সেদিন আশ্চর্য মনে হয়েছিল—আজ কিন্তু আশ্চর্য মনে হয় না।
বিবাহের পূর্বে জীবনের যে উচ্ছাস শুক্লপক্ষের চতুর্দশীর সমুদ্রের মত ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, বিবাহের দিনেই সেই উচ্ছাস স্তিমিত নিরুৎসব বিষণ্ণ হয়ে গেল প্রতিপদ দ্বিতীয়ার ভাটার সমুদ্রের মত। জীবনে পূর্ণিমা তিথিটা যেন এই না কোনোদিন। অমাবস্যাই কি এসেছে? না, তাও আসে নাই আজও। একমাত্র সন্তান বনবিহারীর মৃত্যুতেও না।
এগারই আষাঢ়েই বিবাহ হয়েছিল। কন্যার এ দেশে অভাব হয় না।
কন্যা এ দেশে দায়ের শামিল। যা দায় তাই দুৰ্বহ বোঝ। সবল মানুষ বোঝা বইতে পারে, দুর্বল মানুষ বোঝা নামাতে গিয়ে ফেলে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সংসারে দুর্বলের সংখ্যাই তো বেশি।
দশটি কন্যার খোঁজ এসেছিল। ছটি কন্যাকে পরিচয় শুনেই নাকচ করেছিলেন জগৎমশায়। চারটি কন্যা চাক্ষুষ করে সদর শহরের এক বৃদ্ধ মোক্তারের পিতৃমাতৃহীনা ভাগ্নীকে পছন্দ করলেন। পণ হরীতকী। মেয়েটির নাম কৃষ্ণভামিনী। মেয়েটি তখনকার দিনে অরক্ষণীয়া হয়ে উঠেছিল। চোদ্দ বছর উত্তীর্ণ হয়ে মাস দুয়েক পরেই পনেরয় পড়বে। এ মেয়ের সন্ধান এনেছিল সুরেন্দ্ৰ।
বাইরে-ঘরে উৎসব সমারোহের কোনো ত্রুটি ছিল না। জগৎ মশায়ের তখন কবিরাজ। হিসেবে খ্যাতিতে, অবস্থাপন্ন ব্যক্তি হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় যাকে বলে একই আকাশে চন্দ্ৰসূর্যের একসঙ্গে উদয়। জীবন তার একমাত্র সন্তান, তার ওপর এই বিচিত্র অবস্থায় বিবাহ। কাঁদীতে মঞ্জরী এবং ভূপী বোসের বিবাহ হয়েছিল যত চুপিচুপি, এখানে জীবনের সঙ্গে কৃষ্ণভামিনীর বিবাহ তত উচ্চ সমারোহে নহবত থেকে ঢোল বাঁশি এমনকি ব্যান্ড বাজনা বাজিয়ে হয়ে গেল। ওই ব্যান্ড বাজনা আনা হয়েছিল কাঁদী থেকে। রাঢ় অঞ্চলে প্রথম ব্যান্ড বাজনার দল হয়েছিল মুরশিদাবাদে, তারপর কাঁদীতে। নবগ্রাম থেকে কাঁদী দশ ক্ৰোশ পথ; এখানকার বাজনার শব্দ দশ ক্রোশ অর্থাৎ বিশ মাইল অতিক্রম করে সেখানে নবদম্পতির নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটালেও বাজনদারদের মারফত খবরটা পৌঁছুবার কথা। এই এত সমারোহের মধ্যেও পাত্র জীবন যখন কন্যার বাড়িতে পৌঁছল তখন সে ম্লান স্তিমিত হয়ে গেছে। বাসরে গিয়ে জীবন অবসন্ন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল, হাত জোড় করে বলল—আমাকে মাফ করবেন, আমার শরীরটা বড় খারাপ করছে।
তবুও অবশ্য ছাড়ে নি মেয়েরা। গানও গাইতে হয়েছিল, সেকালের নিয়ম অনুযায়ী কৃষ্ণভামিনীকে কোলে বসাতেও হয়েছিল।
কৃষ্ণভামিনীর রঙ ছিল পাকা সোনার মত। মুখশ্ৰী কোমল এবং স্নিগ্ধ হলে তাকে ডাকসাইটে সুন্দরী বলা যেত।
চৌদ্দ বছরের কৃষ্ণভামিনী যেদিন বধূবেশে মশায়দের ঘরে পদার্পণ করে, সেই দিনই তার নামকরণ হয়েছিল আতর-বউ। কৃষ্ণভামিনীর রঙ দেখে মানুষের চোখ ঝলসে গিয়েছিল। নামকরণ করে জীবনের পিসিমা বলেছিলেন—তোমার স্বভাবের সৌরভে ঘর ভরে উঠুক।
ফুলশয্যার রাত্রিও কেটেছিল একটি প্রচ্ছন্ন উদাসীনতার মধ্যে। জীবন হেসেছিল, ঠাকুমা বউদিদির পরিহাস-রসিকতাতেও যোগ দিয়েছিল, কিন্তু সে যেন প্ৰাণহীন পুতুলনাচের পুতুলের মত। আজ এই বৃদ্ধ বয়সেও মনে পড়ছে শোধ নেওয়ার আনন্দ কেমন যেন নিভানো প্রদীপের মত কালো হয়ে গিয়েছিল। নিগুঢ় একটা বেদনা তাকে যেন অভিভূত করতে চেয়েছিল।
বিবাহ করেছিলেন তিনি অপমানের প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু বিবাহ করে বুঝলেন, অপমানের শোধ নেওয়া হয় নি; শুধু বিয়ে করাই হয়েছে।
এ সংসারে অপমান মাত্রেরই গ্লানি মর্মদাহী, সে মর্মদাহ একমাত্র প্রতিশোধের উল্লাসেই মুছে যায়; তার অন্তরে জ্বলে ওঠে যে আগুন, সেই আগুনে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে ছাই করে শান্ত হয়। না পারলে সেই আগুনে নিজেই তিলে তিলে পুড়ে ছাই হয়। বড় মানুষ যারা, মহৎ যারা তাদের কথা স্বতন্ত্র। তাঁরা অপমানের আগুনকে ক্ষমার শান্তিবারি বর্ষণে নিভিয়ে ফেলেন।
জীবন মশায় মহৎ নন-নিজে তাই বলেন। তার মনের আগুন তাই বোধ করি আজও জ্বলছে। বাইরে দেখে কেউ বুঝতে পারে না। বুঝতে তিনি দেন না। বুঝতে পারে একজন। সে আতর-বউ। সে প্রথম দিন থেকেই বোঝে।
জীবনের প্রচ্ছন্ন বেদনা সংসারে সকলের কাছে প্রচ্ছন্ন থাকলেও নতুন বধূটির অগোচর ছিল না। শুধু তাই নয়, বধূটিকেও আক্রমণ করলে সংক্রামক ব্যাধির মত। ফুলশয্যার রাত্রেই জীবন দত্তের বেদনা নতুন বউয়ের মনে আঘাত করে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল।
ফুলশয্যার শেষ রাত্রে জীবন বধূকে আকর্ষণ করেছিল—নিজের বুকের কাছে। বধূটি তিক্ত কঠিন স্বরে বলে উঠেছিল—আঃ, ছাড়!
—কেন? কী হল?
–কী হবে? ভাল লাগে না।
–ভাল লাগে না?
–না। ছেড়ে দাও, পায়ে পড়ি তোমার। ছেড়ে দাও।
–কী হল?
–কী হবে? আমাকে দয়া করে বিয়ে করেছ, উদ্ধার করেছ। দাসী হয়ে এসেছি—দাসীর মত খাটব। দু মুঠো খাব। আদর তো আমার পাওনা নয়। ছেড়ে দাও আমাকে।
আজও চলছে ওই ধারায়।
আতর-বউ আজ আগ্নেয়গিরি; অগ্ন্যার আরম্ভ হলে থামে না।
আতর-বউয়ের দোষ কী? আতর-বউয়ের বুকে আগুন লেগেছে তারই বুকের আগুনের সংস্পর্শে।
***
তবু এর মধ্যে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ একটি সংসার।
ওই যে আতর-বউ বলে—কত নামডাক ছিল—দু হাতে রোজগার করেছ, চার হাতে খরচ করেছ—এর অর্থই তো হল যশ-প্রতিষ্ঠা অর্থ-সম্পদ। সাধারণ মানুষের এ ছাড়া আর কী চাই?
সাজানো সংসার-তিন কন্যা এক পুত্র। সুরমা-সুষমা-সরমা। ছেলে বনবিহারী। তারা পেয়েছিল মায়ের বর্ণচ্ছটা, বাপের স্বাস্থ্য।
খ্যাতি প্রতিষ্ঠাও অনেক হয়েছিল; সে খ্যাতি কিশোর-জীবনের আকাঙ্ক্ষার পরিমাপে সমুদ্রের। তুলনায় গোষ্পদতুল্য না হলেও দিগন্তজোড়া বিলের তুলনায় মাঝারি আকারের পরিচ্ছন্ন একটি শখের পুষ্করিণী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যার বাঁধানো ঘাট আছে, জলে মাছ আছে, নামেও যে পুষ্করিণীটি কর্তার অভিপ্রায় অনুযায়ী শ্যামসায়র বা শ্যামসরোবর। জলও তার নির্মল ছিল, তপ্ত গ্রামবাসীরা তাতে অবগাহন করে তৃপ্তও হয়েছে। তৃষ্ণার্তেরা তার জল পান করে শ্যামসায়রের অধিকারীকে মুক্তপ্ৰাণে আশীর্বাদও করেছে। কিন্তু দিগন্তবিস্তৃত বিলের তুলনায় সে কতটুকু, কত অকিঞ্চিৎকর—তা সেই অধিকারীই জানে যে এই বিলের মতই একটি বিল কাটাতে চেয়েছিল। যার কল্পনা ছিল ওই বিলের ঘাটে ভিড়বে কত দেশদেশান্তরের বড় বড় বজরা নৌকা ছিপ!
