হয় না। তেমন সান্ত্বনায় কিছু হয় না।
সেটা অনেক সময় টের পেয়েছেন অনামিকা দেবী। তার এই দীর্ঘকালের লেখিকা জীবনে অনেকবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে। তিনি নাকি তাঁর সব পরিচিত জনেদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে কাউকে কাউকে অপদস্থ করতে তাঁর গল্পের নায়ক-নায়িকা সৃষ্টি করেছেন।
অবশ্য কাহিনীর মধ্যেকার মহৎ চরিত্রগুলি সম্পর্কে এ ধরনের দাবি কেউ করে না। হাস্যকর অথবা ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতার মধ্যে নিমজ্জিত চরিত্রগুলিতেই নাকি অনামিকা দেবীর কুটিল প্রচেষ্টা দেখতে পায় পরিচিত জনেরা। তাই মুখ কালো করে বলে, এ তো আমাকে নিয়েই লেখা।…বলে, তোমার মনের মধ্যে এই সব ছিল তা জানতাম না। তা এতোটা অপদস্থ না করলেও পারতে।
তারা নিজেরা ধরতে না পারলেও বন্ধু-বান্ধবেরা নাকি চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়, এই দেখো তোমার অমুক দেবী এবার তোমাকে একহাত নিয়েছেন!
তা অমলবাবুর ক্ষেত্রেও নাকি ওই বন্ধুরাই জ্ঞানাঞ্জনশলাকার কাজ করেছিলেন।
বন্ধুর শলাকার পর তো আর কোন শলাকাই কাজ করে না। কাজেই সেজদির যুক্তি মাঠে মারা গেছে। আমায় নিয়ে লিখেছে ভেবে খাপপা হয়েছিলেন অমলবাবু!
আবার এমন অনুরোধও বার বার আসে-আমায় নিয়ে লেখো-
না লিখলে ভাবে অবহেলা করলো।
কিন্তু আসলে যে সত্যিকারের কোনো একজনকে নিয়ে কোনো একটা সত্যিকার চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না, এ সত্যটা কেউ ভেবেও দেখে না।
হয়তো জানেই না!
জানে না অথবা মানে না যে ওটার নিয়ম অনেকটা বৃষ্টির মত।
পৃথিবীর মাটি থেকে ওঠা জলটাই আবার জল হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে বটে, তবু দুটোই এক নয়। সে জলকে আগে বাষ্প হতে হয়, তারপর মেঘ হতে হয়, তবেই তার আবার বৃষ্টি হয়ে পড়ার লীলা।
তেমনি নিয়মেই প্রায় বহু চরিত্রের, আর বহু বৈচিত্র্যের সংস্পর্শে আসা অনুভূতির বাষ্পও মনের আকাশে উঠে জমা হয়ে থাকে চিন্তা হয়ে। তারপর কোনো এক সময় চরিত্রে রূপায়িত হয়ে কলমে এসে নামে।
কিন্তু এত কথা বোঝানো যায় কাকে? বুঝতে চায় কে? তার থেকে তো রাগ করা অনেক সোজা। অনেক সোজা ভুল বুঝে অভিমান করা।
যাকে নিয়ে লেখা হল না, সে-ও আহত। আর আয়নায় যে নিজেকে দেখতে পেলো সে-ও আহত। অতএব তারা দূরে সরতে থাকে।
অবশ্য এ সমস্যা কেবলমাত্র পরিচিত জন্যেদের নিয়ে।
যারা দূরের, তারা তো আবার ওই আয়নায় মুখ দেখতে পাওয়ার সূত্রেই কাছে এসে দাঁড়ায়। আনন্দের অভিব্যক্তি নিয়ে বলে, ইস, কী করে লিখেছেন! মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের কথা!
অনামিকা দেবীও হাসেন।
বলেন, আপনাদের কথা ছাড়া আর কোথায় কথা পাবো বলুন? আমি তো আপনাদেরই একজন। আকাশ-পাতাল এক করে কথা খুঁজতে যাই এমন ক্ষমতা নেই আমার। আপনারাই যদি আমার ফসল তো, আপনারাই আমার সার। পাঠক পাঠিকাই আমার নায়ক নায়িকা।
কিন্তু অমলবাবুকে এসব কথা বোঝানো যায়নি। অমলবাবু তদবধি সেজদিকে আসতেই দেয়নি এ বাড়িতে।
আশ্চর্য অভিমান মানুষকে কী নির্বোধ করে তোলে! অথবা মানুষজাতটাই নির্বোধ!
বকুলের কথা লেখবার দায়িত্ব নিয়ে বকুলকে ভাবতে ভাবতে, বকুলের সঙ্গে কখন যেন একাত্মা হয়ে যান অনামিকা দেবী। ওই বানানো নামের খোলস খুলে পড়ে, আর সেদিন অনেকদিন আগে বকুল যে-কথা ভেবেছিল, সেই কথাই ভাবতে বসেন তিনি, সত্যি মানুষ কি নির্বোধ!
শুধু দুটো মাত্ৰ হাত দিয়ে শতদিক সামলাবার কী দুঃসহ প্ৰয়াস তার! শুধু দুটো মুঠোর মধ্যে সমন্ত পৃথিবীটাকে পুরে ফেলবার চেষ্টায় কী তার জীবন-পণ! কতো তাব দুশ্চিস্তা, কতো তার ষড়যন্ত্ৰ!
অথচ মুহূর্তে সে মুঠি আলগা করে ফেলে চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে! হাত দুখানা সব কিছু সামলানোর দায়িত্ব থেকে কী সহজেই না মুক্তি পায়!
অমলবাবু তার চাকরিতে অধিক উন্নতি করবার জন্যে কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছিলেন, অমলবাবু তার স্ত্রীকে মুঠোর মধ্যে ভরে রাখতে কী দুঃসহ ক্লেশই না। স্বীকার করেছেন, স্ত্রীর শুধু দৈহিক মঙ্গলই নয়-ঐহিক, পারিত্রিক, নৈতিক, চারিত্রিক, সববিধ মঙ্গলের দায় নিয়ে ভদ্রলোক দিশেহারা হয়ে যেতেন, কিন্তু কতো কম নোটিশে চলে যেতে হল তাকে! কত অস্বস্তি বুকে নিয়ে!
সেজদি বলেছিল, দেখ বকুল, স্বৰ্গ জায়গাটা সত্যিই যদি কোথাও থাকে, আর সেখান থেকে এই মর্ত্যলোককে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে তো অবিশ্যিই আমায় দেখতে পাচ্ছে। বেচারা মরেও কী যমযন্ত্রণা পাচ্ছে তাই ভেবে দুঃখিত হচ্ছি।
বকুল বলতো, তোর মতো দজ্জাল বেপরোয়া স্ত্রীকে মনে রাখতে তার দায় পড়েছে।
সেজদি বলতো, দজ্জাল বেপরোয়াদেরই তো মনে রাখে মানুষ। দেখিস না-স্বয়ং ভগবান ও সাধুসজনদের মনে না রেখে, অহরহ জগাই-মাধাইকে মনে রাখেন, মনে রাখেন কংস, জরাসন্ধ, হিরণ্যকশিপুদের।…এই যে লোকটি আমায় চোখের আড়াল করতো না, সেও তো ওই আমি দজ্জাল আর বেপরোয়া বলেই। শিষ্ট শান্ত সাধ্বী নারী হলে কবে আমায় ভুলে মেরে দিয়ে ভাঁড়ার ঘরের এককোণে ফেলে রেখে দিতো।…তাই ভাবছি কী ছট্ফট করছে ও, যদি সত্যি দেখতে পায়।
কিন্তু নাঃ, দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ বড় অসহায়।
সৰ্ব্বস্ব নামিয়ে রেখে সর্বহারা হয়ে চলে যেতে হয় তাকে।
তারপর আর কিচ্ছু করার নেই।
করার থাকলে আজ প্ৰবোধচন্দ্রের পৌত্রী প্ৰবোধচন্দ্রের ভিটেয় বসেই প্ৰেম করাটাকে মস্ত একটা বাহাদুরি মনে করে মহোল্লাসে তার পিসির কাছে এসে বলতে পারে, পিসি, বললে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আবার একটা নতুন শিকার জালে ফেলেছিা!
এই হতভাগা মেয়েটার সামনে কিছুতেই যে কেন গাম্ভীর্য বজায় রাখতে পারেন না অনামিকা দেবী! মেয়েটার প্রতি বিশেষ একটা স্নেহ আছে বলে? তা হলে তো স্নেহান্ধর দশা ঘটেছে বলতে হয়।
কিন্তু তাই কি?
না, ওর ওই লজ্জাহীনতার মধ্যে কোথায় যেন একটা অমলিন সততা আছে বলে? যে বস্তু ইহসংসারে প্রায় দুর্লভ। তবুও তিনি গাম্ভীর্ঘ বজায় রাখবার চেষ্টায় চোখ পাকিয়ে বলেন, নতুন শিকার জালে ফেলেছি মানে? ও আবার কী অসভ্য কথা?
শম্পা কিন্তু কিছুমাত্র না দমে জোর গলায় বলে ওঠে, হতে পারে অসভ্য, কিন্তু জগতের কোন সত্যি কথাটাই বা সভ্য পিসি? সভ্য মাত্রেই অ-সভ্য, মানে সংসাবী লোকেরা যাকে অসভ্য বলে!
তা সংসারে বাস করতে হলে সংসারী লোকের রীতিনীতির মাপকাঠিতেই চলতে হবে।
শম্পা চেয়ারে বসেছিল, এখন বেশ জোরে জোরে পা দোলাতে দোলাতে বলে, ও কথা আমার পরমারাধ্যা মাতৃদেবী বলতে পারেন, তোমার মুখে মানায় না।
অনামিকা দেবী চেষ্টাটা আরো জোরালো করতে বলেন, না মানাবার কী আছে? মা পিসি কি আলাদা? মা যা বলবে, পিসিও তাই বলবে।
শম্পা হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, দুই কোমরে হাত দিয়ে বলে ওঠে, এ কথা তোমার সত্যি মনের কথা?
এই সরাসরি আক্রমণে অনামিকা দেবী হেসে ফেলেন, মেয়েটার মাথায় একটা থাবড়া মেরে বলেন, এইখানটিতে আছে কেবল দুষ্টবুদ্ধির পাহাড়! কিন্তু ওই সব শিকার-টিকার কী ভালো কথা?
ভালোমন্দ জানি না বাবা, ওই কথাটাই বেশ লাগসই মনে হলো, তাই বললাম, একটা করে ধরি আর মেরে ছেড়ে দিই যখন, তখন শিকার ছাড়া আর কি!
আমি তোর গুরুজন কি না?
হাজার বার।
তবে? আমার সামনে এই সব বেহায়া কথা বলতে তোর লজ্জা করে না?
বলে অনামিকা দেবীও হঠাৎ অন্যমনস্ক ভাবে ওর মতই পা দোলাতে থাকেন।
শম্পা সেই দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বলে, দেখো পিসি, লজ্জা-ফজ্জা বলে আমার কিছু নেই, একথা আমি বাবাকেও বলতে পারি, কিন্তু বলতে প্ৰবৃত্তি হয় না। কথাটার মানেই বুঝবে না। তুমি সাহিত্যিক, মনন্তত্ত্ব-টত্ত্ব বোঝ, তাই তোমাকে বলি। কই বড় মেজ সেজ পিসিকে তো বলতে যাই না!
তাদের পাচ্ছিস কোথায়?
আহা ইচ্ছে করলে তো পেতে পারি। একজন তো এই কলকাতা শহরেই বাস করছেন, আর দুজনও আশেপাশে। কথা তো তা নয়, আশা করি যে তুমি অন্ততঃ বুঝবে আমায়।
অনামিকা দেবী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। ভাবেন, ও আমার ওপর এ বিশ্বাস রাখে আমি ওকে বুঝবো? যদিও এ সংসারে ওইটাই হচ্ছে সব চেয়ে শক্ত কাজ। কে কাকে বোঝে? কে কাকে বুঝতে চায়?
আমি ওকে বুঝতে চেষ্টা করি, ও সেটা বুঝতে পারে। তাই ও আমার কাছেই মনের কথা বলতে আসে। কিন্তু নিত্য নতুন এই প্রেমিকই বা ও জোটায় কোথা থেকে?
সেই প্রশ্নই করেন অনামিকা দেবী।
শম্পা একগাল হেসে বলে, ও ঠিক জুটে যায়। একসঙ্গে দুটো তিনটে এসেই ভিড় করে কত সময়, আর এ তো এখন আমার ভেকেন্সি চলছিল! তোমরা সেই যে বল না, রতনে রতন চেনে, সেই রকম আর কি!।
অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, তা নতুন রতনটি বোধ হয় কারখানার কুটিটুলি হবে?
শম্পা ভুরু কুঁচকে বলে, হঠাৎ এ সন্দেহ করলে যে? শুনেছো বুঝি কিছু?
শুনতে যাবো কোথায়, অনুমান করছি। পছন্দর ক্রমোন্নতি দেখছি কিনা।
শম্পা আরো একগাল হেসে বলে, তোমার অনুমান সত্য। হবেই তো। লেখিকা যে! সত্যি, কারখানাতেই কাজ করে। এণ্টালিতে একটা লোহার যন্ত্রপাতির কারখানা আছে, তারই অ্যাসিসটেন্ট ফোরম্যান। বেশ একখানা কংক্রাট চেহারা, দিব্যি একটি বন্য-বর্বর বন্য-বর্বর ভাব আছে–
বন্য-বর্বর বন্য-বর্বর ভাব আছে!
বাঃ, অবাক হচ্ছ কেন? থাকে না কারো কারো?
অনামিকা দেবী হতাশ গলায় বলেন, থাকতে পারে, কিন্তু—
কিন্তুর কিছু নেই পিসি। পুরুষমানুষের পক্ষে ওটাই তো সৌন্দর্য। দেখলে মনে হয় রেগে গেলে দুঘা মেরেও দিতে পারবে। নিদেনপক্ষে বাসন ভাঙবে বিছানা ছিড়বে, বইপত্তরকে ফুটবল করে স্যুট করবে, হয়তো আমাকেও–।
চমৎকার! শুনে মোহিত হয়ে যাচ্ছি! এ নিধিটিকে পেলে কোথায়?
সে এক নাটক, বুঝলে পিসি শম্পা চেয়ারের মধ্যে নড়েচড়ে বসে, তাহলে শোনো বুলি—বেগবাগানের ওই মোড়টায় বাস চেঞ্জ করতে নেমেছি, দেখি ওটাও এসে কাছাকাছি দাঁড়ালো। কালিঝুলি মাখা নীল প্যান্ট আর খাকি শার্ট পরা, মাথার চুল স্রেফ কদমছাট, মুখটা নিগ্রো প্যাটার্নের, বেঁটেখাটো মুণ্ডবা-মুগুর গড়ন, রংটা ছাতার কাপড়ের কাছাকাছি। ভারী ইণ্টারেস্টিং লাগলো। অনিমেষ নয়নে তাকিয়েই থাকলাম যতক্ষণ না বাস এলো। আর দেখি না আমার ওই তাকানো দেখে সে পাজীটাও ড্যাবড্যাব করে তাকাতে শুরু করেছে। ওমা তারপর কিনা একই বাসে উঠলো! বোঝ ফন্দী। উঠে একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে বলে কিনা, অমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন যে? চিড়িয়াখানার জন্তু দেখছিলেন নাকি?…শুনে মনটা যেন আহ্লাদে লাফিয়ে উঠলো। গলার আওয়াজ কী! যেন সত্যি চিড়িয়াখানার বন্দী বাঘের হুঙ্কার! ওই একটি কথা শুনেই মনে হলো এমন একখানা প্রাণীকে লটকে সুখ আছে।…ব্যস, চেষ্টায় লেগে গেলাম!
চেষ্টায় লেগে গেলাম!
অনামিকা দেবী ওর মুখের দিকে তাকান। ছলা-কলার মুখ নয়, নির্ভেজাল মুখ অথচ অবলীলায় কী না বলে চলেছে! এযাবৎকাল ওর চুলগুলো খাটো করে ছাঁটা ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সেই চুল দিয়েই, কোন অলৌকিক উপায়ে কে জানে, মাথার মাঝখানে চুড়ো করে খোঁপা বেঁধেছে, আর সেই খোঁপাটার জন্যে ওর চেহারাটা একদম বদলে গেছে।
ওকে যেন একটা অহঙ্কারী মেয়ের মতো দেখতে লাগছে।
অনামিকা দেবীর হঠাৎ তার মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল।
অনেক চুল ছিল মার। আর গরমের দুপুরে যখন চুড়ো করে মাথার ওপর বেঁধে রাখতেন, অনেকটা এই রকম দেখাতো। অহঙ্কারী-অহঙ্কারী।
শম্পার মুখে অনামিকা দেবীর মায়ের মুখের আদল আছে। অথচ শম্পার বাবার মুখে তার ছায়ামাত্র নেই। আর শম্পার মা তো সম্পূৰ্ণ আলাদা এক পরিবারের মেয়ে। প্রকৃতির এ এক আশ্চর্য রহস্য! সে যে কতো রহস্যের সিন্দুক আগলে বসে নিঃশব্দে আপন কাজ চালিয়ে যায়! হঠাৎ আবার মায়ের মুখের আদল দেখে কি নতুন করে ওকে ভালো লাগলো অনামিকা দেবীর? আর ওকে এই অহেতুক প্রশ্রয় দেবার ওটাও একটা কারণ?
মায়ের মতো মুখ!
মাকে ভাবলেই মার জন্যে ভয়ানক একটা কষ্ট হয় অনামিকা দেবীর।
এখনো হলো।
মনে পড়লো বহির্জগতের জন্যে কী আকুতি ছিল মার! কী আকুলতা ছিল একটু আলোর জগতের টিকিটের জন্যে!
অথচ এরা–
সিগারেটের সেই প্ৰসিদ্ধ বিজ্ঞাপনটিার কথা মনে পড়লো অনামিকা দেবীর.. আপনি জানেন না আপনি কী হারাইতেছেন।
এরা জানে না। এরা কী পাইতেছে।
এদের হাতে যথেচ্ছ বিহারের ছাড়পত্র, এদের হাতে সব দরজার চাবি, সব জগতের টিকিট। এরা ভাবতেও পারে না, সুবৰ্ণলতা কতো শক্ত দেওয়ালের মধ্যে আটকা থেকেছে আর বকুলকে কতো দেওয়াল ভাঙতে হয়েছে, কতো ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে।
এদের কোনোদিন সে পরীক্ষা দিতে হয়নি।…মহাকাল এগিয়ে চলেছে আপনি নিয়মে, সমন্ত প্রতিকূল চিত্র সে প্রবাহে ভাসতে ভাসতে আপনিই অনুকূল হয়ে যাচ্ছে।
বকুলের যে বড়দা তার ছোট বোনকে একবার পাড়ার ছেলের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখলে সৃষ্টি রসাতলে যাচ্ছে ভেবে রাগে দিশেহারা হতেন, সেই দাদার ছেলে আঠারো বছরের মেয়েকে তার বয়-ফ্রেণ্ডদের সঙ্গে পিকনিক করতে ছেড়ে দেয় দীঘায়, পুরীতে, রাঁচিতে, কোলাঘাটে, নেতারহাটে।
সেই মেয়েটা অনামিকা দেবীর নাতনী সম্পর্ক হল না? তা তারই তো উচিত ছিল অনামিকা দেবীর কাছে এসে হেসে হেসে তার বয়-ফ্রেণ্ডদের গল্প করা।
কিন্তু তা সে করে না।
সে মেয়েটা এদিকও মাড়ায় না।
তার মাতৃদেবী আপন পরিমণ্ডলে আত্মস্থ, তুচ্ছ লেখিকা-টেখিকাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তার পিতৃকুলের দিকে-দিগন্তে সকলেই পদস্থ ব্যক্তি, সরকারের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। সেই সমাজটাকেই সে বোঝে ভালো, সেই সমাজের উপযুক্ত করে মানুষ করে তুলছে সে মেয়েকে। মেয়েকে নাচিয়ে মেয়ে করে তুলতে অনেক কাঠখড় পুড়োচ্ছে।
সাহিত্য-টাহিত্য ওদের কাছে একটা অবান্তৱ বস্তু।
সেই মেয়েটা, যার ভালো নাম নাকি সত্যভামা, আর ডাকনাম কৃষ্ণা (মহাভারতের নামগুলিই তো এযুগে লেটেস্ট ফ্যাশান। আর চট করে বোঝাও যায় না বাঙালী কি অবাঙালী), সে যখন গায়ে টানটান শালোয়ার কামিজ চাপিয়ে আর পুরু করে পেণ্ট করা লালচে-লালচে মুখে মোমপালিশ লাগিয়ে হি হি করতে করতে তার একপাল বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে যায়, তখন সে দৃশ্য চোখে পড়লে অনামিকা দেবীর অজ্ঞাতসারেই তাঁর বড়দার মুখটা মনে পড়ে যায়।
সেই বাড়ি, সদর দরজাটাও একই আছে। যে দরজার সামনে ভীম মনোভাব নিয়ে পাহারা দিতো বড়দা, আর বকুল পাশের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফিরলেই চাপা গৰ্জনে প্রশ্ন করতো, কোথায় গিয়েছিলি?
পাশের ওই বাড়িটা ছাড়া যে বকুলের যাবার আর কোনো জায়গা ছিল না, সে কথা জানা সত্ত্বেও বকুলের বড়দা ওই বৃথা প্রশ্নটাই করতেন।
সত্যভামার মা, অলকাদের সেই বড়দার অনেক যত্নে খুঁজে আনা বৌমাটি কি ওই সেকেলে শ্বশুরটিকে উচিত জবাব দেবার জন্যেই ছোট্ট থেকে মেয়েকে হাতিয়ার বানিয়েছেন!
এখন অবশ্য বড়দা মরে বেঁচেছেন। কিন্তু ওই সযত্নে শান দেওয়া হাতিয়ারটি আবার তার নিজের মা-বাপের জন্যেই আরো শাণিত হচ্ছে কিনা কে জানে! সংসারের নিয়মই তো তাই!
সত্যভামা আর শম্পার বয়সের পার্থক্য সামান্যই, এক বাড়িতেই বাস, তবু ওদের মধ্যে ভাব নেই। শম্পা সত্যভামাকে কৃপার দৃষ্টিতে দেখে, সত্যভামা শম্পাকে কৃপার দৃষ্টিতে দেখে।
শম্পার একমাত্র প্রিয় বান্ধবী পিসি।
তাই শম্পা অবলীলায় বলে বসতে পারে, চেষ্টায় লেগে গেলাম!
অনামিকার কড়া গলাকে অবশ্য শম্পা গ্রাহ্য করে না, তবু অনামিকা কড়া গলায় বলে ওঠেন, চেষ্টায় লেগে গেলাম মানে?
এই সেরেছে, তোমায় আবার মানে বোঝাবো কি? কী না জানো তুমি! আর কী না লেখো! চেষ্টায় লেগে গেলাম মানে-কটমট করে তাকিয়ে বললাম, সাহস থাকে তো একসঙ্গে নেমে পড়ুন, জবাব দিচ্ছি!.ব্যস, যেই আমি নেমে পড়লাম, অমনি সেও দুম করে নেমে পড়লো!
নেমে পড়লো?
পড়বে না? শম্পা একটু বিজয়-গৌরবের হাসি হেসে বলে, অলরেডি তো জালে পা আটকে গেছে ততক্ষণে! রাস্তায় নেমে আমি প্রথম বললাম, আপনার কথার জবাব হচ্ছে, চিড়িয়াখানার জীবকে খোলা রাস্তায় ছাড়া দেখলে তাকাবেই মানুষ। কিন্তু আপনি ড্যাবডেবিয়ে তাকাচ্ছিলেন কী করতে শুনি? পাজীটা বললো কিনা, আপনাদের মতো উদ্ভট সাজ করা হাস্যকর জীবদের দেখলেও তাকাবেই মানুষ…তারপর এইরকম কথাবার্তা হলো-আমি বললাম, জানেন এতে আমি অপমানিত বোধ করছি!
ও বললে, তার মানে আপনাদের গায়ের চামড়া আঙুরের খোসার মতো! সত্যি কথা শুনলেই ফোঁসকা পড়ে!
আমি-—জানেন আপনার এই স্পর্ধাজনক উক্তি যদি রাস্তার লোককে ডেকে বলে দিই তো যে যেখানে আছে একযোগে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেবে!
তা জানি। আর সেইখানেই তো আপনাদের বুকের বল! জানেন দোষ যে পক্ষই করুক, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এই পুরুষ জাতটাকেই!
করা হয় তো কুলিগিরি, এতো লম্বা লম্বা কথা শেখা হলো কোথা থেকে?
কড়া গলায় ও বললে, আপনাদের মতো মেয়েদের দেখে দেখে।
বললাম, এতো দেখলেন কোথা থেকে?
বললে, চোখ থাকলেই দেখা যায়। কেউ তো আর হারেমে বাস করে না! তারপর সে অনেক কথা। মোট কথা, শেষ অবধি ভাব হয়ে গেল।… একসঙ্গে চা খেলাম।–আর সেই অবধি–
শম্পা একটু হেসে চুপ করে।
তার সঙ্গেই তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস এখন?
ঘুরে ঠিক নয়। সময় কোথায় তার? কারখানার কাজ, ওভারটাইম খাটে, ওই মাঝে মাঝে ঘুরি। কালিকুলিমাখা জামা পরেই হয়তো কোনো পার্কে-টার্কে এসে বসে পড়ে।
খুব ভাল লাগে, কেমন? বিশেষ করে চেহারার যা বর্ণনা শুনলাম!
শম্পা এবার গম্ভীর হয়।
বলে, চেহারায় কী এসে যায় পিসি! মানুষটা কেমন সেটাই দেখবার বিষয়। এদেশে একসময় পুরুষের চেহারার আদর্শ ছিল কার্তিক ঠাকুর, আর তার সাজ-সজ্জার আদর্শ ছিল লম্বা-কেঁচা ফুলবাবুটি। এখন বরদাস্ত করতে পারো সে চেহারা? মনের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পছন্দও বদলাবে বৈকি।
অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, তা এখন তো ওই বন্য-বন্য বর্বরে-বর্বরে এসে ঠেকেছে! এর পর? পুরো অরণ্যের প্রাণী?
শম্পা উদাস উদাস গলায় বলে, সেটাও অসম্ভব নয়। মানুষ জাতটা দিন দিন যে রকম ভেজাল হয়ে যাচ্ছে!
টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো শম্পা, নির্ঘাত সে।
রিসিভারের মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে অনামিকা চাপা গলায় বলেন, তোকে না বলেছিলাম, তোর ওই বন্ধুদের আমার ফোন নম্বর দিবি না?
বলেছিলে, মানছি সে-কথা। কিন্তু না দিলে ওদের কী গতি হবে সেটা বলো!
কিন্তু ফোন ধরেই হতাশ হয়ে পড়ে শম্পা, সে নয়।
অনামিকা দেবী ততক্ষণে কথা শুরু করে দিয়েছেন, দেখা করতে চান? কারণটা বলুন? লেখা না সভা? দুটোতেই কিন্তু আপাততঃ অপারগ। …কী বললেন? আমাকে সম্বর্ধনা দিতে চান? কী সর্বনাশ! কেন? হঠাৎ কী অপরাধ করে বসলাম? …পাগল হয়েছেন? না না, ও সব ছেলেমানুষী ছাড়ুন।…দেশ চায়? কেন আমার তো এখনো আশী বছর বয়েস হয়নি। আশীর আগে ওসব করতে নেই।… তবু দেখা করতে আসবেন?…দেখুন, আমার বাড়ি আসবেন না এটা বলা শক্ত, কিন্তু এসে কি করবেন? ওসব সঙ সাজ-টাজা আমার দ্বারা হবে না …তা হোক, তবু আসবেন?.. ঠিক আছে, আসুন, তবে কার্ড-ফার্ড ছেপে বসলে কিন্তু তার দায়িত্ব আপনাদের …কী বললেন? নাকতলা শিল্পী সংস্থা?…আচ্ছা ধন্যবাদ।
নামিয়ে রাখলেন।
ক্লান্ত-কান্তু দেখালো তাকে।
এই আবার চলবে খানিক ধন্তাধস্তি, নিতান্ত অভদ্র না হওয়া পর্যন্ত ওদের হাত এড়ানো যাবে না।… কারণ ওই সম্বর্ধনার অন্তরালে অভিসন্ধি নামক যে জন্তুটি অবস্থান করছে, সে তার মুখের গ্রাসটি কি সহজে ছাড়তে রাজী হবে?
দেশ অনামিকা দেবীকে সম্বর্ধনায় ভূষিত করতে চায় বলেই নাকতলা শিল্পী সংস্থা দেশবাসীর মুখপাত্র হয়ে সেই গুরু দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে চাইছে, এমন কথা বিশ্বাস করার মতো ছেলেমানুষ অবশ্যই আর নেই অনামিকা দেবী। তবু যেটুকু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেইটুকু বিশ্বাস করবার ভানই ভালো। সব সত্য উদঘাটিত না করাই বুদ্ধির কাজ। শম্পার নিয়মে সংসারে বাস করা চলে না।
শম্পা বললে, কী গো পিসি, তোমায় সম্বর্ধনা দিতে চায়?
সেই রকম বাসনাই তো জানাচ্ছে। হ্যাঁ, মনে হয় মরবার আগেই শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করে শেষকৃত্য করে দিচ্ছে।
অথচ বেড়েই চলেছে ব্যাপারটা। রোজই তো শুনি এর সম্বর্ধনা তার সম্বর্ধনা।
বাড়বেই তো। দেশকে যে ফাংশানের নেশায় পেয়ে বসেছে। এ নেশা কাটাতে পারে এমন আর কোনো নতুন নেশা না আসা পর্যন্ত চলবে। উত্তরোত্তর বাড়বে।
মুখে বলবেন ওইটুকু, মনে মনে বলবেন, শুধু তো নেশাই নয়, ওই ফাংশানের পিছনে যে অনেক মধুও থাকে। নেশাটা সেই মধুরই। দেশের লোকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা, সরকারের ঘর থেকে এড বার করা, নিদেনপক্ষে নিজেকে পাদপ্রদীপের সামনে তুলে ধরা, সব কিছুর মাধ্যমেই তো ওই ফাংশান। যখন যে উপলক্ষটা পাওয়া যায়।.
আশ্চর্য আগে কী মূল্যবানই মনে হতে এই সব জিনিসগুলো! প্রথম প্রথম যখন তেরোরদুই রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের চৌকাট পার হয়ে বাইরের পৃথিবীর আসরে গিয়ে বসেছেন অনামিকা দেবী, যখন ওই অভিসন্ধি নামের লুকনো জন্তুটার গোঁফের ডগাটি দেখে চিনে ফেলবার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লাভ হয়নি, তখন সব কিছুই কী ভালোই লাগতো। ভাল ভাল কথাগুলো যে কেবলমাত্র কথা একথা বুঝতে বেশ কিছুদিন লেগেছে তার।
তাই বলে কি খাঁটি মানুষ দেখেননি অনামিকা দেবী? ছিছি, একথা বললে পাপ হবে।
উদার দেবোপম চরিত্র সেই মানুষটিকে কি আজও প্রতিদিন প্রণতি জানান না অনামিকা দেবী? যে মানুষটি বকুল নামের মেয়েটাকে হাত ধরে খোলা আকাশের নীচে ডেকে এনেছিলেন, যে মানুষটির স্নেহ অনামিকার একটি পরম সঞ্চয়?
সেই খোলা গলার উদাত্ত স্বর এখনো কানে বাজে, বাবা আপত্তি করবেন? রাগ করবেন? করেন তো চারটি ভাত বেশী করে খাবেন। তুমি আমার সঙ্গে চলো তো। দেখি তোমায় কে কী বলে!..কী আশ্চর্য! অন্যায় কাজ নয়, অন্যের অনিষ্টকর কাজ নয়, কবিকে দেখতে যাবে। এতে এতো ভয়? কতো লোক যাচ্ছে, সমন্ত পৃথিবীর মানুষ আসছে। অথচ দেশের মধ্যে থেকে দেখবে না? দেব-দর্শনে যায় না লোকে? তীর্থস্থানে যায় না? মনে করো তাই যাচ্ছ। আর তাই-ই তো বোলপুর শান্তিনিকেতন আজ ভারতবর্ষের একটি তীর্থ। তাছাড়া তুমি এখন লেখিকা-টেখিকা হচ্ছ, তোমাদের কাছে তো বটেই।
ভরাট উদার সেই গলার স্বর যেন ভয়ের খোলসগুলো খুলে খুলে দিয়েছে।
তবুও কম বাধা কি ঠেলতে হয়েছিল?
