১২. সুলতান ফিরোজের কাছে

বারো

দেশে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে শেখ বোরহানউদ্দিন ও অন্য সবাই আমাকে পরামর্শ দিলেন, বিশৃখলাবস্থা ভালভাবে দানা বাঁধবার আগেই দক্ষিণ চীনে ফিরে যেতে। তারা আমাকে সুলতান ফিরোজের কাছে নিয়ে গেলেন। সুলতান তার তিন জন অনুচর আমার সঙ্গে দিলেন এবং পথের সর্বত্র আমাকে অতিথির মতো ব্যবহার করতে লিখে দিলেন।

আমরা নদীর ভাটিপথে খাসা এবং সেখান থেকে কাজান ও জায়তুন এসে। পৌঁছলাম। জায়তুনে পৌঁছে ভারত যাত্রার জন্য তৈরি কয়েকখানা চীনদেশীয় নৌকা জাঙ্ক দেখতে পেলাম। সে সব জাঙ্কের একখানার মালিক ছিলেন জাভার (সুমাত্রা) শাসনকর্তা আল-মালিক আজ-জাহির। জাঙ্কের খালাসীরাও সবাই ছিল মুসলমান। এজেন্ট আমার পূর্ব-পরিচিত ছিলেন বলে আমার আগমনে খুব খুশী হলেন। অনুকুল। হাওয়ায় পাল খাঁটিয়ে দশ দিন চলার পরে আমরা যখন তাওলিসি’ দেশের কাছাকাছি এসেছি তখন হাওয়ার গতির পরিবর্তন ঘটলো, আকাশ মেঘে কালো হয়ে গেলো এবং প্রবল বৃষ্টিপাত আরম্ভ হলো। দশ দিন অবধি সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম না। দশ দিন পরে এমন এক সাগরে এসে পৌঁছলাম যার নাম আমাদের জানা ছিলো না। খালাসীরা সবাই তখন শঙ্কাকুল হয়ে উঠলো। তারা চীনে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু চীনে ফিরে যাবার প্রশ্ন তখন অবান্তর। আমরা তখন কোন্ সাগরের বুকে ভাসছি না বুঝেই বিয়াল্লিশ দিন কাটিয়ে দিলাম।

তেতাল্লিশ দিনের ভোরে প্রায় বিশ মাইল দূরে সাগরের বুকে দেখতে পেলাম একটি পর্বত। জাহাজের খালীসারা সবাই হতভম্ব। তারা বলাবলি করতে লাগলো আমরা এখন স্থলভাগের ধারে কাছেও নেই। সাগরে পর্বত আছে বলে আমাদের জানা নেই। বাতাস যদি আমাদের জাঙ্ক পর্বতের উপরে নিয়ে ফেলে তবে আর রক্ষা নেই। সবাই তখন। আল্লাকে স্মরণ করতে লাগলো। কেউ-কেউ নতুন করে তওবা করে নিল। আমরাও খোদার দয়া ভিক্ষা করতে লাগলাম এবং রসুলুল্লাহ্ যাতে আমাদের জন্য খোদার কাছে সুপারিশ করেন সেজন্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। সওদাগরেরা অনেক টাকা-পয়সা খয়রাত করবেন বলে মান করতে লাগলেন। আমি নিজ হাতে একটি খাতায় তাদের মানতের কথা লিখে দিলাম। বাতাস একটু শান্ত হলো। তখন সুর্য উঠলে দেখতে পেলাম, পবর্তটি আকাশে মাথা তুলেছে, পবর্ত ও সাগরের মধ্যবর্তী স্থানে সুর্যের আলো এসে পড়েছে। আমরা তাই দেখে অবাক হয়ে গেলাম। খালাসীরা তখন কাঁদতে-কাঁদতে একে অপরের কাছ থেকে চির-বিদায় গ্রহণ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের এ আবার কি হলো?

তারা বললো, আমার যাকে পবর্ত মনে করেছিলাম সে একটা রক’ পাখী। সে যদি একবার আমাদের দেখতে পায় তবে আর নিস্তার নেই।

আমরা তখন সেই পর্বত থেকে মাত্র দশ মাইল ব্যবধানে রয়েছি। খোদার অসীম অনুগ্রহে তখন বাতাসের গতি আমাদের অনুকুলে এলো। তার ফলে আমরা অন্যদিকে চালিত হলাম এবং সেটাকে আর দেখতে পেলাম না এবং তার স্বরূপও জানতে পেলাম না।

অবশেষে দু’মাস পরে আমরা জাভায় পৌঁছে সুমাত্রা শহরে পর্দাপণ করলাম। জাভার সুলতান তখন বিশাল একদল বন্দী নিয়ে এক অভিযান থেকে ফিরেছেন। তিনি আমাকে দুজন বালক ও দু’জন বালিকা পাঠিয়ে দেন এবং আমাকে সমাদরে স্থান দেন। সুলতানের ভ্রাতুস্পুত্রীর সঙ্গে তাঁর পুত্রের বিবাহে আমি উপস্থিত ছিলাম। এ-দ্বীপে দু’মাস কাটিয়ে আমি পুনরায় একটি জাঙ্কে আরোহণ করে যাত্রা শুরু করলাম। বিদায়কালে সুলতান আমাকে প্রচুর অগুরু, কর্পূর লবঙ্গ, চককাঠ উপহার দিলেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চল্লিশ দিন পরে আমরা কালাম (কুইন) এসে পৌঁছলাম। এখানে। অবতরণ করে আমি মুসলমানদের কাজীর গৃহের সন্নিকটে বাস করতে লাগলাম। সেটা ছিল রমজান (জানুয়ারী ১৩৪৭) মাস। এখানকার প্রধান মসজিদে আমি ঈদের নামাজ আদায় করি। কালাম থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা কালিকট গিয়ে কিছুদিন কাটাই। আমার ইচ্ছা ছিল দিল্লী ফিরে যাওয়া। কিন্তু ভালভাবে চিন্তা করার পরে ভয়ে দিল্লী যাত্রা স্থগিত রাখলাম। পুনরায় জাঙ্কে আরোহণ করে আটাশ দিন পর ধাফারী এসে পৌঁছলাম। তখন ৭৪৮ হিজরীর মহরম মাস(১৩৪৭এর প্রপ্রিল মাসের শেষাংশ)।

অতঃপর জাহাজে চড়ে আমরা ম্যাসকট নামক ছোট একটি শহরে এলাম। এখানে প্রচুর কাল আল-মাছ পাওয়া যায়। সেখান থেকে আমরা গেলাম কুরায়াত, শাবা, কাব্বা ২ ও কালহাত প্রভৃতি বন্দরে। এ সব বন্দরের কথা পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব শহর হরমুজ প্রদেশের অংশ বিশেষ যদিও এগুলোকে ওমান জেলার অন্তর্গত বলে ধরা হয়। সেখান থেকে আমরা হরমুজ গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে তিন রাত কাটিয়ে গেলাম কাওরাস্তান, লার ও খুবালে। এ সবের কথাই আগে উল্লেখ করা হয়েছে। খুবাল থেকে এলাম কারজি। কারজিতে তিন রাত কাটিয়ে অন্যান্য কয়েকটি শহর ও গ্রাম পার হয়ে এলাম শিরাজ; শিরাজ থেকে ইসফাহান। সেখান থেকে তুস্তার (সুস্তার) হয়ে বস্। সেখানে পবিত্র যে সব কবর রয়েছে তা জেয়ারত করা হলো। এমনি করে মাশহাদ আলী ও হিলা হয়ে বাগদাদ এলাম ৪৮ হিজরীর শাওয়াল মাসে (জানুয়ারী, ১৩৪৮)। মরক্কো থেকে এসেছেন এমনি একজন লোকের সঙ্গে সেখানে আলাপ হলো। তারিফার বিপর্যয়ের খবর এবং খ্রীষ্টানদের আল-খাদ্ৰা (আল্ জেসিস) দখলের ৪ খবর পেলাম তার কাছে। ইসলামের যে ক্ষতি তাতে হয়েছে খোদা যেনো তা পূরণ করেন।

আমি উপরে বর্ণিত তারিখে যখন বাদদাদ পৌঁছি তখন বাগদাদ ও ইরাকের সুলতান ছিলেন শেখ হাসান ৫। ভূতপূর্ব সুলতান আৰু সাইদের তিনি ফুপাতো ভাই। শেখ হাসানের স্ত্রীকে যেমন আবু সাঈদ বিয়ে করেছিলেন তেমনি শেখ হাসানও আবু। সাঈদের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী দিলশাদকে বিবাহ করেন এবং আবু সাঈদের ইরাক রাজ্য দখল করেন। দিলশাদ ছিলেন আমীর চুবানের পুত্র দিমাস্ক খাজার কন্যা। আমরা যখন বাগদাদে পৌঁছি সুলতান হাসান তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন সুর দেশের শাসনকর্তা সুলতার আবেগ আফরাসিয়াব-এর সঙ্গে যুদ্ধ। করতে।

বাগদাদ ছেড়ে আমরা গেলাম আনবার। আনবার থেকে পর পর এলাম হিত হাদিসা এবং আনা।

এটি পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী ও উর্বর জেলা। এখানে রাস্তার দু’পাশে এতো দালান কোঠা যে হেঁটে যেতে মনে হবে কোনো বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আগেই আমরা বলেছি, একমাত্র এ জেলা ছাড়া চীনের নদীর তীরবর্তী দেশগুলোর তুলনা হয় না। আনা থেকে রওয়ানা হয়ে পৌঁছলাম রাহবা শহরে। রাহবা সিরিয়ার সীমান্তে সবচেয়ে সুন্দর শহর। সেখান থেকে গেলাম আস্-সুনা নামক আরেকটি সুন্দর শহরে। এ শহরের অধিবাসীরা প্রধানতঃ পৃষ্টান। এ শহরের নাম আস-সুনা (গরম শহর) হবার কারণ হলো, এখানকার পানির উষ্ণতা। এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য। স্নানাগার রয়েছে। এখানকার লোকেরা রাত্রে পানি আনে এবং ঠাণ্ডা হবার জন্য পানি ছাদের উপর রেখে দেয়।

অতঃপর আমরা গেলাম হজরত সুলেমানের শহর তাদমূর (পালমিরা)। এ শহরটি জিদের ৯ দ্বারা তার জন্যে নির্মিত হয়। সেখান থেকে বিশ বছর পরে আবার ফিরে এলাম দামাস্ক শহরে। আমার একজন স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এখানে রেখে গিয়েছিলাম। ভারতে থাকাকালে শুনেছিলাম, সে পরে একটি পুত্র-সন্তান প্রসব করেছে। তাই শুনে আমি ভারতীয় মুদ্রায় চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা দীনার পাঠিয়ে দেই পুত্রের নানার কাছে। তিনি ছিলেন মরক্কোর অন্তর্গত মিকনাসা (মেকুইনেজ) নামক জায়গার অধিবাসী। দামাস্কে পৌঁছে আমার ছেলের খবর নেওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তাই রইলো না মনে। সৌভাগ্যক্রমে মসজিদে গিয়ে নুরউদ্দিন আস্ শাখাইর দেখা পেলাম। তিনি ছিলেন এমাম এবং মালিক বংশের শেখ বা প্রধান ব্যক্তি। আমি তাঁকে সালাম জানালাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি তখন নিজের পরিচয় দিয়ে ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, বারো বছর হবে সে মরে গেছে।

তার কাছে শুনলাম, তাঞ্জিয়ারের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি জাহিরিয়া একাডেমীতে বাস করছেন। কাজেই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমার মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনের খবর জানবার জন্য। গিয়ে দেখলাম, তিনি একজন পূজনীয় শেখ। তাঁকে। সালাম করে আমার বংশ-পরিচয় দিতেই তিনি জানালেন, আমার পিতা এন্তেকাল করেছেন পনেরো বছর আগে। মাতা এখনও জীবিত আছেন। বছর শেষ হওয়া অবধি আমি দামাস্কে কাটালাম, যদিও খাদ্যদ্রব্য সেখানে সেবার দুর্মূল্য এবং সাত আউন্স পরিমাণ রুটির মূল্য এক দেরহাম নাকরা (প্রায় পাঁচ পেনি)। সেখানকার এক আউন্স মরক্কোর চার আউন্সের সমান।

দামাস্ক থেকে এলাম আলেপ্পো। আলেপ্পো আসাতে পথে পড়লো হিমস, হামা, মারা, ও সারমিন। এখানে এলে একটি ঘটনা ঘটলো। আইনটাবৃ১০ নামক শহরের বাইরে এক পাহাড়ের উপর বাস করতেন এক দরবেশ। প্রধান শেখ নামে তিনি পরিচিত। অনেক লোকজন আসততা সেখানে তার সঙ্গে দেখা করে দোয়া পাবার জন্যে। এছাড়া তিনি নিজে ছিলেন অবিবাহিত একজন মাত্র শিষ্য ছিল সঙ্গে তাঁর পরিচর্যার জন্য। এক দিন ধর্মোপদেশ দিতে-দিতে তিনি বললেন, আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু ওয়ালাম হে সাল্লাম) নারী ছাড়া থাকতে পারতেন না কিন্তু আমি তা পারি। এ জন্য কাজীর দ্বারা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য সাবুদ নেওয়া হলো, প্রমাণও পাওয়া গেলো। ব্যাপারটা তখন প্রধান সেনাপতির গোচরীভূত করা হলো। শেখ ও তাঁর শিষ্য দোষ স্বীকার করলেন। তখন চার মোজহাবের বিচারকগণ তাদের প্রাণদণ্ডের বিধান দিলেন। যথা। সময়ে তাদের প্রাণদণ্ড হয়ে গেল।

জুন মাসের প্রথম দিকে আলেপ্পোতে খবর পেলাম গাঁজায় ভয়ানক প্লেগ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় হাজারেরও উপর। আমি হিমস গিয়ে দেখলাম সেখানেও প্লেগের প্রকোপ। যেদিন সেখানে পৌঁছলাম সেদিনের মৃত্যু সংখ্যা সেখানে তিনশ’। কাজেই আমি দামাস্কে রওয়ানা হয়ে গেলাম এবং বৃহস্পতিবার গিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। সেখানকার বাসিন্দারা তখন তিন দিন থেকে রোজা পালন করছে। শুক্রবার কদম মোবারক মসজিদে এসে জমায়েত হলো, আগেই তা পুস্তকের প্রথমাংশে বলেছি। তখন খোদা তাদের প্লেগের কবল থেকে মুক্তি দেন। তাদের সেখানে দৈনিক মৃত্যুর সর্বাধিক সংখ্যা দু’হাজার চার শ’তে উঠেছিলো।

তারপর আমি আজালুন গেলাম, সেখান থেকে গেলাম জেরুজালেম। সেখানে গিয়ে দেখলাম প্লেগের প্রকোপ কমে গেছে। আমরা আবার হেবরণে ফিরে গেলাম, সেখান থেকে গেলাম গাঁজা। গাঁজায় গিয়ে দেখলাম প্লেগে লোক মরে অধিকাংশ জায়গা বিরাণ পড়ে আছে। কাজীর কাছে শুনলাম সেখানে দৈনিক এগারো শ’ লোক প্লেগে মরছে। আমরা সেখান থেকে দামিয়েত্তা এবং দামিয়েত্তা থেকে আলেকজান্দ্রিয়া গেলাম পজে। সেখানেও প্লেগের প্রকোপ তখন কমে এসেছে যদিও মৃত্যু-সংখ্যা দৈনিক এখানে এক হাজার আশি অবধি উঠেছিল।

অতঃপর কায়রো এসে হাজির হলাম। সেখানে এসে শুনলাম প্লেগে মহামারীর সময় দৈনিক একুশ হাজার লোকও মরেছে।১১ কায়রো থেকে সাইদ (আপার মিশর) হয়ে এলাম আয়ধাব। সেখান থেকে জাহাজে উঠলাম জুদ্দায় যাবার জন্যে। জুদ্দা থেকে মক্কা এসে হাজির হলাম ৪৯ হিজরীর ২২শে শাবান (১৬শে নভেম্বর, ১৩৪৮) তারিখে।

এ বছরের হজব্রত (২৮শে ফেব্রুয়ারী-২রা মার্চ) পালন করে সিরিয়ার এক কাফেলার সঙ্গে তায়বা (মদিনা) পৌঁছলাম। সেখান থেকে জেরুজালেম ও গাঁজা হয়ে আবার ফিরে এলাম কায়রো। কায়রো এসে জানতে পারলাম, আমাদের খলিফা আবু ইনের প্রচেষ্টায় আল্লাহ্ মরোক্কোর মারিণ১২ বংশের বিচ্ছিন্ন লোকদের পুণরায় একতাবদ্ধ করেছেন। আমরা শুনলাম আবু ইনান দেশের ছোট বড় সকলের প্রতি এমন অনুগ্রহ দেখিয়েছেন যে আপাময় সকলেই তার আনুগত্য স্বীকার করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। একথা শুনে তার রাজধানী দেখবার ইচ্ছা জাগলো আমার অন্তরে। তাছাড়া নিজের গৃহের স্মৃতিও তখন আমার মনকে উতলা করে তুলেছে, প্রবল আকাঙ্ক্ষা। জেগেছে মনে নিজের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের দেখতে এবং স্বদেশে ফিরে যেতে। কারণ, সে দেশের তুল্য আর কোন দেশই আমার চোখে কখনও পড়েনি।

তখন আমি একজন তিউনিসবাসীর ছোট একখানা সওদাগরী জাহাজে ৫০ হিজরীর সফর মাসে (এপ্রিল-মে, ১৩৪৯) রওয়ানা হয়ে জেরবা পৌঁছলাম। আমি সেখান নেমে রইলাম আর জাহাজ চলে গেলো তিউনিসের দিকে। সেখানে সে জাহাজ শত্রুর কবলে১৩ গিয়ে পৌঁছল। জেবরা থেকে ছোট একখানা নৌকায় আমি কাবি (গাবেস) পৌঁছে আবু মারওয়ান ও আবুল আব্বাস নামক প্রসিদ্ধ ভ্রাতৃদ্বয়ের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। তারা জেরবাও গাবেসের শাসনকর্তা মকির পুত্র। আমি তাদের সঙ্গে হজরতের জন্মদিন ফাতেহা দোয়াজ দাহারম পর্ব (১২ই রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৩১শে মে) উদযাপন করলাম।

অতঃপর সেখান থেকে নৌকাযোগে সাফাঁকাস (Sfax) এলাম এবং সমুদ্রপথে গেলাম বুলিয়ানা১৪। কয়েকজন আরবের সঙ্গে সেখান থেকে পব্রজে তিউনিস শহরে যখন পৌঁছি তখন আরবরা তিউনিস অবরোধ করেছে। তিউনিসে ছত্রিশ দিন কাটাবার পর কাতালানদের সঙ্গে জাহাজে উঠলাম। জাহাজ সারদানিয়া (সারাদিনিয়া) দ্বীপে গিয়ে। পৌঁছল। খৃষ্টান অধিকৃত দ্বীপের অন্যতম দ্বীপ সারদানিয়া। এখানে চমৎকার একটি পোতায় আছে। পোতাশ্রয়টি চতুর্দিক কাঠ দিয়ে ঘেরা, এক জায়গায় একটি দরজা। এদের অনুমতি পেলেই কেবল সে দরজা খোলা হয় ১৫। দ্বীপে সংরক্ষিত শহর আছে। তার একটিতে গিয়ে সেখানে আমরা অনেকগুলো বাজার দেখতে পেয়েছিলাম। দ্বীপের লোকেরা ষড়যন্ত্র করেছিলো,আমরা দ্বীপ ছেড়ে রওয়ানা হলে তারা আমাদের পিছু ধাওয়া করবে এবং ধরে এনে ক্রীতদাস করে রাখবে। তাই টের পেয়ে আমি খোদার কাছে মান করলাম, খোদা যদি নিরাপদে আমাদের এ দ্বীপ থেকে যেতে দেন তা হলে। একাদিক্রমে দুমাস রোজা রাখবো। পরে আমরা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে দশদিন পর তেনেস পৌঁছি, সেখান থেকে পৌঁছি মাজুনা, মাজুনা থেকে মুস্তাঘানিম (মোস্তাঘানেম) এবং তিলিম সান (তেল্মসেন)। আমি আল-উৰ্বাদ গিয়ে শেখ আবু মাদিনের১৬ কবর জেয়ারত করি। তিলিমসান ছেড়ে আমি নাদ্রমা সড়ক ধরে চলতে থাকি এবং সেখান থেকে আখান্দাকান্ সড়কে গিয়ে শেষ ইব্রাহিমের আস্তানায় গিয়ে একরাত কাটাই। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আজগানগানের কাছে পৌঁছলে পঞ্চাশ জন পদাতিক এবং দু’জন অশ্বারোহী আমাদের আক্রমণ করে। তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তানজিয়ারের হাজী ইব্‌নে কারিয়াত এবং তার ভাই মোহাম্মদ। মোহাম্মদ পরে সমুদ্রের বুকে শহীদ হন। আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো বলে স্থির করে নিশান উড়িয়ে দিলাম। তার ফলে তারা আমাদের সঙ্গে সন্ধি করলো এবং খোদাকে ধন্যবাদ যে তাদের সঙ্গেই আমরা অগ্রসর হলাম। তারপর আমরা তাজা শহরে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে খবর পাই আমার মাতা প্লেগ রোগে এন্তেকাল করেছেন। পরম দয়ালু খোদা তার আত্মার শান্তি বিধান করুন। পরে তাজা থেকে রওয়ানা হয়ে ৭৫০ হিজরীর সাবান মাসের শেষে এক শুক্রবার (১৩ই নভেম্বর,১৩৪৯) রাজধানী শহরে ফেজে পৌঁছি।

ফেজে পৌঁছে আমি পরম দানশীল আমাদের ইমাম, আমিরুল মোমেনিন হজরত আল-মুতাওয়াক্কিল আবু ইমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। খোদা তাঁর মহত্ব বৃদ্ধি করুণ এবং শত্রুকে দুর্বল করুণ। তার পদমর্যাদার কাছে ইরাকের সুলতানের পদমর্যাদা, সৌন্দর্যের কাছে ভারতের বাদশাহের সৌন্দর্য, সদগুণের কাছে ইয়ামেনের সুলতানের মহৎ চরিত্র, সাহসের কাছে তুকী সম্রাটের সাহস, দয়ার কাছে গ্রীক সম্রাটের দয়া, জ্ঞানের কাছে জাভার ম্রাটের জ্ঞান আমি ভুলে গেলাম। আমি তার গৌরবময় রাজ্যে এসে আমার সফর শেষ করলাম। আমি নিঃসন্দেহ যে এ দেশটি সর্বপ্রকারে সকল দেশের সেরা দেশ। কারণ এখানে প্রচুর ফল পাওয়া যায় এবং চলমান পানির স্রোত ও পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য কখনও নিঃশেষ হয় না। একসঙ্গে এতোগুলো গুণের সময় খুব কম দেশেই ঘটেছে।

পাশ্চাত্যের দেরহাম ছোট হতে পারে কিন্তু তার ব্যবহারিক মূল্য অত্যন্ত বেশী। আপনি যখন মিশর ও সিরিয়ার দেরহামের মূল্যের সঙ্গে এখানকার দেরহামের মূল্যের তুলনা করবেন তখন আমার কথার সত্যতা এবং পাশ্চ্যত্যের শ্রেষ্ঠতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি মিশরে এক দেরহাম নাবার পরিবর্তে আঠারো আউন্স ছাগমাংস বিক্রি হয়। এক দেরহাম নাা পাশ্চাত্যের ছয় দেরহামের সমতুল্য।১৮ পক্ষান্তরে মূল্য যখন বেশী থাকে তখনও পাশ্চাত্যের দুই দেরহামে অর্থাৎ নাায় এক-তৃতীয়াংশে আঠারো আউন্স গোত পাওয়া যায়। মিশরে তরল মাখন (ঘি) আদৌ পাওয়া যায় না। মিশরের লোকেরা রুটীর সঙ্গে যে সব জিনিষ খায় পাশ্চাত্যের লোকেরা সেদিকে ফিরেও তাকায় না। তারা বেশীর ভাগ খায় প্রকাণ্ড। কড়াইতে তিল তেল দিয়ে রান্না করা মসুর বা মটর কলাই।১৯ বাসিল্লা নামে এক রকম মটর রান্না করে তারা জলপাই তেল সহ খায়; ছোট এক জাতের শশা সিদ্ধ করে তারা। দৈ মিশিয়ে খায়; তারা একই উপায়ে সালাড় তৈরী করে।২০ বাদাম গাছের কুঁড়িও তারা রান্না করে দৈ দিয়ে খায় এবং কচু রান্না করে খায়। পাশ্চাত্যে এ সব জিনিষ অতি সহজলভ্য। খোদা এখানকার অধিবাসীদের এ সব না খাইয়েও পারে কারণ, এখানে প্রচুর গোশত, ঘি, মাখন, মধু এবং অন্যান্য খাদ্য পাওয়া যায়। মিশরে কাঁচা শাকসব্জীও দুষ্প্রাপ্য। বেশীর ভাগ ফলমূলই সেখানে আসে সিরিয়া থেকে। সস্তার সময়ে এক দেরহাম নাায় তিন পাউণ্ড আঙ্গুর বিক্রি হয়। বারো আউন্সে তাদের এক পাউণ্ড।

সিরিয়ায় ফল প্রচুর পাওয়া যায় কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে ফলের দাম অপেক্ষাকৃত সস্তা। সেখানে এক দেরহাম নাকরায় পাওয়া যায় এক পাউণ্ড আঙ্গুর (তাদের এক পাউণ্ড পাশ্চাত্যের তিন পাউণ্ডের সমান)। দাম যখন সেখানে সস্তা হয় তখন এক দেরহাম নাকরায় দু পাউণ্ড পাওয়া যায়। একটি ডালিম বা নাশপাতি জাতীয় ফলের দাম আট ফল (তাম্রমুদ্রা) যা আমাদের এক দেরহামের সমতুল্য। এক দেরহাম নারায় যে পরিমাণ শাকসব্জী পাওয়া যায় তার চেয়ে আমাদের দেশের ছোট দেরহামের কেনা শাকসব্জীর পরিমাণ বেশী। সিরিয়ার এক পাউণ্ড পরিমাণ মাংস সেখানে বিক্রি হয় আড়াই দেরহাম নাকরায়। এসব বিবেচনা করলে সহজেই বুঝা যাবে, পাশ্চাত্যে জীবিকা নির্বাহের ব্যয় স্বল্প, সেখানে ভাল জিনিসের প্রাচুর্য আছে এবং বসবাস করা। আরামদায়ক ও সুবিধাজনক। অধিকন্তু আমির-উল-মোমেনিনের দৌলতেও পাশ্চাত্যের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি করেছেন।২১

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ১২

১। সিন্দবাদ কাহিনীর কল্যাণে রুস্ শব্দটি ইউরোপে যথেষ্ট পরিচিত। কাজেই এটার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। এই বিপুলকায় পাখির গল্পের মূল উৎস কি, সে সম্বন্ধে ইউ মার্কোপলোর বিবরণের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন (২য় খণ্ড, ৪১৫-২০)। দু একজন আরবী লেখক এ ব্যাপারে। ইতিপূর্বে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এবং দেখা যাচ্ছে ইব্‌নে বতুতা এ সম্বন্ধে বেশ বিবেচকের মতো কোনো মত প্রকাশ করেননি। মরীচিকা বা অস্বাভাবিক আলোক প্রতিসরণের দ্বারা এই ব্যাপক প্রচলিত গল্পকে চালু করার ব্যাপারটি সম্বন্ধে তার বর্ণনায় অবশ্য ইঙ্গিত রয়েছে।

২। কুরেয়াত (করিয়াত) এখনো আমাদের মানচিত্রে দেখা যায়। শাবা এবং কাবা অন্ততঃ এ রকম নামে দেখা যাচ্ছে না তবু মনে হয় স্থান দুটি বর্তমান রয়েছে। কেননা ওমান উপকূলে এখনো একটি ধারাবাহিক গ্রামশ্রেণী রয়েছে।

৩। কারাজ বা কারজিন ঠিক সাক্কান (মুখ) নদীর তীরে কিছুটা পূর্বমুখী বাঁকে অবস্থিত। ইব্‌নে বতুতার পথ এ স্থান থেকে সিরাজ পর্যন্ত নদীর উপত্যকার উপরের দিকে। বাসা (ফাসা) এবং শিরাজের মাঝখানের পথে ছিল খাওরিস্তান শহর-এটাই সম্ভবতঃ ইব্‌নে বতুতার কাউরেস্তান (৩য় খণ্ড, ২২ টীকা দ্রষ্টব্য)।

৪। ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে মুর সুলতান আবু হাসান স্পেনের অভ্যন্তরে সসৈন্য অভিযান করেন এবং তারিফার নিকটবর্তী রিয়ো স্যালাডু নামক স্থানে ক্যান্টিলের একাদশ আস্ সোর কাছে সেই একই বছরের ৩০শে অক্টোবর সম্পূর্ণ পরাজিত হন। আল ফসো ১৩৪২ খ্রীষ্টাব্দে আজেসিরাস অধিকার করে তার বিজয় সম্পন্ন করেন, কিন্তু বিভ্রাল্টার পুনঃ অধিকারের চেষ্টায় ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। সে সময়ের ব্রিাল্টার অবরোধের বিবরণ ইব্‌নে বতুতা তার পরবর্তী পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন।