আজ এই পরিণত বয়সে জীবনের সকল মোহই কেটে গেছে। লাল নীল সবুজ বেগুনে সাত রঙের ইন্দ্ৰধনু তিনি আর দেখতে পান না। আজ চোখের সামনে মাত্র দুটি রঙ আছে। একটি সাদা আর অন্যটি কালো। আলো আর অন্ধকার। তাই আশ্চর্য হয়ে ভাবেন—সেদিন কী করে জেগেছিল ইন্দ্ৰধনুর মত এমন বর্ণ-বৈচিত্র্যময় আকাঙ্ক্ষা।
এ প্রশ্ন মনে উঠতেই জীবন দত্ত হাসেন। নিজেকেই নিজে প্ৰশ্ন করেন—কেন? বার বার এ প্রশ্ন মনে ওঠে কেন তোমার? এ প্রশ্ন ওঠবার তো কথা নয়।
দুটি রঙ-দিন ও রাত্রির সাদা ও কালো রঙ দুটি ছাড়া বাকি রঙগুলি তুমি নিজেই তো ধুয়ে মুছে নিয়ে নিজের হাতে। অক্ষম লোকের রঙগুলি ধুয়ে যায় ব্যর্থতায়, বেদনার চোখের জলে। তুমি ধুয়ে মুছে দিয়েছ মিথ্যা বলে, তোমার মহাগুরু জগৎ মশায়ের শিক্ষার কথা ভুলে যাও কেন? তার শিক্ষার মধ্যে তো নিজেকে সেদিন ড়ুবিয়ে দিয়েছিলে তুমি।
নিজের ভুল নিজেই সংশোধন করে নিয়ে ঘাড় নাড়লেন জীবনমশায়। বার বার দাড়িতে হাত বুলালেন। ঠিক! ঠিক!
হঠাৎ একটা আলোর ছটা এসে চোখে বাজল। আলো? উঃসন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। রাত্রি নেমেছে। খেয়াল ছিল না। পুরনো কথা মনে করতে গিয়ে বর্তমানের কথা ভুলেই গিয়েছেন তিনি।
আলোটা আসছে ভিতর-বাড়ি থেকে, হয় ইন্দির, নয় নন্দ আলো নিয়ে আসছে। না তো। পায়ের দিকে কাপড়ের ঘের দেখে মনে হচ্ছে—মেয়েছেলে। আতর-বউ আসছেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন জীবনমশায়। অসময়ে আতর-বউয়ের আসাটা তার কাছে শঙ্কার কারণ।
আতর-বউই বটে। আলোটা সামনে নামিয়ে দিয়ে আতর-বউ কাছে দাঁড়ালেন। দীর্ঘাঙ্গী গৌরবর্ণা আতর-বউ, কপালে সিদ্রের টিপটি আজও পরেন, সিঁথিতে সিন্দুর ডগ-ডগ করে। কঠোরভাষিণী আতর-বউ সুযোগ পেলে বোধ করি একটা রাজ্যশাসন করতে পারতেন। জীবন মশায় এ কথা অনেকবার বলেছেন রসিকতা করে। আতর-বউ উত্তর দিয়েছেন একটা মানুষকেই আনতে পারলাম না হাতের মুঠোয়, তো একটা রাজ্য! আতর-বউ উত্তর দিয়ে চিরকাল এক বিচিত্ৰ হাসি হাসেন।
আতর-বউ আলোটি নামালেন দাওয়ার উপর।
–কী খবর? মুখ তুলে বললেন– জীবনমশায়। আতর-বউয়ের মুখখানি বড় মধুর লাগছে। আজ। মমতায় যেন বর্ষার অভিষিক্ত ধরিত্রীর মত কোমল।
আতর-বউ ঈষৎ উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন—তুমি আজ চা খাও নি?
–ভুলে গিয়েছি।
–ভুলে গিয়েছ? হাসলেন আতর-বউ।–চা খেতে ভুলে যায় মানুষ! নন্দ ছোঁড়া গিয়ে বললে—তামাক পর্যন্ত খাও নি। এসে ডেকেছে, সাড়া দাও নি। শরীর ভাল আছে তো? না–মন ভাল নাই? কী হল তোমার?
অপ্রতিভের মত হেসে জীবনমশায় বললেন–হয় নি কিছু। এমনি ভাবছিলাম। নবগ্রাম রতন মাস্টারের ছেলেকে দেখে এলাম; পথে নিশি-ঠাকরুন ডেকে দেখালে তার ভাইঝিকে। রতন মাস্টারের ছেলের রোগ খুবই কঠিন, তবে জোর করে কিছু বলা যায় না। কিন্তু এই মেয়েটি-এর আর–।
ঘাড় নাড়লেন ডাক্তার। আবার বললেন,—এই কচি মেয়ে-বড়জোর পনের বছর বয়স এরই মধ্যে দুটি সন্তান হয়েছে। নিশি দেখিয়ে বললে–চাঁদের মত ছেলে। আমি দেখলাম চাঁদ নয়, যম। মাকে খেতে এসেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
–নিশিকে বলে এলে নাকি? শিউরে উঠলেন আতর-বউ।
–না। তবে নিশি বুঝতে পারবে। বলেছি জলবারণ খেতে হবে। এছাড়া ওষুধ নাই। কে? আতর-বউয়ের পিছনে কেউ এসে দাঁড়াল। ও—ইন্দির!
–হ্যাঁ। ওকে চা করতে বলে আমি চলে এসেছিলাম। নাও চা খাও! ভাল মানুষ তুমি। যে চা নেশার জিনিস—তা না খেলেও তোমার কষ্ট হয় না? তামাক খেতে ভুলে যাও?
ইন্দির চায়ের পাথরের গেলাসটি এগিয়ে দিল। আতর-বউ বললেন–তুমি খাও, আমি দাঁড়িয়ে আছি। গেলাস আমি হাতে করে নিয়ে যাব। ইন্দিরের হাতে শনি আছে, ছ মাসে তিনটে পাথরের গেলাস ভাঙল। ইন্দির, তাকের ওপর বড় এলাচ গুঁড়ো করা আছে, নিয়ে আয়।
ইন্দির চলে যেতেই আতর-বউ বললেন–তুমি আমাকে লুকোলে। ওই হাসপাতালের ডাক্তারের কথায় তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ। নতুন কালের ছেলেমানুষ ডাক্তার, অহঙ্কার অনেক। কাকে কী বলেছে জানে না। আমি তো জানি তোমার নিদান মিথ্যে হয় না। মতির মা যখন মরবে তখন বুঝতে পারবে ছোকরা ডাক্তার। আমিও তোমাকে ওবেলা কতকগুলো খারাপ কথা বললাম। মুখপোড়া শশী, যে এইখানে হাত-দেখা শিখলে, কম্পাউন্ডারি শিখলে সে এসে বলে। কিনা, হাত-পা ভাঙাতে নিদান হকা তো শুনি নি, বুঝিও না। ও যে কেন মশায় বলতে গেলেন কে জানে! শশীর মুখে এই কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে বলেছি, এ কথা তুই কোন্ মুখে বললি শশী? বলতে লজ্জা লাগল না? কলিকাল, নইলে তোর জিভ খসে যেত।
জীবনমশায় হাসলেন। কিন্তু কথার কোনো উত্তর দিলেন না। শশীর ওপর আজ অত্যন্ত চটেছে আতর-বউ।
আতর-বউ প্রতীক্ষা করলেন স্বামীর উত্তরের। উত্তর না পেয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু ভাল দেখতে পেলেন না স্বামীর মুখ। শ্রাবণ মাসের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি
তার পাশে অনেকখানি খোলা জায়গার মধ্যে বারান্দাটির ওপর একটি পুরনো লণ্ঠন যেটুকু আলোকচ্ছটা বিস্তার করেছিল সে নিতান্তই অপর্যাপ্ত। তার উপর আতর-বউয়ের দৃষ্টি বার্ধক্য ম্লান। হাত বাড়িয়ে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। তারপর ঝুঁকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরেই বলে উলেন-হাসছ তুমি? তোমার কি গণ্ডারের চামড়া? হাসি দেখে অকস্মাৎ চটে উঠলেন আতর-বউ।
ডাক্তার কিন্তু আরও একটু হেসে বললেন–তা ছাড়া করব কী বল? কাঁদব?
কাঁদবে? হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আতর-বউ বললেন–কাঁদবে? তুমি? চোখে জল তো বিধাতা তোমাকে দেয় নাই। কী করে কাঁদবে তুমি? যে মানুষ নিজের ছেলের নিদান হকে; মরণের সময় বাইরে বসে থাকে, বলে, কী দেখব? ও আমি ছ মাস আগে দেখে রেখেছি
ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন–থাম, আতর-বউ থাম। তোমাকে মিনতি করছি। থাম তুমি। আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও। রতনবাবুর ছেলেকে দেখে এসেছি, আমাকে একটু ভাবতে দাও। বুঝতে দাও।
আতর-বউ যেন ছিটকে উঠে পড়লেন ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত, বললেন–অন্যায় হয়েছে। আমার অন্যায় হয়েছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসাই আমার অন্যায় হয়েছে। আমার অধিকার কী? আমাকে এনেছিলে তোমরা দয়া করে, মামার বাড়ির মা-বাপ মরা ভাগ্নী, বিনা পণে দয়া করে ঘরে এনেছিলে দাসী-বাদীর মত খাটাতে আমার সেই অধিকার ছাড়া আর কোনো অধিকার তো নাই। একশো বার অন্যায় করেছি, হাজার বার। মাফ কর আমাকে।
উঠে চলে গেলেন তিনি অন্ধকারের মধ্যে।
এই তো আতর-বউ! চিরকালের সেই আতর-বউ! হাসলেন ডাক্তার। কিন্তু সে হাসি অর্ধপথেই একটা বিচিত্র শব্দে বাধা পেয়ে থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল স্থানটা। ডাক্তার এবার সশব্দে হেসে উঠলেন। আতর-বউ লণ্ঠনটার শিখা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন—বোধহয় মাত্রা অনেক পরিমাণে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কথাবার্তার উত্তেজনার মধ্যে কেউই লক্ষ্য করেন নি। সশব্দে লন্ঠনের কাচটা ফাটিয়ে দপ করে নিভে গেল আলোটা।
***
সশব্দে হাসিও হঠাৎ থেমে গেল তার। মনের ছিন্ন চিন্তা আবার জোড়া লাগল। আতর-বউ বলে গেলেন–বিধাতা তাকে চোখের জল দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। কথাটা মনে হতেই, হাসি থেমে গেল তাঁর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার মনে মনেই বললেন––দিয়েছিলেন, অনেক অজস-তুমি অনুমান করতে পার না আতর-বউ, সমুদ্রের মত অথৈ লবণাক্ত চোখের জল ভগবান তার দুটি চোখের অন্তরালে অন্তরের মধ্যে দিয়েছিলেন। তার সংবাদ তুমি জান না। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞানযোগ অগস্ত্য ঋষির মত গষে সে সমুদ্র পান করে নিঃশেষ করে দিয়েছে। অন্তর এখন শুষ্ক সমুদ্রগর্ভের মত বালুময় প্রান্তর। অনেক প্রবাল অনেক মণিমাণিক্য হয়ত আছে; কিন্তু তার সর্বাঙ্গে আছে চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদ। তুমি তো কোনোদিন সে বুঝলে না, বুঝতে চাইলে। না! তুমি, মঞ্জরী—তোমরা দুজনেই যে মৃত্যু; অমৃত তো তোমরা চাও নি কোনোদিন। চাইলে তার কাছে আসতে, বুঝতে পারতে। আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জীবন ডাক্তার।
মঞ্জরী, আতর-বউকে বা শুধু দোষ দিচ্ছেন কেন তিনি? তার নিজের কথা? তিনি নিজে? নিজেই কি তিনি জীবনে অমৃত পেয়েছেন বলে অনুভব করেছেন কোনোদিন? এ কথা অন্য কেউ জানে না, জানতেন দুজন, তারা আজ নেই। একজন তার বাবা, প্রথম শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু।
জগৎমশায় জানতেন তার এ অতৃপ্তির কথা। অমৃত-অপ্রাপ্তিই হল অশান্তি অতৃপ্তি। মৃত্যুকালে জগৎমশায় এ কথা তাকে ডেকে বলেছিলেন। জীবনকে চিকিৎসাশাস্ত্রে দীক্ষা দিয়ে আরও দশ বৎসর তিনি বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুকালে জ্ঞানগঙ্গা গিয়ে গঙ্গাতীরে দেহত্যাগ করেছিলেন। মা তখন গত হয়েছেন। তিনিও খানিকটা জানতেন। কিন্তু তিনি এ অতৃপ্তির হেতু জানতেন না; তিনি হেতু সন্ধান করেছিলেন একেবারে বাস্তব সংসারে। বাবার মত গভীরভাবে বুঝে তাঁর অন্তর খুঁজে সন্ধান করেন নাই।
বিবাহের পর জীবন আয়ুর্বেদ শিক্ষায় মনপ্ৰাণ ঢেলে দিয়েছিল। যে পড়াশুনা তার ইস্কুলজীবনে ভাল লাগে নাই সেই পড়াশুনায় যেন ড়ুবে গিয়েছিল। জগৎমশায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। জগন্মশায় বলেছিলেন স্কুলে পড়াশুনার রকমসকম দেখে ভাবতম জীবনের বুদ্ধি বোধহয় মোটা; কিন্তু আয়ুর্বেদে দেখছি ওর বুদ্ধি ক্ষুরধার। তবে—হুঁ। থেমে গিয়েছিলেন তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার বলেছিলেন—তবে এর সঙ্গে গানবাজনা শেখ। আনন্দ কর। গান কর। ভগবানের নাম না করলে চিকিৎসকের বৃত্তি নিয়ে বাঁচবে কী করে?
ঠাকুরদাস মিশ্র সে সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ওহে ওটা যে ওর রক্তে রয়েছে। বংশগত বিদ্যেতে তাই হয়। আমার ওই হারামজাদা বেটাটার বিবরণ জান?
অর্থাৎ সুরেন্দ্রের। উচ্ছাসভরে বলেই গেলেন ঠাকুরদাস মিশ্র।
-হারামজাদা বেটা মদ ধরেছে তা তো জান। লেখাপড়া ছেড়েছে অনেক দিন। ভেবেছিলাম ও বেটাকে আর জমিদারি সেরেস্তার কাজে লাগাব না। পুজো-আর্চার মন্তরগুলো মুখস্থ করিয়ে বেটাকে লাট দেবগ্রামের বিশ্বেশ্বরী মায়ের পূজারী করে দেব। ওখানকার পূজারী বেটার বংশ নাই। পূজারীই সেবায়েত, পনের বিঘে জমি আছে চাকরান, তা ছাড়া বিশ্বেশ্বরী হল রেশমের পলু পোকা চাষের রাখে হরি মারে কের মত দেবতা! বিশ্বেশ্বরীর পুজো না দিয়ে পুষ্প না নিয়ে ও চাষই হয় না। পাওনা অঢেল। তা কিছুতেই না। ও বলে-ও মন্তর আমার মুখস্থ হবে না। তারপর ব্যাপার শোন বেটা সেদিন দশ বছর আগের এক জমাওয়াশীল বাকি নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বলে—এটাতে যে ভুল রয়েছে। শোন কথা! ভুল অবিশ্যি আমি জানিও ভুল আমারই কলমের ডগায় পুকুর লোপাট। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে কেউ ধরতে পারে নি। জমিদারের ঘরে আর ধরাও পড়বে না। কিন্তু বেটার বিদ্যে দেখ। গোপনে গোপনে পুরনো কাগজ দেখে হিসেব বুঝেছে, বাপের ভুল ধরেছে। আমি তো বেটার মাথায় চড় মেরে বললাম, চুপ রে বেটা চুপ!
ঠাকুরদাস মিশ্র পুত্ৰগৌরবে যেভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন জগৎমশায় তা হন নি। ঠাকুরদাস আঘাত পেতে পারে বলে শুধু একটু হেসেছিলেন, বাধাও দেন নি। শুধু একটু হেসেছিলেন। জগদ্বন্ধু ছিলেন জ্ঞানযোগী। সেই বাপের ছেলে এবং তাঁর শিষ্য হয়েও আসল বস্তুটি তিনি আয়ত্ত করতে পারলেন না। বাবা বলেছিলেন আয়ুর্বেদে ওর বুদ্ধি ক্ষুরধার।
বুদ্ধি তাঁর ক্ষুরধার ছিল, রোগ উপসর্গ—এমনকি রোগ ও উপসর্গের পশ্চাতে অন্ধ বধির পিঙ্গলকেশী মৃত্যু তার হিমশীতল হাত দুখানি জীবনকে গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছে, কি হয় নি, তাও তিনি অনুমান করতে পারতেন। আজ তুমি তরুণ ডাক্তার জীবন ডাক্তারকে উপহাস করেছ, তিরস্কার করেছ, নতুন কালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অহঙ্কারে তাকে অবহেলা করেছ। কর, কিন্তু সেকালে কেউ সাহস করত না।
স্মৃতি স্মরণ করতে করতে জীবনমশায় যেন প্রাচীন, স্থবির অজগরের মত ফুলে উঠলেন; একটা তরুণ বিষধর তার তারুণ্যের ক্ষিপ্ৰগামিতা আর বিষদন্তের তীক্ষতার অহঙ্কারে ছোবলের পর ছোবল মেরে গেল; বার্ধক্যের জীর্ণতায় তাঁর বিষদাত ভেঙে গিয়েছে, স্থবিরতায় তার বিপুল দেহে গতিবেগ মন্থর হয়েছে; অগত্যা তাঁকে সহ্য করতে হল।
নারায়ণ! নারায়ণ! পরমানন্দ মাধব হে!
বেশ স্কুট স্বরেই উচ্চারণ করলেন জীবন ডাক্তার।
মৃত্যুকালে গঙ্গাতীরে জগদ্বন্ধু মশায় তাঁকে বলেছিলেন–জীবন, বল আমাকে যদি কিছু জিজ্ঞাসার থাকে?
জীবনমশায় নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারেন নি, রুদ্ধ আবেগ চোখের জলের ধারায় পথ করে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। মুখে বলতে কিছু পারেন নি।
জগৎ মশায় বলেছিলেন—তুমি কাদছ? তোমার দীক্ষা আয়ুর্বেদে। জীবন এবং মৃত্যুর তথ্য তো তুমি জান; তবু কাঁদছ? ছি! আমাকে দুঃখ দিয়ো না; তুমি কদলে এই শেষ সময়ে আমাকে বুঝে যেতে হবে যে আমার শিক্ষা সার্থক হয় নি। তা ছাড়া, মৃত্যুতে আমার তো কোনো দুঃখ নাই, আক্ষেপ নাই। পরম শান্তি অনুভব করছি আমি, সুতরাং তুমি কাঁদবে কেন?
জীবন ডাক্তারের চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।
জগৎ মশায় বলেছিলেন-আমি জানি তোমার মনে কোথায় আছে গভীর অতৃপ্তি। থাকা উচিত নয়। তোমার জীবনের কোনো দিক তো অপূর্ণ নয়!
কয়েক মুহূর্ত পরে বলেছিলেন—তবু আছে, রয়েছে। অবশ্য এর ওপর মানুষের হাত নাই আমি জানি। কিন্তু এ অতৃপ্তি থাকতে তো অমৃত পাবে না বাবা। পরমানন্দ মাধবকে অনুভব করতে পারবে না। অতৃপ্তি অবশ্য কামনার বস্তু না পেলে মেটে না। কিন্তু কামনা যে কী তাই কি কেউ জানে? শোন, আশীর্বাদ করে যাই কামনার বস্তু পেয়েই যেন তোমার সকল অতৃপ্তি মিটে যায়, অমৃত আস্বাদন করতে পার। দুঃখে স্থির থাকতে পার, পৃথিবীতে মৃত্যুর মধ্যে অমৃতকে অনুভব করতে পার; আর আনন্দে সুখে কাঁদতে পার। নাই পাও তৃপ্তি। তবে বাবা জ্ঞানযোগে ড়ুব দিয়ে। এই আয়ুর্বেদে। বড় কঠিন এবং শুষ্ক পথ। হোক। জ্ঞান হল অগস্ত্য ঋষি; গষে দুঃখের সমুদ্র পান করে নেন। স্বেচ্ছায় সৃষ্টির কল্যাণে চলে যান দক্ষিণে।
জ্ঞানযোগ-রূপী অগস্ত্যের গষপানে শুকিয়ে-যাওয়া সমুদ্রের বালির মত তার জীবন বালুময়। কিন্তু তার প্রতি বালুকণায় সমুদ্রের জলের লবণাক্ত স্বাদ। আতর-বউ কোনোদিন একবার আস্বাদন করেও দেখলেন না, কেবল মরুভূমি বলেই তাকে উত্তপ্ত দীর্ঘ নিশ্বাসে উত্তপ্ত করে তুললেন।
***
বাপের মৃত্যুর পর জ্ঞানযোগেই নিজেকে ড়ুবিয়ে দেবার জন্য জীবন দত্ত ডাক্তারি পড়বার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তখন বিলাতি চিকিৎসার অভিনবত্বে দেশ চকিত হয়ে উঠেছে। রঙলাল ডাক্তারের পালকির বেহারাদের হাঁকে দেশের পথঘাট মুখরিত; নবীন মুখুজ্জে ডাক্তারের ঘোড়ার খুরের ধুলোয় পথের দুই ধার ধূসর। শুধু পথঘাটেই নয়, কবিরাজদের মনের মধ্যেও এর সাড়া উঠেছে। এই বিদ্যা আগে থেকেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল, বাপের মৃত্যুর পর তিনি সুযোগ পেলেন।
বৃদ্ধ জীবনমশায় অন্ধকারের মধ্যে আবার একবার হাসলেন, দাড়িতে হাত বোলালেন।
হায়রে হায়! মানুষ সংসারে নিজেকে নিজে যত ছলনা করে, প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে তার শতাংশের একাংশও বোধহয় পরকে করে না।
বৃদ্ধ বার বার মাথা নাড়লেন। ছোট ছেলের অপটু মিথ্যা বলার চাতুরীকে ধরে ফেলে কতকটা হতাশায়, কতকটা স্নেহবশে, কতকটা ধরে-ফেলার আনন্দে যেমন প্রবীণেরা মাথা নাড়ে তেমনিভাবেই মাথা নাড়লেন বার বার। সেদিনের আত্মপ্রতারণার কথাই আজ ধরে ফেলেছেন তিনি।
শুধু জ্ঞানলাভের জন্য, জ্ঞানযোগের মধ্যে নিজেকে সমাহিত করবার জন্য ডাক্তারি শিখতে চেয়েছিলেন? নিজে ঘোড়ায় চড়ে, আতর-বউকে পালকিতে চাপিয়ে কাঁদীতে ভূপী বোসের বাড়ি যাওয়ার কামনার তাড়নার কথাটা মিথ্যা?
শুধু কি এই? জগত্মশায়ের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই কতকগুলি বাধা ঘর কি হাতছাড়া হয় নাই তার? লোকে বলে নাই—এইবার মশাইদের বাড়ির পর গেল?
নবগ্রামে কি প্রথম অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার এসে বসে নি? তার প্রায় মাসদুয়েক পর ওই কিশোরের বাপ কৃষ্ণদাসবাবুর আশ্রয়ে কি হরিশ ডাক্তার আসে নি? তিনি কি নিজেই শঙ্কিত হন নি?
