১২. সাজ্জাদের বাড়ি ফিরতে

সাজ্জাদের বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না।

তার বোনটি সারাক্ষণ কাঁদে। কাঁদে নিঃশব্দে। সাজ্জাদ কিছুই করতে পারে না। শুধু বসে থাকে চুপচাপ। বড়ই একা একা লাগে তার।

মামাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো খবর এখনো এসে পৌঁছায়নি। এখন তারা কী করবে তা বুঝতে পারছে না। দেশের বাড়িতে চলে যাবে? কিন্তু কেউ নেই সেখানে। ছোট্ট একটা বাড়ি ছিল। নদীর ভাঙনে কোথায় চলে গেছে। কে এখন আর জায়গা দেবে? তাছাড়া সাজ্জাদের বোন কোথাও যেতে চায় না। যদি কখনো মানুষটি ফিরে আসে? রাতেরবেলা খুব কম করে হলেও সে দশবার জেগে উঠবে। সাজ্জাদকে ডেকে বলবে–মনে হলো কেউ যেন এসেছে, আয় দরজাটা খুলি।

কেউ না আপা।

খোল না তুই। এরকম করছিস কেন?

দরজা খোলা হয়। কোথাও কিছু নেই। একটা কুকুর দরজার পাশে বসে হাই তুলছে শুধু।

সাজ্জাদের বয়স দ্রুত বেড়ে যেতে লাগল। আমাদের বয়স বাড়ে অভিজ্ঞতার সঙ্গে। সেই সময়ে অত্যন্ত দ্রুত সাজ্জাদের অভিজ্ঞতা বাড়তে লাগল। একদিন সে তার বোনের। দুল নিয়ে বিক্রি করে এল সোনার দোকানে। দোকানি খুব সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছিল তার। দিকে। সরুগলায় বলেছিল, কার গয়না থোকাবাবু?

আমার বড়বোনের।

তাকে বলে এনেছ?

হ্যাঁ। সে নিজেই দিয়েছে।

দেখো খোকাবাবু, তুমি তোমার বোনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসো।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে জিনিসটা তুমি না বলে এনেছ। তুমি যাও, বোনকে নিয়ে আসো। আর শোনো, অন্য দোকানে যাবে না। তুমি ছোট মানুষ, ঝামেলা-টামেলা হবে।

সাজ্জাদ বোনকে নিয়ে এসেছিল। তারপরও দুদিন আসতে হলো। একবার একটি চুড়ি নিয়ে। আরেকবার আংটি নিয়ে। দোকানদার এরপর আর কিছু বলত না। সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিত। শেষবার খুব শান্তগলায় বলল, এভাবে আর কত দিন চলবে? এবার তো অন্য কিছু চেষ্টা করা দরকার।

কী চেষ্টা করব?

একটা কাজ-টাজ করার চেষ্টা কেমন মনে হয়?

কী কাজ?

তাও ঠিক। তোমার যে বয়স তাতে কী কাজ আর করবে? তবে খোকাবাবু দিন আর এরকম থাকবে না। তুমি ভেঙে পড়বে না। দেশের অবস্থা বদলাবে। মানুষের ভাগ্যও বদলাবে। তুমি কি কিছু খাবে?

জি-না।

খাও। একটা কিছু খাও। এই যা তো একটি মিষ্টি আন। বুঝলে খোকাবাবু, এখন তোমার যে দুঃসময় সে দুঃসময় আমাদের সবার। তবে এটা থাকবে না।

এই লোকটির সঙ্গে সাজ্জাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। তার দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সাজ্জাদ উঁকি দিত আর সে হাসিমুখে বলত, আরে থোকাবাবু যে, এসো এসো। দেশের কী খবর বলো তো? ওরে, একটা মিষ্টি দিতে বল তো। অনেক রকম গল্পগুজব হতো তার সঙ্গে। মজার মজার সব গল্প।

বুঝলে থোকাবাবু, গয়নার দোকানের মালিকরা মানুষের দুঃখের গল্পগুলি খুব ভালো জানে। আমরা চোখের সামনে কতজনকে নিঃস্ব হতে দেখি। বড় খারাপ লাগে খোকাবাবু।

সাজ্জাদ বুঝতে পারে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। প্রায়ই তার বোন ভয় পাওয়া গলায় বলে, এখন কী হবে? সাজ্জাদ জবাব দিতে পারে না।

আর কয়েকদিন পর তো ঘরে রান্না হবে না। তখন কী করবি?