প্ৰবোধচন্দ্রের চার দেয়ালের মধ্যে থেকে বেরিয়ে প্ৰবোধচন্দ্রের বয়স্থা কুমারী মেয়ে এক নিতান্ত দূর-আত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একা বেড়াতে গিয়ে দুরাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে আসবে, এর থেকে অনিয়ম পৃথিবীতে আর আছে কিনা, সেটা তো প্ৰবোধচন্দ্রের জানা ছিল না, জানতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে, অনেক বাধার সৃষ্টি করতে হয়েছিল।
তবু বেরিয়ে পড়তে পেরেছিল প্ৰবোধচন্দ্রের বয়স্থ কুমারী মেয়ে। একবার স্ত্রীর তীর্থযাত্ৰা রোধ করতে যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, সে কৌশল করতে সাহস হয়নি প্ৰবোধচন্দ্রের।
হ্যাঁ, বকুলের মা সুবৰ্ণলতা একদা সঙ্গিনী যোগাড় করে কেদারবন্দরীর পথে পা বাড়িয়েছিলেন, প্ৰবোধচন্দ্ৰ সেই বাড়ানো পা-কে ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলেন কেবলমাত্র সামান্য একটু কৌশলের জোরে। কিন্তু সে কৌশল এখন আর প্রয়োগ করা চলে না। এখন আর সাহস হয় না একসঙ্গে অনেক বেশী মাত্রায় জোলাপ খেয়ে নাড়ি ছাড়িয়ে ফেলতে। এখন ভয় হয় সেই চলে যাওয়া নাড়ি আর যদি ফিরে না আসে!
অতএব শেষ পর্যন্ত এ সংসারে সেই ভয়ঙ্কর অনিয়মটা ঘটেছিল। তখনো বকুলের বড়দাদার ছেলে স্কুলের গণ্ডি পার হয় নি, আর বাকি সবই তো কুচোকাচার দল।
তখন এ বাড়িতে আসামী শুধু বকুল নামের মেয়েটা।
বড়দা তাই বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, বাড়িতে তা হলে এই সব স্বেচ্ছাচার চলবে?
প্ৰবোধচন্দ্ৰ কোঁচার খুঁটে চোখ মুছে বলেছিলেন, আমি কে? আমি তো এখন মনিষ্যির বার হয়ে গেছি! তোমরা বড় হয়েছে।–
আমরা আমাদের নিজেদের ঘর শাসন করতে পারি, আপনার ধিঙ্গী মেয়েকে শাসন করতে যাবো কিসের জোরে? তায় আবার তিনি লেখিকা হয়েছেন, পৃষ্ঠবল বেড়েছে!
তবু এসেছিলো শাসন করতে। বড়দা নয়, যে মেজদা সাতে পাঁচে থাকে না, সে।
বলেছিল, বাবার উঁচু মাথাটা এইভাবে হেঁট না করলে হতো না?
বকুল ওর মেজদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল, বাবার এতে মাথা হেঁট হবে, একথা আমি মনে করি না মেজদা। অনেকে তো এমন যায়।
ও মনে কর, না? অনেকে এমন যায়! চমৎকার! তা হলে আর বলার কি আছে? কিন্তু সুবিধের খাতিরে এটাও বোধ হয় ভুলে যাচ্ছে, সকলের বাড়ি সমান নয়। এ বাড়ির রীতিনীতিতে–
বকুলের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।
বকুল সেই হাসিটা সমেতই বলেছিল, সুবিধের খাতিরে অনেকে তো অনেক কিছুই ভুলে যায় মেজদা। একদা এ বাড়িতে গৌরীদানের রীতিও ছিল, এখন কুমারী মেয়ের বয়স পঁচিশে গিয়ে ঠেকলেও অনিয়ম মনে হচ্ছে না। এটাই কি মনে থাকছে সব সময়?
তার মানে বকুল তার এই পঁচিশ বছরের কুমারীত্বের কথা তুলে দাদাকে খোঁটা দিয়েছিল। তার মানে এটা যে বকুলের জেদে ঘটেনি সেটাই বোঝাল বকুল।
ওঃ তাই! মেজদা একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিল, যথাসময়ে বিয়ে দেওয়া হয়নি বলে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র পেয়ে গেছ, সেটা খেয়াল হয়নি! তবে বিয়ের চেষ্টাটা বাবা থাকতে আমাদেব করার কথা নয়। বাবা না থাকলে অবশ্যই–
এবার বকুল জোরে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, দোহাই মেজদা, তোমরা আমার বিয়ে দাওনি বলে ক্ষেপে উঠে যথেচ্ছাচার করতে চাইছি, এতোটা ভেবো না লক্ষ্মীটি! ওই বিয়েটা না হওয়া আমার পক্ষে পরম আশীর্বাদ। সনৎকাকা আগ্রহ করে বললেন, তাই সাহস। জীবনের এ স্বপ্ন যে কখনো সফল হবে, তা কোনো দিন ভাবিনি। যদি তোমাদের বাড়ির একটা মেয়ের জীবনে এমন অঘটন ঘটে——