গুরু রঙলাল ডাক্তার এর অন্য অর্থ করেছিলেন। বলতেন জীবন, তোমাকে আমি ভালবাসি কেন জান? তোমাকে ভালবাসি তুমি জীবনে হার মান নি এই জন্যে। এ দেশের কবিরাজরা হার মেনে এই অ্যালোপ্যাথিকে শুধু ঘরে বসে শাপ-শাপান্তই করলে। না পারলে নিজেদের শাস্ত্রের উন্নতি করে এর সঙ্গে পাল্লা দিতে না চাইলে এর মধ্যে কী আছে সেই তত্ত্বকে জানতে। আধমরারা এমনি করেই মরে হে। তুমি জ্যান্ত মানুষ। তাই তোমাকে ভালবাসি। হার মানার চেয়ে আমার কাছে অপমানের বিষয় আর কিছু নাই। হার মানা মানেই মরা। ডেড ম্যান, ডেড ম্যান! বুঝেছ?
লম্বা একটা চুরুট ধরিয়ে খালি গায়ে একখানা খাটো কাপড় পরে রঙলাল ডাক্তার ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন আর পা দোলাতেন।
রোগী আসত। এ কথা যেদিন বলেছিলেন সেদিনের কথা মনে পড়ছে। একজন জোয়ান মুসলমানকে ড়ুলি করে নিয়ে এসেছিল। পেটের যন্ত্রণায় ধড়ফড় করছিল জোয়ানটা। রঙলাল। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে দেখে নির্বিকারভাবেই বলেছিলেন, শুয়ে পড়, চিৎ হয়ে—এই আমার পায়ের তলায় শুয়ে পড়।
জীবন ডাক্তারকে বলেছিলেন—দেখবে নাকি নাড়ি? দেখ, তোমার নাড়িজ্ঞান কী বলে দেখ। অম্বল না অম্বলশূল না পিলের কামড় দেখ।
রোগী চিৎকার করে উঠেছিল, ওগো ডাক্তারবাবু, তুমি দেখ গো, তুমি দেখ! মরে গেলাম, আমি মরে গেলাম। নইলে একটুকুন বিষ দেন মশায়—খেয়ে আমি মরে বাঁচি। আঃ কোথাও কিছু হল না গো, কবরেজ হাকিম পীর কালীস্তান কিছু বাকি নাই মশায়।
বাধা দিয়ে রঙলাল বলেছিলেন, ঠাকুর-দেবতা কী করবে রে ব্যাটা? গোগ্ৰাসে গোশত খাবি তো তারা কী করবে? কতখানি গোশত খাস একেবারে দেড় সের না দু সের? কৃমি হয়েছে। তোর পেটে, তিন-চার হাত লম্বা কৃমি।
—হেই বাবা, ওষুধ দেন বাবা। যাতনায় আর বাঁচি না বাবা।
—তা দেব কিন্তু টাকা কই? অ্যাঁ? দুটো টাকা দে ফিজ আর ওষুধের দাম। দে আগে। টাকা না হলে হবে না।
–এক টাকা এনেছি বাবা—
জীবন বলেছিলেন, কাল তা হলে দিয়ে যেয়ো।
রঙলাল বলেছিলেন, ইউ আর এ ফুল। বিনা ফিজে চিকিৎসা কোরো না। ধারে ওষুধ দিয়ে না, মরবে তুমি। তা ছাড়া ওরা ভাববে এ লোকটার পর নেই ভাল। মানুষের বেঁচে থাকতে টাকা চাই। মানুষ খাটে ওই বাঁচার মূল্য উপার্জন করতে, তাতেও যে দাক্ষিণ্য দেখাতে যায় সে শুধু ফুলই নয় সে অপরাধী, অপরাধী। তাকে জীবনের যুদ্ধে হরতেই হবে। জাস্ট লাইক দি হিন্দুজ, ইতিহাসে পাবে হিন্দুরা প্রবল যুদ্ধ করে জিতে এল প্রায়, মুসলমানেরা যুদ্ধবিরতি প্রার্থনা করলে, ব্যস, হিন্দুরা বিরত হল। আচ্ছা, বিশ্রাম করে নাও, কাল আবার যুদ্ধ হবে। কিন্তু রাত্রে মুসলমান আক্রমণ করলে বিনা নোটিশে, অপ্রস্তুত হিন্দুরা হারল, মরল কিন্তু স্বর্গে গেল। আমি স্বৰ্গকামী নই। বুঝেছ? বলেই রোগীর সঙ্গের লোকদের বলেছিলেন, যাও, আর একটা টাকা নিয়ে এস। যাও। রোগী থাকুক এখানে। ভয় নেই। মরবে না। যাও।
তারা চলে গেলে বলেছিলেন, জীবনে টাকা চাই জীবন! টাকা চাওয়াটা অপরাধ নয়। কারও কাছে ভিক্ষা কোরো না, কাউকে ঠকিও না, কারও চুরি কোরো না, কাউকে সর্বস্বান্ত করে নিও না, কিন্তু তুমি যার জন্যে খাটবে তার মজুরি ফিজ, এ নিতে সঙ্কোচ কোরো না। করলে তুমি মরবে স্বর্গে যাবে কি না জানি না।