৫। শেখ হাসান এবং সুলতান আবু সাইদের মাঝখানের সম্পর্ক ইব্‌নে বতুতা ইতিপূর্বেই বর্ণনা করেছেন (উপরের ১০০ পৃষ্ঠায়)। এই বড় শেখৃ হাসান আমির চুবানের পৌত্র ছোটো শেখ হাসানের সঙ্গে আট বছরের সশ্রামের পর জালাইর কিম্বা ইলকানি রাজত্ব স্থাপন করেন এবং পনেরো শতাব্দীর প্রথম দিকের বছরগুলি পর্যন্ত তারা ইরান এবং আজরবাইজান শাসন করেন।

৬। হিটু এবং আনা এখনো আমাদের ম্যাপে দেখা যায়। বাগদাদের উত্তর-পশ্চিমে ইউক্রেট নদীর তীরে অবস্থিত। হাদিজা, এখন কালাত হাবুলিয়া বলে অভিহিত। এটা আনার ৩৫ মাইল নিয়ে ছিল। এবং আনুবার ছিল পূর্বে ইরাকের অন্যতম একটি প্রধান নগর হিটের কিছু দূর নিমে ইসা খালের মাথায়। এটা হচ্ছে নৌ-চলাচল উপযোগী অন্যতম প্রথম খাল। এই খাল দ্বারা যুক্ত হয়েছে ইউফ্রেটের সঙ্গে তাইগ্রিস। ঘন লোকবসতী এবং বিপুল পরিমাণ ফলের জন্য হিট জেলা ছিল বিখ্যাত।

৭। রাহুবার অবস্থান ইউক্রেটের সঙ্গে যুক্ত কাবুর নদীর সম্মিলন স্থানের আঠারো মাইল নিয়ে নদীর পশ্চিমে একটি খালের ধারে।

৮। সুন্ন হচ্ছে মধ্য ইউফ্রেটস্ এবং পামিরার মধ্যবর্তী পথের একটি স্টেশন। পামিরা থেকে প্রায় ৩৫ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।

৯। ১ম পরিচ্ছেদের ২৮ টীকা দ্রষ্টব্য।

১০। এখন তুরস্কের একটি বৃহৎ শহর।

১১। এই মারী হচ্ছে প্রসিদ্ধ মহামড়ক”। এ বছরের মধ্যে এই মহামারী মুসলিম জগতে অবর্ণনীয় ধ্বংস সৃষ্টি করে। মোঙ্গল এবং তৈমুরলঙের আগমন অপেক্ষা এই দুর্ঘটনা কম ভয়ঙ্কর ছিল না। ইব্‌নে বতুতার হিসাব খুব বেশী আতিশয্যাপূর্ণ নয়-অবশ্য কতকগুলি হিসাব খুব বেশী ধরা হয়েছে। ঐতিহাসিক ইব্‌নে খালদুনের বাবা এই মহামারীতে তিউনিসে মৃত্যুপ্রাপ্ত হন। তিনি বলেন, “এই সর্বগ্রাসী মহামারী জাতিগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নিয়ে গিয়েছে এ যুগের বংশধরদের, সভ্যতার অনেক অপূর্ব সম্পদ লুপ্ত করে দিয়েছেন এবং প্রাসাদরাজী ধূলিসাৎ হয়েছে-পথ এবং পথের নির্দেশন হয়েছে নিশ্চিহ্ন…..এ যেন স্রষ্টা নিজে তার সৃষ্টিকে অধঃপাতের মাঝে আহ্বান করেছেন এবং পৃথিবী তা মেনে নিয়েছে।”

১২। মরক্কোর ম্যারিনিদ রাজত্ব। উপক্রমনিকা ১৯ পৃঃ দ্রষ্টব্য।

১৩। “শ” বতে এখানে নিঃসন্দেহে ক্রিস্টানদের মনে করা হয়েছে-কিন্তু বাক্যটিতে কোননাক্রমেই কোনো সংঘবদ্ধ সামুদ্রিক যুদ্ধের উল্লেখ নেই। সে সময়ে একমাত্র খ্রীষ্টান রাষ্ট্র। ছিল সিসিলি যার সঙ্গে তিউনিসের ভালো সম্পর্ক ছিল না। এর য়্যাড়মিড়াল রোজার ডোরিয়া। ১২৮৯ খ্রীস্টাব্দের দিকে জেরবা অধিকার করেছিলেন। ১৩৩৫ সালে অন্যান্য দ্বীপসহ মুসলিমগণ এ স্থানটি পূর্ণ দখল করেন এবং পরবর্তী যুগে সিসিলিয়ানগণ কর্তৃক দ্বীপটি অধিকারের জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চলেছিল। এটা খুব সম্ভব যে জাহাজটি খ্রীষ্টান জলদস্যুদের হাতে পড়েছিল সে সব শতাব্দীতে (মাস ল্যট্রির মতে) এদের অত্যাচার বারবারি জলদস্যুদের অপেক্ষা ছিল বেশী ভয়ঙ্কর। (Relations of I Afrique septentrlonale, ১০৪-৭ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।

১৪। মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক যে সব গ্রন্থ আমি পড়েছি তাতে কোথাও বুলিয়ানা চোখে পড়েনি। আমার মনে হয় স্থানটি হচ্ছে নেবায়েল, একটি ছোটো বন্দর, তিউনিস্ থেকে তিরিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। ইদ্রিসির মত অনুসারে সেখানে একটি দূর্গ ছিল।

