১২. স্নেহ-ভালবাসা
উদ্দীপনাহীনতার একটি প্রধান কারণ হল, আমাকে কেউ ভালবাসে না এই অনুভূতি। পক্ষান্তরে বিপরীতভাবে, সকলেই আমাকে ভালবাসে এই অনুভূতি উদ্দীপনা বাড়াতে যত সাহায্য করে, অন্য কোনও কিছু তা করে না। কেউ তাকে ভালবাসে না, এই অনুভূতির বিভিন্ন রকমের কারণ থাকতে পারে। তিনি নিজেকে এমন ভয়ংকর একটি মানুষ ভাবতে পারেন, যার জন্যে কারো পক্ষে তাকে ভালবাসা সম্ভব নয়। শৈশবে তিনি হয়তো অন্যান্য শিশুদের তুলনায় কম স্নেহ পেয়েছেন অথবা তিনি এমন লোক যাকে সত্যিই কেউ ভালবাসেন না। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু প্রথম জীবনের দুর্ভাগ্যের জন্যে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলাও এর কারণ হতে পারে। ভালবাসা না পাওয়ার অনুভূতি থেকে নানারকম মনোভাবের উদ্ভব হতে পারে। এরকম লোক হয়তো মরিয়া হয়ে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে নানা অসাধারণ দয়াশীলতার কাজ করতে পারেন। কিন্তু এমন হলে তার কাজে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ যারা তার দয়াশীলতায় উপকৃত হবেন তারা সহজেই তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারবেন। মানুষের প্রকৃতি এমনভাবে গঠিত যে, যারা ভালবাসা দাবি করেন না বলে মনে হয়, তাদেরই তা সহজে দেয়। তাই যে মানুষ কল্যাণকর কাজ করে ভালবাসা কিনতে চান, তিনি মানুষের অকৃতজ্ঞতার অভিজ্ঞতা থেকে মোহমুক্ত হন, তার কখনো মনে হয় না যে ভালবাসা তিনি কিনতে চান তার মূল্য, তার জন্যে যে বস্তুগত সুবিধা তিনি দান করছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও তার অনুভূতি তা মেনে নিতে পারে না। অন্য একজন মানুষ, অন্যেরা তাকে ভালবাসে না, এটা জেনে যুদ্ধ বাধিয়ে অথবা বিদ্রোহ সৃষ্টি করে অথবা ডীন সুইফটের(১) মতো বিষে কলম ডুবিয়ে পৃথিবীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে এই হল বীরের প্রতিক্রিয়া, এতে পৃথিবীর সকলের বিরুদ্ধে একা দাঁড়াবার মতো চরিত্রবল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই উচ্চতায় উঠতে কজন সক্ষম হন? নারী বা পুরুষের অধিকাংশই যদি নিজেদের ভালবাসার ক্ষেত্রে বঞ্চিত মনে করেন, তাহলে তারা এক ভীরু নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবে যান, যেখানে শুধুই অন্ধকার আর সেখানে মাঝে মাঝে ঈর্ষা আর বিদ্বেষের ঝলক ছাড়া আর কিছু জ্বলে ওঠে না। নিয়মানুযায়ী এই ধরণের লোকের জীবন অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং ভালবাসার অভাব থেকে তাদের মনে নিরাপত্তাহীনতা জন্ম নেয় আর তাকে মুক্তি পেতে তারা অভ্যাসের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করেন। যারা বৈচিত্র্যহীন কর্মধারার দাসত্ব স্বীকার করেন তাদের এই কাজের প্রেরণা আসে বাইরের শীতল পৃথিবীর ভয় থেকে এবং তারা মনে করে, পূর্বের চলা পথেই যদি তারা আবার চলে তা হলে তারা আর আঘাত পাবেন না।
যারা নিরাপত্তার অভাববোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন, তাদের চেয়ে তারাই বেশি সুখী হন যারা নিরাপত্তার বোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন। অন্ততপক্ষে যতদিন না নিরাপত্তা বোধ তাদের বিপদের মধ্যে না ফেলে। সব ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে যে বিপদে একজন নিমজ্জিত হয়ে পড়েন, নিরাপত্তাবোধই সেই বিপদ থেকে অন্যজনকে উদ্ধার করেন। এক গভীর গহ্বরের ওপরে অবস্থিত একটা সরু কাঠের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভয় পেলেই বেশি থাকে, ভয় না পেলে নয়। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও একই রীতি। ভয়হীন মানুষ অবশ্য হঠাৎ করে বিপদে পড়তে পারেন। কিন্তু অনেক বিপদসংকুল অবস্থার ভিতর থেকে অক্ষত অবস্থায় তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন, তবে একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এইরকম প্রয়োজনীয় আত্মপ্রত্যয়ের অসংখ্য ধরণ আছে। কেউ আত্মবিশ্বাসী পাহাড়ে, কেউ বা সমুদ্রে আবার অন্যজন হয়তো আকাশে। কিন্তু জীবনের প্রতি সাধারণ আত্মবিশ্বাস আসে সেই যথার্থ প্রয়োজনীয় ভালবাসা পেতে অভ্যস্ত হলে, অন্য কিছু থেকে নয়। উদ্দীপনার উৎসরূপে মনের যে অভ্যাস, তা নিয়েই আমি এই অধ্যায়ে আলোচনা করব।
ভালবাসা যা দেওয়া হয় তা থেকে নয়, যা পাওয়া যায় তা থেকেই নিরাপত্তা বোধ জন্ম নেয়। এই বোধ আরো বেশি জন্মায় যদি ভালবাসা পারস্পরিক হয়। জোর দিয়ে বলতে হলে বলতে হয়, শুধু স্নেহ ভালবাসা নয়, তার সাথে শ্রদ্ধা ও প্রশংসাও মিশে থাকে। অভিনেতা, ধর্মপ্রচারক, বক্তা, রাজনীতিক যাদের কাজই হল জনগণের প্রশংসা কুড়িয়ে পাওয়া, তারা ক্রমেই এদের সমর্থনের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। যখন তারা জনসাধারণের কাছ থেকে যোগ্য পুরস্কার পেয়ে যান, তখন তাঁদের জীবন উদ্দীপনায় ভরে ওঠে। কিন্তু যখন তা পান না। তারা অসন্তুষ্ট হন এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েন। বহুজনের কেন্দ্রীভূত ভালবাসা অন্যদের জন্যে তাই করে। যে শিশু বাবা-মার প্রিয়পাত্র, সে তাদের স্নেহকে প্রকৃতির বিধান হিসাবে গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সে বিশেষভাবে কিছু চিন্তা করে না, যদিও তার সুখের জন্যে এর গুরুত্ব অনেক। সে পৃথিবীকে নিয়ে চিন্তা করে। যেসব উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে এবং আরো সব দুঃসাহসিক ঘটনা তার ঘটতে পারে, যখন সে বড় হবে তা নিয়েও ভাবে। বাইরের নানা ব্যাপারে এই যে উৎসাহ, তার পিছনে রয়েছে সেই অনুভূতি যে, যত বিপদই আসুক বাবা মার স্নেহ তাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করবে। যদি কোনও কারণে কোনও শিশু বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তবে সে শিশু সাধারণভাবে ভীরু এবং দুঃসাহসিক কাজে অনুৎসাহী হয়। তার মন ভয়ে ভয়ে থাকে। নিজেকে সে করুণা করে এবং আনন্দময় অনুসন্ধিৎসার মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ রকম শিশু অবাক হওয়ার মতো কম বয়সে জীবন, মৃত্যু এবং মানব জীবনের পরিণাম নিয়ে ধ্যান করতে শুরু করে। সে অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। প্রথমে বিষাদময়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও বিশেষ দর্শনবিদ্যা বা ধর্মতত্ত্বের মধ্যে অবাস্তব সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। জগৎ বিশৃঙ্খল স্থান, এখানে আনন্দের জিনিস যেমন আছে নিরানন্দের জিনিসও আছে কিন্তু শৃঙ্খলাহীন পরমার্থ নিয়ে-এবং এই কামনার একটি বোধগম্য অবস্থা অথবা প্রতিরূপ সৃষ্টি মূলত ভয় থেকেই জাত, যাকে বলা হয় মুক্তস্থানাতঙ্ক বা এক ধরনের উন্মুক্ত স্থান সম্পর্কে ভীতি। নিজের পাঠাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে ভীরু ছাত্রটি নিজেকে নিরাপদ মনে করে। এই পৃথিবী সমরূপ শৃঙ্খলাপূর্ণ এই অনুভূতি যদি সে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারে, তা হলে পথে বের হওয়ার পরও সে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। সে যদি আরো বেশি স্নেহ পেত, তা হলে বাস্তব পৃথিবীকে আরো কম ভয় পেতে পারত এবং মনে এক আদর্শ পৃথিবী আবিষ্কার করতে হত না যা স্থান করে নিয়েছে তার বিশ্বাসে।
একথা কখনো সঠিক নয় যে, সব স্নেহ-ভালবাসা একই ধরনের সাহসিক অভিযানের পথে চলতে উৎসাহিত করে। যে স্নেহ দেওয়া হয়েছে তা যেন নিজেই ভীরু না হয়ে শক্তিশালী হয় এবং স্নেহের পাত্রের নিরাপত্তার চেয়েও তার উল্কর্ষতা বাড়িয়ে তোলে, যদিও তার নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন হতে হবে তা নয়। ভীরু জননী অথবা ধাত্রী যদি সবসময় শিশুদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে থাকে এবং মনে করে প্রত্যেকটি কুকুরই তাদের কামড়াবে অথবা প্রত্যেকটি গরুই উদ্যত শিং ষাঁড়, তা হলে তারা নিজেদের মনের ভীরুতাকেই শিশুদের মনে সঞ্চারিত করবেন এবং তা হলে শিশুরা ভাববে মা কিংবা ধাত্রীর কাছাকাছি না থাকলেই বিপদ। যে জননী সবসময় সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে চান তার কাছে সন্তানের এইরকম অনুভূতিই পছন্দনীয়। সন্তান পৃথিবীর সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিক, এই ইচ্ছার চেয়েও সে সবসময় তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকুক, এই ইচ্ছাটা তার বেশি হতে পারে। এরকম অবস্থার পরিণামকে সে স্নেহ না পেলে যা হত, তার চেয়েও বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। শৈশবে মনের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, সারা জীবন তার ছাপ থেকে যায়। অনেকের কাছে প্রেমে পড়া হল পৃথিবী থেকে পালিয়ে গিয়ে এমন একটা ছোট নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান, যেখানে তারা নিশ্চিতভাবে শ্রদ্ধা এবং প্রশংসা পায় তার যোগ্য না হয়েও, সত্যি থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের আরেক আশ্রয় তার নিজের বাড়ি, ভীতি এবং ভীরুতাই তাদের এই সাহচর্যের সন্ধান দেয় যা উপভোগ করলে সেই অনুভূতি অক্রিয় হয়ে যাবে। তারা পত্নীদের কাছে তাই চান, যা আগে তারা পেয়েছে অবিজ্ঞ মায়েদের কাছে, কিন্তু তারা অবাক হয়, যদি পত্নীরা তাদের বয়ঃপ্রাপ্ত শিশু মনে করে।
কোন্ স্নেহ শ্রেষ্ঠ তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুব সহজ নয়। কারণ তার মধ্যে কিছু মাত্রায় রক্ষণাত্মক বস্তু থাকা উচিত, যাদের আমরা ভালবাসি তারা কোনও আঘাত পেলে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। কিন্তু আমি মনে করি, দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা যা দুর্ভাগ্যের প্রতি সহানুভূতির, যে দুর্ভাগ্য ঘটে গেছে তার বিপরীত, ভালবাসা যতটুকু সম্ভব, অল্প হলেও একটা ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের সম্পর্কে ভয় অন্যের সম্পর্কে ভয়ের চেয়ে আংশিক ভাল। তার ওপর প্রায় সময়েই এই বোধ অধিকার-বাসনার ছদ্মবেশ। আশা করা হয় ভয় জাগিয়ে অন্যের ওপর আরো বেশি প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা যাবে। পুরুষ ভীরু নারীকে যে পছন্দ করে এটাও তার একটা কারণ, তাহলে তাদের রক্ষা করে দখল করা যায়। নিজের ক্ষতি না করে কোনও মানুষ অন্যের জন্যে কতটা উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে, তা নির্ভর করে তার চরিত্রের ওপর। যে মানুষ শক্তিমান এবং দুঃঃসাহসী, নিজের ক্ষতি ছাড়াই অনেক কিছু সহ্য করতে পারে। কিন্তু ভীরু মানুষ এইভাবে যেন বেশি কিছু না করে সেই ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করা উচিত।
প্রাপ্ত স্নেহ-ভালবাসার কাজ দ্বিধাবিভক্ত। এর আগে নিরাপত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ বয়সে এর মধ্যে আরেকটু বেশি জৈবিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং তা হচ্ছে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্ব। যৌনতা-সম্পর্কিত ভালবাসার প্রেরণা জাগাতে না পারা যে কোনও নারী বা পুরুষের জন্যে চরম দুর্ভাগ্য। কেন না এতে তারা বঞ্চিত হয়, জীবন যে শ্রেষ্ঠ আনন্দ তাদের দান করে, তা থেকে। এই বঞ্চনা এখন হোক বা পরে হোক, উদ্দীপনাকে ধ্বংস করে এবং অন্তর্মুখীতা তৈরি করে। শৈশবের কোনও ভাগ্য বিপর্যয় চরিত্রে এমন ত্রুটির কারণ হতে পারে যার জন্যে উত্তর-জীবনে ভালবাসা পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না, যে ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে। এটা নারীদের তুলনায় সম্ভবত পুরুষের ক্ষেত্রে বেশি বাস্তব, কারণ নারীকে আকর্ষণ করে সম্ভবত পুরুষের চরিত্র, আর পুরুষের আকর্ষণ থাকে নারীর রূপে। একথা অবশ্যই বলা উচিত যে, এ বিষয়ে পুরুষরা নারীদের তুলনায় নিজেদের ছোট করে, কারণ নারীরা পুরুষদের যেসব গুণে খুশী হয়, তার থেকে পুরুষরা নারীদের যেসব গুণে খুশী হয় তা কম কাম্য। আমি নিশ্চিত নই, উন্নত চরিত্র গঠন করা সুন্দর রূপ তৈরী করার চেয়ে সহজতর কিনা। কিন্তু যে কোনও ভাবে পরের ধাপটি ভালভাবে বোঝা বেশি প্রয়োজনীয় এবং নারীরা সহজেই তা অবলম্বন করে, কিন্তু আগের ধাপটি অর্জন করার জন্যে পুরুষদের যা করা দরকার তারা তা করে না।
কোনও মানুষ যে স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে থাকে তা নিয়েই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। এখন আমি, যে স্নেহ ভালবাসা দেওয়া হয় তার কথা বলব। এটা আবার দুই প্রকার। এর একটি সম্ভবত জীবনের উদ্দীপনার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান প্রকাশ, অন্যটা হল ভয়ের প্রকাশ। আমার কাছে প্রথমটা পুরোপুরি প্রশংসাযোগ্য, আর পরেরটা খুব বেশি হলে একটি সান্ত্বনা। আপনি যদি খুব সুন্দর দিনে মনোরম বেলাভূমির পাশ দিয়ে জাহাজে চলেন, আপনি সাগর-বেলার প্রশংসা করবেন এবং এতে আপনি আনন্দ পাবেন। এই আনন্দ সম্পূর্ণরূপে বাইরের দৃষ্টি থেকে লাভ করা এবং মনের কোনও তীব্র প্রয়োজনের সাথে তা সম্পর্কহীন। অন্যদিকে যদি আপনার জাহাজটা ডুবে যায় এবং বিকল হয়ে পড়ে এবং আপনি সাঁতার কেটে তীরে এসে ওঠেন, তখন তার প্রতি আপনার নতুন ধরনের ভালোগা জন্মাবে। তখন এই তীর হয়ে উঠবে তরঙ্গের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা এবং এর সৌন্দৰ্য্য অথবা কুৎসিত রূপ অবান্তর ব্যাপারে পরিণত হবে। নিরাপদ জাহাজের যাত্রীর মনে যে অনুভূতি, সুন্দর ভালবাসার সমগোত্রীয় তা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে সাঁতার কেটে তীরে উঠে আসা যাত্রীর অনুভূতির সাথে যা মেলে তা সুন্দর ভালবাসা নয়। এদের মধ্যে প্রথম ধরনের ভালবাসা সম্ভব সে মানুষের পক্ষে যে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে। পক্ষান্তরে নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে দেখা দেয় ভালবাসার পরের রূপটি। নিরাপত্তাবোধের অভাবের কারণে যে অনুভূতি তুলনায় তা অনেক বেশি বস্তুগত এবং আত্মকেন্দ্রিক কারণ ভালবাসার মানুষ এখানে মূল্যবান কারণ তার কাছ থেকে পরিষেবা পাওয়া যায় বলে সহজাত কোনও গুণের জন্যে নয়। একথা আমার বলার উদ্দেশ্য নয় যে, জীবনে এ ধরনের ভালবাসার কোনও বৈধ ভূমিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে সকল নির্ভেজাল ভালবাসার মধ্যেই এই দুইয়ের কিছু কিছু অংশ যুক্তভাবে রয়েছে এবং ভালবাসা যতটুকু নিরাপত্তা বোধহীনতাকে দূর করতে সক্ষম ততটুকু তা একজন মানুষকে তার অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়। যে অনুভূতি থেকে সে আবার সেই মুহূর্তে বিপন্ন এবং ভয়ার্ত জগতের সব অন্ধকার যে দূর হয়ে গেছে তা অনুভব করতে পারে। এই ধরনের ভালবাসার যে ভূমিকা জীবনে, তাকে স্বীকৃতি জানিয়েও আমাদের বলতে হয় এটা অন্যটার তুলনায় কম সুন্দর, কারণ এটা ভয়ের ওপর নির্ভর করে এবং ভয় একটি ক্ষতিকর জিনিস এবং আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক। সবচেয়ে সুন্দর ভালবাসায় মানুষ আশা করে নতুন সুখের, পুরোনো অ-সুখ থেকে পালাতে নয়।
সুন্দরতম ভালবাসা যে দেয় এবং যে পায়, দুজনের জন্যেই জীবন-প্লাবী । প্রত্যেকেই পরমানন্দের সাথে ভালবাসা গ্রহণ এবং দান করে এবং পারস্পরিক সুখের কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে আরো বেশি চিত্তহারী মনে করে। এ ছাড়া আরো এক ধরনের ভালবাসা আছে যেটা খুব যে কম তা নয় তাতে একজন অন্যজনের প্রাণশক্তি শুষে নেয়। একজন যা দেয় অন্যজন তা গ্রহণ করে কিন্তু প্রতিদানে প্রায় কিছুই দেয় না। এই ধরনের রক্তশোষণকারীর দলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোক আছে, তারা একের পর এক হতভাগ্যকে ধরে এবং বলিপ্রদত্ত প্রাণীর মতো জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়। এবং নিজেদের উন্নতি করে নেয় এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের তা শুষে নিয়েছে তারা হয়ে পড়ে নিষ্প্রভ, ম্লান এবং শক্তিহীন। এই ধরনের লোক নিজেদের স্বার্থের জন্যেই শুধু অন্যদের ব্যবহার করে কিন্তু তাদের সত্তাকে কখনো স্বীকৃতি জানায় না। তারা কিছু সময়ের জন্যে যাদের ভালবাসে বলে মনে করে, মৌলভাবে তাদের প্রতি কোনও উৎসাহ থাকে না। তারা শুধু নিজেদের কাজের প্রেরণার বিষয়ে আগ্রহী এবং সম্ভবত তা নৈর্ব্যক্তিক ধরনের। বোঝা যায় এটা তাদের স্বভাবের ক্রটি। কিন্তু তা এমন একটা রোগ যাকে সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং নিরাময় করা খুব সহজ নয়। প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রায়ই যুক্ত থাকতে দেখা যায়, এবং আমার মনে হয় মানুষের সুখ উৎপাদন অর্থে যে ভালবাসা, যা দুজনের আলাদা মঙ্গলের জন্যে নয়, বরং যা দুজনের মিলিত মঙ্গলের জন্যে, তাই হল প্রকৃত সুখের সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ। যে মানুষের অহমিকা ইস্পাতের দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ সেখানে ভালবাসার এই বিস্তার সম্ভব নয় এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ দান থেকে বঞ্চিত, তা পেশায় সে যত সফলই হোক। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালবাসাকে তার সীমানা থেকে দূরে রাখে তা সাধারণত প্রথম জীবনের দুঃখ, পরবর্তীকালে অবিচার অথবা এমন কোনও কারণ যা নির্যাতন বাতিকে পরিণত হয়েছে, তা মানব সমাজের প্রতি রাগ বা ঘৃণা থেকে জন্ম নেয়। পৃথিবীকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে হলে অতি-অহমিকা, যা একটি কারাগার, থেকে যে কোনও মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে। কোনও মানুষ এই আত্ম-কাব্য থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কিনা তার লক্ষণ দেখা যাবে তার যথার্থ ভালবাসার ক্ষমতা আছে কিনা তার মধ্যে। ভালবাসা পাওয়া কোনও ভাবেই যথেষ্ট নয়, ভালবাসা যা পাওয়া গেল তাকে মুক্ত করে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং যেখানে দুই একমাত্রায় বিরাজ করে সেখানেই ভালবাসা শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনা খুঁজে পায়।
পারস্পরিক ভালবাসা বিকাশের মনস্তাত্ত্বিক অথবা সামাজিক বাধা সবক্ষেত্রেই অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর জন্যে পৃথিবী সর্বকালেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যদি ভুল লোকের কাছে পড়ে, সেই ভয় থেকেই মানুষ সহজে কারো প্রশংসা করতে চায় না, তারা সহজে ভালবাসাও দিতে চায় না। যদি তা অপাত্রে দান করা হয় এই ভয়ে যদি তার কাছ থেকে অথবা সমালোচনাময় পৃথিবী থেকে দুঃখ পায়। নৈতিকতা এবং বৈষয়িকতা এই দুয়ের নামেই সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার ফলে যেখানেই ভালবাসার সম্পর্ক, সেখানেই উদারতা এবং সাহসিকতাকে নিরুৎসাহ করা হয়। এইসব উপদেশ-নির্দেশ মানবসমাজের বিরুদ্ধে ভীরুতা এবং ক্রোধ তৈরী করে। কারণ অনেক মানুষ জীবনভর জানতেই পারে না কী তার মৌলিক চাহিদা এবং তা থেকে সে বঞ্চিতই থেকে যায় এবং প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে নয় জনেরই বিশ্বের প্রতি সুখী ও উদার মনোভাব গড়ে তোলার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, যাদের অনৈতিক বলা হয়, তারা যাদের বলা হয় না তাদের চেয়ে উন্নত। যৌনতা সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ে যাকে বিশুদ্ধ ভালবাসা বলা হয়, তা প্রায় থাকেই না। থাকলেও খুবই কম, বরং সেখানে দেখা যায় মৌলিক বিরূপতা, প্রত্যেকেই অন্যের কাছে ধরা না দেওয়ার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই নিজেদের একাকীত্বকে রক্ষা করে চলে। প্রত্যেকেই অস্পৃষ্ট থাকে এবং সে জন্যেই তারা ব্যর্থ হয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কোনও বাস্তব মূল্য নেই। আমি বলি না, তাদের সযত্নে এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ তা করতে গেলে যেখানে আরো মূল্যবান এবং গভীর ভালবাসা জন্মাবার সম্ভাবনা, তার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি বলতে চাই, যে যৌন সম্পর্কের বাস্তব মূল্য আছে তা এমন, যেখানে কোনও বাক-সংযম নেই, যার মধ্যে দুজনের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব একসাথে মিলিত হয়ে নতুন এক সংযুক্ত ব্যক্তিত্বে রপ লাভ করবে সব রকমের সতর্কতার মধ্যে। ভালবাসায় সতর্কতা সম্ভবত যথার্থ সুখের পক্ষে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক।
—–
১. ডীন, সুইফট, Dean Jonathan Swift (১৬৬৭-১৭৪৫) আয়াল্যান্ডে জন্ম ইংরেজী ভাষার বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক সাহিত্যের রচয়িতা (Satirist)।