১২. সুভদ্রা
ছোটবেলায় যেমনটি পড়েছি, যেমনটি ভেবেছি সবই এখন উলটো হয়ে গেছে। তখন কত হবে– এই বারো-তেরো বছর বয়স। কৈশোরগন্ধী সেই বয়সে যখন অর্জুনের সুভদ্রাহরণ। পড়তাম কাশীরাম দাসের পয়ারে, তখন নিজেকে অন্য এক পৃথক জগতের অধিবাসী মনে হত। সে এক অদ্ভুত বীরের জগৎ। নিজের বোন সুভদ্রাকে নিয়ে পালাবার জন্য কৃষ্ণ নিজের রথখানি সারথি সহ ছেড়ে দিয়েছেন অর্জুনকে। কৃষ্ণের সারথি দারুক সবেগে রথ নিয়ে পালাচ্ছেন। পিছনে বলরামের প্ররোচনায় সমস্ত যদুবীরেরা অর্জুনের পিছনে ধাওয়া করেছেন তাকে ধরে আনবার জন্য। সুভদ্রাকে অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিতে সম্মত নন বলরাম, তার পছন্দের পাত্র হলেন ধার্তরাষ্ট্র দুর্যোধন। যাই হোক, বাঘা-বাঘা যদুবীরেরা যখন অর্জুনকে যুদ্ধাহ্বান জানাচ্ছেন এবং সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহাবীর অর্জুন যখন রথ ঘোরাতে বলছেন, তখন সারথি দারুক রথ চালাতে অস্বীকার করে বসলেন। তার বক্তব্য ছিল– স্বর্গের ইন্দ্রভবনে তুমি পালাতে চাও, তো বল, আমি সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। কিন্তু কৃষ্ণের এই রথে চড়ে তুমি কৃষ্ণেরই ছেলেদের ওপর বাণ-নিক্ষেপ করবে, সে আমি পারব না- মম শক্তি নহিবে তুরগ চালাইতে।
মহাবীর পাণ্ডব-ধুরন্ধর অর্জুন এ যুক্তি মানতে পারেন না। তিনি বললেন– আমাকে পেছন থেকে যুদ্ধে ডাকছে, আর সেই যুদ্ধাহ্বান শুনেও আমি পালাব? এই যুদ্ধে কৃষ্ণের ছেলে কেন, স্বয়ং কৃষ্ণও যদি আসেন, যদি আসেন ভীম-যুধিষ্ঠির, তবুও আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। এই আমার ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। আমি বুঝতে পারছি–এই ভীষণ যুদ্ধে কৃষ্ণপুত্রদের প্রতি মমতায় তুমি আমার যুদ্ধ পণ্ড করবে। তার চেয়ে ছাড়ো তোমার ঘোড়ার লাগাম ফেলহ প্রবোধবাড়ি ছাড় কড়িয়ালি। শুধু কথা বলেই ক্ষান্ত হলেন না অর্জুন। তিনি দারুককে পাশ-অস্ত্রে বেঁধে রথস্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে রাখলেন। তারপর ‘এক পদে কড়িয়ালি আর পদে বাড়ি। ধনুগুণ টঙ্কারি রহিলেন বাহুড়ি। অর্জুন যেভাবে পায়ে ঘোড়া চালিয়ে হাতে ধনুর্বাণ নিয়ে সম্মুখে ফিরলেন, তাতে আজকের হিন্দি ফিল্মের নায়করাও সংকুচিত বোধ করবেন।
কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। অর্জুনকে এইভাবে কষ্টকর অবস্থায় যুদ্ধ করতে দেখে রথস্থিতা সুভদ্রা, যিনি অর্জুনের প্রতি মুগ্ধতায় আপনিই তার প্রেমে ধরা দিয়ে ভাইবন্ধু ছেড়ে অর্জুনের সঙ্গে পালিয়ে যাবার জন্য রথে উঠেছেন, সেই সুভদ্রা সদ্যপরিচিত অর্জুনকে বললেন–
মহাবীর এত কষ্ট কেনে?
আজ্ঞা কর আমারে চালাই অশ্বগণে ॥…
আজ্ঞা কর রথ চালাইব কোন পথে?
এত বলি কড়িয়ালি বাড়ি নিল হাতে ৷৷
চালাইয়া দিল রথ বায়ুবেগে চলে।
না দেখিতে গেল রথ আদিত্যমণ্ডলে ৷
লক্ষণীয়, এই যুদ্ধ অর্জুন জিতেছিলেন এবং কাশীরামের ছন্দোবন্ধে এই যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্ব অর্জুনের যত ছিল, তার থেকে সুভদ্রার কম ছিল না। যুদ্ধে হারার পর যাদব-বৃষ্ণিদের দূত বলরামের কাছে এসেছিল এবং সে–
ঊর্ধ্বশ্বাসে কহে বার্তা কান্দিতে কান্দিতে।
আর রক্ষা নাহি প্রভু অর্জুনের হাতে ॥
সুভদ্রা চালায় রথ না পারি দেখিতে।
কখন আকাশে উঠে কখন ভূমিতে ॥
ছোটবেলায় সেই কৈশোরগন্ধী বয়সে অর্জুনের এই নবপ্রণয়িনী বধূটি যে বীররমণীর সংবাদ দিয়েছিল মনে, তার রেশ আমি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ব্যাসদেবের মূল মহাভারতে সুভদ্রার বিবরণ অনেক মন দিয়ে পড়েছি, কিন্তু বাঙালি কাশীরাম সেই বালকের মনে সুভদ্রার সম্বন্ধে যে বীরভাব সংক্রমিত করেছিলেন, তাতে এখনও মনে হয় এই সুভদ্রা খণ্ডে কাশীরাম ব্যাসদেবকে একেবারে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। যে রমণী দু’দিন আগে যদুবৃষ্ণিদের স্নেহবশীভূতা ছিলেন, তিনি অর্জুনের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ভাবী স্বামীকে সাহায্য করছেন– রমণীর এই বীরচরিত্র আমাকে এখনও অভিভূত করে।
সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাসের মহাকাব্যে সুভদ্রার চরিত্রগতি এত বিচিত্র নাটকীয়তায় ধরা পড়েনি, তবু বাঙালি কাশীরামের আলম্বন যেহেতু ব্যাসই, তাই ব্যাসের সুভদ্রার মধ্যে এই বীরস্বভাবের বীজ নিহিত ছিল নিশ্চয়ই এবং সে বীজ সেইভাবে পত্রে-পুষ্পে বিকশিত হয়নি বলেই তিনি বেশ খানিকটা উপেক্ষিতা বলে মনে হয়। মহাকাব্যের কবির দৃষ্টিতে এই উপেক্ষার কারণও হয়তো ছিল।
সুভদ্রার বংশ-পরিচয় একটা বিরাট কিছু নয়। কোনও মতে তিনি বসুদেবের অন্যতম পত্নী রোহিণীর মেয়ে। এই সূত্রে তিনি বলরামের সাক্ষাৎ সহোদরা ভগিনী। অন্য একটি মতে তিনি কৃষ্ণের বৈমাত্রেয় ভাই সারণের ভগিনী। অবশ্য সুভদ্রা বলরামেরই সহোদরা ভগিনী হোন অথবা সারণের ভগিনীই হোন, কৃষ্ণ তাকে সহোদরা ভগিনীর চেয়েও বেশি ভালবাসতেন এবং সেই ভালবাসার প্রমাণও তিনি দিয়েছেন অনেকভাবে।
সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের যোগাযোগ যেভাবে ঘটেছিল, তা আধুনিক অনেক প্রণয়কাহিনিকেও হার মানাবে। কিন্তু সে কথায় যাবার আগে অর্জুনের মানসিক অবস্থাটুকু আমাদের একটু জেনে নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডবের বিবাহ হয়ে গেছে। অর্জুনই যেহেতু লক্ষ্য ভেদ করে দ্রৌপদীকে জিতেছিলেন, তাতে দ্রৌপদীর ওপরে তারই অধিকার সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ভাগ্যের অন্যথা-নিয়মেই হোক অথবা ঘটনার চক্রজালেই হোক দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর পত্নীত্ব লাভ করলেন। অর্জুনের সঙ্গে একান্ত যোগাযোগ তার হল না। কিংবা অৰ্জুনও এককভাবে পেলেন না দ্রৌপদীর অধিকার। এতে দুই পক্ষেরই কোনও মানসিক অবসাদ ঘটেছিল কিনা, মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে বলেননি। মহাকাব্যের অভিসন্ধিতে সে-কথা বলার প্রয়োজনও হয়তো বোধ করেননি তিনি। কিন্তু ঘটনা হল– দ্রৌপদী কিংবা অর্জুনের চরিত্র পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়– যা আমি অন্যত্র করেওছি– তাতে বোঝা যায় যে, অর্জুনকে একান্তভাবে পাবার জন্য দ্রৌপদীর অন্তর্দাহ কম ছিল না। অন্যদিকে অর্জুন যেহেতু উদারসত্ত্ব এক মহানায়ক, তাই পঞ্চস্বামীর অধিকারভুক্ত দ্রৌপদীর অধিকার থেকে নিজেকে সব সময় সরিয়ে রেখেছেন নায়কোচিত উদারতায়। কিন্তু তাই বলে দ্রৌপদীর জন্য তার হৃদয় কখনও বিদীর্ণ হত না, একথা ভাবার কোনও কারণ নেই।
বিশেষত দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের বিবাহের পরপরই যে দুর্ঘটনা ঘটল, তাতে অর্জুনের দিক থেকে একটা মানসিক বিক্রিয়া হওয়ার কারণ অবশ্যই ছিল। ইংরেজিতে এই বিক্রিয়ার খুব ভাল একটা প্রতিশব্দ আছে– ‘ফ্রাষ্ট্রেশন।
কিন্তু অমন যে ধীর-স্থির, উদাত্ত-গম্ভীর তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, তার জীবনের প্রথম ভাগেই এমন যে একটা ‘ফ্রাষ্ট্রেশন’ আসবে, তা কে জানত। স্বয়ংবর-সভায় আপন বীর্যে দ্রৌপদীকে লাভ করার পরেও নায়কোচিত উদারতায় দ্রৌপদীর অংশ-স্বামিত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। নারদ মুনির সামনে পাঁচ ভাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যেন দ্রৌপদীর কারণে ভাইদের মধ্যে ভেদসৃষ্টি না হয়। তারা সময় ঠিক করে নিয়েছিলেন– ভাইদের মধ্যে যিনি যখন দ্রৌপদীর অধিকার পাবেন, তখন যদি অন্যজন নির্জন অনুরক্তির মধ্যে অধিকারী ভাইকে একবার দেখেও ফেলেন, তবে বারো বছরের জন্য তাকে বনে যেতে হবে। আর ঘটল কি ঘটল, অর্জুনের ভাগ্যেই সেটা ঘটল। কী স্বল্পই না ছিল সেই কারণ– এক ব্রাহ্মণের গোরু খুঁজতে গিয়ে অস্ত্রাগারে বসা যুধিষ্ঠির এবং দ্ৰৌপদীকে দেখে ফেললেন অর্জুন এবং তাকে বনে যেতে হল। যুধিষ্ঠির তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তবু বীর অর্জুন, ক্ষত্রিয় বীর অর্জুন শুধু দ্রৌপদীর ক্রমিক সঙ্গলাভের জন্য তার বীরোচিত সত্যরক্ষার দায় থেকে মুক্ত হতে চাননি। তিনি বনবাসে গেছেন এবং ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বনে গেছেন।
ঠিক এইজন্য ‘ফ্রাস্ট্রেশন’ কথাটা ব্যবহার করেছিলাম। অর্জুন বনবাসের প্রতিজ্ঞা থেকে চ্যুত হননি বটে, কিন্তু খুব সঙ্গত কারণেই ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞাটুকু রাখতে পারেননি। স্বয়ংবর সভায় আপন বীর্যলব্ধা যে বিদগ্ধা রমণীটিকে তিনি একান্ত আপনার করে পেয়েছিলেন, তাকে যেভাবে প্রতিজ্ঞার ফেরে হারিয়ে বসতে হল, তাতে বহিরঙ্গের ক্ষাত্র কাঠিন্যের সহচারী প্রতিজ্ঞাটুকু রইল বটে, তবে অন্তরের গভীরে সেই বৈমনস্য, সেই অন্তহীন নৈরাশ্য একটা কাজ করতেই থাকল। হয়তো বা এই নৈরাশ্য থেকেই অর্জুন পরপর কয়েকটি রমণীর প্রেমপাশে বদ্ধ হলেন। উলূপী এবং মণিপুর রাজনন্দিনী চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে একভাবে বিয়েও হল তার, কিন্তু স্থায়ীভাবে এঁদের সঙ্গে থাকা হল না। মনে মনে সেই প্রতিজ্ঞাটাও কাজ করছিল– তিনি বনবাসে এসেছেন, অতএব তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াবেন। তেমনি করে ঘুরতে ঘুরতেই এবার তিনি উপস্থিত হলেন প্রভাস তীর্থে।
প্রভাস বড় সুন্দর জায়গা, পুণ্যস্থানও বটে। সৌরাষ্ট্রের এই জায়গাটিতে পুণ্যতোয়া সরস্বতী সমুদ্রে এসে মিশেছে, অতএব পুণ্যস্থান তো বটেই সুপুণ্যং রমণীয়ঞ্চ। তবে যতখানি এটা পুণ্যস্থান, তার থেকেও বুঝি রমণীয়। পরবর্তী সময়ে এইখানেই তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত সোমনাথের মন্দির, যা বারবার লুণ্ঠন করেছিলেন গজনীর সুলতান মামুদ। প্রভাস দ্বারকা থেকে খুব দূরে নয় বলেই দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ খুব তাড়াতাড়ি খবর পেয়ে গেলেন যে, তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু এবং ভাই অর্জুন এসেছেন প্রভাসে। কৃষ্ণ জানতেন না যে, অর্জুন প্রতিজ্ঞার কারণে বনবাসে এসেছেন, তাই ভাবলেন– অর্জুনকে একেবারে তুলে নিয়ে আসবেন দ্বারকায়।
কৃষ্ণ প্রভাসে চলে এলেন অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে এবং হঠাৎ বিনা কারণে কোনও খবর না দিয়ে দ্বারকার এত কাছে এই প্রভাস তীর্থেই অর্জুন ঘোরাঘুরি করছেন কেন–এ-সব কথা জিজ্ঞাসা করতেই সব কথা খুলে বললেন অর্জুন, এমনকী হয়তো উলূপী-চিত্রাঙ্গদার কথাও– ততোহজুনো যথাবৃত্তং সর্বমাখ্যাতবাংস্তদা। অর্জুনের মানসিক অবস্থা দেখে কৃষ্ণ তাকে বেশি ঘাঁটালেন না, বরঞ্চ তিনিও অর্জুনের ভাবেই অর্জুনের সঙ্গে প্রভাসেই ঘোরাঘুরি করলেন কিছুদিন। তারপর একদিন বললেন– তুমি এবার রৈবতক পর্বতে আস্তানা নাও কিছুদিন, দ্বারকা থেকে জায়গাটা একেবারেই কাছে, তোমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎটা আরও ঘন-ঘন হবে। অর্জুন স্বীকার করতেই রৈবতক পাহাড়ের অস্থায়ী আবাস ভাল করে সাজিয়ে দিল কৃষ্ণের লোকেরা। খাবার-দাবারও চলে এল কৃষ্ণের পছন্দমতো। প্রচুর গল্প করতে করতে, প্রচুর খেতে খেতে, এমনকী রৈবতক পর্বতের শৈলাবাসে সন্ধ্যার আমোদে প্রচুর নাচ-গান উপভোগ করতে করতে পুরো দিন-রাত কেটে গেল অর্জুনের।
প্রভাস থেকে রৈবতকে অর্জুনকে টেনে আনলেন কৃষ্ণ, এবার দ্বিতীয় টানে এক্কেবারে দ্বারকায়। আসলে বড় অল্প কারণে বনবাস আর তীর্থযাত্রার পরিশ্রমে তখন হাঁপিয়ে উঠেছেন অর্জুন। পরম বন্ধু কৃষ্ণের আদর-অভ্যর্থনা অবহেলা করে বনবাসে দিন কাটানোর মানসিকতা প্রায় চলেই গেছে। কাজেই কৃষ্ণ যখন দ্বারকা যাবার প্রস্তুতি নিয়ে তার সোনা বাঁধানো রথখানি নিয়ে এলেন, তখন অর্জুন আর না বলতে পারলেন না। দ্বারকায় এসে কত আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা হল, রাস্তায় লোক জমে উঠল– এক রথে কৃষ্ণ এবং অর্জুন আসছেন– এই দৃশ্য দেখার জন্য। কৃষ্ণের বন্ধু তিনি, দ্বারকার রয়্যাল গেস্ট। তার সম্মানে সুসজ্জিত করা হয়েছিল দ্বারকা নগরী। ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধক-কৃষ্ণের জ্ঞাতিগুষ্টি যে নামে চিহ্নিত তারা সবাই অর্জুনকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করল।
অভিবাদন, আলিঙ্গন, অভ্যাগমনের পরে অর্জুনের জায়গা হল কৃষ্ণেরই ঘরে। দুই বন্ধুতে গল্পে-গল্পে, আমোদে-আহ্লাদে বেশ কিছুদিন দ্বারকায় থাকা হয়ে গেল অর্জুনের উবাস সহ কৃষ্ণেন বহুলাস্ত শর্বরীঃ।
কৃষ্ণ এবং অর্জুন দ্বারকায় থাকলেও ভবিষ্যৎ-ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল রৈবতক পর্বতই। এখনকার দিনে গিরনারের উলটো দিকে জুনাগড়ে রৈবতক পর্বতের আধুনিক অবস্থান চিহ্নিত হলেও মহাভারত-পুরাণের মতে প্রভাস তীর্থের কাছেই উদবন্ত পর্বতের পশ্চিম দিকটায় রৈবতক পর্বতের অবস্থান এবং এই পর্বতের ‘ল্যান্ডমার্ক’ হল সোমনাথ। উত্তম শৈলাবাস, উত্তম পরিবেশ, দ্বারকাবাসীরা তাদের বাৎসরিক উৎসব পালন করেন এই পর্বতেই। অর্জুন দ্বারকায় থাকতে থাকতেই সেই উৎসবের সময় এসে গেল এবং দ্বারকাবাসী বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজকুলের প্রধান-পুরুষেরা পাহাড়ে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। দ্বারকায় এই সময়টা খুব ভাল সময়। উৎসব উপলক্ষে পাহাড়ে নতুন অস্থায়ী আবাস গড়ে উঠল; সেগুলি সাজানো হল চিত্রবিচিত্র উপকরণে। দেখলেই উৎসবের পরিবেশ মনে আসে। বাজনদারেরা বাদ্যি নিয়ে গেল, নাচিয়েরা নাচের মহড়া দিতে আরম্ভ করল, গাইয়েরা গানের গলা খুলে দিল উৎসবের আমেজে–নতুনর্তকাশ্চৈব জগুর্গেয়ানি গায়নাঃ। উৎসব উপলক্ষে দ্বারকার সমস্ত লোকজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ রথে, কেউ বা সুবর্ণমণ্ডিত যানে রৈবতকে চলে এসেছেন। যদু বৃষ্ণিদের মেয়ে-বউরাও এসেছেন সালঙ্কারে, হাবে, ভাবে, লাস্যে।
নির্দিষ্ট দিনে ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধকদের কুমার-পুরুষেরা উৎসবের সাজে সেজে রৈবতকে প্রবেশ করলেন। এলেন বলরাম অনুগম্যমানা রেবতাঁকে সঙ্গে নিয়ে, উৎসবের আনন্দে তার কাদম্বরী-সেবনের মাত্রা বেড়েছে।– ততো হলধরো ক্ষীবো রেবতীসহিতঃ প্রভু। তার পিছন পিছন গন্ধর্ব-গায়েনদের একটি পৃথক দল গান গাইতে-গাইতে চলেছে। এলেন মহারাজ উগ্রসেন। বহুতর স্ত্রীলোক এবং গন্ধর্বসহযোগে তার যাত্রাপথ যথেষ্টই বর্ণাঢ্য। বৃষ্ণিকুমারদের মধ্যে রৌক্মণেয় শাম্বের সঙ্গে প্রধানপুরুষ অক্রূর, সারণ, গদ, চারুদেষ্ণ, সাত্যকি, উদ্ধব– বলা উচিত কে না এলেন রৈবতকের উৎসবে। এইসব রাজপুরুষদের স্ত্রীরা তো এলেনই এবং সবার শেষে এলেন বাসুদেব কৃষ্ণ এবং অর্জুন। উৎসব আরম্ভ হয়ে গেছে, অর্জুন কৃষ্ণের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে-ঘুরে দ্বারকাবাসীদের বিচিত্র উৎসব কৌতুক দেখছেন। এরই মধ্যে হঠাৎই এক অসাধারণ সুন্দরী রমণীর ওপর চোখ পড়ে গেল অর্জুনের। সকলের মতো এই রমণীও উৎসবের সাজে সেজেছে, বিশেষত রৈবতকের উৎসবে সকলের চলাফেরা অত্যন্ত মুক্ত হওয়ায় এই রমণীও আপন বান্ধবীদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
অর্জুন তাকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়লেন, শুধু প্রেম বললে মিথ্যে বলা হবে এই রমণীর শারীরিক সৌন্দর্যের আকর্ষণ এতটাই ছিল যে, সুচিরকাল স্ত্রীসঙ্গবর্জিত অর্জুন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
তার ব্রহ্মচর্যের নিয়ম-নীতি মাথায় উঠল। যে বন্ধুর সঙ্গে এতক্ষণ তিনি ঘুরছিলেন সেই কৃষ্ণকে একবারও খেয়াল না করে তিনি তাকিয়ে থাকলেন সুভদ্রার দিকে হাঁ করে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল– এ কোনও বিপন্ন ভালবাসা নয়, চর্চিত-উপলব্ধিজাত কোনও প্রেম নয়– সুভদ্রার আঙ্গিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই অর্জুন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন সুভদ্রার দিকে। বৃষ্ণি-অন্ধকদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কুলজাতা, কন্যার প্রতি অভিন্নহৃদয় বন্ধুর এই সবিকার দৃষ্টিপাত অস্বস্তির কারণ হতে পারে ভেবেই অর্জুনের চটকা ভেঙে দিয়ে কৃষ্ণ বললেন- বনবাসীর মন যে একেবারে কামনায় আলোড়িত হচ্ছে- বনেচরস্য কিমিদং কামেনালোভ্যতে মনঃ?
ইনিই সুভদ্রা। আদর করে অনেকেই তাকে ভদ্রা বলে ডাকে। ইনি কৃষ্ণের আপন বোন নন। বটে, কিন্তু অগ্রজ বলরামের আপন বোন। আসলে কৃষ্ণপিতা বসুদেবের আরও অনেকগুলি স্ত্রী ছিল। তার মধ্যে রোহিণী ছিলেন অন্যতম। কংসের অত্যাচারের সময় রোহিণী বৃন্দাবনে নন্দগোপের আশ্রয়ে ছিলেন এবং বলরাম সেখানেই জন্মান। কিন্তু বৃন্দাবনের যত ঘটনাবলি বিখ্যাত পুরাণগুলিতে বলা আছে, তার কোনও অংশেই আমরা সুভদ্রার উল্লেখ পাইনি। তার জন্মনক্ষত্র, বাল্যজীবন কিছুই আমাদের জানা নেই এবং আমাদের ধারণা- সুভদ্রার বাল্য-কৈশোর বৃন্দাবনে কেটে থাকলে কৃষ্ণের বিচিত্র লীলাময় জীবনের সঙ্গে তারও কিছু আমরা পেতাম। তাতেই মনে হয়, কংস মারা যাবার পর বসুদেবের সম্পূর্ণ পরিবার বৃন্দাবন থেকে মথুরায় চলে আসার পর সুভদ্রার জন্ম হয়। বসুদেবের স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে যে সব পুত্র জন্মেছিলেন, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ যেমন বলরাম, তেমনই অন্যান্য ভাইদের মধ্যে সরণ বা সারণও ছিলেন মোটামুটি বিখ্যাত। মহাভারতে সুভদ্রাকে ‘সারণস্য সহোদরা’ অর্থাৎ সারণের মায়ের পেটের বোন বলায় বুঝতে পারি তিনি বলরামেরও আপন বোন ছিলেন। হরিবংশে সুভদ্রার জন্ম-নাম ছিল চিত্রা, পরে তিনি সুভদ্রা নামে বিখ্যাত হন– চিত্রা সুভদ্ৰেতি পুনর্বিখ্যাতা কুরুনন্দন।
দাদা বলরাম যেমন গৌরবর্ণ ছিলেন, সুভদ্রার গায়ের রংও তেমনই কাঁচা সোনার মতো। আর সুভদ্রা তেমনই সুন্দরী, তেমনই কোমল-মধুর তার স্বভাব যার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে পারা যায় না। অর্জুন তাই অনিমিষে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। সুভদ্রার রূপ দ্রৌপদীর মতো আগুনপানা নয়, দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব সম্ভম এমনই যে, তার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কিন্তু সুভদ্রার সৌন্দর্য্যের উজ্জ্বল দীপ্তি আছে, তাপ নেই। অর্জুন অনিমিষে তাকিয়ে ছিলেন, পাশে যে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন, তাও তার খেয়াল নেই। অর্জুনের অপলক চেয়ে দেখাটুকু পরম কৌতূহল নিয়ে লক্ষ করছিলেন কৃষ্ণ- তং তদেকাগ্ৰমনসং কৃষ্ণ পার্থমলক্ষয়ৎ। অস্ত্রশিক্ষার আসরে যিনি পাখির চোখ ছাড়া কিছু দেখতে পাননি, তাকে একইভাবে সুভদ্রার দিকে তাকাতে দেখে কৌতুকী কৃষ্ণের মুখে স্তিমিত হাসি ফুটে উঠল।
কৃষ্ণ বললেন– ব্যাপারটা কী বলো তো সখা? তুমি নাকি ব্রহ্মচর্যের পণ নিয়ে বনবাসী হয়েছ! কিন্তু বনবাসীর বিরাগী মন যে এমন কামনায় আলোড়িত হচ্ছে সেটা কি ভাল কথা হল– বনেচরস্য কিমিদং কামেলোড্যতে মনঃ। এই এতটুকু পরিহাস করার পরেই কৃষ্ণ বুঝলেন যে, তাঁর ভাবে আকুল বন্ধুটিকে এই বৃষ্ণি সুন্দরীর পরিচয় জানানো দরকার এবং যদি এই রমণীকে লাভের ব্যাপারে অর্জুনের কোনও দুর্ভাবনা থাকে, তবে তাকে আশ্বস্তও করা দরকার। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন– যাকে দেখে তোমার এত ভাল লাগছে, সে আমারই বোন। পার্থ! আমার মায়ের পেটের বোন না হলেও আমার বৈমাত্রেয় ভাই সারণের বোন- মমৈষা ভগিনী পার্থ সারণস্য সহোদরা। বলতে পারো আমার বড় মায়ের মেয়ে এই সুভদ্রা, আমার পিতা তার এই মেয়েটিকে প্রাণের অধিক ভালবাসেন। ওর নাম সুভদ্রা। আমার বোনটিকে যদি সত্যিই তোমার খুব ভাল লেগে থাকে– অন্তত আমার মনে হচ্ছে, তোমার ভাল লাগছে, তা হলে বলো আমি নিজেই পিতাকে এ-ব্যাপারে বলব– যদি তে বৰ্ততে বুদ্ধির্বক্ষ্যামি পিতরং স্বয়ম। আমি চাই তোমার ভাল হোক।
অর্জুন বললেন– যে রমণী স্বয়ং বসুদেবের কন্যা এবং যিনি কৃষ্ণ বাসুদেবের ভগিনী, অপিচ যার এই রূপ, তাকে দেখেও ভুলবে না এমন লোক আছে নাকি এই দুনিয়ায়– রূপেণ চৈব সম্পন্না কমিবৈযান মোহয়েৎ! অর্জুনের এই কথাটা কৃষ্ণের সেই পরিহাসের উত্তর– অর্থাৎ বনবাসী কেন, সকলেই ভুলবে তোমার এই বোনটিকে দেখে। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন– যাক ভালই হল। আমি এখন শুধু ভাবছি– তোমার এই ভগিনীটির সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারে কীভাবে? যে কোনও একটা উপায়ের কথা বলো কৃষ্ণ– যদি মানুষ তা পারে, তবে জেনো– আমি তা করে দেখাব আস্থাস্যামি তদা সর্বং যদি শক্যং নরেণ তৎ।
কৃষ্ণ অনেক চিন্তার ভাব দেখিয়ে বললেন- দেখ ভাই, ক্ষত্রিয় পুরুষেরা স্বয়ংবর-সভায় গিয়ে বিয়ে করেন, স্বয়ংবর সিদ্ধ না হলে জোরও খাটান অনেক সময়। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে এই স্বয়ংবর ব্যাপারটা আমাকে খুব নিশ্চয়তা দেয় না, নিশ্চিন্ততাও দেয় না। মেয়েদের মন তো জান; স্বয়ংবর-সভায় তোমার মতো আরও পাঁচ জন পুরুষ আসবেন সুভদ্রার পাণিপ্রার্থী হয়ে এবং সেখানে সবটাই নির্ভর করবে ওই সুভদ্রার ওপর। সুভদ্রা যদি হঠাৎ কোনও আকস্মিক মোহে অন্য কোনও পুরুষকে বরণ করে বসে, সেখানে তোমার-আমার কারওরই কিছু করার থাকবে না। তাই বলছিলাম- ব্যাপারটার মধ্যে সন্দেহ থেকে যায়, স্ত্রীলোকের মন তো– স চ সংশয়িতঃ পার্থ স্বভাবস্যানিমিত্ততঃ।
কৃষ্ণের এই কথা থেকে বোঝা যায়–অর্জুন সুভদ্রাকে দেখা মাত্র তার প্রেমে পড়ে গেলেও সুভদ্রা এখনও অর্জুনকে ভাল করে দেখেননি, কিংবা দেখলেও তিনি তেমন আলোড়িত হননি, অন্তত তখনও পর্যন্ত। আরও জিজ্ঞাসা হয়– কৃষ্ণের মনে কি কোনও সন্দেহ ছিল? কী নিয়ে সন্দেহ? অর্জুনের গায়ের রং কালো, সেইজন্য! অর্জুন পূর্বেই বিবাহিত, সেইজন্য? বলতে পারি– এর কোনওটাই নয়। তা হলে কৃষ্ণের সন্দেহটা আসলে সন্দেহ যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি হল– অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিবাহের ব্যাপারে নিচ্ছিদ্রভাবে নিশ্চিন্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। ঠিক সেই ধারণা মাথায় রেখেই কৃষ্ণ বললেন– বিয়ের জন্য বীর ক্ষত্রিয়েরা তো কন্যাহরণও করে থাকেন, অর্জুন! তা হলে সেই পথটাই তো সবচেয়ে নিশ্চিত। তুমি জোর করে আমার বোনটিকে হরণ করে নিয়ে যাও, অর্জুন। তারপর যা হয় দেখা যাবে।
বাঙালির কাশীরাম দাসে ঘটনাপ্রবাহ একেবারে উলটো আছে। সেখানে অর্জুন নয়, সুভদ্রাই অর্জুনের প্রেমে পড়েছেন এবং সেই প্রেম ঘটিয়ে দেবার জন্য কৃষ্ণপত্নী সত্যভামাকে একেবারে স্নেহময়ী বাঙালি বউদির ভূমিকায় নামতে হয়েছে। বলতে পারেন– কাশীরামের কথা এখানে আসছে কেন? ব্যাস যেভাবে সুভদ্রাকে দেখছেন, সেটাই তো যথেষ্ট। আমরা বলব– ‘মিথ’ মানেই তো এক নির্জন সত্য, এখানে সাহিত্যসৃষ্টি বা জীবনবোধ কোনও একগুঁয়ে শাস্ত্র মেনে চলে না। অতএব কাশীরাম যেভাবে দেখছেন, তার মধ্যেও এক অন্যতর সত্য আছে, যা হলেও হতে পারত। আসলে বাঙালি কবির মনে কাজ করেছে। মহাবীর অর্জুনের ছবি। এমনই তার বীরত্বের মর্যাদা, এমনই তার সর্বময় ব্যক্তিত্ব যে, অর্জুনকে চাক্ষুষ দেখার পর থেকে তিনি আর অন্যদিকে মন দিতে পারছেন না। কৃষ্ণভামিনী সত্যভামা এখানে রক্ষাকর্তা বউদির ভূমিকায়, কিন্তু তিনিও সুভদ্রার নির্লজ্জ আচরণ যেন মেনে নিতে পারছেন না। বেশ একটু তিরস্কার করেই তিনি সুভদ্রাকে বলছেন– ভদ্রা! খাইলি কি লাজ? রাখিলি কলঙ্ক নিষ্কলঙ্ক কুল মাঝ ॥ মনে রেখো, তোমার পিতা বসুদেব, আর ভাই বলরাম এবং কৃষ্ণ। এই বংশের মেয়ে হয়ে একটা পুরুষ দেখে তোমার মন ভুলেছে, এটা কেমন কথা? সত্যভামা মায়ের সমান বয়স্কা বউদিদির মতো করে সুভদ্রাকে বললেন আমাদের ঘরে কি অবিবাহিতা আর কোনও মেয়ে নেই? কই তাদের কেউ তো পরপুরুষ দেখে এমন ব্যবহার করছে না। সত্যভামা ননদকে আরও ভাল উত্তম বংশজ বলিষ্ঠ পণ্ডিত জনের সঙ্গে বিয়ে দেবার আশ্বাস দিলেন। কিন্তু সুভদ্রার সেই এক কথা। অর্জুনকেই তিনি স্বামী হিসেবে চান এবং আজকের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা তাকে করতে হবে।
যতই নিষ্ঠুর কথা বলুন সত্যভামা, ননদের ব্যাপারে তার মনটা খুব নরম, এমনকী একটা প্রচ্ছন্ন সায়ও আছে। একান্নবর্তী পরিবারে এমন একটা ঘটনা ঘটলে স্বামীর সঙ্গে একটা শলা-পরামর্শ করতেই হয় এবং সেই সময়টা হল রাত। রাত্রে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হতেই সত্যভামা ঠিক বাঙালি বউদির মতোই বললেন– তোমার বোনটির অবস্থা তো খুব খারাপ। যখন থেকে সে অর্জুনের মুখ দেখেছে, সে আমার কাছ ছাড়ছে না। এখন সে বলছে বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে। কৃষ্ণ সুযোগ বুঝে বললেন– এ তো বেশ ভাল কথা। বন্ধু অর্জুনকে আমি সত্যিই এই দানটুকু দিতে চাই। আজ রাতটা ধৈর্য ধরে থাকতে বলো। কাল সব কথা হবে। সত্যভামা বললেন– অত দেরি সইবে না। আজ রাতের মধ্যে তার সঙ্গে মিলন না ঘটালে তোমার বোন মরবে। কৃষ্ণ বেশ মধ্যযুগীয় পৌরুষেয়তায় জবাব দিলেন– এ ব্যাপারে তুমি যা করার করো। তবে দেখো, যাতে কোনও বিপদ না হয়। তখন রাত্রি আঁধার হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে সুভদ্রাকে পিছনে নিয়ে সত্যভামা অর্জুনের ঘুম ভাঙালেন।
কাশীরামের পরিবেশনায় এই কাহিনি বাঙালি-হৃদয়ের মর্ম থেকে এমন আবেগমধুর হয়ে উঠেছে যে, ব্যাসের মহাকাব্যিক তথা ক্ষাত্রবীর্যের অভিসন্ধিগুলি আপাতত একটু যেন পরুষ-কঠিন লাগে। অর্জুনের কাছে সুভদ্রার হয়ে দূতিয়ালি করতে গিয়ে পঞ্চস্বামীর অধিকারভুক্তা দ্রৌপদীর কথাটাও সত্যভামা এমনভাবে বলেছেন, তাতে বুঝতে পারি– আমরা যে ‘ফ্রাষ্ট্রেশনের কথা বলেছিলাম, অর্জুনের সেই ‘ফ্রাস্ট্রেশন’-টা কাশীরাম ঠিক বুঝেছিলেন– ব্যাস স্পষ্ট না বললেও। সুভদ্রার কথা অর্জুনের কাছে বলতে এসে সত্যভামা অর্জুনকে গালি দিয়ে বলেছিলেন–
পাঞ্চালের কন্যা জানে মহৌষধি গাছ।
এক তিল পঞ্চস্বামী নাহি ছাড়ে পাছ।
যে লোভে নারদবাক্য করিলা হেলন।
দ্বাদশ বৎসর ভ্রমিতে বনে বন।
ইহাতে তোমার লজ্জা কিছু নাহি হয়।
কিমতে করিবা বিভা দ্রৌপদীর ভয়।
দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ ওঠায় এবং বিশেষত নিজের ‘ফ্রাষ্ট্রেশন’টা ফঁস হয়ে অর্জুনও সত্যভামাকে স্বামী বশীকরণের প্রসঙ্গ টেনে রসিকতার জবাব দিলেন। সত্যভামা বললেন–
ঔষধ করিবে পার্থ স্ত্রীর এই বিধি।
পুরুষ হৈয়া তুমি কৈলে কি ওষধি ॥
ভণ্ডতা করিয়া হইয়াছ ব্রহ্মচারী।
মহৌষধি শিখিয়াছ ভুলাইতে নারী।
সত্যভামা এবার সুভদ্রাকে বিবাহ করার কথা বললেন, কিন্তু তিনি মহাবীর সুলভ ঔদাসীন্যে নিজের ব্রহ্মচারী-ব্রত, তীর্থযাত্রার কারণ দেখাতে সত্যভামা সুভদ্রাকে ফিরিয়ে এনে রতিকার মন্ত্রপূত বশীকরণ সিঁদুর পরিয়ে দিলেন সুভদ্রার কপালে। এবারে অর্ধরাত্রের স্তিমিতপ্রদীপ অন্ধকারে অর্জুন সুভদ্রাকে দেখে এতই মোহিত হলেন যে, তখনি উঠিয়া তারে করিলেন কোলে। অর্জুন-সুভদ্রার গোপন গান্ধর্ব বিবাহ হয়ে গেল। ফলে এই অন্তরঙ্গতার সূত্রে সুভদ্রাহরণের পর তার প্রিয়তম স্বামীর রথচালনাও আরও বেশি রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে।
ব্যাসের মহাভারতে এ-সব রঙ্গরসিকতার প্রশ্রয় নেই আপাতত। তা ছাড়া এখানে প্রেমে পড়েছেন স্বয়ং অর্জুন। এবং স্বয়ং কৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে সুভদ্রা-হরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন তাঁর সঙ্গেই সুভদ্রা-হরণের উপায় ঠিক করতে বসলেন। কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে সুভদ্রাকে হরণ করবেন অর্জুন এবং এই হরণের ভবিষ্যৎ ফল কী হতে পারে– সব ভেবে নেবার পর অর্জুন কয়েকটি নোক পাঠালেন ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নেবার জন্য। কারণ তিনি যা করতে যাচ্ছেন, তার মধ্যে সামাজিক মাত্রা যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক মাত্রা যুক্ত ছিল। সামাজিক মাত্রাটা এইখানে যে, অর্জুনের মা কুন্তী কৃষ্ণপিতা বসুদেবের আপন বোন; বৈমাত্রেয় হলেও অর্জুন কিন্তু তার মামার মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। এই বিবাহ নিয়ে শাস্ত্রকারদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। তারা একদিকে কনভেনশন’ এবং দেশাচারের কথা তুলেছেন, অর্থাৎ কিনা মামাতো বোনের সঙ্গে এই ধরনের বিবাহ ভারতবর্ষের দক্ষিণ এবং পশ্চিম দেশে অনেক জায়গাতেই চালু ছিল। দ্বিতীয়ত কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে ঐশ্বরিক আবেশের কথা মাথায় রেখেও শাস্ত্রকারেরা অর্জুনের এই বৈবাহিক প্রচেষ্টা সমর্থন করেছেন। কাজেই এখানে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি যত প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা। পাণ্ডব-কৌরবদের জ্ঞাতি-বিরোধের নিরিখে মথুরা-দ্বারকার বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজ বংশের কুলপ্রধানেরা পাণ্ডবদের পক্ষেই ছিলেন। অর্জুনের এই বৈবাহিক সম্পর্ক হয় তাদের আরও অনুকূল করবে, নয়তো বিপক্ষতা তৈরি করবে। যদি বিপক্ষতা আসে, তবে যুধিষ্ঠিরের একটা মত এখানে প্রয়োজন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হিসেবে। যুধিষ্ঠির মত দিয়েছেন, কারণ যদুবীর কৃষ্ণ যেখানে নিজে এই বিয়ে চাইছেন, সেখানে সমস্ত রাজনৈতিক যোজনা অর্জুনের অনুকূলেই যাবার সম্ভাবনা।
খবরটা আগেই জানা ছিল। সুন্দরী সুভদ্রা রৈবতক পর্বতে পুজো করতে যাবেন এবং তারপর সেখান থেকে দ্বারকায় চলে যাবেন। অর্জুন আগেই কৃষ্ণের কাছ থেকে একটি রথ চেয়ে নিয়েছিলেন। তাতে জুতে দেওয়া হয়েছিল ভীষণ দ্রুতগামী দুটি অশ্ব। অর্জুন তাঁর ধনুক, তরবারি, বহুতর বাণ এবং অন্যান্য যুদ্ধসজ্জা ভর্তি করে রথটি নিজেই চালিয়ে নিয়ে এসে রৈবতক পর্বতের নীচে সমভূমিতে গোপন স্থানে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু যার জন্য তলায় তলায় এত ব্যবস্থা চলছে, সেই সুভদ্রা কিন্তু কিছুই জানতেন না। তিনি না জানতেন অর্জুনের প্রেমে পড়ার কথা, না জানেন তার সম্বন্ধে ভবিষ্যতের অন্যকৃত পরিকল্পনার কথা। স্বাভাবিক কারণেই যদুবংশীয়দের বার্ষিক উৎসবের সময় রাজকুমারীদের সাধারণ যে সব ‘শিডিউল থাকে, সেইভাবেই একদিন সুভদ্রা সকালবেলায় রৈবতক পর্বতের মাথায় দেবতার পূজা সেরে ফিরে আসছিলেন দ্বারকায় প্রযযৌ দ্বারকাং প্রতি। সুভদ্রার পূজা সমাপন হল, ব্রাহ্মণদের দান দিলে তারা স্বস্তিবাচন করলেন। সুভদ্রা এবার পর্বত থেকে নেমে দ্বারকার পথ ধরলেন। তার পিছন পিছন দ্বারকা থেকে আসা রক্ষীবাহিনী আসছিল। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সুভদ্রার রথে ওঠার কথা। কিন্তু রথে ওঠা আর হল না। সুভদ্রা কিছু না জানলেও অর্জুন তো সব জানেন। কখন তিনি পুজো করতে আসবেন, কতক্ষণ তার সময় লাগবে এবং কখন তিনি ফিরবেন– সে সম্বন্ধে আগেই আন্দাজ করে নিয়েছেন অর্জুন এবং সেই আন্দাজেই তিনি সুভদ্রার ফিরবার রাস্তায় রথ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুচি বসন পরা সুভদ্রার ভক্তিন মুখখানি দেখে আরও একবার ভাল লাগল অর্জুনের। এখন পুলকিত হয়ে সময় নষ্ট করার সময় নেই তার। সুভদ্রাকে দেখে ক্ষণিক বিচলিত হওয়ার পরেই অর্জুন তার সামনে গিয়ে পাঁজাকোলা করে ধরে রথে তুললেন সুভদ্রাকে।
সুভদ্রা বাধা দেননি হয়তো। হয়তো বা সুভদ্রা নিশ্চয়ই অর্জুনকে চিনতে পেরেছিলেন। কৃষ্ণের সঙ্গে দিন-রাত ঘুরছেন অর্জুন, সমস্ত দ্বারকাবাসী তাকে মহাবীরের সম্মানে দেখে– সেই অর্জুনকে দেখে সুভদ্রা চিনবেন না, তা হতে পারে না। হয়তো চিনেছেন বলেই মহাবীর অর্জুনকে তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করেননি, হয়তো বা মহাবীরের এই হঠাৎ বলাৎকৃত আচরণে খুশিও হয়েছিলেন সুভদ্রা। কেন না যে মুহূর্তে সুভদ্রাকে রথে চড়িয়ে অর্জুন ছোঁড়া চালিয়ে দিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের পথে, সেই মুহূর্তেও ব্যাস তার মধুর স্মিতমুখের বিশেষণটি দিতে ভোলেননি– তা আদায় শুচিস্মিতাম৷ অন্তত সুভদ্রা অর্জুন কর্তৃক হৃত হওয়ায় যে অসন্তুষ্ট হননি তা এই বিশেষণ থেকে বেশ বোঝা যায়।
অতএব অর্জুন তাকে মহামহিম বীরের স্পর্শে ধারণ করতেই তিনিও ধরা দিয়েছেন বিনা বাধায়। পরবর্তী কালে বাংলার ব্যাস কাশীরাম অবশ্য সুভদ্রার মধ্যে আপন মমতা ঢেলে দিয়ে সুভদ্রাকে অর্জুনের সমগোত্রীয়া করে তুলেছেন। অর্জুনের রথের রশি সুভদ্রার হাতে চলে গেছে এবং তিনি যুদ্ধবীরের সহায়তা করেছেন রথের সারথ্য করে। কিন্তু মূল মহাভারতে এমনটি নেই। মহাভারতে সুভদ্রার অনুগামী সৈন্যদল যখন দেখল– অর্জুন তাদের রাজপুত্রীকে হরণ করেছেন এবং তিনি দ্বারকার পথে না গিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে রথ চালিয়ে দিয়েছেন, তখন তারা দ্বারকার রাজসভা সুধর্মায় গিয়ে ইতিবৃত্তান্ত সব জানাল।
রৈবতকে অবস্থিত যাদব-বৃষ্ণিদের রক্ষীবাহিনী অর্জুনের নাম মাহাত্মেই তাকে আর বাধা দেবার মূর্খামি করেনি। তারা শোরগোল তুলে রাজসভায় এসে অর্জুনের সুভদ্রাহরণ বৃত্তান্ত জানাল। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ভেরী বাজানো হল তুমুল শব্দে, যে শব্দ শুনলে দ্বারকাবাসীরা যেখানে যেমন থাকে, সেই অবস্থায় পান-ভোজন ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য ছুটে আসে। অতএব ভেরীর শব্দ শুনে ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধকেরা যে যেখানে ছিলেন, সেই অবস্থায় ছুটে এলেন সুধর্মায়- অন্নপানমপাস্যাথ সমাপেতুঃ সমন্ততঃ।
ভোজ-বৃষ্ণিদের শাসনতন্ত্র সঙঘরাষ্ট্রের ধারাণুসারী; এখানে যিনি রাজার উপাধি ধারণ করেন, তিনি সিদ্ধান্ত দেন না। বিভিন্ন কুলপ্রধানদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত তিনি কার্যকর করেন। অতএব সুভদ্রা হরণের পর ভোজ-বৃষ্ণিদের ইতিকর্তব্য নিয়ে ‘মিটিং’ বসল। সভাপাল’ প্রথমে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্ণি-ভোজদের অনেকেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। অত্যুৎসাহীরা দু-একজনে বললেন আরে আমার রথটা নিয়ে আয় তো; কেউ বললেন– আমার অশ্বটি; অন্যজন ধনুক-বাণ এবং বর্মের খোঁজ করতে লাগলেন সমূহ প্রস্তুতির জন্য। অধস্তন আজ্ঞানুবর্তী পুরুষেরা ছোটাছুটিও আরম্ভ করল। অধিকাংশ জনের রায় যুদ্ধের পক্ষেই যাচ্ছে, অথচ কৃষ্ণ একটাও কথা বলছেন না– সমস্ত সভাস্থলে এটা একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। এমনকী অর্জুনের খবর শুনে যিনি ঘনঘন কাদম্বরীর পাত্র নিঃশেষ করছিলেন, সেই বলরাম পর্যন্ত মদপাটল চোখে অন্যদের অত্যুৎসাহ এবং কৃষ্ণের নিস্তব্ধতা দেখে চেঁচিয়ে বললেন– আরে মুর্খরা! তোমরা যে যুদ্ধের জন্য এত ক্রোধ দেখাচ্ছ, এত গর্জন করছ, সব তো বৃথা যাবে, কৃষ্ণ যে এখনও চুপ করেই রইল– কিমিদং কুরুথাজ্ঞা তুষ্ণীষ্কৃতে জনার্দনে। আগে কৃষ্ণ তার মত ব্যক্ত করুক, তারপর তো যা করার করবে।
উত্তেজিত বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজেরা সত্যিই এতক্ষণে লক্ষ করলেন যে, কৃষ্ণ এক্কেবারে নিশ্চুপ। বলরাম তার কথা শোনার জন্য সকলকে অবহিত করলেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণের নিস্তব্ধতার কারণ যদি বন্ধুবাৎসল্য হয়, তবে সেই মধুরতার মুখে আগুন দিয়ে বলরাম বললেন– এতদিন তোমার জন্যই আমরা অর্জুনকে যথেষ্ট সম্মান করেছি, কিন্তু সে বদমাশ সম্মানের যোগ্য নয়। আরে ব্যাটা! যেখানে বসে এতদিন তুই যে পাত্রে খাবার খেলি, সেই পাত্রটাই ভেঙে দিয়ে গেলি– কো হি তত্রৈব ভুক্কান্নং ভাজনং ভেতুমহতি। আমাদের সঙ্গে এতকালের সম্বন্ধ তুই একটুও খেয়াল করলি না। আমাকে তো কোনও ‘কেয়ার’ই করলি না। তোর বন্ধু এই কৃষ্ণটার কথাও তো একটু মনে রাখবি সোহবমন্য তথা চাস্মন্ অনাদৃত্য চ কেশবম্।
বলরাম যে কৃষ্ণের সিদ্ধান্ত শোনার ঔৎসুক্য দেখিয়ে নিজেই বলতে আরম্ভ করলেন, সভার মত তৈরি করার গণতান্ত্রিক ‘তরিকা’ এটাই। বলরাম বললেন– ও সুভদ্রাকে হরণ করে নিজের মৃত্যু বয়ে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। এই যে আমাদের সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে অপমানটা করল অর্জুন, তাতে আমি মনে করছি ও আমার মাথার মাঝখানে লাথি কষিয়ে দিয়েছে কথং হি শিরসো মধ্যে কৃতং তেন পদং মম৷ আমি ছাড়ব না, কৃষ্ণ! আমি এই অপমানের শোধ নেব। এই পৃথিবীতে আর যাতে পাণ্ডব-কৌরব বলে কিছু না থাকে, সে ব্যবস্থা আমি একাই করতে পারব। বলরাম যে ভাবে বলতে আরম্ভ করলেন, তাতে সেই মেঘদুন্দুভির শব্দও হার মানল, এবং এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কথা শুনলে ‘গণতান্ত্রিক মূর্খেরা যে-ভাবে নেতার সুরে কথা বলে, ঠিক সেইভাবেই ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধকদের কুজ্যেষ্ঠরা বলরামের দিকেই ঢলে পড়লেন– অন্ধপদ্যন্ত তে সর্বে ভোজবৃষ্ণন্ধকাস্তদা। বলরাম অর্জুনকে মেরেই ফেলতে চাইলেন। কৃষ্ণ সেদিন সম্পূর্ণ মাথা ঠান্ডা রেখে অসাধারণ ঘটকালি করেছিলেন অর্জুনের পক্ষ হয়ে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন– অর্জুন কোনও সাধারণ পুরুষ নন। তাকে মেরে ফেলাও অত সহজ নয়।
বলরাম অত্যন্ত আবেগে কথা বলেন, কৃষ্ণ বলেন যুক্তি দিয়ে। সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ এক সভাস্থলে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ এবার বললেন– আপনাদের সবচেয়ে বড় ভুল, আপনারা অর্জুনকে শত্রু বলে ভাবতে আরম্ভ করেছেন। অর্জুন এখানে অন্যায়টাই বা করল কী, আর এই ভোজ-বৃষ্ণিদের অপমানটাই বা কী করে করল? আসলে যে-সব পথে বিয়ে হলে ঠিক হত বলে আপনাদের মনে হচ্ছে, অর্জুনের তা মনে হয়নি, কিংবা সে তা মেনে নিতে পারেনি। এক নম্বর, কন্যাপণ দিয়ে বিয়ে হয়, অর্জুন যদি সেই পণ দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব করতেন এবং আপনারাও তা মেনে নিতেন, তা হলে সেই পণ দেবার সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের অর্থলোভীও ভাবতেন মনে মনে। অর্জুন আমাদের এতটা অর্থপিশাচ ভাবেননি– অর্থলুব্ধান্ ন বঃ পার্থো মনতে সাত্ত্বতান সদা। দ্বিতীয় হল স্বয়ংবর বিবাহ। অর্জুন ভরসা পাননি নিশ্চয়। কেননা স্বয়ংবরা কন্যা কাকে বরণ করবে, কোনও ঠিক নেই। যদি বলেন, বামুনদের মতো গোরু-ছাগলের বিনিময়ে অনাড়ম্বর এক ব্রাহ্মবিবাহ করতে পারতেন অর্জুন, তা হলে বলব কোন ক্ষত্রিয় বীর এমন নিস্তরঙ্গভাবে বিয়ে করে? আর এইভাবে কন্যাদান করাটা গোরু-ছাগল দানের মতোই মনে করবেন অর্জুন– প্রদানমপি কন্যায়াঃ পশুবৎ কোহনুমন্যতে।
সুধর্মা-সভা কৃষ্ণের যুক্তিতে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অতএব এবারে তিনি মোক্ষম কথা বললেন। বললেন– সাধারণ বিবাহে যে-সব দোষের কথা বললাম, এগুলো অর্জুনকে যথেষ্ট ভাবিয়েছে বলেই অর্জুন সুভদ্রাকে হরণের পথ বেছে নিয়েছেন। আর সুন্দরী যশস্বিনী সুভদ্রাকে যিনি হরণ করেছেন, তার গুণটা কম কীসে? যে বংশে তিনি জন্মেছেন এবং তিনি যেমন ভারত-বিখ্যাত বীর, তাতে যুদ্ধে তাকে কেউ হারিয়ে দেবে, এমন মানুষ আমি ইন্দ্রলোক কিংবা রুদ্রলোকেও দেখিনি– ন তং পশ্যামি যঃ পার্থং বিজয়েত রণে বলাৎ। কাজেই এমন বীরকে যদি সুভদ্রা স্বামী হিসেবে লাভ করে থাকে, তবে আমার মনে হয়– ভালই হয়েছে। অর্জুন ক্ষত্রিয়বীরের মতোই অসামান্যা সুন্দরী সুভদ্রাকে হরণ করেছে। এতে অন্যায়টা কী হল? সুভদ্রা সুন্দরী, অর্জুন বীর, বেশ তো যোটক হয়েছে– এষ চাপীদৃশঃ পার্থ… সুভদ্রা চ যশস্বিনী। তা ছাড়া অর্জুনের মতো মহাবীরকে পাত্র হিসেবে কে অপছন্দ করবে?
কৃষ্ণ এবার সিদ্ধান্ত দিয়ে বললেন– আমি বলি কি, আপনারা অর্জুনকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনুন। ধরুন, আমরা যুদ্ধে গেলাম অর্জুনের সঙ্গে, তারপর অর্জুন আমাদের হারিয়ে দিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে চলে গেল, তখন আমাদের মান-সম্মানটা কোথায় যাবে? তার চেয়ে তাকে যদি মিষ্টি কথায় ফিরিয়ে আনা যায়, তা হলে এই বৈবাহিক সম্পর্কে পরাজয়ের অসম্মান থাকবে না কোনও। সবচেয়ে বড় কথা, অর্জুন আমাদের পিসতুতো ভাই, তার সঙ্গে কি আমাদের এই শত্রুতার ব্যবহার মানায়– পিতৃস্বসুশ্চ পুত্রো মে সম্বন্ধং নাহতি দ্বিষা?
আবারও সেই গণতান্ত্রিকতার জয় হল। বলরামের চেয়েও হাজার গুণ বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কৃষ্ণের যুক্তি শুনে সমস্ত বৃষ্ণি-ভোজেরা কৃষ্ণের মত মেনে নিলেন এবং অবিলম্বে এবং সসম্মানে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনলেন দ্বারকায়। এটা বেশ পরিষ্কার যে, অর্জুন নিজের সাভিলাষ প্রেম পূরণ করার জন্য সুভদ্রাকে হরণ করেছিলেন। কিন্তু সুভদ্রা অর্জুনকে কতখানি পছন্দ করেছিলেন তার এতটুকু সাভিলাষ উক্তির এতটুকু বর্ণনাও মহাভারতের কবি দেননি। কিন্তু স্বয়ং কৃষ্ণের দূতীয়ালি থেকে বুঝি সুভদ্রাও অর্জুনকে যথেষ্ট ভালবেসে ফেলেছিলেন। কৃষ্ণের কথায় শান্ত হয়ে বলরাম যাদবদের বলেছিলেন অর্জুনকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনতে। অর্জুন ফিরেছিলেন সুভদ্রাকে নিয়ে এবং দ্বারকায় বিধিসম্মতভাবে তার বিবাহাদিও সম্পন্ন হল। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল– অর্জুন তাঁর বারো বছর বনবাস এবং তীর্থযাত্রাকালের মধ্যে সম্পূর্ণ এক বছর সুভদ্রার সঙ্গে অতিবাহিত করলেন দ্বারকায়– উষিত্বা তত্র কৌন্তেয়ঃ সংবৎসরপরাঃ ক্ষপাঃ। এক বছর দ্বারকায় থাকলেও বারো বৎসর কালের তখনও খানিকটা বাকি ছিল এবং সেই সময়টুকু অর্জুন পুষ্কর তীর্থে গিয়ে থাকলেন এবং তীর্থযাত্রায় নববধূ সুভদ্রাও সঙ্গী ছিলেন নিশ্চয়। কেন না এই তীর্থ থেকেই অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজধানীতে ফিরে আসেন সুভদ্রাকে নিয়ে।
সত্যি কথা বলতে কি, বাঙালি কাশীরামের মহাভারতে সুভদ্রাকে যেমন এক বীরাঙ্গনা তথা বীরপত্নীর মতো চিত্রিত দেখি, ব্যাসের মহাভারতে তা একেবারেই উলটো। সুভদ্রার হরণ থেকে আরম্ভ করে একেবারে ইন্দ্রপ্রস্থে তাকে নিয়ে ফেরা পর্যন্ত একটি শব্দও তার মুখে উচ্চারিত হয়নি। যে সুভদ্রাকে অর্জুন জোর করে রথে তুলেছিলেন– তামভিদ্রুত্য কৌন্তেয়ঃ প্রসহ্যারোপয়দ রথম্ অথবা যে সুভদ্রাকে নিয়ে যাদবদের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধই লেগে যাচ্ছিল, সেই সুভদ্রা যেন সর্বকর্মে নির্বিকার। অর্জুনের সমস্ত ক্রিয়াশীলতার মধ্যে তিনি বড়ই অনুপন্থী। অথচ মহাবীর অর্জুন যার জন্য এত প্রগাঢ় প্রেম অনুভব করেছিলেন, তিনি একেবারে নিরেট বোকা হবেন, তা হতে পারে না। আসলে মহাবীর অর্জুনের দিক থেকে এই পছন্দটাও অস্বাভাবিক নয় এবং তার কারণ হয়তো দ্রৌপদী।
দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। তিনি শুধু পঞ্চস্বামী গর্বিতাই নন, ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে তিনি শুধু পট্টমহিষীই নন, পাণ্ডবদের বিবাহোত্তর জীবনে পাণ্ডব-কৌরবদের সমস্ত রাজনীতির মধ্যে তার ভূমিকা আছে এবং সমস্ত ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট বক্তব্যও আছে। এমন একটি রমণীকে তাঁর সহজাত গুণাবলির জন্য সম্মান করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়, অথবা এমন একটি রমণীর স্বামিত্বের অধিকার পেলে তার জন্য গর্বিতও বোধ করা যায়, কিন্তু সম্পূর্ণ আত্মসচেতন সেই রমণীর সমস্ত সত্তার সম্পূর্ণ অধিকারী নিজেকেই ভেবে পুলকিত হওয়াটা যে কোনও স্বামীর পক্ষেই খুব কঠিন। এমনকী মহাবীর অর্জুনের পক্ষেও তা কঠিন। সুভদ্রার সৌন্দর্য্যের সঙ্গে এমন এক নমনীয়তা ছিল, তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমনই এক আত্মনিবেদন ছিল, যা দ্রৌপদীর প্রতিতুলনায় ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে অর্জুনকে। অর্জুন জানতেন যে, দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর ঘরণী হলেও তাঁর প্রতি দ্রৌপদীর অশেষ দুর্বলতা ছিল, কিন্তু এই দুর্বলতা প্রকাশের কোনও উপায় দ্রৌপদীর ছিল না। যদি বা সে দুর্বলতা প্রকাশও পায় তো সাহংকার বক্রোক্তিতে এমনই সূচীভেদতুল্য জ্বলনশীল হয়ে উঠবে যে, সেই দুর্বলতা হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন হয়ে উঠবে। এখানে দ্রৌপদীর আংশিক অধিকার নিয়ে ভাইদের সঙ্গে কোনও মানসিক দ্বন্দ্ব নেই এবং নেই কৃষ্ণা পাঞ্চালীর সভঙ্গ বিদগ্ধমণ্ডণ মুখখানি। আর পায় কে, এক বৎসরের বেশি সময় ধরে অর্জুন থেকে গেলেন দ্বারকায় সুখে, সরসতায়, একান্তে। কিন্তু সময় এল, যখন যেতেই হবে ইন্দ্রপ্রস্থে এবং মুখোমুখি হতেই হবে সেই বিদগ্ধা রমণীর– যিনি অর্জুনের বীরত্ব মোহেই তাকে বরমাল্য দিয়েছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যতই ভাগ হয়ে যান দ্রৌপদী, তাঁকে অতিক্রম করা সহজ ছিল না।
ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরবার পরেই যুধিষ্ঠির মহারাজ এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করেই অর্জুন মা-ভাই এবং অন্য কারও সঙ্গে কথা না বলে, প্রথমে গেছেন দ্রৌপদীর কাছে। সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ের খবর আগেই দ্রৌপদীর কানে গেছে। অর্জুনকে দেখে দ্রৌপদী ক্রোধে আরক্ত হলেন না, আবার বারো বৎসর পর পুনরাগত আপন ঈপ্সিততম স্বামীটিকে দেখে তিনি কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে অভিভূতও হলেন না। অর্জুনকে উপস্থিত দেখে দ্রৌপদী বক্রোক্তিতে মুখর হয়ে বললেন, তুমি এখানে কেন, পার্থ? তুমি যাও সেইখানে যেখানে যাদব-বৃষ্ণিদের মেয়েটি বসে আছে তোমার অপেক্ষায়– তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয় যত্র সা সাত্ত্বতাত্মজা। দ্রৌপদী সুভদ্রার নামও উচ্চারণ করলেন না। শুধু মান করে বললেন– এক জিনিসকে দ্বিতীয়বার বাঁধলে আগের বাঁধনটুকু আলগা হয়ে যায়।
কথাটা অর্জুনের কাছে হয়তো তত সুখপ্রদ নয়, কিন্তু এই কথার বাস্তব মূল্য যে কতখানি, তা এই জীবনে বহুবার দেখেছি। বিবাহ-পূর্ব প্রেমের ক্ষেত্রে যারা একাধিকবার প্রেমে পড়ে সফল হয়েছেন, তাদের প্রথম প্রেমের সুখস্মৃতি দ্বিতীয় বারের প্রেম-মধুরতায় অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। উপমাটাও এখানে সত্যিই অসাধারণ। ছোটবেলায় বেডিং বা বোঁচকা বাঁধার সময় দেখেছি– একবার দড়ি দিয়ে বাঁধার পর যদি দ্বিতীয় বার তার ওপরে কষে বাঁধার চেষ্টা করেছি, তখনই আগের বাঁধনটা শিথিল, ঢলঢলে লাগত। বিবাহের ক্ষেত্রেও প্রেমের মতোই ব্যবহার। যিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করতেন বা এখনও করেন, সেক্ষেত্রে প্রায় সময়েই প্রথম বৈবাহিক প্রেম শিথিল এবং অনবধানে কোনও রকমে চলমান থাকে। দ্রৌপদীর কথায় যে সত্য উচ্চারিত হয়েছে, তা এক চিরকালীন সত্য বটে, কিন্তু সেখানেও স্থান, কাল এবং বিশেষত পাত্রীর বিবেচনা আছে। পাত্রী যে স্বয়ং দ্রৌপদী। তার মতো বিদগ্ধা, মনস্বিনী এবং তেজস্বিনী মহিলার মুখে এমন কথা যে উচ্চারিত হয়েছে, তা হয়তো শুধু অর্জুন বলেই, কেননা অর্জুনের ওপরেই তার অসম্ভব দুর্বলতা ছিল। ফলত এমন এক রমণীকে অতিক্রম করা খুব কঠিন। একথা ঠিক যে, দ্রৌপদীকে সম্পূর্ণ করে পাননি বলেই অর্জুনের জীবনে এতগুলি নারীর পদসঞ্চার ঘটেছে, এতগুলি বিবাহের পরেও এমন বিদগ্ধা রমণীকে অতিক্রম করা অর্জুনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। যদি বা প্রেম নাও হয়, তবু এটা হয়তো অপাদান কারকে বৈদগ্ধ্য হইতে ভয়।
অর্জুন বুঝলেন– দ্রৌপদীর এই অধিকার-বোধের মধ্যে প্রেম যত আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অহংকার। দ্রৌপদীর মানে লাগছে, তিনি থাকতেও অন্যরা কেউ নাকি তাঁরই সঙ্গে সমকক্ষায় প্রবেশ করছে অর্জুনের হৃদয়ে। অর্জুন সব বুঝলেন। কিন্তু দ্রৌপদী বুঝলেন না।
দ্রৌপদী খুব দুঃখ পেয়েছেন অর্জুনের আচরণে, কিন্তু অর্জুনের দিক থেকে তেমন করে তিনি ভাবেননি। দ্রুপদের স্বয়ংবরসভায় যে বরমাল্য তিনি অর্জুনের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন, ঘটনাচক্রে সেই বরমাল্যের বন্ধন-পরিসরে আর চার স্বামী প্রবিষ্ট হয়েছেন। একটি হৃদয়ের জন্য এতগুলি হৃদয় যেখানে এক ফঁসে ধরা পড়েছে, সেখানে আপন সত্তা জাহির করার উপায় অর্জুনের কোথায়? ফলে অতৃপ্ত হৃদয়কে বিশ্রান্ত করার জন্য অর্জুনকে খুঁজে নিতে হয়েছে এমন একটি প্রাণ– যে প্রাণ অর্জুনের বিক্ষুব্ধ আলোড়িত হৃদয়ে মমতা যোগাবে, যোগাবে প্রেমের বিশ্বাস। অর্জুন দ্রৌপদীকে শান্ত করতে পারেননি কারণ তার আত্মসচেতনতায় চিড় ধরানো যায়নি। কিন্তু রৈবতক পর্বতের বৃক্ষান্তরালে অর্জুনের বাহুলগ্না হবার পর থেকেই যিনি আত্মনিবেদন করে বসে আছেন, অর্জুন শেষে তারই শরণাপন্ন হলেন দ্রৌপদীকে শান্ত করার জন্য।
অর্জুন বুঝলেন– দ্রৌপদীর সমকক্ষায় রাজবধূর আড়ম্বরে তাকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করানো যাবে না। না কি, এখানে কৃষ্ণেরই বুদ্ধি ছিল, তিনি তার সখী কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে চেনেন। অতএব বিবাহের লাল চেলি আর রাঙা কাপড় পরে যে সুভদ্রা নববধূর বেশে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করেছিলেন, অর্জুন সেই ঐশ্বর্যের অভিব্যক্ত পরিধানটুকু সুভদ্রার অঙ্গ থেকে খুলে নিয়ে, তাকে পরিয়ে দিলেন সাধারণ গোপবালিকার বেশবাস যার মধ্যে রাজকীয় মর্যাদা এবং সচেতনতা নেই, আছে শুধুই বাধ্য এবং নমনীয় হবার অভিব্যক্তি পার্থঃ প্রস্থাপয়ামাস কৃত্বা গোপালিকা বপুঃ।
অর্জুন এই সাধারণ পরিচয়ে সুভদ্রাকে পাঠিয়ে দিলেন অন্তঃপুরে। তিনি সুভদ্রার সঙ্গে এলেন না। অতিশয় সুন্দরী যদি বৃন্দাবনবাসিনী ব্রজরমণীর বেশে সাজে, তবে যেহেতু তাকে আরও সুন্দর দেখায়, বীরপত্নী সুভদ্রাকেও তেমনই আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল– সাধিকং তেন রূপেণ শোভমানা যশস্বিনী। বস্তুত দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব যদি অতিক্রমের তাৎপর্যে নিহিত থেকে থাকে, তা হলে সুভদ্রার ব্যক্তিত্ব নিহিত ছিল মেনে নেওয়ার নমনীয়তার মধ্যে। অতিক্রম করা অনেক সহজ মেনে নেওয়া অনেক কঠিন। নববধূ সুভদ্রা, যদু-বৃষ্ণিদের কুলজাতিকা সুভদ্রা, কৃষ্ণ-বলরামের ভগিনী সুভদ্রা কী অদ্ভুত নমনীয়তায় নিজেকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন, তা ভাবা যায় না। অসাধারণ মানসিক শক্তি ছাড়া, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া নিজের জাতি-কুল-ঐশ্বর্যের অভিমান মঞ্চ থেকে নেমে এসে নতুন পরিবেশে এমন করে মানিয়ে নেওয়া যায় না, সুভদ্রা যেমন করে মানিয়ে নিয়েছেন।
সুভদ্রা এই এক বছর ধরে অর্জুনের কাছে দ্রৌপদীর কথা শুনে থাকবেন; শুনে থাকবেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা এক পরম ব্যক্তিত্বময়ী রমণীর কথা। কিন্তু অর্জুনের প্রতি ভালবাসায় সুভদ্রা দ্রৌপদীর কাছে দীনভাবে আসতে বিমনা হলেন না একটুও।
গোপিনীর সাধারণ বেশে সুভদ্রা প্রথমে জননী কুন্তীকে প্রণাম করতে গেলেন। সর্বাঙ্গ সুন্দরী এমন এক নমনীয়া বধূমাতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্নেহসূচক মস্তক আঘ্রাণ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায়ই ছিল না কুন্তীর– তাং কুন্তী চারু সর্বাঙ্গীমুপাজিঘ্রত মূর্ধনি। কুন্তীর আশীর্বাদ গ্রহণ করে সুন্দরী সুভদ্রা দ্রৌপদীর ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাদবন্দনা করে সুভদ্রা বললেন– আমি আপনার দাসীমাত্ৰ প্ৰেষ্যাহম ইতি চাব্রবীৎ। নববিবাহিতা রাজবধূর গায়ে রক্ত কৌষেয় বাসখানি নেই, মুখের মধ্যে অর্জুনের প্রথমা প্রিয়াকে জয় করার ঔদ্ধত্য নেই, বরঞ্চ দ্রৌপদীর সামনে জড়, ভয়াকুলি সেই রমণী এক অস্ফুট উচ্চারণে বলছে– দিদি! আমি আপনার দাসী, আপনার চরণ-সেবায় উপস্থিত– এই একটা কথায় দ্রৌপদী একেবারে বিগলিত হয়ে গেলেন। পঞ্চস্বামী গর্বিতা দ্রৌপদী যে মর্যাদার আসনে বসেছিলেন, নবাগতা এই রমণীটি যে সেই মর্যাদার প্রতিযোগিনী হয়ে আসেনি– এই সান্ত্বনাবোধ দ্রৌপদীকে সুভদ্রার ওপর প্রীত করে তুলল। যথোচিত উদারতায় সেই দ্রৌপদীসুলভ বক্রোক্তি মিশিয়েই দ্রৌপদী সুভদ্রাকে বললেন– তোমার স্বামী শত্রুশূন্য হয়ে থাকুন– এই আমি চাই– নিঃসপত্নোহস্তু তে পতিঃ।
আসলে সুভদ্রার নিরহংকার দীন ‘দাসী’ সম্বোধনটুকু দ্রৌপদীর অন্তরাত্মা তৃপ্ত করেছিল। তিনি বুঝেছিলেন–এ আমাকে অতিক্রম করবে না। হায়! দ্রৌপদী বুঝলেন না যে, বিদগ্ধতা, ব্যক্তিত্ব এবং অন্যকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা, এমনকী স্বামীকেও আপনিই প্রীভূত করে রাখার ক্ষমতা একটি স্বামীকে এক ধরনের আহংকারিক তৃপ্তি দেয়, উচ্চতাও দেয় হয়তো, কিন্তু মুগ্ধতা দেয় না, নিশ্চিন্ততাও দেয় না। শুধু আনুগত্যের মহিমাতেই সুভদ্রা জিতে গেলেন। তার ওপরে দ্রৌপদীর আশীর্বাদ ফলল কি না জানি না, কিন্তু দ্রৌপদী যে কোনও দিন এই কোমলা রমণীকে শত্রু ভাবেননি, তার কারণ যতখানি সুভদ্রার আনুগত্য, তার চেয়ে বেশি পঞ্চস্বামী গর্বিতার আত্মতৃপ্তি, যেটা কাশীরাম দাস ঠিক ধরেছিলেন, পাঞ্চালী কৃষ্ণার ব্যক্তিত্ব এমনই যে, ‘এক তিল পঞ্চস্বামী নাহি ছাড়ে পাছ।
সুভদ্রা দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ মেনে নিয়েছিলেন অনুকূল ভাবনায় এবং আনুগত্যে, হয়তো এই কারণেই সুভদ্রা দ্রৌপদীরও প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সমধিক এবং হয়তো বা দ্রৌপদীও নিজের বৈদগ্ধ্য-বুদ্ধিতে সুভদ্রাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন বলেই পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়েরও কোনও অশান্তি তৈরি হয়নি, অশান্তি হয়নি শাশুড়ি হিসেবে জননী কুন্তীরও। কেননা পাঁচ ভাই পাণ্ডবের মধ্যে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির এবং কুন্তী দু’জনেই মনে-মনে এই খবর জানতেন যে, পাঁচ স্বামীর সঙ্গে বিবাহে খণ্ডিতা হলেও খণ্ডিতা দ্রৌপদীরও মানসিক দুর্বলতা ছিল অর্জুনের জন্য। সেই অনন্ত দুর্বলতার জন্যই হয়তো দ্রৌপদী ভগিনীস্নেহে মেনে নিয়েছিলেন সুভদ্রার একান্ত অধিকার এবং দ্রৌপদীর ‘ক্রেডিট’টা এই ব্যাপারে বেশি, কেননা তিনি সব মেনে নিয়েছিলেন বলেই সমস্ত পাণ্ডবরা এবং জননী কুন্তী শেষ পর্যন্ত শান্তিতে খুশি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ততস্তে হৃষ্টমনসঃ পাণ্ডবেয়া মহারথাঃ।/কুন্তী চ পরমপ্রীতা বভূব….
সুভদ্রার এই বিবাহের পরপরই দ্বারকার যাদব-বৃষ্ণিদের ঘর থেকে বহুতর উপহার আসতে আরম্ভ করল খাণ্ডবপ্রস্থে; তখনও এটা ইন্দ্রপ্রস্থ হয়নি। কী নেই তার মধ্যে! রাজকীয় হস্তী অশ্ব, সোনা-দানা, মণি-রত্ন, দাস-দাসী ছাড়াও যেটা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা হল- স্বয়ং বলরাম কৃষ্ণের সঙ্গে উপস্থিত হলেন খাণ্ডবপ্রস্থে এবং এলেন বৃষ্ণি-অন্ধক- ভোজ-যাদবদের প্রধান পুরুষেরা। অর্জুন যেহেতু রাক্ষসবিধিতে সুভদ্রাকে হরণ করেছিলেন এবং সেই হরণ নিয়ে কিছু অসন্তোষও তৈরি হয়েছিল দ্বারকার যদুবৃষ্ণিসঙেঘ, তাই উপহার দেবার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু কৃষ্ণের উদ্যোগে সুভদ্রাহরণের ঘটনা যখন সকলের অনুমোদন লাভ করল, তখন বলরাম-কৃষ্ণ সকলকে সঙ্গে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে এলেন এবং ধনরত্নের বহুল উপহার নিয়ে এলেন সুভদ্রার প্রাপ্য স্ত্রীধন হিসেবে দদৌ শত সহস্ৰাখ্যং কন্যাধনমনুত্তমম্। বলরাম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আনুষ্ঠানিক বৈবাহিকতায় অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার পাণিগ্রহণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন- রামঃ পাণিগ্রহণিকং দদৌ পার্থায় লাঙ্গলী।
বৃষ্ণি-অন্ধকদের সঙ্ঘরাষ্ট্র থেকে এত যে দান-মান-সম্মানের আয়োজন এবং যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে সেই দান-প্রতিগ্রহণের মধ্যেও যে বাধিত, সম্মানিত বোধ দেখা গেছে– পূজয়ামাস তাংশ্চৈব বৃষ্ণন্ধক-মহারথান– তাতে এই বিবাহের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্যও ধরা পড়ে। তৎকালীন দিনের অপ্রতিরোধ্য রাজা মাগধ জরাসন্ধের জামাই মথুরাধিপতি কংস কৃষ্ণের হাতে হত হয়েছেন এবং বৃষ্ণি অন্ধক-ভোজদের সঙঘশাসনপ্রথা আবারও ফিরে এসেছে কুলপ্রধানদের হাতে। কিন্তু সে শাসন এখনও অস্থির কেননা জরাসন্ধ বারবার আক্রমণ করছেন মথুরা-দ্বারকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কৃষ্ণ বলরামের বিরুদ্ধে জরাসন্ধের মিত্রবাহিনীতে যাঁরা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, সেই বাহিনীর পুচ্ছদেশে কিন্তু দুর্যোধনকেও আমরা দেখছি খিলহরিবংশের বিবরণে। মহাভারতে দেখা যাচ্ছে সুভদ্রার বিবাহ উপলক্ষে যে পরিমাণ দান-মান এল দ্বারকা থেকে তার মধ্যে যুদ্ধের উপকরণ হিসেবে হস্তী-অশ্ব যথেষ্টই আছে এবং মহাভারত বলেছে এইসব গজবাজি, ধনরত্নের বিশাল উপকরণ যুধিষ্ঠিরের শত্রুকুলের কাছে যথেষ্ট কষ্টের কারণ হয়ে উঠল– দ্বিষচ্ছোকাবহহাহভবৎ। অন্যত্র একটি গ্রন্থে আমরা এই বিবাহের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে বলেছি যে, কংসবধের পর মগধরাজ জরাসন্ধের রাজনৈতিক এবং সাময়িক তাড়না সহ্য করাটা কৃষ্ণের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল। এই অবস্থায় কৃষ্ণ যে-সব কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেন, সেগুলির অন্যতম হল– কৌরব-পাণ্ডবদের জ্ঞাতিবিরোধে অংশ নিয়ে তার আত্মীয় পাণ্ডবদের কাছাকাছি আসা বা তাদের সহায়তা করা। জরাসন্ধের রাজনৈতিক প্রতাপ এতটাই বেশি ছিল যে, কৃষ্ণের নিজের আত্মীয়গুষ্টির অনেকেই কৃষ্ণের বিরুদ্ধে জরাসন্ধের সহায়তা করেছেন। কৃষ্ণের পট্টমহিষী রুক্মিণীর পিতা ভীষ্মক এবং রুক্মিণীর ভাই রুক্মী কৃষ্ণের বিরুদ্ধে ছিলেন। বিরুদ্ধে ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল, যার সঙ্গে কৃষ্ণের আত্মীয়-সম্পর্ক ঠিক পাণ্ডবদের মতোই পাণ্ডবরা তার এক পিসি কুন্তীর ছেলে, শিশুপাল তার আর এক পিসি তশ্রবার ছেলে। অথচ শিশুপাল ঘোর কৃষ্ণবিরোধী ছিলেন এবং তিনি জরাসন্ধের দক্ষিণহস্ত।
এঁরা ছাড়াও আরও অনেক জরাসন্ধ-পক্ষপাতী শত্রুদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থিতি সুরক্ষিত করার তাগিদেই কৃষ্ণের দিক থেকে এইসব রাজনৈতিক পদক্ষেপ ভীষণ রকমের জরুরি ছিল। আমরা মনে করি– অর্জুনের প্রতি সখ্যবশত তো বটেই, কিন্তু এই সখ্যতা ছাড়াও সুভদ্রাহরণে অর্জুনকে মদত দেওয়া এবং তার জন্য জ্যেষ্ঠ বলরামের বিরুদ্ধে চলে গিয়েও এই বিবাহের উদ্যোগ সফল করে তোলার মধ্যে ন্যূনাধিক কিছু রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল। সেটা মহাভারত-পুরাণ স্পষ্ট করে কোথাও বলেনি এবং বলবেও না বটে, কিন্তু দ্বারকার বৃষ্ণি-অন্ধকদের পুরো গুষ্টি যেভাবে খাণ্ডবপ্রস্থে নেচে-কুঁদে বাজনা বাজিয়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে গেলেন– তত্র তত্র মহানাদৈরুৎকৃষ্টতলনাদিতৈঃ– তাতে বুঝি বৈবাহিক তাৎপর্য ছাড়াও আরও কিছু আছে যা মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শত্রুপক্ষের কাছে পীড়াদায়ক বটে। সবচেয়ে বড় কথা, যদুবৃষ্ণিরা বলরামের তত্ত্বাবধানে দ্বারকায় ফিরে গেছেন, কিন্তু তার পরেও কৃষ্ণ থেকে গেছেন খাণ্ডবপ্রস্থে এবং কিছুদিনের মধ্যে খাণ্ডববন দহন করে খাণ্ডবপ্রস্থটাকে ইন্দ্রপ্রস্থে রূপান্তরিত করা হবে এবং জরাসন্ধ বধের পর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ হবে।
তবে সুভদ্রার বিয়ের মধ্যে রাজনৈতিক তাৎপর্য যাই থাক, সুভদ্রা নিজে খুব রাজনীতি বুঝতেন না, বুঝতে চানওনি কোনওদিন। বিশেষত যেখানে দ্রৌপদীর মতো ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, সেখানে তিনি পাণ্ডবগৃহের কুলবধূর মর্যাদা এবং বন্ধুত্বের মোহটুকুই পছন্দ করেছেন বেশি। হয়তো এই কারণেই মহাভারতের কবি সুভদ্রার পরবর্তী জীবন-বিবরণে তার পুত্রজন্মের ঘটনাটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন এবং এখানে লক্ষণীয়, পঞ্চস্বামীর ঔরসে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র-জন্মের ঘোষণা করার আগেই মহাভারতের কবি সুভদ্রার পুত্রজন্মের কথা বলছেন। তার চেয়েও বড় কথা, অভিমন্যুর জন্ম, তার আকৃতি, তার অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে যতগুলি শ্লোক মহাকবি ব্যয় করেছেন, সেখানে– সৌভদ্র অভিমন্যুকে নিয়ে এত কথা বললাম, অতএব দ্রৌপদীর পুত্রদের কথা না বললে কেমন দেখায়– ঠিক এই ভাবনাতেই যেন মহাকবি লিখলেন– পাঞ্চালী কৃষ্ণাও তাঁর পঞ্চস্বামীর কাছ থেকে পাঁচটি পুত্র লাভ করলেন পাঞ্চাল্যপি তু পঞ্চভ্যঃ পতিভ্যঃ শুভলক্ষণা।
সুভদ্রার সম্পূর্ণ জীবন দ্রৌপদীর মতো ঘটনাবহুল নয়। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের নানান টানাপোড়েন অথবা জ্ঞাতিবিরোধের কূট প্রশ্নগুলি তাকে যেমন এতটুকুও আলোড়িত করে না, তেমনই অর্জুনের মতো বীর স্বামীর বিচক্ষণতা এবং উচ্চতাও যে সুভদ্রাকে কখনও আকণ্ঠ আপ্লুত পুলকিত করে রেখেছিল এমন কোনও স্বকণ্ঠ-নির্গত প্রমাণও আমরা সুভদ্রার মুখ থেকে পাই না। গবেষণার চিরাচরিত চর্চায় এই কথাই উঠে আসবে যে, ‘পণ্ডিতা চ মনস্বিনী’ দ্রৌপদীর অসামান্য ব্যক্তিত্বই সুভদ্রার কণ্ঠরোধের কারণ অথবা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থী। আপাতদৃষ্টিতে এই কথাই মহাভারত-পাঠকের মনে হবার কথা। কিন্তু মূল সংস্কৃত মহাভারতের প্রতিপদপাঠের তাৎপর্য বিচার করলে দেখা যাবে সুভদ্রার ব্যক্তিত্ব এবং জীবনবোধই তেমন প্রখর নয় হয়তো।
বিপরীত দিক থেকে সমাজ-পটের যে চিত্র আমরা জানি, তাতে এমনও দেখেছি– অতি মূর্খ স্ত্রীও– হয়তো কিছু বোঝেন না বলেই উচ্চশিক্ষিত স্বামীর উচ্চতা প্রমাণ করার জন্য অনেক সময় হাস্যকর ভাবেও গলা ফাটিয়ে ফেলেন।
আবার আপাত বড় নিরীহ, দুর্গত, সাত চড়ে রা কাড়ে না এমন রমণীকেও আমি বহুল পারিবারিক কূটনীতি করতে দেখেছি এবং কোনও কোনও সময়ে তাদের তারগ্রামে ন্যস্ত কণ্ঠস্বর চকিত-চকিত করেছে আমাকে। তখন মনে হত– ব্যক্তিত্ব বস্তুটারও উত্তম-মধ্যম। অধম, এমনকী অধমাধম স্তরও আছে। অথচ সুভদ্রা বোধহয় এগুলির কোনও স্তরেই পড়েন না। বৈয়াসিকী মহাভারত-সংহিতায় বার বার সুভদ্রার পরিচয় উল্লিখিত হয়েছে তিনি বসুদেবের মেয়ে, স্বয়ং কৃষ্ণের বোন বলে কথা– দুহিতা বসুদেবস্য বাসুদেবস্য চ স্বসা– কিন্তু বাস্তব জীবনে এই মহান পরিচয়ের এতটুকুও ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্ফুট হয়নি সুভদ্রার চরিত্রে। লক্ষণীয়, তিনি যদি কাশীরাম দাসের মানস-প্রসূতিও হতেন, তা হলেও তার প্রকৃতি অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু কাশীরাম বৈবাহিক ব্যাপারে সুভদ্রার জর-জর প্রেমবিকার দেখালেন, সুভদ্রাহরণ-পর্বে সুভদ্রার বীরাঙ্গনা-সুলভ রথচালনা দেখালেন বটে, কিন্তু তার পরে কাশীরামের মধ্যেও সেই বৈয়াসিকী স্তব্ধতা নেমে এসেছে যে স্তব্ধতা মূল মহাভারতে প্রথম থেকেই ছিল।
মহাভারতে সুভদ্রাকে দেখার পর অর্জুনের মনোহরণ-পর্বে সুভদ্রার দিক থেকে একটি প্রেমের শব্দও ভেসে আসেনি, বাসুদেব কৃষ্ণ আপন জ্যেষ্ঠ বলরামের বিরুদ্ধে গিয়ে অর্জুনকে সুভদ্রা-হরণের প্রস্তাব দিচ্ছেন, সুভদ্রা তা জানেনও না এবং শেষ পর্যন্ত যখন রৈবতক পর্বতের মন্দির পরিক্রমা-শেষে দ্বারকার দিকে অভিমুখী সুভদ্রাকে দৌড়ে এসে জাপটে ধরে জোর করে রথে তুললেন অর্জুন– তামভিত্য কৌন্তেয় প্রসহ্যারোপয় রথম– তখনও আমরা সুভদ্রার মধ্যে এমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি যাতে মনে হয় তিনি মহাবীর অর্জুনের সঙ্গে বীরমহিমায় বীরপত্নীর মতো রথে যেতেই প্রস্তুত; অথবা এমন কোনও ভাবও তিনি করছেন না, যাতে তিনি বিপরীত সক্রিয়তায়– ওরে কে কোথায় আছিস রে, আমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে রে– এমন কথাও একবারও উচ্চারণ করেছেন।
আমার ভাবতে অবাক লাগে কেমন উদাসীন এই রমণী, কেমন তাঁর জীবনবোধ, কেমনই বা তার যুবতী-হৃদয়ের রোমাঞ্চ যাতে অর্জুনের জীবনে তার নিঃশব্দ পদসঞ্চরণগুলি তেমন করে বুঝতেই পারি না, অথচ রবীন্দ্রনাথের মতো আপাদমস্তক রোম্যান্টিক কবি ‘প্রেমের অভিষেক’-এর মতো একটি অন্তরঙ্গ কবিতায় চারটি-পাঁচটি প্রেমোজ্জ্বল পুরাকল্পের মধ্যে সুভদ্রার কথা জানিয়েছেন–
গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল
চুম্বিছে ফাল্গুনী।
আমি বিশ্বাস করি না এই মহাকবি কাশীরাম দাসের কাছ থেকে কোনও অনুপ্রাণ প্রেরণা লাভ করেছেন, কেননা কাশীরামের বীরাঙ্গনা সুভদ্রার কোনও তাৎপর্য তিনি গ্রহণ করেননি। বরঞ্চ বলব- ব্যাসের মহাকাব্য-কণ্বনের মধ্যে সুভদ্রার যে শব্দহীন কথাহীন আত্মনিবেদন সংকেতিত হয়েছে, তার হরণপর্ব থেকে শুরু করে পুত্রজন্ম পর্যন্ত যে মুগ্ধমধুর সম্ভোগ অকীর্তিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথ সেখান থেকেই এই সদা-সতত লজ্জারুণ সুভদ্রাকে তুলে এনেছেন পুরাকল্পীয় মুক্তার মতো। কী বোঝাচ্ছেন মহাকবি? প্রেমের অভিষেকে এটাই তো মর্মবাণী ছিল যে, হেথা আমি কেহ নহি, সহস্রের মাঝে একজন সত্যিই তো ইন্দ্রপ্রস্থের পঞ্চ দৃপ্ত পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন তো মাত্র একজন, দ্রৌপদীর পঞ্চখণ্ড হৃদয়ের তৃতীয় সমাংশমাত্র। অথচ সুভদ্রাকে অর্জুন দেখামাত্র বরণ করেছিলেন সমস্ত হৃদয় দিয়ে। ফলত বৈবাহিক হরণের পূর্বেও তিনি নিশ্চপ, হরণের কালেও তিনি নিরালাপ, নিরাভাষ নিবেদিতপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথ তার প্রেমের অমরাবতীতে যে ছয়টি পুরাকল্পের চরিত্র ]উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে পাঁচ জন রমণী ছাড়াও একটি পুরুষও আছেন– উর্বশীর জন্য অশান্ত ভ্রান্ত পাগল পুরুরবা। কিন্তু দময়ন্তী, শকুন্তলা, পুরুরবা, সুভদ্রা, মহাশ্বেতা, পার্বতী– এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে সেই সামান্য সাধারণ ধর্ম হল– এঁরা সাগ্নিক শারীর প্রেমকে তপস্যায় পরিণত করেছেন– অপেক্ষায় বসে বসে দিন গণনায়– সে আসিবে একদিন।
সুভদ্রা অর্জুনকে পেলেন কতটুকু? যেদিন কৃষ্ণের পরামর্শ মেনে যাদব-বৃষ্ণিরা অর্জুনকে দ্বারকায় ফিরিয়ে আনলেন সমস্ত মর্যাদা দিয়ে, সেই দিন থেকে এক বৎসরকাল অর্জুন সুভদ্রার সঙ্গলাভ করেছেন পূর্ণ অধিকারে। এখানে ব্রাহ্মণের গোরু হারায়নি, অকালে অস্ত্রগৃহে প্রবেশ করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বসা দ্রৌপদীকে দেখে অধিকার-ভঙ্গের অঙ্গুলি সংকেত সহ্য করতে হয়নি, অথবা যুধিষ্ঠিরের পর ভীমের পর্যায়-ভাগে অপেক্ষা করতে হয়নি পুনরায় অপেক্ষিত নকুল-সহদেবের রমণোচ্ছিষ্ট দ্রৌপদী-খণ্ডের জন্য। এখানে বর্ষকালভর ‘প্রেমের অভিষেক ঘটেছে এক সম্পূর্ণ নিবেদিতা রমণীর কাছে, তার মন এখানে ঢাকা আছে ‘অভিনব লাবণ্যবসনে’, সুভদ্রার হৃদয়ে অর্জুন মহীয়ান সম্রাট।
এক বৎসর পর সুভদ্রাকে নিয়েই যেতে হয়েছে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানীতে। সেখানে দ্রৌপদীর বীর্য-সত্তা মেনে নিয়েই সুভদ্রা কিন্তু অন্তঃস্বত্তা হয়েছেন কুমার অভিমন্যুর জন্ম দেওয়ার জন্য।
পূর্বে দেখেছি, হৃদয়ের গভীর ক্ষত থেকে দ্রৌপদী সুভদ্রার সামনে যে হতাশা উচ্চারণ করেছিলেন তোমার স্বামী শত্রুশূন্য হোক– সেই হতাশা সম্পূর্ণ সত্য ছিল কিনা জানি না। কিন্তু সুভদ্রা যে আপন গুণেই তার প্রিয়তম স্বামীর হৃদয় হরণ করেছিলেন, তা অন্তত একটি সূত্রে বোঝা যায়। লক্ষণীয়, দ্রৌপদীর গর্ভে পঞ্চ পাণ্ডবের পাঁচটি পুত্র হয়েছিল এবং অর্জুনের ঔরসজাত পুত্রটির নাম ছিল শ্রুতকীর্তি। কিন্তু সেই শ্রুতকীর্তি কি কোনও দিন সুভদ্রার গর্ভজাত আর্জুনি অভিমন্যুর সমকক্ষ হতে পেরেছেন?
সুভদ্রা আসলে এতটাই মানিয়ে নিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে যে, সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যুকে দ্রৌপদী নিজের ছেলের অধিক ভালবাসতেন। সুভদ্রার কী অসাধারণ গৃহমেধী বুদ্ধি যে, দ্রৌপদীর বুদ্ধিকেও তিনি নিজের অনুকূলে লালিত করেছিলেন শুধু আনুগত্যের মহিমায়। হয়তো বা আনুগত্যেরও এক অহংকার আছে, যা বাইরে থেকে একেবারেই বোঝা যায় না, কারণ এই অহংকারের কোনও অভিব্যক্তি নেই, অবশ্য অহংকার না বলে এটাকে অভিমানহীন অনুকূল আচরণ বলাই ভাল। দ্রৌপদীর অনন্ত বিদগ্ধতা, মনস্বিতা এবং দৃপ্তির আড়ালে অর্জুন এখানে নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে কতদিনই বা আর থাকতে পরেছেন সুভদ্রা। ইন্দ্রপ্রস্থের অন্তঃপুরে থাকার সময় একদিন যমুনা-পুলিনে বনভোজনের সুযোগ এসেছিল এবং সেটা তার বৈবাহিক পর্বের পরপরই মনে হয়। কেননা বিয়ের আসর সেরে সকলে চলে যাবার পর কৃষ্ণ তখনও খাণ্ডবপ্রস্থে রয়ে গেছেন। এই সময়েই দুই সখা কৃষ্ণ এবং অর্জুন যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে যমুনাতীরে ধীরসমীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। রাজধানীতে তখন প্রবল গরম পড়েছে। অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন– এত গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না, চলো যাই যমুনাতীরে– উষ্ণানি কৃষ্ণ বর্তন্তে গচ্ছাবো যমুনাং প্রতি। এই সফরে সুভদ্রা ছিলেন, দ্রৌপদীও ছিলেন। দুই বধূর সম্পর্ক এতটাই ভাল যে, যমুনাতীরের অস্থায়ী আবাসে যে সব অনুগতা রমণীরা নাচ দেখিয়েছিল, গান করেছিল, দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা তাদের প্রচুর জামা-কাপড়, প্রচুর গয়নাগাটিও দিয়ে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী চ সুভদ্রা চ বাসাংস্যাভরণানি চ।
দ্রৌপদীর নাম আগে থাকায় বুঝতে পারি তার ভূমিকাই প্রধান, কিন্তু পাশেই সুভদ্রা থাকায় এটাও বুঝতে পারি যে, সুভদ্রা দ্রৌপদীর কাছে সতীন-কাটা হয়ে ওঠেননি। আপন আনুগত্যময়ী বুদ্ধিতে সুভদ্রা সাহংকারে নিজকক্ষে প্রতিষ্ঠিত। ঠিক এই যমুনাবিহারের পরেই খাণ্ডবপ্রস্থের বন দহন করে ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি হয়েছে। আর ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি হওয়া মানেই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ এবং জ্ঞাতিবিরোধের ঈর্ষা-দ্বেষ, রাজনীতি সব আরম্ভ হয়ে গেল। এইসব সময়ে সুভদ্রা একেবারেই পর্দার আড়ালে। তবে সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যুকে ইতোমধ্যেই অর্জুন অস্ত্রশিক্ষায় সুশিক্ষিত করে ফেলেছেন নিজের হাতে। দ্রৌপদীর গর্ভে জাত পুত্রদের ক্ষেত্রে কতখানি উৎসব-আড়ম্বর হল, সে খবর মহাভারতের কবি দেননি, কিন্তু অগ্ৰজাত অভিমন্যু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির দু’হাতে অর্থ বিলিয়েছেন ব্রাহ্মণদের। পাঁচ পাণ্ডব ভাইদের কাছেই অভিমন্যু সৌভদ্র ভীষণ ভীষণ প্রিয় পিতৃণাঞ্চৈব সর্বেষাং প্রজানামিব চন্দ্ৰমাঃ। বস্তুত অভিমন্যু যে সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের, এমনকী দ্রৌপদীরও নয়নের মণি হয়ে উঠলেন, এর জন্যও তো সুভদ্রাকেই ধন্যি মানতে হবে। বস্তুত এখানেও সেই আনুগত্য এবং অনুকূল ভাবনার দীপ্তি আছে, যেখানে সুভদ্রা আপন অঞ্চলছায়ায় অভিমন্যুকে ধরে রাখেননি। তাকে বাড়তে দিয়েছেন দ্রৌপদীর তত্ত্বাবধানে, পঞ্চপাণ্ডবের একত্রবদ্ধ ছত্রচ্ছায়ায়।
ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের পরপরই সেই বিষময় পাশাখেলা আরম্ভ হয়েছে, পাণ্ডবদের এবং দ্রৌপদীর কপালে জুটেছে বনবাস। পুত্রদের বনবাসকালে জননী কুন্তী রাজবাড়িতে বিদুরের আশ্রয়ে থেকে গেলেন। কিন্তু অন্যেরা কে কোথায় গেলেন যে সেই মুহূর্তে জানাননি মহাভারতের কবি। সেই সময় উভয় পক্ষের ক্রোধোক্তি এবং দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা এতটাই বর্ণময় এবং বিপ্রতীপভাবে ভাস্বর যে, এইসব ক্ষুদ্র সংবাদ দেবার উপায় হয়নি মহাকবির। কিন্তু তেরো বছর পর বিরাট রাজার বাড়িতে কুমারী উত্তরার সঙ্গে যখন অভিমন্যুর বিবাহ আরম্ভ হল, তখন দেখলাম– মাতামহ দ্রুপদের বাড়ি থেকে দ্রৌপদীর ছেলেরা উপস্থিত হলেন বিবাহ-বাসরে, আর ওদিকে অভিমন্যু এবং তার মা সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম এবং অন্যান্য যাদব-বৃষ্ণি-প্রধানেরা দ্বারকা থেকে এলেন বিরাটের বাড়িতে অভিমন্যুমুপাদায় সহ মাত্রা পরন্তপ। আমরা বুঝতে পারি– পাণ্ডবদের তথা দ্রৌপদীর বনবাসকালে সুভদ্রা বাপের বাড়িতেই অর্জুন-বিরহ সম্পন্ন করেছেন এবং অভিমন্যুও দিন কাটিয়েছেন মামাবাড়িতে কৃষ্ণের আদরে।
কিন্তু এতকাল বনবাসে দিন কাটিয়েও অর্জুন যে সুভদ্রা বা অভিমন্যুর কথা ভোলেননি, তা বোঝা যায়– উত্তরার বিবাহ-প্রস্তাব উঠতেই অর্জুন সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যুর কথা বলেছেন গর্বভরে। বলেছেন- আমার সেই ছেলে বাসুদেব কৃষ্ণের বোনের ছেলে স্বস্ত্রীয়ো বাসুদেবস্য সাক্ষাদ্দেবশিশুৰ্যথা। লক্ষণীয়, এখানে কিন্তু দ্রৌপদীর গর্ভজাত অর্জুনের ছেলে শ্রুতকীর্তির কথা আসেনি, অথচ দ্রৌপদী তখনও বনবাসের তেরো বছরের সহবাস পরিচয়ে বিরাটনগরে গভীরভাবে উপস্থিত এবং দ্ৰৌপদীও অর্জুনের মুখে অভিমন্যুর বিবাহ প্রস্তাবে এতটুকুও বিসদৃশ অন্যায় কিছু দেখেননি। তিনি এতটাই স্নেহ করতেন অভিমন্যুকে অথবা সুভদ্রাকেও। সুভদ্রার নিরুচ্চার অথচ মোহময় ব্যক্তিত্বে দ্রৌপদী এতটাই মোহিত ছিলেন যে, সুভদ্রার এই অসামান্য বীর পুত্রটিকে দ্রৌপদী নিজের ছেলেদের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। আমরা বলব এখানেও সুভদ্রাকেই বাহবা দিতে হবে, কেননা নিজের কুক্ষিজাত পুত্রকে জ্যেষ্ঠা সপত্নীর অনুশাসনে রাখাটা খুব সহজ কাজ নয়। সুভদ্রা সেটা করতে পেরেছেন নিরুচ্চারে, অন্যাভিলাষিতাহীন আনুগত্যের মহিমায়। সুভদ্রার এই ছেলেটিকে কতখানি স্নেহ করতেন অথবা ভরসা করতেন দ্রৌপদী, সেটা সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হবে একটি উদাহরণ থেকেই।
বিরাটের রাজধানীতে তখন বনবাসোত্তর যুদ্ধোদ্যোগের মিটিং বসেছে। আসন্ন এই ভয়ংকর যুদ্ধে রক্তক্ষয় যাতে না হয় তার জন্য কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন– সকলেই আগে শান্তির চেষ্টা করতে বলছেন; দ্রৌপদী অসম্ভব ক্রুদ্ধ হলেন এবং নিজের অপমানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃষ্ণকে শান্তির পথে যেতে বারণ করেছেন। তবে এই মুহূর্তে বুঝি দুর্যোধন কর্ণ- দুঃশাসনের চেয়েও তার বেশি রাগ হচ্ছে ভীম-অর্জুনের ওপর– যাঁরা একের পর এক, এবং বারংবার দুঃশাসন-কর্ণ-দুর্যোধনকে মারার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে হঠাৎ এখন শান্তির কথা বলছেন অসীম ক্ষমায়। দ্রৌপদী ক্রুদ্ধ হয়ে শান্তির দৌত্যে উন্মুখ কৃষ্ণের দিকে অগ্নিচক্ষুতে তাকিয়ে তার কেশপাশ ধারণ করেছেন ডান হাতে এবং বলেছেন– এই সেই কেশপাশ যা দুঃশাসন দুর্যোধনের লালসায় কলঙ্কিত। সন্ধি করার আগে আমার এই অপমান যদি ভীম-অর্জুনের স্মরণে না থাকে এবং তারা যদি এখন যুদ্ধ করতে না চান, তবে যুদ্ধ করবেন আমার বাপ-ভাইরা, যুদ্ধ করবে আমার বীর পুত্রেরা এবং আমার পাঁচ ছেলেই অভিমন্যুকে সামনে রেখে তার অধিনায়কত্বে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে– অভিমন্যুং পুরস্কৃত্য যোৎস্যন্তে কুরুভিঃ সহ।
অর্থাৎ অভিমন্যুর ওপর দ্রৌপদীর এতটাই অধিকার যে, এখানে সুভদ্রা কিংবা অর্জুনের কোনও সম্মতি-অনুমতি নেবার কোনও প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি। আমরা বলব– এই অধিকার অভিমন্যুর ওপর যতখানি, তার চেয়েও বেশি কি সুভদ্রার ওপর নয়? নিজের পাঁচ ছেলেকে অভিমন্যুর আনুগত্যে স্থাপন করাটাও কি সুভদ্রার প্রতি তার স্নিগ্ধ সম্মাননার পরিচায়ক নয়? আসলে সুভদ্রার এই অসামান্য পুত্রটিকে নিজের পুত্রদের চেয়েও অধিক মনে করতেন দ্রৌপদী। এ-বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রমাণটা পাওয়া যাবে অভিমন্যুর মৃত্যুর কালে। অভিমন্যু যখন সপ্তরথীর হাতে মারা পড়লেন, তখন সুভদ্রা এবং অভিমন্যুপত্নী উত্তরাকে যতখানি সান্ত্বনা দেবার কথা ভেবেছেন পাণ্ডবরা ঠিক ততখানিই ভেবেছেন দ্রৌপদীর কথা– দ্রৌপদী চৈব দুঃখার্তা তে চ বক্ষ্যামি কিংহম।
হঠাৎ করেই সুভদ্রা-দ্রৌপদীর প্রসঙ্গে অভিমন্যুর মৃত্যুর কথা এসে গেল। বস্তুত এখনই এ প্রসঙ্গ আসবার কথা। পাণ্ডবদের বনবাস-আরম্ভের তেরো বছর পর অভিমন্যুর বিয়ের সময় বিরাট রাজধানীর অদূরে উপপ্লব্য উপনগরীতে পাণ্ডবদের যে অস্থায়ী আবাস তৈরি হয়েছিল, সেখানেই পাণ্ডবদের সৈন্যসংগ্রহ শুরু হয় এবং সেখান থেকেই কুরুক্ষেত্রে তাদের যুদ্ধযাত্রাও শুরু হয়। যুদ্ধকালে পাঞ্চালী কৃষ্ণা পিতা দ্রুপদরাজার স্ত্রীদের সঙ্গে উপপ্লব্যেই ছিলেন, কিন্তু সুভদ্রা এবং অভিমন্যুর পত্নী উত্তরা কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের যুদ্ধশিবিরের নির্দিষ্ট কোনও অস্থায়ী কক্ষাবাসেই থাকতেন বলে মনে হয়। অভিমন্যুর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে, অতএব যুদ্ধশিবিরের কাছাকাছি কোনও ব্যক্তিগত শিবিরে থাকাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। আর সুভদ্রা হয়তো অর্জুনের ন্যূনতম পরিচর্যার কারণেই যুদ্ধশিবিরের কাছাকাছি ছিলেন। এত কথা এইজন্য বলছি যে, বিয়ের পর এক বছর দ্বারকায় এবং আর কয়েক বছর মাত্র ইন্দ্রপ্রস্থে অর্জুনের সাহচর্য-লাভ করা ছাড়া সুভদ্রাও তো পাণ্ডবদের সম্পূর্ণ বনবাসকালে বাপের বাড়ি দ্বারকাতেই ছিলেন। আর তারপরেই তো এই যুদ্ধ লাগল। ফলত সেই সভাপর্বে খাণ্ডব-দহনের পর ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি হবার কাল থেকে উদ্যোগ পর্ব পর্যন্ত সুভদ্রার কোনও প্রসঙ্গই নেই, সম্পূর্ণ যুদ্ধকালেও প্রায় তিনি অনুপস্থিত।
এবং এটাই হবার কথা ছিল। কেননা তিনি রাজনীতি নিয়েও মাথা ঘামান না, কৌরব পাণ্ডবের জ্ঞাতিবিরোধেও তিনি এতটুকু কৌতূহলী নন। একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার নিঃশব্দ পদসঞ্চার ঘটে বলেই অভিমন্যুর মৃত্যুর ঠিক পরেই আমরা প্রথম বুঝতে পারি, তিনি পাণ্ডব-শিবিরেই পুত্রবধূ উত্তরার সঙ্গে আছেন এবং তাও বুঝতে পারি অভিমন্যুর মতো এক মহাবীরের যুদ্ধ সমাধির পর! সুভদ্রা এতটাই আড়ালে থাকতে ভালবাসেন। কিন্তু অভিমন্যু মারা যাবার সময় এমন মানুষকেও আড়াল থেকে বেরোতে হল। আসলে সুভদ্রার মধ্যে এমনই এক স্বপ্রকাশের অবগুণ্ঠন আছে, যা প্রায় অভেদ্য এবং দুর্গম। অভিমন্যুর মৃত্যুসংবাদ প্রথম পেয়েছেন যুধিষ্ঠির। তার অপরাধবোধ এবং বিষাদের অন্ত ছিল না, কারণ প্রধানত তিনিই অর্জুনের অনুপস্থিতিতে অভিমন্যুকে সপ্তরথীর চক্রব্যুহে প্রবেশ করার জন্য উৎসাহিত করেন। অভিমন্যুর মৃত্যুতে যুধিষ্ঠিরের বাঁধভাঙা বিলাপের মধ্যে সেই ভয়ংকর যন্ত্রণা ছিল যেখানে তিনি ভাবছেন প্রিয় পুত্রকে যিনি আর দেখতে পাবেন না, সেই সুভদ্রার সামনে গিয়ে আমি দাঁড়াব কেমন করে সুভদ্রাং বা মহাভাগাং প্রিয়ং পুত্রমপশ্যতীম।
অর্জুনের চিন্তাও একই রকম ছিল, কী করে তিনি সুভদ্রার মুখোমুখি হবেন, অবশ্য অর্জুনের বক্তব্যে দ্রৌপদীর ভাবনাও ছিল, যা আমরা পাণ্ডবদের জবান হিসেবে চিহ্নিত করেছি। কিন্তু সুভদ্রার মতো আত্মগুণ্ঠিত ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়া আর দ্রৌপদীর মতো বিকীর্ণ ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যে তফাত আছে। এটা সোজাসুজি প্রমাণ দেওয়া যাবে না, তবে পরোক্ষ সূত্রে অনুমান করি– দ্রৌপদীর কাছে অভিমন্যুর মৃত্যুকাহিনি শোনালে তার প্রথম উত্তর হত– অভিমন্যু না হয় চক্রব্যুহে প্রবেশ করল, কিন্তু তোমরা তখন কী করছিলে বসে বসে? না, মহাভারতে এটা বলা নেই, তবে অনুমান হয় তার নিজের পঞ্চপুত্রের মৃত্যুঘটনা থেকে। পুত্রদের মৃত্যুতে তার বিলাপ-মূৰ্ছা যা কিছুই হোক, তার শেষ বক্তব্য ছিল যুধিষ্ঠিরের কাছে বেশ তো আছ, মহারাজ! তোমার রাজ্যলাভের পথ তো এখন পরিষ্কার। কিন্তু জেনে রাখো আজ, আজই যদি অশ্বত্থামা তার সহায় সঙ্গীদের নিয়ে নিহত না হন, তা হলে আমি শুধু দিন-দিন উপোস করেই আত্মহত্যা করব– তস্য পাপকৃতো দ্রৌণে ন চেদদ্য ত্বয়া মৃধে।
ঠিক এর প্রতিতুলনায় সুভদ্রাকে দেখলে পরে কত কল্যাণী মনে হয়। এই কল্যাণী মূর্তিরও এমন একটা তেজ আছে, যেখানে মানুষ সহসা তার মুখোমুখি হতে পারে না, সে নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। ঠিক এই কারণেই অর্জুন নিজে তার সামনে আসতে পারেননি। তিনি কৃষ্ণ-সখাকে বলেছেন– তুমি তোমার বোনের কাছে একবার যাও। পুত্রবধূ উত্তরার সঙ্গে বোনকে একটু সান্ত্বনা দাও। সুমধুর সান্ত্বনা-বাক্য তো তুমি বলবেই এবং সত্য ঘটনার বিবরণ দিয়ে সমস্ত যুক্তি দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেবে। তুমি যাও একবার, বোনের কাছে যাও আশ্বাসয় সুভদ্রাং ত্বং ভগিনীং সুষয়া সহ।
মহাভারত লিখেছে- কৃষ্ণ সুভদ্রার সঙ্গে কথা বলার জন্য অর্জুনের ঘরে গেলেন। আমরা এই কথাই বলেছিলাম। বলেছিলাম- এই যুদ্ধ সমারোহের মধ্যেও সেনানায়ক হিসেবে অর্জুনের নিজস্ব একটি শিবির ছিল এবং সুভদ্রা নিজের বাসকৃচ্ছুতা মেনে নিয়ে হয়তো অস্ত্র-যুদ্ধ ক্লান্ত অর্জুনের সেবা করার জন্যই তার শিবিরে থাকতেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিরাটনন্দিনী পুত্রবধূ উত্তরাও অভিমন্যুর সঙ্গে তার সেদিন বিয়ে হয়েছে। কৃষ্ণ অর্জুনের ঘরে প্রবেশ করলেন এবং এটা বুঝলেন যে, সুভদ্রা তার প্রিয় পুত্রের মৃত্যুসংবাদ আগেই পেয়েছেন। কৃষ্ণ আর তাই কোনও ভণিতা করলেন না। স্নিগ্ধ সান্ত্বনা-বাক্যে বরং তাঁর পুত্রগৌরব বাড়িয়ে তুলে বললেন ছেলের জন্য দুঃখ কোরো না, বোন! তুমি না বৃষ্ণিবংশের মেয়ে। সমস্ত প্রাণীকেই একদিন মরতে হয়, এই সাধারণ বাক্য ছাড়াও যে। কথাটা বড়, সেটা হল- তোমার ছেলে ক্ষত্রিয় ঘরের জাতক, যুদ্ধ করে সে মরতে ভয় পায় না। তোমার ছেলে ক্ষত্রিয়ের উপযুক্ত এক সাম্মানিক মরণ লাভ করেছে, তার জন্য তুমি দুঃখ পেয়ো না- সদৃশং মরণং হ্যেতত্তব পুত্রস্য মা শুচঃ।
ক্ষত্রিয়ের বীরগতির বিষয়টাকেই বড় করে দেখিয়ে কৃষ্ণ আবারও বললেন– তোমার। ছেলে হল বাপকা বেটা, অর্জুনের মতোই তার অক্ষমতা এবং পরাক্রম। শত্রুপক্ষের একটার পর একটা কত শত্রুকে জয় করে সে মহাবীরের অভীষ্ট গতি লাভ করেছে। অন্য মানুষ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা, বেদবিদ্যার দ্বারা অথবা প্রজ্ঞার মাধ্যমে যে স্বর্গগতি লাভ করে, তোমার ছেলে বীরকর্ম করেই সেই ক্ষত্রিয়গতি, সেই স্বর্গলাভ করেছে। সেই দিক থেকে দেখলে সুভদ্রা! তুমি যেমন এক মহাবীরের ঘরণী বটে, তেমনই এক মহাবীরের জননীও বটে, বীরত্বের এই একান্ত আত্মীয় পরিবেশের মধ্যে এতদিন তুমি আছ, অতএব অভিমন্যুর জন্য তোমার শোক করা চলে না– বীরসূ বীরপত্নী ত্বং বীরজা বীরবান্ধবা। শত্রুপক্ষে জয়দ্রথ যা করেছে, তার ফল সে কালকেই পাবে। কিন্তু তোমার ছেলে যা করেছে তাতে সে তার পিতৃপক্ষ, মাতৃপক্ষ সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। হাজার হাজার শত্রু ক্ষয় করে সে নিজে মারা গেছে। তোমারই ছেলে স্বর্গে গেছে গো, যে স্বর্গ আমরা চাই, যে স্বর্গ সমস্ত ক্ষত্রিয় বীরেরা চায়– ক্ষত্ৰধর্মং পুরস্কৃত্য গতঃ শূরঃ পরাং গতিম।
কৃষ্ণ সান্ত্বনা দিলেন বটে, তবে যে মায়ের যুবক ছেলে মারা গেছে এবং সে ছেলের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’মাস, সেই মাকে সান্ত্বনা দিয়ে যে কোনও লাভ হবে না, সেটা তিনি যথেষ্ট বোঝেন। সুভদ্রাকেও শান্ত রাখা যায়নি। বরঞ্চ অন্যত্র সাধারণ জীবনে যা হয়, কৃষ্ণের কথা শুনে সুভদ্রার জননী-হৃদয় একেবারে উদ্বেল উন্মথিত হয়ে উঠল। দাম্পত্য জীবনের অনেকটা সময় ধরেই স্বামী অর্জুনের অনুপস্থিতিতে এই বীর পুত্রটিকে নিয়েই সুভদ্রার দিন কেটেছে বাপের বাড়িতে। আজ সেই পুত্রের মৃত্যুতে তার শোক এত তাড়াতাড়ি শান্ত হবে কী করে? কৃষ্ণের সান্ত্বনায় তিনি আরও ভেঙে পড়লেন একেবারে।
তবে হ্যাঁ, সুভদ্রা তো সুভদ্রাই। রুষ্ট হলেও তিনি উন্মত্ত হয়ে ওঠেন না, শোকে মথিত হলেও তার বিষাদসিন্ধু বেলাভূমি অতিক্রম করে না। বরঞ্চ তার শোকের মধ্যে সদ্য যৌবনে উপনীত তার পুত্রের কৈশোরগন্ধী মুখখানিই বারবার ফিরে আসে। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল– কেমন মন্দ এক জননী আমি, কেমন এই জননীর মন্দভাগ্য যে, বাপের মতো পরাক্রমশালী হয়েও আমার ছেলে আজ যুদ্ধে মারা গেল। যারা যুদ্ধস্থলে রয়েছে, তারা আজ কেমন করে দেখছে বাছা! তোমার সেই সুন্দর মোহন মুখখানি, আজ যেটা যুদ্ধভূমির ধুলোয় ধূসর হয়ে পড়ে আছে–মুখং তে দৃশ্যতে বৎস গুণ্ঠিতং রণরেণুনা। তুই তো যুদ্ধ থেকে পালিয়ে ফিরে আসার ছেলে নোস বাছা! তাই তোর অত সুন্দর শরীরটাকে সম্মুখ সমরে অস্ত্রের ক্ষতে নবোদিত চাঁদের মতো রক্তলাল দেখবে সবাই চারূপচিতসর্বাঙ্গং স্বক্ষং শস্ত্ৰক্ষতাচিত– আমি তো ভাবতেই পারি না যে-শরীর তোর কত শত আস্তরণে নরম বিছানায় এলিয়ে থাকত, সেই শরীর অমন কঠিন মাটিতে পড়ে আছে কী করে! শেয়াল, শকুন আর মাংসাশী পশু-পাখির আনাগোনায় কেমন অবস্থায় পড়ে আছে তোর শরীরটা, আমি ভাবতে পারি না– কণ্বমন্বাস্যতে সোহদ শিবাভিঃ পতিতা মৃধে!
পুত্রশোকে অন্যদের প্রতি সুভদ্রার তিরস্কারের ভাষাতে তীক্ষ্ণতাও আসে বটে, কিন্তু সেখানেও তিরস্কারের চেয়ে তার পুত্রস্নেহ এবং জননীর আর্তনাদ তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে, যা দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে একেবারেই উলটো। এখানে সুভদ্রা একবার বলেন- পাণ্ডব-পাঞ্চাল বৃষ্ণিবীরেরা সবাই থাকতে কেমন করে অনাথের মতো তোকে মরতে হল, বাছা! পর মুহূর্তেই তার মাতৃহৃদয় উছলে পড়ে; সুভদ্রা বলেন- তোকে দেখে-দেখেই আমার আশ মেটে না, বাছা! সেখানে তোকে না দেখতে পেয়ে আমি তো মরেই যাব একদিন। অমন সুন্দর তোর চুল, অমন সুন্দর চোখ, কত মিষ্টি কথা তোর মুখে শুনি, এই মুখটা অক্ষত অবস্থায় আমি আবার কবে দেখতে পাব, বাছা তব পুত্র কদা ভূয়ো মুখং দ্রক্ষ্যামি নিব্রণম্।
সুভদ্রা প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছেন। অভিমন্যুর বয়স তো বেশি নয়। তাই পূর্বস্মৃতিতে অভিমন্যুর একান্ত শিশুস্মৃতি তার মনে আরও তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। সুভদ্রার বিলাপিনী ভাষা মর্মে এসে আঘাত করে তখন, যখন তিনি বলেন– আয় বাছা! আয় আমার দুধ খাবি আয়। কতক্ষণ তোকে দেখিনি, আমার বুক ফুলে আছে দুধে, আমার কোলে উঠে দুধ খাবি আয়– এহেহি তৃষিতো বৎস স্তনৌ পূর্ণেী পিবাশু মে। পর মুহূর্তেই ধিক্কার নেমে আসে সুভদ্রার বাস্তব যন্ত্রণা থেকে। তিনি বলেন যে ভীমসেনের শক্তি আর বলের কথা শুনি এত, আমার ধিক্কার রইল তার জন্য। ধিক্কার সেই মহাবীর অর্জুনের ধনুষ্মত্তায়, কেমন ধনুক ধারণ করেন তিনি, কেমনই বা সেই ধনুর্বিদ্যার শিক্ষা, যা প্রয়োজনের সময় তাঁর প্রিয় পুত্রকে বাঁচাতে পারে না– ধিগবলং ভীমসেনস্য ধি পার্থস্য ধনুষ্মতাম। আমার পিতৃকুলের বৃষ্ণিবীরদেরও আমি ধিক্কার দিই, আর ধিক্কার দিচ্ছি পাঞ্চাল বীরদের– তারা থাকতেও কেন আমার ছেলে অনাথের মতো মারা গেল। সে নাকি বাসুদেব কৃষ্ণের ভাগনে, আর গাণ্ডীবধন্থা অর্জুনের ছেলে, সেই অতিরথ বীরকে আমি নিহত হতে দেখছি কেমন করে।
এই উষ্ণ-কোমল তিরস্কার-বিলাপের খানিক পরেই আমরা কিন্তু সুভদ্রাকে এক অসামান্য দার্শনিক নির্বিগ্নতায় দেখতে পাচ্ছি। সুভদ্রা মনুষ্য জীবনের জলবুদ্বুদোপম চঞ্চল্লতার কথা বলছেন এবং ভাবছেন– অভিমন্যুর তরুণী স্ত্রীটিকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন! সুভদ্রা এটাও বেশ ভালই জানতেন যে, তার পুত্রবধূ উত্তরা সন্তানসম্ভবা। সুভদ্রা দুঃখ পাচ্ছেন যে সময়ে আমার নাতির জন্মে সংসার-বৃক্ষ ফলে-ফুলে ভরে ওঠার কথা, সেই সময়ে অকালে আমার ছেলে অভিমন্যু, যাকে দেখার জন্য আমি সদা সর্বদা উদগ্রীব হয়ে থাকি, সেই পুত্র আমাকে ছেড়ে চলে গেল– বিহায় ফলকালে মাং সুগৃদ্ধাং পুত্ৰদৰ্শনে। অথবা মৃত্যু বুঝি এক অদ্ভুত নিয়তি। যেখানে স্বয়ং কৃষ্ণ তার চিরকালের রক্ষাকর্তা হয়েও এই অন্তিম কালে তিনি তাকে বাঁচাতে পারলেন না।
মৃত্যুর অস্থির এই বিনিপাতের মধ্যে দার্শনিক বোধ খানিকটা জাগ্রত হতেই পরলোকগামী পুত্রের জন্য অনন্ত শুভৈষণা আর স্নেহব্যক্তি প্রকট হয়ে উঠছে সুভদ্রার মুখে। সংসার জীবনে ভাল কাজ করার জন্য যে শুভলোক নির্দিষ্ট আছে, ত্যাগীব্রতীর কৃচ্ছসাধনের জন্য শাস্ত্র যে-সব শুভফল উচ্চারণ করেছে, সে সব শুভ একত্রে অভিমন্যুর জন্য প্রার্থনা করেন সুভদ্রা। এই প্রার্থনার সামান্য একটু আভাস দিলে সুভদ্রার আবেগটুকু যেমন বোঝা যায়, তেমনই বোঝা যায়– ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি ক্রোধ এবং শোকে কাউকে দোষারোপ করেন না, যদি বা কোনও আবেগঙ্খলিত মুহূর্তে তা করেনও, তবুও তার স্বস্থ দার্শনিক বোধে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে না।
আমরা অভিমন্যুর জন্য সুভদ্রার আর্ত অনুভূতিগুলিও যে খানিক বিবৃত করার চেষ্টা করছি, তার কারণ এই যে, সারা মহাভারত জুড়ে তিনি কথা বলেছেন কতটুকু, নিজের স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব সকলের সামনে প্রকাশ করেছেন কতটুকু? অতএব তিনি যেটুকু কথা বলেন, সেটুকুই তার জীবনবোধের নিরিখ হয়ে ওঠে। আরও একটা কথা এখানে বলতে হয়– আমাদের ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র এবং পুরাণ কর্মানুসারে ফললাভ ঘোষণা করে। শুভ কর্মের জন্য ইহলোকে যত সুখের কথা বলা আছে, পরলোকে তার শতগুণ সুখ-সমৃদ্ধির কথা বলা আছে- হয়তো বা সেই সুখের বিশ্বাসেও মানুষ যাতে শুভকর্ম করে, তার জন্যই এতসব পুণ্য কর্মের বিধান। এখানে আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় হল– যজ্ঞ, দান, তপস্যা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ ইত্যাদি পুণ্য কর্ম যাঁরা করেন, তাদের তুলনায় ক্ষত্রিয় পুরুষ, এবং রাজ্যরক্ষাকারী রাজা– এঁদের অনেকটাই ছাড় দেওয়া আছে। শাস্ত্র নির্দেশ দিয়েছে– ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ এবং রাজারা যেহেতু প্রজারক্ষণ, প্রজাপালন এবং প্রজাকল্যাণের জন্য জন্মাবধি মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, বিশেষত রাষ্ট্ররক্ষার জন্য শত্রুর মুখোমুখি হয়ে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেন, তাই ধর্মবিহিত যজ্ঞ, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য– এসব তাঁদের ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে প্রযোজ্য হলেও এগুলি তাদের বর্ণধর্ম নয়। শাস্ত্র এই কথা বলে, কিন্তু সত্যই প্রজাকল্যাণ এবং রাষ্ট্র-প্রজা-রক্ষণের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলে সেই পুণ্যগতি হয় কিনা, সেই বিষয়ে মানুষের সামান্য হলেও সংশয় থাকে। সুভদ্রা পুত্রের জন্য সেই সংশয়িত প্রার্থনাই জানাচ্ছেন বিধাতার কাছে।
সুভদ্রা বলেছেন– যাঁরা যজ্ঞ করেন, যাঁরা দানশীল, যাঁরা জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ, যাঁরা অসীম কৃচ্ছতায় তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান, তারা সবাই পরলোকে যে পুণ্যগতি লাভ করেন, সে গতি তুমি লাভ করো, বাছা– যা গতিস্তামবাপুহি। কেউ সামান্য উপকার করলেও যাঁরা ভোলেন না সেইসব কৃতজ্ঞ পুরুষের যে গতি হয়, বদান্য মানুষের যে গতি হয়, গুরুশুশ্রষাকারীদের যে গতি হয়, সহস্ৰমুদ্রা দক্ষিণা দিতে পারেন যাঁরা, তাঁদের যে গতি হয়, তুমি সেই গতি লাভ করো, বাছা। যাঁরা মহাবীর, যুদ্ধ করতে হলে যাঁরা পালিয়ে আসেন না কখনও, যারা বহু শত্রু নিধন করে নিজেও যুদ্ধে নিহত হন, তাঁদের যে গতি হয়, তুমি সেই গতি লাভ করো, বাছা হত্বারীন্নিহতনাঞ্চ সংগ্রামে তাং গতিং ব্রজ।
হয়তো এই শেষের যে কল্পটি, সেটাই অভিমন্যুর ক্ষেত্র সম্বন্ধে সর্বাধিক প্রযোজ্য বটে এবং শাস্ত্রকারেরা শত শতবার সংগ্রামী ক্ষত্রিয়ের এই স্বর্গগতি লাভের কথা বলেছেন। কিন্তু ক্ষত্রিয়-বীরের ঘরে জন্ম এবং ক্ষত্রিয়-বীরের ঘরণী হবার সুবাদে সুভদ্রা জানতেন যে, রাজনীতি বা দণ্ডনীতি শাস্ত্রের যুদ্ধনীতিতে ‘সৈন্য-প্রোৎসাহন-নীতি’ বলে একটা কল্প আছে। এটা আসলে যুদ্ধের আগে সেনা- সৈন্যদের ঐহিক এবং পারত্রিক লাভের লোভ দেখানো। এটা এখনও চলে, তবে পারত্রিক স্বর্গলাভের চেয়েও এখন জাতীয়তাবাদী ভূমিকা, দেশের জন্য, মাতৃভূমির জন্য শহিদ হওয়া অথবা ‘মার্টারডম’-এর ওপর জোর দেওয়াটা সৈন্য প্রোৎসাহনের অন্যতম রীতি। প্রাচীনকালে এই ‘প্রোৎসাহন’-কর্ম বা ‘বাক-আপ’ করার কাজটা চলত স্বর্গ-নরকের সংস্কার এবং বিশ্বাসে। ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিতে যে সিদ্ধিলাভ করতে চায়, তাকে এইভাবেই উৎসাহিত করে বলা হত যে, সম্মুখসংগ্রামে মৃত্যু তার স্বর্গের পথ প্রশস্ত করবে, নইলে অনন্ত নরক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখা যাবে– যুদ্ধের আগে সেনাছাউনিতে বক্তৃতা দেবার সময় রাজা মন্ত্রী এবং রাজপুরোহিতদের দিয়ে বলাতেন যে, দ্যাখো বাপু! বেদে আছে এসব কথা। বেদ বলেছে–”ব্রাহ্মণেরা স্বৰ্গকামনায় সারা জীবন অনেক যজ্ঞ-তপস্যা করে যে ফল পান, যুদ্ধবীরেরা যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে এক মুহূর্তে সেই সেই ফল অতিক্রম করেন। রাজার খেয়ে-পরে, রাজার বেতন ভোগ করে কোনও বীর যদি তার স্বামী রাজার জন্য যুদ্ধ না করে, তবে নরকভোগ আছে কপালে।
সাধারণ সৈন্যদের ক্ষেত্রে এইসব ফলোভের ঘোষণার একটা যৌক্তিকতা এবং কার্যকারিতা অবশই ছিল বা এখনও তা অন্যভাবে আছে, কিন্তু সেকালের মহাবীর ক্ষত্রিয়দের কাছে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করার ব্যাপারটা একটা সাংস্কারিক বিশ্বাসের মধ্যে পড়ত, এমনকী তার মধ্যে এটা একটা চরম রোমাঞ্চ হিসেবেও কাজ করত। তা নইলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধমুখে দুই পক্ষের সৈন্যমধ্যে রথস্থিত অবসন্ন মহাবীর অর্জুনকেও তো কৃষ্ণ ওই একই কথা বলেছেন– কী অদ্ভুতভাবে তোমার সামনে এই স্বর্গের দুয়ার খুলে গেছে, অর্জুন যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম– অথবা, এইরকম একটা ধর্মযুদ্ধের সুযোগ পেলে ক্ষত্রিয়রা ভীষণ খুশি হয়, অর্জুন– সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্। অতএব বুঝতে পারি যে, ক্ষত্রিয়ের এই সাংস্কারিক বিশ্বাসে সুভদ্রারও বিশ্বাস ছিল, এগুলি সৈন্য-প্রোৎসাহনের সামান্য স্তোকবাক্য নয় তার কাছে। বিশেষত তার পুত্র অভিমন্যু এক অতিরথ মহাবীর বলে চিহ্নিত এবং কীর্তিত। তাকে বধ করতে কৌরবপক্ষে সাত জন মহারথীর প্রয়োজন হয়েছে, সেই বীরগর্ব সুভদ্রার মনেও কাজ করে। কিন্তু এইসব কিছু অতিক্রম করে পুত্রের মৃত্যুতে মায়ের মনে যে হাহাকার তৈরি হয়, তার জন্য উৎসারিত হয় এই বিলাপিনী ভাষা, পরলোকে তার জন্য অনন্ত মঙ্গলকামনা।
লক্ষণীয়, এই বিলাপিনী ভাষার মধ্যে ভারতবর্ষীয় সংস্কারে যা পুণ্যকর্ম, যত মাঙ্গলিক ক্রিয়া আছে, যা পরলোকে অক্ষয় স্বর্গ বা নিরবচ্ছিন্ন সুখের সূচনা করে, তা প্রায় সবগুলিরই উল্লেখ করেছেন সুভদ্রা এবং তার সঙ্গে শ্লোকের প্রত্যেক চতুর্থ চরণে ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে এসেছে একটি বাক্য তুমি সেই পুণ্যগতি লাভ করো, বাছা– তাং গতিং ব্রজ পুত্রক। যদি সংস্কৃত পংক্তিটির শেষ শব্দটি খেয়াল করেন–পুত্রক। ‘পুত্র’ নয় শুধু ‘পুত্রক। সংস্কৃতের প্রকৃতি-প্রত্যয় সম্বন্ধে ধারণা থাকলে বা না থাকলেও জেনে রাখুন ‘ক’ প্রত্যয়টা অনেক সময়েই একটি একটি শব্দের অভিধেয় মাত্রাটিকে ছোট করে দেয়। যেমন মানব মানে মানুষ কিন্তু মানবক’ মানে শিশু; একই ভাবে বাল-বালক, বালা-বালিকা; কালিদাস তো দুষ্যন্তের ধনুর লক্ষ্যে স্থাপিত হরিণটিকে হরিণ’ক’ বলে, তপোবনলালিত হরিণের প্রতি শিশুর মায়া তৈরি করে দিয়েছেন। এই নিরিখে সুভদ্রার প্রতি শ্লোকে আবৃত্ত তাং গতিং ব্রজ পুত্রক– তুমি সেই পুণ্যগতি লাভ করো বাছা– এই ‘পুত্ৰক’ শব্দটি তার পূর্বকথিত মাতৃস্তন্যপানের আহ্বানটাকে আরও মাতৃময়ী মমতায় করুণভাবে সযৌক্তিক করে তোলে।
সুভদ্রার এই মর্মান্তিক বিলাপ শুনে স্বয়ং পাঞ্চালী দ্রৌপদী– যিনি জীবনের বহুতর কাঠিন্য দেখে দেখেই রোষাগ্নিতে প্রজ্বলিত হন– তিনি পর্যন্ত বৈরাটী উত্তরাকে নিয়ে সুভদ্রাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এসেছেন– অভ্যপদ্যত পাঞ্চালী বৈরাটীসহিতা তদা। আমরা বুঝতে পারি এবং জানি–দ্রৌপদী যুদ্ধের সময়ে কুরুক্ষেত্রে স্যমন্তপঞ্চকে উপস্থিত ছিলেন না সুভদ্রা বা উত্তরার মতো। কিন্তু বিরাট রাজ্যের উপনগরী উপপ্লব্য থেকে তাকে আনানো হয়েছে। অভিমন্যুর মৃত্যুসংবাদ পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে না জানিয়ে পরবর্তী যুদ্ধকৰ্ম চালিয়ে যাওয়াটা পাণ্ডবদের পক্ষে অসম্ভব ছিল, কেননা সুভদ্রার গর্ভজাত এই পুত্রটির ওপর দ্রৌপদীর স্নেহ এবং বিশ্বাস ছিল অকৃত্রিম এবং দ্রৌপদীকেও সুভদ্রা কতখানি শ্রদ্ধা করতেন অথবা ভালবাসতেন যে, এতক্ষণ কৃষ্ণের সামনে যিনি পাগলিনীর মতো বিলাপ করছিলেন, তিনি দ্রৌপদীকে দেখামাত্রই সকরুণ বিলাপের অন্ত্যমাত্রায় নিশ্চেতন হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে– অর্থাৎ অভিমন্যুর আর একটি সস্নেহা জননীকে দেখার পর সুভদ্রা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, নিঃসংজ্ঞায় নিজেকে সঁপে দিলেন দ্রৌপদীর কাছে– উন্মত্তবত্তদা রাজন নিঃসংজ্ঞা ন্যপতদৃভূমৌ। সুভদ্রাকে কৃষ্ণই চোখে-মুখে জল দিয়ে স্থির করলেন এবং আবারও পূর্বের মতো অভিমন্যুর শক্তি-ক্ষমতা-বীর্যবত্তার বহুমান করে কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে ভার দিয়ে গেলেন সুভদ্রা এবং উত্তরাকে শান্ত করার জন্য– সুভদ্রে মা শুচঃ পুত্রং পাঞ্চাল্যাশ্বাসয়োত্তরা।
মহাভারত যেহেতু বীরগাথা শোনায় এবং যেহেতু ঘটনার পর আরও বিচিত্রতর ঘটনা সেখানে জীবনধর্মেই সন্নিবিষ্ট হয়, তাই সুভদ্রার আর কোনও বিশেষ খবর আমরা পাই না। আর যেহেতু সুভদ্রাও নিজেকে কখনও প্রকট করে তোলেন না, অতএব তার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব প্রায় হারিয়েই যায় মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহে। তবে তার পুত্রস্থান সত্যিই যেন কোনও দুর্দৈব-নক্ষত্রের দৃষ্টিপাতে আচ্ছন্ন। নইলে এমন হবে কেন যে, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্রকে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেললেন, দ্রৌপদী অশ্বত্থামার মস্তকমণি চাইলেন, অশ্বত্থামা প্রাণভয়ে ব্রহ্মশির অস্ত্র ছেড়ে দিলেন, কিন্তু হাজার বারণ সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত বাণের লক্ষ্য হিসেবে সৌভদ্র অভিমন্যুর পুত্র পরিক্ষিৎকেই বেছে নিলেন। অশ্বত্থামার অস্ত্র সম্বরণ করার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু পিতৃহত্যার প্রতিশোধ-স্পৃহা তাঁর এতটাই নিদারুণ ছিল যে, তিনি সুপরিকল্পিতভাবে পাণ্ডবদের শেষ বংশবীজ সৌভদ্র অভিমন্যুর সন্তানকেও ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে অশ্বত্থামাকে জানিয়ে দিয়েছেন– তুমি যতই চেষ্টা করো, সুভদ্রা-অর্জুনের এই পৌত্র বাঁচবেই, আমি তাকে বাঁচাব।
দ্রৌপদী যখন অশ্বত্থামার মস্তকমণি লাভ করে পুত্রবধের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন, তখন একবারের তরেও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি যে, প্রতিপক্ষের আঘাত এইভাবে নেমে আসবে সুভদ্রার পুত্রবধূর ওপর। সুভদ্রা কিন্তু অসূয়া-দ্বেষ পোষণ করেননি দ্রৌপদীর ওপর। তিনি নিশ্চয়ই দাদা কৃষ্ণের ওপর বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কৃষ্ণ বলেছিলেন– যদি সত্য এবং ধর্ম আমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে তবে মৃত হয়ে জন্মালেও বাঁচবে এই অভিমন্যুর জাতক– তথা মৃতঃ শিশুরয়ং জীবতাদভিমন্যুজঃ।
যুধিষ্ঠির তখন হস্তিনায় রাজা হয়েছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন এবং প্রস্তুতি চলছে। রাজ্যে। কৃষ্ণ আত্মীয়-স্বজন নিয়ে হস্তিনায় এসে গেছেন। এই সময়ে একদিন অন্তঃপুরচারিণী রমণীদের গভীর আর্তনাদ শোনা গেল। উত্তরার গর্ভমোচনের সঙ্গে সঙ্গে যে শিশুর জন্ম হল, সে যে মৃত, তা প্রথমে বোঝাই যায়নি। ফলে পুরবাসীদের হর্ষকোলাহল একবার ধ্বনিত হয়েই মুহূর্তের মধ্যে স্তিমিত হয়ে কৌতূহলের অস্পষ্ট আলাপে পরিণত হল।
কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন সাত্যকির সঙ্গে। প্রবেশমুখেই কৃষ্ণ দেখলেন স্বয়ং কুন্তী দৌড়তে দৌড়তে আসছেন তার কাছেই, তার পিছনে আসছেন দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা। কুন্তী কৃষ্ণের কাছে অভিমন্যুর বংশ সুরক্ষিত করার যাচনা করলেন এবং সুভদ্রা কাঁদতে কাঁদতে দাদা কৃষ্ণকে জানালেন– দ্যাখো তুমি, দ্যাখো একবার পার্থ অর্জুনের পৌত্রের দিকে তাকাও, কুরুকুল ক্ষীণ হয়ে গেছে এই বিরাট যুদ্ধে, আজ কুরুকুলের শেষ বাতিটিও নিবে গেল। সুভদ্রা এবার পূর্ববিবরণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন– তুমি তো জানো, কৃষ্ণ! অশ্বত্থামা তার অস্ত্রমোচন করেছিল ভীমকে মারার জন্য, কিন্তু সেই অস্ত্রের লক্ষ্য পরিবর্তন করে সেই অস্ত্রটাকে সে উত্তরার গর্ভে নিক্ষেপ করল এবং সত্যি বলতে কী, সেই অস্ত্রের আঘাত প্রকারান্তরে নেমে আসল আমার ওপরে এবং অর্জুনের ওপরে– সোত্তরায়াং নিপতিতা বিজয়ে ময়ি চৈব হ।
সুভদ্রার কথা শুনে একটিবার মাত্র মনে হতে পারে যেন তিনি বিরক্ত হচ্ছেন, কিংবা স্বার্থপরের মতো ভাবছেন যেন ভীমকে মারার জন্য চিহ্নিত অস্ত্র এসে আমার সংসার ধ্বংস করে দিল। সত্যি বলতে কী, সুভদ্রাকে এমন ভাবাটাই কঠিন। যেটা তিনি বলছেন, সেটা তথ্য নিবেদন-মাত্র, এবং তার মধ্যে এই ভাবটুকু আছে যে, ভীমের মতো মহাবীর যে অস্ত্রাঘাত সইতে পারবেন না, সেই অস্ত্র এসে পড়ল এক অবলা নারীর ততোধিক অবল গর্ভের ওপর। উত্তরার স্বামী যেহেতু বেঁচে নেই, তাই শাশুড়ি হিসেবে সুভদ্রা এবং শ্বশুর হিসেবে অর্জুনই যেন এই অস্ত্রাঘাতে সবচেয়ে বেশি বিমূঢ়। সুভদ্রা যে স্বার্থপরের মতো ভীমসেনের মৃত্যুকামনা করেননি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ লুকিয়ে আছে তার পরবর্তী বক্তব্যে। তিনি কৃষ্ণকে বলছেন– আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না পাণ্ডবরা এই ঘটনা শুনে কী বলবেন? কী কথা এটা, অভিমন্যুর ছেলেটা জন্মাল এবং মরে গেল? একথা শুনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কী বলবেন? কী বলবেন ভীমসেন এবং অর্জুন, অথবা নকুল-সহদেবই বা কী বলবে? অশ্বত্থামা যেন জন্মমাত্রেই চুরি করে নিয়ে গেল পাণ্ডবদের সবাইকে ঠকিয়ে, এটা কেমন কথা– মুষিতা ইব বাষ্ণেয় দ্রোণপুত্রেণ পাণ্ডবাঃ।
এই কথাগুলি থেকেই বুঝতে পারি সুভদ্রার বক্তব্য অন্যরকম। বরঞ্চ তিনি ভাবছেন– এই ঘটনায় মহাবীর পাণ্ডবদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে। কারণ তিনি জানেন এবং কৃষ্ণকেও সেটা জানিয়েছেন যে, অভিমন্যু, তাঁর ছেলে অভিমন্যু সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের কাছে সমান প্রিয় অভিমন্যুঃ প্রিয়ঃ কৃষ্ণ ভ্রাতৃণাং নাত্ৰ সংশয়ঃ– সেই অভিমন্যুর ছেলেটি জন্মমাত্রেই অশ্বত্থামার অস্ত্রাঘাতে মৃতপুত্রে পরিণত হবে, এটা পাণ্ডবভাইদের সইবে না। আমি তাই বলছি, কৃষ্ণ! তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে উত্তরা বৈরাটির কাছে, তুমি অশ্বত্থামাকে বলেছিলে– তোমার অস্ত্রাঘাতে অভিমন্যুর ছেলে মৃত হয়ে জন্মালেও আমি তাকে বাঁচাব। আজকে এই বিপন্ন মুহূর্তে আমি তোমাকে অনুনয় করছি, কৃষ্ণ! অভিমন্যুর ছেলেটাকে তুমি বাঁচাও, আজ যদি তুমি তোমার কথা না রাখো, তা হলে জেনে রাখো আমিও আর বাঁচব না– মৃতাং মাম্ অবধারয়।
লক্ষ করার মতো বিষয় হল, সুভদ্রার হৃদয়টাই এমন বিশাল এবং কোমল, এবং এতটাই তা নমনীয় যে, তিনি কখনওই প্রায় নিজের কথা ভাবেননি। একে তো সারা মহাভারত জুড়ে তার কথাই প্রায় শুনতে পাই না, কিন্তু যখন শুনতে পাই তখন তার মধ্যে এমনই এক সার্বিক শুভৈষণা থাকে, যা দিয়ে রীতিমতো তাকে চিহ্নিত করা যায় এবং সবচেয়ে বড় কথা, কোনও কথায়, কোনওভাবে তাকে দূষতে দেখিনি কাউকে না অন্যান্য পাণ্ডব ভাইদের, না দ্রৌপদীকে, না কুন্তীকে। দাদা কৃষ্ণের সম্বন্ধেও তার এক অলৌকিকী ধারণা আছে, আমার দাদা সব পারে এই গোছের এক অতিশয়ী ধারণা, যা ভগবত্তার বোধ থেকে এক চুল কম হয়তো। কৃষ্ণকে তিনি বলেছেন– তুমি তো সব পারো, দাদা! ইচ্ছে করলে এই তিন ভুবনকে তুমি বাঁচিয়ে দিতে পারো, সেখানে তুমি তোমার প্রিয় ভাগনের ছেলেটাকে বাঁচাবে না তুমি কি পুনর্দয়িতং জাতং স্বীয়স্যাত্মজং মৃতম? সবশেষে সুভদ্রা পাণ্ডবকুলের বংশরক্ষার জন্য সম্পূর্ণ ‘কনসার্নড’। পাণ্ডবদের একটি ছেলেও বেঁচে নেই। দ্রৌপদীর গর্ভজাতরা তো নেইই; নেই অভিমন্যু এবং ঘটোৎকচও। এই অবস্থায় সুভদ্রা যেমন একদিকে কৃষ্ণের কাছে পাণ্ডবদের সকলের জন্য অভিমন্যু-পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইছেন- কুরুষ পাণ্ডুপুত্ৰাণামিমং পরমনুগ্রহম– তেমনই অন্যদিকে তিনি দাদা কৃষ্ণের সার্বিক সাহায্য চাইছেন নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলে। সুভদ্রা বলেছেন কৃষ্ণকে আমি তোমার বোন বলেই এই দয়াটুকু তোমায় করতে হবে, আর এই দয়াটুকু আমার প্রাপ্য যেহেতু আমার শেষ সম্বল আমার ছেলেটাও আর বেঁচে নেই– স্বসেতি বা মহাবাহো হতপুত্রেতি বা পুনঃ।
আমরা জানি, কৃষ্ণ উত্তরার গর্ভজাত শিশুটিকে স্পর্শ করে তার শরীরে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। এই ঘটনার মধ্যে অলৌকিক শক্তিই থাক অথবা লৌকিক ক্রিয়াকুশলতা, সে-কথা অন্যত্র বিচার্য হবে, আপাতত শুধু এইটে জানিয়ে সন্তুষ্ট থাকব যে, উত্তরার প্রিয় পুত্রের দেহে প্রাণের সঞ্চার হতেই সুভদ্রার ব্যক্তিত্ব মিশে গেছে পাণ্ডবকুলের অন্যান্য মহিলাদের বর্ষীয়সী ব্যক্তিত্বের মধ্যে। ব্যাস লিখেছেন– ভরতবংশের স্ত্রীজনেরা যেন কৃষ্ণকে ধরে বিপদের নদী পার হয়ে গেলেন এবং এই মহিলারা হলেন- কুন্তী দ্রুপদপুত্রী চ সুভদ্রা চোত্তরা তথা। কিন্তু এত আচ্ছন্নতার মধ্যেও সুভদ্রাকে পৃথকভাবে চেনা যায়। সময়কালে তার নাম উল্লেখ না করে পারা যায় না এবং এর কারণ দুটো প্রথমত, তার অসামান্য সৌন্দৰ্য– এই মধ্য বয়সেও যৌবন অতিক্রম করেও অন্যতর এক গুরু যৌবন তার শারীরিক সৌন্দৰ্য্য আরও মোহময় করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত সেই স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব যা প্রকট হয়ে ওঠে না, কিন্তু ব্যঞ্জিত হয়।
হয়তো এই কারণেই পাণ্ডবরা যখন সপরিবারে বানপ্রস্থী ধৃতরাষ্ট্র এবং জননী কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, তখন সুভদ্রার সঙ্গে সমাগত তথা অরণ্যেই সহাগত ব্রাহ্মণদের পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছেন- ওই যে দেখছেন দ্রৌপদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, সোনার মতো গায়ের রং, আর চাঁদের জ্যোৎস্না যেন শরীরী হয়ে নেমে এসেছে ভুয়ে, ইনি কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা– অস্যাস্তু পার্শ্বে কনকোত্তমাভা/ যৈষা প্রভা মূর্তিমতীব সৌমী– সত্যি বলতে কী, এখানে তার গায়ের রং একবার সোনার মতো বলে আবার চাঁদের জ্যোৎস্নার উপমাটা পুনরাবৃত্ত-প্রায় হয়ে ওঠে, আসলে জ্যোৎস্নার মধ্যে যে আহ্লাদকত্ব, স্নিগ্ধত্ব এবং মাধুর্য আছে, সেটা সুভদ্রার ব্যক্তিত্বের প্রতিবিম্বে আসে বলেই মহাভারতের কবি এই দ্বিতীয় উপমাটি ব্যবহার করেছেন প্রভা’ শব্দটি লাগিয়ে–যৈষা প্রভা মূর্তিমতীব সৌমী– সুভদ্রা হচ্ছেন সেই আলোক-প্রভা, যেখানে চাঁদের জ্যোৎস্না মূর্তিমতী হয়ে ধরা দিয়েছে।
আশ্রমিকপর্বে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কুরুপাণ্ডবকুলের সমস্ত মহিলারা এসেছিলেন যুধিষ্ঠির এবং পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে। মহামতি ব্যাস সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন পরম কৌতূহলে এই শান্ত মধুর আরণ্যক মিলন দেখার জন্য। গান্ধারী-কুন্তী প্রমুখ প্রবীণরা সেদিন ব্যাসের কাছে অনুনয় করেছিলেন যদি তিনি অলৌকিক যোগবলে তাদের মৃত পুত্র অথবা যাঁদের স্বামী মারা গেছে, তাদের একবার দেখাতে পারেন চোখের সামনে। ব্যাস তাদের সকলের মর্মব্যথা জানতেন, যোগবলে সকলের চোখের সামনে এনেও দিয়েছিলেন নিহত প্রিয়জনদের। সুভদ্রা সেদিন দেখতে পেয়েছিলেন প্রিয় পুত্র অভিমন্যুকে, সেই রাজকুমারের মহার্ঘ বেশ-বাসে, তার মনে কোনও ক্রোধ নেই, জরা নেই, বিকার নেই। পাণ্ডবভাইরা সমক্ষ-স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য এগিয়ে গেছেন কর্ণের দিকে, দ্রৌপদীর পুত্রদের দিকে সৌভদ্র অভিমন্যুর দিকে, হৈড়িম্ব ঘটোৎকচের দিকে। ব্যাস অন্যদের সঙ্গে সুভদ্রার কথাও বলেছিলেন। বলেছিলেন– আমি জানি, এই কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা তার একমাত্র ছেলেটিকে হারিয়ে কত দুঃখ পাচ্ছে- যচ্চ ধারয়তে দুঃখং… তচ্চাপি বিদিতং মম। আজ যখন কতকাল পরে সেই মৃত পুত্রকে দেখলেন পাণ্ডবদের দ্বারা অভিনন্দ্যমান, সুভদ্রার কত সুখ হল! একটা গোটা রাত্রি কেটে গেল ‘চিত্রং পটগতং যথা, শুধু দেখতে দেখতে– যেন মূর্ত একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। সুভদ্রা দেখলেন– ছেলে ভালই আছে, যেমনটি তিনি প্রার্থনা করেছিলেন।
তারপর অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে, যমুনা দিয়েও। হস্তিনায় পঁয়ত্রিশ বছর রাজত্ব করলেন যুধিষ্ঠির, মৌষল দুর্ঘটনায় কৃষ্ণ, বলরাম লীলা সম্বরণ করেছেন, কৃষ্ণের বংশ নির্মূল, শুধু কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধের ছেলে বজ্র বেঁচে আছেন, ঠিক এদিকে যেমন পাণ্ডবকুলে পাণ্ডবদের নগ্ধা পরিক্ষিৎ। পাণ্ডবরা এবং দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানের জন্য তৈরি হলেন। যুধিষ্ঠির কুমার পরিক্ষিৎকে হস্তিনার সিংহাসনে অভিষিক্ত করে ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যাগৰ্ভজাত একমাত্র জীবিত পুত্র যুযুৎসুকে তার অভিভাবক নিযুক্ত করলেন। ওদিকে কৃষ্ণের বংশ বজ্রকে যুধিষ্ঠির অভিষিক্ত করলেন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যে। দুইজনকে অভিষেক করার পর মহাপ্রস্থানে প্রস্তুত ভাইদের সঙ্গে যুধিষ্ঠির এবার সুভদ্রাকে ডেকে বললেন- তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। এই তোমার ছেলের ছেলে পরিক্ষিৎ হস্তিনাপুরে কুরুকুলের রাজা হিসেবে রইল– এষ পুত্রস্য পুত্ৰস্তে কুরুরাজো ভবিষ্যতি– ওদিকে যদুকুলের শেষ বংশধর বর্জ রইল ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হিসেবে। এই দুইজনেরই সুরক্ষা এবং দেখভালের দায়িত্ব রইল তোমার ওপর। তুমি এদের দেখো এবং আশীর্বাদ করি তোমার মন যেন কখনও অধর্মের দিকে না যায়। যুধিষ্ঠিরের মন ভারাক্রান্ত, তিনি আর বেশি কথা বলেননি– দুঃখার্তশ্চাবীদ রাজা সুভদ্রাং পাণ্ডবাগ্রজঃ।
সব ঘটনা দেখে এক পণ্ডিতমানিনী মহিলা ঔপন্যাসিক এক অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন সবটাই নাকি এখানে কৃষ্ণের কারসাজি আছে- তিনি কুরু-পাণ্ডবদের জ্ঞাতিবিরোধের মধ্যে ঢুকে নিজের ঘরের ছেলেটাকে ইন্দ্রপ্রস্থে আর বোনের ছেলের বংশটাকে হস্তিনায় বসিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এঁরা কী মহাভারত পড়েছেন, মহাকাব্যিক চরিত্রগুলিকে কোন গাধবুদ্ধিতে, কত ওপরচালাকিতে বুঝেছেন, আমি বুঝি না। আপনারা দেখলেন তো, চিনলেন তো সুভদ্রাকে। যিনি সৌমী স্নিগ্ধতায় জীবনের কোনও ক্ষেত্রে নিজেকে প্রকট করে তোলেননি, ঘটনার প্রবাহে কৃষ্ণ নিজেই যেখানে নিজের রাজ্যে নিজের বংশের কাউকে প্রতিষ্ঠা করার আগেই চলে গেলেন কোথায় কোন বৈকুণ্ঠলোকে, সেখানে মহাকাব্যিক দৃষ্টি কতখানি কটু এবং ক্ষীণ হলে এমন মন্তব্য করা যায়। পরিশিষ্টে সুতোর মতো কুরু-পাণ্ডবের পরিক্ষীণ বংশের পরিক্ষিৎকে সিংহাসনে বসানোটা দীপদানের মধ্যে সলতের মতো এগিয়ে দেওয়া। সুভদ্রা এখানে হস্তিনায় বসে রইলেন সেই চিরকালীন অনুগতা সৌমী জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতায়; মহাভারত শেষ হয়ে গেল। আমরা দ্রৌপদীরও মহাপ্রস্থানিক পতন দেখলাম, কিন্তু সুভদ্রার অন্তিম মুহূর্তটি দেখতে পেলাম না। তিনি বেঁচে রইলেন মহাভারতের শেষ পর্বের পরেও, পরিক্ষীণ বংশের পরিক্ষিৎ-নাতির হাত ধরে। তার কোনও মহাপ্রস্থান নেই, তিনি থেকে গেলেন ভারতবর্ষের অগণিতা অনুগতা নারীর মধ্যে।