১৫। পোতাশ্রয়ের বর্ণনা থেকে নিশ্চিতরূপে বোঝা যায় যে এটা সে সময়ে আরাগনের অধীন ছিল। ক্যাটালান জাহাজ সমূহের প্রাকৃতিক আশ্রয় স্থান। রিজা পর্টোল্যানে একে বর্ণনা করা হয়েছে “bon porto fato per forza of palangade রূপে। ইনে। বতুতা সে ভয় পেয়েছিলেন সেটা ব্যক্ত করা হয়েছে এর ডাকাত প্রকৃতির অধিবাসীদের ক্রিয়াকার্য। cento (Les faubourgs de Cagliari servaient de repaire aux forbans মাস ল্যাট্রি, ৪০৫)।

১৬। আল-ওবাদ গ্রামটিকে সিদি বু মাদিনে নামক তীর্থস্থানের নাম অনুসারে সাধারণতঃ সিদি বু মাদিন বলা হয়–টিলেমসেন থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত। মজিদটি নির্মিত হয়েছে। ১৩৩৯ খ্রীস্টাব্দে। আলজেরিয়ায় মুরিস স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন।

১৭। আজঘাঘা (লিও আফ্রিকানাসের অজাগান) ছিল এক বার্বার উপজাতি। এরা বাস করতো মেলিলা এবং মুলুয়া নদীর মাঝখানের উপকুলের নিকটবর্তী স্থলে।

১৮। উক্তিটি ভৌগলিক ওসারি সমর্থন করেছেন। তিনি বলছেন সোনার মিসূকালে। (=দিনারের সমান) রয়েছে ১২০ দিরহাম, ষাটটি পুরা দিরহামের সমান এবং তিনটি পুরা দিরহাম মিশর এবং সিরিয়ার একটি দিরহামের সমান। তিনি বছেন দিরহাম শব্দটি কোনো বিশেষত্ব ছাড়াই ব্যবহৃত হতো-এর অর্থ হচ্ছে “ক্ষুদ্র দিরহাম।” ম্যারিনিদের বৃহৎ সোনার দিরহামের ওজন ৮৭ গ্রেন, মূল্য ১৪:৫° ফ্রাঙ্ক; আমরাভিডের ক্ষুদ্র দিনারের ওজন ৬৫ গ্রেন, মূল্য ১০:৯৩ ফ্রাঙ্ক। ইব্‌নে বতুতা ভারতীয় সোনার মোহর তংঘার উল্লেখ করেছেন, এর ওজন ১৭৫ শ্রেন, মূল্য আড়াই মরক্কান ডিনার-বৃহৎ দিনার অপেক্ষা ছোট দিনারের ব্যাপারেই এটা অধিক প্রযোজ্য। ১২০ মূল্যের ক্ষুদ্র দিনার ম্যারিনিদের সোনার দিনারের তুলনায় ১২ সেন্টাইম মূল্যের। এর অর্থ যদি আমরাভিদ দিনার মনে করা হয়ে থাকে তবে এর মূল্য হবে ১০ সেটাইম। মিশরের নুক্ৰা বা দিরহামের উচ্চতম মূল্য ৭৫ সেন্টাইমের কাছাকাছি এবং সাধারণতঃ এর মূল্য ধরা হয় ৫০ এবং ৬০ সেন্টাইমের মাঝামাঝি (ইউলের ক্যাথে’ ৪র্থ খণ্ড, 08 ff.; antara, Le Maroc dans les premieres annees du xVle siecle (আলজার, ১৯০৬) ১০১-২; আল ‘ওমারি’ মাসালিক আল-আবসার অনুবাদ মেমবিন্স (প্যারিস ১৯২৭), ১ম খণ্ড, ১৭৩ দ্রষ্টব্য)।

১৯। বাক্যটি হচ্ছে পুনরায় সলেমনের পূর্ব স্মৃতি। ১ম পরিচ্ছেদ টীকা ২৮ দ্রষ্টব্য।

২০। আমি এটা নিচ্ছি মিশরের সাধারণ মুনুখিয়ার (Corchorus olitorius) সম্পর্কে।

২১। এখানে ইমামতের অর্থ হচ্ছে খিলাফত। ইব্‌নে বতুতা মনে করেন যে মরক্কোর শাসকগণ বিশেষভাবে আবু ইনান কর্তৃক খলিফা বা মুসলিমগণের নেতা পদবী গ্রহণ করায় পশ্চিম দেশের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণেই কয়েক ছত্র পিছে দেন সিংহাসনের পদবী আল্-মুতাওয়াকিল। এ পদবী সুলতান গ্রহণ করেছিলেন বাগদাদের খলিফাগণের অনুকরণে। সে সময়ে কোনো সর্বজনসম্মত খলিফা ছিলেন না। কায়রোর নামমাত্র খলিফাগণকে পশ্চিম অঞ্চলের কেউ স্বীকার করতেন না। বর্তমান কাল অবধি মরোক্কোর সুলতানগণ এই পদবী রক্ষা করে চলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *