সারি সারি তো সব এসে ঢু। এদের হাত থেকেই পালাবার জন্যে কাল থেকে কী না করা হয়েছে। যাক গে, ঘরের মধ্যে যারা ছিল, তারা ঝগড়াঝাটি ভুলে দল বেঁধে, তৈরি হয়ে নিল। প্রথমে দাঁড়ালেন জমিদারবাবু, তার পাশে ঠানদিদি, তারপর শ্যামাদাসকাকা, তারপর বিরিঞ্চিদা, তারপর বুড়ি, তারপর ঝাকড়াচুল, তারপর রোগা বেচারা আর সব শেষে, একটু পেছনের দিকে সরে, আমি।
ঘরের মধ্যে দেখলাম এ ছাড়াও বারো-চোদ্দোজন লোক।
ইন্সপেক্টরবাবু পকেট থেকে একটা ছোটো কালো খাতা আর লাল পেনসিল বের করে বললেন, কোথা থেকে যে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি নে। ভুবনডাঙার ঠ্যাঙাড়েরা ধরা পড়বার পর একসঙ্গে এতগুলো ক্রিমিনাল দেখা গেছে কি না সন্দেহ।
পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, সে দেখলাম খোশামুদের একশেষ, একগাল হেসে বললে, হাঁ স্যার, দেখবেন এবার খবরের কাগজে আপনার নাম বেরুবে। একটা চক্র-টক্রও পেয়ে যেতে পারেন, বলা যায় না, হয়তো তিসরা বিভাগ।
-ওই ছোটো ছেলেটাকে দিয়ে শুরু করে দিন স্যার, কচি আছে, ধমক-ধামক করলে হয়তো একটু-আধটু সত্যি কথা বললেও বলতে পারে।
তাই শুনে বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই এমনি অদ্ভুত চেঁচিয়ে উঠলেন, ও কাজও করবেন না মশাই, ওর কচিপানা মুখ দেখে বিচারবুদ্ধি হারাবেন না। ওই হল গিয়ে পালের গোদা, মশাই, ওই হল সর্দার।
সেজোদাদামশাই কী বিরক্ত!
–আরে রাখো! তোমাদের বিরিঞ্চিটিও কম পাজি নয়।
ইন্সপেক্টরবাবু হকচকিয়ে গেলেন মনে হল, এক বার এর মুখ দেখেন, এক বার ওর মুখ। শেষটা আমি নিজেই এগিয়ে এসে বললাম, আমার নাম গুপি চক্রবর্তী, বয়স এগারো, ক্লাস সেভেনে পড়ি, মাথায় সাড়ে চার ফুট, ওজন–
ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো ছোকরা! বড় বেশি কথা বল!
দেখলে তো মজা? আবার ঠানদিদিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম আর ঠিকানা?
ঠানদিদি মাথায় কাপড় আরো টেনে দিয়ে ইন্সপেক্টরবাবুর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বললেন, ও মাগো!
সেজোদাদামশাই বললেন, লিখুন, নিস্তারিণী দেবী। ৪৩, হরিশংকর লেন, কলিকাতা।
ইন্সপেক্টর এ-সবই খাতায় টুকে বললেন, এখানে আসার অভিপ্রায়–?
বিরিঞ্চিদা ঝুঁকে পড়ে বললে, গয়ার কথাটা বলবে।
সেই খোশামুদে লোকটা বললে, উঁহু! সাক্ষীকে হামলা করবেন না।
ঠানদিদি ভারি খুশি হয়ে বললেন, গয়ায় যাচ্ছিলুম, পথ হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি, তাতে দোষটা কী হয়েছে গা?
ইন্সপেক্টরবাবু তাই টুকতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় সেজোদাদামশাই ছুটে এসে রেগেমেগে বললেন, কী মিছে কথা! পাছে আমার গুরুদেবকে–এদের সামনে তার নাম করাও পাপ পাছে তাঁর চরণে আমার মার গয়নাগাটিগুলো দিয়ে ফেলি, তাই তুমি সেসব নিয়ে সরে পড়নি বলতে চাও, বউঠান? ওই গয়নার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার, বাকি আমার আর ইয়ে গুপির বাবার। ওদিকে গুরুদেব সোনার গাড়র অভাবে কী কষ্টই-না পাচ্ছেন?
ইন্সপেক্টর খচখচ লিখতে লিখতে, একবার থেমে সেজোদাদামশাইয়ের জামা ধরে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, গুরুদেব কার সোনার গাড় নিয়েছেন না কী যেন বললেন, ভালো করে শুনতে পেলাম না। আরেক বার কথাগুলি বলবেন স্যার?
শুনে তো আমার দারুণ হাসি পেল। সেজোদাদামশাই কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর একটু অপেক্ষা করে বুড়িকে বললেন, আপনার নাম ও পেশা?
বুড়ি বললেন, আমার নাম স্বভাবসুন্দরী দাসী। আর পেশার কথা আমি কিছু বলতে পারব, সে আমার অনেক উপকার করেছে।
খোশামুদে লোকটি বললে, কী আপদ। পেশার কথা কে শুনতে চায়? আপনার কী করা হয়। তাই বলুন।
–আর কী করা হবে? রান্না করা হয়। আমার খোকা কিন্তু জমিদারবাবুকে চেনে না।
খোকা বুড়ির হাত ছাড়িয়ে হাঁড়িমুখ করে বললে, এতদিন চিনিনি, এবার খুব চেনা গেছে। দিন, মশাই, আমার একশো টাকা।
জমিদারবাবু তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, আহা, থামো থামো, বলেছি তো দেব।
ইন্সপেক্টরবাবু হতাশ হয়ে পাশের লোকটিকে বললেন, আমি তো কিছু বুঝে উঠলাম না, শম্ভ, তুমি একটু দেখো তো।
শম্ভু তখন তড়বড় করে এগিয়ে এসে বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকাকে লাইন থেকে টেনে বের করে এনে, ধমক দিয়ে বলল, আপনারাই যে রিংলিডার সেকথা অস্বীকার করে কোনো ফল হবে না মশাই, আপনাদের কপালে লেখা রয়েছে বদমায়েশ, ধড়িবাজ। বিলেতে ওই যেসব চোরাকারবার ধরা পড়েছে, তার গোড়াতেও যদি আপনারা থাকেন তো কিছুই আশ্চর্য হব না। নিন, এখন ভালো চান তো বলে ফেলুন আগাগোড়া সব ব্যাপারটা।
তখন বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা ঢোক গিলে, জিব কামড়ে, আমতা আমতা করে, এক জন থেমে, এক জন জোরে, আমাদের কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার পর থেকে সব কথা মোটামুটি বলল।
শুনে ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, বটে।
তারপর বিরিঞ্চিার পিসেমশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, কী যেন বলছিলেন আপনি?
পিসেমশাই বললেন, কী আর বলব মশাই, আমার বন্ধু ঘেঁটুর মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে-টিয়ে ঠিক। টোপর কেনা, পুরুতঠাকুরকে বায়না, বরপণের টাকা হাফ ও নেবে আর হাফ আমি নেব সব ঠিক, আর মাঝখান থেকে একেবারে ভাগলুয়া। বল, হতভাগা পালালি কেন?
বিরিঞ্চিদা মুখ লাল করে বললে, শ্যামাদাস যে বললে, ওই মেয়ে ভীষণ রাগী, নাকি চটে গেলে নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়?
–কী? শ্যামাদাস বললে। বাঃ, চমৎকার কথা, শ্যামাদাস বললে। আর শ্যামাদাস কী করেছে। তা জানিস? নিজের মামাকে বেদম পিটে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কেন তা জানিস? কারণ মামা বলেছিল, বলাই চাটুয্যেই-বা কী, আর গোষ্ঠ পালই-বা কী, ছিল শুধু একজন– ব্যস্ ওই পর্যন্ত তার নামটুকুও বলবার আগেই মামাকে একেবারে ফ্ল্যাট, একেবারে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে এত বড়ো পাজি। কৈমন ঠ্যাঙাড়ে সব সঙ্গী জুটিয়েছ, এবার বুঝতে পারছ আশা করি?
বুড়ি এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিল, এবার বললে, ওমা। কোথায় যাব গো। একটা চোর, একটা ফেরারি, একটা খুনে। ওই ছোকরাটার কথা তো জিজ্ঞেস করতেও ভয়ে হাত-পা পেটে সেঁদোচ্ছে। এই চার-চারটে লোক আমাদের বাড়িতে রাত কাটাল তবু যে বেঁচে আছি তাই রক্ষে।
ইন্সপেক্টরবাবু একটু হাসলেন।
–যা বলেছেন মা-ঠাকরুন। এবার আসুন, এইসব চোরাইমালের গাদার একটা হিসেব দিন। বুড়ি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
-ওমা বলে কী। আমার বিয়ের যৌতুক বাবা কত কষ্ট করে দিয়েছিল পঁচিশ বছর ধরে আগলেছিনা। যাতে উই না ধরে, যাতে ডাকাতে না নেয়, তাকে বলে কিনা চোরাইমাল।
বলে একটা ভাঙা হারমোনিয়ামের পিঠে হাত বুলোত লাগল।
এমনি সময় দাড়িওয়ালা ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই ইন্সপেক্টরবাবু মনিব্যাগ বের করলেন, ক-মাসের মাইনে দেয়নি?
বুড়ো তো আহ্লাদে আটখানা।
–ছ-টি মাস দেয়নি স্যার। সম্পর্কে দাদা হই, সব কাজ করিয়ে নেয়, নিজেদের গোরুকে নিজেরা ভয় পায়। ছ-মাস মাইনে দেয়নি, ছ-যোলং চৌষট্টি।
ইন্সপেক্টরবাবু ওর হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, আপাতত এইটে নাও তো। আচ্ছা এসব জিনিস চুরি করে আনে কারা? চালানই-বা করে কারা?
বুড়ো খুশি হয়ে বললে, সে আমাদের লোক আছে স্যার, নিজের হাতে সব ট্রেনিং দিয়েছি। কম-সেকম পনেরো-কুড়িজন ভাড়া খাটে। সবচেয়ে চালাক কে জানেন?–ওই ঝাঁকড়াচুল– উমমা–
বুড়ি আর রোগা বেচারা ওর মুখ চেপে ধরে বলল, না দেখুন ভীষণ মিথ্যেবাদী, দেখুন।
ইন্সপেক্টর সব কথা খাতায় টুকে নিয়ে বললেন, ব্যস্, মালার ব্যাপার ছাড়া আর সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কিছু ভাববেন না আপনারা, ফঁসি বন্ধ করে দেব। চাই কী এক-আধজনকে জেলে না-ও দিতে পারি। কিন্তু মালাটাই যে ভাবিয়ে দিলে মশাই। ওটি না পেলে কি মাইনে বাড়বে? দেখুন জমিদারবাবু, এতক্ষণ কিচ্ছু বলিনি এবার কিন্তু রেগে গেছি। আপনি নাহয় বড়োলোক কিন্তু তাই বলে আমার উন্নতি বন্ধ করে দিতে পারবেন তা ভাববেন না। ঠিক বলছেন এটা আপনার মালা নয়?
জমিদারবাবু মাথা নাড়লেন। ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, নয় কেন বলুন? এটা কীসে মন্দ?
জমিদারবাবু মহা ফাঁপরে পড়ে গেলেন, ইয়ে মানে এটা আমার গিন্নি পরতেন না– ওই ঝাকড়াচুল– এইটুকু বলেই জমিদারবাবু থামলেন।
–আহা থামলেন কেন? ওই ঝাঁকড়াচুল কি?
জমিদারবাবু কিছু বলবার আগে সে ছোকরাই এগিয়ে এসে বলল, আমি বলব স্যার?
জমিদারবাবু ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, আরে চুপ চুপ, দেব রে এক-শো টাকা নিশ্চয় দেব। এ তো দেখি আচ্ছা গেরো।
ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন বাজে কথা রেখে আগাগোড়া খুলে বলুন।
জমিদারবাবু কোঁচা দিয়ে মুখ মুছলেন।
–একটুও বাদ দিতে পাব না?
–না, সব শুনব।
–কিন্তু কিন্তু গিন্নি যে রেগেমেগে পুলিশের সম্বন্ধে
–আচ্ছা আচ্ছা সেইটুকু নাহয় ছেড়েই দিলেন।
জমিদারবাবু তখন একটা নীচু দেখে বাক্সের ওপর বসে পড়ে বললেন, বেশ তবে সব কথাই শুনুন। আমাদের সাতপুরুষের জিনিস ওই মালা। লাখ টাকা ওর দাম। লাখ টাকা দিয়ে ইনসিওর করা। হারালে লাখ টাকা পাওয়া যায়। গিন্নি প্রাণ দিয়ে সেটি আগলান। সারাদিন গলায় ঝোলে, সারারাত বালিশের নীচে থাকে। সেই মালা বালিশের তলা থেকে উধাও। কেউ কোথাও নেই, ঘর ভেতর থেকে বন্ধ, শুধু বালিশের নীচে মালাগাছি নেই।
তাই নিয়ে গিন্নি যে অতটা রসাতল করবেন এ আমার ভাবনার বাইরে ছিল মশাই। আর ইসিওরেন্স কোম্পানিকে বছরে বছরে টাকা গুনে দেওয়া হয়েছে, তাদের বাঙালি সায়েবেরও যে কী সন্দেহবাতিক সে আর কী বলব! কেমন করে গেল, কোথা দিয়ে গেল, বললেই হল কিনা চুরি, দেব না টাকা, আগে প্রমাণ করুন সত্যি চুরি গেছে। এইরকম। তখন কী আর করা যায়, এই ছোকরার পায়ের ছাপটা দেখাতে হল!
শুনে সবাই অবাক, ওমা সে কী? ছোকরার পায়ের ছাপ আবার কী?
জমিদারবাবু তখন অপ্রস্তুত মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি সবটা বলতে হবে, গিন্নি শুনলে–
–আহা কী জ্বালা, বলুন বলুন, গিন্নিকে আবার কে বলতে যাচ্ছে?
–তবে শুনুন। ইয়ে মানে ছোকরাকে বললাম তোকে কিছু করতে হবে না, জানলার বাইরে দাঁড়াবি আমি গরাদের ফঁক দিয়ে গলিয়ে দেব, তুই উধাও হবি। পরে রেলের ক্রসিং-এ আমার হাতে দিয়ে দিবি। তাহলে তোকে এক-শো টাকা দেব। তোর কোনো বিপদ নেই। বলুন মশাই, ছিল ওর কোনো বিপদ যে এখন ও-রকম তেড়িয়া হয়ে থাকবে?
না, না, সে তো বটেই।
–সে তো বটেই আবার কী? ব্যাটা মালা নিয়ে বেমালুম উধাও। রেলের ধারে তার দেখা নেই। এদিকে গিন্নির জ্বালায় আমি যেখানে যাই পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেয়। সেই থেকে আপনারা যে আমার পেছনে ছিনেজেকের মতো একনাগাড়ে লেগে রয়েছেন মশাই। দে রে বাপ মালাটি, ইসিওরের টাকায় আমার কাজ নেই, মালাটা এখন গিন্নিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
ছোকরা অমনি শ্যামাদাসকাকাকে দেখিয়ে দিলে।
আপনার কথায় বিশ্বাস করেই মালা নিয়ে সরে পড়েছিলাম, আপনারাই যে পেছনে পুলিশ লাগাবেন তা কি আর ভেবেছিলাম। রেলের ধারে গিয়ে দেখি ধরপাকড় চলছে, তখন বেগতিক বুঝে ওই ভদ্রলোকের পকেটে মালা চালান করে দিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমি নাকে কানে খত দিয়েছি সোনাদানা আর ছোঁব না। ইস্কুলে ভরতি হব। যদি মন্টু-পটলাদের ক্লাসে নেয় অবিশ্যি।
তাই শুনে বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওকে সে কত আদর! ওই বুড়োধাড়ি ছেলেকে, ভাবো এক বার!