রকাশ করতে পারতেন, সেই কাপুরুষ আপন সন্তান হলে সেই মহিলাদের প্রশংসা করা হতো। তাঁদের নবজাত শিশু দুর্বল হওয়ায় শিশুটিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এবং যুদ্ধে সন্তান নিহত হলেও তাদের দুঃখ দেখাবার কোনো অধিকার ছিল না। অন্যান্য গ্রিকরা মনে করতেন স্পাতার মহিলাদের সতীত্ব অসাধারণ, একই সঙ্গে, সন্তানহীনা বিবাহিতা মহিলাকে রাষ্ট্র যদি তার স্বামীর তুলনায় সন্তান উৎপাদনে সক্ষমতর কোনো পুরুষকে নাগরিক উৎপাদনের জন্য খুঁজে নিতে বলত তাহলেও মহিলা কোনো আপত্তি করতেন না। আইনত সন্তান জন্মের জন্য উৎসাহ করা হতো। আরিস্ততেলেস বলেছেন, তিনটি পুত্রের জনককে সামরিক কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতো এবং চারটি পুত্রের জনককে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতো।
স্পার্তার সংবিধান ছিল জটিল। দুটি ভিন্ন পরিবারের দুজন রাজা ছিলেন এবং তাঁরা রাজ্য লাভ করতেন উত্তরাধিকার সূত্রে। যুদ্ধের সময় যে কোনো একজন রাজা সৈন্য পরিচালনা করতেন কিন্তু শান্তির সময় তাদের ক্ষমতা ছিল সীমিত। সামাজিক ভোজে তারা সাধারণ নাগরিকদের দ্বিগুণ ভোজ্য পেতেন এবং কোনো রাজার মৃত্যু হলে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হতো। তারা প্রবীণদের পরিষদের সদস্য হতেন, সেই পরিষদে সদস্য সংখ্যা থাকত ত্রিশ জন (দুজন রাজা সমেত), বাকি আটাশ জনের বয়স ষাট বছরের উপরে হওয়া ছিল আবশ্যিক। সমস্ত নাগরিকরা মিলে তাদের সারাজীবনের জন্য নির্বাচিত করতেন তবে শুধুমাত্র অভিজাত বংশের নাগরিকদেরই নির্বাচিত করা হতো। এই পরিষদ ফৌজদারি মামলার বিচার করত এবং যে সমস্ত বিষয় পরিষদে উপস্থাপন করা হবে সেগুলো প্রস্তুত করত। এই পরিষদ সমস্ত নাগরিকদের নিয়ে গঠিত হতো। এই সংসদ কোনো কিছুর সূচনা করতে পারত না তবে তার সামনে কোনো প্রস্তাব এলে তার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ভোট দিতে পারত। তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনো আইন তৈরি করা যেত না। কিন্তু পরিষদের সম্মতি প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট ছিল না; আইনসিদ্ধ। হওয়ার আগে প্রবীণদের এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের (magistrate- শাসক) নিজেদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হতো।
রাজা, প্রবীণ পরিষদ এবং সংসদ ব্যতীত সরকারের একটা চতুর্থ শাখা ছিল, এই শাখা ছিল স্পার্তারই বিশেষত্ব। এঁরা ছিলেন পাঁচজন এফর (epher)।৩২ সমস্ত নাগরিকদের ভিতর থেকে এঁদের নির্বাচন করা হতো, তাদের নির্বাচন পদ্ধতিকে আরিস্ততেলেস বলেছেন অতীব শিশুসুলভ এবং Bury বলেছেন, এ নির্বাচন ছিল প্রায় লটারির মতো। তাঁরা ছিলেন সংবিধানের একটি গণতান্ত্রিক উপাদান। আপাতদৃষ্টিতে এর উদ্দেশ্য ছিল রাজাদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। প্রতি মাসে রাজারা সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিতেন, তারপর এফররা শপথ নিতেন- যতদিন রাজারা তাদের শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেন ততদিন তাদের রক্ষা করা। যে কোনো রাজা যখন যুদ্ধজাতীয় কোনো অভিযানে যেতেন তখন তাঁর আচরণের প্রতি নজর রাখার জন্য দুজন এফর তাঁর সঙ্গে থাকতেন। এফররা ছিলেন সর্বোচ্চ দেওয়ানী আদালত কিন্তু রাজাদের উপর তাদের ফৌজদারী অধিকারও ছিল।
পরবর্তী প্রাচীন যুগে মনে করা হতো স্পার্তার সংবিধান নির্মাণ করেছিলেন লুকুৰ্গস নামে একজন আইন প্রণয়নকারী। মনে করা হতো ৮৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি তাঁর আইনগুলো ঘোষণা করেছিলেন। আসলে স্পার্তার পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছিল এবং লুকুৰ্গস ছিলেন একজন পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব, আদিতে এক দেবতা। তাঁর নামের অর্থ নেকড়ে-তাড়ুয়া (wolf-repeller) এবং তাঁর উৎপত্তি ছিল আর্কাদীয় (Arcadian) থেকে।
অন্যান্য গ্রিকদের ভিতরে স্পার্তা এমন প্রশংসা অর্জন করেছিল যা আমাদের কাছে কিছুটা আশ্চর্যজনক মনে হয়। পরবর্তীকালের তুলনায় প্রথম দিকে অন্যান্য গ্রিক নগরীর সঙ্গে স্পার্তার পার্থক্য ছিল অনেক কম। প্রথম দিকে সেখানে অন্যান্য স্থানের সমমানের কবি এবং শিল্পী জন্মেছেন। কিন্তু প্রায় সপ্তম খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি কিংবা তারও পরে স্পার্তার সংবিধান (ভ্রমক্রমে লুকুর্গসের উপর আরোপিত) আমাদের আলোচিত আকার ধারণ করে। যুদ্ধ জয়ের স্বার্থে অন্যান্য সব জিনিস বলি দেওয়া হয় এবং বিশ্ব সভ্যতায় গ্রিসের যে দান, স্পার্তা তাতে কোননারকমে অংশগ্রহণে বিরত হয়। নাৎসীরা জয়লাভ করলে যেরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করত আমাদের কাছে স্পার্তান রাষ্ট্র তার একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ বলে প্রতিভাত হয় কিন্তু গ্রিকদের অন্যরকম মনে হতো। Bury বলেনঃ
পঞ্চম শতাব্দীতে আথিনা কিংবা মিলেতস থেকে আগত কোনো অপরিচিত ব্যক্তি যদি তাদের ইতস্তত পরিব্যাপ্ত কয়েকটি গ্রাম দিয়ে গঠিত প্রাকারহীন সাদামাঠা নগর দেখতেন- তার নিশ্চয়ই মনে হতো, তিনি যেন কোনো সুদূর অতীতকালে পৌঁছে গিয়েছেন। তখনকার মানুষ বর্তমান যুগের তুলনায় ছিলেন সাহসী, সরল এবং সৎ, সম্পদ তাঁদের নষ্ট করতে পারেনি, নানা চিন্তাধারা তাঁদের অশান্ত করে তোলেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দূরকল্পনে ব্যস্ত প্লাতনের মতো এক দার্শনিকের কাছে স্পার্তার রাষ্ট্রকে মনে হয়েছিল আদর্শ রাষ্ট্রের নিকটতম। সাধারণ গ্রিকের কাছে স্পার্তাকে মনে হতো, কঠোর কিন্তু সরল, সুন্দর একটি সংগঠন, যেন দরীয় মন্দিরের মতোই একটি রাজসিক দরীয় নগর, তাঁর নিজের বাসস্থানের চাইতে অনেক মহান কিন্তু সেরকম আরামদায়ক নয়।
অন্যান্য গ্রিকদের চোখে স্পার্তাকে প্রশংসাৰ্হ মনে করার একটি কারণ স্পার্তার স্থায়িত্ব। অন্যান্য সমস্ত গ্রিক নগরে বিপ্লব হয়েছে কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী স্পার্তার সংবিধান অপরিবর্তিত থেকেছে, তবে এফরদের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে- সেটাও কিন্তু হয়েছে আইনানুগ পদ্ধতিতে, কোনো রকম হিংসা ছাড়াই।
এটা অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘকাল স্পার্তানরা তাদের প্রধান উদ্দেশ্য- অপরাজেয় যোদ্ধৃজাতি সৃষ্টি করা- তাতে সফল হয়েছিলেন। থার্মোপুলায়ে-র (Thermopylae) যুদ্ধে (৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) তাঁরা হিসাব মতে পরাজিত হলেও তাঁদের বীরত্বের এটা বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। থার্মোপুলায়ে ছিল সঙ্কীর্ণ একটি গিরিপথ, আশা করা গিয়েছিল সেখানে পারসিক সেনাকে রুখে দেওয়া যাবে। তিনশ স্পার্তান এবং তাঁদের সহকারীরা সমস্ত সম্মুখ আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারসিকরা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি ঘুরপথ আবিষ্কার করেন এবং স্পার্তানদের দুদিক থেকে যুগপৎ আক্রমণ করতে সক্ষম হন। প্রতিটি স্পার্তান নিজ অবস্থানে মৃত্যুবরণ করেন। দুজন অসুস্থতার জন্য ছুটিতে ছিলেন, তাঁদের অক্ষিজ অসুস্থতা প্রায় অস্থায়ী অন্ধত্বের সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের মধ্যে একজন তার ভূমিদাসকে জবরদস্তি করে নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। অপর জন, আরিস্তদেমস, ঠিক করলেন যে, তিনি যুদ্ধ করার পক্ষে বড়ই রুগ্ন এবং তিনি যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকেন। স্পাতায় প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর সঙ্গে কেউ বাক্যালাপ করতেন না, সবাই তাঁকে বলতেন কাপুরুষ আরিস্তদেমস। একবছর পর প্লাতায়েয়ার যুদ্ধে বীরের মৃত্যুবরণ করে তিনি কলঙ্কমুক্ত হন, সেই যুদ্ধে স্পার্তানরা জয়ী হয়েছিলেন।
যুদ্ধের পর স্পার্তানরা থার্মোপুলায়ে-র যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করেন, তাতে মাত্র লেখা ছিলঃ হে অপরিচত, লাকোয়েমনের অদিবাসীদের বলুন- তাঁদের আদেশ পালন করে আমরা এখানে শুয়ে।
বহুদিন পর্যন্ত স্পার্তানরা স্থলযুদ্ধে নিজেদের অজেয় প্রমাণ করেছিলেন। ৩৭১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্পার্তানরা তাদের প্রাধান্য বজায় রেখেছিলেন, সেই বছর লেউকা-র (Leuctra) যুদ্ধে থেবানদের (Theban) কাছে তাঁরা পরাজিত হন। তাদের সামরিক প্রাধান্যের এখানেই ইতি।
যুদ্ধ ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিষয়ে স্পার্তার বাস্তবতা এবং তত্ত্বে মিল ছিল না। স্পাতার গৌরবময় যুগের মানুষ হেরোদতস (Herodotus)। তিনি এক আশ্চর্যজনক মন্তব্য করেছেন- কোনো স্পার্তানই ঘুষের লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। সম্পদকে ঘৃণা করা এবং সরল জীবন ভালোবাসা- স্পার্তানদের প্রধান শিক্ষা হওয়া সত্ত্বেও। আমরা শুনেছি স্পার্তান মেয়েরা সতী ছিলেন কিন্তু এমন ঘটনা বহু বার ঘটেছিল যে, তাঁর মায়ের স্বামীর সন্তান নয়- এই যুক্তিতে রাজপদের সুখ্যাত উত্তরাধিকারীর উত্তরাধিকার অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। আমরা শুনেছি দেশপ্রেমে স্পার্তানরা ছিলেন অনমনীয় কিন্তু প্লতয়েয়া-র যুদ্ধবিজয়ী রাজা পসেনিয়াস (Pausanias), ক্সারেক্সস-এর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে জীবন শেষ করেন। এই ধরনের ঘোরতর (flagrant) ব্যাপার ছাড়া স্পার্তার নীতি চিরকালই ছিল সঙ্কীর্ণ এবং প্রাদেশিকতার দোষে দুষ্ট। আথিনা যখন এশিয়া মাইনর এবং তার নিকটস্থ দ্বীপগুলোর গ্রিকদের পারসিকদের থেকে মুক্ত করে, স্পার্তা তখন এ ব্যাপারে উদাসীন; যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের পেলপনেশাসকে নিরাপদ মনে হতো ততক্ষণ তারা অন্যান্য গ্রিকদের ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সমস্ত হেলেনীয় (গ্রিক) জগতের ঐক্যের প্রতিটি প্রচেষ্টা স্পার্তানদের স্বাতন্ত্রবোধের দরুন বিফল হয়।
স্পার্তার পতনের পর আরিস্ততেলেসের জীবনকাল। তিনি স্পার্তার সংবিধান সম্পর্কে অত্যন্ত শত্রুতাপূর্ণ একটি বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য অন্যান্যদের বক্তব্যের চাইতে এতই পৃথক যে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তিনি একই জায়গা সম্পর্কে বলছেন, যেমন-আইনপ্রণেতা পুরো রাষ্ট্রটাকে কষ্টসহিষ্ণু এবং মিতাচারী করতে চেয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছাপূরণ করতে পেরেছেন কিন্তু মেয়েদের তিনি উপেক্ষা করেছেন, তাঁরা সবরকমের অমিতাচারী এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। এর ফলে সেরকম রাষ্ট্রে বিত্তের গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে যায়, বিশেষত যদি নাগরিকরা তাঁদের স্ত্রীদের কর্তৃত্বাধীন হন, অধিকাংশ যুদ্ধপ্রিয় জাতির ভিতরেই এরকম ঘটনা ঘটে….। সাহসের ক্ষেত্রেও তাই- শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই সাহসের প্রয়োজন, দৈনন্দিন জীবনে তার কোনো স্থান নেই। এমনকি সাহসের ব্যাপারেও লাকেদায়েমন এর মেয়েদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর…। আদিমতম যুগ থেকে লাকোয়েমন-এর মেয়েদের মধ্যে উচছুঙ্খলতার অস্তিত্ব ছিল, অবশ্য মাত্র এরকমই আশা করা যায়। প্রচলিত কাহিনি হলো লুকুৰ্গস (Lycurgus) যখন মেয়েদের তার আইনের অধীনে আনতে চেয়েছিলেন তখন মেয়েরা প্রতিরোধ করেন এবং তিনি তাঁর প্রচেষ্টা বন্ধ করেন।
তিনি স্পার্তানদের লোভী বলে দোষারোপ করেছেন, তার কারণ হিসেবে বলেছেন সম্পদের অসম বণ্টন। তিনি বলেন, যদিও ভূখণ্ডগুলো বিক্রি করা যায় না কিন্তু সেগুলো দান করা চলে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে উত্তরপুরুষদের দেওয়া চলে। তিনি যোগ করেছেন, ভূমির পাঁচ ভাগের দুভাগ মেয়েদের ছিল। এর ফল নাগরিকদের সংখ্যা বিরাটভাবে হ্রাস পাওয়াঃ শোনা যায় একসময় তাঁদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার কিন্তু থেবিস (Thebes)-এর কাছে পরাজিত হওয়ার সময় তার সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও কম।
আরিস্ততেলেস স্পার্তার সংবিধানের প্রতিটি অঙ্গেরই সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এফররা অনেক সময় অতি দরিদ্র হওয়ায় তাঁদের উৎকোচ দেওয়াও খুব সহজ ছিল এবং তাদের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে, রাজারাও তাদের সঙ্গে সদ্ভাব। রাখতে বাধ্য ছিলেন। সেইজন্য সংবিধানটা গণতন্ত্রের রূপান্তরিত হয়েছিল। আমরা শুনেছি এফরদের সুযোগ সুবিধা (licence) ছিল অত্যধিক, তাঁদের জীবনযাত্রার ধরন ছিল সংবিধানের মর্মবিরোধী। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে কঠোরতা ছিল এমন অসহনীয় যে, তাঁরা ইন্দ্রিয়সুখের জন্য বেআইনি গোপন উপায়ের আশ্রয় নিতেন।
আরিস্ততেলেস লিখেছেন স্পার্তার অবক্ষয়ের যুগে, কিন্তু কোনো কোনো ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য যে, তাঁর উল্লিখিত পাপগুলোর অস্তিত্ব প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। তাঁর বলার ভঙ্গি এত নীরস এবং বাস্তবানুগ যে, তাঁকে অবিশ্বাস করা কঠিন এবং আইনের মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতাজনিত আধুনিক সমস্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বক্তব্য মেলে। কিন্তু মানুষের কল্পনায় আরিস্ততেলেসের স্পার্তার অস্তিত্ব ছিল না; অস্তিত্ব ছিল তা (Plutarch) এর পৌরাণিক স্পার্তার এবং প্লাতনের রিপাবলিক-এ দার্শনিক আদর্শস্বরূপ স্পার্তার। শতাব্দীর পর শতাব্দী তরুণরা এই সমস্ত বই পড়েছেন এবং তারা আকাঙ্ক্ষা করেছেন লুকুৰ্গস হওয়ার কিংবা দার্শনিক-রাজা হওয়ার। এর ফল আদর্শবাদ এবং ক্ষমতালিপ্সার মিলন- যা মানুষকে বারবার পথভ্রষ্ট করেছে এবং আজকের দিনেও তাই করে চলেছে।
আধুনিক এবং মধ্যযুগের পাঠকদের জন্য স্পার্তা সম্পর্কে পুরোকাহিনি প্রধানত সৃষ্টি করে গেছেন প্লুতার্খ। তাঁর লিখনকালে স্পার্তার অস্তিত্ব ছিল কল্পনারঙিন অতীতে। আমাদের তুলনায় কলম্বাস যতটা দূর অতীতে, পুখের সঙ্গে স্পার্তার কালের পার্থক্য ছিল ততটাই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিকদের পুতার্থের বক্তব্যগুলো খুবই সাবধানে বিচার করা উচিত কিন্তু পৌরাণিক ইতিহাস রচয়িতাদের কাছে এর গুরুত্ব বিরাট। মানুষের কল্পনা, আদর্শ এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রভাবিত করে গ্রিস চিরকাল পৃথিবীকে প্রভাবিত করে এসেছে, প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে নয়। রোম বানিয়েছিল রাস্তা, তার অনেকগুলো এখনও রয়েছে, আর বানিয়েছিল আইন-আধুনিক যুগের বহু আইনের উৎস সেই আইনগুলো। কিন্তু এগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে রোমের সামরিক বাহিনী। গ্রিকরা প্রশংসনীয় যোদ্ধা হলেও তাঁরা রাজ্য জয় করেছেন অতি সামান্য। কারণ, তাঁদের সামরিক বোষ তারা প্রয়োগ করেছেন পরস্পরের উপর। মধ্যপ্রাচ্যে গ্রিক সভ্যতা বিস্তারের কাজটি এবং গ্রিক ভাষাকে মিশর ও সিরিয়া-র সমুদ্র উপকূল থেকে দূরবর্তী এশিয়া মাইনরের অঞ্চলগুলোতে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কাজটা অর্ধ-বর্বর আলেকজান্দ্রসের জন্য রক্ষিত ছিল। গ্রিকরা কখনোই এই দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না, সামরিক ক্ষমতার অভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে সঘবদ্ধ হতে অপারগ হওয়ায়। চিরকালই গ্রিসের রাজনৈতিক (Hellenism) বাহকরা ছিলেন অ-গ্রিক কিন্তু গ্রিক প্রতিভা অপরিচিত জাতিদের এমনই প্রভাবিত করেছিল যে, তাঁরা বিজিত জাতির সংস্কৃতি প্রসারের প্রচেষ্টা করে গিয়েছিলেন।
বিভিন্ন গ্রিক নগরীর ভিতরে ছোটখাটো যুদ্ধ কিংবা কোনো দলের নেতৃত্বের জন্য ঘৃণ্য কলহ পৃথিবীর ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো এই স্বল্পকালব্যাপী ঘটনা-অন্তে মানবজাতির বিধৃত স্মৃতি। ঠিক যেমন একজন পর্বতারোহী সারাদিন ঝোড়ো বাতাস এবং তুষারের সঙ্গে লড়াই করে আল্পস পর্বতে উদ্ভাসিত সূর্যোদয়ের স্মৃতি মনে রাখে। এই স্মৃতিগুলো ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হতে হতে মানুষের মনে রেখে গেল কয়েকটি শিখরের স্মৃতি, সেই শিখরগুলো ছিল প্রথম আলোকের বিশিষ্ট ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। ঐ স্মৃতি এই জ্ঞান জিইয়ে রেখেছিল যে, মেঘের অন্তরালে একটা দীপ্তি এখনও আছে, সেই দীপ্তি প্রকাশ পেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। এদের ভিতরে খ্রিষ্টধর্মের প্রথম যুগে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন প্লাতন, আরিস্ততেলেস ছিলেন মধ্যযুগের চার্চে কিন্তু রেনেসাঁ-র পর মানুষ যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে শুরু করল তখন তাঁদের সবচাইতে বেশি নজর পড়ল পুতার্থের উপর। অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ এবং ফরাসি উদার পন্থীদের তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন, প্রভাবিত করেছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের। জার্মানির রোমান্টিক আন্দোলনকে এবং প্রধানত আজ পর্যন্ত পরোক্ষপথে জার্মান মত ও চিন্তাকে প্রভাবিত করে চলেছেন। কোনোদিকে তার প্রভাব ভালো ছিল আবার কোনোদিকে মন্দ, লুকুৰ্গস এবং স্পার্তার ক্ষেত্রে প্রভাব ছিল মন্দ। লুকুৰ্গস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে। এবং কিছুটা পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা সত্ত্বেও আমি তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব।
প্লুতার্থ বলছেন, লুকুৰ্গস স্পার্তার আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করার জন্য নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। ক্ৰিতীয় আইন তার পছন্দ ছিল, আইনগুলো ছিল অত্যন্ত সরল এবং কঠোর৬৬ কিন্তু ইওনীয়-র আইনগুলো ছিল তাঁর অপছন্দের, সেখানে ছিল আধিক্য এবং অন্তঃসারশূন্যতা। মিশরে তিনি শিখেছিলেন সৈন্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পৃথক করে রাখার সুবিধা এবং পরে দেশভ্রমণ সেরে এসে তিনি এই রীতি স্পার্তায় প্রচলন করেনঃ সেখানে তিনি বণিক, কর্মিক এবং শ্রমিক-এঁদের প্রত্যেকেই স্বকীয়ভাবে এক একটি অংশরূপে স্থাপন করে একটি মহান কমনওয়েলথ (Commonwealth- সাধারণতন্ত্র) স্থাপন করেছিলেন। স্পার্তার সমস্ত নাগরিকদের ভিতরে জমি সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নগর থেকে দেউলিয়া হওয়া, হিংসা, লোভ, স্বাদু খাদ্য গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা এবং সবরকম দারিদ্র্য ও সম্পদ নির্বাসিত করা। তিনি স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র লৌহমুদ্রা অনুমোদন করেছিলেন, তার মূল্য এত কম ছিল যে, দশ মিনস (minas-গ্রিসের প্রাচীন মুদ্রা) মূল্যের সেই মুদ্রা জমিয়ে রাখতে হলে বাড়ির একটা গোটা ভাড়ারঘর প্রয়োজন হতো। এই পদ্ধতিতে তিনি সমস্ত বাহুল্য এবং অলাভজনক বিজ্ঞান-কে নির্বাসন দিয়েছিলেন। কারণ, এই সমস্ত চর্চা যারা করেন তাদের দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না এবং একই আইনে সমস্ত বহির্বাণিজ্যকে অসম্ভব করেছিলেন। বাগী, মেয়েমানুষের দালাল এবং মণিকাররা লৌহমুদ্রাকে অপছন্দ করতেন এবং সেইজন্য স্পাতাকে তারা এড়িয়ে চলতেন। পরে তিনি স্থির করেন সমস্ত নাগরিকরা একই সঙ্গে একই খাদ্য খাবেন।
অন্যান্য সমাজ সংস্কারকদের মতো লুকুৰ্গসও ভাবতেন শিশুদের শিক্ষা প্রধানতম এবং মহত্তম কর্ম, একজন আইন সংস্কারকের যা প্রতিষ্ঠা করা উচিত এবং সামরিক ক্ষমতাই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য তাদের সবার মতো তিনিও জন্মহার বৃদ্ধি করবার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। কুমারীরা তরুণদের সামনে নগ্নদেহে খেলাধুলা ও নৃত্য করত, এগুলো ছিল তরুণদের উত্তেজিত করে বিয়ের দিকে আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ করার চেষ্টা। প্লাতন বলেছেন, জ্যামিতিক কারণ নয়, এতে নিহিত ছিল ভালো লাগা এবং ভালোবাসা। প্রথম কয়েকবছর বিয়েকে একটা গোপন প্রেমের মতো করে রাখার অভ্যাসের ফলে প্রেমের উত্তেজনা চলতে থাকত এবং পরস্পরকে পাওয়ার ইচ্ছা ও আকাক্ষা নতুন করে তৈরি হতো- পুখের অন্তত এইরকমই মত ছিল। তার ব্যাখ্যা অনুসারে কোনো বৃদ্ধ তাঁর তরুণী স্ত্রীর গর্ভে কোনো তরুণকে সন্তান উৎপাদন করতে অনুমোদন করলে বৃদ্ধকে দোষী ভাবা হতো না। কোনো সৎ ব্যক্তি পরস্ত্রীতে অনুরক্ত হলে তাকে সেই কামনাসক্ত ক্ষেত্রে কর্ষণ করতে এবং সুসন্তানের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেই স্ত্রীর সঙ্গে শয়তানের অনুমতি দিতে তার স্বামীকে অনুরোধ করা আইনসঙ্গত ছিল। নির্বোধ হিংসা বাঞ্ছনীয় ছিল না। কারণ, সন্তান কোনো এক ব্যক্তির নিজস্ব হোক-এটা লুকুৰ্গস পছন্দ করতেন না, তিনি চাইতেন সাধারণের মঙ্গলের জন্যই সন্তান সবার হোক- সেই কারণেও তিনি চাইতেন ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্মদাতা সবাই হবেন না, হবেন শুধুমাত্র সর্বাপেক্ষা সৎ মানুষরা। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করেছেন চাষিরা তাদের গৃহপালিত জন্তুদের ক্ষেত্রে এই নীতিই প্রয়োগ করেন।
সন্তান জন্মের পর পিতা তাকে পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সামনে পরীক্ষা করানোর জন্য নিয়ে যেতেন। সন্তান সুস্থ হলে তাকে প্রতিপালন করার জন্য পিতাকে পুনঃপ্রদান করা হতো কিন্তু সুস্থ না হলে একটা গভীর কূপের জলে তাকে নিক্ষেপ করা হতো। প্রথম থেকেই শিশুদের শক্তপোক্ত করার জন্য কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো, কোনো কোনো দিক দিয়ে ব্যাপারটা ভালোই ছিল, যেমন- তাঁদের নবজাত শিশুকে জামাকাপড় পরানো হতো না। সাত বছর বয়সে ছেলেদের বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে আবাসিক বিদ্যালয়ে রাখা হতো, সেখানে তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করা হতো, প্রত্যেক দলকেই নিজেদের ভিতরে একজনের আদেশ মেনে চলতে হতো, সাহস এবং বুদ্ধির বিচারে দলনেতা নির্বাচন করা হতো। নিজেদের পালা অনুসারে তাদের খানিকটা শিক্ষা হতো, বাকি সময়টা তারা শিখত আদেশ পালন করতে, ব্যথা-বেদনাকে অগ্রাহ্য করতে, পরিশ্রম অভ্যাস করতে, যুদ্ধে নিশ্চলতা অতিক্রম করতে। অধিকাংশ সময় তারা খেলা করত একসঙ্গে উলঙ্গ হয়ে, বারো বছর বয়স হওয়ার পর তারা কোনো জামা গায়ে দিত না, তারা সব সময়ই নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন থাকত এবং বছরে কয়েকটা দিন ছাড়া তারা কখনোই স্নান করত না। তারা ঘুমোত খড়ের বিছানায়, শীতকালে সেই বিছানায় কাঁটা মেশানো থাকত। তাদের চুরি করতে শেখানো হতো এবং ধরা পড়লে শাস্তি দেওয়া হতো-শাস্তির কারণ চৌর্যবৃত্তি নয়, বোকামি।
মেয়েদের ভিতরে না হলেও ছেলেদের ভিতরে সমকামী প্রেমকে স্পার্তাতে রীতি বলে মনে নেওয়া হতো এবং উঠতি বয়সের ছেলেদের শিক্ষার একটি অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। একটি ছেলের প্রেমিকের সুনাম কিংবা দুর্নাম নির্ভর করত ছেলেটির কাজকর্মের উপর। পুতা বলছেন, একবার মারামারির সময় আঘাত পেয়ে একটি ছেলে কেঁদে ওঠায় কাপুরুষতার জন্য তার প্রেমিকের জরিমানা হয়।
স্পার্তানদের জীবনের যে কোনো স্তরে স্বাধীনতার অস্তিত্ব ছিল সামান্য।
বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও তাদের নিয়মানুবর্তিতা এবং জীবনের শৃঙ্খলা বজায় থাকত। ইচ্ছা অনুসারে জীবনযাপন আইন অনুমোদিত ছিল না, তারা শহরে বাস করত যেন সামরিক শিবিরে বাস করছে। সেখানে প্রত্যেকে জানত তার জীবন ধারণের জন্য কতটা ভাতা সে পাবে এবং কার্যক্ষেত্রে তাকে আর কী কী করতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায়, তাদের সবারই মত ছিল-তারা স্বকর্মে ব্যস্ত থাকার জন্য জন্মায়নি, জন্মেছে দেশসেবার জন্য….। লুকুৰ্গস তাঁর নগরে যেসব জিনিস আমদানি করেছিলেন তার ভিতরে সর্বোত্তম ও সর্বাপেক্ষা সুখপ্রদ ছিল বিশ্রাম এবং অবসর, তার নাগরিকদের জন্য তিনি এর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নিষেধ ছিল শুধুমাত্র কোনো নীচ কিংবা নোংরা কর্মে। বিরাট ধনী না হওয়ার জন্য তাদের সাবধানে চলার কোনো প্রয়োজন ছিল না; এটা ছিল এমন একটা দেশ যেখানে সম্পদে লাভও হতো না এবং সম্পদশালী সম্মানও পেত না। ভূমিদাসরা ছিল যুদ্ধে প্রাপ্ত দাস, তারা জমি কর্ষণ করত এবং তাদের প্রতিবছর একটা রাজস্ব দিতে হতো।
প্লুতার্খ বলছেন আলস্যের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত এক আথিনীয়-র গল্প, শুনে একজন স্পার্তার অধিবাসী বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন, সম্মানজনকভাবে এবং ভদ্রলোকের মতো জীবনযাপন করার জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটিকে দেখান।
লুকুৰ্গস (প্লুতার্খ বলছেন) তার নাগরিকদের এমনভাবে অভ্যস্ত করেছিলেন যে, তাঁরা একা থাকতে চাইতেন না এবং পারতেনও না। মৌমাছিরা যেমন রানী মৌমাছির সঙ্গে সংযুক্ত সেরকমই তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকতেন।
স্পার্তানদের বহির্ভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিল এবং কাজের জন্য ছাড়া বিদেশিদের স্পার্তায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। ভয় ছিল-বিদেশি রীতিনীতির প্রভাবে স্পার্তাতে লাকোয়েমনীয় ধর্ম কলুষিত হবে।
প্লুতার্খ একটা আইনের উল্লেখ করেছেন যাতে স্পার্তার অধিবাসীরা খুশিমতো তাদের ভূমিদাসদের হত্যা করতে পারত কিন্তু এরকম একট জঘন্য কাজের জন্য লুকুৰ্গসকে দায়ী করতে তিনি নারাজ। কারণ, আমি বিশ্বাস করি না এধরনের কোনো আইন লুকুৰ্গস প্রণয়ন করেছিলেন কিংবা এরকম কোনো মন্দ এবং ক্ষতিকারক আইন তিনি চালু করেছিলেন-এটাও আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমার মনে হয় তার প্রকৃতি ছিল নরম এবং করুণাময়, তাঁর অন্যান্য সব কাজকর্মেই আমরা দেখতে পাই ক্ষমাশীলতা ও সুবিচার। এই ব্যাপারটা ছাড়া স্পার্তার সংবিধান সম্পর্কে প্লুতার্খ প্রশংসা ছাড়া আর কিছু করেননি।
এখন প্লাতনই আমাদের বিশেষ আলোচ্য। তাঁর উপরে স্পার্তার প্রভাব তাঁর কাল্পনিক স্বপ্ন রাজ্যের বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে। পরের অধ্যায়ে সেটাই হবে আমাদের প্রধান বিবক্ষা।