আমি কাজ করব।

তোকে কে কাজ দেবে? এবার তোর দুলাভাইয়ের অফিসে বরং যা। দেখ ওরা কী বলে।

ওরা কী বলবে?

জানি না কী বলবে। গিয়ে দেখ না।

একদিন সাজ্জাদ গেল সেখানে। এবং আশ্চর্য, লোকগুলি খুবই যত্ন করল তাকে। বারিন বাবু বলে এক ভদ্রলোক বললেন, তুমি চিন্তা করবে না। এই কারখানাতেই তোমার একটা ব্যবস্থা করব। পড়াশোনা যা করছিলে তা-ই করবে, অবসর সময়ে কাজ শিখবে। ফেরার সময় বারিন বাবু বললেন, তোমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে একবার পঞ্চাশ টাকা ধার করেছিলাম, সেটা ফেরত দেওয়া হয়নি। তোমার কাছে দিয়ে দেই, কেমন? তখন দেখা গেল আরও অনেকেই একই কথা বলছে। কেউ দশ টাকা ধার নিয়েছিল। কেউ কুড়ি টাকা।

সাজ্জাদের মনে হলো লোকগুলি মিথ্যা কথা বলছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা এমন মধুর হয় কী করে কে জানে। তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

বারিন বাবু তাকে কোলে করে একটি রিকশায় এনে তুলে দিলেন। ভরাট গলায় বললেন, তোমরা কোথায় থাকো জানতাম না। জানলে আরও আগে এসে খোঁজ নিতাম। এখন থেকে খোঁজখব না। তোমার কোনো ভয় নাই।

সাজ্জাদ বাড়ি ফিরে দেখে দাদুমণি ও নীলু বসে আছে তাদের বাসায়। নীলুর মুখ দারুণ হাসিহাসি। এবং আশ্চর্য, বহুদিন পর দেখা গেল তার বোন কাঁদছে না। দাদুমণি বললেন, এই যে সাজ্জাদ বাবু, তুমি কোথায় ছিলে। তোমার জন্যেই বসে আছি। কাপড়চোপড় রেডি করো, সময় নাই।

সাজ্জাদ অবাক হয়ে তাকাল।

তোমরা দুজন এখন থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তোমার বোনকে রাজি করিয়েছি।

সাজ্জাদ কিছু বুঝতে পারল না।

তোমার কোনো সুবিধার জন্য বলছি না। আমার এবং নীলুর সুবিধার জন্যে। নীলু একা একা থাকে। তোমরা থাকলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরাঘুরি করতে পারি। তাই না গো দাদুমণি? নীল যসিমুখে বলল, যা। দাদুমণি বললেন, ঢাকায় আমরা কতাদন থাকতে পারি তা অবশ্যি জানি না। যদি শেখ মুজিব আর ভুট্টোর মধ্যে কথাবার্তায় কোনো ফল না হয় তাহলে ঢাকা ছাড়তে হবে। আমরা সবাই মিলে তখন গ্রামে চলে যাব। নীলগতে আমার একটা বড় বাড়ি আছে। নীলু হাসিমুখে বলল, খুবই সুন্দর বা বাড়ির পাশে একটা ছোট নদী আছে। নদীর নাম সোহাগী।

সাজ্জাদের বোন ইতস্তত করে বলল, ওর দুলাভাই যখন ফিরে এসে দেখবে কেউ নাই তখন?

আমরা এ পাড়ার সবাইকে বলে যাব। তাছাড়া সে আমাদের খুঁজে বের করবে। আমরা তো তাকে কম খোজাখুঁজি করিনি, কী বলো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *